Next
Previous
Showing posts with label পথে প্রান্তরে. Show all posts
0

পথে প্রান্তরে - অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

Posted in


পথে প্রান্তরে


মায়াবী ডুয়ার্সের পথে 
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়


সালটা ২০১১। তখন সবে ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে একটা উত্তেজনা কাজ করছিলো। পরীক্ষা শেষ হলে মূলত সবাই আরামে কাটায়, খেলাধুলো চলে দিনরাত। কিন্তু আমার সে উপায় নেই। আমি ব্যস্ত গোছগাছ করতে। আর আমার থেকেও বেশী ব্যস্ত আমার মা। কারণ ছেলে প্রথম বার স্কুল এক্সকারসানে যাচ্ছে যে, চিন্তা তো হবেই। তাই থেকে থেকেই জিজ্ঞেস করে ' কি রে একা একা থাকতে পারবি তো? ভয় পাবি না তো? ' আর আমি ততই রেগে উঠি। ঐ বয়সে কিছু পারবি না বললে যা হয় আর কি।

এক্সকারসান আমাদের স্কুলে শুরু হয় সুব্রত স্যার আসার পর। রণজিৎ স্যারের তত্ত্বাবধানে আর সুব্রত স্যারের ইচ্ছের নৌকায় চেপে ২০১০ সালে প্রথম এক্সকারসান হয় বিশাখাপত্তনমে। কিন্তু আগে থেকে ঘোরা থাকার কারণে সেবার মা আমাকে যেতে দেয় নি। তো তারপর স্কুল যেতেই শুরু হয় বন্ধুদের সেই বিখ্যাত ডায়লগ 'ভাই কি মিস করলি। যা মস্তি করেছি না! গেলে বুঝতিস।' সবাই সর্বক্ষণ বেড়ানোর কথাতেই মত্ত। আর আমি বোবা শ্রোতার মতো শুনে চলেছি। তখন ই ঠিক করলুম পরের যাই হোক না কেন আমি যাবোই।

সেই যাওয়ার দিন কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়েছে। তাই ব্যস্ততার শেষ নেই। স্কুল থেকে একটা লিস্ট দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো কি কি নিতে হবে। সেই কেনাকাটা চলছে। ওষুধপাতি, শীতের জামা, চাদর সব একে একে নেওয়া হলো। আমার দাদা (জেঠুর ছেলে) আর মা দিনরাত খেটে সব আয়োজন করলো। দাদা একটা ওর বিখ্যাত ওম্ফালুস জ্যাকেট দিয়ে বললো ' ভীষণ ঠান্ডা পড়লে তবেই পরিস এটা। নাহলে পরবি না '। অবশেষে যাওয়ার দিন চলে এলো। ৬ জানুয়ারি সন্ধে ৭ টায় ট্রেন ছিলো। আমি, মা, বাবা আর দাদা রেডি হয়ে নিলাম। বিকেল ৫-৩০ টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছানোর কথা ছিলো। ঠিক ছিলো সবাইকে টিকট ডিস্ট্রিবিউট করে দিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দেওয়া হবে। সেই মতো আমরা ৫ টা নাগাদ ই স্কুলে পৌঁছে গেলাম। প্রথমেই স্যারেরা টিকিট ডিস্ট্রিবিউট করে দিলেন। তারপর আমরা বন্ধুরা আড্ডা গল্পে মেতে উঠলাম। বাকী কিছু কাজ সেরে নিয়ে কিছুক্ষণ পর রনজিৎ স্যার বললেন - 'চল এবার যাওয়া যাক। সবাই লাইন করে আসবি। কেউ লাইন ভাঙবি না। আর সবাইকে একটা বিশেষ স্কুলের নাম লেখা টুপি দেওয়া হবে। সেটা সবার মাথায় যেন থাকে। বোঝা গেছে। এবার লাইন করে আস্তে আস্তে আয় '। ১৬ জন স্যার আর ৬৫জন ছাত্র মিলে আমাদের দল চলতে শুরু করলো। সে এক আলাদা অনুভূতি। পিঠে রুকস্যাক নিয়ে আমরা লাইন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর গোটা হাওড়াবাসী তাকিয়ে দেখছে। নিজেকে ফেলুদা - ফেলুদা মনে হচ্ছিলো। যেন অভিযানে চলেছি। 

স্টেশনে গিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন ৬-৩০ বাজে।
রাকেন্দু স্যার বললেন -' কারোর কিছু কেনার থাকলে কিনে নে। আর কিছুক্ষণ পরেই আমরা ট্রেনে উঠবো। ' আমার সব কেনাই ছিলো। বলে দেওয়া হয়েছিলো খাবার তো দেওয়া হবে কিন্তু ছোটো খাটো কিছু স্ন্যাক্স আর পরিমাণ মতো টাকা পারলে নিয়ে নিতে। আমার সব ই নেওয়া ছিলো। তাই বাবা, দাদা আর মাকে প্রণাম করে ট্রেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসার সময় মায়ের মুখে যে উচ্ছ্বাস টা ছিলো আমি ট্রেনে ওঠার পরেই সেটা হারিয়ে গিয়েছিলো। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম অনেক বার ' কি হলো মা হাসছো না কেন ? ' কিন্তু আজ ভালোই বুঝতে পারি সেই বিষণ্ণতার কারণ। দেখতে দেখতে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলো। বাবা , মা কে জানলা দিয়ে টাটা করতে করতে ট্রেন আস্তে আস্তে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। 
কিছুক্ষণ কাটার পর সুব্রত স্যার এসে বললেন ' যে যার টিকিট নাম্বার অনুযায়ী বার্থে বসে পড়। আর ব্যাগ, জুতো সব সাবধানে রাখিস। আমি পাশের বগি থেকে দেখে আসছি। ' আমাদের সবাই তিন টে বগি মিলিয়ে রিসারভেশান পেয়েছিলাম। সেই অনুযায়ী বসা হলো। স্যার রা ভাগ করে প্রতি বগিতে রইলেন। টেন দ্রুত বেগে এগিয়ে চলেছে। রাত ৯-৩০ নাগাদ আমাদের ডিনার দিয়ে দেওয়া হলো। স্যাররা বললেন 'খুব সকালে পৌঁছাবো আমরা। তো খেয়েই শুয়ে পড়বি। নাহলে ট্রেনে রয়ে যেতে হবে। ' কিন্তু আমাদের মতো আড্ডাপ্রিয় রা একসাথে হলে ঘুমও ভয়ে আসতে চায় না। তাই আড্ডা, লুডো খেলা, চোর পুলিশ চলতে লাগলো। আর এসব করতে করতে রাত ২-৩০ টে বেজে গেলো। আমরা হাসছি, হঠাৎ দেখি রনজিৎ স্যার উঠে এলেন। এসে বললেন ' অনেক হলো, এবার তো শুয়ে পড়। নাহলে শরীর খারাপ করবে। ' আমাদের সবার ফেভারিট স্যার উনি। তাই কথা না বাড়িয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লাম। ভোর ৭-৩০ নাগাদ ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছালো। তাপমাত্রার এতটা ফারাক হবে বোঝা যায়নি। তাই কাঁপতে কাঁপতেই ঝপাঝপ শীতের পোশাক গুলো পরে নিলাম। তারপর ওয়েটিং রুমে যাওয়া হলো। ওভারব্রীজ দিয়ে ওয়েটিং রুমে যেতে যেতেপ্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবাই ফোটো তুলতে ব্যস্ত তখন। কিন্তু আমার সে ইচ্ছে নেই। প্রাণভরে দেখতেই থাকলাম। সৈকত বললো 'কি রে ছবি তুলবি না?' তখন খেয়াল হলো ক্যামেরাটা এনেছি যখন ফাঁকা নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না তাছাড়া দাদা বলে দিয়েছে 'ভালো ভালো প্রচুর ছবি তুলে আনবি।' তাই লেগে পড়লাম।ক্লিক করতে। কিছু ছবি তুলে গিয়ে বসলাম। ততক্ষণে বুক করা গাড়ি চলে এসেছে। জিপ। আমরা একে একে গাড়িতে ব্যাগ তুলতে লাগলাম। মোট ৮ টি গাড়ি ছিলো। আর প্রতি গাড়িতে আট জন করে ছাত্র আর দুজন করে স্যার। সব ব্যাগ উঠে যাওয়ার পর। গাড়ি চলতে শুরু করলো ডুয়ার্সের উদ্দেশ্যে।

আমরা চারজন বসেছিলাম পিছনের সিটে। আর ঋক রা বসেছিলো মাঝের সিটে। যেতে যেতে চারপাশের সবুজ পরিবেশটা মন টাকে সতেজ করে তুলছিলো। আমি আর আর্পণ রাস্তারটার ভিভিও করতে থাকলাম। মাঝে কিছু স্ন্যাক্স ও চলছিলো। দু ঘণ্টা চলার পর আমরা বুক করা হোটেলে এসে পৌঁছালাম। হোটেলের নাম সোনার বাংলা। গিয়ে সেদিন ঘর অ্যালট হলো। প্রতি রুমে চার জন করে। আমরা - আমি, শিবায়ণ, কিঞ্জল আর অর্ণব একসাথে ছিলাম। রুমে গিয়ে একটু বসে স্নান করে নিলাম। জলে স্পর্শ করা মাত্রই সারা শরীরে কারেন্ট বয়ে গেলো। জানতে পারলাম তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি, রাতে আরও কমে যায়। জানুয়ারি মাস কাজেই এটাই স্বাভাবিক। দুপুরবেলা হোটলের ই রেসুরেন্টে একসাথে খাওয়া হলো। তারপর স্যার রা বলবেন ' এখন একটু রেস্ট নিয়ে নে, বিকেলে সাইড সিনে যাওয়া হবে।' গিয়ে রেস্ট নিয়ে ৩-৩০ নাগাদ আমরা বেরোলাম। কারণ তাড়াতাড়ি সূর্য ডোবে, তার আগে ফিরে আসতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে ঘুরতে লাগলাম চারপাশ। ঈশ্বর যেন বড়ো যত্ন করে সাজিয়েছে চারপাশটা। শহরের ঘিঞ্জি আবহাওয়া থেকে দূরে এহেন পরিবেশে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে নিজেকে বেশ বড়ো মনে হচ্ছিলো। ফিরে এলাম তখন ৭-৩০ বাজে। সেদিনকার মতো খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা। কারণ সব্বাই খুব টায়ার্ড ছিলো।



পরের দিন সকালবেলা আমরা বেরিয়ে পড়লাম সুলতানেখোলা আর সামসিং র উদ্দেশ্যে। পৌঁছানোর সাথে সাথেই মন এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করলো। ঠান্ডা হাওয়া বইছে, পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে আর সবুজে ঘেরা জায়গায় আমরা বন্ধুরা একসাথে ছবি তুলতে লাগলাম। 

সবাই একে অপরের সাথে ছবি খুনসুটি চলতে লাগলো আর চললো প্রকৃতিকে প্রাণ ভরে উপভোগ করা। ওখান থেকে আমরা গেলাম তিস্তা নদীর তীরে। কনকনে বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিস্তার বয়ে যাওয়া আপন মনে দেখছিলাম আমি আর পিকরব, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তারপর ২-৩০ নাগাদ ফিরে এলাম হোটেলে। সেদিন রাতে সাঁওতাল নৃত্য পরিবেশনের কথা ছিলো। তো এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আমাদের রুমে সবাই এলো আর আড্ডা শুরু হলো। ৭-৩০ নাগাদ শিল্পীরা চলে এলেন। আমাদের নমস্কার জানিয়ে তারা নাচ শুরু করলেন। কি সুন্দর তালের সেই গান আর নাচ না দেখলে বোঝানো যাবে না। দেখতে দেখতে আমরাও নাচতে শুরু করলাম। বাইরে তখন ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। অনুষ্ঠান শেষ হলো তখন রাত ১১-৩০ টা বাজে। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা। পরের দিন জলদাপাড়া যাওয়ার পালা। 

পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। জঙ্গলের সামনে পৌঁছানোর পর আলাদা সাফারি ভাড়া করা হলো। প্রত্যেক সাফারিতে এক জন করে স্যার আর ৬ জন ছাত্র। চলতে শুরু করলো গাড়ি। আস্তে আস্তে আমরা জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছালাম। প্রথমেই একটা সুন্দর ময়ূর দেখে প্রাণ টা ভরে গেলো। আমি, পিকরব, অর্পণ, শিবায়ণ, শুভদীপ আর দেবকুমার ছিলাম। আর আমাদের সাথে ছিলেন রণবীর স্যার। বায়োলজির স্যার। কাজেই আমাদের সব বোঝাতে বোঝাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন উনি। কিন্তু হঠাৎ ই ঘটলো সেই অঘটন। গাড়ি খারাপ হয়ে গেলো আমাদের। ড্রাইভার বললেন অনেকটা সময় লাগবে। ওদিকে বাকী গাড়ি গুলো অনেক এগিয়ে গেছে। আর জঙ্গলের মধ্যে মোবাইলে টাওয়ার ও পাওয়া যাচ্ছিলো না। স্যার বললেন ' তোরা নেমে আয়। একটু আসে পাশে ঘুরে আসি। এভাবে তো আর বসে থাকা যায় না।' আর ড্রাইভার কে বললেন ' তুমি ঠিক হলে ডেকে নিও। আমরা কাছেই আছি। ' হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যেতেই আমরা দুটো বাইসন দেখতে পেলাম। আর ছবি তুলতে থাকলাম। আর কাছেই নানা গাছপালা দেখতে লাগলাম। ওদিকে স্যারের টেনশান বাড়ছে। গাড়ি ঠিক হচ্ছে না। আমাদের মতো ছয় জন ছাত্র কে নিয়ে তিনি একা। বেলা হয়ে আসছে জঙ্গলের মধ্যে। হঠাৎ রনজিৎ স্যারের ফোন এলো রণবীর স্যারের কাছে ' তোরা কোথায় ? অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে পাচ্ছিলাম না। এখন পেলাম। ' রণবীর স্যার সব ঘটনা বললেন। আমরা ততক্ষণে নানা রকমের পাখি, গাছপালা, পতঙ্গ দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিচ্ছি। এদিকে বেলা হয়ে আসছে। অবশেষে দু - ঘণ্টা পর গাড়ি ঠিক হলো। আস্তে আস্তে আমরা এগোলাম। অনেকটা যাওয়ার পর যেখানে সবাই অপেক্ষা করছিলো সেখানে পৌঁছালাম। সব স্যার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু তখন আমরা বাকীদের কাছে হিরো। অ্যাডভেঞ্চারের নানা গল্প সাতরকম রঙ মিশিয়ে শোনাতে লাগলাম সবাইকে আর সবাই জ্বলতে শুরু করলো। ব্ল্যাক 'প্যান্থার দেখেছি ' এই বিখ্যাত ঢপটাও অনেকে বিশ্বাস করে নিয়েছিলো। মিলিত হওয়ার পর এক জায়াগায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। ওখানে নাকি গন্ডার জল খেতে আসে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর এলেন তিনি। আমরা দূর থেকে দেখলাম তাকে। তারপর যখন হোটেলে ফিরলাম সবার অবস্থাই খুব খারাপ। কোনো রকমে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম।



অবশেষে যাওয়ার দিন চলে এলো। যথারিথী সবার খুব মন খারাপ। বিকেলের ট্রেন। সকাল বেলা চেক আউট করে বেরিয়ে গেলাম আমরা। যাওয়ার আগে হোটেলের কিছু ছবি তুলে নিলাম। ট্রেনে ওঠার পর থেকে আড্ডা শুরু হলো। স্যার কে বললাম 'স্যার শেষ দিন। আজ আর শুতে জোর করবেন না প্লিজ। ' স্যার রাজি হলেন। সারা রাত উদুম আড্ডা চলল। সবাই আমরা এক ই বগিতে সেদিন। রাতে জানা গেলো ট্রেন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লেট যাচ্ছে। তাই সকালের খাবার কিনেই খেতে হলো। হাওড়া স্টেশন পৌঁছালাম তখন বিকেল ৪-৩০। বাবা নিতে এসেছিলো বাইক নিয়ে। স্যার রা দেখা করার পর ই তবে যেতে দিলেন। সব্বাইকে টাটা করে বাবার বাইকে বসে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। আর নিয়ে ফিরলাম বেঁচে থাকার জন্য কিছু সুন্দর ফুলে মোড়া স্মৃতির কোলাজ।
0

পথে প্রান্তরে - শিবাংশু দে

Posted in


পথে প্রান্তরে


নীলমাধব - একটি বিকল্প নিমপুরাণ 
শিবাংশু দে 


নীলমাধব বৃদ্ধ হয়েছেন। নিজে গোলযোগ সইতে পারেন কি না, জানিনা। তবে তাঁকে নিয়ে অভ্রভেদী কোলাহল শুরু হয়েছিলো সেই কবে। উনিশ বছর পরে কায়াপলট হবে দেবতার। তাই গত বছর তিনেক ধরে সাজো সাজো প্রস্তুতি চলেছিলো চারদিকে। পুরীর জগন্নাথদেবের নবকলেবর হলো গত বছর রথযাত্রার সময়। যে শহরের স্থায়ী লোকসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারও নয়, সেখানে পঞ্চাশ লাখ লোক এসে পুণ্য করে গেলেন। কোনও বড়োসড়ো দুর্ঘটনা হলোনা। পণ্ডাসমাজ বনাম ব্যুরোক্রেসি, নানা নাটকনবেল, মুর্গি লড়াই হলো। নবীনবাবুর আশীর্বাদে বাবুরা জয়ী হলেন। জনতাও বাবুদের সঙ্গে ছিলো। একুশ শতকে বসে মধ্যযুগের নিয়ম মেনে চলা পণ্ডারা বিশেষ আমল পেলো না। আসলে এদেশে বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে পণ্ডাসমাজের দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস বেশ পুরোনো। দেবতার নামে বদমায়েশির ভারিশিল্প। এদেশে লোকজন ভালোভাবেই জানেন সে সব। 

রথের মোচ্ছব শেষ হতে হতে পুজোর ভিড়। তার পর কাত্তিক মাস। এই মাসে ওড়িশায় যে কতরকম ধম্মোঅধম্মো'র বোলবালা চলে তার ইয়ত্তা নেই। সে সবও ফুরোলো। তার পর থেকে রথযাত্রা পর্যন্ত চলবে মন্দির সংরক্ষণের কাজ। গর্ভগৃহে পুণ্যার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। অতএব রু-ব-রু তাঁকে দেখতে গেলে আর সময় নেই। রাতের খাবার খেয়ে লিখতে বসেছি, ভদ্রমহিলা এসে বললেন, শুতে যাও। আজ আর রাত দু'টো পর্যন্ত লেখা হবেনা। শুধো'ই , কেন? হলোটা কী? 

-ড্রাইভার কা নিদ জরুরি হ্যাঁয়, 

-ড্রাইভার? কেন? 

-কাল ভোরবেলা গাড়িটা নিয়ে বেরোতে হবে, পুরী যাবো... 

-সে কী, এই তো ঘুরে এলুম... 


মানে, মাসে এক-আধবার তো পুরী'র খেপ হয়েই যায়। হঠাৎ আবার কালকেই... 

- হ্যাঁ, নবকলেবরের পর দেখা হয়নি, এবার বন্ধ হয়ে যাবে, একবার দেখে আসি... 

-সে কী? তোমাকে ডেকেছেন নাকি? 

-না, ডাকেননি... কিন্তু জগন্নাথের প্রতি একটা অন্য ধরণের টান... 


এই দেবতাটির প্রতি তো আমিও 'অন্য' ধরণের আকর্ষণ অনুভব করি। একজন প্রাচীন অনার্য দেবতা। স্রেফ লোকপ্রিয়তার জোরে ব্রাহ্মণ্য প্যান্থিয়নে এত বড়ো একটা জায়গা হাসিল করেছেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা ভার্টিক্যাল, যেখানে বিষ্ণুবাদী আর্য প্রবণতাগুলি তাদের জোর ফলালেও শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রাক ঐতিহাসিক, বনচর, শবরনিষাদদের বিশ্বস্ত দেবকল্পনাটিকে বুলডোজিং করে ফেলতে পারেনি। আর্যদের চিরাচরিত ধাতু বা পাথরের বিগ্রহ তাঁর জন্য নয়। উপজাতিক দেবতাদের জন্য প্রযোজ্য দারুবিগ্রহ। পরাবাস্তব কল্পনাময় সেই রূপায়ণ। যা লিঙ্গ বা মানুষমূর্তি নয়। এমন কি আদি টোটেমভিত্তিক পশু ও মানুষিক অবয়বের মিশ্রণও নয়। থাকার মধ্যে দুটি চোখ। আকাশের মতো, শুধু দেখে যাওয়া। কাজ করার মতো অঙ্গ কিছু নেই। নির্বিকার, নির্বিকল্প, নির্গুণ একজন কৃষ্ণদেবতা, অমাবস্যার মতো কালো। 'অদীক্ষিত, অশিক্ষিত' অনার্যদের সেরিব্রাল কল্পনা, সৃজনের স্বাধিকার। 

পুরাকালে এই জায়গাটার নাম ছিলো মহা উদধি। মানে ভারতভূমির প্রথম সূর্যোদয় নীলাচলের এই সাগর উপকূল থেকেই লোকের চোখে পড়তো। এখনও ভোর হয় হয় এখানে পাঁচটা বাজার আগেই। তবে এই শেষ হেমন্তবেলায় আলো ফুটতে একটু দেরি হয়। তার উপর অঘ্রাণের কুয়াশা সমুদ্রের ঢেউ বেয়ে পশ্চিমে ভেসে আসে। মেঘলা লাগে একটু। ছটা নাগাদ গাড়ি বার করলুম। আমার রসুলগড়ের তাঁবু থেকে জগন্নাথ স্বামীর বাড়ি নতুন বাইপাস দিয়ে ঠিক সাড়ে চুয়াত্তর কিমি। রাস্তার নাম শ্রীজগন্নাথ জাতীয় সড়ক। ছবির মতো চার লেন পথ। একশো কুড়ি-পঁচিশ চললেও গাড়ির ভিতরে কো'ই গল নহি। শুধু ভোর ভোর নতুন গাড়িশিখিয়েরা এখানে চালানো শেখে। তার উপর লিঙ্গরাজের বাহনরা পরমানন্দে রাস্তার উপরেই ঘরবাড়ি বেঁধে জাবর কাটছে। এই সব কেষ্টর জীবদের বাঁচিয়ে চালানো। রাস্তার উল্টোদিক আসা রাশি রাশি দু'চাকা, ট্র্যাক্টর, বালুর লরি, ঘাসবোঝাই সাইকেল, যাত্রীবোঝাই বিশাল বিশাল ভলভো বাস, পরস্পর আড়াআড়ি করে রাস্তা কাঁপিয়ে উড়ে যাচ্ছে। গ্রামের পাশ দিয়ে যাবার সময় সদ্য ঘুমভাঙা লোকজন গামছা সম্বল হয়ে সরকারি রাস্তাকে বাড়ির উঠোন ভেবে এপার ওপার করছে দাঁতন করতে করতে। ছাগল-পাগল, ইশকুলের বাচ্চা, যখন তখন সামনে এসে গেলে, এসব কিছু চাপ তো থাকেই। পুরোনো ডেরাইভারকেও দেখে চালাতে হয়। তাও গাড়ি যখন তিন সংখ্যার স্পিডে চলে। বহুদিন পর ভোরের রোদ গায়ে পড়লো। সঙ্গে ভীমসেনের আসাবরি তোড়ি। শিহর লাগায় হাওয়া, শিহর জাগায় সুর। 

পিপলি, সতশঙ্খ, সাক্ষীগোপাল, দণ্ডসাহি, চন্দনপুর, আগেকার সব মাথাখারাপ ট্র্যাফিক দঙ্গল এখন প্রায় উড়ে পেরিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বটমঙ্গলা মন্দির থেকে রাস্তা রোগা হতে শুরু করে। গায়ের উপর ঘরবাড়ি, অলস'পদ গ্রামীনদের চলাফেরা, তার ভিতর রাস্তা করে অত সকালেও রাশি রাশি আসাযাওয়া। অঠারানালার ট্র্যাফিক আলো থেকে ডানদিকে ঘুরে বড়াদণ্ড, গ্র্যান্ডরোড, রথের পথ, মন্দির চলে যাচ্ছে সটান। যেখানে ইতর লোকজন গাড়ি রাখেন, সেখান থেকে মন্দির অনেকটা পথ। যাঁরা হেঁটে যান না, তাঁদের জন্য রিকশা, অটো, মন্দিরের অরুণধ্বজ পর্যন্ত। মিঠেরোদে হেঁটে যাওয়াই ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু পণ্ডামশাই ফোনে তাড়া করছেন। ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সকালবেলাতেই বিবেকবিরুদ্ধ ডিসিশন নং ১ । রিকশায় যেতে হবে। তবে তাই হোক। 

কথা আছে, আমাদের স্টেশন রোড ব্রাঞ্চের নিচে এসে দাঁড়াতে হবে। সেখান থেকেই ঠাকুরের প্রেরিত পুরুষ আমাদের খুঁজে নিয়ে যাবেন। সেখানেই দাঁড়াই। চারদিকে শত শত সারাভারতের তৃণমূল পুণ্যার্থী। সবাই এই নরম ভোরে নানাভাবে অবিরাম নিষ্ঠীবন বর্ষণ করে চলেছেন তীর্থযাত্রার গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে। একটুক্ষণ পরে অসহ্য বোধ হওয়ায় এগিয়ে যাই অরুণস্তম্ভের কাছে। না, আশেপাশে এখনও কেউ থুতু ফেলা শুরু করেনি। এখান থেকে বোধ হয় ঠাকুরের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পণ্ডামশাই এসে যান। কিন্তু ততোক্ষণে সিংহদুয়ারের সামনে আক্ষরিক অর্থেই প্রায় রথযাত্রার ভিড় লেগে গেছে। যেকোনও বঙ্গীয় ভদ্রলোকের মতো পিছনের দরজা খুঁজি। দক্ষিণদিকের এই দরজাটির নাম ঘোড়াদ্বার'অ। প্রথম পাঁচিল মেঘনাদ পচির-অ, পেরিয়ে কূর্মবেধ'অ। ভিতরে রয়েছে নাকি একশো কুড়িটা মন্দির। সহস্র মানুষের ভিড়ে আলপিন পড়ার জায়গা নেই। উচ্চকিত দেবতার ভোর। মন্দিরের মাঝে মন্দির। গলির মাঝে গলি। ভিক্ষার থেকে ভিক্ষা, প্রত্যাশার থেকে প্রত্যাশা। পাইয়ে দেওয়ার দেবতা এতো হট্টগোলের মাঝখানে দারুব্রহ্ম হয়ে নীরব, নিশ্চুপ। তিনি আর হতচকিত হন'না। প্রায় হাজার বছরের অভ্যেস। 

রাজার নাম ছিলো বিশ্ববসু। তিনি ছিলেন অরণ্যময় নীলাচলে শবর, ব্যাধ, নিষাদ'দের রাজা। তাঁর একজন আরাধ্য দেবতা ছিলেন নীলমাধব। এই দেবতার মূল নাম 'কিতুং'। বিশ্ববসু নিজে অনার্য, প্রজারাও অনার্য। পাথর বা ধাতুমূর্তিতে দেবতাকে কল্পনা করেন না তাঁরা। বনের কাঠই তাঁদের জীবন, দেবতাও কাঠের। দেবতার গড়নও তাঁদের চিন্তা থেকেই আসে। আর্যদের তৈরি মানুষের মতো চেহারার দেবতারা তাঁদের জন্য ন'ন। পূর্ব উপকূলের স্থানিক, অন্ত্যজ মানুষদের কাছে তাঁর মাহাত্ম্য প্রশ্নহীন। উত্তরপশ্চিম প্রান্তের মলয় বা মালওয়া রাজত্বের আর্যরাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ইচ্ছা করেন পূর্ব উপকূলেও আর্যদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হোক। এই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের একটা পৌরাণিক সন্দর্ভ রয়েছে। যদিও কিংবদন্তীমাত্র, তবু এই রাজার আনুমানিক সময়কালকে যদি স্বীকার করার চেষ্টা করা যায় তবে তা গৌতম বুদ্ধের আগে যাবে। এই রাজা একজন কিরাতবংশীয়, অর্থাৎ ব্যাধকূলের দলপতি ছিলেন বলে মনে করা হয় (আমাদের চণ্ডীমঙ্গল?)। যেহেতু নামটা আর্য, তাই মনে হয় 'ইন্দ্র' হয়তো এই জনগোষ্ঠীর টোটেম ছিলো। গৌতম বুদ্ধের অনেক আগে থেকেই দক্ষিণ ওড়িশা, অর্থাৎ কলিঙ্গদেশে সমৃদ্ধ সভ্যতার উল্লেখ রয়েছে। কারণ 'সম্ভল' রাজপাটেরও (এখনকার সম্বলপুর) ইন্দ্রদ্যুম্নের নামের সঙ্গে সম্পৃক্তি আছে। সম্ভলের যে উল্লেখ মহাভারতে পাওয়া যায় তাতে মনে হয় সেখানে আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের যোগাযোগ বেশ প্রাচীন ব্যাপার। এ হেন রাজামশাই শুরু করার জন্য তিনি বেছে নিলেন অনার্যদের আরাধ্য দেবতা নীলমাধবকে আর্যায়িত করার কাজ। বিদ্যাপতি নামে এক আর্য ব্রাহ্মণকে তিনি নির্দেশ দিলেন সেই অরণ্যপ্রান্তরময় পূর্বদেশে গিয়ে তাঁদের দেবতা নীলমাধবকে খুঁজে বের করার কাজ। নীলমাধব থাকেন গভীর অরণ্যের গোপন গুহায়িত দেবালয়ে। সেখানে বিশ্ববসু তাঁর পূজা করেন। কী করে পাওয়া যাবে সেই দেবতার খোঁজ? চতুর ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি কীভাবে যেন রাজার দুহিতা ললিতাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে ফেলতে সক্ষম হলেন। রাজজামাতার পক্ষে অনার্য দেবতা নীলমাধবের সন্ধান পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেলো। নীলমাধব থেকে দারুব্রহ্ম জগন্নাথ, 'ইন্দ্রদ্যুম্ন' রাজার সময়েই এই নতুন দেবতার কল্পনা করা হয়। যদিও সে সময় অনার্যদের মননে 'ব্রহ্ম' জাতীয় কোনও আর্য ধারণা ছিলো, এ রকমটা বিশ্বাস করা মুশকিল। বস্তুত আর্যদের দেবতা ধাতু বা প্রস্তরনির্মিত হতো। তাই কাঠের বিগ্রহ বা মাটির দেবমূর্তি অনার্যবিশ্বাস সম্ভূত বলেই মনে হয়। সব থেকে বড়ো ব্যাপার জগন্নাথের রূপকল্পনা আর্যদের সমস্ত দেবমূর্তি, গ্রিস বা গান্ধার সব প্রকল্পনা থেকে এত-ই ভিন্ন যে নিঃসন্দেহে জগন্নাথ অনার্য দেবতার প্রতীক। এর থেকেও উল্লেখ্য লক্ষণ যে জগন্নাথের কোনও জাতিবিচার নেই। শ্রমজীবী অনার্যদের মধ্যে শ্রেণীভিত্তিক দেব আরাধনার কোনও প্রচলন ছিলোনা। 

একই সঙ্গে এই সময় থেকেই শুরু হয় ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলের ওড্রদেশে লোকপ্রিয় অনার্য দেবতা নীলমাধব অথবা জগন্নাথকে নিয়ে আর্যদের অধিকার যুদ্ধের ইতিহাস। ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক রাজচরিত্রটি আসলে আর্যদের উপনিবেশবাদের প্রতীক। নীলমাধবের খোঁজ পেতেই রাজা 'তীর্থযাত্রা' (হয়তো যুদ্ধযাত্রাই হবে) করতে ওড্রদেশে এসে উপস্থিত হলেন। কারণ নির্ভীক শবর, নিষাদ অনার্য যোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে মোকাবিলা করে বহিরাগত আর্যদের পক্ষে রাজ্যবিস্তার বেশ দুরূহ কাজ। পরবর্তীকালে মহারাজাধিরাজ অশোক মৌর্য তার সাক্ষী। তার থেকে যদি তাঁদের সর্বমান্য দেবতাকেই আর্যায়িত করে ফেলা যায়, তবে খেলাটা অনায়াসে জিতে নেওয়া যাবে। শবর'রা ইন্দ্রদ্যুম্নকে আসতে দেখে তাঁদের দেবতাকে লুকিয়ে ফেললেন। কোথাও খুঁজে না পেয়ে আবার কিংবদন্তির সূত্রপাত করতে হলো আর্যদের। ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক চরিত্রটিকে সামনে রেখে চিরাচরিত কঠোর তপস্যা, দৈববাণী, অশ্বমেধ যজ্ঞ, ভেসে আসা কাঠ, স্বপ্নাদেশের পথ বেয়ে 'জগন্নাথ' দেবের সৃষ্টি হলো আদ্যন্ত আর্যদেবতা বিষ্ণুর রূপকল্প হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজিটা মেরেই দিলেন আর্যরা। ব্রাহ্মণ্যযুগে যেহেতু দেশের পূর্বপ্রান্তে আর্যদের তেমন স্ট্রাক্চার্ড অধ্যাত্মিক পরিকাঠামো ছিলোনা, তারা জগন্নাথের জনপ্রিয়তাকে ট্রোজান ঘোড়ার মতো ব্যবহার করে তাঁকে বিষ্ণুর রূপান্তর হিসেবে প্রচার করলো। নবম-দশম শতকে, বাংলাদেশের মতো-ই প্রচুর পশ্চিমদেশীয় (পড়ুন কান্যকুব্জীয়) মানুষকে এখানে আমদানি করা হয় গাঙ্গেয় উপত্যকার ব্রাহ্মণ্যধর্মের শিকড় মজবুত করতে। কৃষ্ণবর্ণ দেবতা জগন্নাথের সঙ্গে গৌরবর্ণ বলভদ্র ও সুভদ্রাকে যোজনা করা হলো। যদিও সপ্তম শতক থেকেই ওড্র, উৎকল, কলিঙ্গতে দেবতা হিসেবে শিবের (মূলত কৌম সমাজের দেবতা, আর্যদের আত্তীকৃত) রমরমা, কিন্তু নীলাচলে জগন্নাথকে কেউ টলাতে পারলো না। জনগণেশের চেতনার এত গভীরে এই দেবতার মাহাত্ম্য প্রোথিত রয়েছে যে কূটবুদ্ধি আর্যরা তাঁকে লোপ করতে চেয়ে বিফল হওয়ার পরিবর্তে নিজস্ব দেবতার দলে আত্তীকরণ করে নিলো। সঙ্গে ফাউ হিসেবে অগণিত লোককথা, কিংবদন্তী ইত্যাদি। বাংলায় যাকে বলে 'সিমলেসলি', জগন্নাথ বিষ্ণুর প্রতিরূপ হয়ে গেলেন। অনার্যদের স্বভাবজ কৃষ্ণবর্ণ গুহাবাসী একাকী দারুদেবতা'কে আর্যমতে পারিবারিক অবতারে আনতে গিয়ে নানা সন্দর্ভের আশ্রয়ও নিতে হলো তাঁদের। 'জগন্নাথ' তো এখন 'আর্য' দেবতা। তাঁর জন্য 'বিপুলাকার' মন্দির গড়া হলো। স্বয়ং ব্রহ্মা স্বর্গ থেকে নেমে আশীর্বাদ জানালেন। আর্যকবিরা ত্রেতাযুগ থেকে দ্বাপর পেরিয়ে 'জগন্নাথে'র কিংবদন্তি নিয়ে রচনা করে ফেললেন নানা আখ্যান। ইন্দ্রদ্যুম্নের যজ্ঞাগ্নি থেকে উদ্ভূত নৃসিংহ দেবতা 'নারায়ণে'র নতুনরূপ কী রকম হবে তা নিয়ে ফরমান জারি করলেন। পরমাত্মা জগন্নাথ আসলে বাসুদেব, সঙ্গী ব্যূহ হবেন বলভদ্র বা সংকর্ষণ বা সহজকথায় পুরাণের বলরাম। তবে নতুন দেবতার শক্তি যোগমায়া, অর্থাৎ সুভদ্রার সঙ্গে কিন্তু জগন্নাথের পুরুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক নয়। সম্পর্কটিতে একটু টুইস্ট রয়েছে। আর্যাবর্তের পুরাণকথা অনুযায়ী সুভদ্রা কৃষ্ণের ভগ্নী। তাই প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মী ও নারায়ণের সম্পর্কের সঙ্গে জগন্নাথ ও সুভদ্রার সম্পর্ক ঠিক সমান্তরাল নয়। সম্ভবতঃ এই বিষয়টি (জগন্নাথ ও তাঁর শক্তি'র মধ্যে নারীপুরুষের স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক) নিয়ে অনার্যদের মধ্যে আপত্তি ছিলো। কারণ নীলমাধব বা জগন্নাথ একেশ্বরবাদের প্রতিভূ। তিনি সবার সৃজনকর্তা। যেকোনও দেবীকল্পনাও বস্তুতঃ তাঁরই সৃষ্টি। তাই সম্পর্কটি স্ত্রীপুরুষের হতে পারেনা কোনও মতেই। আর্যসভ্যতা হয়তো এক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ আপোস করেছিলো। কারণ আর কোনও দেবতার ক্ষেত্রেই এর পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়না। বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রকেও জগন্নাথ পরিকাঠামোর অংশ করে দেওয়া হলো জগন্নাথের 'বিভাব' হিসেবে। স্কন্দপুরাণ বা ব্রহ্মপুরাণ জাতীয় মধ্যপর্বের পুরাণগুলিতে জগন্নাথ সংক্রান্ত এই জাতীয় ডিসকোর্সগুলি পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে সরলাদাস, জগন্নাথদাস, বলরামদাস প্রমুখ পণ্ডিতের নানা লেখায় জগন্নাথ কাল্ট গড়ে ওঠার একটা রূপরেখা পাওয়া যায়। দু'টো ঘটনা, ১৫০১ সালে শ্রীচৈতন্যের পুরী আগমন এবং ১৫৮৬ সালে মুসলিম শাসনের পত্তন, ওড়িশায় জগন্নাথকেন্দ্রিক মন্থনের মেরুকরণ সূচনা করে। 

আরেকটি ক্ষেত্রে আর্যদের আপোস করতে হয়েছিলো। অনার্যরা তাঁদের কল্পিত দেবতার বিগ্রহে কোনও রকম রদবদল স্বীকার করেননি। আর্যদের দেববিগ্রহ নির্মাণ পদ্ধতির কিছু স্বীকৃত ব্যাকরণ ছিলো। প্রথমতঃ মাধ্যম হিসেবে ধাতু বা পাথর ছাড়া আর সবকিছুই অপবিত্র মনে করা হতো। দ্বিতীয়তঃ আকারগত কল্পনার ক্ষেত্রে মানুষী মূর্তির নির্দিষ্ট গঠনটিকে অস্বীকার করা নিষেধ ছিলো। কারণ আর্যদের কল্পিত সব দেবমূর্তিরই নির্দিষ্ট গুণ, কর্ম ও রূপের বাধ্যতা রয়েছে। আধার ও আধেয়'র মধ্যে একটা নির্ধারিত ছন্দ ও নিয়ম কাজ করে। শুধু এদেশে নয়। য়ুরোপের আর্যরা, যেমন গ্রিস বা রোমের দৈবী কল্পনাতেও একই ছাঁচ কাজ করেছে। কিন্তু জগন্নাথ, অনার্যদের বিচারে একটি ঐশী ধারণা, নিছক দেবমূর্তি ন'ন। তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম। তাঁর বাহু, জানু, পদযুগলের প্রয়োজন নেই। রয়েছে শুধু আকাশের মতো দু'টি চোখ। তিনি সব কিছু দেখতে পা'ন। কিন্তু সৃষ্টি-স্থিতি-বিলয়ের কোনও খেলাতেই তাঁর কোনও ভূমিকা নেই। এই মহৎ লক্ষণটি আর্য প্যান্থিয়নের কোনও দেবতাই হাসিল করতে পারেননি। তাঁরা অতি শক্তিমান মানুষী রাজা বা পুরোহিতের প্রতিচ্ছবির ছায়া। ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারার কোনও এলেম তাঁদের নেই। আরও বহু কিছুর মতো 'অসভ্য' অনার্যরা যে আর্যদের সেরিব্রাল আধিপত্যকে নিজস্ব ভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, 'জগন্নাথ' নামের অবধারণাটি তার একটি নিদর্শন। 

জগন্নাথের প্রচলিত রূপটি হয়তো আর্যদের বিশেষ পছন্দ ছিলোনা। তাই একটি গল্পের অবতারণা করতে হয় তাঁদের। ভেসে আসা নিমকাঠটি থেকে দেবমূর্তির রূপ দেবার জন্য পিতামহ ব্রহ্মা'র ইচ্ছায় স্বয়ং বিষ্ণু এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অবতীর্ণ হ'ন। তাঁর শর্ত ছিলো যতদিন না কার্যসমাধা হবে, কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না। বেশ কিছুদিন পরেও যখন কাজটি সম্পূর্ণ হলোনা, তখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পত্নীর অনুরোধে মন্দির কক্ষের দরজা বলপূর্বক খুলে দেখেন সেই ব্রাহ্মণ কোথাও নেই আর কিছু 'অর্ধসমাপ্ত' দারুমূর্তি রাখা আছে। আর্য অহমের একটি প্রকাশ এখানে পাওয়া যাবে। অনার্যদের কল্পিত জগন্নাথবিগ্রহ তাঁদের বিচারে 'অর্ধসমাপ্ত'। কারণ সেটি নান্দনিক বিচারে আর্য উৎকর্ষের নির্দিষ্ট স্তর স্পর্শ করেনা। আসলে এখন বিস্ময় লাগে, কীভাবে জগন্নাথবিগ্রহ স্তরের একটি সার্থক পরাবাস্তব শিল্পবস্তু সেই পুরাকালের শিল্পীদের ধ্যানে রূপ পেয়েছিলো। নিজেদের ধ্যানধারণা থেকে বহুক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদ বাধ্য হয়েছিলো জগন্নাথদেবকে নিজেদের বিষ্ণুকেন্দ্রিক প্যান্থিয়নে সসম্মানে স্থান করে দিতে। তার মূল কারণ দেশের এই প্রান্তে জগন্নাথের প্রশ্নহীন বিপুল লোকপ্রিয়তা। যেভাবে পূর্বভারতে প্রচলিত নানা শিব ও শক্তিভিত্তিক দেবদেবীদের জন্য ব্রাহ্মণ্যধর্মকে দরজা খুলে দিতে হয়েছিলো, সেভাবেই জগন্নাথও বিষ্ণুদেবতার সমার্থক হয়ে আর্য-অনার্য নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের পরিত্রাতা হয়ে ওঠেন। এখনও জগন্নাথদেবের মূলপূজারী অব্রাহ্মণ, সাবর্ণ হিন্দুগোষ্ঠীর বাইরের মানুষ। সত্যিকথা বলতে কি সারা দেশে অন্ত্যজ, নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের জন্য জগন্নাথমন্দিরের মতো এই পর্যায়ে 'শাস্ত্র'সম্মত প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা আর কোথাও দেখিনি। কবি যখন বলেন, "জগন্নাথের জাত যদি নাই, তোদের কেন জাতের বালাই...", একটি আর্ষ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। 

এহেন একজন ইতরের দেবতা, স্রেফ লোকপ্রিয়তার জোরে সর্বগ্রাসী ব্রাহ্মণ্য আনুকূল্যকে জিতে নিয়ে জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্র 'জগতের নাথ'। হয়তো একটু অন্য রকমভাবে ভাবার দাবি তিনি রাখতেই পারেন। ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মজগতে সম্ভবত এটিই একমাত্র সাম্রাজ্য যেখানে মুখ্য পূজারী দৈতপতির দল অনার্য শবরদের বংশধর। জগন্নাথ সৃজনের স্বীকৃতি হিসেবে অনার্যদের রাণী গুন্ডিচা, যিনি লোককথা অনুসারে একাধারে রাজা 'ইন্দ্রদ্যুম্নে'র মহীষী ও জগন্নাথ রূপকল্পের মুখ্য ধাত্রী, তাঁর গৃহে জগন্নাথকে বছরে মাত্র সাতদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হলো। সঙ্গে এল কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের রথযাত্রার আয়োজন। যেহেতু 'ভগবানে'র মা কোনও মানবী হতে পারেন না, তাই তাঁকে মায়ের ভগ্নী মাসিমা হিসেবে সম্বোধন করা হয়। জগন্নাথ ধারণাকে ভ্রূণ থেকে সাবালকত্ব পর্যন্ত প্রতিপালন করার স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মান সমস্ত কৌম অনার্য মায়েদের গরিমান্বিত করে। 'গুন্ডিচা' শব্দটি মনে হয় দ্রাবিড়িয় ভাষা থেকে এসেছে। বীরত্বের সঙ্গে শব্দটির যোগাযোগ আছে। তিনি একজন অনার্য গ্রামদেবী। লোককথায় ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণী। এভাবেই গুন্ডিচা'কে নিয়ে আর্য বৈষ্ণব দুনিয়াকে আপোস করতে হয়েছিলো। এই নারী বা দেবী জগন্নাথের কাছে যাননা, জগন্নাথ তাঁর কাছে আসেন রথে চড়ে। যাবতীয় ঐশী অহংকারকে তাকে রেখে।  

বাল্যকাল থেকেই পুরী'তে আমাদের নিয়মিত আসাযাওয়া। বাইরে থেকে এই দুশো পনেরো ফিট উঁচু বিস্ময়কর মন্দিরটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতুম। গর্ভগৃহের শ্বাসরোধী ভক্তিকুটিল আবহ থেকে চিরকালই দূরে থেকেছি। স্থাপত্যটির প্রতি মুগ্ধতাই যথেষ্ট ছিলো। তার দেবতার বেদীকে স্পর্শ করার কোনও চাপ অনুভব করিনি। পরবর্তীকালে দেখেছি যদিও আমার সঙ্গিনী এই অধমের মতো'ই যাবতীয় বিগ্রহের আশ্বাস থেকে সতত দূরে থাকেন, 'পুজোআচ্চা' জাতীয় ধুলোখেলার থেকেও বহু দূরে। অথচ জগন্নাথের প্রতি তাঁর একটা 'আনুগত্য' চোখে পড়েই যায়। ইতরজনের দেবতার প্রতি টানটি আমি লক্ষ্য করি। অবরে সবরে তিনি জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভগৃহ যেতে চাইলে 'দেহরক্ষী' হিসেবে আমারও বরকন্দাজের ডিউটি। 

তা ঘোড়াদের পেরিয়ে ভিতরে যাওয়া গেলো। প্রথম প্রাচীরের পর দ্বিতীয় প্রাচীরের সিঁড়ি। সেখান থেকে সারা ভারতবর্ষের তুমুল কোলাহল আর গুঁতোগুঁতি। সারি সারি ছোটোবড়ো দেবস্থান, বনস্পতি আর পুণ্যাতুর মানুষের ঘনসন্নিবেশ এড়িয়ে এড়িয়ে পণ্ডামশাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ডানদিকে বিমলা মন্দির রেখে পিছনে মহালক্ষ্মী। গর্ভগৃহের পূর্বদিকের সিঁড়ির কাছে আসতেই গোরা পণ্ডার চিরাচরিত সাবধানবাণী। পার্স বা টাকাপয়সা যেন একেবারে আড়ালে রাখা হয়। যেন পাটনা জংশনে মিছিল ফেরত ভিড় বা মুম্বাই সেন্ট্রাল লাইনের অফিস টাইম লোক্যালের যাত্রীদের প্রতি সতর্কবার্তা। না, পকেটমারদের জন্য এই সাবধানতা নয়। এই দেবতার দালালদের জন্য এই প্রস্তুতি। পণ্ডামশাইয়ের কারুকার্যে সিঁড়িতে বিশেষ ধাক্কা না খেয়েই খাকি পেয়াদার বেষ্টনী পেরিয়ে যাই। পাশে ছড়িদার দাঁড়িয়ে। ছড়ি তুলতেই আমার চাহনি দেখে আর এগোলো না। তারপর শুরু সেই অত্যন্ত বিপজ্জনক জলেকাদায় ছপছপে পিছল ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে গর্ভগৃহে নামার অভিযান। পিছন থেকে ভক্তিমুখর আর্তিকঠোর অন্ধ পল্টনের চাপ। যথেষ্ট পটু না হলে নিজেকে বাঁচিয়ে দেবতার সামনে নিরাপদে ভূমিষ্ট হওয়া দায়। ভিতরে দুয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারা পূর্বজন্মের সুকৃতিমাত্র। চারদিকে ধোঁয়া সম্বল কর্পূরের মশাল প্রদীপ। পায়ের নীচে অতি মলিন জলধারা। এই নির্বাত, নিরালোক, নিঃসীম শব্দপ্রদূষিত, শ্বাসরোধী, পরিত্রাণহীন আবহে দেবতা তাঁর 'রত্নবেদী'তে দাঁড়িয়ে কী ভাবেন, কে জানে?  

সেই অন্ধগৃহের এককোণায় টেনে নিয়ে যান পণ্ডামশাই। সেখান থেকে নাকি কিঞ্চিৎ সুস্থভাবে বিগ্রহ দর্শন করা যাবে। দেবতা তাঁর শাদা সুতি কাপড়ের পোশাকে রয়েছেন সেই মুহূর্তে, তড়পা উত্তরি বা অবকাশবেশে। নবকলেবর হয়তো বা। পূর্বকলেবর থেকে কোনও তফাত নেই। সেটাই তো হবে। অরণ্যের অনার্য সংস্কৃতি দারু ছাড়া অন্য মাধ্যমে তাঁদের দেবতাকে ভাবতে পারেননা। নিম মানুষের জন্য অতীব উপকারী বনস্স্পতি। উপরন্তু তার ভেষজগুণের জন্য কীটের আক্রমণ থেকে অনেকটা সুরক্ষিত। অতএব দেবতার বিগ্রহের মাধ্যম হিসেবে তা শ্রেষ্ঠ বিকল্প। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দেবতার নতুন কলেবর তৈরি হবে। কিন্তু সেই গাছ খোঁজা থেকে শুরু করে মধ্যরাতে ব্রহ্মস্থাপন, অগণন রিচ্যুয়াল, অশ্রান্ত শ্রমদান। ভক্তি, ভালোবাসা, ভয়, অভ্যেস, শিল্প, বাণিজ্য, রাজনীতি, ঈর্ষা, দম্ভ, শ্রেণীস্বার্থ কতকিছু জড়িয়ে আছে এই উদযাপনটির সঙ্গে। দেবতা তো প্রতীক মাত্র। পণ্ডা ডাকেন প্রদক্ষিণ করার জন্য। এক অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার গলিপথে মানুষ রত্নবেদী প্রদক্ষিণ করছে। প্রতিপদে পণ্ডারা দেবতার 'দর্শন' পাইয়ে দেবার মূল্য হিসেবে ভক্তের থেকে আরও অর্থ দাবি করে যাচ্ছে। কসাইয়ের দোকানে দরাদরি থেকে তার কোনও তফাত নেই। বেদী প্রদক্ষিণ করে যখন সেই অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি তখন একটি পণ্ডা এই ক্ষীণ গলিপথটি আটকে বেশ জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে তোলা আদায় করে যাচ্ছে। কিছু না বলে পাশ কাটাই। সে অত্যন্ত উগ্রমূর্তি ধারণ করে অভিসম্পাত করতে থাকে। অভিযোগ করে, সব টাকা মাংসভোজন করে, চিংড়িমাছ আর মদিরার পিছনে ব্যয় করা ভক্তের দল, চুলোয় যাবে। তাকে উৎকোচ না দিলে জগন্নাথ ভক্তকে প্রত্যাখ্যান করবেন। দর্শনের পুণ্য ব্যর্থ হবে। সেদিনের মতো তার সময় বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে সেই মুহূর্তে। বুঝতে পারি, অন্য আর একজন লুব্ধ দেবতার দালালকে জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে অবিলম্বে। আজকের মতো তার রোজগার শেষ হবে। অসম্ভব পিছল ভাঙা সিঁড়ি পেরিয়ে পপাত চ না হয়ে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। বাইরে দিনের আলোয় পৌঁছেই প্রথম যে কথাটা মনে এল, পা দুটো ভালো করে ধুতে হবে। 

প্রিয় কবির প্রিয়তম কবিতার একটি লাইন দেবতাকে ছাপিয়ে বহুক্ষণ ধরে 'মাথার চারিপাশে' ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। "শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে, শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর"। আর কীই বা বলা যাবে? কিন্তু এত এত মানুষ চারদিকে, যারা এই যাত্রার পর নিজেদের ধন্য, তৃপ্ত, চরিতার্থ বোধ করছে। তারা কী ভুলভাল মানুষ? সম্ভবতঃ ও তল্লাটে সেই মুহূর্তে আমিই একমাত্র পোকামাকড় যে এভাবে ভেবে যাচ্ছে। তবে কি 'জগন্নাথ' আমার জন্য ন'ন? 

পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসি। জুতো পরি। পণ্ডামশাইকে দক্ষিণা চুকাই। কলরবমুখর ভিখারিরা, উষ্ণ সৌরভময় গজা'র দোকান, কাঁসার বাসন সকালের নরম রোদে ঝিকমিক করছে, বিভ্রান্ত গ্রামীণ ভক্তসমূহের জাঠা, কোনও এক পণ্ডা মেষপালকের মহিমায় তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে পুণ্যের সন্ধানে। সাইকেল, ষাঁড়, কুকুর আর ঝাঁক ঝাঁক পায়রা। জগন্নাথের দিন গড়াতে শুরু করে আরেকটা বিকেলের দিকে। আরও ফুল, আরও পাতা, শত শত মাটির বাসনে কুটে রাখা ভোগের শাকসব্জি, কাঁধে বাঁক নিয়ে আনন্দবাজারের দিকে ধেয়ে চলেছে অন্যান্য ভোগের সামগ্রী। কোথাও কোনও ফাঁক নেই, ফারাক নেই। জগন্নাথের মন্দির ঘুরে ঘুরে সূর্যের রথ গড়িয়ে যায় পূর্ব থেকে পশ্চিম। 

পাতকীর ছায়াও দীর্ঘ হয়ে আসে।
1

পথে প্রান্তরে - চয়ন

Posted in



পথে প্রান্তরে


রেশম পথের রুদ্ররূপ
চয়ন

যাওয়া হয় কি না হয়, তা নিয়ে সংশয় ছিল। শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনা। টিকিট পাওয়ার অনিশ্চয়তা। কিছু মান, কিছু অভিমান, কিছু ভুল বোঝাবুঝি। শেষমেশ দেখলাম, অক্টোবরের নয় তারিখে সাঁতরাগাছি থেকে নয়াজলপাইগুড়ির যাত্রী পুজো স্পেশাল রেলগাড়িটির সওয়ার হয়েছি আমরা সাড়ে ছয় জন। আমাদের দলের সর্ব কনিষ্ঠা এক অতি পরিশীলিতা ভদ্রমহিলা। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন গান আর বই নিয়ে। আইপ্যাডে ছোটদের ইংরিজি গান, হাতে ইনিড ব্লাইটন। আর কী চাই তাঁর? অন্য কামরায় আছে আরেক বন্ধু পরিবার। তাদের যমজ সন্তান দুটি কনিষ্ঠার বন্ধু এবং আমার প্রাণ। তাঁকে বিনীত ভাবে প্রশ্ন করলাম, "দেখা ক'রে আসবে নকি?" নাকে নেমে আসা চশমাটা ওপরে ঠেলে তুলে সাত বছরের মিষ্টি মুখটা যতটা সম্ভব গম্ভীর ক'রে তিনি বললেন, "যাওয়া যেতে পারে।" তাদের কাছে গিয়ে বসা মাত্র আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। খিলখিল হাসি, ঠেলাঠেলি খেলা, বড়দের নিজেদের মধ্যে খুনশুটি। তিনশিশুর মধ্যে তাদের চয়নকাকুর ভাগ নিয়ে নকল ঝগড়া। দুহাতে আমায় জড়িয়ে ধরে যমজ ভাই বোনের একজন ঘোষণা করল: "যদি একটা ফেইরি আমায় তিনটে উইশ গ্রান্ট করে তো আমি চাইব আমি যেন গ্রেট সিঙ্গার হতে পারি, বোন যেন গ্রেট আর্টিস্ট হয় আর আমার চয়নকাকু যেন ফেমাস্ হয়।" এ.সি.টা বড্ড বেশী ঠাণ্ডা ক'রে ফেলেছে কামরাটা। তাই বোধহয় গলাটা ব্যথা আর চশমার কাচ ঝাপসা। 

নিউজলপাইগুড়ি পৌঁছতে রাত সাড়ে 'নটা। আজ রাত হোটেলে থেকে কাল আমাদের যাত্রা শুরু। সকাল বেলায় গাড়ি হাজির। হাসিখুশি স্বভাবের রাজেশ গান ছাড়া গাড়ি চালাতে পারে না। আর কথায় কথায় ব'লে "পান পরাগ, দিমাগ খারাব।" অর্থ কী, ঈশ্বর জানেন। সাড়ে তিনঘন্টার পথ পেরিয়ে রংলি। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। মঙ্গলদীপ রিসর্ট ঠিক রিসর্ট নয়। এখানে হোম স্টে ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই থাকার। কনিষ্ঠা অতি গম্ভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ক'রে রায় দিলেন, "এটা রিসর্টই নয়। রিসর্টে গার্ডেন থাকে, ফাউন্টেন থাকে, সুইং থাকে, স্লাইড থাকে। চয়নকাকু ওদের নামটা বদলে দিতে বলে দিও।" আশ্বাস দিলাম যে অবশ্যই বলব। পাহাড়ের এক খাঁজে রংলি শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। কুয়াশার গন্ধমাখা বাতাস, সবুজ গাছপালার মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথ, তিরতিরে তন্বী তিস্তা। আমি দেখামাত্র প্রেমে পড়লাম। দু'দিন থাকতে হবে এখানে। অনুমতি পত্র বানানোর ব্যাপার আছে একটা। আমরা যে পথে চলেছি সেখানে চলতে এটা প্রয়োজন। 

সেই অর্থে দেখার কিছু নেই এখানে। তাতে কী? আমরা তো আছি। আমরা, বন্ধুরা। পঁয়ত্রিশ বছর আমরা পরস্পরকে চিনি ঠিকই কিন্তু আরও চেনা বাকী। জমাট আড্ডায় চলল সে চেনাচেনি। আমার মিষ্টুর সঙ্গে গল্প, ঝুপুলের নদী আর ঝর্ণা দেখলেই ছুট মারা, হতাশ দেবাশিসের কাতরোক্তি, " তুমি তো শালা আমার বউয়ের সঙ্গে ঘরে বসে ফস্টিনস্টি করছ। আর ওদিকে তোমার বউ খালি দৌড় মারে। বাজার করব না ওকে সামলাবো? বেঁধে রাখতে হবে ওকে।" এগুলোই প্রাপ্তি। বন্ধু তো আমরা ছিলামই। এখন সখ্যের সঙ্গে যোগ হচ্ছে আত্মিক বন্ধন। নেই নেই করলেও পাহাড়ের বারবার নিজেকে নতুন চেহারায় বদলে নেওয়া দেখছি আমরা। নদীর সঙ্গে হুটোপুটি করছে ছোট্ট দিশুন আর তার ঝুপুল মানি। আমি দু'চোখ ভ'রে দেখছি। 

বিকেলে দেখতে গেলাম অরিতার লেক। পাহাড়ের ওপর প্রাকৃতিক হ্রদ। জলের ওপর সবুজ গাছের ছায়া। ঘন নীল আকাশ। বনের মধ্যে পায়ে চলা পথ ধ'রে মানখিম। বনের একটা তীব্র আদিম গন্ধ আছে। খানিক বাদে শরীর জেগে উঠতে থাকে। নাম না জানা লাল, সাদা বুনো ফুল, টাওয়ারের ওপর থেকে মেঘ জড়ানো পাহাড়ের ছবি তোলা। হামিন্ অস্ত্ ওয়া হামিন্ অস্ত্। তবে কাঁটা ছাড়া গোলাপ হয় না। বনপথ ছেড়ে কনক্রিটের পথে এসে গোড়ালিতে এক শিরশিরে অনুভূতি হওয়াতে জিন্স তুলে দেখি তিনটি প্রমাণ সাইজের জলৌকা রক্তপানে স্ফীতোদর হয়ে আছে। পার্থ আর দেবাশিসেরও একই হাল। মহিলারা হেসে কুটিকুটি। তাঁরা বনপথে চলেননি কি না; সড়ক পথেই ছিলেন। "নুন দে, নুন দে, এই পার্থ, জোঁকের মুখে নুন দিতে হয়;" দেবাশিসের আর্তনাদ। "আমি কি শালা পকেটে ক'রে নুন নিয়ে এসেছি? পারিসও বটে তোরা!" বলতে বলতে এক এক টানে জোঁকগুলো ছাড়িয়ে ফেলে দিল পার্থ। চায়ের দোকানে ব'সে মহিলারা মোমো খেয়ে চলেছেন পরিতোষ সহকারে। এদিকে রক্ত যে বন্ধ হয় না। কাতরভাবে তাঁদের পরামর্শ চাইতে মিষ্টু বলল, "চিনি লাগিয়ে দাও বন্ধ হয়ে যাবে। এই নাও চিনি নিয়ে যাও।" চিনি নিয়ে আসতেই দেবাশিস তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল: "ফ্যাল্! ফেলে দে এখুনি। বারবার ক'রে তোকে বলছি বৌদের কথা শুনবি না।" চিনি ফেলে দেব? তার চেয়ে খেয়েই নিই। চিনি খেতে খেতেই শুনলাম পাশ থেকে এক জ্ঞানী ব্যক্তির উপদেশ: "কিচ্ছু ভাববেন না। রক্ততঞ্চিত হয়ে এখনই বন্ধ হয়ে যাবে।" বাব্বা! ভাগ্যিস বলেননি, "জলৌকাক্রান্ত হননি তো?" 

বিজয়া দশমী। পার্থর মতো জোগাড়ে ছেলে খুব কম আছে। বিজয়ার জন্য মিঠাই, মহুয়া, ঝুপুল, মিষ্টুর সিঁদুর খেলার সিঁদুর থেকে শুরু ক'রে সেই রাতে ভদকার সঙ্গে খাওয়ার জন্য রোস্টেড পর্কের ব্যবস্থা পর্যন্ত - সব ক'রে ফেলল। আর রাতেই নামল বৃষ্টিটা। 

পরদিন জুলুখের পথে রওনা। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি ধরেছে। আমরা পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠছি। সাড়ে নয় হাজার ফুট উঁচুতে জুলুখ। পথে পড়বে হাম্বি পয়েন্ট আর কিউখোলা ঝর্ণা। হাম্বি থেকে পাহাড়ের শিখর দেখতে পাওয়ার কথা। আমরা দেখলাম ঘন মেঘ ক্রমে ভয়াল রূপ নিচ্ছে। ঝর্ণা আসতে আসতেই শুরু হলো মুষল ধারে বৃষ্টি। মিষ্টুর উৎসাহের শেষ নেই। ছাতা মাথায় নেমে গেল ছবি তুলতে। ঝুপুলকেও টেনে নামালো। আমরা গাড়ীতেই থাকলাম। অত উৎসাহ আমাদের নেই। এঁকেবেঁকে উঠছে গাড়ী। এই জুলুখ? এখানে তো রাস্তাই নেই? কাদা মাখা পায়ে চলা পথে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে রাজেশের স্করপিও। ডানহাতে সেনা ছাউনি। পাহাড়ের গায়ে আটকানো পরিচিতিলিপি দেখে ইংরিজি সাহিত্যের ছাত্রী মিষ্টুর উচ্ছ্বাস: The Cloud Warriors? How romantic! বল চয়নদা?" বললাম, "হুঁ, পর্জন্যযোদ্ধা।" ভাগ্যিস কলিকালে নয়নবহ্নি ভস্ম করে না! 

গাড়ি যেখানে থামল সেখান থেকে অন্তত পঞাশ ফুট উঁচুতে এক টিলার ওপর আমাদের পান্থনিবাস। পাশের নালা দিয়ে খর স্রোতে কলকল ধ্বনি তুলে জল ছুটছে। আকাশ ভেঙে পড়ছে যেন মাথার ওপর। রাজেশের অনুরোধ, "শাব থোড়া হাথ লাগাইয়ে না। আদমি জেয়াদা নহি হ্যায় ইঁহা।" পথভোলা পথিকের মতো চারপাশে চাই। কোনওখানে জনমানব নাই। সবাই আমায় ছেড়ে উঠে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি বাক্স ইত্যাদির দায়িত্ত্বে। এ কাজে আমার চেয়ে দক্ষ আর নাকি কেউ নেই বলে সবার ধারণা। কারণ আসার পথে ছাদ থেকে এক বাক্স ছিটকে পড়তে দেখে আমি গাড়ি থামাতে না বললে তা পথেই পড়ে থাকত। বাক্স প্রায় সবই উঠে গেছে। প্লাস্টিক জড়ানো এক বাক্স ধরে ছাতা মাথায় আমি ত্রিভঙ্গমুরারি মূর্তিতে দাঁড়ানো। ধুত্তোর! তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, তা ব'লে ভাবনা করা চলবে না। একাই তুলব এ বাক্স। হে কারিয়াপিরেত, তুমি আমার সহায় হও। তোমার উৎপাটনমন্ত্র আমার কার্যসিদ্ধ করুক: "মারেজ্জুয়ান্ হেঁইয়া / অওর ভি থোড়া হেঁইয়া / পর্বত তোড়ি হেঁইয়া...." গেল গেল! ছাতা উড়ে পাশের নালায়। গায়ে সুঁচের মতো বিঁধছে বৃষ্টি। দাঁতে দাঁতে ঠক ঠক। "ছোড় দিজিয়ে শাহাব। ম্যই লেতা হুঁ।" এতক্ষণ কোথায় ছিলে বৎস বিকশিত দন্ত বাঞ্ছারাম? ওপরে উঠে দেখলাম তিনটি ঘর। অতি আরামপ্রদ। কিন্তু, তখন আমার আর কিছু মাথায় ঢুকছে না। বাক্স ভর্তি জামাকাপড় ভেজা, বই ভেজা, খামে ভরা টাকা ভেজা। "চাপ নিও না" ব'লে ঝুপুল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ভ্যাবলার মত চেয়ে রইলাম। 

সেদিন বেরনোর প্রশ্নই নেই। চিকেন পকৌড়া, চেরি ব্র‍্যাণ্ডি এবং ভদকার অনুপান সহযোগে তুমুল আড্ডা চলল বিকেল থেকে মাঝরাত। খেলা হলো কানেক্ট এবং ট্রুথ অর ডেয়ার। এই খেলার মধ্য দিয়ে চিন্তার বিদ্যুৎ বিনিময় চলল মস্তিষ্ক থেকে মস্তিস্কে। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে আমাদের চরিত্রের এক এক দিক ঝলসে উঠতে লাগল, যা আমরা আগে জানতাম না। খেলা শেষ হওয়ার পর দেখলাম আমি, দেবাশিস, পার্থ হয়ে উঠেছি অত্যাগসহন বন্ধু; মিষ্টু তার বেস্ট ফ্রেণ্ড চয়নদার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে তার নিজের অস্তিত্বের বিস্তার; মহুয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে আমরা শ্রদ্ধা করছি; ঝুপুলের প্রতি এক বাৎসল্য মেশানো স্নেহ অনুভব করছে পার্থ।

পরদিন, বৃষ্টির মধ্যেই বেরনো হলো। নাথাং ভ্যালি, কুপুফ, আঁকাবাঁকা রেশম পথ, এলিফ্যান্ট লেক, পুরনো বাবা মন্দির। এই আমাদের দ্রষ্টব্য। বৃষ্টির পর্দার মধ্য থেকে দেখলাম আবছা এক প্রেত লোকের আলো ঢেকে রেখেছে চারদিক। কুপুফেই যাত্রা শেষ। শীতে কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমাদের। কী দেখছি কিচ্ছু ঠাওর পাচ্ছি না। বাকীরা গাড়ি থেকে নামছে আবার উঠছে। একসময় জানলা দিয়ে দেখলাম ওইই নীচে এক অপার্থিব আবছা আলো আঁধারির মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে এলিফ্যান্ট লেক। পাশে চেয়ে দেখি আমার দিকে সহানুভূতি মাখানো চোখে চেয়ে আছে দুই বিষণ্ণ ইয়াক। আমরা এসে পৌঁছেছি চোদ্দ হাজার ফুট উঁচুতে। এই কুপুফ। আঁকা বাঁকা পথ কুহেলী বিলীন। 

ফেরার পথে বৃষ্টি বাড়তে লাগল। বিকেল পাঁচটা নাগাদ পান্থশালায় ফিরে দেখি বিজলী নেই। মোমবাতির আলোয় আড্ডা বসল। আর ঠিক সেই মুহূর্তটিতেই কাঠের বাড়ির ওপর এসে আছড়ে পড়ল এক প্রবল ঝড়। বাড়ি কেঁপে কেঁপে উঠছে। কাঁপছে মোম বাতির শিখা। বাইরে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। আমার কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। মনে হতে লাগল এই ঘরে আমরা ছাড়াও আরও যেন কারা আছে। আমার শ্রবণ সীমার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস স্বরে কথা কইছে তারা। মনে হতে লাগল বাইরে ছুটে বেরিয়ে আকাশের দিকে বদ্ধ মুঠি তুলে বুড়ো লীয়রের মত চীৎকার ক'রে উঠি, "Blow, winds, and crack your cheeks! rage! blow! / You cataracts and hurricanoes, spout / Till you have drench'd our steeples, drown'd the cocks।" 

পার্থর চিন্তিত স্বরে ঘোর কাটল। "দার্জিলিং এ ধ্বস নেমেছে। শিলিগুড়ি পৌঁছতে আট থেকে দশ ঘন্টা লাগছে। একটা ডিসিশন নিতে হবে এখুনি।" দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছন হলো। যদি পনের তারিখ প্লেন ধরতে হয় তাহলে চোদ্দ তারিখ ইচ্ছাগাঁওতে থাকা চলবে না। চোদ্দ তারিখ শিলিগুড়ি পৌঁছতে হবে যত রাত হোক। ট্যুর অপারেটর কৌশিককে ফোন করে তখনই শিলিগুড়িতে হোটেল ঠিক করে ফেলল পার্ত্থ। রাত কাটলে আমরা রওনা হব। 

পরদিন সকাল দশটায় গাড়ি ছাড়ল রাজেশ। সাড়ে বারোটার মধ্যে রংলি। পথে আশ মিটিয়ে দেখে নিলাম কিউখোলাকে। রংলি থেকে রওনা দিলাম দেড়টায়। গাড়িতে বসে আবার হাসি, গান, দিশুন আর তার মাকে ভূতের গল্প শোনানো। হঠাৎ রাজেশ দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখলাম পাহাড়ি পথে গাড়ির সারি। শম্বুক গতিতে এগিয়ে চলল রাজেশের স্করপিও। দেখলাম ধ্বসের করাল রূপ। বিশাল বিশাল বোল্ডারকে রাস্তার পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়ের গা যেন ছুরি দিয়ে চাঁচা। শিলিগুড়ি পৌঁছলাম রাত দশটায়। ঠিক বারোঘন্টার সফর। 

পরদিন সকাল এগারোটায় যাত্রা। হংকং মার্কেট ঘুরে বাগডোগরা বিমানবন্দর। সিকিউরিটি চেকিং, জিনিসপত্র ওজন, কফি স্যাণ্ডুইচে সময় কেটে গেল দেখতে দেখতে। স্পাইসজেটের কলকাতাগামী বিমানে নিজের নিজের জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিলাম। জানলার বাইরে তাকালাম। প্লেন ছুটতে শুরু করেছে। মিষ্টু আমার দিকে চেয়ে একমুখ হেসে বলল, "কী দারুণ ঘুরলাম আমরা, বল?" আমি একবার মনে মনে সবটা ভেবে নিলাম। নাঃ, প্রাপ্তির পাল্লাটাই বেশী ভারী। আমরা পরিস্কার আবহাওয়া পাইনি বটে কিন্তু দেখেছি প্রকৃতির রুদ্রাণীরূপ; তার সৌন্দর্যও কিছু কম নয়। আমি কল্পনায় পেয়েছি এক অজানা লোকের ইঙ্গিত; আর আমরা সবাই মিলে পেয়েছি নিজেদের। ওর দিকে চেয়ে হেসে মাথা নাড়লাম। প্লেন টেক অফফ্ করল। আর পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে কলকাতা।।





























2

পথে প্রান্তরে - বিবি বসু

Posted in


পথে প্রান্তরে


ভিতরকণিকার নিভৃতে
বিবি বসু


রুটটা আগাগোড়াই ভুল ছিল। অবশ্য জীবনে কোন রুটটাই বা আজ অবধি ঠিকঠাক নিয়েছি আমি! আরে মশাই, এরে কয় ভাগ্য। প্রভিডেন্স হাতে কাঁটা লাগানো চাবুক নিয়ে বসে আছে---আমি তো পিউনিস্য পিউনি মশাই। মানতে হয়, মানতে হয়। নাকিকান্না জুড়তে নেই।

তা যাইহোক, ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্টে নেমে আমার এককালীন ছাত্রী মৌমিতাকে ফোনে ধরলাম। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, সেই সবুজ স্কার্ট পরা, অতীব দুষ্টু, ক্লাসে বসে বকবক করা কিশোরীটি এখন পূর্ণ যুবতী। কলকাতা ছেড়ে পুরীতে বসে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি ট্যুরিজম সার্ভিস কম্পানি চালাচ্ছে। ওর ভরসাতেই ভিতরকণিকা সফর আমার। 

ও মা, ফোনের ওপার থেকে মেয়ে আমায় বলে, ‘একটু দেরি হবে আন্টি, আমি রাস্তায়। বেশি না...এই ঘন্টা খানেক লাগবে। আপনি বসুন না, ভিতরেই বসুন।’

পেট চুঁইচুঁই করছে। মনে মনে মৌমিতার কান ১০০ বার মলে দিয়ে, ক্যাবলার মতন বিমানবন্দরে বসে রইলাম।

আধ ঘন্টা কাটতে আবার ফোনাঘাতে জর্জরিত করি ছেলেমানুষ মেয়েটাকে। 

‘ওরে মা জননী, তুই কতদূর?’ উত্তর আসে, ‘বেশি দূর নয় আন্টি, এই আর মিনিট পঁচিশ। আসলে আমাদের সঙ্গে আরেকজন যিনি যাবেন, তিনি তো আজ ভোরে পুরীতে এসে নামলেন। একটু ফ্রেশ হয়ে নিলেন, তাই বেরোতে দেরি হয়ে গেল। বসুন না, অসুবিধা কি? বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডায় বসুন।’

ভাবলাম বলি, ‘তুই আর ওই আরেকজন ভ্রমণসঙ্গী কচুপোড়া খা। আমি একপেট খিদে নিয়ে এখানে বসে বসে স্যান্ড-আর্ট দেখি’।

আবার ফোন, ‘আন্টি আমি ড্রাইভারকে আপনার নম্বর দিয়ে দিয়েছি, ও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিচ্ছে। আপনি বেরিয়ে গাড়িতে উঠুন। আমরা মাঝপথে উঠছি। শুধু কিলোমিটারটা দেখে নেবেন। নয়ত...’ 

অগত্যা গুটিগুটি পায়ে বিমানবন্দরের শীতল আশ্রয় ছেড়ে রাজপথে নামি। আকাশ তখন সেজেছে বেশ! একটু বাদেই ঝরঝর ঝরবে।

ড্রাইভারটিকে প্রথম দর্শনে বড় সহৃদয় লাগলো। যত্ন করে গাড়িতে বসাল। কিছুদূর নিয়ে গেল। এই যা! কিলোমিটার রীডিং নিতে বলেছিল না মৌমিতা! একদম ভুলে গেছি। তখন গাড়ি থামিয়ে আমার ভয়ঙ্কর হিন্দীতে তাকে জিজ্ঞেস করে নিলাম। উত্তরে কি একখান কইল সে! এখন আর মনে নেই। 

বাপরে, তখন কে জানত এ সফর এত লম্বা! মাঝপথে মৌমিতা উঠল আরেকজনকে নিয়ে। তিনি শুনলাম লেফটেন্যান্ট, কিন্তু অমন গোবেচারা মুখ আমি জন্মেও দেখিনি।

গাড়ি চলল। হাইওয়ের ধারে একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করা গেল। কিঞ্চিৎ শান্ত হলাম। তারপর গাড়ি চলছে তো চলছেই। আরে ভাই, তখন কি আর জানতাম সেই সহৃদয় ড্রাইভার কোনও হোমওয়ার্ক না করেই আমাদের নিয়ে দূর সফরে পাড়ি দিয়েছে! চাঁদবালির অরণ্যনিবাসে যে রাতটুকু কাটানোর ব্যবস্থা, সেটা পর্যন্ত মন দিয়ে শোনেনি। চাঁদবালির পথ না ধরে অন্য পথ ধরেছে! ভুল পথ ধরার পর আমাদের মুখে চাঁদবালি শুনে ড্রাইভারের কি তড়পানি! তার মাতৃভাষায় এমন তড়পাচ্ছে যে মনে হলো সটান কলি থেকে দ্বাপরে ট্রান্সপোর্টেড হলাম। কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে দামামা বাজছে যেন! উফ!

তড়পানি শেষে চালক ধরল এক ভাঙাচোরা রাস্তা। অশীতিপর বৃদ্ধর উচ্চাবচ গালের মতন খানা খন্দ ভরা সে রাস্তা। আমার শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সেদিন দুলতে, দুলতে ঈশান নৈঋত সকল দিক চিনে গেল। মোটামুটি সাড়ে চার ঘন্টার পথ সাড়ে ছয় ঘন্টায় এসে পৌঁছনো গেল। OTDC অরণ্যনিবাসটি বেশ। পরের দিন বোটে বৈতরণী পার হয়ে, ব্রাহ্মণীর জলে ভাসতে ভাসতে, কোলা খাঁড়ি বেয়ে কুমিরের সাথে মোলাকাৎ হবে। তার প্রস্তুতি পূর্ণমাত্রায় চলতে লাগল। 

অরণ্যনিবাস বড় সড়। কিন্তু ওই - সরকারী ব্যবস্থা তো! গিজার চলে না, ইমারশন হিটার দিয়ে যায়। ইন্টারকমের কোনও ব্যবস্থা নেই। পাওয়ার-কাট নৈমিত্তিক। জেনারেটরে এসি চলে না। আর খাওয়া দাওয়া? উহ্য থাক সে কথা। পাঁচফোড়ন দেওয়া ডিমের ডালনা খেয়েছেন কখনও? খান নি? আপনি ভাগ্যবান, মশাই।

আরে দূর! বেড়াতে এসে কে আর আমাকে কালিয়া পোলাও করে দেবে? খুঁতখুঁত করতে নেই।

পরের দিন সকাল সাতটায় OTDর বোট ছাড়ল। ফাইবার বোট। যাত্রা শুরু। বিস্তৃত জল আর দুধারে সবুজের মেলা - কোনও সবুজ বাংলাদেশের পতাকার মতন, কোনও সবুজ আমার সদ্য কেনা জামদানি রঙা, কোনও সবুজ এক্কেবারে জলে ধোয়া। গাছ জলের ধারে নেমে এসে নদীর সাথে ফিসফিসিয়ে গল্প করছে। প্রকৃ্তি যেন ছেঁটে, কেটে বাগান বসিয়েছে জলের ধারে। ব্রাহ্মণী নদীতে বোট ঢোকার আগেই বোট-চালকের চিৎকার, ‘ওই দেখো কুমির, কুমির’।

জলের ধার ঘেঁষে জংলা ঘাস, কেমন দ্বীপের মতন। তার পাশেই মৃদু নড়াচড়া। হঠাৎ মুখ তুললো। ব্রেকফাস্ট করছে। চোয়াল নড়ছে।হায় রে, কিছু মাছ কুমিরের পাকস্থলী হয়ে সোজা অমৃতলোকে যাত্রা করল। রুটটা একটু কষ্টকর বটে, তবু বন্ধনমুক্তি বলে কথা! পরের জন্মে হয়ত হীন মীনগণ আমার মতন বোটে বসে কুমিরের প্রাতরাশ দেখবে!

কি ভাবছেন? আমি তখন মাছ হয়ে ওই কুৎসিত সরীসৃপের পেটে সেঁধবো? সে গুড়ে বালি! আমি ততদিনে ব্রহ্মে লীন... পুনঃজন্ম চক্রে আমায় রাখে কে ডা? আমি রাজ্য সরকারি কর্মচারী। অর্থাৎ কি না সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা। এ কৃচ্ছসাধন বিফলে যায় কখনও?

আর একটু এগোতেই জলে ভেসে উঠল খাঁজকাটা খাঁজকাটা ল্যাজ। আরে আরে, মুখ তোল না বাছা। শুধুই ল্যাজের বাহার দেখাবি? কুমিরই যদি হবি তাহলে শুধু ন্যাজ কেন? সত্যিই তো, শুধু ন্যাজ কেন? বাকি ছায়ায় বোঝা যায় সব মিলিয়ে ১৫ ফুটের কাছাকাছি হবেই সে। টুকি খেলতে খেলতে ভুস!

রসিক চালক বললে, ‘কি দিদি যাবেন না কি কুমিরের সাথে হ্যান্ডশেক করতে?’ বললাম, ‘না ভাই, আমি খাঁটি ভারতীয়, হ্যান্ডশেকে বিশ্বাসী নই। যুক্তকরে অভিবাদন জানাই সবাইকে।’

যেতে যেতে ছায়া শরীর দেখাচ্ছে সব। দূর কুমির, না কুমির-ভূত রে ভাই? তবে নদীতে কুমিরের সংখ্যা প্রায় চীনদেশের জন সংখ্যার মতনই প্রায়।

বোট এসে এক জায়গায় থামল। এবার কোর এরিয়া শুরু। পারমিশান নিতে হবে জঙ্গলে ঢোকার। অনুমতি-পত্র হাতে নিয়ে রসিক সারেঙ, তার আধা বাংলা আর পুরো উড়িয়ায় কি বলল, তা হুবহু তুলে দিচ্ছি -
‘জয় জগন্নাথো, জঙ্গলে কোর এরিয়া শুরু---সবাই ব্যালেঞ্ছ করি বসিবে---নাইলে বোটো হেলি যাবে---নিচে কিছুতে ধাক্কা লাগি গেলে বোটো ভাঙি যাবে---বোটো ডুবি যাবে---তারপরে কি হবে ভাবি লও---আর বল্লুম না।’

জয় মা দুর্গা, এ কোন কুমির-গারদে এসে পড়লাম মা গো। না হয় কলকাতার উৎকট ভিড়ে মিশে থাকতাম। তোমার সিংহ তো মাটির মা--- আমাকে অ্যাট লিস্ট জলখাবার ভাবত না! এখানে যে সব জ্যান্ত কুমিরের দল। হায় হায়! কি করতে এলাম! এ লঞ্চ-চালক বলে কি রে ভাই! কি ক্যাজুয়ালি বলে দিল। 

তা কলকাতাস্হিত মৃণ্ময়ী মা সে প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন কি না জানা নেই, বোট ছাড়ল। এবার একটি খাঁড়ি বেয়ে পথ চলা। হঠাৎ সহকারী চালকের চিৎকার---অই দেখো ডাঙায়। আর যায় কোথায়---লহমায় সব্বাই বোটের একদিকে ক্যামেরা নিয়ে। আমি সেই অমোঘ সাবধানবাণী ভুলি নি। সকলের উল্টো দিকেই বসে রইলাম। কলেবর খাটো নয়। তাই এ যাত্রা ব্যালেন্স রক্ষা হলো। জীবনে প্রথমবার ওবিসিটি-অসুরের গালে চকাম করে একটা চুমু দিলাম মনে মনে। 

ডাঙায় একটি পূর্ণ বয়স্ক সরীসৃপ। আমারই মতন জড়ভড়ত। লোকজন দেখছে তাকে। জঙ্গলের শান্ত, সমাহিত পরিবেশে রীতিমত সুর-ছন্দহীন কলকাকলি। তাও ব্যাটা নড়ে না! সারেঙের আবার সরস মন্তব্য, ‘কি ভাবচ, উঠা প্লাস্টিকের? হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তোমরা আজ আসিবি বলি কাল আমার এই ছেলেটা রাখি গেছে - তোমাদের এই গাইড ছেলেটা গো। একটা মজা দেখবে? এই গাইড তর হাতে রিমোট আছে তো? দেখ ওটি জলে নামিবে।’

এই কথা বলে ইঞ্জিনের শব্দ বন্ধ করে কাছে এগোতেই, চালকের ইন্সট্রাকশন - ‘মুভি কর, মুভি কর। জলে আসবে’। না মিলল না। কুমির তার চারিত্রিক উদাসীনতায় প্রথমটা দৃকপাত করল না, তারপর বোধহয় তার বোধোদয় হলো! মনে পড়ল দাদু শিখিয়েছিল ওই দুপেয়ে আহাম্মকগুলোকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে। 

জলে না এসে কুমির নড়ে, চড়ে নল-খাগড়ার বনে সেঁধিয়ে গেল।চালকের প্রাণখোলা হাসি আর তীক্ষ্ণ মন্তব্য, ‘কি হে গাইড, তোমার রিমোট কি উলটো ছিল?’

ভাসছি তো ভাসছি। দুপাশে গাছ জল ছুঁয়ে ধ্যানে বসেছে... নির্মোক।দু পা যেতে না যেতেই হয় শামুকখোলের, নয় বকের ব্যস্ততা নজরে পড়ার মতন। ডালের উপর থেকে জল-ময়দানে চোখ রাখছে আকাশ-নীল মাছরাঙা। মনে মনে বককে বলছে, ‘দুয়ো, দুয়ো! আমি মাছ পাবো ঠিইইইইইক। তুই শামুক আর কাঁকড়া খেয়ে মর।’

একটা নীলকন্ঠ পাখি ডানা মেলে উড়ল কোন দিশায়! আজ তো সবে মহাসপ্তমী। গুগল ম্যাপ পাখির দিশা গুলিয়ে দিয়েছে, তাই সপ্তমী থেকে ইতিউতি উড়ে ঠিকঠাক পথ খুঁজে চলেছে বেচারা! 

অতঃপর ডাংমালে অবতরণের সময় এল। চুপচাপ চলতে হবে। পথে উঠে দেখি মানুষেরই হাতের কাজ খানিক। নারকেল গাছের সারির মধ্যে দিয়ে মেঠো পথ ধরে হাঁটা। জঙ্গল বেশ পাতলা। গাইডের ঠোঁটে আঙুল হঠাৎ। চোখের ইশারায় পাশের দিকে দেখতে বলে সে। চেয়ে দেখি একপাল চিতল হরিণ প্রায় ‘স্বাগতম’ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে। নিজের মনে ঘুরছে, ফিরছে, আমাদের দেখে পালানোর কোনও লক্ষণই নেই। ওদের মধ্যে একটাই শিঙল, বাকিগুলো ন্যাড়া।হরিণরা আমাদের পাত্তা দিল না বিশেষ। কিন্তু আমরা তো আদেখলা - ছবি তুলেই যাচ্ছি। বোঝা গেল, আমাদের মতন আপদদের সঙ্গে ওদের জান-পহেচান আছে ভালোই।

একটু এগোতে ভিতরকণিকার ভিতরে ট্যুরিস্টদের জন্য গেস্ট-হাউস। ও মা গো! এমন হরিণ-বিছোনো পথের ধারে সরকারী গেস্ট-হাউসগুলো বেবাক ফাঁকা! মৌমিতাকে চেপে ধরি, ‘এই মেয়ে, তুই এখানে থাকার বন্দোবস্ত করিস নি কেন? আহা এমন ছায়া বীথিতল!’ মৌমিতা হতবাক, বলে, ‘অনেক চেষ্টা করেছি আন্টি, বারবার বলেছে সব বুকিং হয়ে গেছে। কোনও অ্যাকোমোডেশন নেই। কিন্তু কি হলো? সবই যে খালি! কোনও গেস্ট নেই। কি টুপি দিল কে জানে বাবা।’

‘তাহলে গেস্টদের কি কুমিরে খেলো?’ সাথে ছিলের এক ডাক্তার বাবু। তিনিও দেখি সরকারী কর্মচারীদের উপর খড়্গহস্ত হয়ে তেড়ে যান আর কি। নিবাসগুলির কর্মীদের ডেকে প্রচুর ধমকাতে থাকেন, ‘কলকাতা ফিরে তোমাদের মজা আমি বের করছি। নেটে সব ফুল দেখাচ্ছে। দু, দুবার ওটিডিসির অফিসে গেছি বুকিং এর জন্য।বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন দেখি সব খালি! আচ্ছা, গেস্ট এলে খাটতে হবে বলে এই ট্রিক করেছো, না? গিয়েই কমপ্লেন করছি। খালি বসে বসে মাইনে পাবার ধান্দা!’

উত্তরে তারা না রাম না গঙ্গা! আর একটু গিয়ে একটা ওয়াটার বডি, বেশ ঘেরা [না না... পাকাপোক্ত কিছু দিয়ে নয়, রীড আর চট দিয়ে ঘেরা]। বড়সড় অক্ষরে লেখা, ‘সাবধান’। ওই জলে বিভিন্ন প্রজাতির কুমিরের সংকরায়ন ঘটানো হয়। প্রশ্বাস বন্ধ করে জায়গাটা পেরিয়ে এলাম।

এবার ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টার। তার পাশে খড় ছাওয়া কি চমৎকার এক গোলঘর! নাম ‘হেঁতাল-হাউস’। হ্যাঁ হ্যাঁ... টুরিস্টদের থাকার জন্যই। কিন্তু ওই যে! সরকারী সম্পত্তিতে আমাদের বিশেষ অধিকার নেই। তাই ভুল তথ্য দিয়ে ওয়েবসাইট ভরিয়ে রাখা হচ্ছে সরকারী দস্তুরের।

ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। প্রথমেই নজর কাড়বে একটি ১৯ ফুট লম্বা কুমিরের কঙ্কাল। জঙ্গলে পাওয়া যায় এমন সকল জন্তুর দেহাংশ সুন্দর করে সাজানো আছে। বিশদে বলছি না। নিচে ছবি দিয়ে দিচ্ছি দেখে শুনে, বুঝে নিন। বেশি বললে আবার অ্যানিমাল কিংডম নিয়ে আমার গভীর জ্ঞানের অহেতুক বিচ্ছুরণ ঘটবে! সেটা কি ঠিক? আমি এতই মডেস্ট যে নিজের বিশেষজ্ঞতার[বিশেষ অজ্ঞতার] পরিচয় দিতে লাজে রাঙা হয়ে উঠি।

দিব্যি হাঁটছি। নড়বড়ে দুই হাঁটু এই ঊনিশটি মণ হাসতে হাসতে বহন করছে। বিদ্রোহ করে সন্ত্রাসবাদের লাল চোখ দেখাচ্ছে না একবারও! সামনে যেতেই অপার বিস্ময়। জাল দিয়ে ঘেরা একটি অলমোস্ট সেক্লুডেড জায়গা। জলের রঙ ভয়ানক ঘোলা। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা ‘গোরি’। এই গোরির বিশদ পরিচয় বাইরে লেখা আছে। সে লাইট-কালার্ড ক্রকোডাইল। ১৯৭৫ সালে জন্মেছে। সাদা কুমির কিন্তু অ্যালবিনো নয়।ভিতরকণিকার একেবারে একান্ত আপন প্রজাতি। এ তো গেল বাইরের কথা। অবাক করা কথা হলো, এ কুমিরণী ইন্দ্রিয়জয়ী। যতবার তাকে সঙ্গী যোগানো হয়েছে, ততবারই পত্রপাঠ বিদায় করেছে উপযুক্ত পাত্রটিকে। একবার সেই সাপোজড টু বি মেট এর সাথে ঘোরতর যুদ্ধে একটা চোখ পর্যন্ত খুইয়ে বসে আছে বেচারি যোগিনী! 

কামজয়ী কুমিরাণীর সাথে মোলাকাৎ আর হলো না। উঁকিঝুকিই সার হলো। এখানেও সেই হ্যোয়াইট অ্যারোগান্স। অগত্যা গুটিগুটি পায়ে বোটানুগমন। সাথে একটি ক্লাস এইটে পড়া ছেলে ছিল। তার মা হঠাৎ একটা কুল-গাছ দেখিয়ে প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষার পরীক্ষকের মতন প্রশ্ন করলেন, ‘বলতো এটা কি গাছ?’

ছেলের চটজলদি উত্তর, ‘সবুজ গাছ।’ মা চোখ গোলগোল করে হাসি চাপতে ব্যস্ত আর আমরা হেসে কুটিপাটি।

বোট চললো আবার। চলছে তো চলছেই। বাতাস কত গল্পই না বলছে কানে কানে! কিছু গল্প দেখি আমারই গল্প। আবার অন্য এক কূলে ভিড়ল তরীখান। চালক জানালে, ‘তিন কিলমিটার হেঁটে যাবো আবার তিন কিলমিটার হেঁটে ফিরব। যারা যারা হাঁটতে পারবে তারাই শুধু নামবে। বাকিরা বোটে বসে থাকো।’

আরে, দূর দূর! তিন আর তিন - ছয় কিলোমিটারই তো। কি আর এমন হাতি-ঘোড়া! স্মার্টলি নেমে পড়ি। বীর বিক্রমে হাঁটতে থাকি। ঝুঁঝকো আঁধার, ঘন ডালপালা। গাছে গাছে জড়াজড়ি। বনপথে আলোছায়া জাফরি কাটা আলপনা। আহা, সীরিনিটি ওয়াজ অলমোস্ট প্যালপেবাল। কোথাও বসবার জো নেই। মাটিতে এসে পড়ল এক ফ্লোরেসেন্ট সবুজ রঙা পোকা। পাশের ঘাসে দুলছে প্রজাপতি। ডানায় টমেটো লাল রঙের কারুকাজ।

নিঝুম বন। ভয়ানক জানোয়ার কিছু দেখলাম না। নিস্তব্ধতায় অনাদিকালের উদাসীন স্বাক্ষর। বাঁ হাতে পড়ল এক পদ্ম পুকুর। পদ্ম-পাতায় জলের ফোঁটা রোদ্দুরের উষ্ণ আদর মেখে উচ্ছ্বল। উদ্বেল জল-ফোঁটারা তাদের উজ্জ্বলতম হাসি হাসছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। হাসিতে ঝরছে চোখ ধাঁধানো হীরে কুচি।

সঙ্গী লেফট্যানেন্টটি দেখি গড়গড় করে পদ্মপুকুরে নেমে যান। কোথা থেকে একটি বছর পনেরোর স্হানীয় ছেলে এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পরিত্রাহি চেঁচায়, ‘কুমির, কুমির’।

নামলে আর রক্ষে ছিল না। আরে টোল ট্যাক্স প্লাজা ওনার আইডেন্টিটি কার্ড দেখে ছেড়ে দিয়েছে বলে কি, কুমিরও ছেড়ে দেবে?

কি সুন্দর সহাবস্থান - জলে কুমির, ডাঙায় মানুষ! আরে এমন একটা পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় একটা বাচ্ছা ছেলে এল কি করে? ভোজবাজি? না। এখানে জঙ্গল বেশ হাল্কা। অদূরে একটা প্রসাধন বিহীন ছোট্ট মন্দির। পায়ে পায়ে এগোই। মন্দির এত নিচু যে মাথা ঝুঁকিয়ে ঢুকতে হয়। বনদুর্গার মন্দির। পাথরের সীলমোহরের উপর পাথরে খোদাই করা মূর্তি। ভিতরে পূজারী কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আর বাইরে দুজন সবল পুরুষ বসে পিতলের থালায় ফল সাজাচ্ছে। একজন কলাপাতার উপর রাশিকৃত নারকেল কুরিয়েই চলেছে।

দুজনেই অতীব মনোযোগী। পাশে একটি শিব মন্দির। আর আছে ওয়াচ টাওয়ার। দশ পা মতন এগোতেই দেখি পুজোর ভোগ রান্না চলছে। বনদুর্গা, তাই নন ভেজ। মাছ আর ভাত রান্না হচ্ছে।

এ কি, জঙ্গল লাগোয়া ধানক্ষেত! ইকোলজিকাল ব্যালেন্সের হদ্দমুদ্দ এক্কেবারে! পথে পড়ে আছে সজারুর কাঁটা। চিনলাম ষাঁড়া গাছ।ষাঁড়া-সুন্দরী। তিনবার বৌ মারা গেলে না কি ষাঁড়া সুন্দরীকে বিয়ে করে তবে চতুর্থবার দার পরিগ্রহ করতে হয়। বাপরে, এক পাপ চার বার! 

এবার ফেরার পথ ধরি। পথে ঝমঝম বৃষ্টি। গাছের পাতা ছাতা হয়ে আশ্রয় দিল। আর যে পা চলে না ফেরার সময়। ভাবছি বসি। কিন্তু কোথায়? কুমির ধরতে এলে টের পাব কিন্তু সাপ কাটতে এলে যে টেরটুকু পাবো না! কিছু না আসুক, কাঠ পিঁপড়ে কি ছেড়ে কথা বলবে!

হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে দুম করে পড়ে যাবো। কি কষ্ট যে হয়েছে ফিরতে কি বলব! কেঁদে ককিয়ে বোটে ফিরে ঘোষণা করলাম, ‘পা জবাব দিয়েছে। আগামীকাল ভুবনেশ্বরের হোটেলে সারাদিন অন্তরীণ থাকব। কোথাও বেরবো না।’

বোট চলল চাঁদবালির উদ্দেশ্যে। সেই সাত সক্কালে বেরিয়ে ঘাটে ভিড়লাম বিকেল সাড়ে চারটের সময়। চোখ থেকে কোমর আনন্দে উন্মনা কিন্তু পা যে বিলাপ করছে! মনের তিন চতুর্থাংশ ভরপুর কিন্তু বাকি এক চতুর্থাংশ আমার পদ যুগলের বিলাপে গলা মেলাচ্ছে। 

জল থেকে ডাঙায় পা দিয়েই আবার বাহনে আসীন হতে হলো। গন্তব্য ভুবনেশ্বর। না এবার আর ওরকম ভয়ঙ্কর রাস্তা দিয়ে নয়, এবারে জাজপুরের রাস্তা ধরল গাড়ি। ফিরতি পথ যুবতীর ত্বকের মতন নিভাঁজ, মসৃণ। কিন্তু পথশ্রমে হাক্লান্ত আমি গাড়িতে এমন ঘুম ঘুমোলাম যে, বার চারেক মাথা ঠুকে গেল, ঠকাস ঠকাস।