Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - কুমকুম বৈদ্য

Posted in








একটা ঝিরঝিরি বৃষ্টির অপেক্ষা করে উপল, একটা ভাঙ্গা ছাতা সম্বল করে বেরিয়ে পড়ে ফুটো পকেটে| উপল মানে আমাদের উপলের অবস্থা বেশ সঙ্গীন, বি.এসি. সি পাশ করার পর এদিক সেদিক দু চার খানা অফিসে কোনটাতে সাড়ে তেরো দিনের বেশি টিকতে পারে নি , প্রত্যেকটাতেই ১৪ দিনের লাঞ্চ টাইম পার করে সে দাসত্ব শৃঙ্গল ঘুচিয়ে পালিয়ে এসেছে| পাড়ায় দুটো বাড়িতে পালা করে সাড়ে তিন জন ছাত্র পড়ায় সে, আসলে দুজনের জন্য পয়সা পায় বাকি দেড়খান সে ফ্রিতে নিজ উদ্যোগে পড়ায়| হাফ ছাত্র হল চঞ্চল, কারণ সে এতটাই চঞ্চল যে মুখে মুখে পড়া ছাড়া, লেখালিখির খাতার সাথে ভাব করানো যায় নি এখনো| এই দেড়া ছাত্রদের আসলে উপলের মত মা বাপের পাট মিটে গেছে, একান্নবর্তী পরিবারে খিদমত খাটে| স্কুলে যাচ্ছে কিনা , খাচ্ছে কিনা খোঁজ নেবার কেউ নেই| এদের জন্যই উপলকে পাড়ায় ফিরতে হয় রোজ রাতে| হ্যাঁ যা বলছিলাম উপলের ভাঙ্গা ছাতা, সেটা তাকে মা কিনে দিয়েছিল ক্লাস সেভেনে, হাতল ভেঙ্গেচুরে খুলে পড়ে গেছে, কাপড়েও বিস্তর ফুটো| যদিও এতদিনে উপল পাখিদের মত ভিজতে অভ্যস্ত , ছাতার প্রয়োজন বিশেষ নেই, খোলাখুলির ঝামেলা বিশেষ করে না, যদি আরো একটা শিক ভেঙ্গে পড়ে| জামা প্যান্টও বেশ পুরোনো| সেও বছর সাতেক আগে লাস্ট কেনা হয়েছিল| এ বিষয়ে উপল বেশ যত্নশীল, জামা যাতে ফিট করে মেপে মেপে খায়, সারা দিনে খাই খরচ সাড়ে তেইশ টাকা|

আপনারা এতক্ষনে ভাবছেন এর সব কিছুতেই আধা. আসলে পুরো হতে গেলে যা যা লাগে তার কোন কিছুতেই উপলের বিশেষ উৎসাহ নাই| তবে বৃষ্টি পড়লে ছাতাটা সে সাথে রাখে, ঝড় বাদলে একটা সঙ্গী নিয়ে বেরোনো ভালো| কত লোকে কত কারণে ঘরছাড়া হয়, উপলের কারণটা বৃষ্টি, বেশ আদেখলে ইচ্ছে বটে| তবে উপন বলে তার বৃষ্টি নেশা, বৃষ্টির জলে ভিজে ন্যাতানো বিড়ি খেতে খেতে সে শহরের দৃশ্য জমায় মাথার মধ্যে আর বিশ্লেষণ করে পরে সময় মত| ও বলে গরু খায় কেন? তুমি আমি বলি খিদে পায় বলে| উপল বলবে উহুঁ হল না গরু খাবার খায় পরে মনের সুখে জাবর কাটবে বলে| জাবর কাটা খুব স্বাস্থ্যকর, চুপচাপ বসে না থেকে তবু একটা কাজ করা তো হয়| তেমনি উপলও জাবর কাটে|

আজ তেমনি একটা নেশা করার দিন| রাত দুটোর সময় যখন তার সাড়ে ছয় নম্বর গার্লফ্রেন্ডের দেওয়া চতুর মুঠোফোন সে দেখেছিল ১ এ.এম এ বৃষ্টি হতে পারে, তখনই তার ঘুমটা আনচান করছিল| সেই ঘুমের বেড়া ডিঙিয়ে ভোর পাঁচটার সময় পিঁচুটি সুদ্ধ চোখে বগলে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে |বাইরে বেরিয়েই তার গায়ে শীত শীত করলো , একটা হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট পরে বেরিয়েছে সে, যার পকেটের একপাশ ছিঁড়ে গেছে| গলির মুখে গোষালদের ভাড়া বাড়ির একটা জানলা খোলা, সে উঁকি মেরে দেখল একটা আধ ল্যাংটা লোক তার সোয়া ল্যাংটা বৌ জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে | বউটা সে অ্যাসিউম করল কারণ এইবাড়িতে যারা ভাড়া থাকে তারা বেশ্যা বাড়ি যেতে পারে, কল গার্ল বাড়িতে ডাকার পয়সা নেই| আচ্ছা ওরা কি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কিছু করে? তারই মতো আরো একজন উঁকি দেবার চেষ্টায় আছে ওদের জানলায়, উপলকে দেখে কেমন সুট করে পাতলা হয়ে গেল| উপল এদিক ওদিক তাকিয়ে উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দা পেরিয়ে সামনে পড়ল লোকটা, তাকে দেখেই হলুদ দাঁত গুলো বের করে চত্রিশপার্টির হাসি দিল| উপল চোখ নাচিয়ে শুধোলো কি মতলব? বলল ,তেমন কিচু নয়, মদন কাল দুটি লুপুর লে এসেচে দাসের দোকান থেয়ে , তাই ভাবলুম আঁকশি গইলে বৌটার পা দিয়ে খুলে নি, বর জড়িয়ে শুয়ে আচে মালুম হবে নি| তা পেলে? কি? নুপূর? ধূস মাগীর পা খালি| মদন কার জন্য নেচে কে জানে, তাও ওর মার নোয়া বেচে নিচে| যাক এ নিতান্ত ছোটলোকি কান্ড কারখানা, বউটার পায়ে লোম আচে কি ? মাথার মধ্যে একটা ফটো উঠে গেল একটা বৌ , তার উরু অবধি কাপড় তুলে বরকে বুকে জড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে আর তার লোমশ একটা পা উপরের দিকে উঠে আচে , তাতে একটা নুপূর|বাহ বেশ একটা জব্বর ওয়েল পেন্টিং আর্ট ধরা পড়েছে| হো হো করে হাসি এল উপলের, তার হাসি দেখে চোরটা আবাক হয়ে পাগল নাকি বলতে বলতে চলে গেল|

তারপর এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে ভোরের জাল বাতাস গায়ে মেখে মেখে উপল এসে দাঁড়ালো ময়দানের কাছে, ভিক্টোরিয়ার পরী আজ ঘুরবে , ওর মন বলছে, ঝোড়ো হাওয়া তেমন নয়, তবে ও জানে ২০ কিলোমিটারের বেশি জোরে হাওয়া হলেই পরী ঘোরে, এ ওর বহু দিনের রিসার্চ, যারা বলে ভিক্টোরিয়ার পরী ঘোরে না তারা শালা আসল খবরটাই রাখে না, বড় বড় বাড়ি তুলে দিয়ে হাওয়া আটকে পরীকে ঘুরতে বললে পরি ঘুরবে না, পরীর ডানায় হাওয়া লাগাতে হয়| ওই একটু ঘুরলো যেন, উপলের চোখদুটো বুজে আসছে, পিঁচুটি আর জল , আগের রাতের আধভাঙ্গা ঘুম সব আষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে উপলকে|পার্কের যে বেঞ্চিটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে মুখ করে আছে বলে উপল জানে, সেইখানে শুয়ে পড়ল| বৃষ্টির জোরটা বাড়ছে, ছাতাটা বুকে জড়িয়ে , জামার হাতা দুটো পরির মতো দুদিকে ছড়িয়ে| বৃষ্টিতে খোলা বেঞ্চ ঘুম কি সুখ! হুড়ো হুড়ি নেই, সারা শরীর ভিজে শিরশির করে|


ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে যখন উঠল বৃষ্টির বেগ তখন অনেক কম, সারা হাত পায়ে জল হাজা উঠেচে, বুপসে গেচে হাত পার চামড়া এইবার চায়ের দোকান খোঁজা দরকার| উপলের পয়সাকড়ি এক্কেবারে যে নেই তা নয় তবে বর্ষার দিনে ও পয়সার ধার ধারে না এটাও একটা নেশা | চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই দোকানি গরম গরম এককাপ আদা দেওয়া চা হাতে ধরিয়ে দিল, বৃষ্টি বাদলে খদ্দের কম, এখন আর উনুন জ্বালায় না , গ্যাসে জ্বলে| আর চা করে ফ্লাস্কে রেখে দেয়| সকালের দিকে এলে তবেই গরম চা মেলে চায়ের দোকানগুলোতে| নির্দিধায় হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে আয়েশ করে খায় উপল, আহ কি দারুণ শান্তি গলার নদীর মতো ঠান্ডা একটা জায়গায় সাবমেরিনের মধ্যেকার ওম উপভোগ করে সে| আর তার পরের ঘটনাটা ভেবে মনে মনে ভুসভুসিয়ে হাসতে থাকে| খেতে খেতে চট করে চায়ের কাগজের কাপ হাতে নিয়ে বৃষ্টির জল ধরতে ধরতে ছুট লাগায়| অমন জোয়ান ছেলের এই কির্তী দেখে দোকানী কিছুটা হতবমম্ভ তারপরে আরে ও ভাই আমার চায়ের দাম, চায়ের দাম বলে চেঁচাতে লাগল , বৃষ্টিতে ভিজে যাবার ভয়ে ধাওয়া করল না|এই যে খুচরো চুরি এতে উপলের একটুও অনুশোচনা নেই| এই যে জল , গ্যাস, চা পাতা সবই প্রকৃতির দান| বিনিময় প্রথার সুবিধার জন্য যে টাকা মানুষে চালু করেছিল তা পৃথিবী শুদ্ধু মানুষের অসুবিধার কারণ| সারা পৃথিবীর কোথায় কি আছে জেনে নিয়ে যে পেরেছে তার দখল নিয়েছে , তারপরে ছবি এঁকে ভাগা ভাগি করে দেশ রাজ্য কিসব বলে ডাকা ডাকি করে মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, পাখিদের মধ্য়ে এইরকম অসভ্যতা নেই|

বৃষ্টিটা এইবার ধরে এসেছে কিন্তু আকাশে কালো মেঘ, দুর্যোগ বলতে যা বলে তাই, রাস্তাঘাটে বিশেষ লোকজন নেই, শহরের ছেলেমেয়েরা জলকাদায় রাস্তায় নামে না নাক সিঁটকোয়| বৃষ্টিতে কলকাতা শহরের একটা জিনিস উপলের জব্বর লাগে বৃষ্টির জল, ড্রেনের জল, মুত সব একাকার , তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ম্যানহোল খোলা থাকলে তলিয়ে যাবে, বেশ মজার ব্যাপার বলে মনে হয়, তবে উপলের সে সৌভাগ্য হয় নি, একবার লেক মার্কেট চত্তরে প্রায় গলা অবধি ডুবে গেছল তবে তাই কিচ্ছু হয় নি| শুধু পরের দু দিন গা চুলকেছিল বেশ লাগে চুলকে চুলকে ছিলে গেলে জ্বালা জ্বালা করে| উপল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিল| খুব জোরে বাজ পড়ল, খুব কাছেই মনে হয়, বাইপাশের ধারে কতগুলো নারকেল গাছের মাথা নেড়া| বাজ পড়লে আর সে গাছে নতুন পাতা গজায় না| নারকেল গাছ দিয়ে যদি খাট বানানো যেত , তাহলে মানুষগুলো ডেকে ডেকে বাজ ফেলত| গাছ কাটা বারণ তো সরকার থেকে| বাজ পড়া নারকেল গাছ একটা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, কেমন নাকের উপর কাঁচকলা দেখাচ্ছে|

হাঁটতে হাঁটতে উপলের জামা শুকাচ্ছে গায়ে, তবে ভালোভাবে শুকাতে পারছে না, বাতাসে জলীয় বাষ্প এত বেশি টানছে না| উপলের গলার কাছটা খুশ খুশ করছে আর হাঁচি আসছে| আহা কদিন আগে পর্যন্ত কেউ হাঁচলে এলাকা ফাঁকা হয়ে যেত|

সামনের মন্দিরে ভোগ বিতরণ করছে, উপল জানে যত বড় বড় মন্দির আছে দক্ষিনেশ্বর থেকে পুরীর মন্দির, ছেলেবেলার মা বাবার সাথে গেছিল সব জায়গায় ভোগ বিক্রি করে, কিনে নিতে হয় পয়সা দিয়ে| দানের পয়সায় হয় না ওদের ভোগ ও বোক্রি করে পুরো দোকান শালা, ভগবানের দোকান| মসজিদের সামনেও দেখেছে জড়ুবুটির দোকান, চার্চের ব্যবস্থা কিছু ভাল ওরা প্রসাদের ধার ধারে না ২৫শে ডিসেম্বর কেক দেয় আর জারা খ্রীষ্টান হয় তাদের অনেক কিছু দেয় চার্চ থেকে|এরা আবার ভক্ত কিনছে|ধর্ম মানেই শালা বেচা কেনার হাট| তবে যে সব মন্দিরে লোক খাওয়ায় তাদের উপল ভালোবাসে, আজ যেমন খিচুড়ি লাবড়া চেটেপুটে খাচ্ছে| মন্দিরের চাতাল ভিজে যাচ্ছে তার জামা প্যান্টের জলে| যাক যদি কিছু ধূলোবালি মরে যায় কাদা হয়ে যায়|

ছোটবেলা মা সকালে বাতাসা আর বিকালে নকুলদানা দিত ঠাকুর কে, দেবার পর পাক্কা ৩ মিনিট উপল পাহারায় থাকত, যদি টিকটিকি চলে যায় সেই ভয়ে, তারপর সেই প্রসাদ উপল পেতো| খাবে যখন উপলই ওর হাতে দিলেই হত, মানুষের শরীরেই তো ভগবান, তাও মা ঠাকুরের সামনে দিত, ঠাকুরের এঁটো হলে প্রসাদ হবে| উপল মাঝে মধ্যে ভাবে প্রায় সে ঈশ্বরের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, তার কোন পিছুটান নেই শুধু মনের ক্যানভাসে এঁকে চলেছে| এই যে মন্দির , একটা কুকুর , পেচ্ছাপ করে দেবে তুলসি তলায়| শুধু এই ছবি তার মন্দির ঘিরে| কুকুরদের ভগবান লাগে না, আর কারোর লাগে না শুধু অসভ্য মানুষের লাগে কেলাকেলি করবার জন্য, হাসি পায় উপলের| রাস্তায় রাস্তায় যারা ফ্যা ফ্যা করে, এরকম বর্ষার দিনে তারা কোথায় যেন সব চলে যায় ছাউনির তলায়|ইলেকট্রিকের তার গুলো শুধু একনাগাড়ে বৃষ্টিতে ভেজে , উপলের ইচ্ছা করে ইলেকট্রিকের তার গলায় জড়িয়ে মরে যায়, কলকাতা শহরটাও তো ওই ভাবে ফাঁসে ঝুলে আছে কতদিন, প্রাণখানি বেরোবো বেরোব করেও বেরাচ্ছে না , উপলেরও যদি ওরকম হয়, গা টা শিরশির করে ওঠে, বেদম জ্বর আসছে মনে হয়, টলমল পায়ে উপল তার পলেস্তরা খসা পুরোনো ঘরে ফরে আসে, আসতেই হয়| আলমারির মাথায় গুঁজে রাখা বাঁশিটিতে ফুঁ পড়ে তার| ঘরের মধ্যে সে বাজিয়েই চলে সন্ধ্যে ছাপিরে রাত , গভীর রাত বাজতেই থাকা, গলিতে তখন সুরের বন্যা ভেসে যাচ্ছে মোড়ের মাথা পর্যন্ত আশ্চর্য সেই সুর| বাঁশি আর বৃষ্টির ঝুগলবন্দিতে ঝিঁ ঝিঁ পোকা যোগাড় দেয়| উপলের পাশে এসে বসে তার মা, গলায় দড়ি দিয়েছিল |আর সেই প্রথম প্রেমিকা, কার ভুলে বিষ খেয়েছিল| ঘুমিয়ে পড়ে উপল, আপাতত মনের সব দরজা বন্ধকরে ঘুম দেবে সে আগামী কদিন , পারলে আর একটা বৃষ্টির আগ অব্ধি
0

গল্প - প্রদীপ ঘটক

Posted in






নারীলোভী বৃষ্টি যেদিন গর্ভবতী মেঘ থেকে ঝড়ে পড়ছিল, তৃণা আমাকে ডেকেছিল। আমি বলেছিলাম , তুমি ঘরেই থাকো। নরম হাতের বেষ্টনীকে আমি প্রেম বলি না। যৌনতা প্রেম নয় তৃণা।


সে ভেবেছিল, বৃষ্টির সাথে সাথে আমার আদর উপভোগ করবে। না, এত পক্ক আমি নই। আমি জানতাম বৃষ্টি আমাকে কিছুই দেবে না। শুধু ফোঁটা ফোঁটা আশ্লেষে জ্বর এনে দেবে।


বালিশ বুকে তৃণার কথা ভাবলেও কখনোই বিবাহ- পূর্ব শয্যাসম্পর্কে আমি বিশ্বাসী নই। তৃণা ভুল বুঝেছিল আমায়। কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু আদর্শচ্যুত হতে পারিনি।


বৃষ্টির জগতে আমি হয়তো বেমানান। তাই বৃষ্টি এলেই জলহীন দেশে দৌড়ে পালাই। তৃণা অন্যকে খুঁজেছিল। সর্বনাশী নেশা তাকে নরকের দিকে টেনেছিল। আমার কথা বোঝেনি।


বৃষ্টি এসে যখন আমাদের ঘিরে ধরত তখন বদনামের ভয়টাও আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতো। আমি মেঘ উঠলেই তৃণার কাছ থেকে দূরে চলে যেতাম একদৌড়ে। তৃণা আমাকে ভীতু বলতো। আমি জানি বৃষ্টির স্বভাবই হল গোপন অভিসারকে পাঁচকান করা। তৃণা বোঝেনি।


তারপর তৃণা হারিয়ে গেছে। তৃণা আজও বৃষ্টি এসেছে। তুমি এস। আমি আজ অনেক সাহসী। কত আর বদনাম দেবে? সতর্ক আজ আমি অনেক। আমাদের মধ্যবর্তী শ্বাসে যাতে বৃষ্টি না প্রবেশ করতে পারে তার জন্য আমি বর্ম পড়েছি।


আজ আমার শূণ্যঘরে বৃষ্টি এসেছে। আমি শুধু তোমাকেই ভাবছি তৃণা। এসো আমার ঘরে।






ReplyForward
0

গল্প - তপন রায়চৌধুরী

Posted in






বিজ্ঞাপন শুরু হয়েছিল প্রায় চারমাস আগে থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দূর্গাপ্রতিমা দর্শন করুন, স্থান সোনালি পার্ক। চলতে ফিরতে, রাস্তাঘাটে, মেট্রো কমপার্টমেন্টে – প্রায় সর্বত্র পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। প্রচারমাধ্যম হিসেবে টিভি, খবরের কাগজও বাদ যায়নি এই বিজ্ঞাপনের আওতা থেকে। ট্রামে-বাসে-ট্রেনে সকলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে এই বিজ্ঞাপন নিয়ে। তার উপর বলিউড একজন সুপারস্টার ট্যুইট করেছেন, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গাপ্রতিমা। সাধারণ মানুষের কাছে এই মানুষটি একেবারে দেবতুল্য। সুতরাং তাঁর মন্তব্য নিঃসন্দেহে এক নিখাদ সত্য। তাই যেতেই হবে, দেখতেই হবে এই দুর্গাঠাকুর। সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে চারিদিকে।

সংবাদে প্রকাশ, নিয়ম অনুযায়ী নাকি চল্লিশ ফুটের বেশি উচ্চতার মণ্ডপ তৈরি করা যাবে না, কিন্তু সেইসব বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে এই পুজোমণ্ডপের উচ্চতা নাকি আশি ফুট করা হয়েছে। নিষিদ্ধ বা নিয়ম বহির্ভূত যে-কোনো বিষয়ের প্রতি প্রত্যেক মানুষের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। সুতরাং দুর্গাপ্রতিমা দর্শনের বিষয়টি আরো দশগুণ জোরালো হল জনমানসে।

পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা বা কলকাতা পুলিশ আশা করতে পারেনি যে চতুর্থী থেকেই এই পুজোকে কেন্দ্র করে এমন মারাত্নক ভিড় শুরু হয়ে যাবে। কলকাতাসহ মহানগরীর সংলগ্ন হাওড়া, হুগলী, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে বা গাড়ি রিজার্ভ করে ভিড় জমাতে শুরু করে সোনালি পার্কে। এর ফলে রাস্তাঘাটের জ্যামজট চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। যে-পথ বাসে অতিক্রম করতে মোটে পাঁচ-সাত মিনিট সময় লাগার কথা তা অতিক্রম করতে দুঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে গাড়িগুলোর। সার সার গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

পঞ্চমীতে এই অচলাবস্থা চরম আকার ধারণ করল। কলকাতা তো বটেই, সুদূর গ্রামাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ বহু আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, সোনালি পার্কের এই দুর্গাঠাকুর কিছুতেই মিস করা চলবে না। এছাড়া গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার সূত্রে প্রায় প্রত্যেকেরই এটা ধারণা হয়ে গেছে যে ষষ্ঠী থেকে নবমী সাংঘাতিক ভিড় হতে পারে, সুতরাং পঞ্চমীতেই এই প্রতিমাদর্শন সেরে ফেলা দরকার। ফলে পঞ্চমীর বিকেল থেকেই ব্রিগেডের জনসভার চেহারা নিল দক্ষিণ কলকাতার রাস্তাগুলো। আশপাশের সমস্ত রাস্তা একেবারে মুক্তাঞ্চল হয়ে গেল হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে। যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হল একরকম। সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কমিশনারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলেন। যানবাহনের অবস্থা এমনই শোচনীয় আকার নিল যে পুলিশ কমিশনার নিজের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মেট্রোতে চেপে এবং পায়ে হেঁটে সোনালি পার্কের পুজোমণ্ডপে উপস্থিত হলেন। শেষে এমনই নাজেহাল অবস্থা দাঁড়াল যে পুজোকমিটির উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে ক্রমাগত মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, জনসাধারণ যেন পুজোমণ্ডপের মাঠে না ঢুকে রাস্তা থেকে প্রতিমা দর্শন করেন। কিন্তু উদ্যোক্তাদের এই ঘোষণা একেবারেই অর্থহীন ছিল, কারণ বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে যাওয়াতে রাস্তা থেকে প্রতিমা দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে অনিবার্যভাবে যা ঘটার তাই ঘটলো। পুজোপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করার জন্য ছিল অত্যন্ত ছোট দুটো গেট। তার উপর সিকিওরিটির ব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট ঢিলেঢালা। কাতারে কাতারে মানুষ ঢুকে পড়ছে মণ্ডপের মাঠে। সেই বিপুল জনস্রোতে ছিটকে গেল বহু মানুষ। ভিড়ের চাপে আর্তনাদ করে উঠলেন অনেকে। পেছন ফিরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন বেশ কিছু লোক। কিন্তু প্রবল ভিড়ে তখন সামনে ধাক্কা দিচ্ছে জনতা। সেই ভিড়কে লক্ষ্য করে প্রাণভিক্ষা চাইলেন অনেকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নারী-পুরুষ সকলেই দুর্গাপ্রতিমা দর্শন করতে এসেছেন। হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের এক সুন্দরী সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা তখন করজোরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ঠিক তার পেছনে দাঁড়ানো অল্পবয়সি কিছু ছেলের কাছে অনুরোধ করলেন বেরিয়ে যাওয়ার একটা পথ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এক বিদ্রুপাত্নক অশ্লীল অট্টহাসি ছাড়া ভদ্রমহিলার ভাগ্যে কিছুই জুটল না। ওদের কুৎসিত মূর্তি দেখে মহিলাটি বেশ ভয় পেয়ে গেলেন এবং সামনের দিকে ফিরলেন। ভিড়ের চাপ কখনও বাড়ছে, কখনও বা একটু কমছে। ভদ্রমহিলা আশপাশে তাকাচ্ছেন যদি কোনোমতে বেরিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বৃথা তার চেষ্টা। ভিড়ের চাপে তাঁর শাড়ির আচল ক্রমাগত গা থেকে খসে পড়ছিল, আর তিনি বারবার সেটা গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছিলেন অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন তাঁর পেটে কেউ হাত দিয়ে চাপছে। তিনি বলে উঠলেন, “আহ্, কি হচ্ছে কি, অসভ্য কোথাকার!”

পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “দিদি, আমাকে বলছেন কি ?”



মহিলা তার কোন উত্তর দিলেন না। ভিড়ের চাপ আরও বাড়তে থাকল। এবার একেবারে পিষ্ট হচ্ছেন মহিলাটি। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তার ঘাড়ের উপর কোনো একজনের নোংরা নিঃশ্বাস পড়ছে। মহিলাটি বলে উঠলেন, “কী হচ্ছে? ঠিকমতন দাঁড়ান।“ কেউ কোন সাড়া দিল না তাতে। ঠেলাঠেলিতে এবার হঠাৎ কিছুটা ফাঁকা হয়ে গেল সামনে। মহিলা দৌড়ে সামনে চলে গেলেন। পেছনের ছেলেগুলোও ছুটল সামনে। এবার ভিড়ের ঠেলাতে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভদ্রমহিলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কিছু ছেলে। মহিলাটি আর্তনাদ করে উঠলেন। কিন্তু কে কাকে বাঁচাবে! কারুর কিছু বলার নেই তখন। শোভন-অশোভন বলে কিছু নেই। সেই জান্তব ভিড়ের মধ্যে ‘সমাজ’ বলে কোনো শব্দ থাকে না। সবাই যে-যার মতন নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। ভদ্রমহিলাকে তখন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে দুজন প্রায় উন্মত্ত অল্পবয়সি দুটি ছেলে। তাদের বয়স কুড়ি-বাইশের বেশি হবে না।



মহিলাটি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “এই, এই, কী হচ্ছে? ছিঃ ছিঃ! ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি ।“



কিন্তু কে শোনে কার কথা ! প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বোধ হয় একটা পশু ঘুমিয়ে থাকে । সুযোগ পেলে সেই পশুটা জেগে ওঠে। এই দুটি ছেলে প্রায় আক্ষরিক অর্থে সেই মুহূর্তে পশু হয়ে উঠল। সেই উন্মত্ত ভিড়ের মধ্যে বড় অসহায়ভাবে, বড় করুণভাবে ধর্ষিত হয়ে চললেন সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দরী মহিলাটি। একসময়ে থাকতে না পেরে অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি – “আহ্! আমার লাগছে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাদের দিদির বয়সি, আমি তোমাদের মায়ের বয়সি। তোমরা প্লিজ ছেড়ে দাও আমাকে। আমার স্বামী আছে, পুত্র আছে। মাগো!”



কথাগুলো ছাড়া ছাড়া ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সেই বাঁধভাঙা জনতার ভিড়ে। কাকস্য পরিবেদনা! পশুশক্তি তখন পেয়ে বসেছে ছেলেদুটোকে। একটি ছেলে বড় নৃসংশভাবে কামড়ে ধরেছে মহিলাটির গাল, অন্য ছেলেটি তার দাঁত বসিয়ে দিয়েছে মহিলার গলায়। আশপাশের আরো দু-একটি নরপশু অসহায় মহিলাটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সুযোগ বুঝে। তখন আর চিৎকার করার শক্তি নেই ভদ্রমহিলার। প্রবলভাবে গণধর্ষণ হয়ে চলেছে। ভিড়ের মধ্যে তখন নানাদিক থেকে ভেসে আসছে অজস্র আর্তনাদ আর পৈশাচিক উল্লাস। ভদ্রমহিলা ছটপট করছেন সেই উন্মত্ত পশুদের নিষ্ঠুর বেষ্টনীর মধ্যে।



হঠাৎ দেখা গেল মহিলার দুটি হাত ঊর্ধমুখী। ছেলেদুটি তখন তাকে জাপটে ধরে তাদের জান্তব স্বাদ মেটাচ্ছে প্রাণভরে। ঠিক তারপরই ঘটল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। মহিলাটি তীব্র আওয়াজ করে চেঁচিয়ে উঠলেন – “জয় মা !”

আর, ঠিক সেই মুহূর্তে মহিলার শরীরে লেপটে থাকা দুটো হিংস্র এবং উন্মত্ত পশু এক তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ঢলে পড়ল ভিড়ের মধ্যে। মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেল জায়গাটা। সবাই বিস্ময়ে দেখল, আক্রান্ত মহিলাটি তার মাথায় লাগানো দুটো শলাকার একটা বসিয়ে দিয়েছে ওই দুজনের একজনের পেটে এবং অপর শলাকাটি আমূল বিদ্ধ করেছে অন্য ছেলেটির বুকের পাঁজর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। ভদ্রমহিলার এহেন সংহারমূর্তি দেখে জনতার ভিড় এলোপাথাড়িভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিলিয়ে গেল। ধারেকাছে কোথাও কোনো পুলিশ নেই তখন। পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভিড় সামলাতে না পেরে সবাই পালিয়ে গিয়েছিল সম্ভবত। দুটো তাজা নিঃস্পন্দ শরীর বলিপ্রদত্ত হয়ে পড়ে রইল সিংহবাহিনী, অসুরদলনী দেবী দুর্গার সামনে।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



 





অষ্টম পর্ব 

ক্লাইভের চন্দননগর দখল  

কলকাতা থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার উত্তরে হুগলি নদীর পশ্চিমপাড়ে ঘাঁটি গেড়ে যখন ব্রিটিশবাহিনী চন্দননগর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত তখন গত্যন্তর না দেখে ফরাসিরা সিরাজকে একের পর এক চিঠি পাঠাতে শুরু করল। সিরাজ তখন মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। ফরাসিদের বক্তব্য পরিস্কার। সিরাজ যেমন নিজের নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ তেমনি ফরাসিদের নিরাপত্তার জন্য তার পদক্ষেপ নেওয়াও ততটাই জরুরি। খবর কানে আসা মাত্রই সিরাজ ব্রিটিশদের জানিয়ে দিল বলা ভাল একরকম আদেশ দিল যে এই অভিযান যেন এই মুহূর্তে বন্ধ করা হয়। 

এদিকে ওয়াট ততক্ষণে সিরাজের অনুরোধ রক্ষার ভান করে কুড়িজন সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সিরাজ একদিকে যেমন ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে উদগ্রীব অন্যদিকে ব্রিটিশদেরও দেখাতে চায় যে সে তাদের সঙ্গে আছে। ওয়াটসের সঙ্গে চলেছে ব্রিটিশ অনুগত ব্যবসায়ী এবং সিরাজের খুব কাছের লোক উমাচাঁদ। সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের যে কোনও রকম আলোচনায় উমাচাঁদের উপস্থিতি প্রায় আবশ্যিকতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ওয়াটস এখন রাজকীয় কায়দায়তেই চলাফেরা করতে শুরু করছে। ৪০০ টাকা দিয়ে রুপোর কাজ করা হাতলের পালকি তৈরি করা হয়েছে তার জন্য। উমাচাঁদ ওয়াটসের কাছে আগেই পৌঁছেছিল সিরাজের দ্বিচারিতার খবর নিয়ে। অবশ্য ব্রিটিশদের কাছে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না কারণ সাম্প্রতিককালে তারা নিজেরাও প্রয়োজনে দ্বিচারিতার আশ্রয় নিয়েছে বেশ কয়েকবার। উমাচাঁদ খবর নিয়ে এল যে একজন ফরাসি দূত গোপনে হুগলির গভর্নর নন্দকুমারের কাছে প্রায় একলক্ষ টাকার উপহারসামগ্রী নিয়ে দেখা করেছে। উমাচাঁদ এ খবরও দিল যে সিরাজ ইতিমধ্যেই নন্দকুমারকে নির্দেশ দিয়েছে যদি ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণ করে সে ক্ষেত্রে ফরাসিদের  সহযোগিতা করা জন্য। এই নন্দকুমার পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হয় এবং ওয়ারেন হেস্টিংসকে সরিয়ে ব্রিটিশ সরকার তাকে বর্ধমান, হুগলি এবং নদীয়ার দেওয়ান পদে অভিষিক্ত করে। 

ব্রিটিশরা আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত রেখে উমাচাঁদকে পাঠাল নন্দকুমারের কাছে। উমাচাঁদ নন্দকুমারকে জানাল যে কোনও ভাবেই ব্রিটিশদের রোখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। নন্দকুমার যদি ফরাসিদের সহযোগিতা করে তাহলে ব্রিটিশদের হাতে তার প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে নিরপেক্ষ থেকে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করলে চন্দননগর জয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে নগদ ১২০০০ টাকা তুলে দেবে ব্রিটিশরা।  ফৌজদার হিসাবে তার মাসিক বেতন যথেষ্ট বেশি হলেও উপরি পাওনার লোভ ছাড়তে পারল না নন্দকুমার। এখনকার মত তখনকার দিনেও উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের ঘুষ নেওয়ার বেশ ভালোই রেওয়াজ ছিল।   

উমাচাঁদ ব্রিটিশদের হয়ে সিরাজের কাছে উমেদারি করার জন্য নাটকের অবতারণা করল। সিরাজের কাছে যখন খবর পৌঁছল যে ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে সে তখন উমাচাঁদকে তার শিবিরে ডেকে পাঠাল। সিরাজ তখনও মুর্শিদাবাদ পৌঁছয় নি। সিরাজ জানতে চাইল ব্রিটিশরা কি গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা ভাঙতে চাইছে কি না। উমাচাঁদ শশব্যস্ত হয়ে সিরাজকে আশ্বাস দিতে শুরু করল এই বলে যে এই সব গুজব সর্বৈব মিথ্যা। ব্রিটিশরা জাতিগতভাবে বিশ্বাসী এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসই তাদের উন্নতির কারণ। ব্রিটিশ সমাজে যে কথার খেলাপ করে বা মিথ্যার আশ্রয় নেয় সে সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে একাকী জীবন যাপন করে।আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবেরা তাকে পরিত্যাগ করে। এক স্থানীয় ব্রাহ্মণকে ডেকে তার চরণস্পর্শ করে উমাচাঁদ বলল যে কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশরা চুক্তিভঙ্গ করবে না।উমাচাঁদের নাটক বিশ্বাস করল সিরাজ। সিরাজ জানাল যে ফরাসীদের সাহায্য করার জন্য অর্ধেক সৈন্যবাহিনী নিয়ে চন্দননগর অভিযানের যে আদেশ সে মিরজাফরকে দিয়েছে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং এও জানাল যে ক্লাইভ যেন মনে না করে যে ব্রিটিশ সৈন্যদের তার কাছে পাঠানো হয়েছে তাদের ফরাসীদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করা হবে। পরের দিন ক্লাইভের চিঠি এসে পৌঁছল সিরাজের কাছে যাতে লেখা আছে সিরাজের সম্মতি ব্যতীত কোনও ভাবেই চন্দননগর আক্রমণ করা হবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে সিরাজ মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।   

  এদিকে ওয়াটস এবং উমাচাঁদ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলো। দু’জনে মিলে ব্রিটিশ আদালতে আবেদন জানাল যেন চন্দননগর আক্রমণের পক্ষে সম্মতি দেওয়া হয়। ওদিকে ক্লাইভ সিরাজের অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ না করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আদালত কার্যতঃ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ফরাসি প্রতিনিধি ল’ সহজে ছেড়ে দেবার লোক নয়। মানিকচাঁদ এবং খোয়াজা ওয়াজিদ ফরাসিদের পক্ষে তদ্বির শুরু করল। ওয়াজিদ ফরাসিদের সঙ্গে ভালোই ব্যবসা করে। ব্রিটিশরা চন্দননগর দখল করলে সে পথে বসবে। মানিকচাঁদ সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় যে পরিমাণ টাকা হাতিয়েছে তা ব্রিটিশদের নজরের বাইরে রাখার জন্য ফরাসিদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। জগৎশেঠের  কাছে ফরাসিদের ধারের পরিমাণ ১৫ লক্ষ টাকা। সুতরাং ফরাসিদের সমর্থন করা ছাড়া জগৎশেঠের আর কোনও উপায় নেই। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থার জন্য সকলে সিরাজের দু’দিক  থেকেই অর্থ আহরণের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রচেষ্টাকেই দায়ি করল।  এই প্রচেষ্টার পিছনে যে গভীর অভিসন্ধি আছে সে কথা বুঝতে কারও বাকি রইল না। এই অবস্থা চলতে থাকলো প্রায় ফেব্রুয়ারির শেষ অবধি।

এদিকে দিল্লিতে তখন পালাবদল শুরু হয়েছে। পাঞ্জাব সুবেদার মির মান্নুর স্ত্রী মুঘলানি বেগমের আমন্ত্রণে নাদির শাহের উত্তরাধিকারি আফগান রাজা আহমেদ শাহ দুরানি আর তার ছেলে তিমুর শাহ দুরানি তখন লাহোর, দিল্লি, মথুরা, বৃন্দাবন দখল করে মহম্মদ শাহ এবং আলমগীরের কন্যাদের নিজেদের হারেমে নিয়ে গিয়ে তুলেছে। নিজেরই রক্ষীদের হাতে খুন হয়ে ১৭৪৭ সালের জুন মাসে নাদির শাহের রাজত্বকাল হঠাৎই শেষ হয়ে যায়। দুরানির কাছে খবর আসে নিজের স্ত্রীর হাতে নিহত হয়েছে নাদির শাহ। নাদির শাহের একান্ত অনুগত এবং বিশ্বাসী আবদালি বাহিনীর সেনাপ্রধান দুরানি জীবন বাজি রেখে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোয়। দুরানি জানত যে বিশ্বাসঘাতক রক্ষীরা তার ওপর আক্রমণ করতে পারে তবুও জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নাদির শাহের মুন্ড এবং মুন্ডহীন দেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে দুরানি। তারপর নাদির শাহের অনামিকা থেকে শিলমোহর এবং বামবাহু থেকে কোহিনূর খুলে নিয়ে ৪০০০ সৈন্য সহযোগে কান্দাহারে ফিরে এসে নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে। মুঘল সৈন্যবাহিনী ছেড়ে রোহিল্লা পাঠান সেনাপতি নাজিবুদৌল্লা তখন যোগ দিয়েছে আহমেদ শাহ দুরানির সঙ্গে। সিরাজের কানে এল আহমেদ শাহ দুরানি আর নাজিবুদৌল্লা পূর্ব ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত সিরাজ ক্লাইভের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে বলল যে সে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর খরচ বাবদ মাসে একলক্ষ টাকা দিতে প্রস্তুত আছে। 

ইতিমধ্যে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ কাম্বারল্যান্ড মাদ্রাজ থেকে বালাসোর এসে পৌঁছেছে। বোম্বে থেকে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে জাহাজও এসে পৌঁছে গেছে। ক্লাইভের আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল যে এখনই চন্দননগর আক্রমণের প্রকৃত সময়। ফরাসিদের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা রক্ষা করার চুক্তি অর্থহীন। যে সমস্ত ফরাসি আধিকারিকেরা চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য অপেক্ষা করছিল ক্লাইভ তাদের ফেরত পাঠিয়ে সিরাজকে জানাল যে যে মুহূর্তে পাঠানদের এগিয়ে আসার খবর পাওয়া যাবে ব্রিটিশ সৈন্য সিরাজের কাছে পৌঁছে যাবে। ক্লাইভ এও জানাল যে ইতিমধ্যে সে সৈন্যবাহিনী নিয়ে চন্দননগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। ক্লাইভের কাছ থেকে সম্ভাব্য পাঠান আক্রমণের মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি পেয়ে সিরাজের তখন চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা উপায় ছিল? ব্রিটিশ অনুগত নন্দকুমার সিরাজকে আশ্বাস দিল যে ব্রিটিশদের কোনও অসদুদ্দেশ্য নেই। এদিকে চন্দননগর আক্রমণের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ওয়াটসন সিরাজকে বার্তা পাঠাল যে ফরাসিরা সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রক্ষার জন্য সিরাজের নাম ব্যবহার করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সিরাজের মতামত শুনতে চায়। ওয়াটসনের দীর্ঘসূত্রতায় বিরক্ত ক্লাইভ ৪ঠা মার্চ, ১৭৫৭ কাউন্সিলের কাছে অনুরোধ জানাল যে তারা যেন অনতিবিলম্বে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে জলপথে চন্দননগর আক্রমণের নির্দেশ দেয়। ক্লাইভ এও জানালো যে সে নিজে স্থলবাহিনী নিয়ে প্রস্তুত এবং ওয়াটসনের এই বিলম্ব যদি কোনও দুর্ভাগ্যের কারণ হয় তবে তার জন্য সে দায়ি থাকবে না। তার আবেদন এই যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যা গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে কি না। যদি হয় তাহলে সে নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্যদের রেখে বাকি বাহিনী নিয়ে মাদ্রাজ ফিরে যাবে। সেক্ষেত্রে কাউন্সিল যেন সৈন্য পরিবহণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।। ঠিক সেই সময়  সিরাজের চিঠি এসে পৌঁছোল। সরাসরি নিজের মতামত না জানালেও সিরাজ লিখল যে শত্রু যদি তোমার কাছে আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমাভিক্ষা করে তবে তাকে ক্ষমা করাই উচিৎ। কিন্তু শত্রু যদি ছলচাতুরির আশ্রয় নেয় বা তার আচরণে ও কথায় আন্তরিকতা এবং আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সংশয়ের উদ্রেক হয় তবে সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে সঠিক পন্থা অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

সিরাজের এই উত্তরকে চন্দননগর আক্রমণের ছাড়পত্র হিসাবে ধরে নিয়ে যুদ্ধজাহাজ চন্দননগরের পথে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিল। স্থলপথে ক্লাইভের বাহিনী আর জলপথে ওয়াটসনের যুদ্ধজাহাজ কেন্ট, টাইগার এবং সালিসবেরির মিলিত আক্রমণে কেঁপে উঠলো চন্দননগর। সেদিনটা ছিল ১৪ই মার্চ, ১৯৫৭। কিন্তু কলকাতা পুনর্দখলের মত চন্দননগর বিজয় অত সহজ ছিল না। ফরাসিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল।বেশ কিছুদিন যুদ্ধ চলার পর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হল ফরাসিরা। জনৈক বিশ্বাসঘাতক সেনা অফিসারের সহযোগিতায় ক্লাইভের বাহিনী দখল করে নিল চন্দননগর ফোর্ট। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ প্রাথমিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত ফরাসি জাহাজকে হুগলিবক্ষে ডুবিয়ে বীরদর্পে চন্দননগর এসে পৌঁছে গেল। ব্রিটিশ স্থলবাহিনীর ৪০ জন সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হল। যুদ্ধজাহাজ কেন্ট এবং টাইগার মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩২ এবং আহতের সংখ্যা ৯৯। মৃতদের মধ্যে ছিল টাইগারের ভারপ্রাপ্ত ফার্স্ট লেফটেনান্ট স্যামুয়েল পেরু এবং আহতদের মধ্যে ছিল অ্যাডমিরাল পোকক। ফোর্ট দখল করার পর ওয়াটসন, পোকক, ক্লাইভ এবং ক্লিপট্রিক সিলেক্ট কমিটির কাছে চন্দননগর ফোর্ট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার অনুমতি চেয়ে পাঠায়। তাদের যুক্তি ছিল যে কোনও সময়ে সুযোগসন্ধানী এবং সুবিধাবাদী  সিরাজ তার অবস্থান পরিবর্তন করে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে ফরাসিদের  দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। ফোর্ট ধ্বংস করে চন্দননগরকে ফরাসিমুক্ত করতে পারলে সেই সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট হবে। শুধু তাই নয় চন্দননগরের মত বর্ধিষ্ণু উপনিবেশ ধ্বংস হলে ফরাসিদের কারখানা ও ব্যবসার ওপরে চরম আঘাত নেমে আসবে। ফলস্বরূপ হুগলিবক্ষে এবং বাংলায় ব্রিটিশরা একচ্ছত্র ব্যবসা চালাতে পারবে। ১৬ই এপ্রিল ১৭৫৭ ব্রিটিশদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেল চন্দননগর ফোর্ট। আরও একবার প্রমাণিত হল রাজনীতি এবং যুদ্ধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পদবৃদ্ধি ব্যতীত আর কিছু নয়। শিষ্টাচারস্বরূপ 

যুদ্ধশেষে ইউরোপের দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী এবং ভারতের দুই ব্যবাসয়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে স্থির হল ফরাসি কাউন্সিল এবং ফ্যাক্টরির প্রধানেরা কলকাতায় কড়া নজরদারিতে রাজকীয় মর্যাদায় গৃহবন্দি থাকবে এবং বন্দি থাকাকালীন তাদের প্রভূত পরিমাণে আর্থিক ভাতা দেওয়া হবে।

ব্রিটিশদের পরবর্তী পরিকল্পনা কি ইতিমধ্যে স্থির হয়ে গেছে? তলে তলে কি শুরু হয়ে গেছে পলাশিযুদ্ধের প্রস্তুতি? 


0

গল্প - সৌরভ হোসেন

Posted in







চৈত্রের পানি

এই অসময়ে হুট করে শিলাবৃষ্টিটা কোত্থেকে যে এল! এ নিশ্চয় আল্লাহর গজব? তা না হলে এই ঘোর চৈত্র মাসে কেনই বা হুড়মুড় করে এমন শিল পড়বে? গদগদে সবুজ ধানগাছগুলোকে মাটির সাথে নুইয়ে থাকতে দেখে সাদেরের অন্তরটা ডুকরে উঠল! সে পারলে, ধানগাছের শীষ ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। গড়াগড়ি দেয়। মনে মনে মেঘকে গাল পাড়ল, ল্যাড়খেকি ম্যাঘ বিহানের আর সুমা পালো ন্যা? বিহালো তো বিহালো পাথরের মুতোন শিল বিহালো! অ্যাক পশলা পানি বিহালেই পাত্তোক।

সাদের জানে, ফাল্গুনের পানি আগুন। কিন্তু চৈত্রের পানিও কি কম আগুন? ফসলের দুষমন এই চৈতি বৃষ্টি। ফুঁ দিয়ে, জাড় মেখে যখন ঝেঁপে নামে, তখন চাষি হাই হাই করে, সব্বনেশে ম্যাগ পাড়িমোষের মুতন ফুঁসি উঠচে! সব ফসলপানি ইব্যার ধুয়ি মুছি লিয়ি যাবে গ!

সাদের দুব্রোঘাসে ঢাকা আলটায় লেটা মেরে বসল। জমা জলে পরনের লুঙ্গিটা ভিজে গেল। ভেজা লুঙ্গির কালহা রস তার পাছায় ঠেকল। ওদিকে হুঁশ নেই তার। খুঁটল চোখগুলো ভাঙা ডিমের কুসুমের মতো থলবল করছে। ফ্যাকাশে মুখটার ওপর জালি বেলার রোদ ছিটকে পড়ে মুখটা ঢাকা ঘাসের মতো হলুদ হয়ে উঠছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না সাদেরের। রাতের লাথিটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এই নুইয়ে পড়া ধানিজমিটাকে দেখে নিজেকে তার বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। নিজেকে এই ঘাস-আলে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে। সে যেন চৈত্রের এই হড়কা শিলের মতো দাগি আসামি। ধানগাছের নষ্ট থোড় দুই হাত দিয়ে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল সাদের। সাদেরকে এই সাতসকালে ধানের আলে বসতে দেখে জোলের ভুঁই থেকে হাঁক ছাড়ল মসলেম, “তুমার ভুঁইয়ের কী হাল গ, সাদেরভাই? আমার তো অ্যাক কাঠাও খাড়া হয়ী দাঁড়ি নাই! অ্যা আল্লাহর গজব। শালোর শিল সব ধুয়িমুছি শেষ করি দিয়ি গেলচে!“

কথাগুলো সাদেরের কানে তীরের মতো বিঁধল। মনে হল, শিল নয়, মসলেম যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলল! সে আলগোছে উত্তর দিল, “একই হাল। সবকডার মাজা ভেঙি গেলচে।“

“থোড়গুলান কেবুলই পুষ্ট হয়ী উঠছিল, আর অমনি হারামি শিল ম্যাগ ফুটি দুদ্দাড় করি পড়ি সব শ্যাষ করি দিয়ি গ্যালো গ! অ্যাখেই বুলে হাতে না মেরি ভাতে মারা।“

“রুজির মালিক আল্লা, যা করে ভালোর লেগিই করে।“ থির চোখদুটো ফ্যাল ফ্যাল করে আসমানের দিকে তুলল সাদের।

“অ বুলা ছাড়া আর কী বা করার আচে। আল্লা তো কুনুকিচুর দোষ লিবে না। কখনও ম্যাগ-পানি, কখনও ঝড়-ঝঞ্ঝা, কখনও ওইদ-খরা তো কখনও এই দুপেয়ি মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপি আল্লা রিহাই পায়।“

“ই বচ্ছর দক্ষিণে ধান কাটতে যাবা না?”

“না গেয়ি কী করব? ইখানে থেকি না খেয়ি শুকি শুকি মরব? তা তুমিও যাবা নাকি?”

“হু, যাব। কী আর করব? প্যাটে ভাতপানি তো লাগবে? ইবার ধানের যা ছড়াদ, তাতে ঝেরিঝুরি পাঁচমুন ধান পাব কি না সন্দেহ। সব পাতান হয়ী যাবে!“

“প্যাটের ভিত্তর দানা গজানোর সুমায় যদি অ্যামুন খাইকুন্নি শিল লাথি মারে, তাহলে কি আর ফল জন্মায়? অ পাতানই হয়।“

“হু।“ সাদের শুধু ঘাড় নাড়ল। ‘লাথি’ কথাটা তার কানে বাজতেই তার অন্তরটাও যেন লাথি খেয়ে উঠল। তার মনে হল, মসলেম তাকে ঠেস মেরেই কথাটা বলল। রাগ অভিমান মনে পুষে পরনের লুঙ্গিটা নেংটি মেরে, সড়সড় করে ধানের জমিতে নেমে পড়ল সাদের। হুমড়িয়ে পড়ে থাকা ধানগাছগুলোর ভাঙা মাজা খাড়া করে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। মাজার আর সে ক্ষমতা নেই যে শীষগুলোকে ধরে রাখবে। ধানগাছের গুঁড়ির চুড়ুত জমাজলে শীষের ঝরা সাদা রেণুগুলো থলথল করে ভাসছে। তা দেখে সাদেরের ভেতরটা ধড়াক করে উঠল! মাটির উশরায় চুঁইয়ে পড়া থলথলে রসটার কথা মনে পড়ে গেল। তার নিজেকে বড় গোনাহগার মনে হল। ভাবল, এই রক্তমাংসের মানুষ শুধুই কি একটা রুহুর খোল? নাহ। এই রক্তমাংসের দেহের মধ্যে একটা প্রকৃতিও আছে। সেখানে ঝড় ওঠে, বৃষ্টি হয়। রোদ-খরাতে পুড়ে পুড়ে রুটি স্যাকা খুলা (তাওয়া)র মতো তেতে ওঠে।

মাঝেমধ্যে তুফান উঠে সব ছাড়খাড় করে দিয়ে যায়। ধানগাছে খসখস করে শব্দ হচ্ছে। চচ্চড়ে পোকা চড়বড় করে এদিকওদিক তিড়িংবিড়িং করে লাফ মারছে। সাদেরের গা-হাত ঝরা ফুলের রেণুতে পাকিয়ে গেল। চৈত্রের বিহেন রোদ সে গায়ে হাতে পড়ে খিলখিল করে উঠল। সাদের খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে এই লম্বা ধানগাছগুলোর থোড় টিপে দেখল, ভেতরে দানাপানি আছে কি না। সাদেরকে হাত দিয়ে থোড় টিপতে দেখে, হুক হুক করে কোদালের কোপ দেওয়া বন্ধ করে মসলেম সেখ ঠাট্টা করল,

“কি গ, থোড়ে হাতচালি দেকচ নাকি, ভিত্তরে দানাবিচি আচে কি না?“

‘হাতচালানো’ শব্দটা শুনে সাদেরের নাড়িভুঁড়ি উল্টি মারল। কিচ্ছু ‘রা’ করল না সে। মাথাটা একটু বেশিই ঝোঁকাল। যেন কোন একটা কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়ল। তার উস্কোখুস্কো চুলের মাথাটাও ধান গাছের ঝোড় হয়ে উঠল। কিন্তু ‘হাতচালানো’ কথাটা তার মাথা ঘুলিয়ে দিচ্ছে। থোড়ে হাত দিতে ভয় পেল সে। নুইয়ে পড়া ধানগাছের ওপর ‘থপ’ করে বসে পড়ল। চিনচিন করছে বুক। মনের ভেতর একের পর এক প্রশ্ন আউরিবাউরি খাচ্ছে। ক্যানে হাতচালাতে লিয়ি গেছুনু? ক্যানেই বা হুট কইরি উভাবে পা’টা উঠি গেল?



শিল 

চোখ সবে টাটিয়ে এসেছিল। আচমকা টালির ওপর দুদ্দাড় শব্দ শুনে ধড়ফড় করে উঠে পড়েছিল সাদের। ঝোড়ো হাওয়াই কাঁপতে কাঁপতে ‘দপ’ করে নিভে গেছিল টিমটিম করে জ্বলতে থাকা লম্পটা। সাদেরের মুখ ফুটে বেরিয়ে এসেছিল, ‘হাই আল্লা!

শিল!’ সাদেরকে অমনভাবে নামতে দেখে, তাহেরার কাঁচা ঘুমটাও ভেঙে গেছিল। লম্বা গড়নের চামটা দেহে ফাসা ঢোলের মতো তার ঢলঢলে পেটটা টুস্কা হয়ে পড়েছিল। দুম করে চোখের পাতা খুললেও হুড়মুড় করে ওঠার শক্তি ছিল না তার। মিহি গলায় শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হইল গো?”

“শিল পইচ্চে!” পিন্ধনের লুঙ্গিটা আলগোছে গুঁজে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল সাদের। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা, চৈত্রের এই শিলাবৃষ্টি ধানের ফুল সব ঝড়িয়ে দেবে! থোড়গুলো সব নষ্ট করে দেবে! সব ধান পাতান হয়ে যাবে! উঠোনে তখন শিলের খৈ ফুটছে। বিদ্যুতের ঝলসানো আলোতে পড়ে থাকা শিলগুলো রূপোর মতো ঝকমক করছিল। একটা ভাঙা শিল হাতে তুলে সাদের ফ্যাসফেসে গলায় বলেছিল, “ওগো, বর্ষার মা, দেখি যাও, সব্বনেশে শিলে উঠ্যেন ভরি গ্যালো।“ তাহেরা উত্তর দেয় নি। শুধু “উঃ” “উঃ” করেছিল।

সাদের মনে মনে বলেছিল, ধানের থোড়ের পেটগুলোও শিলের পটবাড়ি খেয়ে নিশ্চয় এতক্ষণ এভাবেই কুদরাচ্ছে। হাতের মুঠোয় শিলের টুকরো চিপে ধরে এক সতরের উশরাটায় ঠাই দাঁড়িয়ে ফসলের আঁক কষেছিল সাদের। ঘরের ফসল আর মাঠান ফসল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আচমকা পায়ের সামনে পড়ে থাকা শিলের টুকরোটাকে ভ্যাকাম করে লাথি মেরে উঠোনে ফেলে দিয়েছিল। আসলে সাদের এই বরফখণ্ডের মধ্যে নিজের কদর্য রূপটা দেখতে পাচ্ছিল। সেও তো এই রক্তমাংসের মানুষ থেকে মাঝেমধ্যে হড়কা শিল হয়ে ওঠে। তার মনের আকাশে পাড়িমষের মতো কালো মেঘ ওঠে। সে মেঘে ঝড়ের তাণ্ডব বয়।



আল্লাহর গজব

“ইবার কাদানের টাকাকডাই উঠবে না! ই ধান গরুর শানিই (বিচালি) হবে!” ‘ঘুঁত’ করে কোদালের কোপ দিয়ে আফসোস করল মসলেম। মাথায় ফেট্টি বাঁধা গামছাটা খুলে মুখ মুছতে মুছতে এবার হাঁড়া গলাটা একটু চরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমার বউর খবর কী গ?”

কথাটা সাদেরের কানে সপাটে চড় খাওয়ার মতো বাড়ি খেল। কিন্তু সে যে কুকম্মটা করেছে তা তো আর ধামাচাপা দেওয়ার মতো নয়? সে রাতেই গোটা পাড়া ঢ্যাড়ড়া পড়ে গেছিল। গোটা পাড়ার মেয়ে-মরদে ছিঃ ছিঃ করেছিল। ঝোপ ধানের গুঁড়িতে ঠেসে বসে পড়ল সাদের। তার হাড়গিলে পাদুটো যেন শরীরের আর ভার নিতে পারছে না। তারা যেন এই আসামি শরীরটার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করল। একটা শিকড় উপড়ানো ধান গাছের লটকানো দেহ দেখে সাদেরের ভেতরটা থক করে উঠল। সে রাতে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা তাহেরার নিথর শরীরটার কথা মনে পড়ে গেল। নিজেকে তার জ্যান্তশিল মনে হচ্ছে এখন।

ধানের থোড়ে হাত দিতে লজ্জা করছে সাদেরের। কৃষকের হাতের স্পর্শ পেয়েই তো ধানের থোড় ‘ধেই’ করে ওঠে। খিলখিল করে হাসে। কৃষক যে তাদের বাপ মা। অথচ তাহেরার কথা মনে আঁচড় কাটতেই পরানচাষি সাদের যেন একজন বেইমান বাপ।

সে যে বড় পাপ করে ফেলেছে! সে রাতের কু-কীত্তিতে আল্লাহর আরশ যে কেঁপে উঠেছিল। তার জন্যে আল্লাহর আযাব নেমে আসবেই। জাহান্নামের দরজা খুলে যাবে নিশ্চিত। কবরের ফেরেশতাকে কী উত্তর দেবে সে? সে যে একজন খুনি! ফড়ফড়ে মসলেম কোদালটাকে ধানের আলে খাড়া করে রেখে, একটা আধপুষ্ট থোড়কে চিপে বলল, “কিছু কিছু থোড়ে অ্যাখুনও দুধরস আছে গ। এই দ্যাখো জোরে টিপলে সাদা রস ব্যারহাচ্ছে।“ মসলেমের বিড়ি খাওয়া ঠোঁটে মিহি হাসি। চোখ নিংড়ে খসে পড়ছে ধুকধুক করতে থাকা ক্ষীণ আশা।

“অ্যাক শিলে কি সব যায়?” ঝোপের আড়াল থেকে ভেসে উঠল কথাটা।

“কে বুলল, যায় না? গ্যালো বচ্ছরের আগা বচ্ছর, মুনে আচে? সে কি শিল, বাপরে বাপ, আদ্ধেক রাইত জুড়ে শিল্বৃষ্টি হয়ীছিল! মাঠখে মাঠ ধান অ্যাকেবারে মাটিতে মিশি দিয়ছিল! সব ধান ঝেরে পাতান হয়ী গেলছিল!” আকাল বছরের দুঃখের স্মৃতি জাবর কাটল মসলেম। সাদেরও জানে, এক শিলেই সব ধুলিস্যাত হয়ে যেতে পারে। আল্লাহর গজব নেমে আসলে এই দুনিয়ার কারোরই কিছু করার থাকে না। সাদের হাড়ে হাড়ে জানে, মানুষের শরীরের ফুলই এক লাথিতে ঝরে যায় তো ধানের থোড় তো ঝরবেই। মানুষের নাড়ি যে জড়িবুটির আটসাট বাঁধনে বাঁধা থাকে, ধানের থোড়ফুল তো সেভাবে বাঁধা থাকে না?

মসলেম থপথপ করে ঘাসে ঢাকা আল দিয়ে হেঁটে আসল। সাদের ভুঁইএর যে প্রান্তে বসে বসে বাঁকা ধান খাড়া করছিল সেখানে ‘দ’ হয়ে বসল। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে একবার খক করে কেশে বলল, “অ্যাকটা বিড়ি দাও দেখি।“ সাদের বাঁকা মাজা সোজা করে দাঁড়াল। ভাবল, ব্যাটা মসলেম তো এবার গেঁড়ে বসতে চায়ছে। ব্যাটা বিড়ি চায়ছে মানে এবার গল্পের আসর পাড়বে। এ কথা সে কথা গাহাতে গাহাতে পাপ রাতের ঘটনাটা শুনার ফন্দি আঁটবে। কিন্তু বিড়ি নাই, বলাও যাবে না। একটু আগেই তাকে বিড়ি টানতে দেখেছে মসলেম। “বিড়ি তো নাই গ, যে কডা ছিল, বসতে গিয়ি ভেঙ্গি গেলচে মুনে হয়” বলেই নেংটিমারা লুঙ্গির ভাঁজে জড়ানো বিড়ির প্যাকেটটা থেকে দুটো বিড়ি বের করল সাদের। একটা নিজের কানে গুঁজে আর একটা মসলেমকে দিয়ে বলল, “ধরাও।“ মসলেম আলের ওপর ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা নাড়ার আঁটিআগুনটা মুখের কাছে ধরে বিড়িটা মুখে পুরে একটা জোরে টান দিল। ফুঁক ফুঁক করে দুবার ধোঁয়া ছাড়ল। সাদের কান থেকে বিড়িটা মুখে নিয়ে মসলেমের জ্বলন্ত বিড়িটার গনগনে আগুনে তার বিড়ির মুখটা ঠেকিয়ে আগুন ধরাল। একবার ফুঁক করে টেনে খক করে কাশল সাদের।

মসলেম জোরে সুখটান দিয়ে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “ই বচ্ছর পাপের বচ্ছর। অর লেগিই আল্লার গজব নেমি এসচে।“

“শিল কি আজ লতুন? বাপদাদোর আমল থেকিই হয়ী আসচে।“ বিড়বিড় করে উঠল সাদের। মসলেমের কথাটা তার গায়ে লাগল।

‘পাপ’ কথাটা তার কানে বাজলেই সেই রাতের ‘লাথিটা’ তার হৃদয়ে কুড়ুল মারে। মসলেম বিড়িটা মুখে পুরে ডান হাত দিয়ে একটা থোড়ের পেট টিপে বলল, “সব খোল হয়ী গেলচে গ! প্যাটটা ক্যামুন ঢলঢলে চামটা! ভেত্তরের অসকষ সব শুকি খটখটি হয়ী গেলচে! পুয়াতি মেয়ির প্যাটের পুষ্ট ছেলি লষ্ট হয়ী গ্যালে প্যাটটা য্যামুন চামটা হয়ী যায়, অ্যা ঠিক ত্যামুন!”

সাদেরের নাড়িভুঁড়ি পাক মেরে উঠল। গা-গতর হলহল করে কাঁপছে। বিড়িটা মুখের ভেতর পুরে ফুঁক ফুঁক করে দু-তিনবার ধুকপুকানি টান মারল। গব গব করে দলা পাকিয়ে ধোঁয়া বের হল। খুটোল চোখে ঝাপসা স্মৃতি টাটকা হয়ে উঠল।



লাথি

সাদের মুখ্যুসুখ্যু আবোড় লোক হলেও, কোনদিনও তুকতাকে বিশ্বাসী ছিল না। তাবিজ-কবোজ, ঝাড়পুক, পানিপড়া, হাতচালানো তার কাছে ছিল শেরেকি। কিন্তু তার নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে যখন পরপর তিন কন্যাসন্তানের জন্ম হল, তখন তার সে বিশ্বাসে চিড় ধরল। মনের মধ্যে দানা বাঁধতে লাগল নানান সংস্কার। সে ভেবেছিল, তিন মেয়ের পর আবারও যদি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়, তবে খড়কুটো ধরে কোনরকমে বেঁচে থাকা হাভাতের সংসারটা একেবারে উচ্ছেন্নে যাবে! সে আল্লাহর ওপর অভিমান করে উঠেছিল, গরিবের ঘর ভরে এত্ত বিটি দ্যাওয়ার কী দরকার ছিল? তাহেরা তখন সাতমাসের পোয়াতি। চতুর্থবারের জন্য তার পেট ভরে উঠেছে। সাতমাসেই ঠিলির মতো ফোলা পেট! এদিকে সাদেরের ঘুম হয় না। তার মাথায় অনবরত ঠকঠক করে, বিটি না ব্যাটা? সে মনে মনে তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। নানান ফন্দিফেউর আঁটে। কাছের লোকজনদের জিজ্ঞেস করে। শেষে হাজিপাড়ার সালেমুদ্দি মোল্লার কাছ থেকে ঠিকানাটা পেয়ে যায় সাদের।

বটগাছের গা লাগা ছোট্ট একটা ঝুপড়ি। বড়বড় হরফে লেখা, ‘কবিরাজি ঔষধের দোকান’। কবিরাজি ওষুধ খেলে পেটের সন্তান পুষ্ট হবে বলে তাহেরাকে নিয়ে এসেছে সাদের। সাদের চেম্বারে তাহেরাকে বসিয়ে রেখে পাশের ঘুপচি ঘরে কবিরাজজীর সাথে কি সব ঘুটুরমুটুর করল। কবিরাজজী তার কুঁচকানো ভ্রূ সাট করে, গালে আলতো টোল ফেলে ঘাড় নেড়ে জানালেন, “ঠিক আছে। হয়ে যাবে। এ আমার এক তুড়ির কাজ। আগে হাতচালিয়ে দেখেনি, তারপরে দাওয়াই দিচ্ছি।“

কবিরাজের ইশারা পেয়ে সাদের তড়বড় করে উঠে বাইরের বেঞ্চ থেকে তাহেরাকে এই অন্দরঘরে নিয়ে এল। কবিরাজমশায় তাহেরাকে একটা চওড়া কাঠের বেঞ্চে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন। তারপর তাহেরার ঢোল পেটটা থেকে সুতির মেরুন শাড়িটা সরিয়ে উদেম পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কিসব ফুঁ-মন্তর আউড়াতে লাগলেন। মাঝেমধ্যে জোরে ফুঁ ঝেরে হাতের আঙুল দিয়ে ফোলা পেট চেপে চেপে কি যেন পরখ করলেন। মিনিট পাঁচেক এভাবেই হাতচালানো চলল। হাতচালানো হয়ে গেলে তাহেরাকে চেম্বাররুমে পাঠিয়ে কবিরাজজী ফিসফিস করে সাদেরকে গোপন কিছু একটা জানালেন। তারপর ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বললেন,

“একদম চিন্তা করবেন না। জড়ীবুটিগুলো ঠিকঠিক ভাবে খাইয়ে দেবেন। দিন পনেরোর মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।“

কবিরাজজী এত করে বললেও, ওসব জড়িবুটির প্রতি বিশ্বাস হচ্ছিল না সাদেরের। দিন পনেরো মানে তার কাছে অনন্তকাল।

অতদিন অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য তার ছিল না। তার মাথায় শুধু কবিরাজজীর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলা “বিটি’ কথাটা কটমট করে কাটছিল। সে চায়ছিল চটজলদি ফায়সালা।

সে রাতে তেমন কিছুই হয়েছিল না। এরকম ঠুকমুক আগেও অনেকবার হয়েছে। কিন্তু তাহেরার অল্প কথাতেই সাদেরের মাথা তেতে উঠেছিল! সে যেন মনে মনে এই ছুতোই খুঁজছিল। তাহেরার অপরাধ, সে স্বামীকে না জানিয়ে আশাকর্মীর দেওয়া ওষুধ খেয়েছিল। সে স্বামীর নিষেধ শোনেনি। সাদের বারবার করে মানা করে দিয়েছিল, কবিরাজের ওষুধ ছাড়া অন্য কুনু ওষুধ খাবা  না। তাহেরাও মুখের ওপর তর্ক করেছিল। মুখে লাগাম লাগাতে পারেনি। তাহেরা যেই বলেছিল, “উসব জড়িবুটি আমি খাব না”,

অমনি সাদেরের মাথা বিগড়ে গেছিল। মরদ সাদের তার ডান পা’টা তুলে তাহেরার ভরা পেটে ‘ভ্যাকাম’ করে এক লাথি মেরে দিয়েছিল। ব্যস। ওতেই কেল্লাফতে। কাটা গাছের মতো আলুথালু হয়ে মেঝেতে পড়ে গেছিল পোয়াতি তাহেরা। দুই ঊরুর ফাঁক দিয়ে অনর্গল বয়ে গেছিল রক্ত-স্রাব। নষ্ট পুত্রসন্তানের রস-কষ। পরান চাষি সাদের চোখ ফেড়ে দেখেছিল, তার ঘরের খেতিতে একটা পুষ্ট থোড় নষ্ট হয়ে কীভাবে গলে গলে পড়ছে।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








সপ্তম পর্ব

সিরাজের প্রতি-আক্রমণ ও আলিনগর চুক্তি

কলকাতা কাউন্সিল কয়েকদিনের মধ্যেই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।২৬শে জানুয়ারি ঠিক হল যে মেজর ক্লিপট্রিকের নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী গঠন করা হবে আভ্যন্তরীন সুরক্ষার জন্য। এছাড়াও দ্রুত কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবা হল। ঠিক হল যে দেশি তাঁতিদের সুরক্ষা এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে যাতে তারা আবার কাজ শুরু করতে পারে। জমিদারদের বলা হল তারা যেন প্রচার করে যে তাঁতিদের সুরক্ষা এবং কাপড় উৎপাদন ও বিক্রির ব্যাপারে কোম্পানি পূর্ণ সহযোগিতা করবে। স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং কর্মচারিরা যারা যুদ্ধের সময় নবাবের বাহিনীকে সাহায্য না করে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল তাদের সকলকে কোম্পানি এলাকায় ফিরিয়ে আনা হবে, তাদের বাড়ি সারানোর , সংসার চালানোর এবং আবার করে ব্যবসা শুরু করার জন্য সাময়িক সাহায্য করা হবে। যারা যুদ্ধের সময় নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে নবাবের বাহিনীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল তাদের কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। কোম্পানি কর্মচারিরা যারা এতদিন বাড়ি ছেড়ে ছিল তাদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। মাসিক বেতন ছাড়াও এই ভাতার কারণ যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ বাসস্থানের সংস্কার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি। চাকুরির শ্রেণী অনুসারে বিশেষ মাসিক ভাতার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল।

প্রেসিডেন্ট- ৩০০ টাকা

কাউন্সিল মেম্বার-১০০ টাকা

ছোট এবং বড় ব্যবসায়ী- ৭০ টাকা

অন্যান্যরা- ৪০টাকা

এই বিশেষ ভাতা কার্যকরী হল ১লা জানুয়ারি, ১৭৫৭ থেকে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কলকাতা কাউন্সিল লন্ডনে কোম্পানির বোর্ডে জানালো যে বাঙলা থেকে অফিসারদের ইরাক পাঠানো হোক পারসি শেখার জন্য। পারসি শেখা অত্যন্ত জরুরি কারণ নবাবের সমস্ত নথিপত্র পারসিতে লেখা।স্থানীয় পারসি জানা লোকেরা যথেষ্ট শিক্ষিত নয় এই কাজের জন্য। কিন্তু আগে নবাবাকে সামলানো দরকার । কেবল ভাষা বুঝে কোনও লাভ নেই।

ব্রিটিশদের ১০ এবং ১১ই জানুয়ারির হুগলি আক্রমণ সিরাজকে অস্থির করে তুলল। তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল। আর দেরি না করে সিরাজ রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে বেছে নিল মিরজাফর আর রায়দুর্লভকে। এদিকে জগতশেঠ এবং উমাচাঁদ সিরাজের আধিপত্য এবং দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পারলেও তার বিরুদ্ধে যাবার বিশেষ করে ব্রিটিশদের পক্ষে যোগ দেবার সাহস তখনও সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। সুতরাং দু’জনেই তখনও দু’নৌকায় পা দিয়েই চলতে থাকল। জগতশেঠ এবং উমাচাঁদ সিরাজের অতিবিশ্বস্ত জমিদার রণজিৎ রাইকে মধ্যস্থতার কাজে লাগিয়ে গত জুনের যুদ্ধের সময় সম্পত্তির যা ক্ষতি হয়েছিল তা উশুল করার জন্য একদিকে যেমন ব্রিটিশদের শরণাপন্ন হল আবার অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে গিয়ে সিরাজের অতি ঘনিষ্ঠ মোহনলালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে কিছু সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হল।

অন্যদিকে ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে পেয়ে ব্রিটিশরা নতুন উদ্যমে সিরাজের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। কলকাতা থেকে উত্তরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে হুগলির প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার ভিতরে সুরক্ষিত ক্যাম্প বানিয়ে সিরাজের বাহিনীর আসার প্রতীক্ষায় রইল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী। মাদ্রাজ থেকে মেরামত হয়ে ফিরে এসেছে গোলা-বারুদবাহী জাহাজ মার্লবোরো। সুতরাং কামান বন্দুকের কোনও অভাব নেই। সিরাজের বাহিনী হুগলির উত্তরে নদী অতিক্রম করে এগিয়ে আসতে লাগল। আর একটা বাহিনী পুর্বদিকের তীর ধরে দক্ষিণে এগোতে থাকল। ক্লাইভের ভয় ছিল যে যখন নবাবের আর একটা বাহিনী পশ্চিমের তীর ধরে আসার সময় চন্দননগর অতিক্রম করবে তখন ফরাসি সৈন্যরা নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। যদিও ইউরোপের যুদ্ধের খবর এসে পৌঁছেছে তবুও গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল না ফরাসিরা। তা সত্ত্বেও অতিসাবধানি ক্লাইভ নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। পরিস্থিতি ব্রিটিশদের পক্ষে সুবিধাজনক থাকলেও সংখ্যার হিসাবে সিরাজের সৈন্য বেশি ছিল। ৩০শে জানুয়ারি রণজিৎ রাইএর উদ্যোগে ক্লাইভ সিরাজের কাছে শান্তির আবেদন জানাল। সিরাজ কিন্তু তার নিজস্ব ভঙ্গীমায় শান্তি আবেদনের প্রতি সমর্থন জানালেও অভিযান বন্ধ করার কোনও প্রতিশ্রুতি দিল না। সিরাজের বাহিনী এগিয়ে চলল অব্যাহত গতিতে। খাওয়াজা পেট্রাসের দৌত্যে দুই শিবিরে পত্র বিনিময় চলতে থাকল। ২রা ফেব্রুয়ারি কিছুক্ষণের জন্য অভিযান বন্ধ থাকায় মনে হল হয়ত সিরাজ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাময়িকভাবে অভিযান বন্ধ রেখে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। পরের দিন সিরাজের বাহিনী পূর্ণ গতিতে কলকাতার দিকে এগিয়ে চলল। রাস্তার দু’ধারের গ্রামগুলো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। চতুর ক্লাইভ সিরাজের বাহিনীকে বিনা বাধায় এগিয়ে আসতে দিল। দুপুরের দিকে সিরাজের বাহিনী উত্তরের স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে এগিয়ে এসে এমন জায়গায় পৌঁছলো যার একদিকে জলাভূমি আর অন্যদিকে ব্রিটিশ নৌসেনা। ক্লাইভের ফাঁদে পা দিয়ে বেশ কয়েকজন সৈন্য প্রাণ হারাল আর বন্দি হল প্রায় পঞ্চাশজন। সিরাজ যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিল। কিন্তু সিরাজের সৈন্যরা এগিয়ে চলল। এরকমই ঘটে প্রতিবার। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার এ এক কৌশল। শহরের উত্তরে ব্রিটিশ ক্যাম্পের পূর্বে এবং দক্ষিণ-পূর্বে শ’য়ে শ’য়ে নবাবের সেনা জড়ো হল। ক্যাম্পের প্রায় অন্তর্গত একটা বাগানে সিরাজের সৈন্যরা নিষেধসত্ত্বেও অনুপ্রবেশ করায় ক্লাইভের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। বেশ কিছু সৈন্য নিয়ে ক্লাইভ আক্রমণ চালাতেই সিরাজের সৈন্যরা গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করল। প্রায় একঘন্টা ধরে যুদ্ধ এবং বেশ কিছু রক্তপাতের পর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভ সৈন্যদের নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেল।

পরেরদিন অর্থাৎ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সিরাজের মূলবাহিনী এগিয়ে গেলেও সিরাজ নিজে কয়েক কিলোমিটার পিছনে নবাবগঞ্জ নামে একটা গ্রামে কঠোর নিরাপত্তা সহযোগে বিশ্রাম করছিল। ক্লাইভকে চিঠি পাঠিয়ে নবাবগঞ্জে প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাল সিরাজ। এই চিঠির জন্য গত দু’দিন ধরে অপেক্ষা করে ছিল ক্লাইভ। চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ালশ এবং স্ক্রাফটনকে সিরাজের কাছে পাঠানো হল। নবাবগঞ্জে পৌঁছে জানা গেল সিরাজ অন্যত্র অবস্থান করছে। ব্রিটিশরা যদি গোপনে তাকে বন্দি করার জন্য নবাবগঞ্জে সৈন্য পাঠায় তাই শেষ মুহূর্তে স্থান বদল করে ফেলেছিল সিরাজ। নবাবগঞ্জ থেকে নবাবের সেনা পরিবৃত হয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা সিরাজের কাছে পৌঁছে বুঝল যে প্রচুর সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিরাজ রয়েছে ব্রিটিশ ক্যাম্পের খুব কাছেই উমাচাঁদের বাগানবাড়িতে।

রণজিৎ রাই ওয়ালশ এবং স্ক্রাফটনকে রায়দুর্লভের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। রায়দুর্লভ প্রতিনিধিদের জানাল যে তাদের সন্দেহ হচ্ছে যে নবাবকে হত্যা করার কোনও পরিকল্পনা থাকতে পারে ব্রিটিশদের তাই তাদের সার্চ করে দেখা হবে যে লুকিয়ে তারা সঙ্গে করে পিস্তল নিয়ে যাচ্ছে কি না। এছাড়াও তারা সঙ্গে করে তরোয়াল নিয়ে যেতে পারবে না। ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা রায়দুর্লভের এই প্রস্তাবে সম্মত হল না। নবাবের অনুমতি নিয়ে রায়দুর্লভ এদের নবাবের কাছে হাজির করল। নবাবের পাশে বসে থাকা দীর্ঘ পোশাক এবং পাগড়ি পরিহিত বিশালাকৃতি রক্ষীদের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল তারা ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের হত্যার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। দুই প্রতিনিধি সিরাজকে জানিয়ে দিল যে শান্তি আলোচনা চলার সময় বিনা প্ররোচনায় ব্রিটিশ এলাকায় অনুপ্রবেশ করে নবাব ঠিক কাজ করেনি। নবাব প্রেরিত শান্তিপ্রস্তাব সে ক্ষেত্রে হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এরপর প্রতিনিধিরা তাদের লিখিত প্রস্তাব সিরাজের হাতে তুলে দিল। ক্রুদ্ধ সিরাজ সেই প্রস্তাব ভাল করে না পড়েই পাশে বসে থাকা এক আধিকারিককে ডেকে বলল এদের দু’জনকে দেওয়ানের কাছে নিয়ে যেতে। প্রতিনিধিরা সভাকক্ষ থেকে বেরতেই উমাচাঁদ তাদের ডেকে সাবধান করে দিল এবং জানাল যে নবাবেরর কামান যে কোনও মুহূর্তে তাদের পথ আটকে দাঁড়াতে পারে। প্রতিনিধিদের সন্দেহ হল দেওয়ানের কাছে গেলে তাদের বন্দি করে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে বলে বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে দু’জনে ঘুরপথে শিবিরে পৌঁছে গেল। ক্লাইভের কাছে তারা সবকথা বিস্তারিত ভাবে জানালো। সেই মুহূর্তে ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল আর দেরি নয় কাল সকালেই হানতে হবে অতর্কিত আক্রমণ । ৫ই ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে আগ্নেয়াস্ত্রসমেত ছ’শ সৈন্য জাহাজ থেকে নামল । তাদের সঙ্গে যোগ দিল সাড়ে ছ’শ ইউরোপিয়ান সেনা, এক’শ পদাতিক সৈন্য আর আট’শ সেপাই।ভোর হবার আগেই অভিযান শুরু করে দিল ক্লাইভ। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাইভের বাহিনী ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে উমাচাঁদের বাগানে পৌঁছে গেল। এদিকে মিরজাফরের নেতৃত্বে একদল সৈন্য উমাচাঁদের বাগানে রয়ে গেল সিরাজের নিরাপত্তার জন্য। বাকি সৈন্যরা কিছুটা অপরিকল্পিতভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল। উমাচাঁদের বাগানে যেতে যেতেই ক্লাইভের কানে এল বিশাল দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনীর পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার আওয়াজ। কুয়াশায় কিছু দেখতে না পেয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করল ক্লাইভের বাহিনী। কিন্তু সিরাজের সৈন্যরা ক্রমাগত উল্টোদিক থেকে গোলাবর্ষণ করতে থাকল। বাগানের দক্ষিণ থেকে মাইলখানেক আগে রাস্তাটা সরু হয়ে গেছে এবং রাস্তার পাশে ধানজমি। ধানজমির মাঝখানে আল দিয়ে জমি ভাগ করা আছে।সরু রাস্তা দিয়ে একটু এগোতেই নবাবের সৈন্যদের মুখোমুখি পড়ে গেল ব্রিটিশ সৈন্যরা। নবাবের সৈন্যদের আক্রমণ আর গোলার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাশের ধানক্ষেতে নেমে পড়ল ব্রিটিশ সৈন্যরা। কিন্তু অসমতল ধানজমি আর আলে বাধা পেয়ে কামানগুলো টানাই সম্ভব হচ্ছিল না তাদের। এই সুযোগে গোলাবর্ষণ বাড়িয়ে দিল সিরাজের সৈন্যরা। পিছু হটতে হটতে ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন নিজেদের দূর্গে পৌঁছলো তখন সকাল দশটা। সাতাশ জন সৈন্য এবং আঠারোজন সেপাই নিহত ও সত্তরজন সৈন্য এবং পয়ঁত্রিশজন সেপাই আহত হয়েছিল এই যুদ্ধে। নিহতদের মধ্যে ছিল দু’জন ক্যাপটেন। ক্লাইভের ব্যক্তিগত সচিব বেলসেরের একটি পা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল গোলার আঘাতে।

এই পরাজয়ে মনোবল ভেঙ্গে পড়ল ক্লাইভের সেনাপতিদের। ক্লাইভের মতো একজন অভিজ্ঞ এবং কুশলী সেনাধিপতি কী করে নিজের সেনাবাহিনীকে বিনা প্রয়োজনে এত বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিল সে কথা তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। নানা সন্দেহ তাদের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করল। এমনকি মাদ্রাজ কাউন্সিলে ক্লাইভের সহকর্মিরা ক্লাইভের যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতা সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন তুলতে শুরু করল। কিন্তু ক্লাইভ যুক্তি দিল যে তারা যে ভয় পেয়ে চুপ করে বসে থাকবে না সেটা সিরাজকে বোঝানোর জন্য অন্য কোনও রাস্তা ছিল না। এই অতর্কিত আক্রমণ তাদের দিক থেকে কিছুটা বেশি ঝুঁকির হলেও তারা যে প্রয়োজনে বড় ঝুঁকি নিতে পারে সে কথাটা সিরাজের মাথার মধ্যে ঢোকানোর দরকার ছিল। আসলে ঘটেছিলও তাই। ক্লাইভকে আপাতত প্রতিহত করা গেলেও সিরাজের মধ্যে ব্রিটিশদের শক্তি সম্বন্ধে যে ভুল ধারণা ছিল সেটা কেটে গেল। এই যুদ্ধে সিরাজেরও কম ক্ষতি হয়নি।বাইশজন ভালো অফিসার, ছ’শ সাধারণ মানুষ, চারটে হাতি, পাঁচ’শ ঘোড়া এবং বেশ কয়েকটা বলদ ও উট নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। সিরাজ একেবারে সামনে থেকে দেখেছে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা। যে কোনও মুহূর্তে তার জীবন বিপন্ন হতে পারত সে কথা সে ভালোভাবেই বুঝে গেছে। সে বুঝেছে মুখে আস্ফালন করলেও তার সেনাপতিদের মুরোদ আসলে অনেক কম। নিজের অফিসারেরা ক্ষমা না চাইলে এবং ভবিষ্যতে আর ভুল করবে না এই প্রতিশ্রুতি না দিলে তাদের বহিষ্কারের আদেশনামায় সই করেই ফেলেছিল সিরাজ। এদের না তাড়ালেও এই সমস্ত দুর্বলচিত্ত ভীরু অফিসারদের দিয়ে যে ক্লাইভের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না সিরাজ এই যুদ্ধে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ক্লাইভ হেরেছে তার নিজের ভুলের জন্য। এর জন্য তার সেনাপতিদের যে কোনও কৃতিত্ব নেই সে কথা সেনাপতিদের বলতে কসুর করেনি সিরাজ।

এমতাবস্থায় যা হওয়ার কথা তাই হলো। রণজিৎ রাইকে দিয়ে ক্লাইভের কাছে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব পাঠাল সন্ত্রস্ত সিরাজ। ক্লাইভ সাগ্রহে সম্মত হলেও এ কথা জানাতে ছাড়ল না যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যা করেনি। একমাত্র যারা তাদের সামনে এসে গিয়েছিল বা সামনাসামনি আক্রমণ করেছিল নিজেদের বাঁচার জন্য তাদের হত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা তার কাছে। চিঠি দেওয়া নেওয়া চলাকালীন ক্লাইভের প্রতি মানসিক চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সিরাজের দিক থেকে নিজের শক্তি ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্লাইভ শান্তির পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন রইল। অবশেষে ৯ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হল ঐতিহাসিক আলিনগর চুক্তি। এই চুক্তিতে সিরাজ তার সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের জন্য কোম্পানির যা ক্ষতি হয়েছে তার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হওয়া ছাড়াও কোম্পানির দূর্গ নির্মাণের ব্যাপারে সম্মতি দিল। এছাড়াও ব্রিটিশদের স্বর্ণ এবং রৌপ্যমুদ্রা বানানোতে তার যে কোনও আপত্তি নেই সে কথাও লেখা রইল এই চুক্তিতে। বাঙলায় করমুক্ত ব্যবসার অনুমতি ছাড়াও আটত্রিশটি গ্রামের মালিকানা লিখে দিল সিরাজ ব্রিটিশদের নামে। সিরাজের দিক থেকে মিরজাফর এবং রায়দুর্লভ এই চুক্তির সাক্ষী রইল। সিরাজের এই আকস্মিক এবং অপমানজনক পশ্চাদপসরণের আসল কারণ সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। ১১ই ফেব্রুয়ারি মিরজাফর এবং রায়দুর্লভকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে বেশ কিছু মাইল উত্তরে পিছিয়ে গেল সিরাজ এবং তার বাহিনী। ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার বার্তা সিরাজের আচার আচরণে বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পেতে লাগল। ব্রিটিশদের সঙ্গে আরও কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হল পরের দিন অর্থাৎ ১২ই ফেব্রুয়ারি।

শান্তিস্থাপনের প্রক্রিয়া চলাকালীন উমাচাঁদের মাধ্যমে ক্লাইভ সিরাজের কাছে জানতে চাইল যে চন্দননগরে ফরাসি উপনিবেশ আক্রমণের ব্যাপারে তার সম্মতি পাওয়া যাবে কি না। সিরাজ যদিও এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলনা কিন্তু সরাসরি এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করে জানাল যে যদি ফরাসিরা তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে তবে তাদের বাধাদানের ক্ষেত্রে তার কোনও আপত্তি নেই। সিরাজ এ কথাও জানালো যে কুড়িজন ব্রিটিশ সৈন্যকে সে তার নিজের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় এবং কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান ওয়াটসকে সে নিজের দরবারে স্থান দিতে পারে। সিরাজের কাছ থেকে চন্দননগর আক্রমণের ব্যাপারে কোনও সরাসরি আপত্তি না পেয়ে ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণের সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ক্লাইভের বাহিনী শুরু করল চন্দননগর অভিযান।
0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






ভূমধ্যসাগরের হাওয়াতেও অনবরত জীবন-মৃত্যুর ফানুস! হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা স্ট্রিপ থেকে ইসরায়েলের দিকে ছুটে এলো পর পর কতগুলো এরোপ্লেন। এই আক্রমণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণ! ইসরায়েলের মিলিটারি কমান্ডারের ওয়ারলেস-বার্তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো – ‘স্ট্রাইক! ডোণ্ট লুক বিহাইন্ড!’

প্রচন্ড শব্দ! গাজা শহরের ‘শোরেউক টাওয়ার’টা বালির পাহাড়ের মতো নিমেষেই ধ্বসে পড়লো। নাসিমা ভেঙে পড়া বিল্ডিং আর দাউদাউ আগুনের থেকে কিছুটা দূরে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে! পাশেই আলায়েনের রক্তমাখা শরীরটা। একটা অচেনা আঙ্কেল দৌড়ে এসে তার কাঁধে ঠেলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো – ‘হেই লেড়কী, ভাগ্‌ ভাগ্‌ হিয়াসে! সবাই যেদিকে পালাচ্ছে সেদিকে ভাগ্‌!’

চার দিকে ধূলোর ঝড়। আগুনের হলকায় গায়ের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে! বেশী কিছু বুঝে উঠবার আগে নাসিমা পালাতে শুরু করলো। ওদিকে ওর জিগরী দোস্ত আলায়েন যে রক্ত মেখে বারান্দায় শুয়ে আছে!



#

চারদিকে ভয়াবহ অবস্থা! ওরা থাকে শেরেউক টাওয়ারের একটা ফ্লাটে। গতকাল রাতে ঘুম আসার আগে নাসিমার নজরে এসেছিল - তার আম্মু আর আব্বুর মানসিক উত্তেজনা ভরা কথাবার্তা। যে কোন মুহূর্তেই এই গাজা শহরে আবার হামলা হতে পারে। এসব শুনতে শুনতে নাসিমা বিন্দাস ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

দিন-রাতের উত্তেজনা এ গাজা শহরে খুবই স্বাভাবিক! এর কারণ লুকিয়ে আছে ইহুদি-প্রধান ইজরায়েল, হামাস উপদ্রুত গাজা-স্ট্রিপ, প্যালেস্টাইন, আরব এসব দেশগুলোর দীর্ঘকালীন ইতিহাসে। শহরে আরো অনেকেরই মতোই নাসিমার আম্মা আব্বুরা আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটায়। অনেক রাত্রে তাদের চোখে ঘুম আসে না!

নাসিমার এখন ন’বছর। সামরিক অস্থিরতার জন্যে নাসিমাদের ইসকুল-টিসকুল সব বন্ধ! সেদিন ভোরের দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে ওর মা-বাবা টিভির নিউজ দেখছিল। তারই ফাঁকে মেয়েটা কখন যেন নিজে নিজেই নীচে নেমে এসেছে। তাদের ‘শোরেউক টাওয়ার’ পাশেই আরেকটা বিরাট টাওয়ার। নাসিমা জানতো, ওখানে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে আলায়েন। দশ বছর বয়েসী ছেলেটা, ওর দোস্ত। এটা ওদের রোজকার খেলবার জায়গা!

নাসিমা মুসলমান। কিন্তু ওর দোস্ত আলায়েন ইহুদী। তার পূর্বপুরুষেরা ইজরায়েল, মক্কা, জেরুজালেম এসব জায়গা ঘুরে ওরা গাজা শহরেই পাকাপাকি বাসা বেঁধেছে। আলায়েন আর নাসিমা কাছেই একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। ওরা থাকেও পাশাপাশি দুটো টাওয়ারে।

গাজা শহরটাতে ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ার তেতো গন্ধ! শুধু যুদ্ধ আর হানাহানি! হামাস কিংবা ইসরায়েলি হানাদারবাহিনীর সীমান্ত অনুপ্রবেশ লেগেই আছে!

এরই মধ্যে রোজকার মতো আলায়েন আর নাসিমা টাওয়ারের নীচের তালার ফাঁকা পেভমেন্টটাতে বসে খেলছিল। সামনের স্তুপ থেকে কিছু ইট পাথর জোগাড় করে ওরা দুজনে মিলে একটা দুর্গ তৈরী করেছিল। দুর্গের পাঁচিলে দুটো ছোট্ট ছোট্ট বন্দুকধারী সৈনিক আর একটা প্লাস্টিকের কামান।

খেলাঘরে বন্দুকধারী প্লাস্টিকের সৈন্যদুটোকে সাজাতে সাজাতে আলায়েন নাসিমাকে বলছিল – ‘বড় হয়ে তুই আমাকে বিয়ে করবি?’

খবরদারির ঢঙে নাসিমা বলে উঠলো – ‘তুই জানিস না? বাচ্চাদের বিয়ের কথা বলতে নেই!’

আলায়েন নাসিমার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আজ তোকে বাবা-মা’দের একটা সিক্রেট গল্প বলবো। প্রমিস, কাউকে বলবি না!’

তখনই এরোপ্লেনের তীক্ষ্ণ গর্জন! এগিয়ে আসছে কয়েকটা বোমারু বিমান!

তীক্ষ্ণ গর্জন মাথার উপরে! ওরা দুজন চেঁচিয়ে বললো – ‘মেঝেতে শুয়ে পড়, জলদি‌ - জলদি!’ নাসিমা আর আলায়েন প্লেনের শব্দ শুনতে পেয়েই আত্মরক্ষার কায়দায় শুয়ে পড়েছিল গ্রাউন্ডফ্লোরের পেভমেন্টে। এরকমটাই স্কুলে ওদের ট্রেনিং দেয়া আছে।

গাজা শহরটা ততক্ষণে সতর্ক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! ভয়ঙ্কর আওয়াজ! কাঁপুনি দিয়ে পায়ের নীচে মাটি যেন দুফাঁক হয়ে গেলো!

বালির খেলাঘরের মতো ঝুরঝুর করে খসে পড়লো নাসিমাদের ষোলো তলার বিশাল ইমারত – ‘শোরেউক টাওয়ার’!

তখনই একটা আর্ত চিৎকার – আলায়েনের! বিস্ফোরণের সাথে সাথে ভাঙা রাবিশের টুকরো, বড়ো বড়ো পাথরের ঢেলা অনুভূমিক ছুটে এসেছিলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ওরা যেখানে খেলছিল।

একটা ট্রমাতে হতভম্ভ হয়ে পড়েছিল মেয়েটা! কিছুক্ষণ পরে দুহাতের কনুইতে ভর দিয়ে নাসিমা মাথা তুললো। দেখলো, ওর দোস্ত আলায়েনের শরীরটা জমিতে উপুর হয়ে পড়ে আছে। মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। নাসিমা উঠে দাঁড়িয়ে ওর খেলার সাথীর হাত ধরে টানলো। একটু কেঁপে উঠে ফ্লোরে শুয়ে থাকা আলায়েনের শরীরটা স্থির হয়ে গেল।

প্রচন্ড উত্তাপে নাসিমার শরীরটা ঝলসে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে লোকগুলো পালাচ্ছে। ওদেরই একজন দেখলো গ্রাউন্ডফ্লোরের মেঝেতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আর পাশেই একটা ঘুমন্ত বালকের রক্তাক্ত শরীর! লোকটা ভীতার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। অচেনা আঙ্কেলটার হাতের স্পর্শ নাসিমার কাঁধে – ‘হেই লেড়কী, ভাগ্‌ ভাগ্‌ হিয়াসে! আবার বোমা পড়বে- মারা পড়বি।’

আলায়েনের দেহটাকে জমিনে একেলা ফেলে রেখে নাসিমা দিকশূন্যের মতো বেরিয়ে এলো বিল্ডিংটার পেভমেন্ট থেকে। কয়েক কদম এগোনোর পর নাসিমা বুঝতে পারলো তাদের নিজস্ব ফ্লাট সহ পুরো ‘শোরেউক টাওয়ার’টাই বসে গেছে। কোথায় তার আম্মু আর আব্বু? সে কিভাবে নিজের ঘরের দিকে ফিরে যাবে? সেখানে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে! তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার রাস্তা জুড়ে ভাঙ্গা বিল্ডিংটার ডাউস আবর্জনা, ডেবরিস। মাথা উচু করে তাকালেও ফ্লাটের কোনো ব্যালকনি, জানালা কিছুই দেখা যাচ্ছে না! শুধু ধোঁয়া আর ধূলোতে ঢাকা একটা নোংরা আকাশ! যেন নাসিমা অন্য কোন একটা অচেনা শহরে হারিয়ে গেছে। ছুটন্ত মানুষদের ভীড়ে আবার মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেলো। নিজেদের ধ্বসে যাওয়া বিল্ডিংটার অদূরে দাঁড়িয়ে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো!

সমস্ত লোক সামনের দিকে ছুটছে। নাসিফা আবার দৌড় শুরু করলো।

অল্প কিছুক্ষণ ছুটবার পর ক্লান্ত হয়ে ও একটা ল্যাম্পপোষ্টের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন দোকানদার সাটার বন্ধ করছিলো। সে তার বোতল থেকে ঢক্‌ ঢক্‌ করে জল গিলছিল। নাসিমার তেষ্টা পেয়েছে। তাকিয়ে তাকিয়ে সে দেখছিল ঐ লোকটার জল খাওয়া।

দোকানদারটা জল খাওয়া থামিয়ে নজর করলো। একলা দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটাকে! পরনে হাফ স্কার্ট। গায়ের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে গেছে। মেয়েটা ড্যাব ড্যাব চোখে গিলছে দোকানদারের হাতে ধরা জলের বোতলটাকে।

‘কি দেখছিস? আকাশ থেকে বোম পড়েছে! আরো পড়বে! আমাদের গাজার শহরগুলোয় ইজরায়েলী মিলিটারিরা ঢুকে পড়েছে। তোর সাথে আর কে কে আছে?’

মেয়েটার মুখে কোন কথা নেই।

‘জল খাবি?’

নাসিমা মাথা নাড়লো! অচেনা মানুষটার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে জল গিললো।

‘বাড়ি কোথায়?’

‘শোরেউক টাওয়ারে! আম্মু আর আব্বুকে খুঁজে পাচ্ছি না! আমাদের বাড়িঘর আগুনে জ্বলছে!’

‘তোর বাবা-মা নিশ্চয়ই আগে আগে গেছে। একতালা স্কুল বাড়িতে শেলটার নিতে পারে। সামনে এগিয়ে যা, খুঁজে দ্যাখ। এই নে!’ দোকানদার আঙ্কেল হাতের থলে থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো- ‘খিদে পেলে খাস! দেখছিস না? সবাই পালাচ্ছে। এখান থেকে জলদি ভাগ। সামনে স্কুল বাড়িটাতে বা অন্য কোথাও শেলটার পেলে ঢুকে পড়িস! যে কোনো মুহূর্তেই আবার বোমা পড়তে পারে!’

নাসিমা রাস্তায় নেমে সামনের দিকে আবার ছুটতে শুরু করলো। সে জানে না কোথায় তার নিরাপদ শেলটার। একটু আগে দেখা বীভৎস দৃশ্যগুলো সে তার মাথা থেকে মুছে ফেলতে পারছিল না! নাসিমার দুচোখ জলে ভরে এলো। মুহূর্তেই ও দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তায়।

তার পেছনে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল একজন বয়স্কা আন্টি। এই ফর্সা ফুটফুটে মেয়েটাকে পেছন ফিরে তাকাতে দেখে জোরালো গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো - ‘এই মেয়েটা, কাঁদিস না মা! আমাদের মেডিটারিয়ান সী-তে আগুন লেগেছে! প্রাণে বেঁচে থাকলে সব কিছুই ফিরে পাবি। এখান থেকে সামনের দিকে পালা!’

নাসিমার মনটা তখনো পেছনে। যেদিকে ওদের শোরেউক টাওয়ার।

এতক্ষণে সে প্রায় দু কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে। সামনেই দেখা যাচ্ছে ওদের প্রাইমারী স্কুলটা। সামরিক সতর্কতা হিসেবে প্রায় এক সপ্তাহ আগেই বাচ্চাদের স্কুলটাকে নোটিশ দিয়ে তালাবন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সামনের গেটে তালা ঝুলছে। তখনও কিছু লোক স্কুলের গেট আর উচুঁ পাঁচিল টপকে একতালার ছোটো ছোটো ঘরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।

রাস্তায় মানুষগুলো সামনের দিকে নিরাপত্তার জন্যে ছুটছে। এদেশে কোন আশ্রয়টাই বা নিরাপদ?

রাস্তার ছুটন্ত সেই সব লোকগুলোর হঠাৎ কানে এলো - ঝক্কর ঝক্কর শব্দ। অনেক দূর থেকে একটা ট্যাঙ্কার শুঁড় উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তেই রাস্তাটা আবার ফাঁকা। মানুষগুলো দোকান, পিলার, ঘরের দেয়াল, চৌবাচ্চার পেছনে। যে যার মতো জায়গা খুঁজে নিয়ে এদিকে ওদিকে লুকিয়ে পড়ছে।

সামনেই বিপদ, এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা খোলা নেই। ভয়ংকর একটা অবস্থা! আরো কয়েকজনের সাথে নাসিমা ডান দিকের একটা সরু রাস্তা ধরে টার্ণ নিলো। ধ্বসে যাওয়া দুটো বাড়ির ভগ্নস্তূপের মধ্য দিয়ে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে। রাস্তাটার উপর পড়ে রয়েছে ইট, পাথর, ঘরের আধা-পোড়া সরঞ্জাম। এই সব উত্তপ্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নাসিমা ছুটছে। পাথর রাবিশ আবর্জনার উঁচুনীচু ঢাই তার চপ্পল ভেদ করে দু’পায়ের পাতাদুটো পুড়িয়ে দিচ্ছে। মাটিতে নিভে যাওয়া আগুনের উত্তাপ। তার স্কার্টের নীচের দিককার অনাবৃত চামড়া আর মিহি পশমগুলো যেন এক্ষুনিই ঝড়ে পড়বে! এই উত্তাপ আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে সামান্য একটু এগোলেই, ওই তো দেখা যাচ্ছে পরিস্কার একটা মাঠ।

মাঠটা পেরিয়ে নাসিমা উঠে এলো আরেকটা মাঝারি সাইজের কংক্রীটের রাস্তায়। তার বাড়ি থেকে সে দৌড়ে দৌড়ে কতদূর এসে গেছে কে জানে? ও বসে একটু জিরিয়ে নিলো। এই রাস্তাটা পরিস্কার। দেখা যাচ্ছে দূরে একদল লোক। ওরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের পেছন পেছনে আবার হাঁটা শুরু করলো নাসিমা। মাঝে অনেকটাই দূরত্ব। ভূমধ্যসাগরের লোনা হাওয়ায় ঘেমে যাচ্ছে মেয়েটার শরীর। এই রাস্তার দুপাশে, এদিক ওদিকে ভাঙা ঘর বাড়ি।

হাঁটতে হাঁটতে নাসিমার মনে পড়ে গেল একে একে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো! একটা গুঁড়িয়ে যাওয়া ইমারত, তাদের ফ্লাটবাড়ী, টাওয়ারটা! তার নিত্যদিনের খেলার সঙ্গী আলায়েনের নেতিয়ে পড়া শরীরটা!

নাঃ, নাসিমা আর ভাবতেই পারছে না। ওর বেশ ক্ষিধে পেয়েছে। তার হাতে ধরা দোকানদার আঙ্কেলের দেয়া কেকের ছোট্ট প্যাকেটটা।

কত বেলা হলো? শহরের সমস্ত ঘড়িগুলো হয়তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন এইসব এলাকায় লাইট আর জল আসবে না। কয়েকমাস আগেও তো ইজরাইলের এরোপ্লেন তাদের পাম্প হাউজ আর পাওয়ার হাউজে বোমা ফেলে গেছে।

সামনে লোকগুলোকে অনুসরণ করে নাসিমা ছুটে চলেছে। আর কতক্ষণ তাকে চলতে হবে?

তক্ষুনিই পেছন থেকে ওর কানে ভেসে এলো একটা গাড়ির শব্দ! ছুটতে ছুটতেই কৌতূহলবশত নাসিমা ঘাড়টা পেছনে ঘুরিয়ে নিল। চলন্ত ট্যাঙ্কারটা মাঝ রাস্তার উপর থেমে গেছে। ওটার ভেতর থেকে রাস্তায় নেমে পড়েছে উর্দি হেলমেট আর রাইফেলধারী একটা মিলিটারি।

উর্দিটা চেঁচিয়ে উঠলো – ‘ইয়েস গার্ল! গো ফরোয়ার্ড! ডোন্ট লুক বিহাইন্ড! ডোন্ট লুক বিহাইন্ড!’

নাসিমা কিভাবে পেছনে না তাকিয়ে থাকতে পারে? তার মনে হচ্ছে - পেছনে ফেলে আসা শোরেউক টাওয়ারটা তাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে! আলায়েন তাকে পেছন থেকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে। দূর থেকে সে শুনতে পাচ্ছে তার মায়ের গলার স্বর। মা তাকে ডাকছে, ‘নাসিমা, নাসিমা, কোথায় গেলি তুই?’

নিজের অজান্তেই মেয়েটার মাথা আর শরীরটা পেছনে ঘুরে গেলো।

আবার সেই উন্মত্ত মিলিটারীটার গর্জন – ‘ডোন্ট লুক বিহাইন্ড! ......ফায়ার!’

একটা মাত্র গুলির শব্দ!

আর্তনাদ করে নাসিমার শরীরটা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। ছিটকে পড়লো এতক্ষণ হাতে ধরে থাকা তার হাতের কেকের প্যাকেটটা।

এই ভূমন্ডলের আরো অজস্র গোলাগুলির শব্দের মধ্যে এই মুহূর্তের শব্দটা উপরের ঘন বায়ুমন্ডলে মিলিয়ে গেলো।



#

সামনের রাস্তাটা একদম ফাঁকা। মিলিটারির ট্যাঙ্কারটা নাসিমার রক্তাক্ত দেহটাকে অবহেলায় পাশ কাটিয়ে অনেকটা দূরে মিলিয়ে গেছে।

পাশেই একটা মৃত মহাবৃক্ষ - সেখান থেকে উড়ে এলো দুটো পালক খসা জীর্ণ কাক। ওরা মেয়েটার রক্তাক্ত দেহটার কাছেই রাস্তায় পড়ে থাকা কেকটার পাশে বসলো।

কাকদুটো দেখলো – এইমাত্র নাসিমার গোলাপী প্রাণবায়ুটুকু আকাশে উড়াল দিচ্ছে!

আকাশে উড়াল দিতে দিতে ছোট্ট ন’বছরের নাসিমা কালো বোরখাতে মুখ ঢাকা একজন মুসলিম তরুণী হয়ে যাচ্ছে। মর্তলোক থেকে নাসিমাকে আকাশে উঠে আসতে দেখে আলায়েনের আত্মাটা এইমাত্র জীবিত হয়ে উঠলো। মুহূর্তেই সে ইহুদী পোষাক আর টুপিতে নিজেকে সুসজ্জিত করে নিলো। আলায়েন এখন আর সেই দশ বছরের বালক নয়। ভূমধ্যসাগরের লোনা হাওয়ায় সে একজন শান্তি প্রত্যাশী প্যালেস্টাইনী পুরুষ!

ধোঁয়াভরা আকাশটা। আলায়েন তার হাতের প্রিয় গোলাপ ফুলটাকে নাসিমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। নাসিমাকে বলছে – ‘শুনবি না? বাবা-মা’দের সেই সিক্রেট গল্পটা?’

যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলে চলছে বোমারু বিমান আর হানাদারদের গোলাগুলি শব্দ! তারই মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ায় হাওয়ায় জাতিহীন বর্ণহীন ভেসে ভেসে চলছে একজন বালক আর একটা বালিকার সদ্য-নিষ্ক্রান্ত আত্মার কিছু আন্তরিক সংলাপ। তাদের সেইসব প্রেমময় সংলাপ, বিস্তীর্ণ পৃথিবীর মানুষ, তোমরা কি কিছুই শুনতে পাচ্ছো না?
0

গল্প - সুস্মিতা হালদার

Posted in




















(এক)

সকাল থেকে একটা ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছে, ফেসবুকে। আর তা নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কেচ্ছা চলছে গোটা সোশ্যাল মিডিয়া জগতে। দুধে-আলতা রঙের একটা চিকন শিফন শাড়িতে একটি মেয়ে। বয়েস এই বাইশ-তেইশ হবে। কাপড়ের গোলাপ বসানো শর্ট স্লিভ ব্লাউজ়ে। ক্লাচার দিয়ে আলগাভাবে আঁটা পশমের মতো হালকা-বাদামি চুলগুলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে কাঁধের কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে একজন বছর চল্লিশ-পঞ্চাশের ‘ভদ্রলোক’। একটা সি গ্রিন কালারের এক্সিউভি গাড়িতে আলগাভাবে ঠেস দিয়ে মেয়েটা তাকিয়ে রয়েছে অন্যদিকে। পাশের লোকটির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। লোকটি বারবার চেষ্টা করেই চলেছেন তাঁর দিকে মুখ ফেরাতে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে রাখা গাড়িটা। লালফুলে ঢেকে আছে রাস্তাটা। গাড়ির ওপরও পড়ে রয়েছে কিছু ফুল। এমন একটা রোমান্টিক মুহূর্তের দুটো অসম বয়েসি নারী-পুরুষের প্রেম কার চোখ এড়াতে পারে? লোকটির মুখটা দেখা যাচ্ছিল না প্রথম দিকে। ক্যামেরাম্যানের দুর্ভাগ্য সেটা। মেয়েটিকেই দেখা যাচ্ছিল শুধু। বৃষ্টিভেজা একটা বিকেল। মেয়েটির মুখটাও অভিমানের মেঘে ঢাকা।

এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। ভিডিওটাতে দুটি চরিত্রের কারোর কোনও কথা শোনা যাচ্ছে না। মিউজ়িকে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। মানভঞ্জনের পালা চলতে চলতে হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে যায়। মেয়েটির অভিমানের মেঘ গাঢ় হতেই সে চলে যেতে চায়। লোকটি জোর করে কাছে টানেন তাকে। টাল সামলাতে না পেরে মেয়েটি লোকটির প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়ে। তখনই ফাঁস হয়ে যায় লোকটির পরিচয়। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব চিরদীপ ভট্টাচার্য বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত? তাও আবার একটা ‘হাঁটুর বয়েসি’ মেয়ের সাথে? মুখরোচক খবর ছড়িয়ে পড়তে কি আর দেরি হয়?

(দুই)

ভিডিওটা ‘ভাইরাল’ হওয়ার পর থেকে অনেকবার করে দেখছি জানেন। নিজের ভিডিও তো। বাবা অভিনয় জগতে থাকলেও আমি তো আর সে জগতে থাকতে পারলাম না। মা-বাবার ডিভোর্সের পর আমি রয়ে গেলাম মা’র কাছে। বাবা নতুন বিয়ে করলেন। নতুন সংসার টিকিয়ে আমার সাথে আর ওঁর দেখা হয় কতটুকু? তাও যেটুকু হয়, বাড়ির বাইরে। আমাদের বাড়িতে যে বাবা ঢুকবেন না! অবশ্য মাও ঢুকতে দেবেন না। মাও তো আবার বিয়ে করেছেন, ডিভোর্সের পর, অন্য একজনকে, যিনি সমাজে বাহ্যিকভাবে আমার বাবা হিসেবে পরিচিত হলেও আমি ভালোবাসি ওই মানুষটাকেই... যাঁকে আমার প্রেমিক বানিয়ে কোনও অজ্ঞাত ক্যামেরাম্যান এমন সুন্দর একখানা ভিডিও উপহার দিলেন। আমি তো তাঁরই সৃষ্টি, তাঁরই ‘সাধের সাধনা’। উগ্র একটা ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজ়িকে ভালোই বানিয়েছেন, যার পরতে পরতে ঝরে পড়ছে নারী-পুরুষের যৌনতা। ডাউনলোড করলাম ভিডিওটা। এডিটিং সফটওয়্যারে বসালাম। ট্রোল্ড হতে বেশ ‘মজাই’ লাগছিল, জানেন। আমার বাবাও দেখেছেন, মানে আপনাদের মিস্টার নীল ওরফে নীলাঞ্জন। চাইলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাল্টা জবাব দিতেই পারতাম। থাক না, লাভ কী?

ভিডিওটা এডিটিং সফটওয়্যারে অ্যাড করে, ওই উগ্র মিউজ়িকটা অফ করলাম। অন্য একটা গান দিলাম। বাবা-মেয়ের ‘মিষ্টি সে পিছু ডাক’-এর গান।

“আয়রে আমার কাছে আয় মামণি
সবার আগে আমি দেখি তোকে
দেখি কেমন খোঁপা বেঁধেছিস তুই
কেমন কাজল দিলি কালো চোখে।”

মনে পড়ে, বাবা-মেয়ের সেই কালজয়ী জুটির কথা? ভিডিওতে দেখা যায়, বাবা তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে। একহাতে আমার হাতটা ধরা। আলতো করে আমার মাথাটা টেনে নিচ্ছে নিজের বুকে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমার চুলগুলো উড়ছে। বাবা আলতোভাবে আলগোছে গুছিয়ে দিচ্ছে সেগুলো আমার পিঠে। বাবার গাল ঠেকে আছে আমার কপালে। বর্ষার বিকেলের পড়ন্ত রোদ পড়েছে দুজনের মুখে। ভেজা বাতাসে মিশে সেই সুর ছুঁয়ে যাচ্ছে পর্দার দুই অসম বয়েসি নারী-পুরুষকে...

“ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে
সবাই আমার মতো বড় হয়ে যায়
জানিনা কজনে আমার মতন
মিষ্টি সে পিছু ডাক শুনতে যে পায়
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।”
11

গল্প - ময়ূরী মিত্র

Posted in






শীতের সন্ধেতেও আজ গরম ৷ রোগীর ঘরের জানলাগুলো হাট করে খুলে দিয়েছেন সেবিকা ৷ তাঁর রোগী বড়ো ঘামে আর ঘেমে গেলেই আর্তনাদ করতে থাকে ৷ খুব মোটা তো -- ঘামে বড়ো হাঁফায় মানুষটা ৷ রোগীর মুখটা ভালো করে মুছিয়ে কপালের ঠিক মধ্যখানে একটা অর্ধ চাঁদের মতো লাল টিপ পরিয়ে দেন ৷ ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক ৷ রোগীর এই দুটিই শখ --গোল নয় --চাঁদের মতো দেখতে যুবতীদের টিপ এবং ঠোঁটরঙ ৷ সেবিকা বোঝেন --টিপ আর লিপস্টিক পরে বুড়ি মানুষটা কিছুসময় হয়ত ফেরত চায় তার যৌবন --তার সমর্থ দুটো পা ৷ সেবিকার রোগীর মূল রোগ --তিনি পদক্ষেপ হারিয়েছেন ৷ পা থাকতেও কী করে পা ফেলে ফেলে হাঁটতে হয় ভুলে গেছেন ৷ তাঁর এখনকার স্মৃতিবিন্যাস ঠিক এতখানিই বিট্রে করেছে তাঁর সঙ্গে ৷
আবার যখন ফুর্তি আসে --- স্বামী এসে চুলে হাত বোলান তখন একগাল হেসে স্বামীর সঙ্গে গাদাখানেক ঝগড়া করেন রোগী ৷ সেবিকার বাড়ির গাছপাতাটির অব্দি খোঁজ নেন বুড়ি ৷ এই যেমন আজ সকালে সেবিকা যখন রোগীর চুল বব করে কেটে শ্যাম্পু দিয়ে মাথা সাফ করে দিচ্ছিলেন -- কত যে কথা কইছিল সারা দিনমান স্তব্ধ হয়ে থাকা রোগী ৷
----- হ্যাঁ রে --এমন পুকুর পুকুর চোখ তোর --মোটা করে কাজল দিস না কেন রে ? কাজল দিবি ৷ স্মৃতি চলে যাওয়া রোগী অদ্ভুত উপমায় সেবিকার চোখ সাজান ৷ কমন শব্দে বোধহয় বিরাগ আছে রোগীটির ৷
সেবিকা মৃদু হাসেন --কে কিনে দেবে কাজল ?
রোগী -- আমি ৷ ঐ যে দ্যাখ -- আমার মেয়ের ড্রইং পেন্সিলের বাক্স ৷ ওখান থেকে যে কোনো রঙের পেন্সিল নিয়ে নে ৷ বা তুলি নে আর ওই হলুদ রঙের জলরঙ নে ৷ তুলি চুবোবি আর চোখে টানবি ৷
রোগীর খ্যাপাটে কথায় সেবিকার শরীরে এক অচেনা আনন্দ জাগে ৷ নতুন কাটা ববে হাত বুলোতে বুলোতে সেবিকা বেমালুম ভুলেই যান --বিয়ে না দিয়ে বাড়ির লোক তার রোজগার সবটা খেয়ে ফেলছে ৷ মনের ভুলে বাবাকে ফোন করে বসেন ---বাবা সব ভাই বোনকে জমির ভাগ দিলে ৷ আমারটা এবার দেবে গো বাবা ? সেই ভাগ দিয়ে আমি কলকাতায় বাড়ি করব ৷ সেই বাড়িতে তুমি আমি আর মা ই তো থাকব বাবা ৷ দেবে আমার ভাগটা ? একটা ছোট বাগানও করে দেব বাবা তোমায় ৷
সকালবেলার ফোনের উত্তর এসে যায় সন্ধেতেই -----বিয়ে থা করিস নি ৷ তোর নিজের বাড়ি বাগান কী দরকার ? কাদের জন্য দরকার ? এই রোগীর বাড়ি টানা কাজ করছিস ৷ টাকাগুলো জমা ৷ বয়স হলে গ্রামের বাড়িতে ভাইদের কাছে এসে থাকবি --জমানো টাকা থাকলে ভাইপোরা দেখবে ৷
ফোনটা পাওয়ার পর থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছেন সেবিকা ৷ বসে আছেন তো বসেই আছেন ৷ বাবাকে বলা হয়নি ---এই মাস অব্দি রোজগারের আধাভাগ বাবা ভাইয়ের সংসারে পাঠাতে হয়েছে ৷ ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলার অভ্যেস তো করেননি কখনো ৷
রোগীর চিৎকারে হুঁশ ফেরে ৷ সেবিকা প্রথম ভাবেন -- পেটুক মানুষটা চা মুড়ির জন্য হাত ছুঁড়ছেন ৷ চা এনে দিলেন ৷ রোগী আর থামে না ৷ অন্ধকার বারান্দায় কী যেন দেখাচ্ছেন ৷ অনেকক্ষণ ধরে রোগীর ফুলো দুটো হাত খেয়াল করেন সেবিকা ৷ দুই হাত দিয়ে বারান্দার একটা ফুলের গাছকে দেখাচ্ছেন রোগী ৷ ফুলগাছের গোড়ায় একটা ঝরে পড়া ফুলকে দেখছেন আর যুক্তাক্ষর ভেঙে গোটা গোটা করে বলছেন ---বাচ্চাটা ---বাচ্চাটার একটা চোখ খু খু খুলে পড়ে গেছে তো ৷ তুলে ডালে লা লা লাগিয়ে দে ৷ লা লাগিয়ে দে বলছি ৷ নইলে মারবে ওর ওর মা ৷
সেবিকা বুঝতে পারেন না এত রেগে যাওয়া রোগীকে শান্ত করবেন কী করে ! একটি ফুল ঝরে যাওয়াতে মানুষের এমন রাগ তো কখনো দেখেননি তিনি ৷ বারবার বলেন ---কার বাচ্চা ! ও তো গাছ ৷ উত্তেজনায় রোগীর কথা ফের আটকায় --ম ম মাটির বাচ বাচ্চা ৷ অবাক হয়ে এতদিনের রোগীকে দেখতে থাকেন সেবিকা ৷ দেখতে দেখতে সামনের মানুষটির বব মুণ্ডু নিজের ভারী দুটো বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন ৷ রোগীর পুরো শরীরটা দোলাতে দোলাতে বলেন ---ও বেবি --ইউ আর স্মল বেবি ৷
সেবিকা স্থিরপ্রতিজ্ঞ --এবার ভাড়াবাড়িতেই ঠাকুরের আসন পাতবেন ৷বেশ কিছু টাকা দিয়ে খাঁটি তসরের আসন কিনবেন ৷ আর তাতে সবুজ জরিপাড় সেলাই করে নেবেন ৷ আছছা রোজ তো ডিউটিতে বেরিয়ে যেতে হবে ৷ ফুল যদি শুকিয়ে যায় --তার চেয়ে রামকৃষ্ণকে সবুজ গাছ দিয়ে সাজিয়ে দিলে কেমন হয় ! ভিজে মাটির রস খেয়ে দেবসাজ ফুটবে খুব ৷ খুব ৷
জানতে পেরে আকাশের তারারা বলে
--বেশ বেশ ৷
তোমার ঠাকুর গ্রামের মানুষ ৷
সে খুউব গরীব মানুষ ৷
তাকে দেখতে একদিন নাহয় যাব তোমার বাড়ি ৷
সেবকের আরতি নিশ্চয় পথ চিনবার পর্যাপ্ত আলো দেবে ৷
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















ষষ্ঠ পর্ব

ওয়াটসন এবং ক্লাইভের কলকাতা পুনর্দখল।

মাদ্রাজ কাউন্সিল তখন অপেক্ষা করছিল ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতির সংবাদের জন্য। সে সংবাদ অবশ্য এসে পৌঁছেছিল অনেক পরে। এই অপেক্ষার অন্যতম কারণ ছিল যদি ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা খুব শীঘ্র হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে ওয়াটসন এবং ক্লাইভকে দরকার পড়বে করমন্ডল উপকূলে। অবশেষে মাদ্রাজ কাউন্সিলের বৈঠকে ঠিক হল যে সমস্ত খরচের হিসাব রাখার দায়িত্ব থাকবে ক্লাইভের ওপর। মার্লবোরো এবং ওয়ালপোল এই দু’টি বড় জাহাজের জন্য আপাতত ২ লক্ষ টাকা করে ৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হল। ক্লাইভকে বলা হল অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হলে খরচের সঠিক হিসাব নিকাশ সমেত কলকাতা কাউন্সিল বা মাদ্রাজ কাউন্সিলের কাছে আবেদন জানাতে। টাকার অভাব হবে না। কলকাতা উদ্ধার করতেই হবে। ক্লাইভে সঙ্গে পাঠানো হল দু’টি চিঠি। একটি মাদ্রাজ কাউন্সিলের প্রধানের এবং অন্যটি হায়দ্রাবাদের নিজাম শালাবাত জঙ্গের। এই চিঠি দু’টি সঠিক সময়ে সিরাজের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। সঠিক সময়টি কখন সেটির সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব ক্লাইভের উপর দেওয়া হল। এছাড়াও ক্লাইভকে দেওয়া হল তৎকালীন মোগল সম্রাট ফারুখশায়ারের স্বাক্ষর সম্বলিত ফরমানের স্বাক্ষরিত প্রতিলিপি। সঙ্গে দেওয়া হল মোগলরাজের দরবার থেকে বিভিন্ন সুবেদারকে দেওয়া চিঠির প্রতিলিপি যাতে লেখা আছে ব্রিটিশদের যেন দেশের সর্বত্র চুক্তিঅনুযায়ী প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ সুবিধা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনওরকম বাধার সৃষ্টি করা না হয়। ক্লাইভের যাত্রা হল শুরু।

যাত্রা শুরু হতে না হতেই সেনাবাহিনীর ভিতর থেকে বাধার সম্মুখীন হতে হল ক্লাইভকে। ৩৯তম রেজিমেন্টের কর্নেল জন আল্ডারক্রন বেঁকে বসল যে সে ক্লাইভের নেতৃত্ব মেনে নেবে না। কারণ ক্লাইভ তার থেকে জুনিয়র এবং ক্লাইভ লেঃ কর্নেলের পদমর্যাদা পেয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। আল্ডারক্রন তার রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ন্ত্রন ক্লাইভের হাতে দিতে চাইল না। শুধু তাই নয় যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র জাহাজে তোলা হয়েছে সে সমস্ত নামিয়ে নেওয়ার জন্য জেদ করতে লাগল। সরকারি সেনাবাহিনীর একটা অংশ অনেক আগেই কলকাতা চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার কারণ ছিল কলকাতার নিরপত্তা জোরদার করা। তখনও সিরাজ কলকাতা দখল করেনি। কিন্তু এখন আল্ডারক্রন ক্লাইভের নিয়ন্ত্রনে সেনাদের ছাড়ার ব্যাপারে বেঁকে বসল। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন অবস্থার সামাল দিলেন এই বলে যে তিনি সরাসরি তাঁর নিজের নেতৃত্বে জল ও স্থলবাহিনীর একটি যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন। আল্ডাররক্রনের সেনারা একটি অভিযানের অংশহিসাবে যোগ দেবে। সেক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রন ক্লাইভের কাতে থাকবে না। অবশেষে ১৬ই অক্টোবর ,১৭৫৫ এক বিশাল যুদ্ধজাহজের বাহিনী মাদ্রাজ থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

যে সমস্ত জাহাজ এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল সেগুলি হল,

কেন্ট – ৬৫ রাজসেনা, ৭৭ কোম্পানি সেনা এবং ৫৯জন সেপাই ও লস্কর।

কাম্বারল্যান্ড- ৯৭ রাজসেনা, ১৫০ কোম্পানি সেনা, ৬৭জন সেপাই ও লস্কর।

টাইগার- ৫৬ রাজসেনা, ১৪৬ কোম্পানি সেনা, ৭০জন সেপাই ও লস্কর।

সালিসবেরি- ৫৮ রাজসেনা, ১৪৭ কোম্পানি সেনা, ৫৭জন সেপাই ও লস্কর।

ব্রিজয়াটার- ৯৬ কোম্পানি সেনা

ওয়ালপোল- ৪১৩ সেপাই ও লস্কর

মার্লবোরো- ৩৬০ সেপাই ও লস্কর

প্রোটেক্টর – ১৩২ সেপাই ও লস্কর

ল্যাপউইং- ৯০ সেপাই ও লস্কর

বোনেটা- ৬০ সেপাই ও লস্কর

এছাড়াও কিছু ছোট দুইমাস্তুল বিশিষ্ট জাহাজ। সব মিলিয়ে ২৭৬ রাজসেনা, ৬১৬ কোম্পানি সেনা এবং ১৩০৮ জন সেপাই ও লস্কর।

যাত্রা শুরু হবার দু-তিনদিনের মধ্যেই খারাপ আবহাওয়ার মুখোমুখি হতে হল এই জাহাজবাহিনীকে। সুতরাং ঘুরপথে তানাসারি এবং আরাকান হয়ে উত্তরে ঝোড়ো হাওয়া এবং নাব্যতাজনিত নানা বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে জাহাজবাহিনী এগিয়ে চলল বালাসোরের দিকে। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক দেরি হওয়ার জন্য টান পড়ল খাবার এবং জলের ভাঁড়ারে। ১০ই নভেম্বর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন খাবার এবং জলের ওপর নিয়ন্ত্রন শুরু করলেন। দু’দিন পরেই একটি আগুনের সরঞ্জামবাহী একটি জাহাজ ঝড়ের দাপট সহ্য করতে না পেরে শ্রীলঙ্কার পথে পাড়ি দিল। ১৬ই নভেম্বর অস্ত্রবাহী জাহজ মার্লবোরোতে দেখা গেল যান্ত্রিক ত্রুটি। দলছুট জাহাজ মার্লবোরো ত্রুটি সারানোর জন্য চলে গেল মুম্বাই বন্দরের উদ্দেশ্যে। বাকি জাহাজগুলি ১লা ডিসেম্বর এসে পৌঁছলো বালাসোরের কাছে হুগলি নদীর মুখে। হাওয়ার সঙ্গে যুঝতে না পেরে সালিসবেরি এবং কাম্বারল্যান্ড বালাসোরের বেশ কিছু আগে আটকে গেল বালিতে। অনেক চেষ্টায় আবার যাত্রা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র হাওয়ায় কাম্বারল্যান্ড ভেসে গেল ভাইজ্যাগের দিকে। কেন্ট এবং টাইগার হাওয়ার গতিবিধি অনুকুলে আসার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করে ব্রিটিশ পাইলটদের সহযোগিতায় ৯ই ডিসেম্বর রওনা দিয়ে ১৫ই ডিসেম্বর ফলতা পৌঁছল। কাম্বারল্যান্ড এবং মার্লবোরো ছাড়া সবক’টি জাহাজই ২০শে ডিসেম্বরের মধ্যে এসে গেল। এই দু’টি বড়জাহাজের অনুপস্থিতি অভিযানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। প্রায় ২৫০ রাজসেনা এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আটকে রইল এই জাহাজ দু’টিতে।

অবশেষে নববর্ষের পরেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আবার কলকাতা দখল করে নিল ব্রিটিশেরা। ভীতসন্ত্রস্ত মানিকচাঁদ প্রথমদিকে খানিকটা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও অবশেষে প্রাণের দায়ে পালিয়ে বাঁচল। ফলতা পৌঁছোবার কয়েকদিনের মধ্যেই ক্লাইভ নিজের এবং ওয়াটসনের লেখা দুটি ভয় দেখানো চিঠি এবং তার সঙ্গে মাদ্রাজ থেকে আনা চিঠিগুলি মানিকচাঁদের হাতে দিয়ে সিরাজকে পৌঁছে দেবার কথা বলল। মানিকচাঁদ এই ধরণের দুর্বিনীত ভাষায় লেখা চিঠি নিতে শুধু অস্বীকারই করল না উপরন্তু প্রতিআক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দিল। কাম্বারল্যান্ড না পৌঁছোনোর জন্য যে সৈন্যসংখ্যার ঘাটতি ছিল ফলতা থেকে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য পূর্বে পাঠানো কয়েকজন সৈন্যকে নিয়ে ২৭শে ডিসেম্বর হুগলী নদীতে রণতরী ভাসিয়ে দিল ক্লাইভ এবং ওয়াটসন । ২৮শে ডিসেম্বর বজবজ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মায়াপুরে এসে পৌঁছলো ব্রিটিশ রণতরী। ওয়াটসনের নেতৃত্বে নদীবক্ষ থেকে জলপথে এবং ক্লাইভের নেতৃত্বে স্থলপথে সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা ব্রিটিশদের।নদীতীর থেকে প্রায় ষোল ঘন্টা অভিযান চালিয়ে স্থলবাহিনী শহরের প্রান্তে এসে পৌঁছল। ক্লান্ত সেনাবাহিনী নিজেরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে ভেবে কোনওরকম সাবধানতা অবলম্বন না করে আক্রমণ শুরু করার আগে একটু নিচু দেখে একটা জায়গায় সকলে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। কিন্তু একঘন্টার মধ্যেই অতর্কিত আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ল ক্লাইভের সৈন্যরা। কলকাতার দক্ষিণদিক থেকে আসা মানিকচাঁদের সৈন্যবাহিনী ব্রিটিশ সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পালাবার পথ না পেয়ে পিছু হটতে লাগল ব্রিটিশ সেনারা। কয়েকজন মারা গেল, বেশ কিছু সৈন্য আহত হল। কিন্তু ক্লাইভও যুদ্ধ ছেড়ে পালাবার লোক নয়।কিছুক্ষণের মধ্যেই বেয়নেট হাতে প্রতিআক্রমণে এগিয়ে এল ব্রিটিশ সেনারা। আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে চলল ব্রিটিশ সৈন্যরা। মানিকচাঁদের নেতৃত্বে উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা অশ্বারোহী সৈন্যরা গুলিবর্ষণ হচ্ছে দেখে একটু থমকে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মানিকচাঁদের পাগড়ির পাশ দিয়ে প্রায় কান ঘেঁসে উড়ে গেল একটা গোলা। মুহূর্তের মধ্যে মানিকচাঁদের নির্দেশে পিছু হটল সেনাবাহিনী। মানিকচাঁদের ঘোড়া একদৌড়ে এসে থামল কলকাতায়। সেই রাত্রেই দুর্গ দখল করে নিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। এই দুর্গ দখলের পিছনে একটা গল্প আছে। ক্যাপটেন আয়ার কুটের কথা ছিল দুর্গ আক্রমণের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপটেন কুট ক্লাইভের অনুমতির অপেক্ষা করছিল।কিন্তু ক্লাইভের অনুমতি নির্ধারিত সময়ে এসে পৌঁছলো না। প্রায় সন্ধ্যা সাতটার সময় দুর্গের গেট ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকার জন্য ক্লাইভের অনুমতি এসে পৌঁছল। প্রস্তুতি নিশ্ছিদ্র এবং পাকাপাকি করার জন্য এই অতিরিক্ত সময় নিয়েছিল ক্লাইভ। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলে নিঃশব্দে কেন্ট নামের যুদ্ধজাহাজ থেকে দুটি বড় কামান নামিয়ে আনা হল। কামান দুটি সঙ্গে নিয়ে ২০০ সেপাই এবং ১০০ নৌসেনা সঙ্গে নিয়ে দুটি বড় বাহিনী এগিয়ে চলল দুর্গের দিকে। এই আক্রমণের নেতৃত্বে ছিল ক্যাপটেন কুট। কিন্তু ইতিমধ্যে যুদ্ধজাহাজ থেকে কামান নামানোর সময় একজন নৌসেনা মত্ত অবস্থায় দলছুট হয়ে আগেভাগে দুর্গের দরজায় পৌঁছে কোমরের পিস্তল বের করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করে। এইসব শুনে সৈন্যরা ক্যাপটেন কুটকে পিছনে ফেলে রেখে হৈ হৈ করে দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়ে। আশ্চর্যজনকভাবে বিনা বাধায় দুর্গ দখল করে নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। ইতিহাসে কিন্তু এই দুর্গ জয়ের নায়ক হিসাবে ক্যাপটেন কুটের নামই লেখা রইল। এদিকে মানিকচাঁদ বজবজ থেকে পালিয়ে এসে মাত্র ৫০০ জন সৈন্যকে আত্মসমর্পণের উপদেশ দিয়ে দুর্গে রেখে হুগলিতে এসে সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা জানিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ছ’মাস আগে ব্রিটিশ সেনাদের সম্বন্ধে যে অবজ্ঞাজনক কথাবার্তা বলেছিল সেগুলো গিলে নেওয়া করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু করার ছিলনা মানিকচাঁদের। ৩০শে ডিসেম্বর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বজবজ থেকে তান্না ফোর্টের কাছকাছি একটা জায়গায় নোঙ্গর করে একটাও গুলি খরচ না করে বিনাবাধায় তান্না ফোর্ট দখল করে নিল। যদিও বেশ কয়েকটা কামান রাখা ছিল এদিক ওদিক কিন্তু সেগুলো চালানোর কোনও লোক ছিলনা। মানিকচাঁদের কাছ থেকে ব্রিটিশদের হাতে নাজেহাল হওয়ার খবর পেয়ে আগেভাগেই পাততাড়ি গুটিয়েছে তান্না ফোর্টের রক্ষীবাহিনী।

২রা জানুয়ারি ক্লাইভ হুগলির পূর্বতীরে আলিগড়ে নেমে বিশাল সেনাবাহিনী সঙ্গে করে কলকাতার দিকে রওনা হয়ে গেল। সকাল ন’টা নাগাদ যুদ্ধজাহাজ কেন্ট এবং টাইগার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করে ফোর্ট উইলিয়মের ঘাটে নোঙ্গর করল। হাওয়ার গতিবিধির সমস্যার জন্য সঠিক অবস্থানে নোঙ্গর করতে অসুবিধা হচ্ছিল নাবিকদের। এই সুযোগে হুগলি নদীতে টহলরত সিরাজের সৈন্যরা গোলা ছুঁড়ে কেন্ট-এর ৯জন এবং টাইগারের ৭ জন সৈন্যকে খতম করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটিশ রণতরী থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে গোলা ধ্বংস করে দিল সিরাজের রণতরীগুলো। ১১টার কিছু আগে নবাবের সেনাবাহিনীর একজনও রইল না দুর্গে তথা কলকাতায়। ব্যান্ড বিউগিল সহযোগে ব্রিটিশ পতাকা উড়িয়ে দুর্গ বিজয় ঘোষণা করল লর্ড ক্লাইভ। পরের দিন ড্রেক এবং কাউন্সিলের পুরনো সদস্যদের ডেকে তাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিল অ্যাডমিরাল ওয়াটসন। একসপ্তাহের মধ্যে হুগলি আক্রমণ করে সিরাজের অবশিষ্ট সেনাঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে ক্লাইভ। কলকাতা এবং কলকাতার পার্শ্ববর্তী সমস্ত এলাকা নবাবের সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করল ক্লাইভ এবং ওয়াটসন । পরের কাজের দায়িত্ব পুনর্গঠিত কলকাতা কাউন্সিলের।