গল্প - প্রদীপ ঘটক
Posted in গল্পগল্প - তপন রায়চৌধুরী
Posted in গল্পগল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পঅষ্টম পর্ব
ক্লাইভের চন্দননগর দখল
কলকাতা থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার উত্তরে হুগলি নদীর পশ্চিমপাড়ে ঘাঁটি গেড়ে যখন ব্রিটিশবাহিনী চন্দননগর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত তখন গত্যন্তর না দেখে ফরাসিরা সিরাজকে একের পর এক চিঠি পাঠাতে শুরু করল। সিরাজ তখন মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। ফরাসিদের বক্তব্য পরিস্কার। সিরাজ যেমন নিজের নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ তেমনি ফরাসিদের নিরাপত্তার জন্য তার পদক্ষেপ নেওয়াও ততটাই জরুরি। খবর কানে আসা মাত্রই সিরাজ ব্রিটিশদের জানিয়ে দিল বলা ভাল একরকম আদেশ দিল যে এই অভিযান যেন এই মুহূর্তে বন্ধ করা হয়।
এদিকে ওয়াট ততক্ষণে সিরাজের অনুরোধ রক্ষার ভান করে কুড়িজন সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সিরাজ একদিকে যেমন ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে উদগ্রীব অন্যদিকে ব্রিটিশদেরও দেখাতে চায় যে সে তাদের সঙ্গে আছে। ওয়াটসের সঙ্গে চলেছে ব্রিটিশ অনুগত ব্যবসায়ী এবং সিরাজের খুব কাছের লোক উমাচাঁদ। সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের যে কোনও রকম আলোচনায় উমাচাঁদের উপস্থিতি প্রায় আবশ্যিকতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ওয়াটস এখন রাজকীয় কায়দায়তেই চলাফেরা করতে শুরু করছে। ৪০০ টাকা দিয়ে রুপোর কাজ করা হাতলের পালকি তৈরি করা হয়েছে তার জন্য। উমাচাঁদ ওয়াটসের কাছে আগেই পৌঁছেছিল সিরাজের দ্বিচারিতার খবর নিয়ে। অবশ্য ব্রিটিশদের কাছে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না কারণ সাম্প্রতিককালে তারা নিজেরাও প্রয়োজনে দ্বিচারিতার আশ্রয় নিয়েছে বেশ কয়েকবার। উমাচাঁদ খবর নিয়ে এল যে একজন ফরাসি দূত গোপনে হুগলির গভর্নর নন্দকুমারের কাছে প্রায় একলক্ষ টাকার উপহারসামগ্রী নিয়ে দেখা করেছে। উমাচাঁদ এ খবরও দিল যে সিরাজ ইতিমধ্যেই নন্দকুমারকে নির্দেশ দিয়েছে যদি ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণ করে সে ক্ষেত্রে ফরাসিদের সহযোগিতা করা জন্য। এই নন্দকুমার পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হয় এবং ওয়ারেন হেস্টিংসকে সরিয়ে ব্রিটিশ সরকার তাকে বর্ধমান, হুগলি এবং নদীয়ার দেওয়ান পদে অভিষিক্ত করে।
ব্রিটিশরা আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত রেখে উমাচাঁদকে পাঠাল নন্দকুমারের কাছে। উমাচাঁদ নন্দকুমারকে জানাল যে কোনও ভাবেই ব্রিটিশদের রোখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। নন্দকুমার যদি ফরাসিদের সহযোগিতা করে তাহলে ব্রিটিশদের হাতে তার প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে নিরপেক্ষ থেকে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করলে চন্দননগর জয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে নগদ ১২০০০ টাকা তুলে দেবে ব্রিটিশরা। ফৌজদার হিসাবে তার মাসিক বেতন যথেষ্ট বেশি হলেও উপরি পাওনার লোভ ছাড়তে পারল না নন্দকুমার। এখনকার মত তখনকার দিনেও উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের ঘুষ নেওয়ার বেশ ভালোই রেওয়াজ ছিল।
উমাচাঁদ ব্রিটিশদের হয়ে সিরাজের কাছে উমেদারি করার জন্য নাটকের অবতারণা করল। সিরাজের কাছে যখন খবর পৌঁছল যে ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে সে তখন উমাচাঁদকে তার শিবিরে ডেকে পাঠাল। সিরাজ তখনও মুর্শিদাবাদ পৌঁছয় নি। সিরাজ জানতে চাইল ব্রিটিশরা কি গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা ভাঙতে চাইছে কি না। উমাচাঁদ শশব্যস্ত হয়ে সিরাজকে আশ্বাস দিতে শুরু করল এই বলে যে এই সব গুজব সর্বৈব মিথ্যা। ব্রিটিশরা জাতিগতভাবে বিশ্বাসী এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসই তাদের উন্নতির কারণ। ব্রিটিশ সমাজে যে কথার খেলাপ করে বা মিথ্যার আশ্রয় নেয় সে সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে একাকী জীবন যাপন করে।আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবেরা তাকে পরিত্যাগ করে। এক স্থানীয় ব্রাহ্মণকে ডেকে তার চরণস্পর্শ করে উমাচাঁদ বলল যে কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশরা চুক্তিভঙ্গ করবে না।উমাচাঁদের নাটক বিশ্বাস করল সিরাজ। সিরাজ জানাল যে ফরাসীদের সাহায্য করার জন্য অর্ধেক সৈন্যবাহিনী নিয়ে চন্দননগর অভিযানের যে আদেশ সে মিরজাফরকে দিয়েছে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং এও জানাল যে ক্লাইভ যেন মনে না করে যে ব্রিটিশ সৈন্যদের তার কাছে পাঠানো হয়েছে তাদের ফরাসীদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করা হবে। পরের দিন ক্লাইভের চিঠি এসে পৌঁছল সিরাজের কাছে যাতে লেখা আছে সিরাজের সম্মতি ব্যতীত কোনও ভাবেই চন্দননগর আক্রমণ করা হবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে সিরাজ মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
এদিকে ওয়াটস এবং উমাচাঁদ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলো। দু’জনে মিলে ব্রিটিশ আদালতে আবেদন জানাল যেন চন্দননগর আক্রমণের পক্ষে সম্মতি দেওয়া হয়। ওদিকে ক্লাইভ সিরাজের অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ না করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আদালত কার্যতঃ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ফরাসি প্রতিনিধি ল’ সহজে ছেড়ে দেবার লোক নয়। মানিকচাঁদ এবং খোয়াজা ওয়াজিদ ফরাসিদের পক্ষে তদ্বির শুরু করল। ওয়াজিদ ফরাসিদের সঙ্গে ভালোই ব্যবসা করে। ব্রিটিশরা চন্দননগর দখল করলে সে পথে বসবে। মানিকচাঁদ সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় যে পরিমাণ টাকা হাতিয়েছে তা ব্রিটিশদের নজরের বাইরে রাখার জন্য ফরাসিদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। জগৎশেঠের কাছে ফরাসিদের ধারের পরিমাণ ১৫ লক্ষ টাকা। সুতরাং ফরাসিদের সমর্থন করা ছাড়া জগৎশেঠের আর কোনও উপায় নেই। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থার জন্য সকলে সিরাজের দু’দিক থেকেই অর্থ আহরণের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রচেষ্টাকেই দায়ি করল। এই প্রচেষ্টার পিছনে যে গভীর অভিসন্ধি আছে সে কথা বুঝতে কারও বাকি রইল না। এই অবস্থা চলতে থাকলো প্রায় ফেব্রুয়ারির শেষ অবধি।
এদিকে দিল্লিতে তখন পালাবদল শুরু হয়েছে। পাঞ্জাব সুবেদার মির মান্নুর স্ত্রী মুঘলানি বেগমের আমন্ত্রণে নাদির শাহের উত্তরাধিকারি আফগান রাজা আহমেদ শাহ দুরানি আর তার ছেলে তিমুর শাহ দুরানি তখন লাহোর, দিল্লি, মথুরা, বৃন্দাবন দখল করে মহম্মদ শাহ এবং আলমগীরের কন্যাদের নিজেদের হারেমে নিয়ে গিয়ে তুলেছে। নিজেরই রক্ষীদের হাতে খুন হয়ে ১৭৪৭ সালের জুন মাসে নাদির শাহের রাজত্বকাল হঠাৎই শেষ হয়ে যায়। দুরানির কাছে খবর আসে নিজের স্ত্রীর হাতে নিহত হয়েছে নাদির শাহ। নাদির শাহের একান্ত অনুগত এবং বিশ্বাসী আবদালি বাহিনীর সেনাপ্রধান দুরানি জীবন বাজি রেখে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোয়। দুরানি জানত যে বিশ্বাসঘাতক রক্ষীরা তার ওপর আক্রমণ করতে পারে তবুও জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নাদির শাহের মুন্ড এবং মুন্ডহীন দেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে দুরানি। তারপর নাদির শাহের অনামিকা থেকে শিলমোহর এবং বামবাহু থেকে কোহিনূর খুলে নিয়ে ৪০০০ সৈন্য সহযোগে কান্দাহারে ফিরে এসে নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে। মুঘল সৈন্যবাহিনী ছেড়ে রোহিল্লা পাঠান সেনাপতি নাজিবুদৌল্লা তখন যোগ দিয়েছে আহমেদ শাহ দুরানির সঙ্গে। সিরাজের কানে এল আহমেদ শাহ দুরানি আর নাজিবুদৌল্লা পূর্ব ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত সিরাজ ক্লাইভের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে বলল যে সে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর খরচ বাবদ মাসে একলক্ষ টাকা দিতে প্রস্তুত আছে।
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ কাম্বারল্যান্ড মাদ্রাজ থেকে বালাসোর এসে পৌঁছেছে। বোম্বে থেকে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে জাহাজও এসে পৌঁছে গেছে। ক্লাইভের আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল যে এখনই চন্দননগর আক্রমণের প্রকৃত সময়। ফরাসিদের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা রক্ষা করার চুক্তি অর্থহীন। যে সমস্ত ফরাসি আধিকারিকেরা চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য অপেক্ষা করছিল ক্লাইভ তাদের ফেরত পাঠিয়ে সিরাজকে জানাল যে যে মুহূর্তে পাঠানদের এগিয়ে আসার খবর পাওয়া যাবে ব্রিটিশ সৈন্য সিরাজের কাছে পৌঁছে যাবে। ক্লাইভ এও জানাল যে ইতিমধ্যে সে সৈন্যবাহিনী নিয়ে চন্দননগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। ক্লাইভের কাছ থেকে সম্ভাব্য পাঠান আক্রমণের মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি পেয়ে সিরাজের তখন চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা উপায় ছিল? ব্রিটিশ অনুগত নন্দকুমার সিরাজকে আশ্বাস দিল যে ব্রিটিশদের কোনও অসদুদ্দেশ্য নেই। এদিকে চন্দননগর আক্রমণের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ওয়াটসন সিরাজকে বার্তা পাঠাল যে ফরাসিরা সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রক্ষার জন্য সিরাজের নাম ব্যবহার করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সিরাজের মতামত শুনতে চায়। ওয়াটসনের দীর্ঘসূত্রতায় বিরক্ত ক্লাইভ ৪ঠা মার্চ, ১৭৫৭ কাউন্সিলের কাছে অনুরোধ জানাল যে তারা যেন অনতিবিলম্বে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে জলপথে চন্দননগর আক্রমণের নির্দেশ দেয়। ক্লাইভ এও জানালো যে সে নিজে স্থলবাহিনী নিয়ে প্রস্তুত এবং ওয়াটসনের এই বিলম্ব যদি কোনও দুর্ভাগ্যের কারণ হয় তবে তার জন্য সে দায়ি থাকবে না। তার আবেদন এই যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যা গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে কি না। যদি হয় তাহলে সে নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্যদের রেখে বাকি বাহিনী নিয়ে মাদ্রাজ ফিরে যাবে। সেক্ষেত্রে কাউন্সিল যেন সৈন্য পরিবহণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।। ঠিক সেই সময় সিরাজের চিঠি এসে পৌঁছোল। সরাসরি নিজের মতামত না জানালেও সিরাজ লিখল যে শত্রু যদি তোমার কাছে আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমাভিক্ষা করে তবে তাকে ক্ষমা করাই উচিৎ। কিন্তু শত্রু যদি ছলচাতুরির আশ্রয় নেয় বা তার আচরণে ও কথায় আন্তরিকতা এবং আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সংশয়ের উদ্রেক হয় তবে সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে সঠিক পন্থা অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সিরাজের এই উত্তরকে চন্দননগর আক্রমণের ছাড়পত্র হিসাবে ধরে নিয়ে যুদ্ধজাহাজ চন্দননগরের পথে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিল। স্থলপথে ক্লাইভের বাহিনী আর জলপথে ওয়াটসনের যুদ্ধজাহাজ কেন্ট, টাইগার এবং সালিসবেরির মিলিত আক্রমণে কেঁপে উঠলো চন্দননগর। সেদিনটা ছিল ১৪ই মার্চ, ১৯৫৭। কিন্তু কলকাতা পুনর্দখলের মত চন্দননগর বিজয় অত সহজ ছিল না। ফরাসিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল।বেশ কিছুদিন যুদ্ধ চলার পর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হল ফরাসিরা। জনৈক বিশ্বাসঘাতক সেনা অফিসারের সহযোগিতায় ক্লাইভের বাহিনী দখল করে নিল চন্দননগর ফোর্ট। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ প্রাথমিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত ফরাসি জাহাজকে হুগলিবক্ষে ডুবিয়ে বীরদর্পে চন্দননগর এসে পৌঁছে গেল। ব্রিটিশ স্থলবাহিনীর ৪০ জন সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হল। যুদ্ধজাহাজ কেন্ট এবং টাইগার মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩২ এবং আহতের সংখ্যা ৯৯। মৃতদের মধ্যে ছিল টাইগারের ভারপ্রাপ্ত ফার্স্ট লেফটেনান্ট স্যামুয়েল পেরু এবং আহতদের মধ্যে ছিল অ্যাডমিরাল পোকক। ফোর্ট দখল করার পর ওয়াটসন, পোকক, ক্লাইভ এবং ক্লিপট্রিক সিলেক্ট কমিটির কাছে চন্দননগর ফোর্ট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার অনুমতি চেয়ে পাঠায়। তাদের যুক্তি ছিল যে কোনও সময়ে সুযোগসন্ধানী এবং সুবিধাবাদী সিরাজ তার অবস্থান পরিবর্তন করে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে ফরাসিদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। ফোর্ট ধ্বংস করে চন্দননগরকে ফরাসিমুক্ত করতে পারলে সেই সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট হবে। শুধু তাই নয় চন্দননগরের মত বর্ধিষ্ণু উপনিবেশ ধ্বংস হলে ফরাসিদের কারখানা ও ব্যবসার ওপরে চরম আঘাত নেমে আসবে। ফলস্বরূপ হুগলিবক্ষে এবং বাংলায় ব্রিটিশরা একচ্ছত্র ব্যবসা চালাতে পারবে। ১৬ই এপ্রিল ১৭৫৭ ব্রিটিশদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেল চন্দননগর ফোর্ট। আরও একবার প্রমাণিত হল রাজনীতি এবং যুদ্ধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পদবৃদ্ধি ব্যতীত আর কিছু নয়। শিষ্টাচারস্বরূপ
যুদ্ধশেষে ইউরোপের দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী এবং ভারতের দুই ব্যবাসয়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে স্থির হল ফরাসি কাউন্সিল এবং ফ্যাক্টরির প্রধানেরা কলকাতায় কড়া নজরদারিতে রাজকীয় মর্যাদায় গৃহবন্দি থাকবে এবং বন্দি থাকাকালীন তাদের প্রভূত পরিমাণে আর্থিক ভাতা দেওয়া হবে।
ব্রিটিশদের পরবর্তী পরিকল্পনা কি ইতিমধ্যে স্থির হয়ে গেছে? তলে তলে কি শুরু হয়ে গেছে পলাশিযুদ্ধের প্রস্তুতি?
গল্প - সৌরভ হোসেন
Posted in গল্পচৈত্রের পানি
এই অসময়ে হুট করে শিলাবৃষ্টিটা কোত্থেকে যে এল! এ নিশ্চয় আল্লাহর গজব? তা না হলে এই ঘোর চৈত্র মাসে কেনই বা হুড়মুড় করে এমন শিল পড়বে? গদগদে সবুজ ধানগাছগুলোকে মাটির সাথে নুইয়ে থাকতে দেখে সাদেরের অন্তরটা ডুকরে উঠল! সে পারলে, ধানগাছের শীষ ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। গড়াগড়ি দেয়। মনে মনে মেঘকে গাল পাড়ল, ল্যাড়খেকি ম্যাঘ বিহানের আর সুমা পালো ন্যা? বিহালো তো বিহালো পাথরের মুতোন শিল বিহালো! অ্যাক পশলা পানি বিহালেই পাত্তোক।
সাদের জানে, ফাল্গুনের পানি আগুন। কিন্তু চৈত্রের পানিও কি কম আগুন? ফসলের দুষমন এই চৈতি বৃষ্টি। ফুঁ দিয়ে, জাড় মেখে যখন ঝেঁপে নামে, তখন চাষি হাই হাই করে, সব্বনেশে ম্যাগ পাড়িমোষের মুতন ফুঁসি উঠচে! সব ফসলপানি ইব্যার ধুয়ি মুছি লিয়ি যাবে গ!
সাদের দুব্রোঘাসে ঢাকা আলটায় লেটা মেরে বসল। জমা জলে পরনের লুঙ্গিটা ভিজে গেল। ভেজা লুঙ্গির কালহা রস তার পাছায় ঠেকল। ওদিকে হুঁশ নেই তার। খুঁটল চোখগুলো ভাঙা ডিমের কুসুমের মতো থলবল করছে। ফ্যাকাশে মুখটার ওপর জালি বেলার রোদ ছিটকে পড়ে মুখটা ঢাকা ঘাসের মতো হলুদ হয়ে উঠছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না সাদেরের। রাতের লাথিটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এই নুইয়ে পড়া ধানিজমিটাকে দেখে নিজেকে তার বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। নিজেকে এই ঘাস-আলে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে। সে যেন চৈত্রের এই হড়কা শিলের মতো দাগি আসামি। ধানগাছের নষ্ট থোড় দুই হাত দিয়ে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল সাদের। সাদেরকে এই সাতসকালে ধানের আলে বসতে দেখে জোলের ভুঁই থেকে হাঁক ছাড়ল মসলেম, “তুমার ভুঁইয়ের কী হাল গ, সাদেরভাই? আমার তো অ্যাক কাঠাও খাড়া হয়ী দাঁড়ি নাই! অ্যা আল্লাহর গজব। শালোর শিল সব ধুয়িমুছি শেষ করি দিয়ি গেলচে!“
কথাগুলো সাদেরের কানে তীরের মতো বিঁধল। মনে হল, শিল নয়, মসলেম যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলল! সে আলগোছে উত্তর দিল, “একই হাল। সবকডার মাজা ভেঙি গেলচে।“
“থোড়গুলান কেবুলই পুষ্ট হয়ী উঠছিল, আর অমনি হারামি শিল ম্যাগ ফুটি দুদ্দাড় করি পড়ি সব শ্যাষ করি দিয়ি গ্যালো গ! অ্যাখেই বুলে হাতে না মেরি ভাতে মারা।“
“রুজির মালিক আল্লা, যা করে ভালোর লেগিই করে।“ থির চোখদুটো ফ্যাল ফ্যাল করে আসমানের দিকে তুলল সাদের।
“অ বুলা ছাড়া আর কী বা করার আচে। আল্লা তো কুনুকিচুর দোষ লিবে না। কখনও ম্যাগ-পানি, কখনও ঝড়-ঝঞ্ঝা, কখনও ওইদ-খরা তো কখনও এই দুপেয়ি মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপি আল্লা রিহাই পায়।“
“ই বচ্ছর দক্ষিণে ধান কাটতে যাবা না?”
“না গেয়ি কী করব? ইখানে থেকি না খেয়ি শুকি শুকি মরব? তা তুমিও যাবা নাকি?”
“হু, যাব। কী আর করব? প্যাটে ভাতপানি তো লাগবে? ইবার ধানের যা ছড়াদ, তাতে ঝেরিঝুরি পাঁচমুন ধান পাব কি না সন্দেহ। সব পাতান হয়ী যাবে!“
“প্যাটের ভিত্তর দানা গজানোর সুমায় যদি অ্যামুন খাইকুন্নি শিল লাথি মারে, তাহলে কি আর ফল জন্মায়? অ পাতানই হয়।“
“হু।“ সাদের শুধু ঘাড় নাড়ল। ‘লাথি’ কথাটা তার কানে বাজতেই তার অন্তরটাও যেন লাথি খেয়ে উঠল। তার মনে হল, মসলেম তাকে ঠেস মেরেই কথাটা বলল। রাগ অভিমান মনে পুষে পরনের লুঙ্গিটা নেংটি মেরে, সড়সড় করে ধানের জমিতে নেমে পড়ল সাদের। হুমড়িয়ে পড়ে থাকা ধানগাছগুলোর ভাঙা মাজা খাড়া করে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। মাজার আর সে ক্ষমতা নেই যে শীষগুলোকে ধরে রাখবে। ধানগাছের গুঁড়ির চুড়ুত জমাজলে শীষের ঝরা সাদা রেণুগুলো থলথল করে ভাসছে। তা দেখে সাদেরের ভেতরটা ধড়াক করে উঠল! মাটির উশরায় চুঁইয়ে পড়া থলথলে রসটার কথা মনে পড়ে গেল। তার নিজেকে বড় গোনাহগার মনে হল। ভাবল, এই রক্তমাংসের মানুষ শুধুই কি একটা রুহুর খোল? নাহ। এই রক্তমাংসের দেহের মধ্যে একটা প্রকৃতিও আছে। সেখানে ঝড় ওঠে, বৃষ্টি হয়। রোদ-খরাতে পুড়ে পুড়ে রুটি স্যাকা খুলা (তাওয়া)র মতো তেতে ওঠে।
মাঝেমধ্যে তুফান উঠে সব ছাড়খাড় করে দিয়ে যায়। ধানগাছে খসখস করে শব্দ হচ্ছে। চচ্চড়ে পোকা চড়বড় করে এদিকওদিক তিড়িংবিড়িং করে লাফ মারছে। সাদেরের গা-হাত ঝরা ফুলের রেণুতে পাকিয়ে গেল। চৈত্রের বিহেন রোদ সে গায়ে হাতে পড়ে খিলখিল করে উঠল। সাদের খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে এই লম্বা ধানগাছগুলোর থোড় টিপে দেখল, ভেতরে দানাপানি আছে কি না। সাদেরকে হাত দিয়ে থোড় টিপতে দেখে, হুক হুক করে কোদালের কোপ দেওয়া বন্ধ করে মসলেম সেখ ঠাট্টা করল,
“কি গ, থোড়ে হাতচালি দেকচ নাকি, ভিত্তরে দানাবিচি আচে কি না?“
‘হাতচালানো’ শব্দটা শুনে সাদেরের নাড়িভুঁড়ি উল্টি মারল। কিচ্ছু ‘রা’ করল না সে। মাথাটা একটু বেশিই ঝোঁকাল। যেন কোন একটা কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়ল। তার উস্কোখুস্কো চুলের মাথাটাও ধান গাছের ঝোড় হয়ে উঠল। কিন্তু ‘হাতচালানো’ কথাটা তার মাথা ঘুলিয়ে দিচ্ছে। থোড়ে হাত দিতে ভয় পেল সে। নুইয়ে পড়া ধানগাছের ওপর ‘থপ’ করে বসে পড়ল। চিনচিন করছে বুক। মনের ভেতর একের পর এক প্রশ্ন আউরিবাউরি খাচ্ছে। ক্যানে হাতচালাতে লিয়ি গেছুনু? ক্যানেই বা হুট কইরি উভাবে পা’টা উঠি গেল?
শিল
শিল!’ সাদেরকে অমনভাবে নামতে দেখে, তাহেরার কাঁচা ঘুমটাও ভেঙে গেছিল। লম্বা গড়নের চামটা দেহে ফাসা ঢোলের মতো তার ঢলঢলে পেটটা টুস্কা হয়ে পড়েছিল। দুম করে চোখের পাতা খুললেও হুড়মুড় করে ওঠার শক্তি ছিল না তার। মিহি গলায় শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হইল গো?”
“শিল পইচ্চে!” পিন্ধনের লুঙ্গিটা আলগোছে গুঁজে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল সাদের। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা, চৈত্রের এই শিলাবৃষ্টি ধানের ফুল সব ঝড়িয়ে দেবে! থোড়গুলো সব নষ্ট করে দেবে! সব ধান পাতান হয়ে যাবে! উঠোনে তখন শিলের খৈ ফুটছে। বিদ্যুতের ঝলসানো আলোতে পড়ে থাকা শিলগুলো রূপোর মতো ঝকমক করছিল। একটা ভাঙা শিল হাতে তুলে সাদের ফ্যাসফেসে গলায় বলেছিল, “ওগো, বর্ষার মা, দেখি যাও, সব্বনেশে শিলে উঠ্যেন ভরি গ্যালো।“ তাহেরা উত্তর দেয় নি। শুধু “উঃ” “উঃ” করেছিল।
সাদের মনে মনে বলেছিল, ধানের থোড়ের পেটগুলোও শিলের পটবাড়ি খেয়ে নিশ্চয় এতক্ষণ এভাবেই কুদরাচ্ছে। হাতের মুঠোয় শিলের টুকরো চিপে ধরে এক সতরের উশরাটায় ঠাই দাঁড়িয়ে ফসলের আঁক কষেছিল সাদের। ঘরের ফসল আর মাঠান ফসল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আচমকা পায়ের সামনে পড়ে থাকা শিলের টুকরোটাকে ভ্যাকাম করে লাথি মেরে উঠোনে ফেলে দিয়েছিল। আসলে সাদের এই বরফখণ্ডের মধ্যে নিজের কদর্য রূপটা দেখতে পাচ্ছিল। সেও তো এই রক্তমাংসের মানুষ থেকে মাঝেমধ্যে হড়কা শিল হয়ে ওঠে। তার মনের আকাশে পাড়িমষের মতো কালো মেঘ ওঠে। সে মেঘে ঝড়ের তাণ্ডব বয়।
আল্লাহর গজব
“ইবার কাদানের টাকাকডাই উঠবে না! ই ধান গরুর শানিই (বিচালি) হবে!” ‘ঘুঁত’ করে কোদালের কোপ দিয়ে আফসোস করল মসলেম। মাথায় ফেট্টি বাঁধা গামছাটা খুলে মুখ মুছতে মুছতে এবার হাঁড়া গলাটা একটু চরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমার বউর খবর কী গ?”
কথাটা সাদেরের কানে সপাটে চড় খাওয়ার মতো বাড়ি খেল। কিন্তু সে যে কুকম্মটা করেছে তা তো আর ধামাচাপা দেওয়ার মতো নয়? সে রাতেই গোটা পাড়া ঢ্যাড়ড়া পড়ে গেছিল। গোটা পাড়ার মেয়ে-মরদে ছিঃ ছিঃ করেছিল। ঝোপ ধানের গুঁড়িতে ঠেসে বসে পড়ল সাদের। তার হাড়গিলে পাদুটো যেন শরীরের আর ভার নিতে পারছে না। তারা যেন এই আসামি শরীরটার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করল। একটা শিকড় উপড়ানো ধান গাছের লটকানো দেহ দেখে সাদেরের ভেতরটা থক করে উঠল। সে রাতে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা তাহেরার নিথর শরীরটার কথা মনে পড়ে গেল। নিজেকে তার জ্যান্তশিল মনে হচ্ছে এখন।
ধানের থোড়ে হাত দিতে লজ্জা করছে সাদেরের। কৃষকের হাতের স্পর্শ পেয়েই তো ধানের থোড় ‘ধেই’ করে ওঠে। খিলখিল করে হাসে। কৃষক যে তাদের বাপ মা। অথচ তাহেরার কথা মনে আঁচড় কাটতেই পরানচাষি সাদের যেন একজন বেইমান বাপ।
সে যে বড় পাপ করে ফেলেছে! সে রাতের কু-কীত্তিতে আল্লাহর আরশ যে কেঁপে উঠেছিল। তার জন্যে আল্লাহর আযাব নেমে আসবেই। জাহান্নামের দরজা খুলে যাবে নিশ্চিত। কবরের ফেরেশতাকে কী উত্তর দেবে সে? সে যে একজন খুনি! ফড়ফড়ে মসলেম কোদালটাকে ধানের আলে খাড়া করে রেখে, একটা আধপুষ্ট থোড়কে চিপে বলল, “কিছু কিছু থোড়ে অ্যাখুনও দুধরস আছে গ। এই দ্যাখো জোরে টিপলে সাদা রস ব্যারহাচ্ছে।“ মসলেমের বিড়ি খাওয়া ঠোঁটে মিহি হাসি। চোখ নিংড়ে খসে পড়ছে ধুকধুক করতে থাকা ক্ষীণ আশা।
“অ্যাক শিলে কি সব যায়?” ঝোপের আড়াল থেকে ভেসে উঠল কথাটা।
“কে বুলল, যায় না? গ্যালো বচ্ছরের আগা বচ্ছর, মুনে আচে? সে কি শিল, বাপরে বাপ, আদ্ধেক রাইত জুড়ে শিল্বৃষ্টি হয়ীছিল! মাঠখে মাঠ ধান অ্যাকেবারে মাটিতে মিশি দিয়ছিল! সব ধান ঝেরে পাতান হয়ী গেলছিল!” আকাল বছরের দুঃখের স্মৃতি জাবর কাটল মসলেম। সাদেরও জানে, এক শিলেই সব ধুলিস্যাত হয়ে যেতে পারে। আল্লাহর গজব নেমে আসলে এই দুনিয়ার কারোরই কিছু করার থাকে না। সাদের হাড়ে হাড়ে জানে, মানুষের শরীরের ফুলই এক লাথিতে ঝরে যায় তো ধানের থোড় তো ঝরবেই। মানুষের নাড়ি যে জড়িবুটির আটসাট বাঁধনে বাঁধা থাকে, ধানের থোড়ফুল তো সেভাবে বাঁধা থাকে না?
মসলেম থপথপ করে ঘাসে ঢাকা আল দিয়ে হেঁটে আসল। সাদের ভুঁইএর যে প্রান্তে বসে বসে বাঁকা ধান খাড়া করছিল সেখানে ‘দ’ হয়ে বসল। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে একবার খক করে কেশে বলল, “অ্যাকটা বিড়ি দাও দেখি।“ সাদের বাঁকা মাজা সোজা করে দাঁড়াল। ভাবল, ব্যাটা মসলেম তো এবার গেঁড়ে বসতে চায়ছে। ব্যাটা বিড়ি চায়ছে মানে এবার গল্পের আসর পাড়বে। এ কথা সে কথা গাহাতে গাহাতে পাপ রাতের ঘটনাটা শুনার ফন্দি আঁটবে। কিন্তু বিড়ি নাই, বলাও যাবে না। একটু আগেই তাকে বিড়ি টানতে দেখেছে মসলেম। “বিড়ি তো নাই গ, যে কডা ছিল, বসতে গিয়ি ভেঙ্গি গেলচে মুনে হয়” বলেই নেংটিমারা লুঙ্গির ভাঁজে জড়ানো বিড়ির প্যাকেটটা থেকে দুটো বিড়ি বের করল সাদের। একটা নিজের কানে গুঁজে আর একটা মসলেমকে দিয়ে বলল, “ধরাও।“ মসলেম আলের ওপর ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা নাড়ার আঁটিআগুনটা মুখের কাছে ধরে বিড়িটা মুখে পুরে একটা জোরে টান দিল। ফুঁক ফুঁক করে দুবার ধোঁয়া ছাড়ল। সাদের কান থেকে বিড়িটা মুখে নিয়ে মসলেমের জ্বলন্ত বিড়িটার গনগনে আগুনে তার বিড়ির মুখটা ঠেকিয়ে আগুন ধরাল। একবার ফুঁক করে টেনে খক করে কাশল সাদের।
মসলেম জোরে সুখটান দিয়ে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “ই বচ্ছর পাপের বচ্ছর। অর লেগিই আল্লার গজব নেমি এসচে।“
“শিল কি আজ লতুন? বাপদাদোর আমল থেকিই হয়ী আসচে।“ বিড়বিড় করে উঠল সাদের। মসলেমের কথাটা তার গায়ে লাগল।
‘পাপ’ কথাটা তার কানে বাজলেই সেই রাতের ‘লাথিটা’ তার হৃদয়ে কুড়ুল মারে। মসলেম বিড়িটা মুখে পুরে ডান হাত দিয়ে একটা থোড়ের পেট টিপে বলল, “সব খোল হয়ী গেলচে গ! প্যাটটা ক্যামুন ঢলঢলে চামটা! ভেত্তরের অসকষ সব শুকি খটখটি হয়ী গেলচে! পুয়াতি মেয়ির প্যাটের পুষ্ট ছেলি লষ্ট হয়ী গ্যালে প্যাটটা য্যামুন চামটা হয়ী যায়, অ্যা ঠিক ত্যামুন!”
সাদেরের নাড়িভুঁড়ি পাক মেরে উঠল। গা-গতর হলহল করে কাঁপছে। বিড়িটা মুখের ভেতর পুরে ফুঁক ফুঁক করে দু-তিনবার ধুকপুকানি টান মারল। গব গব করে দলা পাকিয়ে ধোঁয়া বের হল। খুটোল চোখে ঝাপসা স্মৃতি টাটকা হয়ে উঠল।
লাথি
সাদের মুখ্যুসুখ্যু আবোড় লোক হলেও, কোনদিনও তুকতাকে বিশ্বাসী ছিল না। তাবিজ-কবোজ, ঝাড়পুক, পানিপড়া, হাতচালানো তার কাছে ছিল শেরেকি। কিন্তু তার নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে যখন পরপর তিন কন্যাসন্তানের জন্ম হল, তখন তার সে বিশ্বাসে চিড় ধরল। মনের মধ্যে দানা বাঁধতে লাগল নানান সংস্কার। সে ভেবেছিল, তিন মেয়ের পর আবারও যদি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়, তবে খড়কুটো ধরে কোনরকমে বেঁচে থাকা হাভাতের সংসারটা একেবারে উচ্ছেন্নে যাবে! সে আল্লাহর ওপর অভিমান করে উঠেছিল, গরিবের ঘর ভরে এত্ত বিটি দ্যাওয়ার কী দরকার ছিল? তাহেরা তখন সাতমাসের পোয়াতি। চতুর্থবারের জন্য তার পেট ভরে উঠেছে। সাতমাসেই ঠিলির মতো ফোলা পেট! এদিকে সাদেরের ঘুম হয় না। তার মাথায় অনবরত ঠকঠক করে, বিটি না ব্যাটা? সে মনে মনে তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। নানান ফন্দিফেউর আঁটে। কাছের লোকজনদের জিজ্ঞেস করে। শেষে হাজিপাড়ার সালেমুদ্দি মোল্লার কাছ থেকে ঠিকানাটা পেয়ে যায় সাদের।
বটগাছের গা লাগা ছোট্ট একটা ঝুপড়ি। বড়বড় হরফে লেখা, ‘কবিরাজি ঔষধের দোকান’। কবিরাজি ওষুধ খেলে পেটের সন্তান পুষ্ট হবে বলে তাহেরাকে নিয়ে এসেছে সাদের। সাদের চেম্বারে তাহেরাকে বসিয়ে রেখে পাশের ঘুপচি ঘরে কবিরাজজীর সাথে কি সব ঘুটুরমুটুর করল। কবিরাজজী তার কুঁচকানো ভ্রূ সাট করে, গালে আলতো টোল ফেলে ঘাড় নেড়ে জানালেন, “ঠিক আছে। হয়ে যাবে। এ আমার এক তুড়ির কাজ। আগে হাতচালিয়ে দেখেনি, তারপরে দাওয়াই দিচ্ছি।“
কবিরাজের ইশারা পেয়ে সাদের তড়বড় করে উঠে বাইরের বেঞ্চ থেকে তাহেরাকে এই অন্দরঘরে নিয়ে এল। কবিরাজমশায় তাহেরাকে একটা চওড়া কাঠের বেঞ্চে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন। তারপর তাহেরার ঢোল পেটটা থেকে সুতির মেরুন শাড়িটা সরিয়ে উদেম পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কিসব ফুঁ-মন্তর আউড়াতে লাগলেন। মাঝেমধ্যে জোরে ফুঁ ঝেরে হাতের আঙুল দিয়ে ফোলা পেট চেপে চেপে কি যেন পরখ করলেন। মিনিট পাঁচেক এভাবেই হাতচালানো চলল। হাতচালানো হয়ে গেলে তাহেরাকে চেম্বাররুমে পাঠিয়ে কবিরাজজী ফিসফিস করে সাদেরকে গোপন কিছু একটা জানালেন। তারপর ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বললেন,
“একদম চিন্তা করবেন না। জড়ীবুটিগুলো ঠিকঠিক ভাবে খাইয়ে দেবেন। দিন পনেরোর মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।“
কবিরাজজী এত করে বললেও, ওসব জড়িবুটির প্রতি বিশ্বাস হচ্ছিল না সাদেরের। দিন পনেরো মানে তার কাছে অনন্তকাল।
অতদিন অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য তার ছিল না। তার মাথায় শুধু কবিরাজজীর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলা “বিটি’ কথাটা কটমট করে কাটছিল। সে চায়ছিল চটজলদি ফায়সালা।
সে রাতে তেমন কিছুই হয়েছিল না। এরকম ঠুকমুক আগেও অনেকবার হয়েছে। কিন্তু তাহেরার অল্প কথাতেই সাদেরের মাথা তেতে উঠেছিল! সে যেন মনে মনে এই ছুতোই খুঁজছিল। তাহেরার অপরাধ, সে স্বামীকে না জানিয়ে আশাকর্মীর দেওয়া ওষুধ খেয়েছিল। সে স্বামীর নিষেধ শোনেনি। সাদের বারবার করে মানা করে দিয়েছিল, কবিরাজের ওষুধ ছাড়া অন্য কুনু ওষুধ খাবা না। তাহেরাও মুখের ওপর তর্ক করেছিল। মুখে লাগাম লাগাতে পারেনি। তাহেরা যেই বলেছিল, “উসব জড়িবুটি আমি খাব না”,
অমনি সাদেরের মাথা বিগড়ে গেছিল। মরদ সাদের তার ডান পা’টা তুলে তাহেরার ভরা পেটে ‘ভ্যাকাম’ করে এক লাথি মেরে দিয়েছিল। ব্যস। ওতেই কেল্লাফতে। কাটা গাছের মতো আলুথালু হয়ে মেঝেতে পড়ে গেছিল পোয়াতি তাহেরা। দুই ঊরুর ফাঁক দিয়ে অনর্গল বয়ে গেছিল রক্ত-স্রাব। নষ্ট পুত্রসন্তানের রস-কষ। পরান চাষি সাদের চোখ ফেড়ে দেখেছিল, তার ঘরের খেতিতে একটা পুষ্ট থোড় নষ্ট হয়ে কীভাবে গলে গলে পড়ছে।
গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পগল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in গল্পগল্প - সুস্মিতা হালদার
Posted in গল্পগল্প - ময়ূরী মিত্র
Posted in গল্পগল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পবিধিসম্মত বিজ্ঞপ্তি
দর্শকসংখ্যা
ঋতবাক পরিচালনায়
উপদেষ্টামণ্ডলী – সুদিন চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, চিন্ময় গুহ, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শুভ্র ভট্টাচার্য, পল্লববরন পাল
সম্পাদনা – সুস্মিতা বসু সিং
কার্যনির্বাহী সম্পাদনা – শিশির রায়, সৌম্য ব্যানার্জী
কারিগরী সহায়তা – সুমিত রঞ্জন দাস
ব্লগ সংরক্ষণাগার
-
▼
2024
(68)
-
▼
April
(18)
- সম্পাদকীয়
- প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
- প্রবন্ধ - বেবী সাউ
- প্রবন্ধ - সেবিকা ধর
- প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার
- প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস
- ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
- ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল
- ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
- ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
- গল্প - মনোজ কর
- গল্প - রূপশ্রী ঘোষ
- গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী
- কবিতা - উদয়ন ভট্টাচার্য
- কবিতা - সুস্মিতা মজুমদার
- কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়
- কবিতা - শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
- ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
-
▼
April
(18)