Next
Previous
Showing posts with label অনুবাদ সাহিত্য. Show all posts
0

অনুবাদ সাহিত্য - সুলগ্না মুখোপাধ্যায়

Posted in
 
মুল গল্পঃ Der Heiland

ত্রাতা

এতদ্বারা আমি গটলিব মাউরার-এর অবিভাকত্বের বিষয়ে খবর এবং বিবরণ তোমার সামনে পেশ করতে চলেছি। এতাই আমার মক্কেলের ব্যাপারে শেষ খবর। একজন প্যারিশের-এর কেরানি হিসেবে তুমি জানঃ গটলিব গত বছরের শেষ দিকে মারা গিয়েছে। আমার প্রাথমিক রিপোর্ট সবসমই সংক্ষিপ্ত আর তাতে নথিভুক্তে করা আছে যে, এই প্রতিবেদনের সময় গটলিব-এর শারীরিক অবস্থার খুব তাড়াতাড়ি অবনতি ঘটেছিল আর ২২শে ডিসেম্বরের সকালে তাকে বৃদ্ধাশ্রমের কংক্রিটের প্যানেলের ওপরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রাথমিক রিপোর্টের পরে আছে নগদ লেনদেনের আট পাতার এক বিবরণ, সম্পত্তির হিসেব, ব্যাল্যান্স শিট এবং সম্পদের এক তুলনাভিত্তিক রিপোর্ট। এই রিপোর্টের সঙ্গে জমা দেওয়া হচ্ছে সব নথিপত্র, যার মধ্যে তার দুটো ব্যাঙ্কের একাউন্টের তথ্য আছে। গটলিবের সেখানে সামান্যই টাকা ছিল। 

গটলিব এই বৃদ্ধাশ্রমের যে ঘরটায় থাকত, সেই ঘর ওর বোন আর আমি পরিষ্কার করি। ঘর পরিষ্কারের সময় ওর বোন বৃধবাশ্রমের সামনের বেঞ্চে দেখতে পায়ঃ “ এই গটলিব লোকটা … এর বাবার উচিত ছিল তাঁর বীর্যটা সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলার।” আমাদের অনেক সময় লেগেছে ওর ঘর থেকে সমস্ত ইঁট এবং প্যানেল পরিষ্কার করতে। ছটা প্যানেলকে এমনভাবে কাটা ছিল যেন সেগুলোকে কলা রাখার বাক্সে রাখা যেত। যখন গটলিবকে মানাসিক চিকিৎসালয়ে বা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে ওগুলোকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। 

গটলিব-এর ঘরে ঢুকলে প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে, সেটা হল খোদাই করা এবং আঁকা প্যানেলগুলো। একদিকে আঁকা আছে একটা গরু, একটা পাত্র থেকে জল খাচ্ছে, একটা মোরগ, যে দানা খুঁটে খাচ্ছে আর পপলার গাছের সারি দেওয়া রাস্তা, যেগুলো বাতাসে দুলছে।অন্যদিকে রয়েছে সমুদ্রের ধারে একটা পাম গাছ, একটা ব্যাজার সমেত একটা বনের ঝাড় আর একটা প্যানেল যেখানে বড় হরফে লেখা “এফা” আর ছোট হরফে লেখা “ ৩২-টা দুধসাদাদাঁত।” আমি জানিনা, কে এই “এফা”, আমি জানিনা আদৌ এই নামে কেউ আছে কিনা। কিন্তু এটা আমি জানি , যে গটলিব-এর খালি একটা দাঁত ছিল, হলুদ, নিকোটিনের ছোপ লাগা দাঁত। 

মাটিতে দুটো প্যানেলের ওপরে গটলিব শুতো। ও সেটাই চাইত। একটা আলুর বস্তা ছিল তার বালিশ। তার মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার সব ক্যাটালগ সে জমিয়ে রাখত, যেগুলো বেশিরভাগই সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাওয়ার। আমি নিশ্চিত যে গটলিব কখনও সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যায়নি। গটলিব বলত,“ক্যাটালগগুলোর ওপরে মাথা রেখে আমি স্বপ্ন দেখি।” 

দিনেরবেলা ওই খালি আলুর বস্তাটা নিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। উপত্যকার লোকেরা ওকে এইভাবে চিনতঃ লম্বা কালো কোট, রবারের জুতো, কাঁধে আলুর বস্তা। প্রায়শই দোকানের সামনে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে থাকা আবর্জনা তুলে সে তার আলুর বস্তায় রাখত, তারপর সেগুলো নিয়ে দোকানে ঢুকে দেখিয়ে একটা কুড়ি টাকার নোট পাওয়ার আশা করত। গটলিব-এর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বেশ কিছু টাকা তারা দিয়ে দিত। এইভাবে সে তার ইঁট আর প্যানেলের টাকা রোজগার করেছিল। 

গটলিব-এর শোয়ার জায়গাটা ঘরের ভেতরেই একটা দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা ছিল। ডানদিকে ছিল একটা ছোট প্যাসেজ, যেটা দিয়ে লোকে তার ঘরে ঢুকত। শোয়ার ঘরের পিছনের দেওয়ালটাও ছিল ইঁট দিয়ে ঢাকা। “যাতে আমার ঘরের জানালা দিয়ে আলো না ঢোকে”, গটলিব আমাকে এই কারণ দর্শে ছিল। সব ইঁটগুলোর ওপরে তার হিজিবিজি হাতের লেখায় ভর্তি ছিল। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তারা গটলিব-এর এই স্ব-নির্মাণকে সহ্য করে নিয়েছিলেন। সেটা দেখে একই সঙ্গে আমি বিস্মিত ও খুশি। এই ইঁটগুলো যে গটলিব-এর মাথায় পড়েছিল, সেটা নিয়ে লোকের কোনও সংশয় ছিল না। কারণ সে ছিল প্লাস্টারবিহীন একজন অতি বিচক্ষণ মাউরার। 

অনেক কমবয়সেই গটলিব “উপত্যকার ত্রাণকর্তা”, এই ডাকনামটা পেয়েছিল। সেই সময় ও ঢেউয়ের মতন চুল নিয়ে ওই পাড়ায় দুলে দুলে ঘুরে বেড়াত। তখনও পুরুষেরা কেউই লম্বা চুল রাখত না। সেটা তোমার প্যারিশের কেরানি হিসেবে কাজ করার অনেক আগে, তাই তোমার সেটা জানার কথা নয়। গটলিব এখানে ওখানে কাজ করত, প্যারিশের হয়েও ও কাজ করেছে। কোথাও যদি একটা কবর খোঁড়ার দরকার হত, তো গটলিব –এর মতন সুযোগ্য লোক আর ছিল না। তার শরীরের ওপর দিকটা ছিল ভারোত্তোলকের মতন। যদি কোনও কাজ তার ক্ষমতানুযায়ী হত, তখন সে ভালুকের মতন তীব্র গতিতে সেই কাজ সুসম্পন্ন করত। গটলিব একদিনে খুঁড়ে ফেলেছিল নতুন কর্মশালা থেকে রাস্তা পর্যন্ত যে নিকাশীটা ছিল, সেটাকে। সে একা! আর যদি কোনও কাজ তার নাপসন্দ হত, তাহলে কিছুতেই সেই কাজটা সে করত না। যদি ওর মাথায় সেটা গেঁথে যেত, সেই ব্যাপারে কোনও আলোচনাতেই ও ঢুকত না। তুমি কি জানতে, আমি ওর অভিভাবকত্ব নেওয়ার আগে, ও নিজের একটা কুঁড়ে ঘরে থাকত? পাশের উপত্যকার পিছনদিকটায়, ভ্যুএস্ট্মাট-এর বিপরীতে, তিন, চার মিটার বনের ভিতরে। সেখানে সে বনের মধ্যেই তার ঘরটা নির্মাণ করে এবং বালিপাথর দিয়ে সেটাকে খোদাই করে তলে। এমনকি সে ওই পাথরের মধ্যে শক্ত লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়।

ওই বনের মধ্যেও সে সব অদ্ভুত জিনিস ওই ইঁটগুলোর ওপরে লিখে রেখেছিল, যেগুলো সে পরে বৃদ্ধাশ্রমেও লিখেচিলঃ ৩০ থেকে ৮০ কিলমিটার-এর মধ্যে সব কোম্পানির নামের লিস্ট, যেখানে লোকেরা ইঁট কিনতে পারবে। আরেকটা লিস্ট ছিল সব গুল্মলতার এবং বন্যফুলের, আরকাসিয়া থেকে শুরু করে কাঁটাগাছ পর্যন্ত। আরকাসিয়া গুল্মলতার চা ও একবার গলাব্যাথার জন্য খেয়েছিল। দু-বার ও কাপড়ও গলায় ধকাবার চেষ্টা করে দেখেছে।অবশ্য তখন ও আমাকে ওর অভিভাবক হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিল, সেটা আমি তোমাকে বলতে পারি। গটলিব কোনওসময় নিজের থেকে হাসপাতালে যেত না। দ্বিতীয় অপারেশনটার আগে ও নিজের গলায় একটা পাতলা নল ঢুকিয়ে ছিল, যাতে গলায় অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও ও খিদেয় না মরে। ওই নল দিয়ে ও কফির সঙ্গে সরু সসেজ ঢুকিয়ে দিত।

এটা আমাকে অবাক করত, যে গটলিব বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত খুবই বলিষ্ঠ ছিল। বৃদ্ধাশ্রমে সে স্যারভেলাট-এর সসেজ মজুত রাখত। পোকামাকড় টার ওপরে ঘুরে বেড়াত। আমি ওকে বলেছিলাম, ওই সসেজগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেলে দিতে। ও শুধু হাসতো আর বলতঃ “আমি চামড়াটা তুলে ফেলে দিই, আর তাতেই ওই স্যারভেলাটগুলো খাওয়া যায়।” এটা আর কাউকেই অবাক করে না, যে গটলিব-এর এক্তাই মাত্র দাঁত ছিল, ডান দিকের মাংস খাওয়ার দাঁতটা। যদিও সে হাসপাতালে সহজে যেতে চাইত না, কিন্তু তার নিজের ডাক্তার ডক্টর কেলার-এর ওপরে ওর ছিল অগাধ বিশ্বাস। প্রত্যেক মাসে এই ডাক্তার ওকে একটা করে ইনজেকশন দিতেন।খুব সসম্ভবত ওর “মানসিক রোগের জন্য এই বিশেষ ওষুধটি ওকে দেওয়া হত, মিউনিসিপালিটির অভিভাবকত্বের নথিতে সেইভাবেই বিবরণ দেওয়া আছে। খোলা রাস্তার ওপরেই গাড়ি থেকে নেমে ডক্টর কেলার গটলিবকে টার পিছনদিকে একটা ইনজেকশন দিতেন, যখন দৈবাৎ তাঁদের দুজনের দেখা হয়ে যেত। এই ইনজেকশনগুলো তাকে এমন ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলত; সে তখন্ আর সহজে ঘর থেকে বেরত না। বেশ কয়েকদিন পরে আবার সে তার পরিচিত বৃত্তে বেরত। সেইজন্য গটলিব প্রথমদিকে ইনজেকশন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইত। তবে কখনওই হিংস্র হয়ে উথত না, কারণ ডক্টর কেলার-এর প্রতি গটলিব-এর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। 

গটলিব-এর পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনে আমাদের গ্রামের সঙ্গীত সমিতি তার উদ্দেশে সঙ্গীত পরিচালনা করে। গটলিব অবশ্যই আশা করেনি যে আমরা আসব। আরও এটা ওর মনে হয়েছিল, কারণ এই বৃদ্ধাশ্রমটি আমাদের গ্রামে অবস্থিত নয়, বরং উপত্যকার অনেক নীচের দিকে। আমরা দুটো পোল্কা আর একটা আধুনিক সঙ্গীতের সুর বাজিয়েছিলাম। তারপর সঙ্গীত সমিতির সভাপতি গটলিবকে অভিনন্দন জানান। যখন সমবেত স্বরে জন্মদিনের গান হচ্ছিল, তখন গটলিব তার চোখের জলকে থামাতে চেষ্টা করছিল, আর “ওল্ড কমরেড” গান্তার সময় সে দুরগের কুকুরের মতন চীৎকার করছিল। ওই একবারই আমি গটলিব-কে কাঁদতে দেখেছিলাম। কনসার্ট শেষ হওয়ার পরে কী ভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে হয়, সে তা জানত না। কুড়ি জনের ওপরে যে সঙ্গীতশিল্পীরা ছিলেন, সঙ্গীত পরিচালকেরা এবং লেফটেন্যান্ট, গটলিব ভয়াতুর ভঙ্গীতে তাঁদের প্রত্যেকের কাছে গেল। হটাৎ সে দ্রুত বাড়ির মধ্যে চলে যায়, ইঁটগুলো বের করে আনে বাইরে, আর যাঁরা ওখানে উপস্থিত ছিল, তাঁদের প্রত্যেককে একটা করে ইঁট দেয়।

সভাপতি খুব সুন্দর শব্দচয়নের মাধ্যমে গটলিব-কে ধন্যবাদ জানালেন। আমরা ইঁটগুলো আমাদের গাড়িতে তুলে বাড়ির উদ্দেশে রাওনা হই। আজকাল অনেকেই ‘উপত্যকার ত্রাণকর্তা’-র এই উপহার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে, কিন্তু আমার যতদূর জানা আছে, কেউই সেগুলো ফেলে দেয়নি। কারণটা হতে পারে এই যে, গটলিব-কে তার পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনের পরের দিনই ওই প্যানেলের ওপরে মৃতাবস্থায় পাওয়া যায়। সেই থেকে আমাদের এই উপত্যকার দু-ডজন ঘরে রয়েছে ইঁটের স্তূপ, জার উপরে কাঁপা হাতে লেখাঃ

“২৪ ঘণ্টা”

“সমুদ্রেরপ্রতিভালবাসা”

“ঘৃণ্যএফা”

“ব-সন্ত”

“৩৬৫ দিন”

“ট্রাকেরচাকা”

“কালোকাঁটারমুকুট”

“প্রকৃতিরআত্মা” 

আমার “পঁচাত্তর বছরে”
2

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in

অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৯ 

এবারের অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতায় নির্বাচিত একজন কবির মৃত্যু হলো ২৭ এপ্রিল, ২০২০, যদিও করোনার প্রকোপে নয়, ৭৫ বছর বয়েসে স্ট্রোক হয়ে। তিনি আয়ারল্যান্ডের কবি এইভান বোলান্ড, আমেরিকার অধিবাসী হলেও কাব্যভাবনায় আপাদমস্তক আয়ারল্যান্ডের। ২০১৬ সালে হোয়াইট হাউসে সেন্ট প্যাট্রিক দিবসের উৎসবের উদযাপনের সময় রাষ্ট্রপতি ব্যারাক ওবামা উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন তাঁর কবিতা থেকে। দেশটির জাতীয় অভিজ্ঞান এবং এবং সেই দেশের জাতীয় জীবনে নারীর ভূমিকা তাঁর কবিতার উপজীব্য। ১৯১৮ সালে নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডে -- তার শতবার্ষিকী উদযাপনে লেখা তাঁর আর একটি কালজয়ী কবিতা। প্রেমের কবিতা লেখার ফুরসৎ তাঁর নেই, কিন্তু ১৮৪৭ সালের দুর্ভিক্ষের কাহিনীই প্রেমের রূপ ধারণ করে তাঁর রচনায়। সেই দুর্ভিক্ষের কালে অনাহারে এবং টাইফাস জ্বরে মৃত্যু হয়েছিল দশ লক্ষের বেশি মানুষের। সংকলিত কবিতাটির নাম “কোয়ারান্টিন” -- আমরা এখন যে সময়ে বাস করছি তাতে খুবই প্রাসঙ্গিক। 

শুরু করেছি আরেকজন নোবেলজয়ী কবিকে দিয়ে -- যে শহর থেকে প্রতি বছর নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা ঘটে, সেই শহরের বাসিন্দা টোমাস ট্রান্সট্রোমার। প্রতি বছরই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহিত্যিক বন্ধুরা আসতেন স্টোকহোম শহরে তাঁদের নোবেল পুরস্কারষ্কার নিতে; তাঁরা গল্পগুজব করতে আসতেন কবির বাড়িতে। প্রতি বছরই গুজব ছড়াত যে এবার তাঁর পালা। শেষ পর্যন্ত সেই ঘটনাটি ঘটলো ২০১১ সালে। কিন্তু তার দুদশক আগেই তিনি এক মর্মান্তিক অসুখে বাকশক্তি হারিয়েছেন। তাঁর মুখনি:সৃত ধ্বনিগুলির মর্মোদ্ধার করতে পারেন একমাত্র তাঁর স্ত্রী মনিকা; সে বছর ডিসেম্বর মাসে নোবেল পুরষ্কার বিতরণের সভায় নোবেল বক্তৃতার বদলে তিনি এক হাত দিয়ে পিয়ানো বাজিয়ে শোনালেন। ৮৩ বছরের জীবনে মাত্র কয়েকশো কবিতা লিখেছিলেন তিনি -- তার একটি সংকলিত এখানে।

গ্রামের সাধারণ চাষাভুষো মানুষদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা নিয়ে কবিতা লেখেন নরওয়ের কবি নুট ওডেগার্ড, তাঁর অন্তরে বাস করেন করুনাময় যীশু। সম্প্রতি সেই দেশের রাজধানী অসলোর এক জনপ্রিয় সংবাদপত্রে তাঁর বিষয়ে লেখা হয়েছিল, “Norway does not have a court poet. But Norway does have a poet of European stature in Knut Odegard.” গভীর ধর্মভাবনা সমৃদ্ধ করেছে তাঁর মরমী কবিতাকে। নরওয়ের রমসডাল অঞ্চলটিতে শৈশব কেটেছে তাঁর এবং এখনো তিনি পাখা মেলে উড়ে যান সেখানকার জেলেদের গ্রামগুলির আকাশ বেয়ে স্বপ্নে।

আরো পাঁচজন কবি আছেন এবারের প্রেমের কবিতার সমারোহে -- একজন ইংল্যান্ডের, বাকি চারজন মার্কিন: কেউ সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপক, কেউ নারীবাদী নেত্রী; কিভাবে কবিতা পড়তে হবে, সেই নিয়ে পুরো একটি গ্রন্থ লিখেছেন একজন; “তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা এক শুক্কুরবারের বিকেলে, আর সেইদিন আমার জীবনে এলো প্রেম,” লিখেছেন অন্য একজন।

কত বিচিত্রভাবেই যে গড়ে ওঠে প্রেমের কবিতা -- করোনার দিনগুলিতে প্রেম -- আসুন এবার কবিতাগুলি উপভোগ করি: 

টোমাস ট্রান্সট্রোমার (সুইডেন, ১৯৩১-২০১৫)

দম্পতি 

আলো নেভায় তারা, রাতের গেলাসে ট্যাবলেটের মতন 
শেষ রশ্মিটুকু মিলিয়ে যাবার আগে চকচক করে 
রূপালি বাতিদান। তারপরে মত্ত হয় দুজনে।
আকাশে শোঁ করে উড়ে যায় দেওয়াল।

সোহাগের গতি কমতে থাকে আর তারা ঘুমোয়,
কিন্তু তাদের গোপন চিন্তাভাবনাগুলো মিশতে চায়,
যেভাবে স্কুলের ছাত্রের আঁকা ছবির ভেজা কাগজে 
দুটো রং দুদিক থেকে গড়িয়ে আসে ও মিলিত হয়।

নিথর ও অন্ধকার ধরিত্রী। কিন্তু সংঘবদ্ধ হয় 
শহরের ইঁটকাঠ। জানালাগুলি কোঁচকানো। গৃহগুলি 
সব এসে হাজির। দাঁড়িয়ে থাকে তারা দল বেঁধে,
জড়োসড়ো, নির্বিকার মুখের অপেক্ষমান জনতা।

[সুইডেনের শীর্ষস্থানীয় কবি এবং মনোবিদ চিকিৎসক। এক দশকের বেশি সময় নোবেল পুরষ্কারের সম্ভাব্য তালিকায় পরে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যে নোবেল পেলেন ২০১১ সালে। ১৯৯০ সালে এক মর্মান্তিক অসুখে তিনি বাকশক্তি হারান। কথা বলতে না পারলেও তিনি কবিতা লিখে চলেন। হুইলচেয়ারে বসে তাঁর এক হাতে পিয়ানো বাজানোর ভিডিও দেখেছি। কবিতাটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত “অসমাপ্ত স্বর্গ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। সুইডিশ ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মে সোয়ানসেন।] 

অড্রি লর্ড (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩৪-১৯৯২)

বিনোদন 

সম্মিলিতভাবে
কাজ করার সুবিধে হবে
আগে যদি
মিলিত হয়
একজোড়া গতর আমাদের
কাগজের ওপরে কলম
না কোনো পরোয়া না কোনো মুনাফা
আমরা লিখি কিংবা না লিখি 
যখন তোমার শরীর নড়াচড়া করে
আমার হাতের আবরণে
ছিলেটান আর অপেক্ষমান 
আমি তাদের বন্ধন কেটে দিই 
তোমার ঊরুর বিপরীতে আমায় সৃষ্টি করো তুমি
পাহাড়-পর্বতে আকীর্ণ সেই প্রতিমা
শব্দময় ভুবনগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
আমার শরীর নিয়ে যে খেলা
খেলতে চাও তুমি
তার কবিতা লিখি আমি
তোমার মাংসকে বিদ্ধ করে।

তোমাকে ছুঁয়ে মধ্যরাতের স্পর্শ পাই
কণ্ঠনালীতে আগুন জ্বালায় চাঁদ
তোমার মাংস থেকে ফুল ফোটা দেখে চোখ জুড়োয়
তোমাকে নির্মাণ করে
নির্মিত তোমাকে
মেশাই আমার অভ্যন্তরে। 

[নারীবাদী মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক, গ্রন্থাগারিক এবং মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী। নিজেকে বর্ণনা করেছেন “black, lesbian, mother, warrior, poet” হিসেবে। কালো মানুষের ওপরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম তাঁর। মাত্র ৫৮ বছর বয়েসে কর্কটরোগে অকালমৃত্যু। কবিতাটি নেওয়া হয়েছে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত “কবিতাসমগ্র” থেকে।]

নিকি জিওভানি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- )

তুমি আছো

আমার কবিতাগুলো যত্ন করে রাখবো
আমার স্বপ্নের শীতকালের জন্যে
দোলচেয়ারে দুলতে দুলতে
জড়িয়ে ধরবো আমার জীবনকে
অবাক লাগে -- কী ভাববো তখন 
পুরানো প্রেমিকদের কথা -- অনেককেই 
আর মনে পড়ে না আমার 
তবে জানি আমার নিজের জীবনকে আর 
জানি তুমি আছো 

গভীর শীতের দিনে তুমি থাকবে সঙ্গে 
হাঁটুর ওপরে শ্যামদেশের বেড়ালের মতন 
গায়ে হাত বোলালেই গুর গুর আওয়াজ 

বৃষ্টির দিনেও থাকবে তুমি 
মাথার ওপরে বিশাল একটা ছাতার মতন 
আর্দ্র কুয়াশায় মিশে যেতে দেবে না আমায় 

রাতের আঁধারেও সঙ্গ দেবে তুমি 
ঝড়ের রাতে লাইটহাউসের মতন 
পথ দেখাবে কূলের নিরাপত্তার দিকে

গ্রীষ্ম দ্বিপ্রহরের উষ্ণতাতেও পাশে থাকবে তুমি 
আমার নগ্ন পিঠে মালিশ করবে নারকেল তেল 
যাতে রোদে না পুড়ে তামাটে হয়ে যাই আমি 

যত্ন করে রেখে দেব একটা কবিতা 
কেবল তোমার মুখে শুনবো বলে
তোমার কণ্ঠস্বর হাসি ফোটায় আমার মুখে 
যদিও আমি নিয়মিতই কেঁদে উঠি 
তুমি বলেছো যে তুমি ভালো করেই জানো 
নিরাশ করবো না তোমায় আমি 

তুমি চলে গেলেও হতাশ হবে না 
বারান্দার দোলচেয়ার অথবা আমি 
শীতের শূন্যতা আমি 
জমা করে রেখে দেব 
এই কথা জেনে --
তুমি সর্বদা থাকবে আমার সঙ্গে 

টীকা:
শ্যামদেশের বেড়াল: সিয়ামিজ ক্যাট (Siamese Cat), ঘিয়ে রঙের ছোটো ছোটো লোমওয়ালা বাদামি মুখের বেড়াল।

সম্মোহন 

একদিন 

তুমি দরজা খুলে ঢুকবে আমার ঘরে 
আমি পরে থাকবো লম্বা 
আফ্রিকান গাউন 
তুমি বসতে না বসতেই বলবে “ওই কালো …..”
সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরবো আমি তোমার 
দেখেও দেখবে না তুমি, বলবে “ওই দাদার 
কথা কিছু শুনেছো …..”
তোমার হাত দিয়ে জড়াবো গলা 
তুমি ঘ্যান ঘ্যান করেই চলবে “এই বিপ্লব…..”
আমি তোমার হাতের স্থান করে দেব আমার তলপেটে 
তুমি আগের মতোই বলে চলবে 
“আমি বুঝতে পারি না …..”
আমি তোমার হাত নিয়ে সংগোপনে বোলাবো ওপর থেকে নিচে 
এবং ধীরে ধীরে খুলে ফেলবো তোমার দাশিকি 
তুমি বলতে চাইবে “এখন আমাদের প্রয়োজন…”
আমি জিভ দিয়ে চাটবো তোমার বাহু 
কথা থামবে না তোমার “আমার মনে হয় এখন চাই…..”
এর মধ্যে আমি বেল্ট খুলে নামিয়ে ফেলেছি তোমার প্যান্ট
“বিপ্লবের এখন যা পরিস্থিতি…..” 
এদিকে তোমার আন্ডারপ্যান্ট নেমে গিয়েছে হাঁটুর নিচে 
সম্বিৎ ফিরবে তোমার তখন 
দেখবে নিজের অসম্বৃত অবস্থা 
তোমায় জানি বলেই বলছি 
তুমি তখন বলবে 
“নিকি,
এ তো প্রতিবিপ্লবী আচরণ, তাই না…….?

টীকা: 
দাশিকি: পশ্চিম আফ্রিকার জাঁকজমকপূর্ণ রঙিন জামা।

[আফ্রিকান-আমেরিকান প্রতিবাদী কবি, রাজনৈতিক কর্মী এবং ভার্জিনিয়া টেক এর অধ্যাপক; 2007 সালের 16 এপ্রিল তাঁর কবিতার ক্লাসের ছাত্র সিউং-হুই চো অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে হত্যা করে বত্রিশ জন ছাত্রছাত্রীকে; পরের দিনের স্মরণসভায় মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দেন তিন -- “We know we did nothing to deserve it. But neither does a child in Africa dying of AIDS. Neither do the invisible children walking the night awake to avoid being captured by a rogue army. Neither does the baby elephant watching his community being devastated for ivory. Neither does the Mexican child looking for fresh water....We are Virginia Tech.... We will prevail.” কবিতাদুটি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত “প্রেমের কবিতা” (“Love Poems”) সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।]

এইভান বোলান্ড (আয়ারল্যান্ড, ১৯৪৪-২০২০)

কোয়ারান্টিন 

সমগ্র মানবজাতির ঘোর দু:সময়ে 
সবচেয়ে বাজে বছরের, সবচেয়ে বাজে ঋতুর, সবচেয়ে বাজে প্রহরে,
একজন মানুষ তার কর্মশালা ছেড়ে রওনা দিল বৌকে সঙ্গে নিয়ে।
হাঁটছিল সে -- হাঁটছিল তারা দুজনে -- গন্তব্য উত্তর দিকে।

অনাহারে গায়ে জ্বর এসেছে বৌটার, হাঁটতে অপারগ হলে
স্বামী তাকে তুলে নিল নিজের কাঁধে।
এভাবেই চললো তারা -- পশ্চিমে, আরও পশ্চিমে, তারপর উত্তরে।
সূর্য ডুবে গেলে নক্ষত্রদের থেকে ধরায় নামে তুষারের শীতলতা।

ভোরবেলায় তাদের দুজনকেই পাওয়া গেল মৃত।
শৈত্যে, খিদেয়, আর মানবজাতির সমস্ত বিষ শরীরে নিয়ে;
বউটার পাদুটোর চেটো রাখা ছিল স্বামীর বুকের গায়ে।
তার হৃৎপিণ্ডের অন্তিম উষ্ণতাটুকু দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল নারীকে।

এদের চৌকাঠ পার হবে না পৃথিবীর কোনো প্রেমের কবিতা।
বেফাঁস কোনো কথা বলার ফুরসৎ নেই এখানে।
সহজ সৌন্দর্যের প্রশংসা অথবা শারীরিক কামনা-বাসনা
হৃদয়হীন হিসেব-নিকেশের সময় এখন:

তাদের যুগলমৃত্যু ঘটেছিল ১৮৪৭ সালের শীতকালে।
কেমনভাবে বাঁচতো তারা; কেমন দারিদ্র তাদের জীবনে।
আর কোন সেতু জুড়ে রাখতো তখনকার পুরুষ আর নারীকে।
আর কোন গভীর অন্ধকারে সেটা প্রমাণ করা সম্ভব।

[প্রথা-বিরোধী এই প্রেমের কবিতার লেখক আয়ারল্যান্ডের কবি, বাস করতেন আমেরিকাতে, অধ্যাপনা করতেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। মারা গেলেন ২৭ এপ্রিল, ২০২০; না, করোনার প্রকোপে নয়, স্ট্রোক হয়ে। বয়েস ৭৫। তাঁর কবিতা পড়ানো হয় আয়ারল্যান্ডের স্কুলে। ২০০১ সালে প্রকাশিত কবিতার বই এর নাম “প্রেমের কবিতার বিরুদ্ধে”। কবিতাটি “সংকেত” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

ক্যারোল সি গ্রেগরি : (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৫- ) 

প্রেমপত্র 

প্রিয় স্যামসন,
তোমার চুলগুলো 
একটা জারে ভরে 
ওর কাছে 
ন্যাসপাতি গাছের গোড়ায় রেখেছি।

আমার কৃতকর্মের কথা 
কয়েকদিন ধরেই ভাবছি এবং
আমি এখনও মনে করি না 
ঈশ্বর তোমায়
অমিতশক্তি দিয়েছেন বলেই
তুমি আমাদের লোকজনকে
ধরে ধরে মারবে;

ভালোবাসা নিও -

ডিলাইলা; 

[আফ্রিকান-আমেরিকান কবি এবং ম্যানহাটান কমিউনিটি কলেজের সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপিকা। কবিতাটি “কন্ডিশন ৫” কবিতাপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। ]

নুট ওডেগার্ড (নরওয়ে, ১৯৪৫- )

সব কিছু 

থরজাৰ্দুর এর জন্যে 
যখন আমরা বৃদ্ধ হই, হে প্রিয়ে 
কাকের দল আসে আমাদের নিতে 
(কা: কা:, তারপর ডানার তুমুল ঝাপটে সোজা আকাশে,)
কোথায় যাবে আমাদের প্রেম তখন?

যে হাসিমুখ এখন বলে যায় ভাঙা কফি-মেশিনের কথা,
গাড়ির গায়ের মরচে, হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করা,
খসে পড়েছে দাঁতের ফিলিং, ফোনের বিল দেবার দিন এলো,
অথবা সোনালি চাঁদ দেখার সোহাগ এবং ফুলে ফেঁপে ওঠা 
পাহাড়ি গোলাপ, যাতে ব্যাখ্যা করা যায় সব ডাহা মিথ্যে 
আর অন্য ছলচাতুরি, কিন্তু বলতে পারে না আমাদের না-পাওয়া 
সন্তানের কথা এবং যে চুম্বনে আমি গলে যাই তোমার সঙ্গে,
তার কী হবে তখন?

অথবা যে চোখজোড়া কমপিউটারের সবুজ পর্দায় চেয়ে থাকে 
দিনের পর দিন এবং সন্ধের সময় তুমি জামাকাপড় ছাড়লে 
তাড়িয়ে তাড়িয়ে দ্যাখে তোমায়: লজ্জায় আলো নেভাও তুমি,
দাঁড়াও সিল্যুয়েট হয়ে -- সুপক্ব স্তন আর নিতম্বে আইসল্যান্ডের 
কোবাল্ট -- নীল সমুদ্র থেকে আলো চুঁইয়ে আসে জানালার 
খড়খড়ি বেয়ে।

অথবা যে হাত পাতার পর পাতা লিখে যায় আর তুষার-ঝাড়ু
গুছিয়ে রাখে তার জায়গায়, আদর করে তোমার গতরে,
যতক্ষণ না আগুন হয়ে জ্বলে ওঠো তুমি, আর
আমাকে চাও তোমার মধ্যে নিতে --
বাঁধভাঙা স্রোতের মতন আমি ঝাঁপাই তোমার অভ্যন্তরে আর
জলপ্রপাত হয়ে নামি তোমার জরায়ুতে, যেটা সেদিন
কেটে আলাদা করলেন রিকিয়াভিকের শল্য-চিকিৎসক?

এই সব, সব কিছু, যাকে আমরা বলি প্রেম--
কাকেদের আগমনের সময় কোথায় লুকাবে তাকে?
আমাদের দুজনকে তারা একসঙ্গে নেবে না। আমাদের মধ্যে
একজনকে আগে গিয়ে শুতে হবে তুষারপাতে নোংরা হওয়া জমিতে
সমুদ্রের পাশে (গত গ্রীষ্মের হলুদ ঘাস, এখন সজীব তুষার-জলে),
তারপর কাকেরা এসে ঠোকরাবে তার ঠোঁটে,
চোখে, হাতে, অথবা যৌনাঙ্গে।

আর অন্যজন দাঁড়িয়ে থাকবে, হে প্রিয়ে, জানালার পেছনে,
ঘুম ভেঙে উঠবে ভোরবেলা এবং চালিয়ে যাবে চির চেনা
দিনগত পাপক্ষয় -- চিঠির বাক্স থেকে তুলে আনবে 
সকালের টাটকা মর্গ্যানব্লাদিদ। বাথরুমের কল থেকে 
নিজের মুখ দেখবে আয়নায়: সেখানে কি নিজের মুখ ছাড়া 
অন্য কিছু দেখা যাবে? অন্যজনের মুখও কি তখন 
ঝিকমিক করবে আরশিতে, যখন পরিত্যক্ত গৃহগুলি 
সৈকতে দাঁড়াবে আলোঝলমল? 

টীকা:
পাহাড়ি গোলাপ (Rowan-tree) -- উত্তর ইয়োরোপের পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ, বৈজ্ঞানিক নাম Sorbus Acuparia. একই ধরণের গাছ জন্মায় হিমালয় অঞ্চলে: Sorbus Cashmiriana.

মর্গ্যানব্লাদিদ (Morganbladid ) -- রিকিয়াভিকের জনপ্রিয় সংবাদপত্র।
[গভীর ধর্মভাবনার অনুপ্রেরণায় কবি। নরওয়ের দৈনন্দিন জীবনের ছবি ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। গ্রামের কৃষক দম্পতি, তাঁদের ট্র্যাক্টর ও পোষা কুকুর, মাঝিদের মাছ ধরার জেলে ডিঙি, স্থানীয় গির্জার ধর্মযাজক -- সাধারণ মানুষ, কেজো মানুষের কেজো কথা নিয়ে মুখর তিনি। যীশুর সহচর জুডাস ইস্কারিয়ট এর কাহিনী অবলম্বনে লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা -- প্যালেস্টাইনের পটভূমিতে প্রাচীন কাহিনীর নতুন কাব্যরূপ। নরওয়ের ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ব্রায়ান ম্যাকনিল।] 

জোন আই সিগেল (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৬- )

মেরি ক্যাসাট: চিঠি (১৮৯০-১৮৯১)

সারাদিন চিঠিটা গানের মতন তার সঙ্গে ঘরে 
যখন সে ছুরি দিয়ে কাটে প্রাতঃরাশের কমলালেবু,
চুলে বুরুশ চালায়, বা 
জানালা বন্ধ করে।

সারাক্ষণ সে তার কথা শোনে 
যখন বন্ধুরা বেড়াতে আসে আর 
সে গতকালের খোশখবর নিয়ে 
গল্পগুজব চালায়,
চা ঢালে,
বিদায় জানাতে দরজায় এসে দাঁড়ায়।

তারপর তার সঙ্গে একলা হয়ে 
শেষ বিকেলে,
তাকে নামিয়ে রাখে লেখার টেবিলে,
ফুলদানিতে ফুলের মতন করে 
সাজায় তাকে।

তারপর তাকে খামের মধ্যে ভরে দিয়ে 
জিভ ছুঁইয়ে আশ্লেষে খাম বন্ধ করে।

টীকা:
মেরি ক্যাসাট (১৮৪৪-১৯২৬) অংকিত “চিঠি” তৈলচিত্রটি ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট” এ রক্ষিত আছে।

[জোন আই সিগেল এর কবিতা আমেরিকার বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিউ ইয়র্কের অরেঞ্জ কাউন্টি কমিউনিটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপিকা। “ওয়ার্ডস্মিথ” নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। কবিতাটি “দি আটলান্টিক মান্থলি” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।]

এডওয়ার্ড হার্শ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫০- )

দুটি (পান্ডিত্যপূর্ণ) প্রেমের কবিতা 

১. মৃত সাগরের পুঁথিসমূহ 

কুমরানের অন্ধকার গুহায় দীর্ঘকাল বন্দী
প্যাপিরাসের পাতায় লেখা গোপন শিক্ষার পুঁথির
অচেনা অক্ষর হয়ে লুকিয়ে ছিলাম আমি,

আর তুমি হলে সেই পণ্ডিত গবেষক
এক নিবিড় পাঠক, যার জন্যে
আমার সারা জীবনের অপেক্ষা

যে আমাকে খুলে ফেলবে প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে
আর গভীর অধ্যয়নে বুঝে নেবে আমার ভাষা
আর আকণ্ঠ অভিনিবেশে উন্মোচন করবে তার রহস্য। 

২. পরমানন্দের সন্দর্ভ 

তোমার নগ্ন শরীর ছুঁয়েছিলাম আমি 
পণ্ডিত রাবাই যেমন দুবেলা 
কামনার প্রাচীন পুঁথিগুলো খুলে 
তার অক্ষরের রহস্য বুঝে নিতে চায় 

মনে আছে আমাদের প্রলাপী চিত্তবিভ্রম 
যখন আমার আঙ্গুল গুলো সামনে আর পিছনে 
পৃষ্ঠা থেকে পৃষ্ঠা, বর্ণ থেকে বর্ণ, অক্ষর থেকে অক্ষর,
বাক্য থেকে বাক্য -- সরে সরে যেতে থাকে।

আমি ছিলাম নিবেদিত পাঠক 
দিনের পর দিন ছুঁয়েছি তোমার রহস্য 
গোপন পুঁথির গোপন বাক্যগুলিতে।
আমাদের শয়নকক্ষ এক পবিত্র মন্দির 

কেঁপে ওঠে আমার দুহাত 
আশংকায় বেপথু আমার কণ্ঠস্বর 
আউড়ে যাই সে পুঁথির আশীর্বাদ 
যা ঝলসে উঠবে খানিকটা পরেই।

টীকা:
কুমরান: প্যালেস্টাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের যে গুহায় লুকানো ছিলো মৃত সাগরের পুঁথি (“Dead Sea Scrolls”); সেগুলো প্রথম খুঁজে পান বেদুইন মেষপালকেরা।

গোপন শিক্ষার পুঁথি: গ্রিক ভাষায় আপোকৃফন (“Apocryphon”); প্রাচীন ইহুদি ও খৃষ্টান ধর্মগ্রন্থ।

রাবাই: ইহুদি ধর্মযাজক (“Rabbi);

[নামকরা মার্কিন কবি -- ৯ টি কাব্যগ্রন্থ; কিন্তু “কীভাবে কবিতা পড়তে হয় এবং কবিতার প্রেমে পড়তে হয়” (১৯৯৯) নাম একটি বেস্টসেলার গদ্যগ্রন্থ লিখে জনপ্রিয়। সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন দু দশক; কবিতা দুটি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত “প্রেম বিষয়ক” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

গ্রেস নিকোলস: (ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ড, ১৯৫০- )

অভিযাত্রী 

পুরুষ নারীকে দিলো ইয়োরোপ -- পুরো 
মহাদেশটির রূপরেখা।

নারীর জবাব -- উপচানো তোতারঙ্গের মেঘ।
পুরুষ আনলো সিধে সোনালী চুল আর 
শাদা চামড়ার পাগলামি।

নারী দিলো কালো পশম। তার 
যুগ্ম নিষিদ্ধ ফলের অন্ধকার।

পুরুষ বয়ে আনে ইউরেনিয়াম, প্ল্যাটিনাম, এলুমিনিয়াম 
আর কনকর্ড।

নারী এগিয়ে দেয় তার ধূসর নিতম্ব।

পুরুষ বলে, দারুচিনির গন্ধ তোমার ত্বকে।

নারী গায় ঘুমপাড়ানি গান আর 
পিঠ চুলকে দেয় তার।

পুরুষটি কলম্বাসের মতন --
অসংবৃত নৌকো ভেড়ালো তার
ঘুমঘুম জটপাকানো বাগিচায়।

নারী তার কাছে সমর্পণ করলো 
পুরো ইন্ডিজ আবার -- তবে এবার 
আস্তে আস্তে প্রসারিত ঊরুদ্বয় জড়ো করলো 
সম্রাটের মাথার দুপাশে।

[কবির জন্ম গিয়ানায়; ১৯৭৭ সাল থেকে বাস করেন ইংল্যান্ডে; ১৯৮৩ সালে কমন ওয়েলথ কবিতা পুরস্কার পেয়েছিলেন; বারোটি কাব্যগ্রন্থ; কবিতাটি ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত “অলস নারীর অলস ভাবনা” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।] 

মে ২০২০ [ক্রমশ:]
0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in



অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৮
 
এবারের কিস্তি শুরু করছি সুদূর উত্তরের খর্খরে, শীতল হাওয়ায় -- ফিনল্যাণ্ড আর আইসল্যান্ডের কবিদের কবিতা দিয়ে।

দানিউব নদী ছিল রোম সাম্রাজ্যের উত্তর প্রান্তে -- সেই স্রোতস্বিনী পেরিয়ে ওপারে যেতে ভয় পেতো তার সৈন্যেরা। আরও সুদূরের বরফে ঢাকা দ্বীপগুলিরও খবর ছিল তাদের কাছে -- নাম দিয়েছিল ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়া’ অর্থাৎ “দূর উত্তরের দ্বীপগুলি”। রুক্ষ প্রকৃতির দেশ, কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অমলিন। মানুষগুলি সুভদ্র, সুশিক্ষিত ও শ্বেতকায় -- জন্মের হার কম এবং বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেশি; নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার এবং সমকামীদের সমানাধিকার বিষয়ে দেশগুলি পৃথিবীর শীর্ষে। এক নারী অন্য নারীকে, অথবা এক পুরুষ অন্য পুরুষকে বিবাহ করে ঘর-সংসার করতে পারেন নির্বিঘ্নে, লালন-পালন করতে পারেন ক্ষেত্রজ অথবা দত্তক নেওয়া সন্তানদের। উদারপন্থী শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঘুচে গিয়েছে কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি এবং ধর্মভীরুতা। মানুষ বাস করেন সন্তুষ্ট, শান্তিময় সহিঞ্ষুতায়। কিন্তু তাঁরা অনেকেই সঙ্গীহীন ও একাকী। মাথাপিছু মানসিক রোগীর সংখ্যা এবং আত্মহত্যার সংখ্যা খুব বেশি। দীর্ঘ নিশীথ এবং গভীর শৈত্য থেকে জন্ম হয় অকল্পনীয় নৈরাশ্যের আর তার ছায়া পড়ে সাহিত্যে।

সোলভেইগ ভন শুলৎস ফিনল্যান্ডের কবি কিন্তু লেখেন সুইডিশ ভাষায় -- ঠিক যেমন একসময় বাঙালিদের বৌদ্ধিকচর্চা চলতো সংস্কৃত অথবা ফার্সি ভাষায়। সাত দশক ধরে সাহিত্যের চর্চা করেছিলেন এই দীর্ঘজীবী সাহিত্য-সম্রাজ্ঞী; দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের উপকূলে সুইডিশভাষী পরভো শহরে তাঁর জন্ম -- কবিতায় তিনি তাঁর নারীসুলভ অনুভূতিগুলি প্রকাশ করেছেন অনবদ্য শৈলীতে -- পৃথিবী, সূর্য, সমুদ্রের ঢেউ, বৃক্ষরাজি, মানব-মানবীর প্রেম। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু ছেঁকে নিয়ে প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে তার আবেগহীন বহি:প্রকাশ। এক একটি কবিতা তাঁর কাছে এক বিন্দু বৃষ্টির জল, যার মধ্যে তিনি দেখতে পান মানব অস্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন। প্রথম গ্রন্থ থেকেই তাঁর কবিতায় প্রকৃতি সুন্দর, ভয়ঙ্কর, সতেজ ও মুখর। ইঙ্গমার বার্গম্যানের চলচ্চিত্রের মতন সেখানে শাদা আর কালো রঙের প্রাধান্য হলেও সেখানে মানবিক আবেদনের অভাব নেই।

আইসল্যান্ডের এক শীর্ষস্থানীয় কবি স্টাইন স্টাইনার -- মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়েসে পোলিও রোগের আক্রমণে অকালমৃত্য না হলে তিনি ইউরোপের এবং পৃথিবীর এক প্রধান কবি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল মধ্যে। বুদ্ধদেব বসুর সমবয়েসি কবি তাঁর কবিজীবন শুরু করেছেন প্রথাসিদ্ধ ধারায় কবিতা লিখে এবং পরবর্তীকালে সেই প্রথার নিগড় ভেঙে নির্মাণ করেছেন আইসল্যান্ডের আধুনিক কাব্যপ্রতিমা। খেতমজুরের পরিবারে তাঁর জন্ম, দিন কেটেছে খিদে আর ব্যাধির আক্রমণে। গৃহনির্মাণশিল্পে অল্প মজুরিতে কঠোর পরিশ্রম করে পাশাপাশি চালিয়েছেন সাহিত্যচর্চা। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থের নাম “গন্তব্যহীন যাত্রা”।

স্টাইন স্টাইনার এর চেয়ে বয়েসে আট বছরের ছোট ইয়ন উর ভর, তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী। শৈলির দিক থেকে তিনি আপাদমাথা ইয়োরোপীয় -- আইসল্যান্ডের কবিতার ঐতিহ্যকে পুরোপুরি বর্জন করেছেন তিনি। তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল যে শহরতলিতে তিনি বাস করেন, সেখানে আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা -- সে কাজে তিনি সফল হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি আইসল্যান্ডের সেরা কবির পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নামে একটি প্রধান সাহিত্য পুরস্কার চালু হয়েছে।

একই সঙ্গে সংকলিত হয়েছেন পাঁচজন মার্কিন মানবীকবি। সংসারী এবং শরীরী কবি হিশেবে শ্যারন ওল্ডস এর দেশজোড়া খ্যাতি -- কবিতায় নৈর্ব্যক্তিক বিষয় নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না বিশেষ; শাকসব্জি, রন্ধন, বাগানের কাজ, শিশুকে স্তন্যদান, অসুস্থ সন্তানের সেবা, আকাশের চাঁদ কিংবা বন্ধুত্ব নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন তিনি। কিন্তু ঋতু শোণিত, ট্যাম্পন , শরীরের বয়েসজনিত স্ট্রেচমার্ক, টয়লেট, যৌন অযৌন শারীরিক প্রক্রিয়া -- কোনোকিছুই ব্রাত্য নয় তাঁর কবিতায়। অজাত শিশুরা লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে জন্ম নেবার অপেক্ষায় -- কেউ দাঁড়িয়েছে শিক্ষকের লাইনে, অন্যেরা সৈন্যদের লাইনে, লেখকদের লাইনে, উকিল, পুরোহিত, ব্যবসায়ীদের লাইনে, কিন্তু কবি হওয়ার অথবা মা হওয়ার লাইন একেবারে খালি -- সেখানে একজনও নেই -- এই কবি চেয়েছিলেন শূন্যস্থানটি পূর্ণ করতে।

বাকি চারজন মানবীকবিও কবিতায় এবং জীবনযাত্রার বৈচিত্রে বর্ণময়। কবি হিসাবে এঁরা সকলেই সাহসী, মুখর, দক্ষ ও বহুমুখী -- নানান পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত। আসুন তাঁদের কবিতাগুলি উপভোগ করি।

সোলভেইগ ভন শুলৎস (ফিনল্যাণ্ড, ১৯০৭-১৯৯৬)

স্বপ্ন

হঠাৎ আলোর ঝলক বন্যার মতন 
তার ঘাগরা বেয়ে ওপরে ওঠে 
ছড়িয়ে যায় তনুর অন্ধকার গভীরে।
নারী ত্বরিতে ঘাগরা খুলে ফেললে,
শাদা শাদা পপিফুল হয়ে 
তারা ওড়ে বিছানার ওপরে শূন্যে।
পুরুষটি ধরতে যায় তাদের 
মুখ ডোবায় তাদের শান্ত ও 
আত্মসমর্পণময় অস্তিত্বে।
এদিকে তার ভুলে যাওয়া নারীটি 
নগ্ন দাঁড়িয়ে 
শয্যার পাশে।


তুমি আর আমি 

এই তুমি আর আমি 
মানে আমরা।
এ সম্পর্ক চিরস্থায়ী।
কখনও তার বস্তুরূপ বা ওজন 
আমি দেখতে পারি হাতে নিয়ে 
উষ্ণ অথচ দৃঢ়, দেখার জন্যে,
ভাগ করে নিই তাকে 
যা রুটি আর নুনের মতোই 
অপরিহার্য।


প্রেমিক-প্রেমিকা 

।।১।।
যখন আমার হাতে হাত বোলাও তুমি
ধীর, অভ্যন্তর, নিরুচ্চার, ডান এবং বাঁ হাত --
গাছ গজায় আমার অন্তরে, বন্দি পাখির ঝাঁক উড়ে যায়।
যখন তুমি গ্রহণ করো আমার ওষ্ঠ, ডুবে যাও তার গভীরে,
দ্রুত ডানা ঝাপটায় আমার আঁখিপল্লব:
ছেড়ে দাও, মুক্তি দাও আমায়। আমি মুক্ত হতে চাই।

যখন তুমি চুমু খাও আমার স্তনে,
কলিরা কাঁপে, ফুল হয়, ত্বক খুঁজে পায় কণ্ঠস্বর:
আশ্লেষে চেঁচিয়ে আমি, নীরব চিৎকার।

।।২।।
চারপাশে ধরার বাতাসে মৃদু মর্মর,
শিকারী হাঁটে -- মন্থর অথচ দৃঢ় গতি,
তার সঙ্গী কুকুরটির নিরানন্দ আর্তনাদ,
অজানা গ্রহ থেকে তীর ছোটে --
এবং সব কিছু ছাপিয়ে কৃষ্ণ ঝড়ের গর্জন।

নক্ষত্রের শয্যায় টানটান শুয়ে আমরা,
নক্ষত্রের শয্যা, আমরা নির্ভয়।
যতক্ষণ আমার উষ্ণতামথিত নি:শ্বাস পড়ে তোমার কাঁধে,
আর তোমার হাতের শান্তি-বিশ্রাম আমার ঊরু-খিলানে,
যতক্ষণ আমরা চোখ বুজে মানবার্তা শুনতে থাকি,
প্রবেশ করি একে ভেতর, পুরানো কামনা ও স্মৃতি সমেত,
যতক্ষণ আমাদের মিলিত হাসি অন্ধকারের পানে বয়,
যতক্ষণ আমরা বাঁধা থাকি উজ্জ্বল বিশ্বাসে,
কোনো সন্তাপ স্পর্শ করে না আমাদের।

[গত শতাব্দীর সমবয়েসী ফিনল্যান্ডের এই শক্তিশালী কবি-সাহিত্যিক। তার মধ্যে সাত দশক ধরে তাঁর সাহিত্যচর্চা। পঞ্চাশটির বেশি গ্রন্থ: কবিতা, ছোটোগল্প , উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচিত্র। তাঁর লেখা নাটক অভিনীত হয় মঞ্চে, বেতারে ও টেলিভিশনে। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি থেকেই উঠে আসে তাঁর সাহিত্যের রসদ -- কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকেই ফুটে ওঠে বৃহৎ ও মহতের আভাস। সুইডিশ ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন অ্যান বর্ন।]


স্টাইন স্টাইনার (আইসল্যান্ড, ১৯০৮-১৯৫৮)

সমুদ্রসৈকতে গ্রীষ্ম 

সূর্যের শুভ্র আলোক 
আর সমুদ্রের গুনগুন গান --
এরা আমার ভ্রাতা ও ভগিনী।

একা বসে কান পেতে শুনি,
সমুদ্র আমার সামনে 
উঠে আসে কটা চুলের নারীর বেশে।

আমি দেখি নিশীথের আগমন,
হাতদুটো ঘুমন্ত হলেও 
সারারাত জেগে থাকে হৃদয়।

আর আমার ভালোবাসায় মত্ত, সে নারী,
হাসে আর বলে:
আমি অলীক; আমি নেই।


সময় আর জলস্রোত 

।।১।।
সময় জলস্রোতের মতন,
আর জলরাশি -- শীতল এবং গভীর 
আমার অনুভূতির মতন।

আবার সময়কে মনে হতে পারে 
জলের রঙে আঁকা ছবি,
তার অর্ধেকটা এঁকেছি আমি।

আবার সময় ও জলরাশি 
বয়ে যায় চিহ্নহীন বিলুপ্তির দিকে 
আমার অনুভূতির চেতনায়।


।।২।।
সূর্য,
আমার সঙ্গেই থাকেন তিনি
হলুদ জুতো পায়ে
তন্বী নারীর ভঙ্গিতে।

জলের কুড়ি ফ্যাদম নিচে 
পাশাপাশি ঘুমোয় আমার বিশ্বাস ও প্রেম --
দোরঙা এক ফুল যেন।

আর সূর্য,
হলুদ জুতো পায়ে হাঁটেন 
সেই অসন্দিগ্ধ ফুলকে মাড়িয়ে।

।।৩।।
যে ঢেউ ভাঙে 
তামাটে রঙ বালুকায়;
যে বাতাস বয় 
নীল ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে;
সে ফুলটি মরে।

পাথর ছুঁড়ি 
সিমেন্টের দেওয়ালের গায়ে,
পাথর হাসে।

।।৪।।
আমার অনুভূতির থেকে 
তোমার ঠোঁট পর্যন্ত --
পথহীন সমুদ্র।

আমার উজ্জ্বল স্বপ্নগুলি 
চোরাস্রোতের ঢেউয়ে --
কিন্তু গভীর সমুদ্র ঘুমোয় তখন।

আমার গোপন দু:খগুলো 
লুকিয়ে দেখা করে তোমার সঙ্গে
দূরের কোন নীল সায়রে। 

।।৫।।
সূর্যের শাদা আলোয় তোমার রূপ 
মনে করিয়ে দেয় 
আমার হিপি দিনগুলোর কথা।

নকল নীল বৃষ্টির মতন 
তোমার অশ্রু পড়ে 
আমার দু:খের গায়ে।

আর তোমার দূরত্বকে 
আঁকড়ে ধরে শুই 
প্রথমবারের মতন।

।।৬।।
আমার দু:খের 
শুভ্র আলো এসে পড়ে 
তোমার জাগরুক চোখে।

আমার মনকে উড়তে দিই 
তোমার আঁখির 
পথহীন সমুদ্রে।

তোমার সুখ যাতে 
বইতে পারে আমার আঁখির 
শুভ্র আলো।

।।৭।।
আমার শাদা পশমি স্বপ্নের 
কল্পিত আলো 
ছড়ায় তোমার চিহ্নহীন পদক্ষেপে।

উল্টোমুখী হাওয়ার 
দ্বিধান্বিত স্রোতে 
তোমার মুখচ্ছবি দেখি।

আর তোমার মুখ 
হাড় কাঁপানো শীতল ছায়া হয়ে 
ছুটে যায় আমার নিদ্রা ও স্বপ্নের ফাঁক দিয়ে।

।।৮।।
রক্তবর্ণ সমুদ্রের মতন
নীরবতা ধুয়ে দেয়
আমার কণ্ঠস্বর।

মরচে ধরা অন্ধকার হয়ে 
নীরবতা মুছে দেয় 
আমার অস্তিত্ব।

নীরবতা উঠে এসে 
তিন-ফেরতা কম্বল হয়ে 
জড়ায় নীরবতাকে।

টীকা: 

ফ্যাদম -- জলের গভীরতার মাপক বাঁও। ১ ফ্যাদম = ৬ ফুট। 

[আইসল্যান্ডের প্রথম আধুনিক কবি। প্রাচীন কাব্যরীতিকে ভেঙেচুরে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন নতুন ধারার কবিতা এবং আইসল্যান্ডের কবিতাকে টেনে হিঁচড়ে পৌঁছে দেন বিংশ শতাব্দীতে। ইউরোপের কবিদের অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছে মুক্তছন্দের কবিতা, কিন্তু তার মধ্যেও ধরে রেখেছেন আইসল্যান্ডের ঐতিহ্যমূলক অলংকার ও অনুপ্রাস। মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়েসে পোলিও রোগে মৃত্যু। আইসল্যান্ডিক ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মার্শাল ব্রেমেন্ট।]

ইয়ন উর ভর (আইসল্যান্ড, ১৯১৭-২০০০)

তুষার 

আকাশ থেকে নিষ্পাপ তুষার,
আকাশ থেকে নিষ্পাপ তুষার,
-- তোমার রূপ
সেই তুষারকণাগুলির মতন পবিত্র --

আর তোমার মুখের কথা 
তুষার পতনের মতন মনোরম।

তোমার কেশরাজি 
একদিন তোমার কেশরাজি ছিল 
আমার দৃষ্টি আকর্ষণের 
কুহক জাল।
পুরানো দিনের 
গন্ধতেলের ঘ্রাণ আজও 
পেয়ে যাই তার থেকে।

এখন তোমার দুহাত 
আগলে রাখে 
দুটি দুষ্প্রাপ্য, মহার্ঘ ডিম,
আমাদের ভঙ্গুর হৃদয়দুটি --
অন্তিম দিনগুলোতে 
দেখাশোনার জন্যে।

[ইয়ন ইয়নসনের জন্ম সমুদ্রের ধরে “ভর“ নামে জেলেদেরএকটিগ্রামে। কবিতা লেখার জন্যে তিনি যে নামটি গ্রহণ করেছিলেন, তার অর্থ হলো “ভর গ্রামের ইয়ন“। তাঁর কবিতা পুরোপুরি ইওরোপ-কেন্দ্রিক। আইসল্যান্ডের সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন তিনি। গ্রাম্য চাষা ও জেলেদের মুখের ভাষা তাঁর কবিতায় স্বমহিমায় উপস্থিত। আইসল্যান্ডিক ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মার্শাল ব্রেমেন্ট।]

শ্যারন ওল্ডস: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪২- )

প্রথমবারের যৌনতা

জে-এর জন্য 

আমি জানতাম খুব সামান্য, আর যা জানতাম 
বেশির ভাগ বিশ্বাস করতাম না -- এতবার মিথ্যে 
বলেছে সবাই, আমি ভাবলাম যা হয় হোক,
চাদরের ওপরে তার নগ্ন শরীর, পায়ের 
ছোটো ছোটো লোমগুলি সুন্দর সোনালি ঝিনুক --
কুঁকড়ে যায়, তার পুরুষাঙ্গ 
দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে আমার হাতের মুঠোয়, কিন্তু 
পাথরের মতন শক্ত হয়নি এখনো, তার মুখ 
ঋজু, ভয়ে যেন পিছিয়ে, তার শরীরের 
সব রন্ধ্র থেকে যেন ঝেঁপে আসে স্বেদবিন্দু 
গুটি গুটি হেঁটে চলা ছোট্ট শামুকের মতন, যেমন সময় 
তার হাঁটুতে লাগলো ঠোকাঠুকি, আর আমার হাতে 
জড়ো হওয়া শিশুর মতন কাঁপলো সে,
আর দুধের মতন ভেসে এলো শাদা তরলতা,
আমি দেখলাম তারা জ্বলজ্বল করছে তার পেটের ওপর,
অনেক কিছু বলছে আমায়,
আমি দুহাতে ক্রিমের মতন তাকে ঘষে নিই, 
আর এইভাবে ঢুকে পড়ি ঘটনটির ভেতর।

স্টিল লাইফ 

সহবাস শেষ -- আমি চিৎ হয়ে শুয়ে,
ঢাকা স্তনদুটি ঢাকনা দেওয়া ঝোলের বাটি -- ফাঁপা ও বক্র,
বৃন্তে বেরিফুলের ফুটকি, পরিবর্তনহীন, ঝলমলে। 
আমার পাদুটি অইখানে শায়িত বিছানার কোথাও, টেবিলের 
ধার থেকে উঁকি দেওয়া বড় সড় রূপালি মাছ যেন।
চরম ধ্বংসের দৃশ্য, নিখুঁত শান্তির দৃশ্য,
চকচকে লাল ও ঘন নীলরঙা মৃত বনমোরগের 
ঘাড়ের মেরুনরঙা পালক ও গভীর ক্ষতের মতন,
উজ্জ্বল, স্থির, আলোকময় যৌনমিলন,
আর আমার কপালের মাঝখানে এক ফোঁটা জল 
গোল, শাদা, জ্যোতির্ময় এবং তাতে 
সেই শিল্পীর নগ্ন, উপুড় হওয়া আত্মপ্রতিকৃতি, আলোকিত 
টর্চের মতন তোমার উঁচানো তুলি থেকে ঝরে ফোঁটা ফোঁটা রঙ।


মানচিত্র 

দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত উড়ে এসে ক্লান্ত 
আমরা, গা এলিয়ে দিই বিছানায় 
সমবেত, সাবধান, পাশাপাশি রাখা মানচিত্রের মতন 
মুখোমুখি, পুব থেকে পশ্চিমে, আমার 
সান ফ্রান্সিসকোর গায়ে ঘেঁষে তোমার নিউ ইয়র্ক, আমার 
সোনোমা ঢলে পড়ে তোমার ফায়ার আইল্যান্ডের ওপর, আমার 
নিউ অরলিন্স সটান ঢুকে যায় তোমার টেক্সাসের গহনে, তোমার 
আইডাহো উজ্জ্বল আলো ছড়ায় আমার হ্রদের গভীর জলে, আমার 
ক্যানসাস পুড়ছে তোমার ক্যানসাসের কামানলে, তোমার 
ক্যানসাস জ্বলছে আমার ক্যানসাসের দহনে, তোমার 
পূর্ব উপকূলের প্রমাণকাল চাপ দেয় আমার 
প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রমাণকালে, আমার পার্বত্য লগ্ন 
এসে ধাক্কা মারে তোমার কেন্দ্রীয় লগ্নে, তোমার 
সূর্য চটপট উঠে পড়ে ডানদিকে, আমার 
সূর্য চটপট উঠে যায় বাঁদিকে, তোমার 
চাঁদ অলসগতিতে ওঠে বাঁদিক থেকে, আমার 
চাঁদ অলসগতিতে যায় ডানদিকে, যতক্ষণ না 
আকাশে স্থিত চার চারটে শরীর 
মাথার ওপর জ্বলে, জোড়া লাগায় আমাদের,
আমাদের সব শহরই যমজ,
আমাদের সব প্রদেশই আলিঙ্গনে নিবিড়, এক 
জাতি, এক প্রাণ, অবিভাজ্য,
সবার জন্যে সুবিচার ও স্বাধীনতা।

[আগুনের পরশমণির মতন ঝলসে ওঠে তাঁর কবিতা -- একটি বিখ্যাত কবিতার নাম “পোপের যৌনাঙ্গ”। ১৯৮০ সালে সাঁইত্রিশ বছর বয়েসে তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন: “শয়তান উবাচঃ” -- গ্রন্থের চারটি অংশ: “কন্যা, নারী, মাতা, যাত্রা”। জীবনের অষ্টম দশকেও সেই সাহসী যাত্রা অব্যাহত; ২০১৩ সালে কবিতায় পুলিৎসার পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তিনটি কবিতাই ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত “স্বর্ণকক্ষ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

এরিকা জং: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪২- )

শীতলতর 

আমি আর ভাবি না সব নষ্ট মেয়েদের কথা।
তাদের সুগন্ধি স্তনের অভ্যন্তরে
বিশুদ্ধ সিন্দুক নুনের হৃদয়।
লটের স্ত্রীর মতোই পাপী তারা --
সব কটাই।

আমি কেয়ার করি না যদি আমার 
পুরুষকে নিয়ে তারা নাড়াচাড়া করে পার্টিতে,
বাড়ি নিয়ে গিয়ে সহজেই 
বসিয়ে দেয় স্বামী আর শিশুর ফাঁকে, 
আর চুমু-চোষণের ভঙ্গিতে 
ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতন খালি করে তার পকেট।

কিন্তু শীতলতা বিব্রত করে আমায়,
যখনই হে বাড়ি ফেরে।
বলে, “শীত করছে --”
(তাতে কিছু সাহায্য হয় যে তা নয়)।
গায়ে হাত দিয়ে বুঝি সে নিজে 
জানেও না সে কতোটা শীতল।

উদাসীন সঙ্গম।
মেয়েমানুষকে সপ্তাহে চারবার 
মরে পুড়ে ছাই হয়ে 
আবার নতুন করে জন্মে 
উপলব্ধি করতে হয় তার অভিজ্ঞতা।

ক্ষুরধার তার পাছা 
শ্রোণির হাড় ছুরির ফলা 
তার কনুই কাটতে পারে মাখন।

তার মুখ থেকে বেরোয় 
মেঘের মতন শীতল তুষার।
বিশুদ্ধ বরফে গড়া তার শিশ্ন --
ধোঁয়া উঠতে থাকে।
আমার মুখের ওপর শূন্যে ঝোলে 
তার মুখ -- বরফে খোদাই।

কোনো একদিন 
আমায় ভাঙবে সে 
অথবা 
গলে যাবে নিজেই।

টীকা:

লটের স্ত্রী: যীশু তাঁর শিষ্যদের বলতেন, “লটের স্ত্রীর কথা মনে রাখবে।” বাইবেলের কাহিনি: সডোম নগরী যখন ধ্বংস হচ্ছে, ঈশ্বর তখন লট ও তাঁর স্ত্রীকে আদেশ দেন, একবারও পিছনে না তাকিয়ে সোজা শহর ছেড়ে চলে যেতে। লটের স্ত্রী পিছন ফিরে তাকালে সেই মুহূর্তে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁর মৃতদেহ পরিণত হয় নুনের স্তম্ভে। আজও ডেড সি’র দক্ষিণ উপকূলে গাছের গায়ে নুনের পুরু আস্তর জমে মানুষের আকার ধারণ করে -- ট্যুরিস্টরা ছবি তোলেন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে।

[যদিও গদ্যকার এবং বিতর্কিত নারীবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তাঁর জনপ্রিয়তা বেশি, তিনি কবিতাও লেখেন নিয়মিত; ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তাঁর “উড়ান-ভীতি” (“Fear of Flying”) উপন্যাসটি বিক্রি হয়েছে দু কোটির বেশি কপি। নারীর যৌন আকাঙ্খার এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কার্যকলাপের অকুন্ঠ, দ্বিধাহীন বর্ণনা। সেই তুলনায় তাঁর কবিতা মনোযোগ পেয়েছে কম। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত “প্রেমশিকড়” কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটি সংকলিত হয়েছে। কবিতা অনুবাদের অনুমতি চেয়ে তাঁকে ইমেইল করলে, তাঁর উকিল উত্তরে অনুমতির সঙ্গে জানান যে কবির অন্তনামের উচ্চারণ হবে “জং”, “ইয়ং” নয়।]

লুইস গ্লাক: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- )

বাধাবিপত্তির গান 

যখন প্রেমিককে বাহুবন্ধনে জড়াই, বুকের ভেতর মনে হয়
নড়তে শুরু করলো ধরিত্রীর আদিম হিমবাহ,
বিরাট, বিশাল পাথর উলটে সরতে লাগলো বরফ, তারপর 
গম্ভীর, কঠিন মুখের পাথর সব; আর জঙ্গল উপড়ানো 
বৃক্ষেরা মিলে তৈরি হল ছেঁড়াখোঁড়া ডালপালার সমুদ্র --
আর যেখানে দাঁড়িয়ে শহর, তারাও শুরু করলো গলতে,
দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলা বাগান, উঠোনে বসে চকলেট খাচ্ছিলো 
যে সব খুকিরা, আর আনমনে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো 
তাদের রঙিন খোশা: আর যেখানে শহর ছিলো,
তার আকর, তার উন্মোচিত রহস্য: আর আমি দেখি 
পাথরের চেয়ে বরফ শক্তিশালী, আত্মরক্ষার চেয়েও --

তারপর আমরা যাই যে যার যার পথে, সময় কাটতেই চায় না,
এক ঘন্টাও না।

[জার্মান-মার্কিন কবি -- বারোটি কাব্যগ্রন্থ। একটি কবিতা বিষয়ক সন্দর্ভের সংকলন। পুলিৎসার (১৯৯৩ সালে “বুনো আইরিস” কাব্যগ্রন্থের জন্যে) ও অন্যান্য নানান পুরষ্কার। আমেরিকার জাতীয় কবি ২০০৩-২০০৪। “কবিতা লেখা নিজের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিশোধ -- দুর্ভাগ্য, পরাজয়, ব্যর্থতা, যন্ত্রনা।” কবিতাটি ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত “আকিলিসের বিজয়” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ]

এলেন ব্রায়ান্ট ভয়েট: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- )

অন্যেরা 

আমাদের দুই সন্তান বড়ো হয়েছে, এখন 
আমরা ভাবতে বসি 
অন্য সন্তানদের কথা:
আরও দুবার 

বিরাট মাথাওলা শুক্রাণু লাফিয়ে এসে
গোঁয়ারের মতন আঘাত করলো,
ছুটে এলো চটচটে ডিম্বাণুর দিকে --

বিবাহ 
আমাদের বিবাহ থেকে ক্ষিতি ও তেজ --
এবং তার পরে কী,
মুক্ত অঙ্গনে 

ইঙ্গিত -- ঈশ্বরের আঙুল থেকে 
আদমের হাতে?

আত্মা 
ফিরে গেল:

আমাদের ভাগ্যবান 
অথবা অভাগা চিরকালের জন্যে হারালো, 
তাদের কথা আমরা কখনো বলি না।

[ন’টি কাব্যগ্রন্থ এই মার্কিন কবি ও প্রাবন্ধিকের। তার মধ্যে একটির নাম “স্বর্গের ছায়া” (“The Shadow of Heaven”, ২০০২)। ভারমন্ট রাজ্যের সভাকবি ছিলেন তিন বছর। কবিতাটি “দি আটলান্টিক মান্থলি” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।]

লোলা হাসকিন্স: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- ) 

প্রেম

প্রেমকে সে ড্রেসের মতন গায়ে জড়ায়।
পরে মনে হয় ঠিক যেন ফিট করছে না,
তাই চেষ্টা করে খুলে ফেলতে।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে আসে তার গায়ের চামড়া। 

[মার্কিন কবি এবং ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্সের অধ্যাপিকা। ছ’টি কাব্যগ্রন্থ। একটির নাম “তার কামনার রেখা -- নতুন ও নির্বাচিত কবিতা” (“Her Desire Lines -- New and Selected Poems”, ২০০১)। কবিতাটি “দি আটলান্টিক মান্থলি” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।]

 [ক্রমশ:]