0

সম্পাদকীয়

Posted in

































ঊনআশি বছর আগের কলকাতা শহর। অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি। চারদিন ধরে সংঘটিত হয়েছিল এক হত্যালীলা। শহরের পথঘাট ভিজে গিয়েছিল রক্তে। নিহত হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। কে বা কারা ছিলেন এই 'Great Calcutta Killing'- এর নেপথ্যে? মুসলিম লিগের পক্ষে মহম্মদ আলি জিন্না ডাক দিয়েছিলেন 'Direct Action Day' র - সেটা ছিল ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ আর তারপর এখানে ১৬ থেকে ১৯ আগস্ট যা ঘটে গিয়েছিল, তাকে 'নরমেধ যজ্ঞ' বললে অত্যুক্তি হয় না খুব।

এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। অন্তত ইতিহাসে এর সাক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু এই ধরনের যেকোনও ঘটনার সঙ্গে মিশে যায় কল্পনার নানা রং। এই অধ্যায়টিও তার ব্যতিক্রম নয়। সমস্যার উৎপত্তি সেখানেই। অনেক আজগুবি রটনা হয়তো চক্রান্ত করেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রকৃত সত্যের শিরা উপশিরায়।

সম্প্রতি এইসব প্রসঙ্গ নতুন করে উসকে দেওয়া হল একটি চলচ্চিত্রের রিলিজ উপলক্ষ্যে। আর আশ্চর্যের বিষয় সেখানেও যুযুধান রাজনীতির দুই পক্ষ। অতএব সেদিনও যা হয়েছিল। আজ তাই প্রত্যক্ষ করছি আমরা। সেদিন বলি গিয়েছিল নিরীহ কিছু প্রাণ আর আজ হাড়িকাঠের তলায় আমাদের বিবেক। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in



















"Far from being a feudal poet, the Shakespeare that 'Troilus & Cressida', 'The Tempest,' or, even 'Coriolanus' shows us is much more a Bolshevik (using this little word popularly) than a figure of conservative romance". Wyndham Lewis, "The Lion and the Fox" [London, 1927]. p.3.


গৌরচন্দ্রিকা

[আকাদেমিক দুনিয়ার বাইরে বাংলায় শেক্সপিয়র চর্চার,(মঞ্চে এবং লেখালিখিতে) অন্যতম পথিকৃৎ এবং বিশিষ্ট নট, নাট্যকার ও পরিচালক উৎপল দত্তের ৯১ তম জন্মদিন গেল ২৯মার্চ তারিখে। আবার উইলিয়ম শেক্সপীয়রের জীবননাট্যে ২৩শে এপ্রিল তারিখটি ধরা হয় একই সঙ্গে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন হিসেবে। এই সামান্য প্রবন্ধটি ওঁদের দুজনের প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি মাত্র]


বর্তমান প্রবন্ধটি মহাকবি শেক্সপীয়রের রচনার কোন একাডেমিক চর্চা বা মূল্যায়নের প্রচেষ্টা নয়, সে যোগ্যতাও আমার নেই । এ শুধু বিশ্বজোড়া ভুমন্ডলীকরণ এবং নব-উদারবাদী অর্থনীতির বোলবোলাওয়ের দিনে আমার মত এক ছাপোষা এবং একটু বামঘেঁষা মধ্যবিত্তের নিজস্ব শেক্সপীয়র পাঠ; একান্তই আমার ভালোলাগাটুকু বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার প্রয়াস। তাই এই ছোট পরিসরে আমি সংক্ষেপে ওঁর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইশারা করব।

প্রথমতঃ আমরা মধ্য যৌবনে শেকসপিয়রকে অন্যভাবে পড়ার আগ্রহ পেয়েছিলাম উৎপল দত্তের “শেক্সপিয়রের সমাজচেতনা” বলে বইটি হাতে পেয়ে। কোলকাতার অধ্যাপককুল সেই বইটি নিয়ে কিঞ্চিৎ নাক সিঁটকে ছিলেন। পরে আমার বন্ধু সাংবাদিক প্রণয় শর্মা আমাকে দেখিয়েছিলেন যে ওই বইটিতে ‘যীশু” এবং “ধর্ম” অধ্যায় দুটিতে জার্মান কমিউনিস্ট কার্ল কাউটস্কির ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ‘ফাউন্ডেশন অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি”র প্রভাব বেশ প্রকট। একটু অস্বস্তি বোধ করেছিলাম।

তাতে অবশ্য বইটির উপস্থাপনায় কোন তফাৎ হয় নি। আমার এই অকিঞ্চিৎকর লেখায় মৌলিক চিন্তার বদলে রয়েছে উৎপল দত্ত সমেত সমসাময়িক বামমার্গী সাহিত্য সমীক্ষক গারেথ জেঙ্কিস -- ‘শেক্সপিয়র বিলংস টু আস’(২০১৬)-- এবং টেরি ইগলটন এর মত দিকপাল মার্ক্সিস্ট সাহিত্য সমালোচকদের প্রভাব। তাই এই প্রবন্ধে যদি কিছু ভাল আর্গুমেন্ট থাকে তার কৃতিত্ব ওঁদের। আর দুর্বল বা টেনে মানে করার ক্ষেত্রে বুঝতে হবে আমি কতটা ছড়িয়েছি।


মার্ক্স, এংগেলস, জেনি মার্ক্স ও শেকসপিয়র

দুই বন্ধু, মার্ক্স ও এংগেলস মুগ্ধ ছিলেন শেক্সপিয়রের কলমে সাদামাটা একমাত্রিক স্টেনসিল চরিত্রের বদলে বহুস্তরীয় দ্বন্দ্বে দ্বিধাদীর্ণ মানুষের চিত্রণে। এদিক ওদিক চিঠিপত্রে ওঁরা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন ‘টিমন অফ এথেন্স’ নাটকে প্রায় সর্বস্বান্ত টিমনের সোনা নিয়ে বৈপরীত্যের বিখ্যাত স্বগতোক্তি।১৮৭৭ সালে জেনি মার্ক্স ইংল্যান্ডের লাইসিয়াম থিয়েটারে হেনরি আর্ভিংএর রিচার্ড দি থার্ড অভিনয়ে বাঁধাধরা ভিলেন এর স্টেনসিল থেকে আলাদা বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রণে মুগ্ধ হয়ে রিভিউ লিখেছিলেন। মার্ক্সের জীবনীকার ফ্রাঞ্জ মেহরিং জানিয়েছেন মার্ক্সের গোটা পরিবার ভুগত ‘শেক্সপিয়রফোবিয়া’তে।

এছাড়া গত শতাব্দীর গোড়া থেকে সেসময়ের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও পরিচালক বের্টল্ট ব্রেখট ও ছিলেন শেক্সপিয়রভক্ত। শুধু ‘করিওলেনাস’ নয় অন্য কয়েকটি নাটককেও নতুন করে গড়ে তোলার বারবার পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।

সে যাই হোক, গোদা বাংলায় আমার বক্তব্যের মোদ্দা কথাটা হল শেক্সপীয়র ছিলেন ওঁর যুগের ,মানে এলিজাবেথান যুগের, জনতার কবি।

যদিও মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাহিত্য সমালোচকেরা এ’ব্যাপারে দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে একদল যান্ত্রিক ভাবে মার্ক্সের অর্থনীতিকে ভিৎ এবং শিল্পসাহিত্যকে ওপরের তলা ধরে কেঠো আলোচনা করতেন, এবং উপরিকাঠামোকে আর্থিক সম্পর্কের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা গোছের যান্ত্রিক বিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে ভাবতেন-- যেহেতু শেক্সপিয়রকে প্রগতিশীল হতে হবে , অতএব ওনাকে উঠতি বুর্জোয়ার প্রতিনিধি ধরতে হবে। কারণ ইতিহাসের বিচারে এলিজাবেথান ইংল্যান্ডে সামন্ততন্ত্র প্রতিক্রিয়াশীল এবং উঠতি বণিকপুজি হল প্রগতিশীল। অতঃ শেক্সপিয়র হলেন রেনেসাঁর এবং উঠতি বুর্জোয়ার প্রতিনিধি। ওঁরা উদাহরণ দেবেন মার্চেন্ট অফ ভেনিসের, কমেডি অফ এরর্সের এবং এই জাতীয় কিছুর। এ যেন শার্টের গায়ে বোতাম লাগানোর বদলে হাতে একটা গোটা বোতাম পেয়ে তাতে শার্ট সেলাই করে দেয়া।






জীবননাট্যের কিছু প্রস্থানবিন্দুঃ

উইলিয়ম এসেছিলেন হ্যাভন নদীর তীরের স্ট্র্যাটফোর্ড নামের একটি অনামী গ্রামের সাধারণ পরিবার থেকে ।

পিতা জন শেকসপীয়র ছিলেন একজন সফল কারিগর। কিঞ্চিৎ সম্পত্তি অর্জিত করে চাইছিলেন সমাজের উঁচুতলায় উঠতে; আবেদন করেছিলেন ‘কোট অফ আর্মস’ পেতে। এই সাপসিঁড়ি খেলায় ব্যর্থ হন। কিন্তু ছেলে উইলিয়ম তাঁর সেই বাসনা পূর্ণ করেছিলেন। নিজে গ্লোবের নিয়মিত ভাল অভিনেতাদের একজন। তারপর সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশঃ গ্লোব থিয়েটারের মালিকানার অংশীদারি ছাড়াও নদীর পাড়ে বেশ কিছু জমিজমার মালিক হওয়া। দুনিয়াদারির ঘাঁতঘোঁত ভালই বুঝতেন। তাই রাণী এলিজাবেথের কড়া শাসন ও নাটক নিয়ে সেন্সার এবং জেল তথা মুন্ডচ্ছেদের সময়েও ধরি-মাছ, না-ছুঁই-পানি ভালই চালিয়ে গেছলেন।

ভাষাতেও অসামান্য দখল এবং বৈপরীত্য। কবিতায় সনেট ও ব্ল্যাংক ভার্সে পটুত্বের সঙ্গে নিজস্ব ছাপ। নাটকীয় গদ্য লেখার ও কাব্যময় সলিলোকিতে একমেবাদ্বিতীয়ম। চরিত্রের সৃজন ও তাদের মুখে সঠিক ভাষাশৈলীর প্রয়োগ—সে জেন্টলম্যানের হোক কি শুঁড়িখানার মাতালের বা ভবঘুরের। একদিকে ‘ টু বি অর নট টু বি’ বা ‘ হোয়াট ইজ ম্যান’ এর দার্শনিকতা, অন্যদিকে কমেডি অফ এরর্স ও মিডসামার নাইট’স ড্রিমএর বটম তাঁতি ও তার সাথিদের ভাঁড়ামি; শেক্সপিয়রে এই দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের সহাবস্থান।

প্রশ্ন হল আজ সাড়ে চারশ’ বছর পরে তাঁর লেখা কেন আপন লাগছে?


মননের দিক থেকে তিনি ছিলেন সে’ সময়ের জনতার প্রতিনিধি। আত্মসাৎ করেছিলেন তাদের মুল্যবোধ ও রুচি। এখানেই তিনি তাঁর সমসাময়িক অন্য নাট্যকারদের – যেমন, বেন জনসন, এডওয়ার্ড মার্লো—থেকে স্বতন্ত্র। ওঁরা ছিলেন অভিজাত পরিশীলিত রুচির। তাই জনসন অনায়াসে শেক্সপীয়েরের লাতিন এবং গ্রীক সাহিত্যের সঙ্গে অপরিচয়ের কথা বলে খোঁচা দিতে একটুও ইতস্ততঃ করেন না, যদিও উইলিয়ম তাঁর গ্রামার স্কুলে গ্রীক-লাতিন সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

আসলে তাঁদের চোখে মহাকবি একটু গ্রাম্য রুচির। অনেকবার তাঁর চরিত্রদের ঠাট্টাতামাশা ভদ্রলোকের কানের পক্ষে মাত্রাছাড়া লাগে।

শুধু ফলস্টাফের ভাঁড়ামো নয় , রোমিও জুলিয়েটের একটি দৃশ্য দেখুন।

জুলিয়েটের বয়স নিয়ে ওর মা এবং ধাইমার আলাপ। বৃদ্ধা মহিলাটি নিজের প্রয়াত স্বামীর রগুড়ে স্বভাবের কথা তুলে বলে-- ছোট্ট জুলি যখন পড়ে গিয়ে কপাল ফুলিয়ে কাঁদছিল তখন আমার কত্তাটি ওকে ভোলাতে গিয়ে বলে –এখন ছোট্টটি, তাই উপুড় হয়ে পড়েছ, যখন ডাগর হয়ে উঠবে তখন চিৎ হয়ে পড়বে।

“ Won’t you Jule?

‘Aye’, quoth she.”

প্রশ্ন ওঠে, ডক্টর জনসন কি সেই ১৭৬৫ সালেই বলেননি যে শেক্সপীয়রের রচনা অগভীর, শুধু আনন্দলাভের জন্যেই পাঠ করা যায় , তার বেশি নয় ? এ বিষয়ে ডক্টর জনসন ও যাঁরা কেবল আনন্দলাভের জন্যে শেক্সপীয়র পাঠের কথা বলেন, এবং ব্র্যাডলির মত সমস্ত বিদগ্ধ অধ্যাপককুল, অর্থাৎ যাঁরা শেক্সপীয়রকে তাঁর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিতে চান, তাঁদের নমস্কার করে আমি সবিনয়ে অন্য মত পোষণ করতে চাই ।

শেক্সপীয়র পড়ব শুধু আনন্দ বা মজা পেতে? মানে প্রেম? তলোয়ারবাজি? প্রেতাত্মা? রোমান্স এবং ভাঁড়ের ভাঁড়ামো ? মহাকবি নিজে এ ব্যাপারে কী বলেছেন শোনা যাকঃ

"Though it makes the unskillful laugh, cannot but make the judicious grieve". Hamlet (III, 2).


আরেকটি প্রশ্নঃ কীভাবে বুঝব কোনটি নাট্যকারের নিজের মত , আর কোনটি একান্তভাবে নাটকের চরিত্রটির? নিশ্চয়ই ওথেলো নাটকের শয়তান ইয়াগোর উক্তি শেক্সপীয়রের বলে ধরে নেব না ? তাহলে? কঃ পন্থা?

অধ্যাপক আর্থার সিটওয়েল তাঁর "Character and Society in Shakespeare" [Oxford, 1951] বইয়ে একটি পথ বাতলেছেন। উনি বলছেন যদি মুখ্য চরিত্রের মুখে একটি আইডিয়া বারবার, এমনকি নানান বিপরীত পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত সময়েও, শোনা যায় তাহলে সেটা রচয়িতার নিজের চিন্তা বলে মানতে বাধা কোথায়? তেমনই যেটা উনি বারবার ভিলেনের মুখে বসিয়েছেন সেটা নিশ্চয়ই ওনার অপছন্দের স্বর?

কিন্তু যদি ওই জনরুচির তাগিদে তলোয়ারবাজি, প্রেতাত্মা,এবং স্থুল রসিকতাতেই শেক্সপীয়র আটকে থাকতেন তাহলে তাঁর রচনা কালোত্তীর্ণ হত না, কিছুতেই না । উনি খুব বেশি হলে সেকালের জনপ্রিয় আমুদে নাট্যকার হতেন যার রচনা দু’তিন দশকের পরে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে যায় । কিন্তু উনি একইসঙ্গে যুগের হয়েও ছাড়িয়ে গেছেন নিজের সময় ও সমাজকে। জনরুচিকে উপেক্ষা না করলেও তার গোলামি করেননি। প্রশ্ন করেছেন প্রচলিত মূল্যবোধকে, বারংবার।

আসুন, আমরা তাঁর লেখা থেকে তেমনই কিছু ধারণাকে—ধরুন, বাজার, মুনাফা, সমুদ্রযাত্রা, নারী এবং অল্পসংখ্যক সম্প্রদায় ইত্যাদিকে মহাকবির যুগ, কালখন্ড এবং সমাজের প্রেক্ষিতে নেড়েচেড়ে দেখি।


এলিজাবেথীয় যুগ

আমাদের মানসে রাণী এলিজাবেথের রাজত্বকাল ও ইংল্যান্ডের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ একাকার হয়ে আছে। এবং শেক্সপীয়র হলেন সেই নবজাগরণের কবি ও নাট্যকার, যেমন দান্তে অলিঘিয়েরি হলেন ইতালীয় নবজাগরণের মুখপাত্র। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে এই বহুপ্রচারিত সযত্নে লালিত ধারণাটি ধাক্কা খেতে বাধ্য।

আমরা জানি যে রেনেসাঁ হল মধ্যযুগের অন্ত, নতুন করে গ্রীক-লাতিন ক্লাসিক্স পড়ার ঝোঁক, এবং ফলে চিন্তা ও বিচারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরবাদের জায়গায় মানুষের জয়গান। কিন্তু এই ধারার মুখপাত্র তো আসলে বেন জনসন, মার্লোর মত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এলিট নাট্যকারেরা, আর শেক্সপীয়র তো ওই দুনিয়ার লোক ন’ন। জনসনের উক্তি- উনি লাতিন ও গ্রীক বিশেষ জানতেন না !

আর ভাবনার জগতে এই বিপ্লব তখনকার আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় কতটুকু ছাপ ফেলেছিলো?

ভুললে চলবে না যে এলিজাবেথীয় যুগ একই সঙ্গে ‘কর্ন ল’ বা শস্য আইন জারি হওয়ার যুগ বটে! ওই কানুনের ফলে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষির দল নিজেদের জমি থেকে উৎখাত হয়ে শহুরে মজুর এবং ভবঘুরে হয়ে গেল। কারণ তাদের ছোট ছোট ক্ষেতগুলো জুড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল ভেড়াপালন খামার। কাপড়ের মিলমালিকদের উলের চাহিদা পূরণ করতে হবে যে ! এভাবেই ক্ষয়িষ্ণু জরদ্গব সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর গজিয়ে উঠেছিল ‘মার্কেন্টাইল ক্যাপিটালিজম’ বা নব্য বণিকতন্ত্রের সৌধ।

(হুম্ম, আজকের ভারতবর্ষের কৃষিবিতর্কের ছায়া দেখতে পাচ্ছি কি?)

শেক্সপীয়রের নাটক হল সেই বিশাল পরিবর্তনের ছবি, তার জীবন্ত দলিল---ঠিক যেভাবে তিন শতাব্দী পেরিয়ে লেনিনের চোখে তলস্তয়ের সৃজন সমাজবিপ্লবের ডাক না দিলেও সমাজের বিশ্বস্ত আয়না বলে ধরা দিত, অথবা মার্ক্স বালজাকের উপন্যাসে পুঁজিবাদী নরকের আগুন দেখে শিউরে উঠতেন।

অথচ মার্ক্সবাদের যান্ত্রিক ব্যাখ্যায় শেক্সপীয়রকে জোর করে বিপ্লবী বানাতে গিয়ে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নবাগত পুঁজিবাদ বা বণিকবাদের মুখপাত্র ধরে নেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্য হিসেবে দেখানো হয় ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’। তাতে কি সাগর পেরিয়ে নতুন দেশে গিয়ে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ মন্ত্রের আরাধনা করতে বলা হয়নি?

ধর্মাবতার, উই বেগ টু ডিফার। আবারও বলছি , শেক্সপীয়র নন’ –উদীয়মান পুঁজিবাদের চারণকবিরা হলেন মার্লো, জনসন, গ্রীন, মেসিঙ্গার, ও বোমন্ট এবং ফ্লেচার।




বণিকবাদঃ শেক্সপীয়র বনাম অন্যেরা

আমরা জানি যে বণিকবাদের পহচান বা হলমার্ক হচ্ছে-- সামুদ্রিক বাণিজ্য, নতুন নতুন দেশের এবং বাজারের খোঁজ, এবং দিন- দোগুণী, রাত- চৌগুণী মুনাফা। রাণী এলিজাবেথের ইংল্যান্ড তখন সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে এমন করতে ব্যস্ত ‘যেখানে সূর্য অস্ত যায় না ‘। তাই জাতীয় সংগীত হলঃ

" Britania! Rules Britannia.

Britannia rules the waves."

এবার দেখুন, গ্রীনের ‘অর্ল্যান্ডো’ নাটক ঘটিত হচ্ছে আফ্রিকায়, মার্লো’র ‘ট্যাম্বারলেইন’ এশিয়ায়, ম্যালিগ্নারের ‘রেনেগাদো’ টিউনিসে, বোমন্ট-ফ্লেচারের ‘ আইল্যান্ড প্রিন্সেস’ ঘটছে পর্তুগালের মশলা দ্বীপে। কিন্তু আমাদের শেক্সপীয়র তাঁর বিপুল রচনায় সহজে ইউরোপের বাইরে পা ফেলেন না । এমনকি ঊনি শুধু ইংল্যান্ডেই স্বচ্ছন্দ, ইতালিতেও নয়। নইলে কোন ভূগোলের হিসেবে মিলান থেকে জাহাজ ছাড়ে(টেম্পেস্ট)? বা বোহেমিয়ায় নোঙর ফেলে? এটাও সবাই জানে যে হ্যামলেট নাটকে প্রিন্স অফ ডেনমার্কের গল্প বললেও সেটা আসলে রূপকের আড়ালে তাঁর সমসাময়িক ইংল্যান্ডেরই কথা । যে কারণে পুশকিনের “ক্যাপটেইন’স ডটার” উপন্যাস আসলে সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী পুগাচেভের বন্দনায় লেখা উলটপুরাণ। ধড়ের থেকে মুন্ডু খসে পড়ার ভয় সব যুগেই থাকে; সেসব যুগে আরও বেশি।

ঊনি একবারই ইউরোপের বাইরে পা রেখেছিলেন, ওথেলো নাটকে সাইপ্রাসে। বোঝা যায় উথালপাথাল সমুদ্রের ঢেউয়ে জাহাজে চড়ে বিদেশযাত্রা ওঁর খুব একটা পছন্দ নয় । কলম্বাস বা ম্যাগেল্লানের আবিষ্কার, ১৫০০ সালে ব্রেজিলের খোঁজ –এসবের কোন কিছুই ওঁর লেখায় নেই । চ্যাপম্যান তাঁর ‘ইস্টওয়ার্ড হো’ নাটকে এবং জনসন তাঁর ‘ এভরিম্যান ইন হিজ হিউমার’ নাটকে সগৌরবে উল্লেখ করছেন স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের ‘গোল্ডেন হাইন্ড’ জাহাজে চড়ে বিজয়পতাকা ওড়ানো যা তখন ছিল পুঁজিবাদের অজেয় শক্তির প্রতীক। কিন্তু এর কোনকিছুই শেক্সপীয়রকে প্রেরণা দেয়নি।

আমাদের মতে, এই যে সোনার খোঁজে মুনাফার লালসায় দিকে দিকে নৌ- অভিযান তা’ শেক্সপীয়রের না-পসন্দ ।

পেরিক্লিস নাটকের দৃশ্য দুইয়ে শুনতে পাইঃ সমুদ্রযাত্রায় শান্তি নেই । আকাশ থেকে বজ্র নামে, সাগরের অতলে তলিয়ে যায় বাণিজ্যপোত, এভাবেই আমাদের রাজপুত্র সর্বস্বান্ত হলেন।

উইন্টার্স টেল নাটকে ক্যামিল্লো রাজকুমার ফ্লোরিজেলকে বলে সাগরে না যেতে। টেম্পেস্টে শান্ত গঞ্জালো আফসোস করে বলে মরতে হলে ডাঙায় মরব, জলে ডুবে কেন ?


এবার মার্চেন্ট অফ ভেনিস নাটকে মুনাফার ছবিটি কেমন দেখা যাক। সেইসময়ে সমাজে ব্যবসায়ী ও বণিককুলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছিল সন্দেহ নেই । এই নাটকের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে পারস্পরিক সন্দেহ, গলাকাটা প্রতিযোগিতা, নগ্ন লোভ এবং মানবমূল্যের অবনমনের ছবি। শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তা এবং মুনাফার ঝুঁকি কেড়ে নিচ্ছে রাতের ঘুম। আন্তনিওর বন্ধু সালেরিও এবং সোলিনিওর কথাবার্তা শুনুনঃ

"Your mind is tossing in the ocean" এবং " Believe me Sir, had I such venture forth, the better part of my affection would be with my hopes abroad.

পুঁজিবাদী সমাজে প্রেম? ব্যাসানিও এবং পোর্শিয়ার প্রেম? হাসালেন মশাই। বন্ধু আন্তোনিওকে ব্যাসানিও চুপি চুপি জানায় যে বেহিসাবী খরচায় ও দেউলে হয়ে গেছে। সম্পত্তি গেছে ভোগে, আকন্ঠ ধারে ডুবে সম্মান যায় যায় । উপায়? অগাধ ধনসম্পত্তির মালকিন বেলমন্টের পোর্শিয়াকে বিয়ে করা । [Merchant of Venice, I, 1,122 and 161]

শুধু এইই নয়, নারীকে পণ্যদ্রব্য (কমোডিটি) হিসেবে দেখা পুঁজিবাদী ধ্যানধারণায় স্বাভাবিক। তাই ব্যাসানিও’র চোখে পোর্শিয়া হলেন একটি লোভনীয় বস্তু, উনি অনায়াসে স্বয়ংবরা পোর্শিয়ার পাণিগ্রহণে তিন প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতাকে বর্ণনা করেন বণিকদের মধ্যে লুটের মাল ভাগাভাগি হিসেবে। প্রেমই বটে! এক্কেবারে টুরু লাভ।

এবার দেখুন, পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতির সবচেয়ে গহন ভাষ্যকার মার্ক্সের চোখে শেক্সপীয়রের সময়ে বণিকতন্ত্রের জন্মলগ্নের ছবিটি কেমন ছিল। কেমনভাবে বর্বরের মত শিল্পী কারিগর ও লঘু উৎপাদকদের লুঠ করে পুঁজিবাদের ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল।

"--- under the stimulus of passions, the most infamous, the most sordid, the pettiest, the most meanly odious".

Karl Marx: Capital (New York, 1906), Part VIII, P. 835-836 [Footnote]


টিমন অফ এথেন্সেও প্রায় একই ভাষায় অভিশাপ বর্ষিত হয় লোভ, সম্পত্তি, সোনা ও মুনাফাখোরির উপর। আপেমান্তুস এক বণিককে বলে যে ব্যবসা হল তোমাদের ভগবান। এই ভগবানই তোমাদের জাহান্নমে পাঠাক।টিমন চোরেদের সোনা বিলিয়ে দিয়ে বলেন—যাও, এবার সবার গলা কাটো আর গোল্লায় যাও।

টিমনের চোখে সোনা হল অমিতশক্তিধর। বানিয়া সমাজে সোনা সব জিনিসকে তার বিপরীত বস্তুতে বদলে দিতে পারে । যেমন, সোনা (পড়ুন টাকা) থাকলে সবচেয়ে কুৎসিত পুরুষ হয়ে যায় সবচেয়ে রূপবান। কারণ সে অর্থের জোরে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে কুক্ষিগত করতে পারে । ঠিক যে ভাবে সবচেয়ে রোগাপ্যাংলা লোকও টাকার জোরে বাউন্সার রেখে হয়ে ওঠে শক্তিমান।

Timon of Athens, I, 1, 237; IV, 3,443; III, 6, 97; and IV, 1, 8.

কী করে ভুলব আলবানির সেই ভবিষ্যবাণী যাতে উনি নবযুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলছেন – যখন মানুষ মানুষকে ছিঁড়ে খাবে? King Lear, IV, 2, 46.


শেক্সপীয়রের চোখে নারীঃ

আচ্ছা, আজকাল যে নারী-স্বাধীনতা বা লিঙ্গসাম্য নিয়ে এত কথাবার্তা, কল্পনা করুন তো সাড়ে চারশ’ বছর আগে কী ভাবতেন মহাকবি? ধরুন লাভ-জিহাদ নিয়ে ?

আমার ভাবতে ভাল লাগে যে আমার (এবং আরও অগণিত মানুষের) প্রিয় কবি ও নাট্যকার এ’ব্যাপারে যুগের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন । তাঁর সমসাময়িক সমাজের চোখে প্রশ্নটি অবান্তর । এ নিয়ে প্রচুর সাক্ষ্য বর্তমান। পাদ্রীদের মুখ থেকে নারী -নরকের-দ্বার বা শয়তানের দূতী গোছের ফতোয়া আকছার শোনা যেত। বাইবেলে দেখুন-আপেল খেলেন আদম ঈভ দুজনে, দোষী সাব্যস্ত হলেন একা ঈভ। আদম যেন এক অপাপবিদ্ধ কিশোর যাকে ফুসলে পাপের পঙ্কিল পথে টেনে নামিয়েছে ঈভ।

কিন্তু কবি নিজে কী ভাবতেন?

ওঁর অনেক নাটকে পিতা-পুত্রী মুখোমুখি, এবং মেয়েটি প্রশ্ন তুলছে--‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার’?

নাটকের নাম ‘মিড সামার নাইটস’ ড্রীম’। মেয়ে হার্মিয়ার পছন্দের ছেলে লাইসান্ডারকে নাকচ করেছেন বাবা। তাঁর চোখে কন্যা হল তাঁর সম্পত্তি, জমিজমা, গয়নাগাটি বা টাকাপয়সার মত । এসব তিনি যথাসময়ে সুযোগ্য জামাইবাবাজির হাতে তুলে দেবেন, যেন খপ- পঞ্চায়েত বসেছে। তাঁর ফরমান শুনুনঃ

"And she is mine; and all my right of her

I do estate into Demetrius".

আর মেয়েটি ভাবছে: "O hell! To choose love by another's eyes."

নাটকের শেষে হার্মিয়া বিজয়ী হয় এবং মনের মানুষকে বিয়ে করে ।

ওথেলো নাটকে নায়িকা ডেসদেমোনার বাবা ব্রাবান্তসিও ওথেলোর নামে অপহরণের কেস করেন । কিন্তু আদালতে দাঁড়িয়ে ডেসদেমোনা বলেনঃ

"I am hitherto your daughter; but here's my husband,

And so much duty as my mother show'd

To you, preferring you before her father,

So much I challenge that I may profess

Due to the Moor, my Lord."

(Othello, I, 3, 185)

‘কমেডি অব এরর্স’ নাটকে আদ্রিয়ানা লিঙ্গসাম্যের দাবি তোলে: "Why should their liberty than ours be more?" (II, I)।

জুলিয়েট বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে দোনোমোনো করে বাবার কাছে বকুনি খায়। ‘মারচেন্ট অফ ভেনিস’ নাটকে জেসিকা কাপড়চোপড় গয়নাগাটি নিয়ে মায়কা থেকে পালিয়ে দয়িতের সাথে মিলিত হয় । নাট্যকারের পক্ষপাতিত্ব জেসিকার প্রতি প্রকট, সূদখোর বাবা শাইলকের জন্যে ঝরে পরে অবজ্ঞা ও সামান্য করুণা। ‘হ্যামলেট’ নাটকের অফিলিয়াকে বাবা পোলোনিয়াস আচ্ছা করে কড়কে দেন , কারণ ও বাবার পছন্দকে অগ্রাহ্য করে পাগলাটে রাজকুমার হ্যামলেটের প্রেমে পাগল। টেম্পেস্টের প্রসপেরো মেয়ে মিরান্দার জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকারকে তাচ্ছিল্য করে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেন। কিন্তু শেষপর্বে মেয়ের পছন্দকে স্বীকৃতি দিয়ে পাঠকের চোখে মহান হয়ে ওঠেন।

‘মেরি ওয়াইভস অফ উইন্ডসর’নাটকে বিবাহিত মহিলারা দল পাকিয়ে রাজদরবারের বিদূষক ফলস্টাফকে মেয়েবাজির জন্যে ভাল করে উত্তমমধ্যম দেন। রাজার বয়স্য বলে লুজ -ক্যারেকটারটি রেহাই পায় না

[।আমার মনে হয় দীনবন্ধু মিত্রের ‘কমলে কামিনী’ নাটকে হলধর বলে চরিত্রটি, পদে মন্ত্রী স্বভাবে স্থুল রসিকতায় ডগোমগো মেয়েবাজ এবং পরিণতিতে মেয়েদের হাতে উত্তম মধ্যম পাওয়া, ফলস্টাফের আদলে তৈরি।]

শেকসপীয়র এবং থিয়েটার

থিয়েটার সমস্ত যুগেই ক্ষমতার সমালোচনা করেছে এবং প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। শাসকেরাও তাই যুগে যুগে থিয়েটারকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। বর্তমান সময়ও তার ব্যতিক্রম নয় ।

ইংল্যান্ডে ক্রমওয়েল বিপ্লবের পর পিউরিটানরা ক্ষমতায় এসে এক অর্ডিন্যান্স জারি করে সবরকম থিয়েটারকে নিষিদ্ধ করলেন। ফিলিপ স্টাবসের চোখে থিয়েটারই হল বেশ্যাবৃত্তি ও বিকৃতির মূল। টমাস হোয়াইট লন্ডনে প্লেগের জন্যে দায়ী করলেন থিয়েটারকে। গসন এবং নর্থব্রুক থিয়েটারকে আখ্যা দিলেন শয়তানের আখড়া যেখান থেকে মেয়েরা শেখে বেশ্যাবৃত্তি,( ১৫৭৮ থেকে ১৫৮৩ নাগাদ প্রকাশিত বিবিধ প্রবন্ধ ও বক্তৃতামালা)।

রাণী এলিজাবেথ- প্রথম স্বয়ং থিয়েটারের অনুরাগী ছিলেন । সাধারণ মানুষ থিয়েটারের নামে পাগল। তাতে কি ? ক্ষমতাশালী লর্ড মেয়র হরদম বখেড়া খাড়া করতেন। টমাস ন্যাশের ‘আইল অফ ডগস’ নাটক নিষিদ্ধ হল। ওতে নাকি রাজদ্রোহমূলক ডায়লগের বাড়াবাড়ি! অভিনেতাদের জেলে পোরা হল।

বেন জনসনের মত নাট্যকারকেও হাজতবাস করতে হয় । ‘ইস্টওয়ার্ড হো!’ নাটক নিষিদ্ধ হয় এবং নাট্যকার চ্যাপমান কারারুদ্ধ হন। শেক্সপীয়রকেও বাধ্য করা হয়েছিল ‘রিচার্ড দ্বিতীয়’ নাটকে রাজার সিংহাসনচ্যুত হওয়ার দৃশ্যটি বাদ দিতে ।গোড়ায় ফলস্টাফ চরিত্রটির নাম ছিল ‘ওল্ডক্যাসল’, কিন্তু সেন্সরের চাপে শেকসপীয়র বাধ্য হলেন বদলে দিতে, --একেবারে ‘পদ্মাবতী’ থেকে ‘পদ্মাবৎ’ কেস।এরকম উদাহরণ আরও আছে।


শেকসপীয়রের প্রাসংগিকতা

আজকে সাড়ে চারশ’ বছর আগের শেকসপীয়র কতটা প্রাসংগিক? বা আদৌ প্রাসংগিক কি?উনি কি ইতিমধ্যেই সযত্নে জাদুঘরে রক্ষিত একটি পুরাতাত্ত্বিক বস্তু হয়ে যান নি? মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো মোটা মোটা রচনাবলীর মধ্যে মুখ লুকোননি?

আমার কাছে শেকসপীয়রের চরিত্রগুলো আজ আমার মত সাধারণ ছাপোষা মানুষের অনেক বেশি কাছের, ইদানীং যেন ওদের আরও ভাল করে চিনতে পারছি ।তাই ওরা আজকের ভারতে বৃটেনের চেয়েও বেশি প্রাসংগিক বলে আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত।

যখনই আমি বিশ্ববাণিজ্য ও গ্লোবালাইজেশনের বন্দনা শুনি বা নব-উদারনীতিবাদের ভাট ও চারণদের গাথায় এই আশ্বাসবাণী ধ্বনিত হয় যে কীভাবে মুক্ত ব্যাপার এবং ব্যক্তিগত বিদেশি পুঁজি (এফ ডি আই) এলে আমাদের সব জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়োবে, তখনই আমার মগ্নচৈতন্যে মুনাফা ও বল্গাহীন লোভের ভয়াবহ পরিণামের বিষয়ে মার্চেন্ট অফ ভেনিসের সাবধানবাণী গুরু গুরু রবে বেজে ওঠে।

যখন দৈনিক পত্রিকায় ‘অনার কিলিং’, খপ-পঞ্চায়েতের ফয়সালা, ‘লাভ-জিহাদের’ নির্মমতা বা সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যুগলের আত্মহত্যার খবর পড়ি তখন আমার সামনে অভিনীত হয় ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘মিডসামার নাইটস’ ড্রিম’ এবং ‘অবশ্যই ‘ওথেলো’।

এভাবেই অল্পসংখ্যক সমুদায়ের মানুষজনের উপর ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে অপমান ও হিংস্র আক্রমণের খবরে দেখি ‘ওথেলো ‘ ও ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিসে’র পুনরাভিনয়।আমার কানে বাজে শাইলকের মার্মিক আবেদন ও অভিযোগ--" Hath not the Jews eyes and ears?"

মার্চেন্ট অফ ভেনিসের আপাত খলনায়ক শাইলকের ওই দীর্ঘ মনোলগের মতন অল্পসংখ্যকের পক্ষে এমন শক্তিশালী বয়ান সাহিত্যে অন্ততঃ আমার চোখে পড়েনি।

আর রাজনীতিবিদদের নিয়ে ঘোড়া কেনাবেচা, শিবিরবদল, গুপ্তহত্যা, ক্ষমতা দখল, প্রজা খেপিয়ে বিদ্রোহ? একেবারেই হাতড়াতে হবেনা,-- লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, জুলিয়াস সীজার, করিওলেনাস ও টিমন অফ এথেন্স। রাজাদের নিয়ে একগুচ্ছ ডার্ক নাটক, যেমন রিচার্ড দ্য থার্ড এবং কিছু ডার্ক কমেডি।

এতসব লেখার পর একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি—তাহলে কি সাড়ে চারশ’ বছর পরেও মানুষ একটুও এগোয়নি?


[পাদটীকাঃ আমি জানি যে এই বামমার্গী শেকসপীয়ার -পাঠ অধ্যাপককুলে সমাদৃত নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটিও তো অনেক সম্ভবপর ব্যাখ্যার একটি হতে পারে। সেই প্রত্যয়ে লেখাটি পেশ করলাম।]

0 comments:

1

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in









আমাদের সময়ের কবি লিখেছেন –

বৃষ্টি এলেই আসবে কফি, কান টানলে মাথা
এক বিকেলে অফিস কেটে ঝুপ্পুস কলকাতা
আলতো ভাপে নাম লিখেছি কফি শপের কাচ
মেঘ যদি না ডাকে, তোমার আসতে বারণ আছে।


সত্যিই, মেঘলা দিনের প্রত্যাশী মন হোক, বা ল্যাপটপে চোখ আটকানো কাজের ব্যস্ত সময়, রাত জাগা পড়ার টেবিলেই হোক, কি চোখজুড়োনো পাহাড়ী দৃশ্য সামনে নিয়ে হোটেলের বারান্দা, বা বন্ধুসমাগমে নেহাতই অবসরের আড্ডা, এক ধুমায়িত কাপ কফি এখন আমাদের প্রায় অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী হয়ে উঠেছে। মান্না দে যদিও সেই ১৯৮৩ সালে গেয়েছিলেন, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, সে কেবল এক প্রজন্মের আক্ষেপ। পরের প্রজন্মরা আজও কফি হাউস মাতিয়ে রেখেছে। তার সাথে সাথে আনাচে কানাচে বিস্তার ঘটেছে, যাকে আজকাল বলা হয়, তৃতীয় লহরের কফি শপ বা ক্যাফে সংস্কৃতি। আসুন. এক কাপ কফি নিয়ে বসে একটু আড্ডা মারা যাক সেই কফি নিয়েই। ভারতের কফি।


উৎপাদন, রপ্তানি এবং আভ্যন্তরীন চাহিদা – এই সব দিক দিয়েই এখন আমাদের দেশে কফির রমরমা। ভারতে কফির উৎপাদন এবং ব্যবসার উন্নয়নবর্ধক স্বায়ত্বশ্বাশক সংস্থা কফি বোর্ডের প্রধান নির্বাহক বলছেন, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে দেশে কফির উৎপাদন ৩.৬ লক্ষ মেট্রিক টন হবার সম্ভাবনা, এবং পরের বছর তা আরও বাড়বে। ঐ বছরেই ভারত ১৫,৪০০ কোটি টাকার কফি রপ্তানি করেছে, তার মধ্যে প্রায় ৯,৫০০ কোটি টাকার কফি কেবল মাত্র কর্নাটক থেকে। কফি আবাদীরাও খুশী। এ বছর রোবাস্টা কফির ৫০ কেজির বস্তার জন্য তাঁরা ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পেয়েছেন। মাত্র দু বছর আগেও তাঁরা পেতেন মেরেকেটে ৫,০০০ টাকা। তবে এই স্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা কম। পৃথিবীতে উৎপাদন ও চাহিদায় ব্রাজিল অগ্রগণ্য দেশ। তারপর ভিয়েতনাম, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া। গত বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ব্রাজিলের উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের উৎপাদন বর্ধিত বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণ করতে যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতির সুবিধা পেয়েছেন ভারতের উৎপাদকরা। ব্রাজিল স্বমহিমা ফিরে পেলে চাকা ঘুরতে পারে। ভারতে উৎপন্ন কফির ৭০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে।


ভারতে পানীয় হিসেবে কফির ব্যবহারের সব থেকে প্রাচীন বিবরণ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে। জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইংরেজ রাজার রাষ্ট্রদূত স্যার টমাস রো সাহেবের চ্যাপলেইন রেভারেন্ড এডোয়ার্ড টেরী আনুমানিক ১৬১৬ সালে একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন:

“সেখানে অনেক মানুষই অত্যন্ত কঠোরভাবে তাঁদের ধর্মাচরণ পালন করেন এবং কোন রকম পানাসক্তি থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু একটি পানীয়, যাকে তাঁরা কফি বলেন, তাঁরা পান করেন, যা উপাদেয় তো বটেই, তারও বেশী স্বাস্থ্যকর। এক ধরণের কালো রঙের বীজ জলে সেদ্ধ করে এটি বানানো হয়, যার থেকে জলও সেই রঙ ধারণ করে, কিন্তু জলের স্বাদ সামান্যই পরিবর্তিত হয়। অথচ পাচনশক্তি বাড়ায়, শরীরে উদ্দীপনা আনে এবং রক্ত পরিশোধনেও সাহায়্য করে।“


কফি পানের প্রচলন হলেও এ দেশে কফি চাষের সূচনা তখনও হয়নি। তা শুরু হয় আরো কিছু বছর পরে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে। এই সম্পর্কে একটি মজার কাহিনী আছে।


কফি বিষয়ে গবেষকরা বলেন, সম্ভবত আফ্রিকাতে ইথিওপিয়ায় কফির প্রথম উৎপাদন শুরু হয়। সেখানে কলদি নামের এক ছাগপালক লক্ষ্য করেন, তাঁর ছাগলগুলি একটি বিশেষ উদ্ভিদের ফল খেয়ে অত্যন্ত তেজী আচরণ করছে। তখন তিনি এই গাছগুলি আবাদ করে তার ফল থেকে পানীয় প্রস্তুতি শুরু করেন। সেই ছিল কফির প্রথম মনুষ্যকৃত উৎপাদন ও ব্যবহার। ষোড়শ শতাব্দীতে কফি আরব দেশে ও পরে ইওরোপে প্রসার লাভ করে। সপ্তদশ শতকে আরব বা য়েমেন হয়ে উঠেছিল কফি রপ্তানির প্রধান কেন্দ্র। সে সময় আবার ভারত ছিল মধ্যপ্রচ্যে মশলাপাতি রপ্তানির শীর্ষে। ধরে নেওয়া যায়, তখন য়েমেন থেকে সমুদ্রপথে আরবসাগর হয়ে বা স্থলপথে পারস্যদেশ হয়ে কফির বীজ ভারতে আমদানী হতো। কিন্তু তা চাষের উপযুক্ত ছিল না। তার কারণ য়েমেন থেকে কফির বীজ শুধুমাত্র তাপে সেঁকা (roasted) বা সেদ্ধ অবস্থায় ছাড়া আর কোন ভাবে দেশের বাইরে পাঠানো নিষিদ্ধ ছিল। এর অন্যথা করে ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি, এমন কি মৃত্যুদন্ডও, দেওয়া হত। এইভাবে য়েমেন কফির উৎপাদন ও ব্যবসা নিজেদের কুক্ষিগত ও একচেটিয়া করে রেখেছিল।


সেই সময় দক্ষিণ ভারতে এক সুফি সন্ত ছিলেন হজরত শাহ জামের আল্লাহ মাজরাবি। তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি বাবা বুদান নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সম্ভবত ১৬৭০ থেকে ১৬৯০ সালের মধ্যে কোন সময় তিনি হজ তীর্থভ্রমণে মক্কা গিয়েছিলেন। ফেরবার পথে তিনি আসেন য়েমেনের বন্দর শহর মোচাতে। সেখানে কফির বাড়বাড়ন্ত দেখে, এবং তার বীজ থেকে বানানো ‘কাহবা’ (পানীয়, যার অপভ্রংশ থেকে সম্ভবত কফি নামের উৎপত্তি) পান করে তিনি বিশেষ প্রভাবিত হন। কফির চাষ পদ্ধতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত কিভাবে পানীয় প্রস্তুত করা হয়, ইত্যাদি বিশদ বৃত্তান্ত অধ্যয়ন করে তিনি স্থির করলেন, ভারতে এই বস্তুটির কৃষিকাজ প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য চাই কাঁচা ফল বা বীজ যার চালান নিষিদ্ধ। অতএব আল্লাহকে স্মরণ করে তিনি করে বসলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। ইসলাম ধর্মে সাত সংখ্যাটির মাহাত্ম্য আছে, এই সংখ্যাকে মঙ্গলকারী বা পয়মন্ত মনে করা হয়। তিনি সাতটি কফির বীজ তাঁর দাড়ির মধ্যে কোন প্রকারে লুকিয়ে রাখলেন। মতান্তরে তিনি তাঁর লাঠির ফাঁপা অংশে ঐ সাতটি বীজ লুকিয়েছিলেন। সংখ্যার মাহাত্ম্য বা তাঁর দাড়ির ঘনত্ব, যার জোরেই হোক, তিনি য়েমেনের সিকিউরিটি চেক নিরাপদে অতিক্রম করে দেশে ফিরে আসেন। অবশেষে নীলগিরি পর্বতমালার চন্দ্রগিরি পর্বতে তিনি ওই সাতটি অঙ্কুরিত কাঁচা বীজ রোপন করলেন। সময়ে গাছ বেরোল, ফুল ধরল, এবং অনেক ফলও উৎপন্ন হোল। তার বীজের অংশ পুনরায় রোপন করে আরও গাছ হল। এইভাবে ভারতে শুরু হল কফি চাষের প্রারম্ভ এবং বিস্তার। বাবা বুদানকে তাই দেশে কফি চাষের জনক বলা হয়।


এই গল্প সত্য বা নিছক লোক কাহিনী হতে পারে। কিন্তু বাবা বুদান এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। অধুনা কর্নাটকের চিকমাগালুরু জেলায় যে পর্বতে তিনি কফির চাষ করেছিলেন বলে কথিত আছে, তা এখন বাবা বুদান গিরি নামে পরিচিত। এই পাহাড়ে তাঁর মাজারও আছে, সেখানেই তাঁকে এবং তাঁর অনুগামী আরও দুজন সুফি সন্তকে হত্যা করা হয়। এই স্থানকে দত্তত্রেয় বাবা বুদান পীঠ বলা হয়। দত্তত্রেয় ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের যুগ্ম অবতার বলে মান্য একজন ঋষির নাম, তার সঙ্গে বাবা বুদানের কী যোগ ? যে গুহা দত্তত্রেয়র ধ্যানস্থল ছিল, সেখানেই বাবা বুদানও প্রার্থনা করতেন বলে কথিত আছে। দত্তত্রেয় অবধুত প্রথার অংশ। সব রকম আচার, বিধি, সংস্কার থেকে বিরত হয়ে এক নিরাকার ঈশ্বরের সাধনা, নিরাড়ম্বর, অহিংস জীবনযাপন এই প্রথার মূল দর্শন। সুফি তত্ত্বের সঙ্গে তার সাযুজ্য দেখা যায়। তাই দত্তত্রেয় বাবা বুদান গিরি দুই সম্প্রদায়েরই পীঠস্থান।


যাই হোক। ফিরে আসি কফির কথায়। ভারতে কফির চাষ অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রধানত ওলন্দাজদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাঁরা মূলত নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কফির আবাদ করতেন। ইংরেজদের আগমন ও ক্রমান্বয়ে প্রাধান্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কফি চাষেও তাঁদের অংশীদারী বাড়লো। বেশী জমি-জায়গায় কফির চাষ হতে লাগলো এবং উৎপাদনও বাড়লো। কারণ ইংরেজরা ব্রিটেন এবং ইওরোপের অন্য অনেক দেশে ভারতে উৎপন্ন কফি বীজ রপ্তানিও শুরু করে।


স্বাধীনতার পর কফি ক্ষেত্রের মালিকানা পূর্ণভাবে ভারতীয়দের হাতে আসে। দেশে কফির উৎপাদন ও বিপণনে নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তার জন্য স্বাধীনতার আগেই ১৯৪২ সালে ভারত সরকার ভারতীয় কফি বোর্ড স্থাপন করেছিল। এটি একটি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হলেও বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের অধীনস্থ। উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপারে কফি উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের নানা রকম বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে চলতে হত। যার ফলে উৎপাদন পরিসংখ্যানে অনেক বছর পর্যন্ত তেমন চমকপ্রদ কোন উন্নতি দেখা যায়নি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক উদারীকরণ প্রক্রিয়ার পর, বিশেষ করে রপ্তানি এবং মূল্য ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদকরা অনেক স্বাধীনতা লাভ করেন। ফলত, উৎপাদন, ব্যবসা এবং লভ্যাংশও ক্রমবর্ধমানভাবে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।


কফি চাষের জন্য কতকগুলি বিশেষ পরিমন্ডলের প্রয়োজন। কফির প্রকারভেদে আবশ্যিকতা ভিন্নতর হলেও, সাধারণভাবে কয়েকটি প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য। মোটামুটিভাবে বলা যায়, মাঝারি ঢালু জমি, যেখানে জল বাহিত হয়ে নেমে যেতে পারে, জৈব সার সমৃদ্ধ উর্বর জমি, ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা, ১৬০-১৭০ সেমি গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত, ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আর্দ্রতা, এবং সমুদ্রস্তর থেকে ৭০০-১৫০০ মিটার উচ্চতা কফি চাষের জন্যে উপযুক্ত।


এই সব আবশ্যিকতার পরিপূরক জায়গা হল পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা। তাই ভারতের কফি চাষের সিংহভাগ এই অঞ্চলেই হয়। দেশে যত কফি উৎপাদন হয়, তার ৭১ শতাংশ আসে কর্নাটকের নীলগিরি পর্বতশ্রেণীর উপত্যকায় অবস্থিত কোড়াগু বা কূর্গ, চিকমাগালুরু ও হাসান জেলা থেকে। এদের মধ্যে আবার একা কোড়াগু জেলাই ৩৩ শতাংশের অংশীদার। কেরালা (২১%) ও তামিল নাড়ু (৫%) অন্য দুই প্রধান উৎপাদক রাজ্য। এ ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেও কফির আবাদি হয়। এখন অন্ধ্র প্রদেশ এবং ওড়িশাতেও পূর্ব ঘাট পর্বতাঞ্চলের উপত্যকাভুমিতে কফি উৎপাদন হচ্ছে।

বাবা বুদান গিরি

বড় বৃক্ষের ছত্রছায়ায় কফি গাছের চাষ

আমাদের দেশে কফি প্ল্যান্টেশনগুলির শ্যামলিমা এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এখানে কফি গাছ রোপন করা হয় অন্য বড় বৃক্ষের আচ্ছাদনের (canopy) নীচে। কফি বাগানগুলিতে দেখা যাবে অনেক ফল এবং নানা রকম শিম গোত্রের ছায়া প্রদানকারী গাছ, তার সঙ্গে এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা, লবঙ্গ, জায়ফল, গোলমরিচ ইত্যাদি মশলার গাছ কফির গুল্মদের ছত্রছায়া বিস্তার করে যেন সুরক্ষা প্রহরীর মত অবস্থান করছে। এই সব গাছ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতাই শুধু নিয়ন্ত্রণ করে না, এদের শুখনো ফুল-পাতা, এবং এই সব বৃক্ষ যে পাখীদের আকর্ষণ করে আনে, তাদের বর্য্যপদার্থ, মাটিকে জোগায় প্রয়োজনীয় জৈব সার, রোধ করে মাটির অবক্ষয়। সরাসরি সূর্যালোক না পাওয়ায় ফলগুলি বেশী বাড়ে না, কিন্তু ফলন পর্যাপ্ত হয়। ভারতই প্রধান দেশ যেখানে এই অনন্য পদ্ধতিতে কফি চাষ হয়। এই কফির গুণগত মানও উচ্চ, এর অম্লতা কম, সুবাস ও স্বাদ আকর্ষণীয়।


ভারতে প্রধানত দু’ ধরণের কফির চাষ হয়ে থাকে, প্রথমটি আরবিকা, এবং অন্যটি হল রোবাস্টা। এ ছাড়াও সময়ের সাথে কিছু ভিন্ন প্রজাতির বা সঙ্কর গোত্রীয় কফির উৎপাদন সীমিতভাবে হলেও আরবিকা ও রোবাস্টা বা তাদের জ্ঞাতিবর্গের কফিরই মুখ্যভাবে আমাদের দেশে চাষ হয়।


আরবিকাই আদি কফি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইওরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় যে কফি ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং বাবা বুদান যা ভারতে প্রথম উৎপন্ন করেছিলেন, তা এই আরবিকা। এর গাছগুলি ১৫ ফিট পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে, কিন্তু বাণিজ্যিক সুবিধার্থে ৬ ফিটের মত উচ্চতায় ছেঁটে দেওয়া হয়। আরবিকার বীজে অম্লতা ও ক্যাফেইনের পরিমান কম। স্বাদে মসৃণ, কড়া ভাব কম, কতকটা মিঠাপন আছে। গন্ধে হালকা চকোলেট বা এক ধরণের ফলজাতীয় সুবাস পাওয়া যায়। অন্য দিকে রোবাস্টা (যার আসল বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানেফোরা) গাছ উচ্চতায় আরবিকার দ্বিগুণ হতে পারে। এর বীজে ক্যাফেন ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের পরিমান বেশী। স্বাদে তীব্রতা ও ঈষৎ তিক্ততা বিদ্যমান। গন্ধে যেন রবারের আভাস পাওয়া।


রসিকদের কাছে আরবিকাই কৌলীন্য অর্জন করলেও রোবাস্টাও পিছিয়ে নেই। বিশ্বের ৬০ শতাংশ উৎপাদন আরবিকার হয়ে থাকে। ভারতেও ফলনের হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে আরবিকাই প্রাধান্য পেয়ে এলেও গত দেড়-দু দশকে রোবাস্টা তাকে অতিক্রম করে এখন সিংহভাগ, প্রায় ৭০ শতাংশ, লাভ করেছে। তার কারণ আছে। আরবিকার গাছ স্বভাব-চরিত্রে একটু কমনীয়, বলা যায় পলকা ধরনের। এর ফলগুলির সংক্রমণ এবং কীটের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। গত শতাব্দীতে এক ধরণের সংক্রমণ ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশে একাধিকবার আরবিকার ফলন নষ্ট করে দেয়। অন্য দিকে, অ্যাসিডিটি বা অম্লতা এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট অধিক পরিমানে থাকার জন্য রোবাস্টা রোগ প্রতিরোধে অনেক শক্তিশালী। একই ক্ষেত্রফলের এলাকায় রোবাস্টা আরবিকার তুলনায় বেশী ফল যোগায়। এবং আরবিকার জন্য ঢালু জমি অপরিহার্য হলেও রোবাস্টা কিন্তু কম ঢালু , বা অনেক জায়গায় সমতল জমিতেও বেশ বেড়ে ওঠে।


কফি একটি বার্ষিক ফসল, এর ফলন বছরে একবারই হয়। গাছগুলিতে প্রথমবার ফুল আসতে তিন-চার বছর লাগে, কিন্তু তার পর ষাট বছর পর্যন্তও ফসল উৎপন্ন করে যেতে পারে। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস কফি গাছে প্রস্ফুটনের সময়। এই সময়ে গাছগুলিতে থোকা থোকা সাদা ফুল আসে, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। অনেকটা জুঁই ফুলের মত দেখতে এই ফুলগুলির হালকা সুবাসও অনেকটা জুঁইয়ের মত। প্ল্যান্টেশনগুলিতে এ সময়ে যাঁরা প্রথমবার কফি ফুলের শোভা দেখবেন এবং গন্ধ আঘ্রাণ করবেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এগুলি বুনো জুঁইয়ের উদ্দাম প্রগলভতা বলে ভ্রম হতে পারে। সময়মত এবং পর্যাপ্ত ফুল আসার জন্য জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জলবায়ুর ক্রমবিবর্তনের ধাক্কায় প্রধান কফি অঞ্চল দাক্ষিণাত্যে এই বর্ষণ আজকাল সব সময় নির্ভরযোগ্য নয়। তাই ইদানীং প্ল্যান্টেশনগুলিতে দেখা যাবে স্প্রিঙ্কলারের সাহায্যে জল ছিটিয়ে কৃত্রিম বর্ষণ উপায়ে সেচন করা হয়।

কফির ফল
  কফি বীজ

কফি ফুলের শোভা




কফি ফুলগুলির আয়ু মাত্র তিন-চার দিন। তারপর তাদের পাপড়ি একে একে ঝরে পড়ে। তবে তার আগেই ফুলের বাহারে-গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে মৌমাছি আর পিঁপড়ে ইত্যাদি পোকামাকড়। পরাগায়ন অর্থাৎ pollination প্রক্রিয়ায় এদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য আরবিকার ক্ষেত্রে স্ব-পরাগায়ন সম্ভব, কারণ এদের ফুলে দু’ ধরণের ক্রোমোজোমই বর্তমান। রোবাস্টার জন্য পারস্পরিক পরাগমিলন বা cross pollination জরুরী। দেখা গেছে মৌমাছিদের বদান্যতায় দু’ ধরণের কফিতেই কিন্তু ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই অনেক কফি উৎপাদকরা আবার মৌ-পালনও করে থাকেন। কফি ফুলের পাপড়ি থেকেও এক প্রকার চা তৈরী হয়। ফুলের পাপড়িগুলি ঝরে গেলে দেখা যায় ছোট্ট সবুজ রঙের গুটির মত ফলের আবির্ভাব। এই ক্ষুদ্র সবুজ ফলগুলি ধীরে ধীরে পরিনত হয়ে লাল, হলদেটে-লাল বা চেরি ফলের মত বেগুনি রঙ ধারণ করে, আকারেও বেড়ে ওঠে। এই অবস্থায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল সমারোহে গাছগুলির শোভাও এক দেখবার মত দৃশ্য। কফি ফলের পরিপক্কতার প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আরবিকার ক্ষেত্রে লাগে প্রায় সাত মাস, আর রোবাস্টার জন্য প্রায় ন’ মাস। কফির ফলকে cherry, berry এবং বীজগুলিকে beans বলা হয়ে থাকলেও এরা কিন্তু এদের গোত্রীয় নয়। চেরি বা বেরী ফলে মাত্র একটি করে বীজ থাকে, শতকরা ৯০ ভাগ কফির ফলেই থাকে দুটি করে বীজ। আর বীজগুলি মোটেই bean বা শুঁটি জাতের ফসল নয়।


ফল পাকবার পর সেগুলি বেছে বেছে আহরণ করে সংগ্রহ করাও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এবং আমাদের দেশে অধিকাংশত তা মানবিক শ্রমভিত্তিক। এই সব প্রক্রিয়া প্রতি বছর অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করে। যাই হোক, এর পর আসে ফল থেকে বীজ নিষ্কাশনের পর্যায়। প্রধাণত দুই পদ্ধতিতে তা হয়ে থাকে। প্রথমটি প্রাচীন এবং আদি উপায়। একে বলা যায় শুষ্ক পদ্ধতি বা dry process। ফল সংগ্রহের পর পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে তা ছড়িয়ে বিছিয়ে দেওয়া হয় রোদে শুখানোর জন্য। কোড়াগু বা চিকমাগালুরের কফি এস্টেটগুলিতে গেলে ঘরে ঘরে দেখতে পাওয়া যাবে সমতল খালি জায়গা বা উঠোন যেখানে কফি ফল শুখানো হয়। পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেলে প্রায় চার সপ্তাহ লাগে সঠিক শুষ্কতা আনতে, অর্থাৎ ফলগুলিতে জলের আর্দ্রতা ৬৫-৭০ শতাংশ থেকে ১২-১৩তে কমিয়ে আনতে। খুব বেশী শুখিয়ে ফেললে আবার বীজ ভঙ্গুর হয়ে যায়। এর পর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফলের খোসা, শাঁস ইত্যাদি বাদ দিয়ে বীজ বার করে আনা হয়। যে সব অঞ্চলে সূর্যালোক এবং উত্তাপ সহজপ্রাপ্য নয়, সেখানে এই পদ্ধতি চলে না। সে সব জায়গায় বীজ নিষ্কাশনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় আর্দ্র পদ্ধতি বা wet process। এই পদ্ধতি অনেকটাই যান্ত্রিক এবং বেশী ব্যয়সাপেক্ষ, তবে নাকি এতে করে বীজের গুণগত মানও বজায় থাকে বেশী। অধিকাংশ আরবিকা বীজ এই পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হয়। এখানে পাকা ফল না শুখিয়ে শাঁসালো অংশ আগেই যান্ত্রিক উপায়ে অপসৃত করা হয়। তার পরও একটা পাতলা আবরণ বীজের গায়ে লেগে থাকে। সেটিকে প্রাকৃতিক এনজাইমের সাহায্যে একটি আধার বা ট্যাঙ্কের মধ্যে দু-তিন দিন রেখে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় সরিয়ে ফেলা হয়। এর পর বীজগুলি ভালো করে ধুয়ে নিয়ে রোদে বা গরম হাওয়া চালিয়ে শুখানো হয়। বীজের বাইরের শুখিয়ে যাওয়া অংশ, যাকে বলা হয় পার্চমেন্ট, তা যান্ত্রিক উপায়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। কাঁচা বীজকে অভিপ্রেত শুষ্কতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বলা হয় সেঁকানো বা roasting।


এই দুই পদ্ধতি ছাড়া আর এক, একটু অদ্ভুত, উপায়েও কফি ফল থেকে বীজ বার করার চলন আছে, তবে খুবই সীমিত পরিসরে। আমাদের দেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে বিড়াল প্রজাতির এক জন্তুর নাম Asian palm civet, যাদের বাংলায় বলা হয় গন্ধগোকুল বা খাট্টাস। অরণ্যবাসী এই নিশাচর প্রাণীটি অন্য ছোট জীব শিকার করে খেলেও পাকা ফলই এদের প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। এরা বেছে বেছে কফির পাকা ফল খেয়ে তার শাঁসালো অংশ নিপূণভাবে হজম করে ফেলে। তারপর অপাচ্য বীজগুলি তাদের বিষ্ঠার সঙ্গে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে বেরিয়ে আসে। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে নিষ্কাশিত এই বীজ সংগ্রহ করে যথাযথ ভাবে পরিশোধন করে নেওয়া হয়। শুনতে বিদঘুটে লাগলেও কফির দুনিয়ায় সিভেট কফি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পণ্য, এর মুল্যও বেশ ভারী।


ব্রিটিশদের সময় থেকেই কফি বীজ ভারত থেকে ইওরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো, সে যুগে সমুদ্রপথে কাঠের আধারে করে। কেপ অব গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ইওরোপ পৌঁছতে লেগে যেত প্রায় ছ’ মাস। এই দীর্ঘ সময়ে সাগরের লবনাক্ত আর্দ্র পরিমন্ডল, বিশেষ করে বর্ষণসিক্ত জলহাওয়া, কফির বীজগুলিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতো। আর্দ্রতা শোষণের ফলে বীজগুলি হয়ে উঠতো আকৃতিতে স্ফীত, রঙে ফেকাসে। অম্লতা অনেকাংশে হ্রাস পেতো। এর থেকে যে পানীয় তৈরী হতো, তার স্বাদে কড়া ভাব ও তিক্ততা কম হতো এবং মসৃনতা বৃদ্ধি পেতো, আর তা ছিল সাহেবদের বেশ পছন্দ। উত্তরোত্তর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতি ঘটার ফলে যাত্রার সময় কম হয়ে আসার কারণে বীজের মধ্যে সেই পরিবর্তন আর রইলো না। ভারতীয় কফির জনপ্রিয়তা পশ্চিমে কমতে শুরু হলো। আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা তখন এক অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। চালান করার আগে পশ্চিম উপকুলের সামুদ্রিক পরিবেশে প্রাকৃতিক হাওয়া চলাচল করতে পারে এমন সব গুদামে বাছাই করা বীজ এখন বর্ষাকালে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ রেখে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে লব্ধ কফিকে বলা হয় Monsoon Malabar Coffee এবং এই কফি এখন ভারতের ভৌগলিক ইঙ্গিত (geographical indication) পণ্য আইনে সংরক্ষিত।


রোস্টিংয়ের পর বাজারজাত হবার আগে কফি প্রায়শই আরও একট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যায় যাকে বলা হয় সংমিশ্রণ বা blending। প্রজাতি, উৎপত্তিস্থল এবং কৃষিপদ্ধতির ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক শ্রেণীর কফির গুণগত বৈশিষ্ট্য আছে, স্বাদ-গন্ধের অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ধরণের কফিকে নির্দিষ্ট শতাংশে ভালোভাবে মিশ্রিত করাই blending । এতে মিশ্রিত কফির মধ্যে প্রত্যেক বীজের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুষম মিলন ঘটিয়ে, বলা যায়, নতুন রকমের গুণগত এক এক কফি নির্মিত হয়। এই মিশ্রণ আরবিকা ও রোবাস্টার হতে পারে, আবার ব্রাজিলের আরবিকার সঙ্গে কলম্বিয়ার আরবিকার হতে পারে, বা ভারতের ও ইন্দোনেশিয়ার রোবাস্টার সঙ্গে পশ্চিমের আরবিকার হতে পারে, এবং বিভিন্ন শতাংশেও হতে পারে। এমন কতই মিশ্রণ ঘটিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কফি বাজারে আসে।


চিকোরি ফুল ও শিকড়



কফি বীজের সংমিশ্রন (blending) হচ্ছে

কফি যখন গুঁড়ো পাউডার হয়ে বাজারে আসে, তখন প্যাকেটের ওপর আরেকটি উপাদানের উল্লেখ আপনারা দেখতে পাবেন। এর নাম চিকোরি। এই চিকোরি বস্তুটি কী ? এটি একটি উদ্ভিদের নাম। এর ফুলগুলি নীল রঙের, পাতায় ও শিকড়ে ওষধিগুণ আছে বলে সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই ব্যবহৃত হবার উল্লেখ পাওয়া যায়। কফি পাউডারে যা মিশ্রণ করা হয় তা এর শিকড়। শিকড়কে শুখিয়ে গুঁড়ো করে কফি পাউডারের মতই দেখতে খয়েরী রঙের একটি চূর্ণ পাওয়া যায়। স্বাদেও কফির মত বলে, ঐতিহাসিক সময়ে যখনই কফি মহার্ঘ্য হয়েছে, যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, বা বিশ্বযুদ্ধ, বা পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক আকালের সময়ে, বিকল্প হিসেবে অথবা মিশ্রিত করে চিকোরি কফির পরিপূরক স্থান পেয়েছে। এখন কফি পাউডারে কিছু শতাংশ চিকোরি মিশ্রণ প্রায় অনিবার্য। এমনিতে এর স্বাদ বেশ তিক্ত এবং এক ধরণের কেঠো গন্ধ আছে। কিন্তু কফির সঙ্গে মেশালে কফির স্বাদে বলিষ্ঠতা এবং গভীরতা এবং গন্ধে নতুন মাত্রা আনে। প্রধাণত ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে পাওয়া গেলেও এখন বিশ্ব জুড়েই চিকোরির আবাদ হয়।


এবার একটু জানা যাক কফির পানীয় প্রস্তুত করার প্রণালী বা brewing সম্বন্ধে। কফি নির্যাস বানানোর জন্য প্রয়োজন একটি আধার যার মধ্যে থাকে একটির ওপর আরেকটি রাখা তিনটি প্রকোষ্ঠ। সব থেকে সরল এবং পুরোনো পদ্ধতি হল ভারাকর্ষণ বা gravity পদ্ধতি। একটি ছাঁকনি অথবা ফিল্টার কাগজের ওপর গুঁড়ো কফি মাঝের প্রকোষ্ঠে রেখে ওপর থেকে ধীরে ধীরে গরম জল ঢালা হয় যা কফির ভেতর দিয়ে বাহিত হয়ে নীচে রাখা পাত্রে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু জমা হয়। এই তরলকে বলা হয় decoction। দক্ষিণ ভারতে গরম দুধ ও চিনির সঙ্গে মিশিয়ে ঘরে ঘরে এই ‘ফিল্টার কাপি’ পানের চলন বহুকাল থেকেই সমানভাবে জনপ্রিয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ওপরের প্রকোষ্ঠে পিস্টন দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে গরম জলকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত বেগে কফি পাউডারের ভেতর দিয়ে তলার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়। একে বলে French press প্রণালী। এতে নাকি কফির ক্যাফেন, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ইত্যাদি গুণগত আবশ্যিক উপাদানগুলি নির্যাসের মধ্যে অধিক মাত্রায় মজুদ থাকে। আর একটি পদ্ধতিতে নীচের প্রকোষ্ঠে জল ফোটানো হয়। বাষ্প হয়ে কফি পাউডারের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়ে ওপরের প্রকোষ্ঠে ওঠে এবং ক্রমে ঠান্ডা হয়ে নির্যাস হয়ে জমা হয়। এমনি সব প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের কফি প্রস্তুতকারক যন্ত্র বাজারে পাওয়া যায়। কফির নির্যাস বানানো একটু সময়সাপেক্ষ। আজকের চটজলদির যুগে যাদের সময়ের অভাব, তাদের জন্য এসেছে ইনস্ট্যান্ট কফি। কেবল গরম জলে গুলে নিলেই কফি তৈরী, কোন তলানি গুঁড়োও থাকে না। তবে খানদানী কফি রসিকরা এ কফি পছন্দ করেন না।


আমেরিকায় কফি পানের ইতিহাসে তিনটি লহর বা waveকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে সব বিশেষত্বের নিরিখে এদের কাল বিভাজন করা হয়েছে, সেগুলি অনুসরণ করলে পৃথিবীর অন্যত্র এবং ভারতেও এই তিন লহরকে নির্ধারণ করা যেতে পারে। বহু বছর ধরে কফি এ দেশে চিরাচরিত উপায়ে প্রস্তুত করে পরিবেশিত হত অথবা ইনস্ট্যান্ট কফি পান করা হত, সেখানে কফির উৎস বা প্রস্তুতি পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি মুখ্য ছিল না। কফি ছিল মোটামুটি সর্বসাধারণের সামর্থ্যের মধ্যে। কফি বোর্ড পরিচালিত কফি হাউসগুলি এবং ছোট-বড় রেস্তোরাঁ এই পর্বের ধারক ও বাহক। কফি তখন বড় শহরগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলা বাহুল্য, কফির এই প্রথম লহর কিন্তু আজও বেশ জনপ্রিয়। ১৯৯৬ সালে ক্যাফে কফি ডে’র আবির্ভাব নিয়ে এল ক্যাফের সংস্কৃতি। এঁরা কফির উৎসস্থানগত বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিলেন। সেই সঙ্গে জোর দিলেন ক্যাফেকে এক উপভোগের জায়গা করে তুলতে, যেখানে এক কাপ কফিকে সঙ্গী করে অবসর সময়ও কাটানো যায়, আবার কাজের কাজও করা যায়। তাছাড়া দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলিতেও কফিকে ছড়িয়ে দিতে এঁদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে গেল ২০১১ সালে টাটা গোষ্ঠীর সহযোগে বহুজাগতিক শৃঙ্খলা স্টারবাকসের আগমন। বিভিন্ন প্রজাতির ও ধরণের কফিকে এঁরা ভারতে নিয়ে এলেন। সেই সঙ্গে কফির সাথে রকম রকম সুগন্ধি, পানীয় ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কত বিচিত্রভাবে কফিকে উপভোগ করা যায়, তার বহুবিধ বিকল্প তাঁরা গ্রাহকদের উপলব্ধ করলেন। কফির গুণমান উন্নত করতেও এঁদের প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। গত দু’ দশকে কস্টা কফি, থার্ড ওয়েভ কফি ইত্যাদি ব্র্যান্ডেড কফি শৃঙ্খলা সহ ছোট বড় অনেক ক্যাফের প্রাদুর্ভাব শহরে শহরে ঘটেছে।


কিন্তু তৃতীয় লহর বা Third Wave চিহ্নিত হয়েছে speciality coffee বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কফি দিয়ে। ভৌগলিক স্থানগত বিশেষত্ব, ত্রুটিহীন কাঁচা বীজ নির্বাচন থেকে শুরু করে বীজের প্রক্রিয়াকরণের প্রত্যেক স্তরে গুণগত মান বজায় রাখা, এমন কি যে জল ব্যবহৃত হবে তার মান ইত্যাদি, এবং শেষে প্রস্তুত কফির স্বাদ ও গন্ধের অনন্যতা, এত সব ব্যাপারের নিরিখে সেই কফি বিশিষ্টতার তখমা পাবে কি না, তা নির্ভর করে। স্পেশিয়ালিটি কফি অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থা মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে বিচার করে নির্ধারণ করেন কোন কফি গুণবত্তার মাপকাঠিতে কত উন্নত মানের। ৯০এর ওপর নম্বর পেতে পারলে সেই কফিকে স্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়।

দক্ষিণ ভারতের ‘ফিল্টার কাপি’


ঐতিহ্যবাহী কফি হাউস


আজকের কফি শপের কফি

আজকের ক্যাফেতে পুরোনো সেই একই ধরণের কফির জায়গায় পাবেন হরেক রকমের কফি। গরম কফি চাইলে নির্বাচন করুন কালো আমেরিকানো বা ফেনিল এসপ্রেসো, অথবা দুধ মেশানো লাটে, ক্যাপুচিনো, মোকা ইত্যদির মধ্যে থেকে। ঠান্ডাই পছন্দ ? তাহলে বেছে নিন নিছক বরফ মেশানো কালো কফি, না হলে ভ্যানিলা, ক্যারামেল, চকোলেট, ক্রীম, আইসক্রীম ইত্যাদির মিশেলে তৈরী সম্ভার। আপনার রুচি আর পছন্দমত কফি অচিরেই বানিয়ে দেবেন ব্যারিস্টারা। সেই ১৯৪৬ সালে ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা গেয়েছিলেন, ‘They’ve got an awful lot of coffee in Brazil’, আজ এ দেশে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই বলতেন, ‘ভারতেও তো এখন দেখছি কফির হরেকরকমবা’ !

1 comments:

0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী রায়

Posted in








আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না। কারণ আপনি ভাবছেন, যদি কাউকে আটকানো হয়, তাহলে আদালত বসবে, বিচারক থাকবে, আইনজীবী থাকবে, কাগজপত্র থাকবে। কিন্তু এখানে নেই কিছুই। আছে শুধু একটা প্যাটার্ন। একটা অ্যালগরিদম। আর শর্তাবলী, যা আপনি কখনও পড়েননি—ক্লিক করেছেন “অ্যাকসেপ্ট” করে। এখন সেটাই যথেষ্ট। কোনও আদালতের আদেশ নেই। কোনও সাক্ষর লাগে না। শুধু নীরবে, ধীরে ধীরে আপনার অধিকারগুলো সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনভাবে, যেন আপনি ভুলেই যান যে কখনও সেই অধিকার ছিল।

২০০১ থেকে অ্যালগরিদমিক নাগরিকত্বের উত্থান। ২০০১ – “প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট”—নামটা শুনলেই বোঝা যায় কতটা দেশপ্রেমিক! এর আড়ালে শুরু হল নাগরিকদের উপর নজরদারি। ২০০৮ আর্থিক ধসের পর জন্ম নিল “ঝুঁকি-পূর্বাভাস” শিল্প। ২০১৩, স্নোডেন ফাঁস করল গোটা মেটাডেটা নজরদারির খেলা। আমরা কাঁধ ঝাঁকালাম। ২০১৬–২০২০, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঢুকে পড়ল চাকরির ইন্টারভিউতে, টেলি-হেলথে, মেজাজ মাপার সফটওয়্যারে। ২০২০, হেলথ সার্ভেইল্যান্স হয়ে গেল “স্বাভাবিক।” ২০২১–২০২৩, সেফটি আর ওয়েলনেস নামে ভবিষ্যদ্বাণী করা এআই মেইনস্ট্রিম হয়ে গেল। ২০২৪–এখন, ট্রাস্ট স্কোর, ইমোশনাল প্রোফাইল, ঝুঁকি মডেল ঢুকে গেছে আপনার প্রতিদিনকার অ্যাপে। অপ্ট আউট করার সুযোগ নেই।

ওয়েলনেস অ্যাপস (মমতার আড়ালে নজরদারি?): ঘুম মাপা? মুড ট্র্যাক করা? কেমন নিরীহ, তাই না? কিন্তু আপনার ঘুম ভেঙে তিনটের সময় অনলাইন শপিং করলে সেই অ্যাপ বলে দেয় আপনি “আবেগিকভাবে অস্থির এবং আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।” এবং সেই ডেটা চলে যায় বীমা কোম্পানির ঝুঁকি মডেলে। আপনি ভাবছেন, অ্যাপটা কেবল মজার কোটস দিচ্ছে? হ্যাঁ, সেই কোটসের পেছনে নীরবে বীমার প্রিমিয়াম পাল্টে যাচ্ছে।

এআই ঝুঁকি স্কোরিং, হাসি মাপা হয়, গলা মাপা হয়। আপনার এইচআর ইন্টারভিউ এখন আর শুধু কথার উপর নির্ভর করে না। আপনার মুখের ভঙ্গি, চোখের পলক, ইমেইলের টোন—সব বিশ্লেষণ করছে অ্যালগরিদম। আপনি স্ল্যাক-এ কম উত্তর দিচ্ছেন? কল মিস করছেন? আপনার নামের পাশে লেগে যাচ্ছে “ইমোশনালি কম রেজিলিয়েন্ট” ট্যাগ। অফিস শেষে গাড়িতে বসে কাঁদলে? সেটা-ও ঝুঁকি সংকেত।

মেন্টাল হেলথ প্রোফাইলিং। BNPL (বাই নাউ পে লেটার) অ্যাপ আপনার ফোন মডেল, ইমোজি ব্যবহার, রাতের শপিং—সব যোগ করে ঠিক করছে আপনি “বিশ্বাসযোগ্য” কিনা। একইসাথে, আপনার সার্চ হিস্টরি দেখে বলছে আপনি ডিপ্রেশন প্রবণ কিনা।

টেলিহেলথ আর চ্যাটবট থেরাপি। এআই থেরাপিস্ট নোট করেছে, “দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ।” আপনি ফলো-আপ করেননি। ডেটা চলে গেছে “নন-কমপ্লায়েন্ট” ট্যাগে। পরের ডাক্তার বলে দিল, “দুঃখিত, আমরা এখন নতুন পেশেন্ট নিচ্ছি না।”

সেফটি ফিল্টার আর প্রেডিক্টিভ পুলিশিং। আপনি ইনস্টাগ্রামে ভুল মেম শেয়ার করেছেন। একটা রাজনৈতিক হ্যাশট্যাগ বেশি ফলো করেছেন। অ্যালগরিদম ভুল বুঝেছে। আপনাকে ব্লক করেনি। শুধু কম রিচ দিয়েছে, পোস্টে কেউ সাড়া দেয় না। আপনি হয়ত টেরই পাবেন না, শুধু ভাববেন “অ্যালগরিদম খারাপ চলছে।”

এখনকার টুলস। হায়ারভিউ – মুখের ভঙ্গি দেখে চাকরির ইন্টারভিউয়ের স্কোর দেয়। পিমেট্রিক্স – নিউরোসায়েন্স গেম দিয়ে আপনার “ইমোশনাল এজিলিটি” মাপে। প্যালান্টির – সরকার আর পুলিশের প্রেডিক্টিভ মডেল চালায়। সিফট – আপনার অনলাইন ব্রাউজিং, কেনাকাটা থেকে ট্রাস্ট স্কোর বানায়। অনফিডো – মুখ চিনে আচরণ প্রোফাইল তৈরি করে। বেটারহেল্প এবং টকস্পেস – “অ্যানোনিমাইজড” ডেটা বেচে মানসিক স্বাস্থ্যের ট্রেন্ড বানায়। বেনেভোলেন্টএআই – আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ডেটা “অপ্টিমাইজ” করে। (মানে: ট্র্যাক করে, টার্গেট করে।)

ডিজিটাল জাতপাত। এখন এই জাতপাত কাগজে লেখা নয়। এটা আপনার ইমোশনাল টেম্পারেচার দিয়ে মাপা হয়। নতুন নাম: “ডিজিটাল ওয়েলনেস প্রোটোকল”, “ইউজার ট্রাস্ট অ্যালগরিদম”, “হার্ম রিডাকশন ফ্রেমওয়ার্ক”, “বিহেভিয়রাল অ্যাস্যুরেন্স স্কোর”। আসলে বলছে: “আমরা আপনার আত্মার স্কোরিং অটোমেট করেছি।” আপনি এখন থার্মোস্ট্যাটের মত, শুধু আপনার এঙ্গজাইটি বেশি।

এগুলো কাল্পনিক নয়। হিথ্রোতে এক মহিলাকে বোর্ডিংয়ে আটকানো হল, কারণ তার ট্র্যাভেল হিস্ট্রিতে “মেন্টাল হেলথ ফ্ল্যাগ।” এক ডেলিভারি পার্টনার উবার ইটস থেকে বাদ পড়ল, কারণ তার প্যাটার্ন “অস্বাভাবিক।”আপনাকে সরাসরি ব্যান করা হয়নি, শুধু আপনার পাশে লেখা হয়েছে: “লো ভ্যালু।” নতুন ব্ল্যাকলিস্ট। আপনি একা নন। আপনার বন্ধুর ডেটা, ভাইবোনের দেউলিয়াত্ব, রুমমেটের লেট পেমেন্ট—সব মিলিয়ে যাচ্ছে। কে আসলে করেছে তা জরুরি নয়, আপনি কার সঙ্গে মিশছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালগরিদমিক দোষ ভাগাভাগি। এটাই ডিজিটাল টেম্পারামেন্ট ট্রেনিং। আপনাকে ‘সফটনিং আপ’করা হচ্ছে। ছোট করা হচ্ছে। “কমপ্লায়েন্স” এর জন্য নতুন করে গড়া হচ্ছে।

গভীরতর সমস্যা। এই সিস্টেমটা আপনাকে কেবল আটকাচ্ছে না, বদলে দিচ্ছে, জানিয়ে দিচ্ছে আপনি কেমন মানুষ হবেন। আপনি রাত জাগতে ভয় পাচ্ছেন কারণ ফোন মাপছে। আপনি মুড লিখতে ভয় পাচ্ছেন কারণ সেই মুড কোথাও গিয়ে ডেটা হয়ে যাচ্ছে। আপনি আস্তে আস্তে এক অ্যালগরিদমিক শিষ্টাচার তৈরি করছেন—যেন মেশিনকে খুশি রাখতে হবে। আপনার হাসি, রাগ, প্রেম—সব কিছু ফিল্টার হয়ে যাচ্ছে যেন আপনি “ঝুঁকিপূর্ণ” না হন।

এটাই আসল বিপদ। আপনি নিজের নয়, কারও ডেটা মডেলের সংস্করণ হয়ে যাচ্ছেন। আপনি একটা ‘ঝুঁকি প্রোফাইল’। এক ‘ট্রাস্ট স্কোর’। এবং এর মধ্যে কোনও মানবিক বিতর্ক নেই। কোনও ভোট নেই। কোনও প্রতিবাদ নেই—কারণ আপনি জানেন না ঠিক কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। একদিন দেখবেন, আপনি শুধু নিজের অধিকার হারাননি, নিজের স্বভাবটাই হারিয়ে ফেলেছেন।

এখানে আসল প্রশ্ন শুধু প্রযুক্তি নয়, নৈতিকতা। যে অ্যালগরিদম আমাদের ঝুঁকি মাপে, সেটা কে বানায়? তার মানদণ্ড কী? আপনি কি জানেন, এই মডেলগুলোর অনেকটাই ট্রেন হয় পুরনো পক্ষপাতের বর্ণ, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা? ফলাফল: পুরনো বৈষম্য নতুন নামে ফিরছে। ডিজিটাল জাতপাত।

একটা সময় ছিল, মানবাধিকার মানে ছিল: “আপনি মানুষ বলেই কিছু অধিকার আপনার।” এখন অধিকার মাপা হচ্ছে আপনি কতটা “লো রিস্ক।” যদি আপনার বন্ধুর দেউলিয়াত্ব, মুড সুইং, বা পুরনো কোনও রাজনৈতিক পোস্ট আপনার নামের পাশে ঝুঁকি যোগ করে, আপনি অজান্তে এক অদৃশ্য নিম্নস্তরের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন। এটা শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজকেও পাল্টে দিচ্ছে। মানুষ খোলামেলা কথা বলার বদলে অ্যালগরিদম-বান্ধব আচরণ শিখছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবে কমে যাচ্ছে—কারণ অ্যালগরিদমিক ভয়। এর ফলে তৈরি হচ্ছে এমন একটা সংস্কৃতি যেখানে সবাই একটু বেশি নীরব, একটু বেশি সাবধানী, একটু বেশি নিরপেক্ষ দেখাতে চায়।

প্রশ্ন হলো: আমরা কি এমন সমাজ চাই যেখানে মেশিন আমাদের চরিত্র নির্ধারণ করবে? যেখানে নৈতিকতা আর মানবিক ভুলের জায়গা নেই, শুধু ডেটা প্যাটার্নের জেল? এই প্রশ্ন এখনই করতে হবে—কারণ একবার প্যাটার্ন লিখে গেলে, তা মুছতে পারবে না কেউ।

শেষে, আপনার আচরণ এখন “কনটেন্ট।” আপনার মুড এখন “মেট্রিক।” আপনার সুনাম এখন একটা অদৃশ্য শেয়ারবাজারে কেনাবেচা হচ্ছে। কোনও অনুমতির দরকার নেই, শুধু প্যাটার্ন চাই। আপনি আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন না। আপনাকে শর্তাবলীর মাধ্যমে বন্দি করা হচ্ছে। আপনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি, আপনাকে শুধু “ঝুঁকি মিটিগেশনের জন্য রিক্যালিব্রেট” করা হয়েছে। কোনও বিচার নেই। কোনও আপিল নেই। কোনও নোটিফিকেশন নেই।

শুধু একদিন দেখবেন: আপনি একটু কম দেখতে পাচ্ছেন, একটু কম বুঝতে পারছেন। আর এক কোণে পড়ে আছে সেই মানসিক ওয়েলনেস সার্ভে, যা আপনি কখনও শেষ করেননি।এই সবই, এখনো পর্যন্ত পাশ্চাত্য, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি। কিন্তু আমরাও একই পথে যাচ্ছি।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















১০.
প্রান্তিক মানুষের মহাশ্বেতা দেবী




সুপরিচিতাসু বাসু,

নীরদ সি চৌধুরীকে প্রথম চিনেছিলাম আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ পড়ে। এই বইয়ে রবীন্দ্র-জীবনের নানা অনুজ্জ্বল দিক নিয়ে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ করলেও রবীন্দ্রনাথের বাইরে যে বাঙালির সংস্কৃতি খানিকটা অস্তিত্বহীন তা-ও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, "বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক জন্ম-নাড়ির সম্পর্ক। বাঙলায় না জন্মালে, রবীন্দ্রনাথকে কিছু মাত্র না জানলে বাঙালির বাঙালিত্ব বজায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা বাঙালীর স্বরূপ উপলব্ধরই প্রয়াস মাত্র"। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ৪০ বছর, ৬০ বছর এবং ৮০ বছর বয়সে তাঁর কবি কৃতি, তাঁর প্রতিভা, তাঁর প্রখর মননশীলতা নিয়ে সমসাময়িক কালের বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগণের সঙ্গে তুলনা করেও তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে কার্পণ্য করেননি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসের প্রতিটা বাক্য মনে হয় তিনি শুধু পড়েননি, বুঝেছেন এবং আত্মস্থ করেছেন। এক অপূর্ব স্বাভিমানী বাঙালি যেভাবে সারা জীবন ইংরেজিয়ানা চর্চা করে গেলেন তা বাঙালি মনীষার বিকাশেরও একটা রূপরেখা স্পষ্ট করে। এবং সেই ছবিটার ভুল ব্যাখ্যা করার কোনও সুযোগই তাঁর বিরোধীরা কখনও হাতছাড়া করেননি। আমার মনে হয় উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলাভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে যে ক'জন ক্ষণজন্মা তুখোড় লিখিয়ে এবং মৌলিক চিন্তকের আবির্ভাব ঘটে, নীরদ সি চৌধুরী এঁদের অন্যতম।

নীরদ সি চৌধুরী নিয়ে তোমার ভাবনা পড়তে পড়তে সহসা মনে পড়লো এমন একজন সাহিত্যিকের কথা যিনি নীরদ সি চৌধুরীর একদম বিপরীত। যিনি নিপীড়িত মানুষের অলিখিত সংগ্রামী জীবনেতিহাসকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। জীবনবিচ্ছিন্ন ভাবকল্পনা বা নিছক প্রণয়ের অর্ধকল্পিত উপাখ্যান নয়, প্রবলভাবেই জীবনসম্পৃক্ত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী সমগ্র জীবন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি প্রবল দায়বোধে সাহিত্য রচনা করেছেন। জল-মাটি-শস্যের গন্ধবাহী মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে যে স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেছে তা বহমান আছে, থাকবে আরো বহুকাল। ঝাঁসীর রাণী তাঁকে লেখক হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।ইতিহাস-আশ্রিত জীবনীগ্রন্থ ঝাঁসীর রাণী সাহিত্যিক হিসেবে মহাশ্বেতার অবস্থানকে একটি শক্ত ভিত্তি দেয়। সেই ভিত্তিতেই তাঁর পরবর্তী জীবনের সুউচ্চ সাহিত্য-পিরামিড স্থাপিত। ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ চরিত্রটির গভীরে ডুব দিতে দিতে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়ে এতদসংক্রান্ত বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁর সংকল্পে থিতু হলেন তিনি, এই রানিকে নিয়ে লিখবেন তিনি। প্রাথমিকভাবে লিখেও ফেললেন চারশো পৃষ্ঠা। স্বস্তি পেলেন না লিখে। ছিঁড়ে ফেললেন সে-লেখা আর ঝাঁসী গিয়ে রানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি হৃদ্গত করে নিয়ে লিখবার জেদ তাঁকে সেখানে নিয়ে ছাড়ল। ‘সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য কর্তৃক লিখিত বীরশ্রেষ্ঠা ভারতীয় নারী লক্ষ্মীবাঈয়ের বহু নূতন তথ্য সংবলিত জীবনালেখ্য ‘ঝাঁসীর রাণী’ ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫৫ সাল জুড়ে ধারাবাহিকভাবে তা ছাপা হলো।

এমন কিন্তু নয় যে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি শুরু হয় এ লেখাটির মাধ্যমে। এর আগে ‘দেশ’ পত্রিকাতেই তাঁর দু-তিনটে ছোটগল্প বেরিয়েছিল। জিম করবেট, যাঁকে তিনি পরবর্তীকালে অনুবাদ করবেন, ছিল তাঁর প্রবন্ধের বিষয়, ওখানেই। তাছাড়া মহাশ্বেতা দেবীর লেখক সত্তার উন্মেষকাল তো শৈশবেই, শান্তিনিকেতন পর্বে। সেখানে সে সাহিত্যসভা হত নিয়মিত, সরলা দেবী চৌধুরানী সভাপতিত্ব করতেন, দশ-বারো বছরের মহাশ্বেতা দেবী লেখা পড়তেন সেখানে, যা ছাপাও হয়েছিল। সেই বয়সে আলফ্রেড নোবেলকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী প্রবন্ধ লিখছেন, ভাবা যায়? পরবর্তীকালে খগেন্দ্রনাথ সেনের ‘রংমশাল’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ বইয়ের আলোচনা করেন যখন, তখন তাঁর বয়স মাত্রই তের (১৯৩৯)। হাতে-লেখা পত্রিকা বার করাও বাদ যায়নি, বয়সে তিন মাসের ছোট ঋত্বিক ঘটক যে-কাজে তাঁর সহযোগী। পত্রিকায় ছবি আঁকার দায়িত্ব ছিল ঋত্বিকের। রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন বেলতলা স্কুলে মহাশ্বেতার সহপাঠিনী, এমএ ক্লাসেরও। স্কুলে পড়ার সময় তাঁরা আর-একবার হাতে-লেখা পত্রিকা বার করলেন, নাম ‘ছন্দ-ছড়া’। দ্বিতীয়বারের শান্তিনিকেতন-পর্বে তাঁর গল্প লেখার সূচনা। ‘দেশ’, ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকা-সহ আরও নানা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন এ-সময়ে, পাঁচের দশকের গোড়া থেকে।

মহাশ্বেতা দেবী নিয়ে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি কি? তুমি কিভাবে দেখো তাঁর লেখাকে? খুব জানতে মন চাইছে। জানি এইসময় মুখোমুখি বসে থাকলে তুমি অনেক জানা অজানা কথা খুলে বসতে। তোমাকে যতটা চিনি ও জানি আমার বিশ্বাস মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য জগতের চেয়ে তুমি বেশি নজর দিতে তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে। উচ্ছাসিত হয়ে বলতে শুরু করতে তার রাজনৈতিক যাপনের কথা অনুমান করি সেসব তথ্যের ভিড়ে তুমি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে। শ্রেণী সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র নিয়ে বলতে বলতে তুমি চেনাতে অনন্য এক মহাশ্বেতা দেবীকে, যিনি লেখার পাশাপাশি অন্যতর এক পরিচয়ে পরিচিত, তিনি একজন সমাজকর্মী এবং তা কোনও সৌখিনতায় মোড়া নয়। বাংলা-বিহার-ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর আদিবাসীর মধ্যে কাজ করে গেছেন তিনি আজীবন। জঙ্গলমহলের খেড়িয়া, শবর, লোধাদের সামাজিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন তিনি। এই জনজাতিকে জমির পাট্টা দিতে তাঁর নেতৃত্বদানের জন্য তিনি সেখানে মায়ের মত সম্মান পান। শবর জাতির ওপর ঔপনিবেশিক শোষণ ছিল সীমাহীন উপরন্তু ব্রিটিশরা এঁদের আখ্যা দেয় ‘অপরাধপ্রবণ’ জাতি হিসেবে। মহাশ্বেতা দেবী তাঁদের সেই দুর্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেখান, তাঁদের প্রাচীন সংস্কৃতি কী মহান। একদিকে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে গিয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ভারতের আদিবাসী সমাজের এক বিরাট অংশ তাঁদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার নিয়ে প্রামাণ্য ও মহত্ত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’, ‘কৈবর্তখণ্ড’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং তাঁর অসংখ্য ছোটগল্পে আদিবাসী মানুষের স্বেদ রক্ত হাহাকার ও সহজ আদিম জীবনযাপনের রেখাচিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। আদিবাসীদের জীবনের গভীরে গিয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া, তাঁদের লোকাচার এবং ইতিহাসের পরম্পরাকে শ্রদ্ধাসহকারে অনুধাবনের চেষ্টা আর কোনও বাঙালি লেখকের মধ্যে দেখা যায়নি। বাংলা সাহিত্যের ভূগোলকে বিস্তৃতি দিয়েছেন তিনি, আদিবাসী সমাজের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য এনে দিয়েছেন। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও মহাশ্বেতা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংগ্রামকে উপজীব্য করেছেন অনায়াস দক্ষতায়। ‘দ্রৌপদী’, ‘জাতুধান’, ‘শিকার’, ‘শিশু’, ‘সাগোয়ানা’, ‘লাইফার’, ‘মাছ’, ‘বিছন’ প্রভৃতি গল্পে সমাজের নানা অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার প্রতিবাদের শিল্পভাষ্য নির্মিত হয়েছে।

জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে পিছনে ফিরে গেলে দেখি পরাগ দা আমাদের কমরেড পরাগ মিত্র ঘরময় বইয়ের স্তুপ। মনে আছে তোমার পরাগ দার কথা? পরাগ দা এখন মালবাজারে থাকে। তার ঘরেই বইয়ের স্তুপে মহাশ্বেতা দেবীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। স্মৃতি বিট্রে না করলে সম্ভবত নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হাজার চুরাশির মা উপন্যাসটি মহাশ্বেতা-কথাসাহিত্যের এক মাইলফলক বলে বিবেচিত হয় বলে সেই বইটিই পড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু পরাগ দা বলেছিল আগে অরণ্যের অধিকার পড়, নিজেই বইয়ের স্তুপ থেকে খুঁজে বের করে দিল। সেই প্রথম আমার মহাশ্বেতা পাঠ। মুন্ডা বিদ্রোহের আখ্যানকে উপন্যাসের কলেবরে স্থান দিয়ে, অভাবী মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রতি শুধু মমত্বই প্রকাশ পায়নি, মুন্ডাজীবনের গভীর বেদনাও প্রকাশ পেয়েছে। পেটভরা ভাত, গায়ে মাখার তেল, পরনের জন্য কাপড় – এটাই তাদের জীবনের সর্বশেষ আকাঙক্ষা। ব্রিটিশ সরকার মনে করত, মুন্ডাদের বিদ্রোহ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আসলে বিদ্রোহটা ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে। সেই শোষক বিদেশি নয়, ভারতের ভিন্নভাষী, ভিন্ন বর্গের মানুষ – বাঙালি, বিহারি, রাজপুত, মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী ও জমির মালিকরা – আদিবাসীদের ভাষায় ‘দিকু’। ‘দিকু’রা আদিবাসীদের কষ্টে ফেলে, সুদের জালে আটকে তাদের ফসল নিয়ে গিয়ে তাদের নিঃস্ব ও ভূমিদাসে পরিণত করত। খাদ্য, বাসস্থান হারিয়ে, শোষণের পীড়নে মুন্ডারা তীর, টাঙি, বর্শা হাতে নিরুপায় হয়ে প্রশাসনের বন্দুকের গুলির সামনে এসে দাঁড়ায়। মহাশ্বেতা দেবী অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে সেই দ্রোহের চিত্রটি জীবন্ত করে তুলেছেন। যেমন – ‘মুন্ডার জীবনে ভাত একটা স্বপ্ন হয়ে থাকে।… কোন না কোনভাবে ভাত বীরসার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বেশিরভাগ সময়েই বীরসার যে উদ্ধত ঘোষণা মুন্ডা শুধা ‘ঘাটো’ খাবে কেন? কেন সে ‘দিকুদের’ মত ভাত খাবে না। ’ বীরসার ভগবান হয়ে ওঠার পেছনে অরণ্য-চেতনাটিকে লেখক সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এভাবে সে জিতেন্দ্রিয় পুরুষে পরিণত হয়। তার প্রতি আকর্ষণ অনেক মুন্ডা যুবতীর। কিন্তু সে নিজেকে উৎসর্গ করেছে ‘উলগুলানে’র কাজে। আকর্ষণ নিয়েও সে থাকে নিরাসক্ত। তাই বীরসাকে শুদ্ধ চরিত্র, জিতেন্দ্রিয়, আত্মত্যাগী, আদর্শ পুরুষে রূপ দিয়েছেন লেখক। কেননা অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে বীরসার নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্রোহ বা ‘উলগুলান’ দেখানোই তার উদ্দেশ্য। আদিবাসী জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে অরণ্য। অরণ্য উচ্ছেদ করা মানে আদিবাসীদের জীবন বিপন্ন করা। অরণ্যবাসীদের আহার এবং আবাস – দুই জোগায় বনভূমি। সেই বনভূমি ‘দিকু’রা কেড়ে নিচ্ছে, বনভূমিতে তাদের অসিস্ত আর থাকছে না – বনভূমির কান্না, আদিবাসীদেরই কান্না। আদিবাসীরা ফিরে চায় অরণ্যের অধিকার। এজন্যই বীরসা মুন্ডাকে মহাশ্বেতা দেবী ভগবান মহিমা দান করে ঈশ্বরোপম করে চিত্রিত করেছেন। তার দ্রোহ ও নেতৃত্বে সঞ্জীবিত করে দিয়েছেন চিরকালের মহিমা। অরণ্যের অধিকার পড়ার অনেক পরে আমি পড়েছিলাম হাজার চুরাশির মা,যদিও এর আগে ‘রং নাম্বার’, ‘শরীর’, ‘প্রাত্যহিক’ গল্পেও একই বিষয় অবলম্বিত হয়েছিল। ‘রং নাম্বার’ গল্পে নকশাল আন্দোলনে নিহত দীপঙ্করের বাবা তীর্থবাবুর মানস জগতের উন্মোচনের মতো হাজার চুরাশির মা উপন্যাসে নকশালপন্থী নিহত তরুণ ব্রতীর মা সুজাতার অন্তর্দহনকে বিসত্মৃতি দিয়ে সত্তরের উত্তাল সময়কে ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় জীবনের রক্তাক্ত এক অধ্যায়কে সাহিত্যের দলিলীকরণের মধ্য দিয়ে এ-উপন্যাসে লেখক মধ্যবিত্তের আত্মতৃপ্তি ও মুগ্ধ সংকীর্ণতার প্রাকারে তীব্র আঘাত হানেন। গোর্কির মায়ের মতোই ব্রতীর মা সুজাতার অরাজনৈতিক সত্তা রূপান্তরিত হয় বিপ্লবী চেতনাসমৃদ্ধ সত্তায়।

জীবনের দুপুর পেরিয়ে এসে এই পড়ন্তবেলায় মনে হয় মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যভাবনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা বিচিত্রমুখী প্রান্তিকজীবনের আখ্যান। নিকট ও দূরের ইতিহাসকে তিনি যেমন গ্রথিত করেন তাঁর সাহিত্যে, তেমনি সাম্প্রতিক সময়কেও ইতিহাসেরই বস্তুনিষ্ঠ তাৎপর্যে তুলে ধরেন তাঁর লেখায়। বর্তমানতার মধ্যেও তাই তাঁর লেখায় থাকে যেন দূরকালের ইতিহাসের বিভ্রম। তিনি একাধারে সমাজকর্মী এবং লেখক। বঙ্গদেশ তথা ভারতসহ বিশ্বক্ষেত্রে এমন দৃষ্টান্ত প্রায় নজিরবিহীন। মহাশ্বেতা দেবী শুধু লেখেন না। যা লেখেন, তাই করেও দেখান। তাই তাঁর সাহিত্য আর কর্মজীবন একাত্ম সাধনার এক অনন্য প্রয়াস। সর্বস্বহারাদের জন্য লেখেন না, তাদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগও করেন। সৃষ্টির প্রাপ্তি অর্থ নিয়ে কলকাতা শহরে বসে থাকেন না। চলে যান প্রান্তিক পুরুলিয়ায়। তিনি শুধু ভয়েসলেস সেকশনের রাইটার নন, নিরক্ষর বাক্যহারা মানুষের মনের সম্রাজ্ঞী। যেখানে অত্যাচার, নিপীড়ন সেখানেই সবার আগে ছুটে গেছেন জননী মহাশ্বেতা দেবী। কারোর কাছে তিনি দিদি কিংবা বহিন, আবার কারো কাছে মমতাময়ী মা। সর্বার্থেই তিনি একজন যোদ্ধাকর্মবীর। তিনি কর্মসাধক। ব্যক্তিগতকে গুরুত্ব না দিয়ে সমাজের অবহেলিতদের সংগঠিত করার দুর্বার ব্রতকে আজীবন পালন করেছেন। আদিবাসীজনজাতি সমাজ ও সংস্কৃতির ভ্রান্ত ভাবনাকে দূর করার জন্য আপসহীন লড়াই করেছেন।

মুখরিত শ্রাবণ এসে গেলো, রাত ভর বৃষ্টি ছিল গতকাল এইখানে। স্কুলের দিনগুলোর মতন ইচ্ছে করেই আজ অফিস কামাই করেছি। মেঘলা দিনের সরলতা মেখে গ্যাসচুল্লিতে খিচুড়ী বসিয়েছি। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিনা সঙ্গে কি ডিম অমলেট নেবো নাকি মাংস কষা। সামনেই তোমার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন চিরযুবক। তোমার জন্মদিনে ‘বিবেক বিদায় পালা’বইটি পাঠালাম। জানিনা বইটি তোমার পড়া কিনা যদি তোমার সংগ্রহে থেকে থাকে তাহলে আমার কপাল মন্দ। মহাশ্বেতা দেবী এই উপন্যাসে ধরেছেন শ্রীচৈতন্য ও তাঁর সমসময়কে। কোথায় জানি পড়েছিলাম এ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। দুর্ভাগ্য, নানান উপকরণ সংগৃহীত হলেও শেষ পর্যন্ত লেখা হয়ে ওঠেনি এ-উপন্যাসের খণ্ডটি। নিরন্তর ভালো থেকো। তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।



শুভেচ্ছা ও শুভকামনায়-

তোমার সুস্মি

১৯ জুলাই, ২০২৫

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১৩

অনেকদিন গের্ট, ইনেস আর দুষ্টু পোষ্য ফ্লকের খোঁজখবর পাইনি আমরা। শেষোক্ত প্রাণীটির জীবনযাপনে সেরকম কোনও পরিবর্তন হয়নি। ইনেসের ঘরের সামনের করিডরে সে ঘুমোয়। তার বাস্কেটে একটা লালরঙের কম্বল আছে। বাস্কেটের পাশে একটা এনামেল করা পাত্র রোজ সন্ধ্যায় জল ঢেলে ভর্তি করা হয়। ফ্লক নিশ্চিন্তে এবং শান্তিতে ঘুমোয়; সকালে উঠে সে নিজের থাবা দিয়ে ঘরের দরজাটা আঁচড়াতে শুরু করে, যতক্ষণ না সেটা খুলে দেওয়া হয়। তারপর তার ঝোড়ো আদুরে ভাবভঙ্গির উত্তরে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ছোট করে ইনেস তাকে সুপ্রভাত জানায়। ফ্লক তাতে অবাক হয় না, দুঃখ পায় না। কারণ সে জানে যে ইনেস অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গেও একই ধরনের ব্যবহার করে থাকে। ব্যাপক আবেগী ভাবভঙ্গির সামনে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায় সবসময়।

ইনেস লাল রঙের চপ্পল পরেছে। রঙটা ফ্লকের কম্বলের সঙ্গে ম্যাচিং। লম্বা একটা ড্রেসিং গাউন পরেছে সে; তার পোশাক থেকে অবর্ণনীয় সুন্দর একটা সুবাস আসছে। যখন ইনেস ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তার নখের পরিচর্যা করে, তখন ফ্লক তার পোশাকের প্রান্তের নরম পশমে নাক ডুবিয়ে বসে থাকতে ভালবাসে। ইনেস সেটা লক্ষ্য করে তাকে একটু দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে; তবে দূরে যেতে বলার আগে অবশ্যই সে এক মুহূর্তের জন্য তার উষ্ণ এবং ঋজু হাতে তাকে আদর করতে থাকে এক দুই মুহূর্তের জন্য। ‘এবার এসো, ভালো কুকুরছানা!”… ইনেসের কথাগুলির মধ্যে যে এক মহান কোমলতা লুকিয়ে আছে সেটা ফ্লক অনুভব করে এবং এই অনুভূতিকে সে গের্টের আবেগের বিস্ফোরণ এবং ছোট্ট বের্নহার্ডের নিয়ত এবং বেশ অসহনীয় টোকা মেরে যাওয়া আদরের থেকেও অনেক বেশি পছন্দ করে। ফ্লক খুব ভাল এক পর্যবেক্ষক, যদিও সে এটা বোঝে না যে বের্নহার্ড যখন তাকে টোকা মেরে আদর করে, সেটা শুধুই তাকে আদর করবার ইচ্ছে হয় বলে করে না। যখন ইনেস এবং গের্ট বের্নহার্ডের উপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে যায়, তখন নিজের অস্বস্তি গোপন রাখবার জন্য বের্নহার্ড তাকে আদর করে। কিম্বা যখন বিশেষ কোনও আলোচনায় বের্নহার্ড অংশগ্রহণ করতে চায় না, কোনওভাবে এড়িয়ে যেতে চায়, তখন সে ফ্লককে আদর করে। ঘটনাচক্রে, বের্নহার্ড প্যারিসে চলে যাবার পর থেকে শনিবারের বিকেলে গাড়ি চড়ে হাওয়া খেতে যাওয়া অনেকটা কমে গেছে। যেহেতু ফ্লক ওদের সবাইকে খুব ভালবাসে, সেহেতু একথা বলাই যায় যে ফ্লক বের্নহার্ডের উপস্থিতির অভাব অনুভব করে।

তবে ফ্লক রোজ খায়দায়, ঘুমায়, হাঁটতে যায়। তার দিনলিপির নিয়মের খুব সাঙ্ঘাতিক কোনও হেরফের ঘটে না। মোটের উপর এককথায় বলা চলে যে ফ্লক ভাল আছে।

কিন্তু ইনেস নানারকমের চিন্তা ভাবনায় জর্জরিত। যদিও সে খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা আছে, তবুও সম্প্রতি সে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কখনো কখনো। প্রতি ক্ষেত্রে সে ভেবে চলেছে যে ঠিক কী ভাবে করলে কাজটা ঠিকভাবে করা সম্ভব। যেমন, সে ভাবছে যে নিজের কেরিয়ারের উপরে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমি হয়তো আগে পরিষ্কার করে বলিনি যে ইনেস কোনও চাকরি করে না, যদিও সে খুবই আধুনিকমনা নারী। ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। সাধারণ মানুষজনের চেয়ে তার বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানগম্যি আছে এবং পরিশীলিত আদবকায়দাসম্পন্না; তার উপরে দেখতে সুন্দরী এবং যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। তার এত গুণের সেরকম কোনও সদ্ব্যবহার সে করছে না। সে কালেভদ্রে বাড়ির বাইরে বেরোয়। অতিরিক্ত সামাজিকতা পালন করা কিম্বা সমাজে বিশেষ ভাবে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল দেখাবার কোনও তাগিদ নেই তার। তার বাবার এই ব্যাপারে বেশ আক্ষেপ আছে। কারণ সে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতিভার যথাযথ প্রয়োগ করছে না। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই ইনেস নিজের মত থাকতে ভালবাসে এবং তাঁর বাবা নিজস্ব মতামত মেয়ের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নন। অবশ্য তার অর্থ এমন নয় যে ইনেস তাঁর বাবার মতামতকে কোনও গুরুত্ব দেয় না। ইনেসের বাবা খুব বুদ্ধিমান, নিজস্ব ব্যবসা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন, শিক্ষিত, দূরদর্শী এবং মুক্তমনা ব্যক্তি। ইনেস বাবাকে খুবই ভালবাসে কিন্তু নিজের জীবনের কিম্বা তাঁর বন্ধুবান্ধব বেছে নেওয়া কিম্বা নিজস্ব সময় কাটানোর কোনও সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই বাবার মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয় না। কারণ সে মনে করে যে তাঁর জীবনের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা প্রয়োজন। স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাইরের প্রভাব যদি ভুল হয়, সেক্ষেত্রে জীবনে ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। “পরিস্থিতি বুঝে চলা আর সেটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া”… সে বলে, “এটাই তো জীবনে বেঁচে থাকার আসল কৌশল। তবে সেটা কখন কী ভাবে করব, সেটা অবশ্যই আমার পছন্দ! তবে দিনের শেষে আমি জানি যে বাবা আছেন এবং আমি সবসময় তাঁর উপরে ভরসা করতে পারি।”

উদাহরণস্বরূপ, তাঁর বাবা যদি জানতে পারেন যে গের্টের বাড়ির বন্ধুদের আড্ডায় সে ছাড়া আর কোনও মেয়ে যায়নি, তাহলে কেমন আচরণ করবেন? তাছাড়া সে যে সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝে গের্টের সঙ্গে বেড়াতে চলে যায়, সেটার জন্যেও যদি সে অনুমতি চায়, বাবা কখনই রাজি হবেন না। যদিও আমরা জানি যে তিনি যথেষ্ট মুক্তমনা, উদারচিত্ত, তবুও তিনি আপত্তি করতেই পারেন এই কথা বলে যে ইনেস যদি এদের সঙ্গে এইভাবে মেলামেশা করে, তাহলে তাঁর সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে।



কিন্তু ইনেস তাঁর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের বন্ধুদের আড্ডা এড়িয়ে থাকতে পারে না। যেমন ফার্দিনান্দ, ইনেসকে যার খুব দরকার; তাছাড়া বের্নহার্ড, সে তো ইনেসের বাড়িতেও এসেছে। গের্টের সঙ্গে সপ্তাহান্তের শেষে লং ড্রাইভ সে শুধুই সামাজিক সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে বন্ধ করে দিতে পারে না। গ্রীষ্মের সময়ে গ্রামের দিকের পরিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেওয়া সপ্তাহে অন্তত একদিন তাঁর, ফ্লকের এবং গের্টের জন্য খুব প্রয়োজন।

ইনেস তাঁর বাবার আপত্তির কারণগুলো বুঝতে পারে। কিছুটা সে বিবেচনা করেই চলে। কিন্তু সব কথা মেনে চলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বাবার মূল্যবোধ আলাদা। তিনি মনে করেন যে গরমের ছুটি কাটানোর মজার থেকেও সামাজিক সম্মান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ভবিষ্যতের কথা তলিয়ে ভাবেন, অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী। অন্যদিকে ইনেস সামাজিক মানসম্মান নিয়ে ততখানি ভাবিত নয়। ভবিষ্যতের ব্যাপার নিয়ে ভাবতেও তাঁর বয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ তাঁর মতে খুব অনিশ্চিত এবং অনেক দূরের ব্যাপার। আপাতত সে আগামী শনিবার ফ্লক আর গের্টের সঙ্গে জঙ্গলের দিকে লং ড্রাইভে যাবে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পুরো পাহাড়টা পেরিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে তাদের। পাহাড়ের উপরে একটা লেক আছে। সেখানে বসে তারা মাছভাজা খাবে আর বের্শেনের কথা ভাববে, যে প্যারিসে গেছে পিয়ানো শিখবে বলে। ফ্লকের গলার কলারটা খুলে দিয়ে তাকে ইচ্ছেমত দৌড়াতে দেবে ইনেস। যদিও ব্যাপারটায় ঝুঁকি আছে, কারণ ফ্লক খামকা ঘেউঘেউ করে সরাইওয়ালার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তারপর আবার তাকে শান্ত করতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়ে যাওয়া চঞ্চল খরগোশগুলোকে ধরবার মত ক্ষমতা ফ্লকের নেই। অবশেষে অন্ধকার হয়ে আসবে। গের্টের মেজাজ খারাপ হবে। সে ফ্লককে বলবে অপদার্থ জন্তু, কারণ ফ্লক সব্বার মিলিত শিসের শব্দ অবধি শুনছে না, নিজের ইচ্ছেমত দৌড়ে কোথায় লুকিয়ে বসে আছে।

কিন্তু ফিরবার সময় কে জানে কোত্থেকে ফ্লক হঠাৎ এসে হাজির হবে ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে। আনন্দে, খুশিতে লাফাতে লাফাতে গড়াতে গড়াতে এসে সব্বার আগে আগে নিজের নাকটা উপর দিকে তুলে চলতে থাকবে সে। সরাইখানাটাকে অবশ্য ঠিক হোটেল বলা চলে না। ঘরোয়া ব্যবস্থাপনা। বিশাল বিশাল খাটগুলোতে অনেক বালিশ আর ডোরাকাটা উলের কম্বল। গের্ট ওয়াইন অর্ডার করবে আর প্রমাণ করবার চেষ্টা করবে যে সে একটুও ক্লান্ত হয়নি। ইনেস জোর করে ঘুমাতে চলে যাবে। ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়েও পড়বে। বের্শেন যে ভাবে রবিবারে জেগে উঠতে চায়, ঠিক সেইভাবেই সবার ঘুম ভাঙবে। ঝরনার জলের কুলকুল শব্দে, সূর্যের সোনালি আশাবাদী রশ্মি যা পাথরের সব ফাটলের মধ্যে ঢুকে চারদিক আলো করে দেয় এমন সকালে জেগে উঠবে তারা।

গের্ট সবসময় ইনেসের চেয়ে আগে উঠে যায় ঘুম থেকে। তারপর সে ইনেসের ঘরের সামনে বাইরে থেকে ইনেসকে ডাকবে। তারপর সরাইখানায় যে মেয়েটা প্রাতরাশ পরিবেশন করে, তাঁকে বলবে ইনেসের ঘরে সবার খাবার দিয়ে যেতে। গের্ট অনেক রুটি খেয়ে ফেলবে। তারপর সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে মেয়েটাকে বলবে আরও দুধ দিয়ে যেতে। তারপর প্লেটে ঢেলে চুপিচুপি বেশ কিছুটা দুধ ফ্লককে খাইয়ে দেবে।

কিন্তু সন্ধের মধ্যে ইনেস খুব ক্লান্ত হয়ে যাবে। রবিবারের সন্ধেটা খুব তাড়াতাড়ি আসে। এটা বের্শেন বলে। ফুলে ফুলে ঢাকা উপত্যকার মধ্য দিয়ে গাড়িতে ফিরবে তারা। যাবার পথে দিগন্তরেখার আকাশ প্রথমে উজ্জ্বল ছিল, তারপর ধীরে ধীরে বিষণ্ণ ফ্যাকাসে নীল হয়ে আলো নিবে আসবে।

বাতাসে উত্তাল পথ দিয়ে দিগন্তরেখার দিকে গাড়ি চালিয়ে যাবে গের্ট। পথে রাত হয়ে যাবে কখনো কখনো। একটা উজ্জ্বল চাকতির মত দেখতে চাঁদ ওদের পথের সঙ্গী হবে। ফ্লক ইনেসের হাতের মধ্যে নাক গুঁজে ঘুমিয়ে পড়বে।

আবার পরের শনিবার ইনেস ফ্লক আর গের্টকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাবে। তাতে তাঁর সামাজিক সম্মান থাকল না গেল, সেটা নিয়ে সে ভাবে না। তবে যাবার আগে সে কখনই তাঁর বাবার কাছে অনুমতি চায় না কিম্বা এই ভ্রমণ নিয়ে বাবার সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না। কারণ সে জানে যে বাবা ব্যাপারটা সেভাবে অনুমোদন করেন না, তিনি সামাজিক সম্মান নিয়ে ভাবিত। ফলে অনাবশ্যক এই বিষয়ে আলোচনা করে বিতর্ক বাড়িয়ে সে তাঁর বাবাকে দুঃখ দিতে চায় না। তাছাড়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে যে কোনও ঘটনা ঘটে যাবার পরে সেটার মধ্যে আর ততখানি ধার থাকে না, অথচ কোনও ঘটনা ঘটবার আগে সেটা নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা এবং নানা আশঙ্কা মানুষের জীবনে অশান্তি ডেকে আনে।

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি যে শনিবারের এই ভ্রমণ আগের মত ঘনঘন হচ্ছে না বের্শেন প্যারিসে চলে যাবার পরে এবং সেটার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে ফ্লক। অবশ্যই না বেরোবার বেশ কিছু কারণ আছে। সেটার মধ্যে অন্যতম হল যে ইনেস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকে আজকাল।

(চলবে)

0 comments: