0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in










বিমল কর (১৯২১-২০০৩) এর যাত্রাশুরু ছোটগল্প দিয়ে অন্য সব খ্যাতিমান লেখকদের মতই। ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ তাঁর প্রকাশিত প্রথম ছোটগল্প। ছোটগল্পের পথ ধরে তিনি উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়ে এক সময় বাংলা গল্প- উপন্যাস সাহিত্যে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রাখেন।
বাংলা সাহিত্যের গল্প-উপন্যাসের ব্যতিক্রমী ধারার শিল্পী হওয়ার পেছনে ইতিবৃত্ত জানতে হলে আমাদেরকে মানুষ বিমল কর এর ব্যক্তি জীবনের প্রতি অবশ্যই আলোকপাত করতে হয়।
বিমল কর এর জন্ম ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগণা জেলার টাকির কাছের এক গ্রামে। তাঁর শৈশব আর কৈশোর কাটে টানা পোড়েনের মাঝে। কলেজ জীবনে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ছোটবেলা ও কিশোরবেলা কেটেছে ধানবাদ, আসানসোল, কালিপাড়ায়, বরাকর, কুলটি অঞ্চলে। তাঁর ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কেটেছে নিঃসঙ্গতায় আর পড়াশুনোয়। তাছাড়াও অসুস্থতা তার ছোটবেলায় নিত্যসঙ্গী হওয়ায় বিড়ম্বনার শিকার তাকে কম হতে হয়নি। কলকাতায় পড়াশোনাকালে তাঁর জীবনে অস্থিরতা কম ছিল না। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও ডাক্তারী পড়া হয়ে উঠেনি তাঁর। তিনি মেডিকেল কলেজ ছেড়ে শ্রীরামপুর টেক্সটাইল কলেজে ভর্তি হয়েও তা ছেড়ে দিয়ে শেষে ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে। ছাত্রজীবনের টানাপোড়েনের মাঝে তার জীবনে বন্ধুবান্ধব, বই, যাত্রা-নাটক ও সিনেমা জায়গায় করে নেয়। কলেজে পড়াকালে তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন এবং সম্পৃক্ত হন লিটিল ম্যাগ প্রকাশনার সাথে। এক সময় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিমল যোগদান করেন এ.আর. পি তে। তারপর আসানসোলে অ্যামিউনিশন প্রেডাকশন ডিপোতে। সেখান থেকে কাশীতে রেলের অ্যাকাউন্ট হিসেবে যোগদান করেন। তারপর এক সময় এলো যখন তিনি সবকিছু ছেড়েছুড়ে যোগদান করলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়।

প্রায় আটাশ বছর ‘দেশ ‘পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর প্রতিষ্ঠা পাবার পথ সুগম হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের গল্প-উপন্যাসের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে সংযুক্ত হবার পরে তিনি বাংলাসাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক-লেখিকাদের লেখার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হলেন। তার ফলেই তিনি গল্প-উপন্যাসের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে নতুন রীতির নিরীক্ষাধর্মী লেখাতে সচেষ্ট হন। গ্রামজীবন থেকে উঠে আসা একটা মানুষ কলকাতার জীবনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেও গ্রামজীবনকে ভুলতে পারেনি, ভুলতে পারেনি তিনি তাঁর ছোটবেলার কিশোর জীবনকে। বিমল কর তাঁর লেখা ছোট গল্প-উপন্যাসে গ্রামের মানব-মানবী, গাছপালা বৃক্ষলতা আর প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা নানা অনুষঙ্গকে গভীর মমতায় তুলে এনেছেন, যাতে লেখকের গভীর অর্র্ন্তদৃষ্টি, মেধা মনন ও চিন্তা চেতনার আভাস ফুটে উঠেছে। বিমল কর তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মে জীবন জিজ্ঞাসাকে উপস্থাপন করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। মানুষের অন্তরের কথা তিনি তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসে কতটা গভীর মমতায় তুলে এনেছেন তা দেখার জন্য আমরা তাঁর লেখা কয়েকটি ছোটগল্পের ওপর দৃষ্টিপাত করতে পারি।

বাংলা গল্পসাহিত্য নবতর মাত্র পেয়েছে বাংলা সাহিত্য জগতের বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান গল্পকারের লেখা নিরীক্ষাধর্মী ব্যতিক্রমধর্মী ধারার গল্পের মাধ্যমে একথা না বললেই চলে নয়। জগদীশ গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী প্রমুখ বাংলা ছোটগল্প নির্মাণে নবতরমাত্র যোগ করেন ,যা বোদ্ধা ও মনোযেগী পাঠকদের অজানা নয়। বিমল করের লেখায় নিঃসন্দেহে তাঁর অগ্রজ ওই সব লেখকদের রচনার ছায়া অবশ্যই কোন না কোন ভাবে পড়েছে। তবে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় বিমল কর শুধুমাত্র তাদের রচনার অনুপ্রেরণা থেকেই দায়সারা গোছের লেখালেখি করে খান্ত হননি।

বিমল কর তাঁর লেখা গল্পে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছেন মনস্তাত্তি¡ক অনুষঙ্গে। তাঁর ছোটগল্পের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলতে হয় তাঁর প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ গল্পে ভদ্রসমাজের নৈতিকতার মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। একটা খৃষ্টান মেয়ে চরম অসহায় অবস্থায় পড়ে এক পর্যায়ে একজন আলুর দোকানদারকে বিয়ে করে আত্মনিগ্রহের শিকার হয়। এ গল্পে গল্পকারের অন্তর্মুখিতার আভাস প্রথম থেকেই পাওয়া যায়। বিমল কর এর অনেক লেখাতে অন্তর্মুখিতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান তা আমাদের এ আলোচনায়ই উঠে আসবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে বিমল কর নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি মূলত ইন্ট্রোভার্ট লেখক এবং আমার লেখার বিষয়ও অনেক সময় কোন মানুষের আত্মসমস্যা ও দার্শনিক জিজ্ঞাসা থেকে দেখা।’

বিমল কর এর লেখা নাম করা গল্পের মধ্যে মানবপুত্র, বসন্তবিলাপ, বালিকাবধূ, পিঙ্গলার প্রেম, বন্ধুর জন্য ভূমিকা, নিরুদ্দেশ যাত্রা, আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন, পলাশ, বকুল গন্ধ, উদ্ভিদ, অলৌকিক বিষণ্ণ, জননী, নিষাদ, সংশয়, উদ্বেগ, কাঁচঘর, সোপান, আঙুরলতা, নিগ্রহ, সে, শীতের মাঠ, সত্যকাম, কামকামিনী, ফুটেছে কমলকলি, নদীর জলে ধরা ছোঁয়ার খেলা, উপাখ্যানমালা ইত্যাদি।
বিমল কর-এর নিরীক্ষাধর্মী গল্প ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’। এই গল্পে লেখক নারী সংসর্গজাত অনুভূতির বিচিত্র নিরীক্ষা উপস্থাপন করেছেন। শিবানীকে ঘিরে চারজন পুরুষ, তিনজন প্রেমিক আর একজন তার স্বামী ভুবন। তিন প্রেমিক শিবানীকে যেভাবে পেয়েছিল চতুর্থজন তার স্বামী ভুবন তাকে সেভাবে পায়নি। তিনজন পুরুষের যে সমস্যা চতুর্থ পুরুষ তার স্বামী ভুবনের সমস্যা আলাদা। শেষ পর্যন্ত শিবানীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তিন প্রেম বিলাসী বন্ধুর সামনে ভুবনের কর্তব্য নিষ্ঠা ও প্রেমের শুদ্ধতার একটা সম্ভাব্যরূপকে যেন অনায়াসেই তুলে ধরছেন বিমল কর। শিবানীর মৃত্যুতে স্বামী ভুবনের মাঝে যে শুদ্ধতা নেমে আসে তা দেখে মনে হয় সে অন্য আর এক ভুবন।

বিমল কর এর উপন্যাস লেখার ভিত রচিত হয় তার লেখা অনেক গল্প থেকে, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় তাঁর ‘সুধাময়’ গল্পের মতো গল্প থেকেই তিনি উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ হন। এই গল্পের নায়কের আত্ম-অন্বেষণের ভঙ্গিটিই বিমল কর এর অনেক উপন্যাসের নায়কের চরিত্রে ফুটে তুলেছেন । বিমল মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচনা করেন অপেক্ষা, সংশয়, উদ্বেগ, আঙুরলতা, কাঁচঘরের মতো গল্প। আঙুরলতা তাঁর বিখ্যাত গল্প, বহুল পঠিত ও বহুল আলোচিত। আঙুরলতা গল্পে পতিতা আঙুরলতার সাথে নন্দর সম্পর্কটা প্রেমভালবাসা আর ঘৃণায় মেশানো। মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেই একজন গল্পকার আঙুরলতার মতো গল্প লিখতে পারেন।

বিমল কর এর দু’একটা গল্প-উপন্যাস পড়ে তাঁকে বিষণœ লেখক হিসাবে ভেবে নেবার অবকাশ নেই। তাঁর বেশ কিছু গল্পে বিষণœতা বিশেষ অনুষঙ্গে উঠে এলেও তা নিঃসন্দেহে বাস্তবতা বর্জিত নয়। যেমন তাঁর শীতের মাঠ গল্প পড়ে মনে হবে বিষণœ মৃত্যু ভয় তাড়িত স্বামীর প্রেম শুদ্ধতায় উত্তীর্ণ। তিনি যে শুধু বিষণœতার অনুষঙ্গে গল্প লেখেননি তার উদাহরণ ‘সুখ’ গল্পটি। তাঁর লিখেছেন বাস্তবতা অভিজ্ঞতার আলোকে। গত শতকের ষাট শতকের পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে যে অস্থিরতা দেখা দেয় তার ছাপ আমরা লক্ষ্য করি তাঁর লেখা ‘নিগ্রহ’ ও ‘সে’ গল্পে। নব্বই দশকে প্রকাশিত ‘উপাখ্যানমালা গল্প সংকলনে পাঁচটি গল্প ‘সত্যকাম’, ‘কাম কামিনী’, ‘ফুটেছে কমল কলি’, ‘নদীজলে ধরা ছোঁয়ার খেলা।’ উপাখ্যান। বিমল কর নব্বই দশকে লেখা গল্পগুলোতে নতুনমাত্রা যোগ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ পর্বের গল্পগুলোতে লৌকিক অনুষঙ্গের বাতাবরণ সৃষ্টি করলেও আধুনিক মন কিংবা মানসিকতার পরিচয় উপস্থাপন করেছেন। এখানে ‘ফুটেছে কমল কলি’ গল্পের কিছু কথা তুলে ধরা যেতে পারে। বিমাতার মেয়ে কনক খুব ভালবাসে নীলকমলকে, সে তা বুঝতেই দেয়নি নীলমণিকে। সংস্কারই তাকে বোধশক্তিকে প্রতিহত করেছে। দোলের উৎসবের দিন বিমাতা ইন্দু নীলমণিকে বলে বসে, ‘ওই মেয়ের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক নেই, ওর বাবা তোমার বাবা নয়।’

বিমল কর এ গল্পে ভালবাসার অনুষঙ্গ কত গভীর মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন তা দেখতে গেলে এ গল্পের পরবর্তী অংশ উদ্ধৃত করতে ‘নীলমণি নানা ভাবে এর মাঝেই চেষ্টা করেছে কনককে বিয়ে দেবার। কিন্তু কনকের বিয়ে হয়নি। দোল পূর্ণিমার উৎসবে চলে যায়। এক বন্ধু ইন্দ্র নীলমণির চোখ খুলে দেয়। চশমা পরা থাকলে দেখা যায় না এমন একটা ইঙ্গিত দিলে নীলমণি বলে, “চশমা তো আমি পরি না।, ইন্দরদা।” ইন্দরদা বলে, “ওটা ঘসা কাঁচের চশমা। তোমার চোখ দুটো ওই রকম ছিল। অন্ধ তুমি। কাছের জিনিস দেখার চোখ তোমার ছিল না।” ইন্দ্র নীলমণিকে বুঝিয়ে দেয় “দেখ তারা সমুদ্রমন্থন করে অমৃত তুলতে চেয়েছিলেন। ভালবাসাও যে মন্থন করে তুলতে হয়গো।” আগের ভালবাসার স্বরূপটি ধরে দিতে চেয়েছিল সে নীলমণির মধ্যে: “ভালবাসার তত্ত¡টি দেহ থেকে আসে। মুশকিলটা কোথায় হয় জান? ভালবাসা যখন দেহ ছাড়া আর কিছু দেখে না- তখন সেটি কাঁচা ভলোবাসা।” ইন্দ্রের মুখ দিয়ে লেখক যে কথাটি বলেছেন তার মাঝে একটা দুর্লভ অনুভব লুকিয়ে আছে তা পাঠকের বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। বিমল কর অন্যধারার গল্প ও লিখেছেন সে প্রসঙ্গের আগে তার উপন্যাসের ওপর স্বল্পপরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে তিনি ছোটগল্প লেখার মাঝ দিয়ে এক সময় নতুন মাত্রার উপন্যাস লিখে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নিজের পারঙ্গমতার পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়। তার লেখা উপন্যাসগুলোর নাম এখানে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি। ‘অপরাহ্ন’, ‘যদুবংশ’, ‘দেওয়াল’ (১৯৫৬), ‘সান্নিধ্য’ (১৯৭৩) প্রচ্ছন্ন (১৯৭৭) ‘নিমফুলের গন্ধ’ (১৯৮৬) ‘খোয়াই’, ‘অসময়’ (১৯৭৩), ‘শমীক’ (১৯৯৫) ‘ত্রিপদী’, ‘নতুন তারা’ (১৯৮৯) ‘এক অভিনেতার মৃত্যু’ (১৯৯২) ‘ভুবনেশ্বরী’, ‘খড়কুটি’, ‘পূর্ণ’, ‘অপূর্ণ’ ইত্যাদি। বিমল কর এর উপন্যাস ‘অসময়’ ১৯৭৫ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার লাভ করে। তাঁর লেখা উপন্যাস গুলোর মধ্যে দেওয়াল ও অসময় বাদ দিলে ছোট উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি। তিনি ছোট উপন্যাস লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন তা তিনি নিজেই বলেছেন, “বেশির ভাগ উপন্যাস ঝযড়ৎঃ ঘড়াবষ-এর অর্ন্তভুক্ত। আসলে আমি সে ধরনের উপন্যাস লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যা বিশেষ একটা ধারণাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। আর এগুলো আকারে ছোট হলেও অনেকক্ষেত্র বিষয়গত ভাবে খানিকটা জটিল।”

0 comments: