0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৫.২

মোটা লোকটা ফিরে এসেছে। এসেই সিং সাহেবের হাতে পঁচিশ টাকা গুঁজে দিয়েছে। সব এক টাকার নোট। সায়েব নিজের বক্তিমে থামিয়ে পুরো টাকা একটা একটা করে গুণে দেখলেন। একটা ময়লামতন নোট বদলে নিলেন। তারপর টাকা পয়সা ভেতরের ফতুয়ার পকেটে হালকা হাতে গুঁজলেন।

রঙ্গনাথ এতক্ষণ ওনাকেই দেখছিল। উনি বললেন,” দেখছ তো অবস্থা! আগে লোকে যেই টের পেত হাকিম ঘুষ নিচ্ছে , অমনি হাজার লোক জুটে যেত, ওনাকে ঘিরে দাঁড়াত, টাকাপয়সা দিত, আবার কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলত না। এখন কেউ ধারে কাছে আসে না। যদি কেউ আসেও, সে এই রূপ্পনবাবুর মত কাউকে ধরে আনে। দয়াদাক্ষিণ্যে মামলা বিগড়ে যায়”। তারপর উনি রূপ্পনকে বোঝাতে লাগলেন।

--“ দীনানাথ তহসীলদারের সঙ্গে কী হয়েছিল? জানেন কিছু? কখনও বৈদ্যজীর থেকে জেনে নেবেন। চারটে মাস আপনাদের শিবপালগঞ্জে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। কেউ একটা কানাকড়িও ঠেকায়নি। তখন একদিন এজলাসে বসেই গরম হয়ে উঠলেন। দু-চারজন উকিল সামনে দাঁড়িয়েছিল। তাদের শুধোলেন—ব্যাপারটা কী? পাবলিক কী ভেবেছে আমি টাকায় হাত লাগাই না? বেশ, তাহলে আপনারা পুরো তহসীলের এমাথা থেকে ওমাথায় ঘোষণা করে দিন –হ্যাঁ, আমি ঘুষ নিই, কেউ যেন ধোঁকা না খায়!

“ এটাও লোকে ঠাট্টা ধরে নিল। ওনার মুখের ভাবই এমন যে সবার মনে হয়ত—সাচ্চা আদমী। কেউ বুঝতেই পারেনি যে উনিও ঘুষ চাইছেন। পরে যখন বড় বড় লোকেরা বলতে লাগল, এবং স্বয়ং বৈদ্যজী দু-চার জায়গায় বলে দিলেন তখন সবার বিশ্বাস হল। লোকজন সুপারিশের জন্যে তদবির করা ছেড়ে নোট হাতে ওনার কাছে গেল।

“ এবার আপনিই বলুন রূপ্পনবাবু, এভাবে কখনও বড় পুঁজি গড়ে ওঠে? যা চলছে, তাতে ডাল-ভাতের জোগাড় হলেই যথেষ্ট ।

ঘুষ নেওয়াও এখন বড় বেইজ্জতি! ওতে কিছু বাঁচে না। যে নেয় আর যে নেয় না –সবাই সমান। সবার অবস্থা খারাপ”।

ওনার লেকচারের স্রোত পাশের দোকানের হাঙ্গামার চোটে বন্ধ হল। কেউ চেঁচাচ্ছে—‘চলছে! চলছে’। এর মানে লাঠিবাজি শুরু হয়েছে।

“কী হয়েছে? কী হয়েছে?” বলতে বলতে বেশ কিছু লোক দোকানের উপর হামলে পড়ল। একজনের ভাব দেখে মনে হবে যে সারা সমস্যার জড় সন্দেশের থালাতে। ও খামচে এক মুঠো সন্দেশ তুলে নিয়ে চেঁচাল—কী হয়েছে? খানিকক্ষণ এভাবেই নানা লোকে সমস্যার শেকড় খুঁজতে লাগল। কারো মনে হল সমস্যা লাড্ডুর থালায় লুকিয়ে আছে, কারও বাতাসার থালায়। ভা্রি গোলমাল আর চেঁচামেচি!

আচমকা রুল দুলিয়ে দু-তিনজন পুলিশের সেপাইয়ের আবির্ভাব। রুল নির্বিচারে দমাদ্দম লোকের পিঠে পড়তে লাগল। খানিকক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি কাবু হল। ভীড় ছত্রভঙ্গ। যার দোকানে এত হাঙ্গামা সেই দোকানদার রুলের বাড়ি খেয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে পিঠ ডলছে। একপাশে ছোটে পালোয়ান, শনিচর এবং জোগনাথ দাঁড়িয়ে। রূপ্পন ও রঙ্গনাথ এবার ওদের সঙ্গী হলেন, -স্টেজ তৈরৈক

জনৈক সিপাহী উবাচ—বোল বে, কী হয়েছে? আরে এমন করে পিঠ ডলছিস যেন কেউ অ্যাটম বোম মেরেছে!

দোকানদার ফোঁপানো বন্ধ করে জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলল—যা হবার হয়েছে, এ’নিয়ে কোন কথা বলতে চাইনা।

ছোটে পালোয়ান নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ কনুইয়ের ময়লা খুঁটছিল। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল—কোন ব্যাটা এভাবে গঞ্জহাদের ঠকাতে পারবে না। আমার টাকার বাকি হিসেব এখনও হয়নি।

এবার ময়দানে নামলেন রূপ্পনবাবু। এক ঝটকায় সামনে এসে পড়া লম্বাচুল মাথার পেছনে করে পুলিশের সেপাইদের উপর লেখাপড়া জানা মানুষের রোয়াব দেখিয়ে বললেন—“এই পালোয়ান আমার সঙ্গের। আমাদের অনাথ ভেবে যা ইচ্ছে তাই করার ভুল করো না। কথাবার্তা কায়দা মেনে হবে তো আমি পুরো সাহায্য করব। বাঁকাচোরা চলন দখলে কালই আমার কলেজের সাতশো স্টুডেন্ট ময়দানে নামিয়ে দেব”।

একজন সেপাই বলল—ভাইসাব, এখনই আপনার কথাবলার দরকার নেই। আপনাকে আমরা চিনি। যা হবে, ঠিকই হবে।

তারপর দোকানদারের দিকে ঘুরে বলল—তোমার বয়ান কী, বলে ফেল।

দোকানদার সতর্ক হয়ে বলল—বয়ান? এখন বয়ান-টয়ান দিতে পারবনা।ওসব দেব আমার উকিলের সামনে।

সেপাই ধমকে উঠল—আবে, তোর বয়ান কে লিখছে! কী ঘটেছে সেটা বল!

ও বলল—‘ধর্মাবতার! হল কি এই পালোয়ান এসে প্রথমে পেছনের ওই মোড়াটায় বসল। দুটো দোনা পালং পাকোড়া খেল, তারপর আরও দুই দোনা মুখিকচুর বড়া খেল। মুখির দ্বিতীয় দোনা খাচ্ছিল তখনই এদিকের ওই দু’জন গঞ্জহা এসে হাজির’। ও একবার টেরিয়ে টেরিয়ে শনিচর ও জোগনাথের দিকে তাকাল, তারপর ফের বলতে শুরু করল—‘এরা আধ- আধপোয়া বরফি চাইল, সেটা ওদের দেওয়া হল’।

সেপাই ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল—কী, এ’পর্যন্ত সব ঠিক তো?

ছোটে গালি দেয়ার ভঙ্গীতে বলল-হ্যাঁ, ঠিক।

-“এরপর ওই দুই গঞ্জহা বরফি সাঁটিয়ে হাঁটা দিল। আমি বলতে লাগলাম যে আট আনা হয়েছে। তো ওরা উলটে আমাকে ধমকাল—আট আনা দাম তো আগেই দেয়া হয়েছে, কতবার নেবে? দেখুন, এখানে আমি কম সে কম একশ’ লোককে খাবার দিই, কখনও ভুল হয়? আমি বারবার আট আনা চাইতে থাকি, তো ওদের এক কথা—আগেই দিয়েছি। শেষে যখন কড়া হয়ে বললাম তো আমাকে গালি দিতে ---“।

ওর কথার মাঝখানে শনিচর বলল—“যা সত্যি সেটাই বল হে লালা চিরঞ্জীমল! তুমি বললে আমরা আট আনার বরফি খেয়েছি, তো আমরা বললাম-হ্যাঁ, খেয়েছি তো। তুমি বললে আমরা পয়সা দিইনি, তো আমরা বললাম -না, দিয়েছি তো”।

রঙ্গনাথ ওর মাঝখানে বলল—তো ঝগড়া কিসের? দোকানদার পয়সা পায় নি? পেয়ে যাবে।

শনিচর বলল-“ দাদার যে কথা! এ’ভাবে সবসময় দু’দুবার করে পয়সা চুকোতে চারদিনের মাথায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হবে”।

দোকানদার বলল—“আসল ঝগড়া তো আট আনার নয়, ওদিকে ছোট পালোয়ানকে নিয়ে। এদিকে যখন দুটো গঞ্জহা আট আনা দেয়া নিয়ে খিচ খিচ শুরু করে যাচ্ছে , ওদিক থেকে পালোয়ান বলে উঠল—ভাই, এদের আট আনার ঝগড়ায় আমি যে একটাকার নোট দিয়েছি তার বাকি পয়সা ফেরত দিতে ভুলে যেও না। এখন দেবার বেলা তিনি এখনও কানাকড়ি ঠেকান নি, অথচ একটাকার বাকি খুচরো চাইছেন! কী যে দিনকাল পড়েছে”!

পালোয়ানের কোন হেলদোল নেই, আগের মতই শরীরের ময়লা খুঁটতে ব্যস্ত।

সেপাই বলল—তুমি কী বল পালোয়ান?

ছোটে উবাচ—আমি আর কী বলব? বেশি বকবক করতে পারি না। আমি আট আনার খেয়েছি, বাকি আট আনা ফেরত পেলেই হল, ব্যস্‌। বাকি কোন কিছুতে আমার মাথাব্যথা নেই”।

অনেকক্ষণ এ’নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে লাগল। ভীড়ের মধ্যে নানারকম মন্তব্য ভেসে বেড়ায় যার তাৎপর্যঃ এই মেলাতে প্রতিবার এমন ঝগড়া হয়। ঝগড়া কারা শুরু করে? ব্যস্‌ এই গঞ্জহার দল—যত লুচ্চা লফংগা এসে জুটেছে! কিন্তু এদের সাথে লাগতে যাবে কে? যা মুখ! তবে সত্যি বলতে কি সব গাঁয়ের একই হাল। আজকালকার ছেলেছোকরারা সব----।

কিন্তু কাকে কত দিতে হবে সেটার সমাধান এখনো হল না। শেষে এক সেপাই বের করল এক সরল সমাধান। সেটা এইঃ দু’পক্ষই ছাড় দিক। পালোয়ান যদি টাকা দিয়ে থাকে তো বাকি আট আনা ছেড়ে দিক। আর দোকানদার যদি খাবারের দাম না পেয়ে থাকে তো দামটা ভুলে যাক। তাহলে কাউকেই কিছু দিতে-টিতে হবে না-ব্যস্‌।

এই রায় শুনে যুযুধান দুই পক্ষই বড় অসন্তুষ্ট; ভারি শোরগোল। শেষে এই ফয়সালা দুই দলই মেনে নিল। এবার যেদিকে শরাবের দোকান ওখানে কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া শুরু হল। সেপাইয়ের দল সেদিকেই গেল। ভীড় এবার ফাঁকা ।

অকস্মাৎ রঙ্গনাথ রুক্ষ স্বরে বললেন—আমি কি জানতাম যে আমার সঙ্গীরা সব লুঠেরা! কেমন লোক এরা?

রূপ্পনবাবু আশ্চর্য হয়ে দাদার মুখে চাইলেন—কোন লোক? ওই ব্যাটা দোকানদার? আরে ও তো জন্ম থেকেই লুঠেরা।

রঙ্গনাথের মুখ উত্তপ্ত হল। ও দোকানদারের কাছে গিয়ে পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বললে –“তিন জন মিঠাই-পাকোড়া যা যা খেয়েছে সবের দাম এর থেকে কেটে নাও। যা হয়েছে--- সেসব ভুলে যাও”।

এই বলে সে নিজের রাগী মুখ করে সাথীদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রূপ্পন মুখ বেঁকালো, যার মানে—যত বোকামি সব কি আজকের জন্যেই তুলে রেখেছিলে?

ছোটে নীচু স্বরে বলল-এনাকেও নিজের দম দেখাতে দাও। লেখাপড়া জানা আদমী। এ মে পাস। কে ওনার সামনে মুখ নাড়াবে?

এই কথা বলে পালোয়ান অন্যদিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন যা ঘটে গেছে তার সঙ্গে ওর কোন সম্বন্ধ নেই। আর ঘটনা বলতে একজন এ মে পাশ মানুষ কীরকম বেকুব হতে পারে!

কিন্তু রূপ্পন বাধা দিল। -“ ফয়সলা তো হয়ে গেছে রঙ্গনাথ দাদা। এখন তোমার কথা বলার হক নেই। যা করার পুলিশের সামনে করতে, তাহলে কোন মানে হত”। রঙ্গনাথ পাঁচ টাকার নোটটা দোকানদারের সামনে ফেলে দিয়েছিল। এসব কথায় কান না দিয়ে ওকে বলল তাড়াতাড়ি করে বাকি পয়সা ফেরত দিতে। দোকানদার চারদিকে একবার তাকাল। তারপর পাঁচটাকার নোট ফেরত দিয়ে বলল—তুমি বাইরের লোক, বাবুজী। আমাকে তো এখানেই করে খেতে হবে।

গঞ্জহাদের দল ভেঙে এখন তিনটে ভাগ হল। জোগনাথ গেল মদের দোকানের দিকে, শনিচর আর ছোটে গেল মেলার অন্যদিকে চেনাজানা দু’চারজন ভাঙ ঘুটছে। রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু একসঙ্গে ফিরছে। রঙ্গনাথ গম্ভীর, একটু ক্লান্ত। শেষে একটা কুয়োর বাঁধানো পাড়ে আরাম করতে বসে পড়ল। রূপ্পনবাবু ওখানেই দাঁড়িয়ে একটু দূরের তিতিরের লড়াই মন দিয়ে দেখতে লাগল।

কুয়োর থেকে একটু দূরে একটা ভাঙাচোরা পড়ো বাড়ি। ওখানে থামের পাশে একটি মেয়ে বসেছিল—গমের মত গায়ের রঙ, নবযুবতী। জমকালো রঙের শাড়ি, নাকে সোনার নথ। মেলার নোংরামিতে তিতিবিরক্ত রঙ্গনাথের চোখে এই দৃশ্য বড় মনোরম লাগল। তাই ও দিকেই তাকিয়ে রইল।

নোংরা লুঙি এবং চকমকে নকল সিল্কের সাফসুতরো পাঞ্জাবি পরা একটা লোক মেয়েটার একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল। একটি কানের লতিতে চূণের ফোঁটা, মাথার চুল তেলে জবজবে। ধীরে ধীরে ও মেয়েটার কাছে গেল। তারপর ওর সঙ্গে প্রায় একগজের দূরত্ব রেখে বসে পড়ল। ও কিছু বলল, তাতে মেয়েটি মুচকি হাসল।

রঙ্গনাথের বেশ লাগছিল। চাইছিল- মেয়েটি ওর দিকেও তাকিয়ে দেখুক। মেয়েটি ওকেও দেখল। চাইছিল-- মেয়েটি অমনই করে আর একবার মুচকি হাসুক, মেয়েটি হাসল। তেল-জবজবে লোকটা ফের একটা বিড়ি ধরাল।

একটা লোক রঙ্গনাথের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে ধুতি-কুর্তা আর টুপি। গেঁয়ো হিসেবে একটু পরিপক্ক দায়িত্বশীল ভাবভঙ্গী। রঙ্গনাথ ওর দিকে একবার তাকিয়ে ফের মেয়েটিকে দেখতে লাগল। মেয়েটির হাসি বন্ধ, ওর মুখে এমন একটা করুণভাব, যেন হিন্দি সিনেমার নায়িকা এক্ষুণি কোন গজল গাইবে।

লোকটি মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল—আপনি কি এদিকেই থাকেন?

রঙ্গনাথ মাথা নাড়ল।

লোকটি রঙ্গনাথের পাশে আরাম করে বসে পড়ল। বলল,” এই দেহাতিগুলোর কোন রুচি নেই। খালি ফরমাইশ করে—অমুক সিনেমার গান শোনাও, তমুক গানটা শোনাও!”

রঙ্গনাথ আগ্রহের সঙ্গে ওর কথা শুনতে থাকে, ব্যাপারটা কি -ধরতে পারে না। লোকটা বলতে থাকে—“ তারচেয়ে ওর তিলানা শুনুন, দাদরা শুনুন, চাই কি ঠুংরি! একেবারে প্রাণ দিয়ে গায়”। লোকটি ভাবুক হয়ে স্বপ্নমাখা চোখে রোমান্টিক ঢঙে বলল-“রোহুপুর গেছল, এখন বেজেগাঁও যাচ্ছে”।

শহরে এক সংগীতের জলসায় রঙ্গনাথ পণ্ডিত রবিশংকরের সম্বন্ধে এই ধরণের কথাবার্তা শুনেছিল। অ্যানাউন্সার মাইকে বলছিল—‘পণ্ডিতজি এডিনবরা থেকে এখনই ফিরেছেন, এবার শীত পড়লে নিউ ইয়র্ক যাবেন’।

ও মাথা কাত করে লোকটাকে সমর্থন করল। এতক্ষণে কথার আগা-মাথা বুঝতে পেরেছে। লোকটি একটু থেমে ফের বলতে লাগল—“এঁর বিদ্যে পথচলতিদের জন্য নয়। বৈঠকে আসুন, বসে শুনুন, তখন নিজেই বুঝতে পারবেন কোনটা আসল আর কোনটা নকল”।

রঙ্গনাথের নজর সামনের দিকে। তেল-জবজবে লোকটা এখন মেয়েটির পাশে সেঁটে বসেছে। দুজনে কথা বলছে, হাসিঠাট্টা করছে, আর মাঝে মাঝে রঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে দেখছে। এতক্ষণে বুঝতে পারল যে এই লোকগুলো ওকে নিয়ে আশায় আশায় রয়েছে,-- অনেক বড় বড় আশা!

ওর পাশে বসে থাকা ধুতি-কুর্তা পরা লোকটিকে দেখলে দূর থেকে মনে হবে ওরা দুজন সিরিয়াস; দেশের বড় বড় সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন। লোকটা ভুরু কুঁচকে বলছিল— “নতুন আইন এসে সব বরবাদ করে দিয়েছে। বড় বড় ধনীর দুলাল সঙ্গীত শোনার আকাঙ্খায় ছটপট করছিল। তবে এখন তো থানাদার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। বৈঠকে গান-বাজনা ফের শুরু হয়েছে”।

রঙ্গনাথ উঠে পড়ল। লোকটাও উঠে দাঁড়াল। “আমিও এর উপর দশবছর জান লড়িয়েছি। ময়ূরের মত গলা পেয়েছে। এখন রেয়াজ করে একশ’ জনের মধ্যে সেরা”।

রঙ্গনাথ রূপ্পনবাবুর দিকে তাকাল। ও তখন তিতিরের লড়াই দেখতে দেখতে একটু দূরে সরে গেছল। রঙ্গনাথ ডাক পাড়ল—রূপ্পন!

লোকটা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল,” মেয়েটি আমাদেরই ধর্মের—হিন্দু। বড্ড সরল আর সাদাসিধে”।

ফির মুখ বেঁকিয়ে গর্বের সঙ্গে বলল,” খালি গান গায়, গুণীজনের মধ্যে। পেশা করে না।“

রঙ্গনাথ জবাবে বল—খুব ভাল। গায়িকা পেশায় নামলে গান নষ্ট হয়। সঙ্গীতও এক সাধনা। ব্যস, ওকে এই পথেই এগিয়ে যেতে দিন”।

লোকটা থতমত খেয়ে বলল, “আপনি তো দেখছি সবই জানেন, আপনাকে আর কী বলব। একদিন আসুন আমাদের বৈঠকে---“। রূপ্পনবাবুকে দেখে ওর কথা আটকে গেল। ও পেছন দিক দিয়ে হঠাৎ হাজির হয়েছে। কড়া স্বরে রূপ্পন বলল—“ বৈঠকে আসব তো বটেই। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলছ হে? নিজের বাপকে চিনতে ভুল? দেখে কথা বল”।

লোকটার চেহরা বদলে গেছে। হাত জোড় করে লম্পটের ভঙ্গিতে হেসে বলল—“মালিক, আমার বাপ তো টাকা”!

রঙ্গনাথ হাসল। চোখে পড়ল মেয়েটির হাসি এখন আরও চওড়া হয়েছে।


ওরা অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে, চুপচাপ। শেষে রূপ্পন বাবু মুখ খুলল, “ও’ব্যাটা কী বলছিল? মেয়েটা এখনও পেশায় নামেনি”?

রঙ্গনাথ নিরুত্তর।

“চারদিকে জালিয়াতি। এই শালী রেণ্ডিটাকে ছোটবেলা থেকে দেখছি”। রূপ্পন এবার বয়স্ক কর্তাব্যক্তির মত বলা শুরু করল,” অনেক বছর হল নাকে নথ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ইনি ওর ঠুমরি-দাদরার নাগাড়া বাজাতে থাকেন। মোষের মত গলার স্বর, ও নাকি গানেরওস্তাদ! আমাদের এলাকার ওই হল সবচেয়ে পচাগলা বেশ্যা। কেউ ওকে এক পয়সাও পোঁছে না”।

রঙ্গনাথ এবার সত্যিই দেহে-মনে ক্লান্ত। রূপ্পন ছাড়ে না। “ আমি সময়মত নাএলে ওচুপ করতনা। তোমাকে তো প্রায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিল”।

রূপ্পন একনাগাড়ে নিজের ঝোঁকে বলে যাচ্ছিল। আচমকা রঙ্গনাথ প্রশ্ন করল,”রূপ্পন, তুমি বেলাকে কেন প্রেমপত্র লিখেছ”?

এইকথায় রূপ্পনবাবুর কথকতা হোঁচট খেল। কিন্তু উনি সামলে নিয়ে বললেন—দাদা, এতদিন শহরে থেকেছ, তবু বোঝনা কেন -কেউ- কাউকে- প্রেমপত্র লেখে”?

রঙ্গনাথের মুখে কোন জুতসই উত্তর জুটল না। ও শুধু বলল,”মামাবাবু খুব রাগ করছিলেন”।

রূপ্পনের চেহারা কঠিন। মেজাজ দেখিয়ে বলল,”ওনার কিসের রাগ! ওনাকে বল, সিধে আমার সঙ্গে কথা বলতে। তবে শোন, ওনার বিয়ে হয়েছিল চোদ্দ বছর বয়েসে। প্রথম মা মারা যেতেই ঊনই সতের বছর বয়সে ফের বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। একটা বছরও একা থাকতে পারলেন না?

“সে না হয় নিয়ম-কায়দা মেনে হয়েছিল। আর বেনিয়মে কায়দা-কানুনের বাইরে কী কী করেছিলেন শুনতে চাও—“?

রঙ্গনাথ, “না, শুনতে চাইনে”।

(চলবে)

0 comments: