0

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in








হাসান আজিজুল হকের লেখা যত পড়ি, বিস্মিত ও শ্রদ্ধাবনত হই, কি বিশাল মাপের লেখক তিনি! নিঃসন্দেহে হাসান আজিজুল হক বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য একজন ধীমান পুরুষ। তাঁর হাতে বাংলা গদ্যসাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। বড়ো দুঃখের কথা, নভেম্বর-২০২১এ, তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে প্রয়াণের পথে চলে গেলেন!
তার সম্পর্কে প্রাবন্ধিক, গবেষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, হাসান আজিজুল হক যে-কোনো মানদন্ডে একজন বড় গল্পকার। ...তাঁর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। সে-দৃষ্টি শাণিত হয়েছিল তাঁর বামপন্থী বোধের দ্বারা।
হাসান আজিজুল হকের চোখের সামনে লক্ষ কোটি মানুষ দেশান্তরিত ও উদ্বাস্তু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি ঘটেছে। সর্বস্ব গিয়েছে। অর্থ সম্পদ, সহায় সম্পদ চিরকালের জন্য বিনষ্ট হয়েছে, মানুষেরা নিজের আকাশ মাটি জমি থেকে উৎখাত হয়েছে, এক একটা সম্প্রদায় ভয়ানক সংকটের সন্মুখীন হয়েছে। এই ব্যাপারটা আজীবন তার বিবেককে খন্ড খন্ড করেছে, দগ্ধ করেছে! এই দেশভাগের কারণে মানুষের মর্যাদা গেছে, ইজ্জত গেছে, মানুষ হিসেবে তাদের নিম্নতম স্বীকৃতিও জোটেনি। মনে মনে এই কষ্টকর বিশ্বাসটুকু হাসান আজিজুল হককে ধারণ করে রাখতে হয়েছে, দেশভাগের একটা বিশাল মানবিক বিপর্যয় তার মনে গভীর ক্ষত তৈরী করেছে, সেটা আজীবন আরোগ্যহীন। তার লেখাতেও বার বার প্রতিফলিত হয়েছে দেশের এই দ্বিধাভক্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশের কষ্টকর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি!
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত এপার বাংলায়, বর্তমান ভারত/পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা নিজের গ্রামেই করেছেন। তিনি ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপরে সপরিবারে তাদেরকে খুলনায় উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসতে হয়। ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং এখান থেকেই দর্শণ শাস্ত্রে অনার্স গ্রাজুয়েট হন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ, ব্রজলাল কলেজ - এরকম কয়েকটি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। এর পরে তিনি, ১৯৭৩ থেকে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। ২০০৪ সালে সেখান থেকেই তিনি সুনামের সাথে অবসর নেন।
তার প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪)। এর পরে ধীরে ধীরে তার সমস্ত বইগুলো প্রকাশিত হতে থাকে – আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), লালঘোড়া আমি ( কিশোর উপন্যাস / ১৯৮৪), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), বৃত্তায়ন (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার(১৯৯৭), ছোটদের জন্যে লেখা ‘ফুটবল থেকে সাবধান’ (১৯৯৮)।
হাসান আজিজুল হকের হাতে আমাদের গদ্য সাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। গদ্যের জন্যে যাঁরা ভাষা নির্মাণ করেছেন তিনি তাঁদের পুরোধা। শকুন, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, মারী, আমৃত্যু আজীবন, তৃষ্ণা, উত্তর বসন্তে, পরবাসী, শোণিত সেতু, জীবন ঘষে আগুন, জননী, ঘর ঘেরস্থি, খনন-এর মতো অসংখ্য গল্পে এই সত্য উদ্ভাসিত।
আগেই বলেছি, তার ‘শকুন’ গল্পটি সে সময়ে পাঠকমহলে প্রচুর সাড়া ফেলে। কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুনকেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রিযাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পুরো গল্পটা। একদল কিশোরের জীবন আর ভাগাড়ের মুমুর্ষু একটা শকুনের শেষকালীন সময় একই ফ্রেমে আঁটা হয়, প্রশ্ন আসে মানুষের জীবনটা কি তা’হলে এমনি শকুনেরই মতো? এই গল্পে আবার শকুনকে চিহ্নিত করা হয় সুদখোর মহাজনের প্রতিরূপ হিসেবে। এ ভাবেই মুমুর্ষু শকুনটার প্রতি কিশোরদের নিষ্ঠুর অত্যাচারটা একটা সামাজিক প্রতিশোধ, মহাজনদের বিরুদ্ধে জনতাদের একটা নির্দয় আচরণ হিসেবে এই গল্পে উঠে আসে। ‘শকুন’ গল্পটিতে ঈঙ্গিত দেয়া হয় রাতের আঁধারে নরনারীরা অবৈধ ভাবে মিলিত হচ্ছে, তার পরিণামে জন্ম নিচ্ছে বেওয়ারিস সন্তান। শকুনের মৃত দেহের পাশে, এই গল্পে আমরা দেখি পরিত্যক্ত একটি ফুটফুটে নবজাতক শিশুকে, যাকে ঠুকরে খাবার জন্যে আকাশ থেকে নেমে আসছে জীবন্ত শকুনের দল! গ্রামীন জীবনের পটভূমিকায় এভাবেই ‘শকুন’টি হয়ে ওঠে সাড়া জাগানো, একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গল্প!
হাসান আজিজুল হকের আরেকটি গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক। এই গল্পটিতে দেখি তিনজন উদভ্রান্ত বখে যাওয়া যুবক রাতের অন্ধকারে বেরিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে তারা হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের প্রত্যন্তে। তারা এসে পৌঁছায় একজন অসুস্থ বুড়োর দাওয়ায়। তাদের দীনহীন কুঠিরের আঙ্গিনায় লাগানো আছে একটা করবী গাছ। বখে যাওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন যুবকের পকেটে আছে চুরি করে আনা টাকা - মাত্র দুটো করে টাকা। সেই টাকা বুড়ো বাপটাকে দিয়ে ওরা দুজনে রুকুর শরীর ভোগ করবে। এই রুকুই অসুস্থ বুড়ো বাপের মেয়ে, একমাত্র অবলম্বন। কত নিরুপায় হলে বাপ চোখের সামনে নিজের মেয়েকে অন্য ছোকরাদের সাথে শুতে পাঠায় তা বোঝা যাবে গল্পের পরিণতিতে। বুড়ো বাপটা বলছে – ‘এখানে যখন এলাম ... আমি একটা করবী গাছ লাগাই, বুঝলে? ... বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ বিষকে খুঁজে নেয়ার তাড়নায় বুড়োর অসহায় উদ্বাস্তু জীবনের কান্নাগুলো যখন হু হু করে বেরিয়ে আসে – ঠিক তখনই কুঠিরের ভেতরের ঘরে তার মেয়ে রুকুর শরীর বিক্রি হচ্ছে দুদুটো বখাটে ছিন্নমূল যুবকের কাছে – মাত্র দু দু টাকার বিনিময়ে!
তার লেখা বিভিন্ন গল্পের বিশ্লেষণের নিরিখে, আমাদের এপার বাংলার পরিচিত গল্পকার সাধন চট্টোপাধ্যায়ের কিছু মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের কথাকার হাসান আজিজুল হকের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন – “লেখকের আখ্যান নির্মাণের টেকনিক্‌টি সরল ভঙ্গির। কোনো জটিলতা বা মারপ্যাঁচ নেই। অথচ, শব্দ নির্মাণে, বলবার ভঙ্গিতে, বিমূর্তকে বিশেষণ যোগে আকৃতি দিতে এবং অদ্ভুত নৈর্ব্যক্তিকতায় পাঠকের হৃদয় ও বুদ্ধিকে আমূল শলাকাবিদ্ধ করতে, হাসানদার জুড়ি মেলা ভার। ঘটনায় তেমন সাসপেন্স নেই, রগরগে যৌনতাকে লেখক আখ্যানে আহ্বান জানান না ...... - তবুও আখ্যানের চোরাটানে সর্বক্ষণ পাঠককে কৌতুহলে টানটান থাকতে হয়। এটা আমি তার প্রথম পর্বের গল্প ‘শকুন’ থেকেই লক্ষ্য করেছি।
দ্বিতীয়ত, তার গল্পে প্রকৃত অর্থে কোনো ‘গল্প’ বা জমজমাট ঘটনা নেই, যা পাঠক পড়ে অন্যকে শোনাতে পারে। যদি শোনাতে চায় – একটি বা দুটি বাক্যে শেষ হয়ে যাবে।” [শুভশ্রী, বাংলাদেশের গল্প/গল্পকার সংখ্যা – ২০১৭-১৮ সাল।]

তার ‘আগুনপাখি’(২০০৬)উপন্যাসটি খুবই বিখ্যাত, এতে তার শৈশবের গ্রাম, পরিবার আর তার মায়ের কথা তিনি তুলে এনেছেন। এই হৃদয়গ্রাহী বইটা পড়লে বোঝা যাবে, তিনি ও তার পরিবার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা দেশের বিভাজন কোনো মতেই মেনে নিতে পারেন নি। ‘আগুনপাখি’র পর তার অন্য প্রকাশিত উপন্যাসগুলো – শিউলি (২০০৬), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩)।
হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী মূলক লেখা ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ (২০০৯) ও ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২০১১)।
কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। এর মধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার, ইত্যাদি আরো অনেক। এছাড়া ১৯৯৯ সালে 'একুশে পদক'এ ভূষিত হন হাসান আজিজুল হক। ভারতবর্ষে 'আগুনপাখি' উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার।
হাসান আজিজুল হকের কথা উঠলেই আমার সামনে একটা অগ্নিদগ্ধ পাখির চেহারা ফুটে ওঠে। তার ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে স্তব্ধ হয়ে যাই। এখানে তিনি লিখেছেন স্বাধীনতা-পূর্ব একটি গ্রাম জীবনের চলমান চালচিত্র। ‘আর হুজুগের শ্যাস নাই।..... মাঠে ঘাটে ছেলে-ছোকরারা গাইছে, সারেগামাপাধানি, বোম ফেলেছে জাপানি।...... জাপানিরা বোমা ফেলবে এই হুজুগ ওঠার পর থেকে অ্যাকন আবার লোকে পেরায় সব সোমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।’ [আগুন পাখি / দে’জ পাব্লিশিং / মে ২০০৮ সংস্করণ / পৃষ্ঠা – ১৫৯-১৬০]
যুদ্ধ আর আকাল হাত ধরাধরি করে চলছে। মানুষদের কি দুর্বিসহ অবস্থা। কোনটা আগে? আনহারে মৃত্যুর ভয়, নাকি যুদ্ধের আঘাতে মৃত্যু? আকাশে ঘন ঘন হানা দিচ্ছে বোমারু বিমান। ওদিকে অনাহার, দুমুঠো খাবারের সংস্থান নেই। কোথাও কোথাও যুদ্ধের চাইতেও ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা।
দেশব্যাপী এই আকালের কথা তার উপন্যাসে কতোগুলো করুণ ছবি রেখে গেছে। যেমন - ‘আক্‌লি’ একটি দরিদ্র গ্রামের মেয়ে, তার পরিবারে কেউ নেই। সে তার বুড়ি দাদির সাথে থাকে। ঘরে খাবার নেই। কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছে। ক্ষুধার তাড়নায় এই আক্‌লি বৃষ্টি দিনে, অর্দ্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় অন্যের ঘর থেকে পান্তাভাত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। লেখকের কলমে তার কি নির্মম বর্ণনা! - ‘একবার যেন মনে হলো খিড়কি-পুকুরের কোনের বাড়ি থেকে পানি দিয়ে তৈরি একটো মেয়ে বেড়িয়ে এল। পানির ভেতর দিয়ে ছপ ছপ করে হাঁটছে। ...... আক্‌লিই বটে। বিয়ে হয় নাই, এক বুড়ি দাদি ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই তার। ভেজা জবজবে মোটা একটো চট বুক থেকে পা পর্যন্ত ডান হাত দিয়ে ধরে আছে। খেতে পায় না, তবু এত বড় বড় দুটো বুক ক্যানে যি তার, কি কাজে লাগবে আল্লা জানে! অমন করে চটটো হাত দিয়ে ধরে আছে মেয়েমানুষের শরম বাঁচাইতে কিন্তুক তবু ঢাকা পড়ে নাই ওই পব্বতের মতো বুক। বাঁ হাতে মাটির শানকি ভরা বাসি ভাত, তার আদ্দেক গলা। এক শানকি ভাত। হেঁশেলে ভাতের হাঁড়িতে গত রেতের পানি দেয়া যা ভাত ছিল তা বোধ হয় সবটাই নিয়েছে শানকি ভরে।
আমরা দুজনা মুখোমুখি তাকিয়ে থাকলম। ...... কতক্ষণ বাদে আক্‌লি ফিসফিস করে বললে, তিনদিন তিনরাত কিছুই খাই নাই, দাদি ঘরেই আছে, বোধায় আজ মরতে পারে।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ১৬৮-১৬৯]
ভারত পাকিস্থান দেশ বিভাগের জন্যে কারা দায়ী? কোন মতে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষ, যারা অর্ধ উলঙ্গ, যারা লতা পাতা শামুক গুগলি খেয়ে বেঁচে আছে? সত্যি কথা বলতে কি – এইসব সাধারণ প্রান্তিক মানুষদের কল্পনায় দেশ বিভাগের কথা আসে না! এই দেশ বিভাগের ব্যাপারটা রাজনৈতিক নেতা, বড়ো বড়ো মানুষদের মস্তিষ্কপ্রসূত। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের আক্ষেপটা তার উপন্যাসে বার বার খেদোক্তি হয়ে উঠে আসে – ‘হিঁদু-মোসলমান সম্পক্ককে বিষ বিষ করতে হবে ক্যানে?’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২১৬] কিংবা
‘আর য্যাত লড়ালড়ি, খুনোখুনি হচে তো শুদু হিঁদু-মোসলমান বলে। এক হিঁদু মায়ের পুতকে মারছে একজনা মোসলমান আবার এক মোসলমান মায়ের পুতকে মারছে একজনা হিঁদু। আঃ হায়রে! মানুষ লিকিন বুদ্ধিমান পেরানি।’[ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২১৯]
দেশ বিভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা ভারতে আসছে। তার উল্টোটাও হচ্ছে। আগুনপাখি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে ভারতে বসবাসকারী হাসান আজিজুল হকের নিজের মা-এর কথা উঠে এসেছে। জাতিতে তারা মুসলমান। জাতি দাঙ্গা ও উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পরিবারের সবাই ধীরে ধীরে একে একে নিজেদের আজন্ম লালিত ঘর বাড়ি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্থানের এক নতুন পরিস্থিতি, হয়তো বা কোন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে যাচ্ছে, চলে যেতে হচ্ছে। কিন্ত আগুনপাখি উপন্যাসের সেই একজন ‘মা’ গোঁ ধরে বসে আছে! কেন সে নিজের দেশ ছাড়বে? এই একজন ‘মা’র দুর্দান্ত কথাবার্তা ও উদ্বেগভরা প্রশ্ন হাসান আজিজুল হকের উপন্যাসের মূল মর্ম বস্তু। তারই কিছুটা বইএর পাতা থেকে তুলে দেয়া যাক –
‘একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২৪৯]
‘তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২৫২]
মানবিক বোধে উজ্জীবিত হাসান আজিজুল হক আদপেই কোনো সংকীর্ণ স্বাদেশিক ব্যাক্তিত্ব নন। তার নিজস্ব বামপন্থী বিশ্বাসই তাঁকে আন্তর্জাতিক করেছে। জীবন কেমন তা তিনি দেখেছেন; কেমন হওয়া উচিত ছিল, তা উপলব্ধি করেছেন। এমনি ভাবেই তার ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছিল স্বপ্ন, জন্মেছিল ক্রোধ, জাগছিল পরিহাস-প্রবনতা। তাঁর বিভিন্ন লেখায় আমরা দেখি মার্কসবাদী দার্শনিকতা, যদিও নিজেকে তিনি মার্কসবাদী লেখক হিসেবে কখনো দাবী করেন নি।
অসামান্য লেখক হাসান আজিজুল হককে সামান্য যেটুকু বুঝেছি, এই নিবন্ধটির মধ্যে তারই অল্পস্বল্প কিছু উল্লিখিত হয়েছে। লেখার পরিসমাপ্তিতে একটি সাক্ষাৎকারে নেয়া লেখক হাসান সাহেবের নিম্নোক্ত ভাবনাটুকুর উল্লেখ করতে চাই – ‘ধর্মীয় গোড়ামী ও কুসংস্কার সব কিছুরই অন্তরায়। সবচে’ কঠিন এবং সবচে’ পশ্চাদমুখী গোড়ামী হচ্ছে ধর্মীয় গোড়ামী। এটা মানুষের বৃদ্ধিও বন্ধ করে দেয়। সমাজ সভ্যতার গতিকে স্থবির করে দেয়।’[তথ্যসূত্র – সাক্ষাৎকার : প্রকৃতি ও মানুষের কবি হাসান আজিজুল হক - ইকবাল হাসান / গল্পপাঠ ব্লগ]
পরিশেষে জোর দিয়ে বলতে চাই, আজকের কিছু অসুস্থ মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দিনে হাসান আজিজুল হক ভীষণ ভীষণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক।

0 comments: