0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in





















(২০)

এতক্ষণে শৈলবালার ফোঁপানো গলায় কান্নাটি থেমে গেলেও ওর থমথমে অশ্রুস্নাত মুখটি অতিজাগতিক এক যৌবনার উন্মেষে বেশ অনেকক্ষণ ধরে জেগে আছে দেখে শেষমেশ গোলকপতি আর চুপ করে শুয়ে থাকতে পারলনা।

তাই সে এবারে চুপিচুপি এসে দাঁড়াল তার সামনে। বাইরের অবারিত মসীকৃষ্ণ ঘনায়মান রাত্রি যেন সার্থকভাবে এই রাত্রিশেষের দৃশ্যপটের আবহটিকে নিপুণ হাতে রচনা করে আছে। দূরে কোথাও দু একটি আকুল শিবারব যেন শ্রুতিগোচর হল। ভোর হতে আর বেশী বাকি নেই দেখে গোলকপতি একটু গলা খাঁকরিয়ে বলে উঠল,

" হে দেবী! এবার শয়নের সময় তো ফুরিয়ে আসছে! রাত্রির তৃতীয় প্রহর যে প্রায় সমাপনের পথে!"

গোলকপতির মন্দ্রস্বরের পুরুষকন্ঠটি তার কাছে এই কদিন আগেও অপরিচিত ছিল, তাও সেটি আজ একেবারে অন্যায্য বা অশ্রুত নয়। এবারে শৈলবালার বাদলবিধৌত মুখশ্রীটি একটু যেন বিস্মিত হয়ে উঠল। ঠোঁট চেপে সে অতিদৃঢ় কন্ঠে এবার বলে উঠল,

" আমি কি আপনার কেনা মেয়েমানুষ? শুদুশুদু আমাকে বিরক্ত কচ্চেন কেন! আমার একোন একটুও ঘুম পাচ্ছেনা কো! তাছাড়া আপনি যেটা চান তা আমি এখন কিছুতেই দিতে পারব নে । সেটা তো শুধু আপনাকে বলে নয়! না! না!কাউকেই না! তাও যদি এরপর জোর করতে আসেন তো আমি নিজের গলার নলি কেটে রেকে দেব বলে এইটা সাথে এনে রেকেছি! "

এইটুকু কথা কোনওমতে বলে সে লকলকে ফলা সমেত একটি ছোট খঞ্জর বের করে গোলকপতিকে দেখাল।

....

কি আশ্চর্য! এটা তো গোলকপতির কাছে থাকার জিনিস! তাছাড়া এই মেয়ে সেই অস্ত্রটি হাতে পেল কি করে?

তখন ওর মনে পড়ল যে শৈলবালার গহনাগুলি একটি কাপড়ের থলেতে বেঁধে রাখার সময় অস্ত্রটি ওকে ধরতে দেওয়ার পর গোলকপতির আর ওটি তালেগোলে ফেরত নেওয়া হয়নি।

যদিও এটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত একটি দোষ! তাও গোলকপতি এবার সজোরে হেসে উঠল। সে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠল,

" তোমার সুডৌল হাতে কৃপাণটি বড় বেমানান। তবে সত্বর তোমার হাতে হাতা-খুন্তি ধরানোই আমার অভিপ্রায়! যদিও রণচন্ডী কালিকার আমার আরাধ্যা দেবী।তবে আমি তোমায় মন্দমনে বা বলপূর্বক ভোগ করব ভাবলে সেটা সেদিন ওই আশ-শ্যাওড়ার ঝোপেই করে আসতে পারতাম। তুমি হয়ত ভুলে গেছ যে বিস্রস্ত বসনে সেদিন কিয়ৎক্ষণ আমার বাহুবেষ্টনীতেই তুমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলে!তাই সম্পূর্ণ সুযোগ থাকলেও সেদিন তোমাকে কামদংশনে ভ্রষ্টা করিনি। এখনও বুঝতে পারছ না যে আমি রিপুজয়ী না হলেও তোমার শত্রুমনস্ক নই। তাছাড়া এই মধুরতি আমাকে জীবনভর বড় অসম্মানের বাস্তবে এনে দাঁড় করিয়েছে বলে আমি তোমার ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি করব না। তাই গান্ধর্ব্য মতে হলেও প্রথমা পত্নীর মৃত্যুকালীন একাকিত্বজনিত কারণেই আবার তোমার পাণিগ্রহণ করব বলে মনস্থ করেছি। এ বিষয়ে অন্য সবাই আপত্তি করবে জানি তাও, পরাশরসংহিতায় লেখা আছে যে, - " নষ্টে, মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ | পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্য বিধীয়তে |" এই শ্লোকটা আচার্য সর্বজ্ঞ দেবের কাছে বহুবার আমিও এর আগে অনেকবার শুনেছি। তাই স্বয়ং মহর্ষি পরাশর যা অনেককাল আগে বলে গেছেন তা আজ সবাই ভুলে গেলেও আমি এখনও ভুলতে পারিনি।"

....

শৈলবালা এবার স্থাণবৎ ও ভাবান্তরহীন মুখে তাকিয়ে থাকল গোলকপতির দিকে। তখুনি ঝটিতে গোলকপতি খঞ্জরটি তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে তার ফলাটি এনে সামান্য ঠেকাতেই রক্তপাতের সূত্রপাত হল।

দক্ষিণহস্তের করাঙ্গুলী বিধৌত শোণিতধারা অতি সন্তর্পণে সে শৈলবালার সিঁথিতে ঠেকিয়ে রাখতেই ঝড়ের গতিতে শৈল গোলকপতির কোমরটিকে থরথর ভঙ্গিতে বেষ্টন করে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকল।

এবারে গোলকপতি অতি ধৈর্য্যবান ও একনিষ্ঠ প্রেমিকের মত সান্দ্র স্বরে বলে উঠল, " দেহী পদপল্লব মুদারম্ "! আর শৈলবালার অলক্তরঞ্জিত চরণদুটি তার নিজের সুবিশাল বক্ষে চেপে ধরতে উদ্যত হল।

......

কিছু কিছু ঘটনা এইরকম আকস্মিকতার আবহে মহান হয়ে উঠে মানবজীবনটি বড় মধুময় করে তোলে।

ব্রাহ্মমুহূর্তের সেই ঈষৎ গৈরিক সূর্যালোক যেন আস্তে আস্তে বরণ করে নিতে লাগল মধ্যযুগের কালান্তরের পর একটি নবোদিত আধুনিকতার প্রত্যূষকে দুটি অসম চরিত্রের মানব-মানবীকে একীভূত করে তোলার মাধ্যমে।

.......

দেখতে দেখতে ১৮৩০ সালের হেমন্তকাল পেরিয়ে শীতের মাঝামাঝি সময় এসে গেল।

বিলেতে এসে ভিলাটির বাগানে বসে সান্ধ্য চা পান করতে করতে মাঝেমাঝে নিজের সমস্ত কার্যকলাপের কথা ভেবে রামমোহন বিস্মিত হন নিজেই। সেই শৈশব কৈশোরের খানাকুলের দিনগুলো তো কখনোই বিস্মৃত হতে পারবেন কি?

তারপর কমবয়সে তিব্বত ভ্রমণ তথা পাহাড়ি স্নেহশীলা মাতৃধনদের অবাধ প্রশ্রয় সেদিন জ্ঞানচর্চা আর বোধিসত্ত্বের কাছে আত্মার পরিধিটি মেলে ধরতে কোনরকম সমস্যাই করেনি। সমস্ত জীবন ধরে কেবল পড়াশোনা আর কেবল পড়াশোনা। হাতের করকোষ্ঠীর মত অমোঘ করে তোলা তাঁর যাত্রাপথের শেষে আছে ব্রহ্মস্বাদের পুরষ্কার।

আবার তারই মধ্যে আছে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে পিতার সাথে বিরোধ, সতীদাহ বিরোধী বিলটিকে কেন্দ্র করে কূলীন সমাজের উপহাস, সমবেত হয়ে একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্মকে উপাসনার কারণে লোকাচার সহ মাতা তারিণী দেবীর বিরাগঘন আবহাওয়া এসব যেমন পুরোটাই সত্যি আবার তেমনই অভিন্নহৃদয়ের কিছু মিত্রতাও লাভ করেছেন অনেকের সাথে।

এমনকি জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথকে বাদ দিলেও সেই পরম মিত্রজনদের তালিকা আজ আর খুব কম নয়।

সমস্তজীবন ধরে তিনি শত্রুতা এ মিত্রতা এই দুটি পরস্পর বিরোধী বিষয়কেই তিনি নখদর্পণে ধরে রাখতে শিখতে চেয়েছিলেন।

....

মাসাধিককালের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর তিনি আপাতত এখন বিচরণ করছেন প্রবাসপথের নিশ্ছিদ্রতায়। এখানে একমাস ম্যানচেস্টারে এসে বসবাসের পর আপাতত লিভারপুলে এসে থেমেছেন।

অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে তাঁদের কখনোই কোনো রাজত্ব ছিল না, কিন্তু এখন নামের আগে বসে গেছে রাজা' উপাধি।

তাই শুনে হাসি পেলেও এদেশে বোধহয় তিনিই একমাত্র রাজত্বহীন রাজা। এমনকি মুকুটহীন সম্রাট বললেও অত্যুক্তি হয় না।

সমস্ত জীবনে বাঙালিকে আধুনিক মননে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। এমনকি বিলেতের মাটিতে এসে পা রাখার কথাও অবলীলায় ভাবতে পেরেছেন। যদিও তিনি কোন জীবিকাসূত্রে বিলেত আসেন নি । তিনি এদেশে এসেছেন বেশী শতাংশ স্বেচ্ছায় খানিকটা আর বাকীটা মোগল দরবারের অনুরোধে।

যেহেতু বিলেতের সাহেবরা উন্নাসিক ও ভারতের রাজা-বাদশাহ ছাড়া আর কাউকেই সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নন। তাঁকে 'রাজা' উপাধিতে সম্মানিত করে সমস্ত খরচের দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে বিলেত পাঠাতে উদ্যোগ নিয়েছেন মোগল শাসকদলের ক্ষীণক্ষমতাসীন বংশসজটি।

....

এখানে কালকের জনপ্রিয় ইংরেজী সংবাদপত্রে ফলাও লিখেছে তিনি ভারতবর্ষ থেকে এখানে এসেই প্রথম লোহার পাত কেটে বানানো রাস্তার উপর দিয়ে বাষ্পচালিত গাড়ি ছুটে যাচ্ছে; এই দৃশ্যটি দেখে বাহ্যত যেন তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।

নিজের মনে ভাবছিলেন যে ভারতবর্ষের মানুষেরা কবে জানতে পারবে বা আদৌ কি কখনও জানতে পারবে যে বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম রেলগাড়ি চড়েছেন।

এমনকি সেই গাড়ি যখন ঘণ্টায় পনেরো ক্রোশ বেগে চলতে শুরু করে, তখন যে নকল পোশাকের 'রাজা'টি যে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই কথাটিও এখানকার সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে দেখে তিনি প্রথমে বেশ বিব্রত বোধ করলেও পরে খুশী হয়েছেন।

....

রাতে ঘুসঘুসে জ্বর আর সাথে খুশখুশে কাশি হচ্ছে ক'দিন হল। প্রিভি কাউন্সেলে তাঁর এখনও দুটি বক্তৃতা দেওয়া বাকী। ইংরেজরা নিজেদের সভ্যতাদর্পী ভাবলেও ভারতবর্ষ সম্পর্কে ওরা বেশ উদাসীন। যা বুঝছেন তা হল গত সাতটি দশকে বৃটিশ আগ্রাসন ঘনিয়ে এলেও প্রায় নিখরচায় সস্তা মজুর সহ ধান, পাট,চা আর নীল চাষের এক কৃষিক্ষেত্র হিসাবে বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র ছাড়া পূর্ব গোলার্ধের এই দেশটির হাজার বছরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ধারাবাহিকতা নিয়ে এরা কোনওকিছুই এখন ভাবতে শেখেনি । এরা কার্যত ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে জান্তব প্রকৃতির বনমানুষের সমতুল্য বলে মনে করে।

....

চা পান শেষ করতেই দূরের পাহাড়ের কোলে চিত্রার্পিতের মত সূর্যাস্তটি দেখতে দেখতে নিজের মাতৃভূমির জন্য ওঁর মনটা আজ বড় উতলা হয়ে এল।

আচ্ছা! দেশে আবার ফিরে আসতে পারবেন তো!

এইসব বিপরীতধর্মী চিন্তাসিন্ধুর দোলাচলের তরঙ্গ এসে তাঁকে বিব্রত করতেই গার্ডেন চেয়ার থেকে এবারে উঠে গেলেন। তাঁর পদশব্দ শুনতে পেয়ে বৃদ্ধ বাটলার মিস্টার জোসেফ হাওয়ার্ডির কোন প্রশ্নের উত্তর না দিতে দিতেই তিনি সশব্দে ভিলার দক্ষিণদিকে থাকা সুবিশাল পাঠকক্ষের দরজাটি খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। এখন মনকে সংহত করতে গেলে কিছু পুস্তকপাঠের আশু প্রয়োজন বোধ করছেন।

0 comments: