0

সম্পাদকীয়

Posted in






আবার সেই উৎসবের দোরগোড়ায় আমরা। কিন্তু উৎসবের অর্থ কী? তার প্রয়োজনীয়তার গণ্ডি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত? এইসব প্রশ্ন অনেকাংশে উত্তরগর্ভ। সেইসব উত্তর আবার জন্ম দিতে পারে বিবিধ জিজ্ঞাসার।

একথা অবশ্য অনস্বীকার্য এই বিষয়টির দুটি মূল ধারা - সামাজিক এবং ধর্মীয়। আবার এই দুই ধারার মধ্যে প্রধান সাযুজ্য স্বতস্ফূর্ততা। এই আপন অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত বহতা নদীর মতো সহজিয়া ভঙ্গীটিই এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মানুষের সানন্দ যোগদান - যার অনুপস্থিতিতে একটি উৎসব কখনওই তার যথার্থ মর্যাদা পেতে পারে না। তাহলে এমন যদি ভাবা হয়, কোনও বিশেষ উপলক্ষ্যে দলবদ্ধভাবে মানুষের নিঃসঙ্কোচ একত্র হওয়াই একটি উৎসবের প্রাথমিক শর্ত, ভুল হবে কি? সেই যুক্তিতে যে কোনও উৎসবের একটি মানবিক মুখ থাকা নিতান্ত জরুরি।

আসন্ন বার্ষিক উৎসবের প্রেক্ষাপটে এই ভাবনাগুলি অত্যন্ত সঙ্গত মনে হওয়ার কারণ উৎসব পালনে ফতোয়ার ঘোষণা। আর একথা কি আমাদের জানা নেই যে ফতোয়া আর মৌলবাদ সর্বদা হাত ধরাধরি করে থাকে। সেক্ষেত্রে উদযাপনের মূল সুরটির যায় তাল কেটে। ফুটন্ত ভাতের গন্ধে মাতোয়ারা মানুষের চেয়ে উৎসবপ্রিয় আর কে আছে?

সুস্থ উৎসবে থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









নারীর ভেতর যে আগুন বা অগ্নিময় শক্তি আছে তাকে সমাজ বা সমসমাজ বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চিনতে পারে না।ফলে নারীকে সবসময়ই একটা কোমল,পেলব ছায়াতরু হিসেবে দেখানর চেষ্টা করা হয়।আমরা যারা সমাজতত্ত্ব বা সামাজিক জীবন বা নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবি তখন দেখতে পাই যে নারীকে বৃক্ষ ভাবার অর্থ তাকে কুড়োল দিয়ে মারলে সে কথা বলবে না, তার গায়ে আগুন দিয়ে দিলে সে কথা বলবে না,তার গায়ে এসিড ঢেলে দিলেও সে কথা বলবে না,তাকে দড়ির ফাঁস তৈরি করে, সটান ঝুলিয়ে দিলেও সে কথা বলবে না।কারণ গাছ নীরব থাকে।কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে বৃক্ষের সঙ্গে নারীর তুলনা হলেও নারী কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার স্বজ্ঞান নিয়ে জাগরিত থাকে। তার বুদ্ধিমত্তা, তার প্রজ্ঞা,তার মেধা তার জিজ্ঞাসা, তার যাবতীয় আবিষ্কারের চিন্তা -সবটা একটা নতুন ভুবন এবং নতুন ভুবনের যে পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে আমাদের সামনে, যেটা আমরা বারে বারে যুগে যুগে কালে কালে দেখেছি দেশে এবং বিদেশে। বেদের যুগে,উপনিষদের যুগে পরবর্তী সময় মহাভারত, রামায়ণকে যদি মহাকাব্যও ধরে নি, কল্পনাও করি।সেই সময়টা ধরে নিয়ে দেখবো নারী কিন্তু সব সময় অত্যন্ত সচেতন, সংবেদনশীল তাকে সেইদিক থেকে বৃক্ষ যেমন বলা যায়, তার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধের ক্ষমতাও আছে। যে প্রতিরোধ করে, প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে নতুন করে সমাজ বাস্তবতার চেহারা বদলে দেয়।এখানে আগুনের ডালপালা বলা হয়েছে মেয়েদের।আগুনের ডালপালা অর্থে বৃক্ষ গভীরে যখন আগুন লেগে যায় অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশ শোষণ, বঞ্চনা এবং নারীকে দাবিয়ে রাখার যে স্বভাব -প্রবণতা সেইটা যখন ভেতরে ভেতরে পেট্রোল, কেরোসিন, বারুদ জমাতে জমাতে দেশলাই কাঠি জ্বেলে বা মশালের আলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তখন এই শান্ত বৃক্ষরা হয়ে ওঠে অগ্নিময় কালান্তক কোনো যাত্রা।আর এই অগ্নিময়তা নিয়েই সে যাত্রা করে সূর্য শিকারে।সূর্য শিকার অর্থে এখানে জীবনের চরম সত্যকে চরম ভাবনাকে চরম জিজ্ঞাসা এবং প্রশ্নের প্রতি উত্তরকে সমূহভাবে, সামূহিকভাবে নিয়ে আসা,এটাই তার আগুনের ডালপালা হিসেবে সূর্য শিকারের দিকে যাত্রা আমাদের মনে হয়।ফলে সূর্য শিকার থাকে আগুনের ডালপালাও থাকে। নারী তার সমাজ বাস্তবতা এবং তার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্যাগ তিতিক্ষা ও জীবনের যাবতীয় যে কষ্ট, বঞ্চনা তার মধ্য দিয়ে এক নতুন পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। সেই পৃথিবীর নাম সবুজ, এবং চিরন্তন এক যাত্রার স্বপ্ন নিয়ে থাকা ভুবন পথে যাত্রার কথাই বলে দেয় আমাদের।
নারী আমার কাছে শেকলে বাাঁধা সারমেয় ,পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্রের এই আস্ফালন যেন আবহমানের।আগেকার দিনে রাজা মহারাজার সভায় চিতা বাঘ দেখা যেত, আকবর ও জাহাঙ্গীরের সভায় চিতা রয়েছে গলায় শেকল বেল্ট বাধা।শিকারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতো তারা।আর কুকুরকে তো রাখেই।এই ব্যাপারটা ক্রমশ করে দেওয়া হল। পুরুষ নারীর সব অধিকার হরণ করবে কিন্তু নারী তার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে পারবে না।নারী অসূর্যম্পশ্যা। সে সূর্যের মুখও দেখতে পারবে না।প্রাচীন কালে মুঘল শাসনের সময়, মুঘল সম্রাটরা তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতেন নাা পাছে সম্পত্তি ভাগ হয়, এই ভালো না লাগাকে মাথায় রেখে জাহানারা, রোশেনারা কারোরই বিয়ে হয় নি। আকবর এই আইন চালু করেছিলেন। তারা কিন্তু ঝরোখার ভিতর দিয়ে রাজপুত বীরদের দেখতেন- সুউচ্চ বুক, চওড়া কাঁধ, সুন্দর গোঁফ,সুপুরুষরা যাচ্ছে বা মধ্য এশিয়ার কোনো যোদ্ধাকে দেখতেন।কারণ তখন তো মধ্য এশিয়া থেকে আসতেন পেশাদার যোদ্ধারা মুঘল সেনা দলে চাকরি করতে, তাতার,তুর্ক,উজবেক,ইরানি থেকে সবাই আসতেন আর্মিতে-মোঘল সৈন্য দলে।তখন রাজ প্রাসাদের নারীরা লুকিয়ে বীর যোদ্ধাদের দেখতেন।কিন্তু বাইরে থেকে যোদ্ধারা বাইরে থেকে তাঁরা দেখতে পেতেন না।মুঘল হারেমে খোজা অর্থাৎ নপুংসক পাহারাদার রাখতেন।বা যাঁরা বাদশাহদের রক্ষিতা ছিলেন, তাদের পাহারাদারির জন্য - খোজা, নয়তো তাতারানি রাখা হতো পাহারাদার হিসেবে।তাদের মন মানসিকতা হচ্ছে এমন তুমি আমার সম্ভোগের বস্তু। আমার বাগানের গোলাপ তুমি।তোমাকে যখন ইচ্ছে ছিঁড়ব। যখন ইচ্ছে বুক পকেটে রাখব,যখন মনে হয় গন্ধ শুঁকব৷কখনও ফুলদানিতে রাখব,কখনও তাকে পদদলিত করব। আমাকে কেউ কিচ্ছু বলার নেই।আবার ইচ্ছে হলে পাপড়িগুলো ছিঁড়ে দূরে ভাসিয়ে দেবো কোথাও।এটা যে সবটাই আমার ইচ্ছে। গোলাপের কোনো ইচ্ছে নেই। তার কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই।সে শুধু ফুটে যাবে।গন্ধ বিলিয়ে পুরুষ নামক বস্তুকে খুশি রাখবে।কখনো ফুলদানিতে, কখনো তাকে পদদলিত করব।এই যে পুরুষতন্ত্রের পুরনো খেলা, এই খেলাটা ক্রমশঃ নারী ধরে ফেলেছে। কল্যাণী দত্তের 'পিঞ্জরে বসিয়া'তে কিন্তু অন্যভাবে আঁকা হিয়েছে মেয়েমহল,নারীমহলের ছবি।সেখানে দেখা যায় যে আমাদের হিন্দু বাঙালি নারীরা অন্দর মহলে তাস খেলছে দাবা খেলছে, গ্রাবু, বিন্তি, সামনে সাজান পানের বাটায়,পান, জর্দা,চুন,,ছোটো এলাচ,বড় এলাচ, কিমাম। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন,কখনো কখনো চাপা গলায় মহিলা মহলের খিস্তি মৃদু গালাগালি-চাপা স্বরে, কখনও কখনও রসের কথা-আদি রসের কথা,একটু আদি রসাত্মক গুপ্তজ্ঞান জগতের কথাও হচ্ছে। এটা মেয়ে মহলের মুক্তি কিন্তু নয়। পুরুষরা যে বারমুখো, অর্থাৎ সন্ধ্যা হলে বাবু ধুতিটি পরে পাঞ্জাবিটি গায়ে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ,কানে আতর দিয়ে, চললেন রক্ষিতার বাড়ি, নয়তো বাইজি সন্নিধানে।তাদের প্রতিহত করার, রেজিস্ট করার ক্ষমতা কিন্তু অন্তঃপুরবাসিনীদের থাকছে না।

আসলে নারী প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রতিভাবান। যেহেতু নারী ভালো সংগঠক,যেহেতু সমস্ত পৃথিবীটাকে ভালো করে চালাতে পারেন,যেহেতু নারী পূর্ণ আকাশ,তাই পুরুষের ভয় যদি নারীর কাছে হেরে যাই,যদি তাকে দাবিয়ে দেয়,তাকে যদি তাড়িয়ে দেয়,তাড়িয়ে দেয় মানে গৃহ ত্যাগ নয়,কোন মতামত পছন্দ না হলে যদি তা নিমেষে উড়িয়ে দেয় তার ভয় পুরুষের। এটা নারীর স্বাধিকারের প্রশ্ন।আমি সন্তান ধারণ করব কী করব না, আমার গর্ভে সন্তান আসবে কি আসবে না,এই সিদ্ধান্ত নারী যদি নিতে না পারে, তাহলে কী করে নারী স্বাধীনতা আসবে।আগুনের ডালপালা বলা হচ্ছে কেন, নারীর ভেতর যে বিস্ফার আছে,যে প্রতিভা আছে,সেই প্রতিভাকে সে বিস্তৃত করতে চায়। হ্যাঁ, না বলতে চায়,তখনই সে বিদ্রোহী ।কিন্তু তার শিকড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।কিন্তু সে যখন শুদ্ধ স্বরে হ্যাঁ বা না বলতে চায় তখনই সে বিদ্রোহী। এই যে আগুনের ডালপালা, এই যে শিরোনামের দিকে আমরা আসছি, এই আগুনের ডালপালাগুলি ক্রমশঃ সম্প্রসারিত করছে তারা সূর্য শিকার করতে।সূর্য যা পৃথিবীকে আলো দেয়,নিজের গাত্র বর্ণ বা হেমবর্ণ অগ্নিবর্ণ আলো দিয়ে সে সূর্য শিকার করতে চাইছে।এই সূর্য শিকারের মধ্য দিয়েই ত্রিপুরার নারীদের লেখা অন্য নারী লেখকদের চেয়ে আলাদা।এবং সূর্য শিকার তারাই করবেন কারণ তাদের আগুনের ডালপালা আছে।এবং সেইটা তারা গোড়া থেকে মানে একটা মেয়ে যখন বড় হয়ে উঠে, আস্তে আস্তে যখন তার বালিকা বেলা থেকে কৈশোর বেলা,কৈশোর থেকে যখন যৌবন বেলা তখন থেকেই ঘরের মা বাবারা বুঝাতে থাকেন এটা করতে হবে,ওটা করতে হবে,এসব না মানলে পাপ হবে।এবং অদ্ভুত ভাবে মেয়েরা সবই মেনে চলতো।নারীর এতো প্রতিভা যে তাকে পুরুষ একশোতে একশো না বলে সাত বলতে চায়।পুরুষরা বরাবরই বলে থাকেন মেয়ে মানুষ বারো হাত কাপড়েও লেংটা।মেয়ে মানুষ উড়বে ছাই,....গুণ গাই।এটি নারীর বিপর্যয়।
প্রথম জীবনে পিতা, দ্বিতীয় জীবনে পতি,তৃতীয় জীবনে পুত্র।ফলে নারী সকলের কর্তা।এখানে নারী সমান সমান ফলে সকলের কর্তাকে সব সময়ই মানসিক এবং শারিরীকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।বছরের পর বছর নারীকে সন্তান জন্ম দেয়া,প্রত্যেক মাসে রজঃ নিবৃত্তি হয় দীর্ঘ সময় ধরে এদিকে পুরুষের কোনো খেয়ালই নেই।সেটাকে যদি সমাজ বুঝতে না পারে,তাহলে আগামী দিনে পরিবার,সমাজ,দেশ, রাষ্ট্র কীভাবে এগোবে।

রাষ্ট্র কিন্তু আসলে মনহীন একটা যন্ত্র।একটা হেডলেস ক্রিচার।সে সবাইকে গ্রাস করতে চায়।মাথার চিবিয়ে ফেলতে চায়।নষ্ট করতে চায়।সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি মেয়ে দাঁড়ায়।একটি পুরুষ মানুষের স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়ানো ও মেয়ের দাঁড়ান মধ্যে ফারাক আছে।একটি জেলে একজন পুরুষ প্রচন্ড মার খেতে পারেন কিন্তু একটি মেয়েকে তো সেখানে ধর্ষিত হতে হয়।এ-ইটা হচ্ছে রাষ্ট্র। মহেশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী গল্পের শেষে দোপদী মেঝেন শেষে মনে করছেন অর্থাৎ যখন তাকে ধর্ষণ করছে তখন তার পুলিশ অফিসারের উচ্ছ্রিত পুরুষাঙ্গ সমেত গোটা শরীরটাকে নিজের গভীরে প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতে বাধ্য হয়ে,পুরুষাঙ্গটিকে চলমান পিস্টন ভাবতে শুরু করে ভয়ানক যন্ত্রণা ও ব্যথার ভেতর। এখানে একটি রাষ্ট্র কীভাবে নারীর শরীর দখল করে।এর পর মীনাক্ষী সেনের গল্প,এর পর জয়া গোয়ালা,নারী এবং তার স্বকীয়তা, স্বাধীনতা এইটা যদি তার পুরুষের সহমর্মিতার,বন্ধুতার সব কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁরা এগুচ্ছেন ,নারী ক্রমশঃ ক্রমশঃ রিভোল্ট করবে।তাকে পিঞ্জরে রাখা যাবে না।পিঞ্জরে বসিয়া সুখ হয়ে সে কথা বলবে না।এর জন্য কিন্তু দায়ী থাকবে পুরুষ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

অর্থাৎ মেয়ে মানুষ যে একটা ইমপর্টেন্ট পার্সন তাকে যে গুরুত্ব দিতে হয় সেইটাই শেখানো হয় না বেশিরভাগ পরিবারে।ঘরে যেকোনো কথা বললে মেয়ে শুনতে চাইলে বা বলতে চাইলে তাকে সব সময়ই বলা হয় এই তুমি মেয়েছেলে সব কথার মধ্যে তুমি কথা বলছ কেন।মনে হয় মেয়েমানুষ যেন মানুষই নন তাই এই বিষয়ে ঘর থেকেই শিক্ষা দেয়া দরকার। সেটা একমাত্র হতে পারে নারী জাগরণ এবং সাহিত্যের যে মহানুভব খেলা তার মধ্য দিয়ে হতে পারে।
তবে ত্রিপুরার সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে আলদা তার কারণ ত্রিপুরার ভৌগোলিক যে অবস্থান, যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক যে পরিবেশ, যেভাবে আর্মি এবং রাষ্ট্র অত্যাচারের থাবা নামিয়েছে সেটা বাংলায় কিছুটা হয়েছে হয়তো কিন্তু ত্রিপুরায় একটি পর্যায়ে ভীষণভাবে হয়েছে।ফলে সেখানকার নারী লেখকদের লেখা আলাদা তো হবেই। স্বতন্ত্র উচ্চারণ স্বাভাবিক ভাবেই হবে।এবং সেই স্বতন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়েই কিন্তু তাঁরা এগুচ্ছেন। এবং এগুতে এগুতে অর্জন করছেন একটা স্বাধীনতা।সেই স্বাধীনতার পতাকা- সংগ্রামের নিশান,তাঁরা নিজেদের স্বোপার্জিত ভূমিতে প্রোথিত করেছেন।

জীবনকে অন্তঃস্থল থেকে দেখার মানস-চক্ষু ও শক্তিশালী কলমের লেখিকা মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায় যৌবন প্রারম্ভেই সাহিত্যের অঙ্গনে পা রেখেছিলেন।তাঁর কথায় ঐশ্বরিক প্রেমের কাহিনি নয় ছিল সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ,হাসি কান্নার বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। লেখক মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ওঠে এসেছে নারীর সমকালীন সমাজের নানা দ্বন্দ্ব, জটিলতা,অপরিনত প্রেম,অবৈধ প্রেম ও নানা মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ। তিনি উপন্যাসে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।

মীনাক্ষী সেনের 'জেলের ভেতর জেল' উপন্যাসটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি 'পাগলাবাড়ি' ও দ্বিতীয়টি 'হাজতি নম্বর মেয়াদী নম্বর।' পাগলাবাড়ি পর্বটি চৌদ্দটি কাহিনির মাধ্যমে তোলে ধরেছেন লেখক।
মা কাহিনিতে মা'এর নাম মীরা।মীরা বদ্ধ পাগল।তাই তাকে জেলে ঢুকিয়ে চেন দিয়ে বেধে রাখা হত।কিছুদিন পর তার গর্ভে মানব শিশুর ভ্রূণ বেড়ে ওঠছিল।তাকে পুলিশ প্রথমে দু রাত থানায় রাখে।তারপর স্থানীয় জেল ঘুরে পাগলবাড়িতে।সে কোথাও ধর্ষিত হয়েছে - হয় থানায় নয় তো পথে।পিতার ধারণা পুলিশই তাকে ধর্ষণ করেছে।পাগলবাড়িতে কয়েকমাস থাকার পর সুস্থ হয়ে ওঠে - জ্ঞান ফিরে পায়।তখন সে সাত মাসের গর্ভবতী। সে ঠিক সময়ে সজ্ঞানে শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছে।শিশুর পিতৃ পরিচয় জানা নেই।সে কুমারী মা।লেখকের বর্ণনায়- ' মায়ের চেয়েও ভয়াবহ তার চেহারা।হাড়গুলো অপুষ্টির ফলে সরু-সরু।এক ফোঁটা মেদ তো নয়ই,কোনো মাংসও নেই শরীরে। মনে হয়; শীর্ণ হাড়ে আলগাভাবে যেন জড়ানো আছে গায়ের চামড়া।'
কুমারী-মা মীরার কঠোর সংগ্রাম শুরু হয় পরম ধন সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার।সন্তানের জন্য কোন আহার জেল কর্তৃপক্ষ মঞ্জুর করে নি।কারণ সে হল ' না- বন্দি শিশু।' স্বেচ্ছায় তার মা জেলে রেখেছে।না বন্দী,না অপরাধী শিশুর মায়েরা সর্বদা ক্ষমতাধর অত্যাচারীদের পায়ে পড়ে থাকে।হাত কচলে,তোষামোদ করে,পা টিপে,পিঠ চুলকে,শরীর দিয়ে- সর্বস্বান্ত হয়।
'সেই নীল নীলিমা ও একজন ওয়ার্ডার' কাহিনিতে রয়েছে রূপ লাবণ্যে পূর্ণ অসামান্য সুন্দরী নীলিমার স্থান হল ডিগ্রি ঘরে।ডিগ্রিঘর হল শাস্তি ঘর। নীলিমা অনাথ।ছোটো বেলায় মা বাবা মারা যাবার পর এক অভিজাত -ধনী দম্পতি নিজ সন্তানের মতো নীলিমাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে,লেখাপড়া শিখিয়ে লালন পালন করে। বয়ঃসন্ধিকালে নীলিমা জেনে যায় সে হিন্দু ও অনাথ। মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব সে লড়াই করে একদিন ঘরে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।নারীমাংস লোলুপ শ্বাপদের হাতে পড়ে ধর্ষিত হয়।তারপর হাত বদল হতে হতে চলে আসে পতিতা পল্লীতে।এখানে তার মূল্য চড়া।কাজেই তার বিশ্রাম নেই।এই পতিতা পল্লীতে ঢোকা সহজ কিন্তু বেরনো প্রায় অসম্ভব। অনাথ হলেও নীলিমা রাজনন্দিনীর মতো বেড়ে উঠেছিল।ফলে পতিতা পল্লীতে অসহ্য যন্ত্রণায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে নীলিমা।পতিতাপল্লীর সঙ্গে জেলের নিবিড় যোগাযোগ। চিকিৎসার জন্য পাগলবাড়িতে ঠাঁই হলেও তার নিরাপত্তার কথা ভেবে ডিগ্রিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।যদি কোনো পাগল তার সোনার অঙ্গে দাগ ফেলে দেয় আঁচড় কামড় দিয়ে।ডিগ্রিতে থাকলেও খাওয়া দাওয়ায়,চিকিৎসা, ওষুপথ্য,কম্বল এসব সে তার মালিকদের তদারকিতে পেয়ে যেত।কারণ সে যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে তার স্থানে যাবে ততই তাদের লাভ।ওরা ওঁৎ পেতে থাকে ঠিকানাহীন পাগলীরা সুস্থ হয়ে ওঠলে আত্মীয় সেজে এদের নিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে ঢুকিয়ে দেয়।
এর পরের কাহিনি শোভা।অপরূপ সুন্দরী ষোড়শী শোভার সঙ্গে প্রণয়ের অভিনয় করেছিল পাশের বাড়ির এক ধনীর দুলাল।কালীঘাটে নিয়ে বিয়ে করে এবং ভাড়াবাড়িতে রেখে শোভার শরীর ভোগ করে।পরে শোভার পেটে সন্তান এলে ভাড়া বাড়িতে তাকে ফেলে চলে যায়।শোভার পিতা শোভাকে বাড়ি নিয়ে আসে।পরে শোভার এই অবস্থা দেখে মামলা করতে বাধ্য হয় । মামলার ফলে তিনজনই জেলে আসতে বাধ্য হয়।শোভা- তার সন্তান ও সন্তানের জনক।পরে ছেলেটি অবশ্য জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় এবং জেলে পড়ে রইল শোভা।

বেশ কিছুদিন পর জেলের চূড়ান্ত অবহেলার মধ্যেই আবার এক শিশু পুত্রের জন্ম দেয় শোভা।পুত্রসন্তানের জন্মের জন্য শোভা আশায় বুক বাঁধে এবার নিশ্চয়ই স্বামী ও শ্বশুর তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে।কিন্তু তা হয় নি।তাঁর সন্তান নিয়ে স্বামীর সংশয়।শোভা আদালতে শুনেছে সন্তানের রক্ত পরীক্ষায় প্রমাণিত হবে সন্তানের পিতৃত্ব।কিছুদিন পর হাসপাতালের ভাঙা জং ধরা উন্মুক্ত লোহার খাটে কয়েকদিন কাটিয়ে শোভার শিশুপুত্রটি মারা যায়।নানা কুৎসিত গালাগালি করে শোকাতুরা শোভাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল নোংরা অস্বাস্থ্যকর হাজতি নম্বরে।সন্তান-শোক ও জীবন যন্ত্রণা শোভাকে বিধ্বস্ত করে তুলে। জেলে এমন রটনাও ছিল যে শোভাই তার আত্মজাকে খুন করেছে।সদ্যোজাত পুত্রের মৃত্যুতে শোভার সমস্ত আশাই শেষ।

শোভার দেড় বছরের জেল।কোনোদিন মেয়াদি নম্বরের দিদিদের সঙ্গে কথা হয় নি।একরাতে মীরা,আরতিরা খুব মারধর করে শোভাকে।পরদিন জেলের দিদিরা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে মারধরের কারণ জানতে চাইল।শোভা উত্তরে জানায় হাজতি নম্বরের এক বন্দিনী শোভার বান্ধবী। তাকে শোভা প্রেমপত্র লিখে দিয়েছিল। শোভা লেখাপড়া জানতো- হাতের লেখা যেহেতু শোভার সুন্দর। জেলখানার ভেতর এসব চলত।প্রেমপত্র লেখার পুরুষ চরিত্র মেটরা।মেট অর্থাৎ সাজা পাওয়া পুরুষ বন্দীরা নানা কাজের জন্য মহিলা ওয়ার্ডে ঢোকার অনুমতি পেত।যেমন- দুজন বন্দিনী মিলে এক ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি তৈরি হয়।এর মধ্যে মীরা একজন।সেই চিঠি গিয়ে পড়ে মীরার হাতে।হাতের লেখা যেহেতু শোভার তাই যত আক্রোশ তার ওপর।শোভা সেই মেটকে চেনেও না।সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। মীরা শোভাকে শাসিয়ে ডিগ্রি ঘরে ঢুকিয়েছে।অবশেষে শোভা জেলারের নির্দেশে নিরপরাধ কিশোরী শোভাকে ডিগ্রি থেকে মুক্ত করা হয়।অথচ আইনের আশ্রয়ে থেকে শোভাকে চূড়ান্ত গঞ্জনা, অত্যাচার সইতে হয়েছে।মাতৃত্ব নিয়ে নানা কদর্য-প্রশ্ন।আত্মজকে হারাতে হয়েছে।তার স্বামী বিয়ে করেছে।সন্তান হয়েছে।এতোসব মানসিক আঘাত সইতে না পেরে স্বাভাবিক ভাবেই শোভা পাগল হল।
হাওয়াবিবির কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই হাওয়াবিবি কৃষক দম্পতির একমাত্র বেঁচে থাকা সন্তান। অত্যন্ত আদরে বেড়ে ওঠা তার। তখন তাকে বিয়ে দেবার জন্য এক রাজপুত্রের সন্ধান পাওয়া গেল।হাওয়ার বাবা জায়গাজমি বিক্রি করে ধারদেনা করে তেরো বছরের আদরের হাওয়াকে বড় লোকের বাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্য।হাওয়া কুরূপা এই অজুহাতে তার বর তাকে নির্যাতন শুরু করে।শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলতে তাকে বউ ছেলের মন ভরাতে পারছে না।দোষ হাওয়ারই।কিছুদিন পর হাওয়া শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে আসে।কন্যার এই অবস্থা দেখে মা -বাবাও অসুস্থ হয়ে যায়। হাওয়া বাবা মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।পাশেই ফুপুর বাড়ি।ফুপুতো ভাইয়েরা ও ফুপু তাদের দেখাশোনা ও খোঁজ খবর নিত।কিছুদি পর উভয় বাড়ির ইচ্ছায় ফুপুতো ভাইয়ের সঙ্গে হাওয়াবিবির বিয়ে হয়।হাওয়ার দিন সুখে কাটতে লাগলো শরীরে স্বাস্থ্য ও লাবণ্যের জোয়ার এলো।ঠিক তখনই লম্পট প্রথম স্বামী রূপ লাবণ্যে ভরপুর হাওয়ার দিকে কু-নজর দেয়। হাওয়াকে একদিন একা পেয়ে বলাৎকার করার চেষ্টা করে।হাওয়া সে কথা স্বামী ও দেবরকে জানালে তারা সেই লম্পটকে হত্যা করে। তিন জন জেলে যায়।হাওয়া আর জামিন পায় নি।
দুই নারী কাহিনির নায়িকা শিবানীদি।শিবানীদির ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়েছিল- আর দশজন মেয়ের মতোই।প্রেমে প্রতারণা, অবৈধ সহবাস, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর অস্বীকার হওয়ার পর অস্বীকার করা ইত্যাদি। শিবানী অত্যন্ত দরিদ্র-ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে।রোগা-পাতলা চেহারা।আকর্ষণীয় তেমন কিছু ছিল না।তবে বয়সের স্বভাবে যৌবন এসেছিল এবং এক অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটা ক্রমে দৈহিক সম্পর্কে পরিণত হয়।শিবানী গর্ভবতী হয়।পাড়ার লোকজন শিবানীর পক্ষে ছিল।ওরা চাপ দেয় ছেলের বাড়িতে।কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে অস্বীকৃত হয়।

শিবানী ছেলেটিকে খুব ভালোবাসত এবং জানত সেই তার স্বামী। অভিযোগ ছিল ছেলেটির বাবার ওপর।বাবার অসম্মতি ছিল। শিবানীর বাবাও তাকে আর বাড়িতে স্থান দেয় নি।ফলে জেলখানার নিরাপদ আশ্রয়ে তাকে চলে যেতে হয়। রুগ্ন স্বাস্থ্য শরীরে আরেকটি জীবন বড় হতে থাকে শিবানীর ভেতর সবার আশঙ্কার মধ্যে সে শিশুপুত্রের জন্ম দিল। ঔষধ-পত্রের যোগান নেই,কীকরে সে সন্তানকে বাঁচাবে।অনেক কষ্টে শিশুর জীবন রক্ষা করে।বাচ্চাটিও দুর্ভাগা, কারণ শিবানীর বুকে দুধ না থাকায় সে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে।বিচারের দিন শিক্ষক তার ছেলে ও স্ত্রীকে অস্বীকার করল। সে তাদের চেনেই না।হাকিম রক্ত পরীক্ষার কথা বলল।প্রকৃত বাবা কে তা প্রমাণের জন্য কিন্তু শিবানীর স্পষ্ট কথা 'আমার ছেলেকে বাঁচাতে হবে।এ ছেলে শুধু আমার।' সে আর কোনোদিন তার পিতৃত্ব দাবী করতে পারবে না।অর্থাৎ মনে প্রাণে শিবানী তাকে ত্যাগ করেছে।
এক্ষেত্রে শিবানী অন্যান্য মেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।অন্যান্য মেয়েরা শত প্রবঞ্চনার পরেও আবার স্বামীর ঘরে যেতে বা স্বামীকে নিয়ে ঘর করতে চায়।কিন্তু জেলখানা থেকে বেরিয়ে তার শিশুসন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবে শিবানী?ঠিক এই সময় আরেক নারী তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।নবদ্বীপের এক মাসী এসে প্রস্তাব দিল তার বাড়ি যেতে একজন স্ত্রী লোকের অভাবে তার সংসারটি ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে শিবানী রাজি হয়ে গেল।শীর্ণ,উপোসী,মলিন, দুর্বল শরীর, কিন্তু মন প্রচণ্ড শক্তিশালী, জেলখানার সবাই শিবানীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু শিবানীর বুকে অসীম সাহস।প্রতারক প্রেমিকের দ্বারা ধাক্কা খেয়ে জীবনের কঠিন পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ভালোবাসার কাহিনিতে লেখক মেয়েদের প্রেমের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।একটি মেয়ে বিয়ে করেছে, তার বিয়ের বয়স হয় নি।এদিকে সে অন্তঃসত্ত্বা। বাবা তাকে জেদ মেটানোর জন্য একটা হোমে রেখে দেন - যাতে সে তার ভালোবাসার পাত্রকে ভুলে যায়।মেয়েটি হোমে সন্তানের জন্ম দেয়। ছাড়া পেয়ে শ্বশুর বাড়ি যায়।মেয়েটি নিজে নানা সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজ আত্মমর্যাদা লাভ করে।
রীতা নামে একটি মেয়েকে ওর মা লাভ কেসে ফাঁসিয়ে জেলবন্দী করেছিল।মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল গৃহ শিক্ষকের বিরুদ্ধে। মায়ের হীন বেশ্যাবৃত্তিতে রীতার সহমত ছিল না।এই ছিল তার অপরাধ।
হাজতি নম্বর কাহিনিতে রয়েছে বিচারাধীন বন্দীদের থাকার কথা।কিন্তু বাস্তবে ঐ ঘরে সাজা পাওয়া মেয়াদি এবং নিরপরাধ বন্দিনীরা থাকত।শিশুরা,না-অপরাধী পাগলরাও থাকত।হাজতি নম্বরের ভিড় দিনে দিনে বেড়েই চলছিল।ফলে আয়তন তো আর বাড়ে নি।শুলে একজনের পা অপরজনের গায়ে লাগে।হাসি, কান্না, ঝগড়া গল্প সবই চলতে থাকে সমান তালে।হাজতি নম্বরের এক মেয়ে শিখা।আর দাপটে বন্দিনীদের অবস্থা কাহিল।সে ছিল সকলের ত্রাস।এ হেন কাজ নেই যে সে পারে না।অশ্লীল ভাষায় গালাগাল-মারপিট,সবই সে অবলীলায় করে যেত।
শিখার জেলে আসার কারণ সে ছিল গরীবের মেয়ে- তার স্বামী শ্রমিক। কারখানার মালিকের ছেলের সঙ্গে শিখা পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর তাদের টাকা পয়সা ফুরিয়ে যায়।তারপর বাঁচার তাগিদে শুরু করে জালিয়াতি।পরে পুলিশের হাতে দুজনেই ধরা পড়ে।ছেলেটি অবশ্য জামিনে বাড়ি চলে যায়।তখন স্বামী তাকে ত্যাগ করে। শিখার আর কেউ নেই খোঁজ খবর করার।কাজেই তার আর জামিন হয় নি।সে সহজেই মেট্রনের খুব কাছের লোক হয়ে গেল।শিখা প্রধান মেট হয়ে ওঠে।সে আচারে ব্যবহারে যেমন ব্যাতিক্রম তেমনি পোশাক -আশাকেও উদ্ভট। শুধু হাত কাটা ব্লাউজ আর সায়া পড়ে ঘুরে বেড়াত।শিখার নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য শিখার পুরুষ সঙ্গীর অভাব হয় না।তার আবার মেয়ে সঙ্গীও চাই।মনের চাহিদা পূরণ না হলে নানাভাবে অত্যাচার চালাত অন্যান্য বন্দীদের ওপর।বিশেষত সন্ধ্যার পর জেলখানার মৃদু আলোতে শিশু, কিশোর-কিশোরী,বৃদ্ধাদের সামনে চলত জৈবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থের প্রয়াস।শুধু শিখা নয় অন্যান্য বন্দিনীরাও এই আচরণে সামিল হত।
জেলের ভেতর জেল উপন্যাসে একটি জেলখানার মহিলা ওয়ার্ডের বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের ছবি চিত্রিত করা হয়েছে।

জয়া গোয়ালার প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস 'এই সীমান্তে।' এই কাহিনির জীবন স্রোত চা বাগানের খেটে খাওয়া সাধারণ নারী পুরুষ। চা-বাগানের শ্রমিকদের জীবন যুদ্ধের পাশাপাশি নারীদের শোষণ, অত্যাচার ও নারীর নিরাপত্তাহীনতার ছবি দিয়ে রচিত হয়েছে এই আখ্যান।কাহিনির নায়ক যদু।সমগ্র উপন্যাসে টুকরো টুকরো গল্প ফুটে ওঠেছে।নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি সব পেছনে ফেলে যদুরা কীভাবে বাগানের কুলি হয়ে ওঠে তার ইতিহাস এখানে ফুটে ওঠেছে। সমাজের মহাজনেরা সুদের ব্যবসায় কীভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠে তার গল্পও রয়েছে।যদুর মেয়ে চম্পা কাঁচা কুয়োয় পড়ে ঠ্যাং ভাঙে।সেই মেয়েকে সারিয়ে তুলতেই নকুল সাহার দ্বারস্থ হয়।আর সেই সুযোগে তার অসহায়তাকে পুঁজি করেই মহাজনের গদি মজবুত করে। পাঠক ভারাক্রান্ত হয় লীলার দেহ বিনিময়ের অধ্যায়ে।ক্ষুধার কাছে সতীত্ব তার অর্থ হারায়।দেহ বিক্রি করে স্বামী সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেয় লীলা।পরিণতিতে লীলার গর্ভসঞ্চার। পরে জড়িবুটি দিয়ে খালাস পাবার চেষ্টা করে।এবং শেষে মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেয় লীলা।লীলার শরীর বিক্রির ঘটনার শিউরে ওঠে যদু।মনে পড়ে চম্পার মুখ।চম্পার জীবনের অন্তিম পরিণতি যদি লীলার মতই হয়,যদু কি পারবে তা রুখতে? ভীত হয় দরিদ্র পিতা।
জয়া গোয়ালা সমাজের ক্ষত,সমাজের ব্যাধির ছবি,প্রান্তিক মানুষের জীবন যুদ্ধের ছবি আঁকে বিশ্বস্তভাবে।একদিকে গরিবী অপরদিকে জীবনে টিকে থাকার লড়াই,'এই সীমান্তের' শরীর জুড়ে।
'তবু মাদল বাজে' উপন্যাসে জয়া গোয়ালা সম্পূর্ণ অন্য পথে হেঁটেছেন। প্রান্তিকমানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জীবন যুদ্ধ এই উপন্যাসের বিষয় বস্তু নয়।সমাজের বেআব্রু কুসংস্কারের দগদগে ঘা'কে কীভাবে শুধুমাত্র নারীদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন লেখক।
উপন্যাসের শুরুতেই আঁতুড় ঘরে ডমরুর বউ ফুলির এক ভয়ানক মৃত্যু দৃশ্য। বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরেছে ফুলির শরীর থেকে।ধাই ফুলমতী ফুলির প্রসব করালেও প্রসব সম্পন্ন হয় নি।ফুলির পাগলের মতো অবস্থা।ডাকা হল ডমরু ওঝাকে।ফুলিদের অগাধ বিশ্বাস ওঝার ওপর।কিন্তু তা যে সম্পুর্ণ কুসংস্কার। ফলে ফুলি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।এখানে যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাব তা জয়া গোয়ালা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
তারপর উন্মোচিত হল ধাই ফুলমতির ডাইনি হবার গল্প।ওঝার এত সব ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র তো বিফলে যাবার কথা নয়,তাহলে হলটা কী? তবে ধাই- এরই কীর্তি। এই ধাই আস্তএকটা ডাইনি।কিন্তু নিরক্ষর ডমরু কিছুতেই বিশ্বাস করে না ফুলমতী ডাইনী।তার শুধু মনে পড়ে আতুড় ঘরে ফুলিকে প্রাণ ঢেলে সেবা করেছিল ফুলমতী।'তবু মাদল বাজে'এই প্রান্তিক মানুষদের সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক জেহাদ।
দিপালী ভট্টাচার্যের 'বিদগ্ধা ধরিত্রী' উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে আপামর পুরুষকুলের বিরুদ্ধে। তিনি লিখেছেন-' আমার ঠাকুমাকে আমার দাদু পাঁচকুড়ি পাঁচটাকা দিয়ে এনেছিল।ঠাকুরমার মুখেই শুনেছি এই কথা।যার যত কন্যা সন্তান থাকবে, সে তত বড় ব্যবসায়ী।আজকাল যুগ পাল্টেছে। এখন রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব। এ কোন ব্যবস্যা।পুত্র বিক্রয় না ব্যবসায় মালিক বদল। স্বামীর ক্ষুধা মেটানোই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য।
পুরুষ - মানুষের অনেক রূপ। সে কখনো স্বামী, কখনো পুত্র, কখনো পিতা, কখনো বন্ধু।তবে যাই হোক না কেন প্রকৃত পক্ষে পুরুষজাতি নারীকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে। সে রাজা থেকে শুরু করে সবাই।সত্যি কথা হল আমাদের সমাজের নিম্ন মানসিকতা, শিক্ষার অভাব প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত। প্রকৃত পক্ষে উপন্যাসটি আপামর পুরুষকুলের বিরুদ্ধে। উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে দেশভাগের ফলে নারীদের অসহায়তা নিয়ে।সুরেশ্বর, সৌদামিনী ও কৌমুদিনীর একদিকে দেশ হারা অপরদিকে শেকড় ছেঁড়ার বেদনা,অসহায়ত্ব তাকে পশুতে পরিণত করে।এর মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠা দাম্ভিক পৌরুষত্ব।ভারতী নাম্নী নামে এক সাধারণ মেয়ে আর পাঁচজন নারীর মতোই স্বামীর অবহেলা ও অত্যাচারে ওষ্ঠাগত প্রাণ। স্বামী নামক ব্যক্তিটির কাছে সে চিরকাল অবহেলিত। উপন্যাসিকের উদ্দেশ্যই হল মেয়েদের অসহায়ত্ব বর্ণনা করা।
'যোগ্য কন্যা' মঞ্জুরাণী বিশ্বাসের লেখা এক অভিনব উপন্যাস। কাহিনির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই কমলনাথ ও কাকলি বাড়ৈ- এর সন্তান হিসেবে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হল। প্রত্যেক পরিবারের চির কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তান কিন্তু কমল ও কাকলী তাদের কন্যা অর্পিতাকে নিয়েই সুখী। ক্রমে অর্পিতার বুদ্ধির বিকাশ ও প্রতিভার স্ফূরণ ও চিন্তাশীলতার ছাপ লক্ষ্য করা গেল। অর্পিতা এন সি সি করত।সে জানে এন সি সি করা মেয়েরা নির্ভীক হয়।আর শারীরিক গঠন হয় অটুট। এন সি সি করা মেয়ের উপর কোন পুরুষ অত্যাচারের কথা ভাবতেই পারে না। দশম,দ্বাদশ পাশ করে এম বি বি পড়ে চাকরি পায়।ফলে সে বিয়ে করে মৃণাল নামে এক যুবককে।বিয়ের সময় সে শর্ত রাখে যেগুলো পুরুষতন্ত্রকে সরাসরি নাকিচ করেছে সমাজের প্রতিভূ রূপে।
অর্পিতা সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়ে নারী স্বাধীনতার বীজ বহন করেছে। প্রথাগত হিন্দু ধর্মের কৌলিণ্য প্রথার বিরুদ্ধে সে সোচ্চার হয়ে নিজ শর্তে বিবাহ করেছে। অর্পিতা ও মৃণাল আর পাঁচটা দম্পতির মতো একঘেয়ে জীবনযাপন করেনি।তারা নিজেদের আত্মনিয়োজিত করেছে সমাজের নানা কাজে।অর্পিতা ও মৃণালের সুখী সংসারে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।এই আনন্দকে তারা খুশির উৎসবে পরিনত করে।সমগ্র উপন্যাসটিতে রয়েছে নারীমুক্তির বীজ।মেয়েদের রক্ষা করার জন্য অর্পিতা একটি সামাজিক সংস্থা গঠন করে।নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে। তাদের কাজ বিভিন্ন ঘটনা পুলিশের গোচরে নিয়ে আসা।পূজা সেন হত্যা মামলা,রেবা দাশের ওপর ঘটে যাওয়া ধর্ষণ এর মতো ঘটনাকে পুলিশের প্রত্যক্ষ গোচরে আনে।শুধু তাই নয় নারীর ওপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে মৌন মিছিলের মাধ্যমে সমাজে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় অর্পিতার নেতৃত্বে।
স্বল্পায়তন এই উপন্যাসটিতে লেখক সুকৌশলে নারীবাদী ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।আজও রাষ্ট্রে,সমাজে,পরিবারে ও ঘরে নারীরা যে কত অবহেলিত ও অত্যাচারিত তার অবস্থা এবং তা থেকে উত্তরণের প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে এই উপন্যাসে।নারীর কলমে নারীর সামাজিক অবস্থানের নিখুঁত প্রতিবিম্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে আলোচ্য আখ্যানে।মল্লিকা সেনগুপ্ত, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসুর মতো মহিলা কথাকারদের মতো মঞ্জুরাণী বিশ্বাস- এর উপন্যাসেও ফুটে ওঠেছে নারীদের মুক্তির প্রয়াস, তাদের ক্ষমতায়ন এবং স্বাধিকার অর্জনের লড়াই। ত্রিপুরার বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে মহিলা কথাকার হিসেবে তার অভিনবত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
টগর ভট্টাচার্যের 'খোলা জানালায়' আখানে প্রধানত নারী জীবনের নানা সামাজিক সমস্যা ও নারীর জন্মগত কিছু ত্রুটির কথা তোলে ধরা হয়েছে।একজন নারী তার পারিবারিক, সামাজিক এবং শারিরীক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কীভাবে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে তাই উপন্যাসে ফুটে ওঠেছে। মা হারা অরুণিমা সংসারে তিন ভাই আর বাবা থাকলেও সকলের উদাসীনতায় সে ছোটোবেলা থেকেই নিঃসঙ্গ।এক নিঃসন্তান মাসীর তত্ত্বাবধানে সে বড় হয়।অনাদর অবহেলায় সে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে থাকে।সে বুঝে নেয় বেঁচে থাকতে হলে স্বাবলম্বী হতে হবে,নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।স্বাধীনচেতা অরুণিমা প্রতিষ্ঠিত বাড়ির ছেলে দীপ্তনুর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও সে কখনো দীপ্তনুর উপর নির্ভর করে বাঁচতে চায় নি।অরুণিমার জীবনে অনেক সমস্যা এসেছে, এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সে অন্যের সাহায্যও পেয়েছে।একটা সময় সে কলকাতায় ত্রিপুরা ভবনে ক্লার্ক কাম রিসেপশনিস্ট এর চাকরি পায়।কর্ম জীবনে অরুণিমা একটি হোস্টেলে ছিল।সেখানের জীবনও ছিল দুর্বিষহ। হোস্টেলে ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নারীদের সঙ্গে অবস্থানকালে তাকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।একাধিকবার মুখোমুখি হতে হয়েছে অশ্লীল মন্তব্য ও ইঙ্গিতের। কখনো আবার পুরুষের লোভ লালসায়ও নিগৃহীত হতে হয়েছে।প্রতি পদে পদে হোঁচট খেয়েও সে পথ চলা বন্ধ করেনি।এমনকি উচ্চপদস্থ ডাক্তারের আহবানে সারা দেয়নি অরুণিমা।সে ব্যক্তিত্বময়ী,স্বতন্ত্র। দীপ্তনুর জন্য সে ভালোবাসাকে পোষে রাখে অন্তরে।
তবে অরুণিমার কিছু শারিরীক ত্রুটি ছিল যার জন্য সে মা হবার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত ছিল।ডা মিত্রের কাছ থেকে নিজের শারিরীক অক্ষমতার কথা জেনেও নিজেকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করেছে।নিজের অসহায়তার জন্য অন্যের দেওয়া সুযোগের অসৎ ব্যবহার জরে সে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় নি।গ্রহণ করেনি ডা মিত্রের দেওয়া বিবাহের প্রস্তাব। পাশাপাশি দীপ্তনুকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও পিতা হবার সুখ দিতে অক্ষম বকে তাকে বিবাহ না করার সীদ্ধান্ত নেয়।সমগ্র উপন্যাসে অরুণিমাকে কোথাও অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হতে দেখা যায় নি।নিজের সচেতনতাই অরুণিমাকে জীবনের সঠিক পথ বেছে নিতে সাহায্য করেছে।
উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে বার বার সুচিত্রা ভট্টাচার্যের 'আমি রাইকিশোরী' উপন্যাসটির প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে। দুটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী।দুটি উপন্যাসের মধ্যেই রয়েছে নারীর একক পথ চলা,তার উত্তরণের কাহিনি। অন্দরমহলের সকল সংস্কারের বাধা অতিক্রম করে রাইকিশোরী পেয়েছিল তার আত্মোপলব্ধির নিজস্ব জমি।অরুণিমাও নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল।দুজনেই ঘটনাক্রমে পুরুষের লালসার শিকার হলেও দুজনেই সততা আর প্রচেষ্টার জোরে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিল।এখানেই উপন্যাসিকের সার্থকতা।

আসলে আগুনের ডালপালারা তো পুড়তে চায়। পোড়াতে চায় না।তারা পুড়তেই চায়।সারাজীবন পুড়তে পুড়তে তাদের গভীর থেকে ওঠে আসে একধরনের দীর্ঘশ্বাস।একধরনের প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস।যে দীর্ঘশ্বাসের কথা সমাজের কার্পেটের নীচে,সমাজের জুতোর তলায় সমাজের টেবিলের নীচে একটু একটু করে চাপা পড়ে যায়। নারীর সৌন্দর্য, আসলে নারীর সৌন্দর্যে পুরুষ আপাত মুগ্ধ থাকে কিন্তু নারীর যে বিদ্যাবত্তা, যে সারস্বত চেতনা সেইটাকে কিন্তু অন্যভাবে বাঁচতে দিতে হয়। মানে যে গান গায়,পড়ে,যে লেখা,ছবি আঁকে,সিনেমা বানায়,নাটক লিখে,নাটক পরিচালনা করে,নাটক বানায়,যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলে এদের কথা কিন্তু সবার আগে আসা উচিৎ। যে গ্রামের মেয়ে ফসল ফলায়,যে কিষাণী ফসল ফলান।একা কৃষক ফসল ফলান না,কিশানীও ফসল ফলান।তিনি জমিকে উর্বর করতে চান।শ্রমিক মহল্লায় যারা নারী কর্মী তারা দায়বদ্ধভাবে শুধু স্বামীটিকেই আড়াল করেন না,ঘরের মধ্যে যাতে পরিচালন ব্যবস্থা ঠিক থাকে,সেই নিয়েও তার মাথা ব্যথার অন্ত নেই।নারী তার দায়িত্ব পালন করেও নিজের গায়ের যে আগুনের যে শুদ্ধতা সেই শুদ্ধতা,সেই শুদ্ধতাকে ঘিরে যে সারস্বত চেতনা,সেই চেতনাকে থেকে তিনি সমাজকে শুদ্ধ করতে চান করতে করতে নিজে জ্বলে যান নীরবে, নিভৃতে,একা।তার খবর কেউ রাখে না,রাখতে চায় না।দু'একজন সংবেদনশীল মানুষ হয়তো মনে করেন যে নারীর এই কষ্ট, এই যাতনা পাওয়া উচিৎ।

আখ্যানের বেশ কয়েকটি শব্দের উচ্চারণ আমরা করলাম।ত্রিপুরার নারী লেখকরা যে লেখা লিখেছেন, লিখছেন এবং আগামী দিনে লিখবেন তার একটা সংক্ষিপ্ত পুনরুদ্ধার করতে আমরা চেষ্টা করা হল এই গ্রন্থে।এই রূপরেখা সর্বাত্মক সম্পূর্ণ তো নয়ই।কিন্তু তার মধ্যে একটা সম্পূর্ণতার যাত্রা রয়েছে। দীপালি ভট্টাচার্য বা মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায় দুজন দু'প্রান্তের লেখক।তবু তাদের লেখার মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে।তাদের যে আখ্যান যাত্রা প্রত্যেকটি আলাদা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আখ্যানযাত্রা বলতে থাকে আমাদের সামনে।আমরা এই আখ্যানগুলোর চরিত্র নির্মাণ করার বলেছি, বলেছি সব চরিত্রদের যাত্রাপথের কথা,বলেছি দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত মানুষের যাত্রার ফলাফল ও ফসল সংকেত।আমরা জানি নারীই ফসল ফলান এবং তিনি ফসল তোলেন।ফলে এই যে লেখকরা আছেন,সেই নারী লেখকরা তাদের নিজস্ব উচ্চারণে, নিজস্ব মনোভূমির যে শাব্দিক কাঠামো সেইটাকে এক সম্পূর্ণত নতুনতর আঙ্গিকে যা পুরুষরা দেখতে পান না, দেখতে চান না বা দেখাতে চেন না,নারী তার নিজস্ব চোখ দিয়ে সেই ভুবনটিকে বারবার আবিষ্কার করে, ফলে যে আগুনের ডালপালা তৈরি হয়, তার গভীর প্রত্যন্ত যাতনায় যে আগুনের ডালপালা তৈরি হয়,ভয়ানক কষ্ট এবং বিভোর মনস্তাপের মধ্যে সেই আগুনের ডালপালাই চলে যায় সূর্য শিকারে, সূর্য ছিনিয়ে আনতে।আমরা সূর্য শিকার এবং আগুনের ডালপালা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এবার শেষ লগ্নে,লেখা যখন অন্তিম চরণে এসে পৌঁছেছে তখন আবারও স্মরণ করি ত্রিপুরার এইসব আখ্যানকারদের যারা তাদের আগুনের ডালপালাকে বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর করে খুঁজে নিতে চেয়েছেন সম্পূর্ণত অন্য এক সূর্য ভুবনকে।সেই সূর্য ভুবনের কথা,সূর্য শিকারের কতা,সূর্য সন্ধানের কথা সূর্য আহবানের কথা আমরা বারবার বলে গেলাম এই নিবন্ধের মধ্য দিয়ে। এই আলোচনা একেবারেই সম্পূর্ণ নয় কিন্তু অসম্পূর্ণতার যেটুকু সেটুকু একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়, বিভিন্ন ধরনের আখ্যান এবং আখ্যান চর্চার মধ্য দিয়ে যাত্রা কীভাবে আমরা করলাম তার ফলাফলে।আমরা আশা করব আগামী দিনে ত্রিপুরায় যারা নারী লেখকরা আছেন, তাঁরা সমানভাবে সমাজের কথা,সমাজের যে বিচ্যুতি এবং অসংগতি, ভাবনার যে বহিঃপ্রকাশে নানারকম যাতনা এবং কষ্টের যে চিত্র সেই চিত্র তারা তাদের অন্দরমহলের ভাষায় নয় বাহির মহলের ভাষাকেও তোলে ধরবেন কেননা নারী আজ শুধুমাত্র সহনশীল বৃক্ষ নন, তিনি আগুনে ডালপালা সহ তার হাত প্রশস্ত প্রসারিত করে খুঁজে দিচ্ছেন সূর্য এবং সূর্যের ভুবন জয় করছেন আকাশ। পূর্ণ আকাশের চিন্তাই নারীকে ঘিরে করা উচিত, নারী সম্পূর্ণ আকাশ,পূর্ণ আকাশ,সেই পূর্ণ আকাশের যে দিগন্ত নিশ্চিত যাপন সেখানেই সূর্য শিকারের জন্য এগিয়ে এসেছেন আগুনের ডালপালারা। আমরা তাকে স্বাগত জানাই।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in








হাসান আজিজুল হকের লেখা যত পড়ি, বিস্মিত ও শ্রদ্ধাবনত হই, কি বিশাল মাপের লেখক তিনি! নিঃসন্দেহে হাসান আজিজুল হক বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য একজন ধীমান পুরুষ। তাঁর হাতে বাংলা গদ্যসাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। বড়ো দুঃখের কথা, নভেম্বর-২০২১এ, তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে প্রয়াণের পথে চলে গেলেন!
তার সম্পর্কে প্রাবন্ধিক, গবেষক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, হাসান আজিজুল হক যে-কোনো মানদন্ডে একজন বড় গল্পকার। ...তাঁর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। সে-দৃষ্টি শাণিত হয়েছিল তাঁর বামপন্থী বোধের দ্বারা।
হাসান আজিজুল হকের চোখের সামনে লক্ষ কোটি মানুষ দেশান্তরিত ও উদ্বাস্তু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি ঘটেছে। সর্বস্ব গিয়েছে। অর্থ সম্পদ, সহায় সম্পদ চিরকালের জন্য বিনষ্ট হয়েছে, মানুষেরা নিজের আকাশ মাটি জমি থেকে উৎখাত হয়েছে, এক একটা সম্প্রদায় ভয়ানক সংকটের সন্মুখীন হয়েছে। এই ব্যাপারটা আজীবন তার বিবেককে খন্ড খন্ড করেছে, দগ্ধ করেছে! এই দেশভাগের কারণে মানুষের মর্যাদা গেছে, ইজ্জত গেছে, মানুষ হিসেবে তাদের নিম্নতম স্বীকৃতিও জোটেনি। মনে মনে এই কষ্টকর বিশ্বাসটুকু হাসান আজিজুল হককে ধারণ করে রাখতে হয়েছে, দেশভাগের একটা বিশাল মানবিক বিপর্যয় তার মনে গভীর ক্ষত তৈরী করেছে, সেটা আজীবন আরোগ্যহীন। তার লেখাতেও বার বার প্রতিফলিত হয়েছে দেশের এই দ্বিধাভক্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশের কষ্টকর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি!
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত এপার বাংলায়, বর্তমান ভারত/পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা নিজের গ্রামেই করেছেন। তিনি ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপরে সপরিবারে তাদেরকে খুলনায় উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসতে হয়। ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং এখান থেকেই দর্শণ শাস্ত্রে অনার্স গ্রাজুয়েট হন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ, ব্রজলাল কলেজ - এরকম কয়েকটি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। এর পরে তিনি, ১৯৭৩ থেকে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। ২০০৪ সালে সেখান থেকেই তিনি সুনামের সাথে অবসর নেন।
তার প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪)। এর পরে ধীরে ধীরে তার সমস্ত বইগুলো প্রকাশিত হতে থাকে – আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), লালঘোড়া আমি ( কিশোর উপন্যাস / ১৯৮৪), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), বৃত্তায়ন (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার(১৯৯৭), ছোটদের জন্যে লেখা ‘ফুটবল থেকে সাবধান’ (১৯৯৮)।
হাসান আজিজুল হকের হাতে আমাদের গদ্য সাহিত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। গদ্যের জন্যে যাঁরা ভাষা নির্মাণ করেছেন তিনি তাঁদের পুরোধা। শকুন, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, মারী, আমৃত্যু আজীবন, তৃষ্ণা, উত্তর বসন্তে, পরবাসী, শোণিত সেতু, জীবন ঘষে আগুন, জননী, ঘর ঘেরস্থি, খনন-এর মতো অসংখ্য গল্পে এই সত্য উদ্ভাসিত।
আগেই বলেছি, তার ‘শকুন’ গল্পটি সে সময়ে পাঠকমহলে প্রচুর সাড়া ফেলে। কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুনকেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রিযাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পুরো গল্পটা। একদল কিশোরের জীবন আর ভাগাড়ের মুমুর্ষু একটা শকুনের শেষকালীন সময় একই ফ্রেমে আঁটা হয়, প্রশ্ন আসে মানুষের জীবনটা কি তা’হলে এমনি শকুনেরই মতো? এই গল্পে আবার শকুনকে চিহ্নিত করা হয় সুদখোর মহাজনের প্রতিরূপ হিসেবে। এ ভাবেই মুমুর্ষু শকুনটার প্রতি কিশোরদের নিষ্ঠুর অত্যাচারটা একটা সামাজিক প্রতিশোধ, মহাজনদের বিরুদ্ধে জনতাদের একটা নির্দয় আচরণ হিসেবে এই গল্পে উঠে আসে। ‘শকুন’ গল্পটিতে ঈঙ্গিত দেয়া হয় রাতের আঁধারে নরনারীরা অবৈধ ভাবে মিলিত হচ্ছে, তার পরিণামে জন্ম নিচ্ছে বেওয়ারিস সন্তান। শকুনের মৃত দেহের পাশে, এই গল্পে আমরা দেখি পরিত্যক্ত একটি ফুটফুটে নবজাতক শিশুকে, যাকে ঠুকরে খাবার জন্যে আকাশ থেকে নেমে আসছে জীবন্ত শকুনের দল! গ্রামীন জীবনের পটভূমিকায় এভাবেই ‘শকুন’টি হয়ে ওঠে সাড়া জাগানো, একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গল্প!
হাসান আজিজুল হকের আরেকটি গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক। এই গল্পটিতে দেখি তিনজন উদভ্রান্ত বখে যাওয়া যুবক রাতের অন্ধকারে বেরিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে তারা হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের প্রত্যন্তে। তারা এসে পৌঁছায় একজন অসুস্থ বুড়োর দাওয়ায়। তাদের দীনহীন কুঠিরের আঙ্গিনায় লাগানো আছে একটা করবী গাছ। বখে যাওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন যুবকের পকেটে আছে চুরি করে আনা টাকা - মাত্র দুটো করে টাকা। সেই টাকা বুড়ো বাপটাকে দিয়ে ওরা দুজনে রুকুর শরীর ভোগ করবে। এই রুকুই অসুস্থ বুড়ো বাপের মেয়ে, একমাত্র অবলম্বন। কত নিরুপায় হলে বাপ চোখের সামনে নিজের মেয়েকে অন্য ছোকরাদের সাথে শুতে পাঠায় তা বোঝা যাবে গল্পের পরিণতিতে। বুড়ো বাপটা বলছে – ‘এখানে যখন এলাম ... আমি একটা করবী গাছ লাগাই, বুঝলে? ... বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ বিষকে খুঁজে নেয়ার তাড়নায় বুড়োর অসহায় উদ্বাস্তু জীবনের কান্নাগুলো যখন হু হু করে বেরিয়ে আসে – ঠিক তখনই কুঠিরের ভেতরের ঘরে তার মেয়ে রুকুর শরীর বিক্রি হচ্ছে দুদুটো বখাটে ছিন্নমূল যুবকের কাছে – মাত্র দু দু টাকার বিনিময়ে!
তার লেখা বিভিন্ন গল্পের বিশ্লেষণের নিরিখে, আমাদের এপার বাংলার পরিচিত গল্পকার সাধন চট্টোপাধ্যায়ের কিছু মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের কথাকার হাসান আজিজুল হকের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন – “লেখকের আখ্যান নির্মাণের টেকনিক্‌টি সরল ভঙ্গির। কোনো জটিলতা বা মারপ্যাঁচ নেই। অথচ, শব্দ নির্মাণে, বলবার ভঙ্গিতে, বিমূর্তকে বিশেষণ যোগে আকৃতি দিতে এবং অদ্ভুত নৈর্ব্যক্তিকতায় পাঠকের হৃদয় ও বুদ্ধিকে আমূল শলাকাবিদ্ধ করতে, হাসানদার জুড়ি মেলা ভার। ঘটনায় তেমন সাসপেন্স নেই, রগরগে যৌনতাকে লেখক আখ্যানে আহ্বান জানান না ...... - তবুও আখ্যানের চোরাটানে সর্বক্ষণ পাঠককে কৌতুহলে টানটান থাকতে হয়। এটা আমি তার প্রথম পর্বের গল্প ‘শকুন’ থেকেই লক্ষ্য করেছি।
দ্বিতীয়ত, তার গল্পে প্রকৃত অর্থে কোনো ‘গল্প’ বা জমজমাট ঘটনা নেই, যা পাঠক পড়ে অন্যকে শোনাতে পারে। যদি শোনাতে চায় – একটি বা দুটি বাক্যে শেষ হয়ে যাবে।” [শুভশ্রী, বাংলাদেশের গল্প/গল্পকার সংখ্যা – ২০১৭-১৮ সাল।]

তার ‘আগুনপাখি’(২০০৬)উপন্যাসটি খুবই বিখ্যাত, এতে তার শৈশবের গ্রাম, পরিবার আর তার মায়ের কথা তিনি তুলে এনেছেন। এই হৃদয়গ্রাহী বইটা পড়লে বোঝা যাবে, তিনি ও তার পরিবার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা দেশের বিভাজন কোনো মতেই মেনে নিতে পারেন নি। ‘আগুনপাখি’র পর তার অন্য প্রকাশিত উপন্যাসগুলো – শিউলি (২০০৬), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩)।
হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনী মূলক লেখা ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ (২০০৯) ও ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২০১১)।
কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। এর মধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার, ইত্যাদি আরো অনেক। এছাড়া ১৯৯৯ সালে 'একুশে পদক'এ ভূষিত হন হাসান আজিজুল হক। ভারতবর্ষে 'আগুনপাখি' উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার।
হাসান আজিজুল হকের কথা উঠলেই আমার সামনে একটা অগ্নিদগ্ধ পাখির চেহারা ফুটে ওঠে। তার ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে স্তব্ধ হয়ে যাই। এখানে তিনি লিখেছেন স্বাধীনতা-পূর্ব একটি গ্রাম জীবনের চলমান চালচিত্র। ‘আর হুজুগের শ্যাস নাই।..... মাঠে ঘাটে ছেলে-ছোকরারা গাইছে, সারেগামাপাধানি, বোম ফেলেছে জাপানি।...... জাপানিরা বোমা ফেলবে এই হুজুগ ওঠার পর থেকে অ্যাকন আবার লোকে পেরায় সব সোমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।’ [আগুন পাখি / দে’জ পাব্লিশিং / মে ২০০৮ সংস্করণ / পৃষ্ঠা – ১৫৯-১৬০]
যুদ্ধ আর আকাল হাত ধরাধরি করে চলছে। মানুষদের কি দুর্বিসহ অবস্থা। কোনটা আগে? আনহারে মৃত্যুর ভয়, নাকি যুদ্ধের আঘাতে মৃত্যু? আকাশে ঘন ঘন হানা দিচ্ছে বোমারু বিমান। ওদিকে অনাহার, দুমুঠো খাবারের সংস্থান নেই। কোথাও কোথাও যুদ্ধের চাইতেও ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা।
দেশব্যাপী এই আকালের কথা তার উপন্যাসে কতোগুলো করুণ ছবি রেখে গেছে। যেমন - ‘আক্‌লি’ একটি দরিদ্র গ্রামের মেয়ে, তার পরিবারে কেউ নেই। সে তার বুড়ি দাদির সাথে থাকে। ঘরে খাবার নেই। কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছে। ক্ষুধার তাড়নায় এই আক্‌লি বৃষ্টি দিনে, অর্দ্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় অন্যের ঘর থেকে পান্তাভাত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। লেখকের কলমে তার কি নির্মম বর্ণনা! - ‘একবার যেন মনে হলো খিড়কি-পুকুরের কোনের বাড়ি থেকে পানি দিয়ে তৈরি একটো মেয়ে বেড়িয়ে এল। পানির ভেতর দিয়ে ছপ ছপ করে হাঁটছে। ...... আক্‌লিই বটে। বিয়ে হয় নাই, এক বুড়ি দাদি ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই তার। ভেজা জবজবে মোটা একটো চট বুক থেকে পা পর্যন্ত ডান হাত দিয়ে ধরে আছে। খেতে পায় না, তবু এত বড় বড় দুটো বুক ক্যানে যি তার, কি কাজে লাগবে আল্লা জানে! অমন করে চটটো হাত দিয়ে ধরে আছে মেয়েমানুষের শরম বাঁচাইতে কিন্তুক তবু ঢাকা পড়ে নাই ওই পব্বতের মতো বুক। বাঁ হাতে মাটির শানকি ভরা বাসি ভাত, তার আদ্দেক গলা। এক শানকি ভাত। হেঁশেলে ভাতের হাঁড়িতে গত রেতের পানি দেয়া যা ভাত ছিল তা বোধ হয় সবটাই নিয়েছে শানকি ভরে।
আমরা দুজনা মুখোমুখি তাকিয়ে থাকলম। ...... কতক্ষণ বাদে আক্‌লি ফিসফিস করে বললে, তিনদিন তিনরাত কিছুই খাই নাই, দাদি ঘরেই আছে, বোধায় আজ মরতে পারে।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ১৬৮-১৬৯]
ভারত পাকিস্থান দেশ বিভাগের জন্যে কারা দায়ী? কোন মতে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষ, যারা অর্ধ উলঙ্গ, যারা লতা পাতা শামুক গুগলি খেয়ে বেঁচে আছে? সত্যি কথা বলতে কি – এইসব সাধারণ প্রান্তিক মানুষদের কল্পনায় দেশ বিভাগের কথা আসে না! এই দেশ বিভাগের ব্যাপারটা রাজনৈতিক নেতা, বড়ো বড়ো মানুষদের মস্তিষ্কপ্রসূত। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের আক্ষেপটা তার উপন্যাসে বার বার খেদোক্তি হয়ে উঠে আসে – ‘হিঁদু-মোসলমান সম্পক্ককে বিষ বিষ করতে হবে ক্যানে?’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২১৬] কিংবা
‘আর য্যাত লড়ালড়ি, খুনোখুনি হচে তো শুদু হিঁদু-মোসলমান বলে। এক হিঁদু মায়ের পুতকে মারছে একজনা মোসলমান আবার এক মোসলমান মায়ের পুতকে মারছে একজনা হিঁদু। আঃ হায়রে! মানুষ লিকিন বুদ্ধিমান পেরানি।’[ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২১৯]
দেশ বিভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুরা ভারতে আসছে। তার উল্টোটাও হচ্ছে। আগুনপাখি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে ভারতে বসবাসকারী হাসান আজিজুল হকের নিজের মা-এর কথা উঠে এসেছে। জাতিতে তারা মুসলমান। জাতি দাঙ্গা ও উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পরিবারের সবাই ধীরে ধীরে একে একে নিজেদের আজন্ম লালিত ঘর বাড়ি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্থানের এক নতুন পরিস্থিতি, হয়তো বা কোন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে যাচ্ছে, চলে যেতে হচ্ছে। কিন্ত আগুনপাখি উপন্যাসের সেই একজন ‘মা’ গোঁ ধরে বসে আছে! কেন সে নিজের দেশ ছাড়বে? এই একজন ‘মা’র দুর্দান্ত কথাবার্তা ও উদ্বেগভরা প্রশ্ন হাসান আজিজুল হকের উপন্যাসের মূল মর্ম বস্তু। তারই কিছুটা বইএর পাতা থেকে তুলে দেয়া যাক –
‘একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২৪৯]
‘তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়।’ [ পূর্বোক্ত / পৃষ্ঠা – ২৫২]
মানবিক বোধে উজ্জীবিত হাসান আজিজুল হক আদপেই কোনো সংকীর্ণ স্বাদেশিক ব্যাক্তিত্ব নন। তার নিজস্ব বামপন্থী বিশ্বাসই তাঁকে আন্তর্জাতিক করেছে। জীবন কেমন তা তিনি দেখেছেন; কেমন হওয়া উচিত ছিল, তা উপলব্ধি করেছেন। এমনি ভাবেই তার ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছিল স্বপ্ন, জন্মেছিল ক্রোধ, জাগছিল পরিহাস-প্রবনতা। তাঁর বিভিন্ন লেখায় আমরা দেখি মার্কসবাদী দার্শনিকতা, যদিও নিজেকে তিনি মার্কসবাদী লেখক হিসেবে কখনো দাবী করেন নি।
অসামান্য লেখক হাসান আজিজুল হককে সামান্য যেটুকু বুঝেছি, এই নিবন্ধটির মধ্যে তারই অল্পস্বল্প কিছু উল্লিখিত হয়েছে। লেখার পরিসমাপ্তিতে একটি সাক্ষাৎকারে নেয়া লেখক হাসান সাহেবের নিম্নোক্ত ভাবনাটুকুর উল্লেখ করতে চাই – ‘ধর্মীয় গোড়ামী ও কুসংস্কার সব কিছুরই অন্তরায়। সবচে’ কঠিন এবং সবচে’ পশ্চাদমুখী গোড়ামী হচ্ছে ধর্মীয় গোড়ামী। এটা মানুষের বৃদ্ধিও বন্ধ করে দেয়। সমাজ সভ্যতার গতিকে স্থবির করে দেয়।’[তথ্যসূত্র – সাক্ষাৎকার : প্রকৃতি ও মানুষের কবি হাসান আজিজুল হক - ইকবাল হাসান / গল্পপাঠ ব্লগ]
পরিশেষে জোর দিয়ে বলতে চাই, আজকের কিছু অসুস্থ মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দিনে হাসান আজিজুল হক ভীষণ ভীষণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in










বিমল কর (১৯২১-২০০৩) এর যাত্রাশুরু ছোটগল্প দিয়ে অন্য সব খ্যাতিমান লেখকদের মতই। ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ তাঁর প্রকাশিত প্রথম ছোটগল্প। ছোটগল্পের পথ ধরে তিনি উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়ে এক সময় বাংলা গল্প- উপন্যাস সাহিত্যে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রাখেন।
বাংলা সাহিত্যের গল্প-উপন্যাসের ব্যতিক্রমী ধারার শিল্পী হওয়ার পেছনে ইতিবৃত্ত জানতে হলে আমাদেরকে মানুষ বিমল কর এর ব্যক্তি জীবনের প্রতি অবশ্যই আলোকপাত করতে হয়।
বিমল কর এর জন্ম ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগণা জেলার টাকির কাছের এক গ্রামে। তাঁর শৈশব আর কৈশোর কাটে টানা পোড়েনের মাঝে। কলেজ জীবনে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ছোটবেলা ও কিশোরবেলা কেটেছে ধানবাদ, আসানসোল, কালিপাড়ায়, বরাকর, কুলটি অঞ্চলে। তাঁর ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কেটেছে নিঃসঙ্গতায় আর পড়াশুনোয়। তাছাড়াও অসুস্থতা তার ছোটবেলায় নিত্যসঙ্গী হওয়ায় বিড়ম্বনার শিকার তাকে কম হতে হয়নি। কলকাতায় পড়াশোনাকালে তাঁর জীবনে অস্থিরতা কম ছিল না। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও ডাক্তারী পড়া হয়ে উঠেনি তাঁর। তিনি মেডিকেল কলেজ ছেড়ে শ্রীরামপুর টেক্সটাইল কলেজে ভর্তি হয়েও তা ছেড়ে দিয়ে শেষে ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে। ছাত্রজীবনের টানাপোড়েনের মাঝে তার জীবনে বন্ধুবান্ধব, বই, যাত্রা-নাটক ও সিনেমা জায়গায় করে নেয়। কলেজে পড়াকালে তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন এবং সম্পৃক্ত হন লিটিল ম্যাগ প্রকাশনার সাথে। এক সময় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিমল যোগদান করেন এ.আর. পি তে। তারপর আসানসোলে অ্যামিউনিশন প্রেডাকশন ডিপোতে। সেখান থেকে কাশীতে রেলের অ্যাকাউন্ট হিসেবে যোগদান করেন। তারপর এক সময় এলো যখন তিনি সবকিছু ছেড়েছুড়ে যোগদান করলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়।

প্রায় আটাশ বছর ‘দেশ ‘পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর প্রতিষ্ঠা পাবার পথ সুগম হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের গল্প-উপন্যাসের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে সংযুক্ত হবার পরে তিনি বাংলাসাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক-লেখিকাদের লেখার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হলেন। তার ফলেই তিনি গল্প-উপন্যাসের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে নতুন রীতির নিরীক্ষাধর্মী লেখাতে সচেষ্ট হন। গ্রামজীবন থেকে উঠে আসা একটা মানুষ কলকাতার জীবনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেও গ্রামজীবনকে ভুলতে পারেনি, ভুলতে পারেনি তিনি তাঁর ছোটবেলার কিশোর জীবনকে। বিমল কর তাঁর লেখা ছোট গল্প-উপন্যাসে গ্রামের মানব-মানবী, গাছপালা বৃক্ষলতা আর প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা নানা অনুষঙ্গকে গভীর মমতায় তুলে এনেছেন, যাতে লেখকের গভীর অর্র্ন্তদৃষ্টি, মেধা মনন ও চিন্তা চেতনার আভাস ফুটে উঠেছে। বিমল কর তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মে জীবন জিজ্ঞাসাকে উপস্থাপন করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। মানুষের অন্তরের কথা তিনি তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসে কতটা গভীর মমতায় তুলে এনেছেন তা দেখার জন্য আমরা তাঁর লেখা কয়েকটি ছোটগল্পের ওপর দৃষ্টিপাত করতে পারি।

বাংলা গল্পসাহিত্য নবতর মাত্র পেয়েছে বাংলা সাহিত্য জগতের বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান গল্পকারের লেখা নিরীক্ষাধর্মী ব্যতিক্রমধর্মী ধারার গল্পের মাধ্যমে একথা না বললেই চলে নয়। জগদীশ গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী প্রমুখ বাংলা ছোটগল্প নির্মাণে নবতরমাত্র যোগ করেন ,যা বোদ্ধা ও মনোযেগী পাঠকদের অজানা নয়। বিমল করের লেখায় নিঃসন্দেহে তাঁর অগ্রজ ওই সব লেখকদের রচনার ছায়া অবশ্যই কোন না কোন ভাবে পড়েছে। তবে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় বিমল কর শুধুমাত্র তাদের রচনার অনুপ্রেরণা থেকেই দায়সারা গোছের লেখালেখি করে খান্ত হননি।

বিমল কর তাঁর লেখা গল্পে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছেন মনস্তাত্তি¡ক অনুষঙ্গে। তাঁর ছোটগল্পের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলতে হয় তাঁর প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ গল্পে ভদ্রসমাজের নৈতিকতার মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। একটা খৃষ্টান মেয়ে চরম অসহায় অবস্থায় পড়ে এক পর্যায়ে একজন আলুর দোকানদারকে বিয়ে করে আত্মনিগ্রহের শিকার হয়। এ গল্পে গল্পকারের অন্তর্মুখিতার আভাস প্রথম থেকেই পাওয়া যায়। বিমল কর এর অনেক লেখাতে অন্তর্মুখিতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান তা আমাদের এ আলোচনায়ই উঠে আসবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে বিমল কর নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি মূলত ইন্ট্রোভার্ট লেখক এবং আমার লেখার বিষয়ও অনেক সময় কোন মানুষের আত্মসমস্যা ও দার্শনিক জিজ্ঞাসা থেকে দেখা।’

বিমল কর এর লেখা নাম করা গল্পের মধ্যে মানবপুত্র, বসন্তবিলাপ, বালিকাবধূ, পিঙ্গলার প্রেম, বন্ধুর জন্য ভূমিকা, নিরুদ্দেশ যাত্রা, আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন, পলাশ, বকুল গন্ধ, উদ্ভিদ, অলৌকিক বিষণ্ণ, জননী, নিষাদ, সংশয়, উদ্বেগ, কাঁচঘর, সোপান, আঙুরলতা, নিগ্রহ, সে, শীতের মাঠ, সত্যকাম, কামকামিনী, ফুটেছে কমলকলি, নদীর জলে ধরা ছোঁয়ার খেলা, উপাখ্যানমালা ইত্যাদি।
বিমল কর-এর নিরীক্ষাধর্মী গল্প ‘আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন’। এই গল্পে লেখক নারী সংসর্গজাত অনুভূতির বিচিত্র নিরীক্ষা উপস্থাপন করেছেন। শিবানীকে ঘিরে চারজন পুরুষ, তিনজন প্রেমিক আর একজন তার স্বামী ভুবন। তিন প্রেমিক শিবানীকে যেভাবে পেয়েছিল চতুর্থজন তার স্বামী ভুবন তাকে সেভাবে পায়নি। তিনজন পুরুষের যে সমস্যা চতুর্থ পুরুষ তার স্বামী ভুবনের সমস্যা আলাদা। শেষ পর্যন্ত শিবানীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তিন প্রেম বিলাসী বন্ধুর সামনে ভুবনের কর্তব্য নিষ্ঠা ও প্রেমের শুদ্ধতার একটা সম্ভাব্যরূপকে যেন অনায়াসেই তুলে ধরছেন বিমল কর। শিবানীর মৃত্যুতে স্বামী ভুবনের মাঝে যে শুদ্ধতা নেমে আসে তা দেখে মনে হয় সে অন্য আর এক ভুবন।

বিমল কর এর উপন্যাস লেখার ভিত রচিত হয় তার লেখা অনেক গল্প থেকে, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় তাঁর ‘সুধাময়’ গল্পের মতো গল্প থেকেই তিনি উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ হন। এই গল্পের নায়কের আত্ম-অন্বেষণের ভঙ্গিটিই বিমল কর এর অনেক উপন্যাসের নায়কের চরিত্রে ফুটে তুলেছেন । বিমল মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচনা করেন অপেক্ষা, সংশয়, উদ্বেগ, আঙুরলতা, কাঁচঘরের মতো গল্প। আঙুরলতা তাঁর বিখ্যাত গল্প, বহুল পঠিত ও বহুল আলোচিত। আঙুরলতা গল্পে পতিতা আঙুরলতার সাথে নন্দর সম্পর্কটা প্রেমভালবাসা আর ঘৃণায় মেশানো। মনস্তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেই একজন গল্পকার আঙুরলতার মতো গল্প লিখতে পারেন।

বিমল কর এর দু’একটা গল্প-উপন্যাস পড়ে তাঁকে বিষণœ লেখক হিসাবে ভেবে নেবার অবকাশ নেই। তাঁর বেশ কিছু গল্পে বিষণœতা বিশেষ অনুষঙ্গে উঠে এলেও তা নিঃসন্দেহে বাস্তবতা বর্জিত নয়। যেমন তাঁর শীতের মাঠ গল্প পড়ে মনে হবে বিষণœ মৃত্যু ভয় তাড়িত স্বামীর প্রেম শুদ্ধতায় উত্তীর্ণ। তিনি যে শুধু বিষণœতার অনুষঙ্গে গল্প লেখেননি তার উদাহরণ ‘সুখ’ গল্পটি। তাঁর লিখেছেন বাস্তবতা অভিজ্ঞতার আলোকে। গত শতকের ষাট শতকের পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে যে অস্থিরতা দেখা দেয় তার ছাপ আমরা লক্ষ্য করি তাঁর লেখা ‘নিগ্রহ’ ও ‘সে’ গল্পে। নব্বই দশকে প্রকাশিত ‘উপাখ্যানমালা গল্প সংকলনে পাঁচটি গল্প ‘সত্যকাম’, ‘কাম কামিনী’, ‘ফুটেছে কমল কলি’, ‘নদীজলে ধরা ছোঁয়ার খেলা।’ উপাখ্যান। বিমল কর নব্বই দশকে লেখা গল্পগুলোতে নতুনমাত্রা যোগ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ পর্বের গল্পগুলোতে লৌকিক অনুষঙ্গের বাতাবরণ সৃষ্টি করলেও আধুনিক মন কিংবা মানসিকতার পরিচয় উপস্থাপন করেছেন। এখানে ‘ফুটেছে কমল কলি’ গল্পের কিছু কথা তুলে ধরা যেতে পারে। বিমাতার মেয়ে কনক খুব ভালবাসে নীলকমলকে, সে তা বুঝতেই দেয়নি নীলমণিকে। সংস্কারই তাকে বোধশক্তিকে প্রতিহত করেছে। দোলের উৎসবের দিন বিমাতা ইন্দু নীলমণিকে বলে বসে, ‘ওই মেয়ের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক নেই, ওর বাবা তোমার বাবা নয়।’

বিমল কর এ গল্পে ভালবাসার অনুষঙ্গ কত গভীর মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন তা দেখতে গেলে এ গল্পের পরবর্তী অংশ উদ্ধৃত করতে ‘নীলমণি নানা ভাবে এর মাঝেই চেষ্টা করেছে কনককে বিয়ে দেবার। কিন্তু কনকের বিয়ে হয়নি। দোল পূর্ণিমার উৎসবে চলে যায়। এক বন্ধু ইন্দ্র নীলমণির চোখ খুলে দেয়। চশমা পরা থাকলে দেখা যায় না এমন একটা ইঙ্গিত দিলে নীলমণি বলে, “চশমা তো আমি পরি না।, ইন্দরদা।” ইন্দরদা বলে, “ওটা ঘসা কাঁচের চশমা। তোমার চোখ দুটো ওই রকম ছিল। অন্ধ তুমি। কাছের জিনিস দেখার চোখ তোমার ছিল না।” ইন্দ্র নীলমণিকে বুঝিয়ে দেয় “দেখ তারা সমুদ্রমন্থন করে অমৃত তুলতে চেয়েছিলেন। ভালবাসাও যে মন্থন করে তুলতে হয়গো।” আগের ভালবাসার স্বরূপটি ধরে দিতে চেয়েছিল সে নীলমণির মধ্যে: “ভালবাসার তত্ত¡টি দেহ থেকে আসে। মুশকিলটা কোথায় হয় জান? ভালবাসা যখন দেহ ছাড়া আর কিছু দেখে না- তখন সেটি কাঁচা ভলোবাসা।” ইন্দ্রের মুখ দিয়ে লেখক যে কথাটি বলেছেন তার মাঝে একটা দুর্লভ অনুভব লুকিয়ে আছে তা পাঠকের বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। বিমল কর অন্যধারার গল্প ও লিখেছেন সে প্রসঙ্গের আগে তার উপন্যাসের ওপর স্বল্পপরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে তিনি ছোটগল্প লেখার মাঝ দিয়ে এক সময় নতুন মাত্রার উপন্যাস লিখে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নিজের পারঙ্গমতার পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়। তার লেখা উপন্যাসগুলোর নাম এখানে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি। ‘অপরাহ্ন’, ‘যদুবংশ’, ‘দেওয়াল’ (১৯৫৬), ‘সান্নিধ্য’ (১৯৭৩) প্রচ্ছন্ন (১৯৭৭) ‘নিমফুলের গন্ধ’ (১৯৮৬) ‘খোয়াই’, ‘অসময়’ (১৯৭৩), ‘শমীক’ (১৯৯৫) ‘ত্রিপদী’, ‘নতুন তারা’ (১৯৮৯) ‘এক অভিনেতার মৃত্যু’ (১৯৯২) ‘ভুবনেশ্বরী’, ‘খড়কুটি’, ‘পূর্ণ’, ‘অপূর্ণ’ ইত্যাদি। বিমল কর এর উপন্যাস ‘অসময়’ ১৯৭৫ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার লাভ করে। তাঁর লেখা উপন্যাস গুলোর মধ্যে দেওয়াল ও অসময় বাদ দিলে ছোট উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি। তিনি ছোট উপন্যাস লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন তা তিনি নিজেই বলেছেন, “বেশির ভাগ উপন্যাস ঝযড়ৎঃ ঘড়াবষ-এর অর্ন্তভুক্ত। আসলে আমি সে ধরনের উপন্যাস লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যা বিশেষ একটা ধারণাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। আর এগুলো আকারে ছোট হলেও অনেকক্ষেত্র বিষয়গত ভাবে খানিকটা জটিল।”

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






















গের্টের মতে অবশ্য পড়াশুনার পিছনে এত সময় দেওয়া একেবারে অর্থহীন, যদি কেউ সঙ্গীত নিয়েই ভবিষ্যতে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করে। তাছাড়া রাত্তিরে তো মানুষের ঘুমানো উচিত। না ঘুমিয়ে পড়াশুনা করা ঠিক কাজ নয়।

“তুমি আবিটুয়োর* দিচ্ছই বা কেন?” গের্ট প্রশ্ন করে। কিন্তু বের্নহার্ড তার বাবার জন্যই স্কুলে পড়াশুনা করছে। তার বাবা তাকে অনুরোধ করেছেন স্কুলে গিয়ে ভালোভাবে পড়াশুনা করবার জন্য। এক্ষেত্রে তার কোনটা ভালো লাগে, সেটা বড় ব্যাপার নয়। হ্যাঁ, এরকম মনে হতে পারে যে কারো যে বের্নহার্ড অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ। সে দুনিয়ার সামনে এটা প্রমাণ করে দিতে চায় যে তার বহুমুখী প্রতিভা আছে। গের্টের স্বভাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষাযুক্ত অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে হাসিতামাশা করতে থাকে। অবশ্য তার প্রচুর টাকাকড়ি আছে, গাড়ি আছে, ইনেসের মত বান্ধবী আছে বলেই সে এমন করে, ব্যাপারটা এতখানি সহজ সমীকরণ দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে গের্ট প্রায়শই ভীষণ রকমের তিক্ত আত্মসমালোচনায় ডুবে যায়। কারণ, তার একমাত্র উৎসাহ আছে ছবি আঁকার ব্যাপারে, যেটা সে খুব মন দিয়ে করে এবং অবশ্যই তার প্রতিভাও আছে শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে। কিন্তু তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সেরকম কোনো সহায়তা এই বিশেষ ব্যাপারে সে পায় না; তার বাবা মা চান যে সে একজন নামিদামি পেশাদার হোক। সেইজন্য সে আইনশাস্ত্র পড়বে বলে ঠিক করেছে; যদিও এক অদ্ভুত উদাসিনতা আছে তার এই বিষয়ের প্রতি। খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসব নিয়ে ভাবতে চায় না সে। ক্লাসে খুব কম দেখা যায় গের্টকে। বরঞ্চ সে আঁকাজোকা করে সময় কাটায়। এই পরিস্থিতিতে এটা খুব অস্বাভাবিক নয় যে গের্ট তার তরুণ বন্ধু বের্নহার্ডের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ নিয়ে শুধু যে উদাসীন, তাই নয়, সে অংশত বের্নহার্ডের সমালোচক। অন্যদিকে সে নিজে শিল্পের অভ্যাস করে গোপনে। ফলে সে সর্বদা সন্দিগ্ধ বোধ করে যে তার এই অভ্যাস আদৌ সঠিক কিনা। অর্থাৎ নিজের প্রতিভার বিষয়ে তার দ্বিধা আছে; নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সে এবং এই ভাবটা সে সবসময় তার বলিষ্ঠ এবং কিছুটা উদ্ধত আচরণের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এমনিতে সে খুবই মিত্রভাবাপন্ন; বের্নহার্ড এবং ইনেস তার কাছের মানুষ। বিশেষত ইনেস অন্য অনেকের চেয়ে গের্টকে বেশি চেনে। তার খিটখিটে মেজাজ, অতি সূক্ষ্ম মেয়েলি ধরনের সংবেদনশীলতা, যার ফলে সে নিজেই বেশি কষ্ট পায়, গের্টের এই ব্যাপারগুলো ইনেস জানে এবং গের্টকে ঠিকভাবে সামলাতেও জানে সে। বের্নহার্ড গের্টকে বেশ পছন্দ করে এবং তাদের এই বন্ধুত্ব তাকে খুশি রাখে। কিন্তু গের্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। গের্ট বের্নহার্ডকে একটু অদ্ভুতভাবে পছন্দ করে। বের্নহার্ডের সৌন্দর্য এবং তারুণ্য তাকে স্পর্শ করে। বের্নহার্ড পাশে থাকলে সে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। বের্নহার্ডকে সামনে বসিয়ে তার ছবি আঁকতে ভালবাসে সে। দুনিয়ায় আর কোনো কাজ সে এত ভালবাসে না। প্রতি শনিবার বের্নহার্ড এবং ইনেসকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবার রুটিনটা তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি! প্রথম দিকে গের্টের সঙ্গে বের্নহার্ড শনিবার ডিনারের পর দেখা করতে যেত এবং গের্ট তার ছবি আঁকত। কিন্তু স্থির হয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকাটা তার ভীষণ একঘেয়ে লাগবার পরে সে প্রস্তাব দেয় যে গের্ট তার এখানে আসতে পারে এবং যখন সে পিয়ানো অভ্যেস করবে, তখন ছবি আঁকতে পারে। তাহলে তাদের কারো সময় সেভাবে নষ্ট হবে না। সেই থেকে গের্ট প্রায়ই আসে বের্নহার্ডের কাছে। বের্নহার্ডের ঠাকুমাও গের্টকে বেশ পছন্দ করেন, কারণ সে যথেষ্ট বিচক্ষণ এবং আদবকায়দাদুরস্ত যুবক। প্রায়ই সে ঠাকুমার আমন্ত্রণে ডিনার খেয়ে তারপর ফেরে।

ছবি আঁকবার সময়ে গের্ট এমন কিছু মন্তব্য করে মাঝে মাঝে, যে বের্নহার্ডের অস্বস্তি হয় একটু একটু। সে প্রায়ই তাকে বলে, ‘বের্শেন, তোমার মাথার গড়নটা ভারি সুন্দর!’ শুনে বের্নহার্ড লজ্জা পায়, চোখমুখ লাল হয়ে যায় তার, চোখ নামায় সে, ভুলভাল পিয়ানোর চাবিতে হাত পড়ে। সেটা লক্ষ্য করে একবার গের্ট উঠে দাঁড়িয়ে, কাছে এসে বের্নহার্ডের মাথাটা ধরে রেখেছিল নিজের দুই হাতে। ‘সুন্দর হওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই’ বলেছিল সে। বের্নহার্ড অন্যদিকে তাকাবার চেষ্টা করছিল। গের্ট তুলে ধরেছিল তার চিবুক। আলতো করে ধীরে ধীরে চুম্বন করেছিল তার ঠোঁটে।

শনিবার কোনও ছবি আঁকার ব্যাপার থাকে না। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বের্নহার্ড অপেক্ষা করে কখন এসে গের্ট গাড়ির হর্ন বাজাবে। ঠাকুমা সমানে বলতে থাকে যেন গের্ট ধীরেসুস্থে গাড়ি চালায়, যেন বের্নহার্ড সন্ধ্যাবেলায় বাবা মায়ের কাছে যাবার ট্রেন মিস না করে। বের্নহার্ড প্রতি শনিবার বাবা মায়ের কাছে যায়। এই অভ্যাসটা সে একেবারেই বদলাতে চায় না। যদিও সেটার জন্য গের্টের লং ড্রাইভের আমন্ত্রণ রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে লং ড্রাইভে যেতে না পারার ব্যাপারটাও তার কাছে সুখকর নয়। কারণ, প্রিয়বন্ধুদের সঙ্গে গ্রীষ্মে গ্রামের পথ দিয়ে লং ড্রাইভে যেতে তার খুব ভালো লাগে। বিশাল লিনডেন গাছের নিচে বসে গ্রামের কোনো ছোট সরাইখানায় বসে মহাভোজ, তারপর সরাইয়ের ধবধবে সাদা সদ্য কাচা মাড় দেওয়া চাদরের খসখসে বিছানায় রাতে ঘুমিয়ে ভোরবেলায় জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় এবং আঙিনায় ফোয়ারার জলের শব্দে ঘুম ভেঙে ওঠা… সে এক ভারি সুন্দর অভিজ্ঞতার সঞ্চয়।

কিন্তু এখন আপাতত শনিবারের বিকেলটুকুই তার সম্বল। তার বেশি সময় সে বন্ধুদের সঙ্গে কাটাতে পারবে না। তারপর সন্ধের মধ্যে গের্ট তাকে শহরে পৌঁছে দেবে যাতে সে স্যুটকেস এবং ফাইল নিয়ে লক্ষ্মীছেলের মত ট্রেন ধরে যেতে পারে বাবা মায়ের কাছে। ‘লক্ষ্মীছেলে’ উপমাটা অবশ্য গের্টের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। তবে অবশ্যই বের্নহার্ডকে বন্ধু হিসেবে সে হালকা ইয়ার্কি করেই থাকে। অতিরিক্ত মাত্রায় উত্যক্ত কিম্বা বিরক্ত করা গের্টের উদ্দেশ্য নয়।

বের্নহার্ড লক্ষ্য করেছে যে গের্ট খুবই সময়ানুবর্তী। একচুল এদিক ওদিক হয় না তার সময়ের। তাকে নিতে এসে সে এত জোরে গাড়ির হর্ন বাজায় যে বের্নহার্ডের ঠাকুমা ঘাবড়ে যান, উদ্বিগ্ন বোধ করেন। সেইজন্য গের্ট আসবার আগে থেকেই তিনি বের্নহার্ডকে তাড়া দিতে থাকেন তৈরি হয়ে নেবার জন্য, বলেন যে বন্ধুদের একদম অপেক্ষা করানো উচিত নয়। বের্নহার্ড সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে সোজা গাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়, কারণ গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। কিন্তু গাড়িতে বসে তার খেয়াল হয় যে ফাইলটা সে ফেলে এসেছে ঘরে। এখনই একদৌড়ে নিয়ে আসবে সে। কিন্তু গের্ট বলে ওঠে,

‘ধুত্তোর, কাজ ছাড়াও মানুষের খুশি থাকা উচিত, বুঝলে হে ফ্যাকাশেমুখো!’ বলে সে বের্নহার্ডের হতাশ মুখচোখের অভিব্যক্তির দিকে পেছনে না তাকিয়েই ধাঁ করে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যায়। ইনেস তার বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ভারি সুন্দর হালকা রঙের একটা কোট আর দস্তানা পরেছে সে। তার সামনে ফ্লক। ফ্লকের গলায় বাঁধা বেল্টের প্রান্ত ইনেসের হাতে।



(চলবে)




*আবিটুয়োর –(Abitur) জার্মানির উচ্চবিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের প্রধান পরীক্ষা।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৫.২

মোটা লোকটা ফিরে এসেছে। এসেই সিং সাহেবের হাতে পঁচিশ টাকা গুঁজে দিয়েছে। সব এক টাকার নোট। সায়েব নিজের বক্তিমে থামিয়ে পুরো টাকা একটা একটা করে গুণে দেখলেন। একটা ময়লামতন নোট বদলে নিলেন। তারপর টাকা পয়সা ভেতরের ফতুয়ার পকেটে হালকা হাতে গুঁজলেন।

রঙ্গনাথ এতক্ষণ ওনাকেই দেখছিল। উনি বললেন,” দেখছ তো অবস্থা! আগে লোকে যেই টের পেত হাকিম ঘুষ নিচ্ছে , অমনি হাজার লোক জুটে যেত, ওনাকে ঘিরে দাঁড়াত, টাকাপয়সা দিত, আবার কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলত না। এখন কেউ ধারে কাছে আসে না। যদি কেউ আসেও, সে এই রূপ্পনবাবুর মত কাউকে ধরে আনে। দয়াদাক্ষিণ্যে মামলা বিগড়ে যায়”। তারপর উনি রূপ্পনকে বোঝাতে লাগলেন।

--“ দীনানাথ তহসীলদারের সঙ্গে কী হয়েছিল? জানেন কিছু? কখনও বৈদ্যজীর থেকে জেনে নেবেন। চারটে মাস আপনাদের শিবপালগঞ্জে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। কেউ একটা কানাকড়িও ঠেকায়নি। তখন একদিন এজলাসে বসেই গরম হয়ে উঠলেন। দু-চারজন উকিল সামনে দাঁড়িয়েছিল। তাদের শুধোলেন—ব্যাপারটা কী? পাবলিক কী ভেবেছে আমি টাকায় হাত লাগাই না? বেশ, তাহলে আপনারা পুরো তহসীলের এমাথা থেকে ওমাথায় ঘোষণা করে দিন –হ্যাঁ, আমি ঘুষ নিই, কেউ যেন ধোঁকা না খায়!

“ এটাও লোকে ঠাট্টা ধরে নিল। ওনার মুখের ভাবই এমন যে সবার মনে হয়ত—সাচ্চা আদমী। কেউ বুঝতেই পারেনি যে উনিও ঘুষ চাইছেন। পরে যখন বড় বড় লোকেরা বলতে লাগল, এবং স্বয়ং বৈদ্যজী দু-চার জায়গায় বলে দিলেন তখন সবার বিশ্বাস হল। লোকজন সুপারিশের জন্যে তদবির করা ছেড়ে নোট হাতে ওনার কাছে গেল।

“ এবার আপনিই বলুন রূপ্পনবাবু, এভাবে কখনও বড় পুঁজি গড়ে ওঠে? যা চলছে, তাতে ডাল-ভাতের জোগাড় হলেই যথেষ্ট ।

ঘুষ নেওয়াও এখন বড় বেইজ্জতি! ওতে কিছু বাঁচে না। যে নেয় আর যে নেয় না –সবাই সমান। সবার অবস্থা খারাপ”।

ওনার লেকচারের স্রোত পাশের দোকানের হাঙ্গামার চোটে বন্ধ হল। কেউ চেঁচাচ্ছে—‘চলছে! চলছে’। এর মানে লাঠিবাজি শুরু হয়েছে।

“কী হয়েছে? কী হয়েছে?” বলতে বলতে বেশ কিছু লোক দোকানের উপর হামলে পড়ল। একজনের ভাব দেখে মনে হবে যে সারা সমস্যার জড় সন্দেশের থালাতে। ও খামচে এক মুঠো সন্দেশ তুলে নিয়ে চেঁচাল—কী হয়েছে? খানিকক্ষণ এভাবেই নানা লোকে সমস্যার শেকড় খুঁজতে লাগল। কারো মনে হল সমস্যা লাড্ডুর থালায় লুকিয়ে আছে, কারও বাতাসার থালায়। ভা্রি গোলমাল আর চেঁচামেচি!

আচমকা রুল দুলিয়ে দু-তিনজন পুলিশের সেপাইয়ের আবির্ভাব। রুল নির্বিচারে দমাদ্দম লোকের পিঠে পড়তে লাগল। খানিকক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি কাবু হল। ভীড় ছত্রভঙ্গ। যার দোকানে এত হাঙ্গামা সেই দোকানদার রুলের বাড়ি খেয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে পিঠ ডলছে। একপাশে ছোটে পালোয়ান, শনিচর এবং জোগনাথ দাঁড়িয়ে। রূপ্পন ও রঙ্গনাথ এবার ওদের সঙ্গী হলেন, -স্টেজ তৈরৈক

জনৈক সিপাহী উবাচ—বোল বে, কী হয়েছে? আরে এমন করে পিঠ ডলছিস যেন কেউ অ্যাটম বোম মেরেছে!

দোকানদার ফোঁপানো বন্ধ করে জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলল—যা হবার হয়েছে, এ’নিয়ে কোন কথা বলতে চাইনা।

ছোটে পালোয়ান নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ কনুইয়ের ময়লা খুঁটছিল। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল—কোন ব্যাটা এভাবে গঞ্জহাদের ঠকাতে পারবে না। আমার টাকার বাকি হিসেব এখনও হয়নি।

এবার ময়দানে নামলেন রূপ্পনবাবু। এক ঝটকায় সামনে এসে পড়া লম্বাচুল মাথার পেছনে করে পুলিশের সেপাইদের উপর লেখাপড়া জানা মানুষের রোয়াব দেখিয়ে বললেন—“এই পালোয়ান আমার সঙ্গের। আমাদের অনাথ ভেবে যা ইচ্ছে তাই করার ভুল করো না। কথাবার্তা কায়দা মেনে হবে তো আমি পুরো সাহায্য করব। বাঁকাচোরা চলন দখলে কালই আমার কলেজের সাতশো স্টুডেন্ট ময়দানে নামিয়ে দেব”।

একজন সেপাই বলল—ভাইসাব, এখনই আপনার কথাবলার দরকার নেই। আপনাকে আমরা চিনি। যা হবে, ঠিকই হবে।

তারপর দোকানদারের দিকে ঘুরে বলল—তোমার বয়ান কী, বলে ফেল।

দোকানদার সতর্ক হয়ে বলল—বয়ান? এখন বয়ান-টয়ান দিতে পারবনা।ওসব দেব আমার উকিলের সামনে।

সেপাই ধমকে উঠল—আবে, তোর বয়ান কে লিখছে! কী ঘটেছে সেটা বল!

ও বলল—‘ধর্মাবতার! হল কি এই পালোয়ান এসে প্রথমে পেছনের ওই মোড়াটায় বসল। দুটো দোনা পালং পাকোড়া খেল, তারপর আরও দুই দোনা মুখিকচুর বড়া খেল। মুখির দ্বিতীয় দোনা খাচ্ছিল তখনই এদিকের ওই দু’জন গঞ্জহা এসে হাজির’। ও একবার টেরিয়ে টেরিয়ে শনিচর ও জোগনাথের দিকে তাকাল, তারপর ফের বলতে শুরু করল—‘এরা আধ- আধপোয়া বরফি চাইল, সেটা ওদের দেওয়া হল’।

সেপাই ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল—কী, এ’পর্যন্ত সব ঠিক তো?

ছোটে গালি দেয়ার ভঙ্গীতে বলল-হ্যাঁ, ঠিক।

-“এরপর ওই দুই গঞ্জহা বরফি সাঁটিয়ে হাঁটা দিল। আমি বলতে লাগলাম যে আট আনা হয়েছে। তো ওরা উলটে আমাকে ধমকাল—আট আনা দাম তো আগেই দেয়া হয়েছে, কতবার নেবে? দেখুন, এখানে আমি কম সে কম একশ’ লোককে খাবার দিই, কখনও ভুল হয়? আমি বারবার আট আনা চাইতে থাকি, তো ওদের এক কথা—আগেই দিয়েছি। শেষে যখন কড়া হয়ে বললাম তো আমাকে গালি দিতে ---“।

ওর কথার মাঝখানে শনিচর বলল—“যা সত্যি সেটাই বল হে লালা চিরঞ্জীমল! তুমি বললে আমরা আট আনার বরফি খেয়েছি, তো আমরা বললাম-হ্যাঁ, খেয়েছি তো। তুমি বললে আমরা পয়সা দিইনি, তো আমরা বললাম -না, দিয়েছি তো”।

রঙ্গনাথ ওর মাঝখানে বলল—তো ঝগড়া কিসের? দোকানদার পয়সা পায় নি? পেয়ে যাবে।

শনিচর বলল-“ দাদার যে কথা! এ’ভাবে সবসময় দু’দুবার করে পয়সা চুকোতে চারদিনের মাথায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হবে”।

দোকানদার বলল—“আসল ঝগড়া তো আট আনার নয়, ওদিকে ছোট পালোয়ানকে নিয়ে। এদিকে যখন দুটো গঞ্জহা আট আনা দেয়া নিয়ে খিচ খিচ শুরু করে যাচ্ছে , ওদিক থেকে পালোয়ান বলে উঠল—ভাই, এদের আট আনার ঝগড়ায় আমি যে একটাকার নোট দিয়েছি তার বাকি পয়সা ফেরত দিতে ভুলে যেও না। এখন দেবার বেলা তিনি এখনও কানাকড়ি ঠেকান নি, অথচ একটাকার বাকি খুচরো চাইছেন! কী যে দিনকাল পড়েছে”!

পালোয়ানের কোন হেলদোল নেই, আগের মতই শরীরের ময়লা খুঁটতে ব্যস্ত।

সেপাই বলল—তুমি কী বল পালোয়ান?

ছোটে উবাচ—আমি আর কী বলব? বেশি বকবক করতে পারি না। আমি আট আনার খেয়েছি, বাকি আট আনা ফেরত পেলেই হল, ব্যস্‌। বাকি কোন কিছুতে আমার মাথাব্যথা নেই”।

অনেকক্ষণ এ’নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে লাগল। ভীড়ের মধ্যে নানারকম মন্তব্য ভেসে বেড়ায় যার তাৎপর্যঃ এই মেলাতে প্রতিবার এমন ঝগড়া হয়। ঝগড়া কারা শুরু করে? ব্যস্‌ এই গঞ্জহার দল—যত লুচ্চা লফংগা এসে জুটেছে! কিন্তু এদের সাথে লাগতে যাবে কে? যা মুখ! তবে সত্যি বলতে কি সব গাঁয়ের একই হাল। আজকালকার ছেলেছোকরারা সব----।

কিন্তু কাকে কত দিতে হবে সেটার সমাধান এখনো হল না। শেষে এক সেপাই বের করল এক সরল সমাধান। সেটা এইঃ দু’পক্ষই ছাড় দিক। পালোয়ান যদি টাকা দিয়ে থাকে তো বাকি আট আনা ছেড়ে দিক। আর দোকানদার যদি খাবারের দাম না পেয়ে থাকে তো দামটা ভুলে যাক। তাহলে কাউকেই কিছু দিতে-টিতে হবে না-ব্যস্‌।

এই রায় শুনে যুযুধান দুই পক্ষই বড় অসন্তুষ্ট; ভারি শোরগোল। শেষে এই ফয়সালা দুই দলই মেনে নিল। এবার যেদিকে শরাবের দোকান ওখানে কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া শুরু হল। সেপাইয়ের দল সেদিকেই গেল। ভীড় এবার ফাঁকা ।

অকস্মাৎ রঙ্গনাথ রুক্ষ স্বরে বললেন—আমি কি জানতাম যে আমার সঙ্গীরা সব লুঠেরা! কেমন লোক এরা?

রূপ্পনবাবু আশ্চর্য হয়ে দাদার মুখে চাইলেন—কোন লোক? ওই ব্যাটা দোকানদার? আরে ও তো জন্ম থেকেই লুঠেরা।

রঙ্গনাথের মুখ উত্তপ্ত হল। ও দোকানদারের কাছে গিয়ে পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বললে –“তিন জন মিঠাই-পাকোড়া যা যা খেয়েছে সবের দাম এর থেকে কেটে নাও। যা হয়েছে--- সেসব ভুলে যাও”।

এই বলে সে নিজের রাগী মুখ করে সাথীদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রূপ্পন মুখ বেঁকালো, যার মানে—যত বোকামি সব কি আজকের জন্যেই তুলে রেখেছিলে?

ছোটে নীচু স্বরে বলল-এনাকেও নিজের দম দেখাতে দাও। লেখাপড়া জানা আদমী। এ মে পাস। কে ওনার সামনে মুখ নাড়াবে?

এই কথা বলে পালোয়ান অন্যদিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন যা ঘটে গেছে তার সঙ্গে ওর কোন সম্বন্ধ নেই। আর ঘটনা বলতে একজন এ মে পাশ মানুষ কীরকম বেকুব হতে পারে!

কিন্তু রূপ্পন বাধা দিল। -“ ফয়সলা তো হয়ে গেছে রঙ্গনাথ দাদা। এখন তোমার কথা বলার হক নেই। যা করার পুলিশের সামনে করতে, তাহলে কোন মানে হত”। রঙ্গনাথ পাঁচ টাকার নোটটা দোকানদারের সামনে ফেলে দিয়েছিল। এসব কথায় কান না দিয়ে ওকে বলল তাড়াতাড়ি করে বাকি পয়সা ফেরত দিতে। দোকানদার চারদিকে একবার তাকাল। তারপর পাঁচটাকার নোট ফেরত দিয়ে বলল—তুমি বাইরের লোক, বাবুজী। আমাকে তো এখানেই করে খেতে হবে।

গঞ্জহাদের দল ভেঙে এখন তিনটে ভাগ হল। জোগনাথ গেল মদের দোকানের দিকে, শনিচর আর ছোটে গেল মেলার অন্যদিকে চেনাজানা দু’চারজন ভাঙ ঘুটছে। রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু একসঙ্গে ফিরছে। রঙ্গনাথ গম্ভীর, একটু ক্লান্ত। শেষে একটা কুয়োর বাঁধানো পাড়ে আরাম করতে বসে পড়ল। রূপ্পনবাবু ওখানেই দাঁড়িয়ে একটু দূরের তিতিরের লড়াই মন দিয়ে দেখতে লাগল।

কুয়োর থেকে একটু দূরে একটা ভাঙাচোরা পড়ো বাড়ি। ওখানে থামের পাশে একটি মেয়ে বসেছিল—গমের মত গায়ের রঙ, নবযুবতী। জমকালো রঙের শাড়ি, নাকে সোনার নথ। মেলার নোংরামিতে তিতিবিরক্ত রঙ্গনাথের চোখে এই দৃশ্য বড় মনোরম লাগল। তাই ও দিকেই তাকিয়ে রইল।

নোংরা লুঙি এবং চকমকে নকল সিল্কের সাফসুতরো পাঞ্জাবি পরা একটা লোক মেয়েটার একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল। একটি কানের লতিতে চূণের ফোঁটা, মাথার চুল তেলে জবজবে। ধীরে ধীরে ও মেয়েটার কাছে গেল। তারপর ওর সঙ্গে প্রায় একগজের দূরত্ব রেখে বসে পড়ল। ও কিছু বলল, তাতে মেয়েটি মুচকি হাসল।

রঙ্গনাথের বেশ লাগছিল। চাইছিল- মেয়েটি ওর দিকেও তাকিয়ে দেখুক। মেয়েটি ওকেও দেখল। চাইছিল-- মেয়েটি অমনই করে আর একবার মুচকি হাসুক, মেয়েটি হাসল। তেল-জবজবে লোকটা ফের একটা বিড়ি ধরাল।

একটা লোক রঙ্গনাথের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে ধুতি-কুর্তা আর টুপি। গেঁয়ো হিসেবে একটু পরিপক্ক দায়িত্বশীল ভাবভঙ্গী। রঙ্গনাথ ওর দিকে একবার তাকিয়ে ফের মেয়েটিকে দেখতে লাগল। মেয়েটির হাসি বন্ধ, ওর মুখে এমন একটা করুণভাব, যেন হিন্দি সিনেমার নায়িকা এক্ষুণি কোন গজল গাইবে।

লোকটি মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল—আপনি কি এদিকেই থাকেন?

রঙ্গনাথ মাথা নাড়ল।

লোকটি রঙ্গনাথের পাশে আরাম করে বসে পড়ল। বলল,” এই দেহাতিগুলোর কোন রুচি নেই। খালি ফরমাইশ করে—অমুক সিনেমার গান শোনাও, তমুক গানটা শোনাও!”

রঙ্গনাথ আগ্রহের সঙ্গে ওর কথা শুনতে থাকে, ব্যাপারটা কি -ধরতে পারে না। লোকটা বলতে থাকে—“ তারচেয়ে ওর তিলানা শুনুন, দাদরা শুনুন, চাই কি ঠুংরি! একেবারে প্রাণ দিয়ে গায়”। লোকটি ভাবুক হয়ে স্বপ্নমাখা চোখে রোমান্টিক ঢঙে বলল-“রোহুপুর গেছল, এখন বেজেগাঁও যাচ্ছে”।

শহরে এক সংগীতের জলসায় রঙ্গনাথ পণ্ডিত রবিশংকরের সম্বন্ধে এই ধরণের কথাবার্তা শুনেছিল। অ্যানাউন্সার মাইকে বলছিল—‘পণ্ডিতজি এডিনবরা থেকে এখনই ফিরেছেন, এবার শীত পড়লে নিউ ইয়র্ক যাবেন’।

ও মাথা কাত করে লোকটাকে সমর্থন করল। এতক্ষণে কথার আগা-মাথা বুঝতে পেরেছে। লোকটি একটু থেমে ফের বলতে লাগল—“এঁর বিদ্যে পথচলতিদের জন্য নয়। বৈঠকে আসুন, বসে শুনুন, তখন নিজেই বুঝতে পারবেন কোনটা আসল আর কোনটা নকল”।

রঙ্গনাথের নজর সামনের দিকে। তেল-জবজবে লোকটা এখন মেয়েটির পাশে সেঁটে বসেছে। দুজনে কথা বলছে, হাসিঠাট্টা করছে, আর মাঝে মাঝে রঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে দেখছে। এতক্ষণে বুঝতে পারল যে এই লোকগুলো ওকে নিয়ে আশায় আশায় রয়েছে,-- অনেক বড় বড় আশা!

ওর পাশে বসে থাকা ধুতি-কুর্তা পরা লোকটিকে দেখলে দূর থেকে মনে হবে ওরা দুজন সিরিয়াস; দেশের বড় বড় সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন। লোকটা ভুরু কুঁচকে বলছিল— “নতুন আইন এসে সব বরবাদ করে দিয়েছে। বড় বড় ধনীর দুলাল সঙ্গীত শোনার আকাঙ্খায় ছটপট করছিল। তবে এখন তো থানাদার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। বৈঠকে গান-বাজনা ফের শুরু হয়েছে”।

রঙ্গনাথ উঠে পড়ল। লোকটাও উঠে দাঁড়াল। “আমিও এর উপর দশবছর জান লড়িয়েছি। ময়ূরের মত গলা পেয়েছে। এখন রেয়াজ করে একশ’ জনের মধ্যে সেরা”।

রঙ্গনাথ রূপ্পনবাবুর দিকে তাকাল। ও তখন তিতিরের লড়াই দেখতে দেখতে একটু দূরে সরে গেছল। রঙ্গনাথ ডাক পাড়ল—রূপ্পন!

লোকটা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল,” মেয়েটি আমাদেরই ধর্মের—হিন্দু। বড্ড সরল আর সাদাসিধে”।

ফির মুখ বেঁকিয়ে গর্বের সঙ্গে বলল,” খালি গান গায়, গুণীজনের মধ্যে। পেশা করে না।“

রঙ্গনাথ জবাবে বল—খুব ভাল। গায়িকা পেশায় নামলে গান নষ্ট হয়। সঙ্গীতও এক সাধনা। ব্যস, ওকে এই পথেই এগিয়ে যেতে দিন”।

লোকটা থতমত খেয়ে বলল, “আপনি তো দেখছি সবই জানেন, আপনাকে আর কী বলব। একদিন আসুন আমাদের বৈঠকে---“। রূপ্পনবাবুকে দেখে ওর কথা আটকে গেল। ও পেছন দিক দিয়ে হঠাৎ হাজির হয়েছে। কড়া স্বরে রূপ্পন বলল—“ বৈঠকে আসব তো বটেই। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলছ হে? নিজের বাপকে চিনতে ভুল? দেখে কথা বল”।

লোকটার চেহরা বদলে গেছে। হাত জোড় করে লম্পটের ভঙ্গিতে হেসে বলল—“মালিক, আমার বাপ তো টাকা”!

রঙ্গনাথ হাসল। চোখে পড়ল মেয়েটির হাসি এখন আরও চওড়া হয়েছে।


ওরা অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে, চুপচাপ। শেষে রূপ্পন বাবু মুখ খুলল, “ও’ব্যাটা কী বলছিল? মেয়েটা এখনও পেশায় নামেনি”?

রঙ্গনাথ নিরুত্তর।

“চারদিকে জালিয়াতি। এই শালী রেণ্ডিটাকে ছোটবেলা থেকে দেখছি”। রূপ্পন এবার বয়স্ক কর্তাব্যক্তির মত বলা শুরু করল,” অনেক বছর হল নাকে নথ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ইনি ওর ঠুমরি-দাদরার নাগাড়া বাজাতে থাকেন। মোষের মত গলার স্বর, ও নাকি গানেরওস্তাদ! আমাদের এলাকার ওই হল সবচেয়ে পচাগলা বেশ্যা। কেউ ওকে এক পয়সাও পোঁছে না”।

রঙ্গনাথ এবার সত্যিই দেহে-মনে ক্লান্ত। রূপ্পন ছাড়ে না। “ আমি সময়মত নাএলে ওচুপ করতনা। তোমাকে তো প্রায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিল”।

রূপ্পন একনাগাড়ে নিজের ঝোঁকে বলে যাচ্ছিল। আচমকা রঙ্গনাথ প্রশ্ন করল,”রূপ্পন, তুমি বেলাকে কেন প্রেমপত্র লিখেছ”?

এইকথায় রূপ্পনবাবুর কথকতা হোঁচট খেল। কিন্তু উনি সামলে নিয়ে বললেন—দাদা, এতদিন শহরে থেকেছ, তবু বোঝনা কেন -কেউ- কাউকে- প্রেমপত্র লেখে”?

রঙ্গনাথের মুখে কোন জুতসই উত্তর জুটল না। ও শুধু বলল,”মামাবাবু খুব রাগ করছিলেন”।

রূপ্পনের চেহারা কঠিন। মেজাজ দেখিয়ে বলল,”ওনার কিসের রাগ! ওনাকে বল, সিধে আমার সঙ্গে কথা বলতে। তবে শোন, ওনার বিয়ে হয়েছিল চোদ্দ বছর বয়েসে। প্রথম মা মারা যেতেই ঊনই সতের বছর বয়সে ফের বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। একটা বছরও একা থাকতে পারলেন না?

“সে না হয় নিয়ম-কায়দা মেনে হয়েছিল। আর বেনিয়মে কায়দা-কানুনের বাইরে কী কী করেছিলেন শুনতে চাও—“?

রঙ্গনাথ, “না, শুনতে চাইনে”।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in





















(২০)

এতক্ষণে শৈলবালার ফোঁপানো গলায় কান্নাটি থেমে গেলেও ওর থমথমে অশ্রুস্নাত মুখটি অতিজাগতিক এক যৌবনার উন্মেষে বেশ অনেকক্ষণ ধরে জেগে আছে দেখে শেষমেশ গোলকপতি আর চুপ করে শুয়ে থাকতে পারলনা।

তাই সে এবারে চুপিচুপি এসে দাঁড়াল তার সামনে। বাইরের অবারিত মসীকৃষ্ণ ঘনায়মান রাত্রি যেন সার্থকভাবে এই রাত্রিশেষের দৃশ্যপটের আবহটিকে নিপুণ হাতে রচনা করে আছে। দূরে কোথাও দু একটি আকুল শিবারব যেন শ্রুতিগোচর হল। ভোর হতে আর বেশী বাকি নেই দেখে গোলকপতি একটু গলা খাঁকরিয়ে বলে উঠল,

" হে দেবী! এবার শয়নের সময় তো ফুরিয়ে আসছে! রাত্রির তৃতীয় প্রহর যে প্রায় সমাপনের পথে!"

গোলকপতির মন্দ্রস্বরের পুরুষকন্ঠটি তার কাছে এই কদিন আগেও অপরিচিত ছিল, তাও সেটি আজ একেবারে অন্যায্য বা অশ্রুত নয়। এবারে শৈলবালার বাদলবিধৌত মুখশ্রীটি একটু যেন বিস্মিত হয়ে উঠল। ঠোঁট চেপে সে অতিদৃঢ় কন্ঠে এবার বলে উঠল,

" আমি কি আপনার কেনা মেয়েমানুষ? শুদুশুদু আমাকে বিরক্ত কচ্চেন কেন! আমার একোন একটুও ঘুম পাচ্ছেনা কো! তাছাড়া আপনি যেটা চান তা আমি এখন কিছুতেই দিতে পারব নে । সেটা তো শুধু আপনাকে বলে নয়! না! না!কাউকেই না! তাও যদি এরপর জোর করতে আসেন তো আমি নিজের গলার নলি কেটে রেকে দেব বলে এইটা সাথে এনে রেকেছি! "

এইটুকু কথা কোনওমতে বলে সে লকলকে ফলা সমেত একটি ছোট খঞ্জর বের করে গোলকপতিকে দেখাল।

....

কি আশ্চর্য! এটা তো গোলকপতির কাছে থাকার জিনিস! তাছাড়া এই মেয়ে সেই অস্ত্রটি হাতে পেল কি করে?

তখন ওর মনে পড়ল যে শৈলবালার গহনাগুলি একটি কাপড়ের থলেতে বেঁধে রাখার সময় অস্ত্রটি ওকে ধরতে দেওয়ার পর গোলকপতির আর ওটি তালেগোলে ফেরত নেওয়া হয়নি।

যদিও এটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত একটি দোষ! তাও গোলকপতি এবার সজোরে হেসে উঠল। সে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠল,

" তোমার সুডৌল হাতে কৃপাণটি বড় বেমানান। তবে সত্বর তোমার হাতে হাতা-খুন্তি ধরানোই আমার অভিপ্রায়! যদিও রণচন্ডী কালিকার আমার আরাধ্যা দেবী।তবে আমি তোমায় মন্দমনে বা বলপূর্বক ভোগ করব ভাবলে সেটা সেদিন ওই আশ-শ্যাওড়ার ঝোপেই করে আসতে পারতাম। তুমি হয়ত ভুলে গেছ যে বিস্রস্ত বসনে সেদিন কিয়ৎক্ষণ আমার বাহুবেষ্টনীতেই তুমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলে!তাই সম্পূর্ণ সুযোগ থাকলেও সেদিন তোমাকে কামদংশনে ভ্রষ্টা করিনি। এখনও বুঝতে পারছ না যে আমি রিপুজয়ী না হলেও তোমার শত্রুমনস্ক নই। তাছাড়া এই মধুরতি আমাকে জীবনভর বড় অসম্মানের বাস্তবে এনে দাঁড় করিয়েছে বলে আমি তোমার ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি করব না। তাই গান্ধর্ব্য মতে হলেও প্রথমা পত্নীর মৃত্যুকালীন একাকিত্বজনিত কারণেই আবার তোমার পাণিগ্রহণ করব বলে মনস্থ করেছি। এ বিষয়ে অন্য সবাই আপত্তি করবে জানি তাও, পরাশরসংহিতায় লেখা আছে যে, - " নষ্টে, মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ | পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্য বিধীয়তে |" এই শ্লোকটা আচার্য সর্বজ্ঞ দেবের কাছে বহুবার আমিও এর আগে অনেকবার শুনেছি। তাই স্বয়ং মহর্ষি পরাশর যা অনেককাল আগে বলে গেছেন তা আজ সবাই ভুলে গেলেও আমি এখনও ভুলতে পারিনি।"

....

শৈলবালা এবার স্থাণবৎ ও ভাবান্তরহীন মুখে তাকিয়ে থাকল গোলকপতির দিকে। তখুনি ঝটিতে গোলকপতি খঞ্জরটি তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে তার ফলাটি এনে সামান্য ঠেকাতেই রক্তপাতের সূত্রপাত হল।

দক্ষিণহস্তের করাঙ্গুলী বিধৌত শোণিতধারা অতি সন্তর্পণে সে শৈলবালার সিঁথিতে ঠেকিয়ে রাখতেই ঝড়ের গতিতে শৈল গোলকপতির কোমরটিকে থরথর ভঙ্গিতে বেষ্টন করে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকল।

এবারে গোলকপতি অতি ধৈর্য্যবান ও একনিষ্ঠ প্রেমিকের মত সান্দ্র স্বরে বলে উঠল, " দেহী পদপল্লব মুদারম্ "! আর শৈলবালার অলক্তরঞ্জিত চরণদুটি তার নিজের সুবিশাল বক্ষে চেপে ধরতে উদ্যত হল।

......

কিছু কিছু ঘটনা এইরকম আকস্মিকতার আবহে মহান হয়ে উঠে মানবজীবনটি বড় মধুময় করে তোলে।

ব্রাহ্মমুহূর্তের সেই ঈষৎ গৈরিক সূর্যালোক যেন আস্তে আস্তে বরণ করে নিতে লাগল মধ্যযুগের কালান্তরের পর একটি নবোদিত আধুনিকতার প্রত্যূষকে দুটি অসম চরিত্রের মানব-মানবীকে একীভূত করে তোলার মাধ্যমে।

.......

দেখতে দেখতে ১৮৩০ সালের হেমন্তকাল পেরিয়ে শীতের মাঝামাঝি সময় এসে গেল।

বিলেতে এসে ভিলাটির বাগানে বসে সান্ধ্য চা পান করতে করতে মাঝেমাঝে নিজের সমস্ত কার্যকলাপের কথা ভেবে রামমোহন বিস্মিত হন নিজেই। সেই শৈশব কৈশোরের খানাকুলের দিনগুলো তো কখনোই বিস্মৃত হতে পারবেন কি?

তারপর কমবয়সে তিব্বত ভ্রমণ তথা পাহাড়ি স্নেহশীলা মাতৃধনদের অবাধ প্রশ্রয় সেদিন জ্ঞানচর্চা আর বোধিসত্ত্বের কাছে আত্মার পরিধিটি মেলে ধরতে কোনরকম সমস্যাই করেনি। সমস্ত জীবন ধরে কেবল পড়াশোনা আর কেবল পড়াশোনা। হাতের করকোষ্ঠীর মত অমোঘ করে তোলা তাঁর যাত্রাপথের শেষে আছে ব্রহ্মস্বাদের পুরষ্কার।

আবার তারই মধ্যে আছে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে পিতার সাথে বিরোধ, সতীদাহ বিরোধী বিলটিকে কেন্দ্র করে কূলীন সমাজের উপহাস, সমবেত হয়ে একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্মকে উপাসনার কারণে লোকাচার সহ মাতা তারিণী দেবীর বিরাগঘন আবহাওয়া এসব যেমন পুরোটাই সত্যি আবার তেমনই অভিন্নহৃদয়ের কিছু মিত্রতাও লাভ করেছেন অনেকের সাথে।

এমনকি জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথকে বাদ দিলেও সেই পরম মিত্রজনদের তালিকা আজ আর খুব কম নয়।

সমস্তজীবন ধরে তিনি শত্রুতা এ মিত্রতা এই দুটি পরস্পর বিরোধী বিষয়কেই তিনি নখদর্পণে ধরে রাখতে শিখতে চেয়েছিলেন।

....

মাসাধিককালের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর তিনি আপাতত এখন বিচরণ করছেন প্রবাসপথের নিশ্ছিদ্রতায়। এখানে একমাস ম্যানচেস্টারে এসে বসবাসের পর আপাতত লিভারপুলে এসে থেমেছেন।

অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে তাঁদের কখনোই কোনো রাজত্ব ছিল না, কিন্তু এখন নামের আগে বসে গেছে রাজা' উপাধি।

তাই শুনে হাসি পেলেও এদেশে বোধহয় তিনিই একমাত্র রাজত্বহীন রাজা। এমনকি মুকুটহীন সম্রাট বললেও অত্যুক্তি হয় না।

সমস্ত জীবনে বাঙালিকে আধুনিক মননে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। এমনকি বিলেতের মাটিতে এসে পা রাখার কথাও অবলীলায় ভাবতে পেরেছেন। যদিও তিনি কোন জীবিকাসূত্রে বিলেত আসেন নি । তিনি এদেশে এসেছেন বেশী শতাংশ স্বেচ্ছায় খানিকটা আর বাকীটা মোগল দরবারের অনুরোধে।

যেহেতু বিলেতের সাহেবরা উন্নাসিক ও ভারতের রাজা-বাদশাহ ছাড়া আর কাউকেই সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নন। তাঁকে 'রাজা' উপাধিতে সম্মানিত করে সমস্ত খরচের দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে বিলেত পাঠাতে উদ্যোগ নিয়েছেন মোগল শাসকদলের ক্ষীণক্ষমতাসীন বংশসজটি।

....

এখানে কালকের জনপ্রিয় ইংরেজী সংবাদপত্রে ফলাও লিখেছে তিনি ভারতবর্ষ থেকে এখানে এসেই প্রথম লোহার পাত কেটে বানানো রাস্তার উপর দিয়ে বাষ্পচালিত গাড়ি ছুটে যাচ্ছে; এই দৃশ্যটি দেখে বাহ্যত যেন তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।

নিজের মনে ভাবছিলেন যে ভারতবর্ষের মানুষেরা কবে জানতে পারবে বা আদৌ কি কখনও জানতে পারবে যে বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম রেলগাড়ি চড়েছেন।

এমনকি সেই গাড়ি যখন ঘণ্টায় পনেরো ক্রোশ বেগে চলতে শুরু করে, তখন যে নকল পোশাকের 'রাজা'টি যে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই কথাটিও এখানকার সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে দেখে তিনি প্রথমে বেশ বিব্রত বোধ করলেও পরে খুশী হয়েছেন।

....

রাতে ঘুসঘুসে জ্বর আর সাথে খুশখুশে কাশি হচ্ছে ক'দিন হল। প্রিভি কাউন্সেলে তাঁর এখনও দুটি বক্তৃতা দেওয়া বাকী। ইংরেজরা নিজেদের সভ্যতাদর্পী ভাবলেও ভারতবর্ষ সম্পর্কে ওরা বেশ উদাসীন। যা বুঝছেন তা হল গত সাতটি দশকে বৃটিশ আগ্রাসন ঘনিয়ে এলেও প্রায় নিখরচায় সস্তা মজুর সহ ধান, পাট,চা আর নীল চাষের এক কৃষিক্ষেত্র হিসাবে বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র ছাড়া পূর্ব গোলার্ধের এই দেশটির হাজার বছরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ধারাবাহিকতা নিয়ে এরা কোনওকিছুই এখন ভাবতে শেখেনি । এরা কার্যত ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে জান্তব প্রকৃতির বনমানুষের সমতুল্য বলে মনে করে।

....

চা পান শেষ করতেই দূরের পাহাড়ের কোলে চিত্রার্পিতের মত সূর্যাস্তটি দেখতে দেখতে নিজের মাতৃভূমির জন্য ওঁর মনটা আজ বড় উতলা হয়ে এল।

আচ্ছা! দেশে আবার ফিরে আসতে পারবেন তো!

এইসব বিপরীতধর্মী চিন্তাসিন্ধুর দোলাচলের তরঙ্গ এসে তাঁকে বিব্রত করতেই গার্ডেন চেয়ার থেকে এবারে উঠে গেলেন। তাঁর পদশব্দ শুনতে পেয়ে বৃদ্ধ বাটলার মিস্টার জোসেফ হাওয়ার্ডির কোন প্রশ্নের উত্তর না দিতে দিতেই তিনি সশব্দে ভিলার দক্ষিণদিকে থাকা সুবিশাল পাঠকক্ষের দরজাটি খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। এখন মনকে সংহত করতে গেলে কিছু পুস্তকপাঠের আশু প্রয়োজন বোধ করছেন।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








সতেরো

বিজয়ের বৌ মুন চা করে কাপ দুটি টেবিলে রাখলো।তারপর বসলো বিজয়ের পাশে। গল্পে ডুব দিয়েছে বিজয়।

মুনের মন ফিরে গেলো, পাঁচ বছর আগে কলেজ জীবনে।তখন ওরা দুজনে দুজনকে চিনত না। একদিন কলেজের কমন রুমে বিজয় বসে আছে। এমন সময় মুন গিয়ে বসলো তার পাশে। একবার মুখ তুলে তাকিয়ে বিজয় আবার নিজের কাজ করতে লাগলো।মুন বললো,আপনি কোন ইয়ার?

------ থার্ড ইয়ার, বাংলা।

------আমারও বাংলা। ফার্ষ্ট ইয়ার।

-----ও তাই। কোথা থেকে আসেন।

------টিকিয়াপাড়া।

------ও আমি পটুয়া পাড়া থেকে।

-----তাহলে তো একই দিকে। খুব ভালো হলো একসঙ্গে যাওয়া আসা করা যাবে।

-----অবশ্যই।

তারপর থেকে ওরা একসাথে ওঠাবসা করতো।ভালোলাগা ক্রমশ ভালোবাসায় পরিণত হলো। তারপর বিয়ের। বিয়ের পরেই একটা ফার্মে চাকরী।এখন ওরা ঘর ভাড়া নিয়ে সুখে আছে।

মুন একটা গান গাইছিলো। বিজয়ের জামাটা আলনা থেকে টেনে গন্ধ শুঁকে দেখলো কাচতে হবে কি না। কাচতে হবে, তাই পকেট হাতড়ে টাকা পয়সা কাগজ বের করে টেবিলে রাখলো।মুন দেখলো,কাগজের সঙ্গে একটা রেলের টিকিট। মুন ভাবলো,অফিস তো সাইকেলে যায় তাহলে দাঁইহাটের টিকিট কেন? দাঁইহাটে আমাদের সাতকুলে কেউ থাকে না। তাহলে ওখানে কেন? কই বিজয় তো বলে নি, সে ওখানে গিয়েছিলো? তাহলে কি বিষয়টা বলার মত নয় বলে এড়িয়ে গেছে। সন্দেহ দানা বাঁধলো মুনের মনে। গান থেমে গেছে। অকারণে থালা, বাটি, গ্লাস ফেলে আওয়াজ করছে। বিজয় বললো,আস্তে কাজ করো।গল্প পড়ছি।

----আমি খেটে মরবো আর তুমি বাবুমশাই বসে গল্পের বই পড়বে?

---- কি হলো, অইভাবে কথা বলছো কেন?

----না বলবে না। আমি একা একা বাড়িতে থাকি আর উনি হিল্লি দিল্লি করে বেড়াচ্ছেন।

-----কি বলছো,বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার করে বলো।

-----দাঁইহাট কেন গেছিলে।কার কাছে। নিশ্চয় প্রেমিকার কাছে। আমাকে তবে বিয়ে করলে কেন?

----আরে দাঁইহাটে কেন যাবো?

-----আবার মিথ্যে কথা। আমার কাছে প্রমাণ আছে।

----কি প্রমাণ। কই দেখাও।

মুন দাঁইহাটের টিকিট এনে খাটে ফেলে দিলো।বিজয় হেসে উঠলো জোরে। বললো,আজ বই কিনতে প্ল্যাটফরমে গেছিলাম।প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম দশ টাকা। আর দাঁইহাটের টিকিট পাঁচ টাকা। টিকিট একটা থাকলেই হলো। তাই পাঁচ টাকা বাঁচাতে দাঁইহাটের টিকিট কাটলাম।

সুমন আমার সঙ্গে ছিলো। ওকেই জিজ্ঞাসা করো।

তারপর মোবাইলে সুমনকে ধরে ফোনটা দিতে গেলো বিজয়। মুন ফোনটা কেটে দিয়ে হাসিমুখে বললো,আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। তারপর বিজয়ের গলা পেঁচিয়ে ধরে বললো,তুমি এমনি করেই শুধু আমার হয়ে থেকো চিরকাল।

বিজয় মুনকে আদর করার সময় শুনতে পেলো ভবিষ্যতের পদধ্বনি।

পাশাপাশি দুজনেই শুয়ে আছে বিছানায়। মুনকে বললো,আজ আমি তোমাকে আমার ছোটোবেলার গল্প শোনাই শোনো।

0 comments: