Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৭

রাতের প্রথম পহর। বৈদ্যজীর ঘুম চটে গেছে, কারণ বড্ড শীত করছে। চব্যনপ্রাশ, স্বর্ণভস্ম, এবং বাদাম পাকের ব্যারিকেড ভেঙে ঠান্ডা ওনার চামড়ার নীচে ঢুকে পড়েছে আর মাংসের বেশ ক’টি পরত ভেদ করে হাড়মজ্জায় সেঁদিয়েছে। লেপটাকে ভাল করে গায়ে জড়াতে জড়াতে ওনার মনে পড়ল—বিছানায় একলা শুলে শীতের অনুভূতি বেশি হয়। এরপর ধেয়ে এল স্মৃতির মিছিল। তাতে লাভ হল এই যে একটু যেন চোখ লেগে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় একটু শান্তি। কিন্তু একটু পরেই শুরু হল পেটের ভেতর দুরন্ত হাওয়ার ক্রান্তি।

পেটের মধ্যে হাওয়ার চাপ দেহের নীচের ভাগ থেকে ঘন ঘন ঘোর নিনাদে বেরোতে লাগল। উনি লেপচেপে কয়েকবার পাশ ফিরলেন এবং শেষে বিপ্লবের এক ভয়ানক বিস্ফোটের পর ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে বিপ্লবের হাওয়া এক পোষা কুকুরের মত লেজ নাড়তে নাড়তে শুধু ওনার নাকের ফুটো দিয়ে শব্দ করে যাতায়াত করতে লাগল। উনি ঘুমিয়ে পড়লেন এবং ঘুমের মধ্যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।

দেখলেন গণতন্ত্র ওনার খাটের পাশে মাটিতে উবু হয়ে হাত জোড় করে বসে আছে। ওর চেহারাটা খেতে হাল জোতা চাষির মত, আর ইংরেজির কথাছেড়েই দিলাম, ওতো ঠিক করে হিন্দিও বলতে পারে না। তবু ও কাকুতিমিনতি করেই চলেছে আর বৈদ্যজী শুনছেন। উনি বারবার ওকে চৌকির উপর বিছানাতে উঠে বসতে বলছেন।ওকে বোঝাচ্ছেন—আরে গরীব তো কী হয়েছে, তুমি হলে আমার আত্মীয়; কিন্তু গণতন্ত্র তবু ওনাকে হুজুর হুজুর, সরকার--এইসব করে চলেছে।

অনেক বোঝানোর পর গণতন্ত্র উঠে এসে বৈদ্যজীর চৌকির কোণায় বসলো। আরো খানিক সান্ত্বনার পর যখন বুঝল এবার কিছু কাজের কথা বলা যেতে পারে তখন বৈদ্যজীর কাছে নিবেদন করল –আমার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে গেছে, আমি প্রায় নগ্ন হয়ে গেছি। এই অবস্থায় কারও সামনে বেরোতে লজ্জা করে। তাই বলছি, হে বৈদ্যজী মহারাজ! দয়া করে এই অধমকে একটা সাফ-সুতরো ধূতি দিন, পরে দেখি।

বৈদ্যজী বদ্রী পালোয়ানকে বললেন ভেতর থেকে একটা ধূতি এনে দিতে, কিন্তু গণতন্ত্র মাথা নাড়তে লাগল। বলল—আমি আপনার কলেজের গণতন্ত্র। আর আপনি ওখানকার বার্ষিক সভা অনেক বছর ধরে ডাকেননি। ম্যানেজারের নির্বাচনও সেই কলেজ খোলার পর থেকে আর হয়নি। আজকাল আপনার কলেজ সব ব্যাপারে এগিয়ে চলছে, শুধু আমিই এককোণে অবহেলায় পড়ে রয়েছি। একবার আপনি নিয়মমাফিক নির্বাচন করিয়ে দিন। তাতেই আমার শরীর ঢাকার এক নতুন কাপড় হয়ে যাবে। আমার লজ্জা চলে যাবে।

এসব বলে গণতন্ত্র বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল আর বৈদ্যজীর ঘুমটিও ফের ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই উনি লেপের তলায় ওনার ভেতরের ক্রান্তির এক তাজা বজ্রনির্ঘোষ শুনতে পেলেন। তখনই ঠিক করলেন যে দেখতে যেমনই ফালতু লাগুক, গণতন্ত্র লোকটা ভালোমানুষ, ওনার নিজের লোক এবং ওকে সাহায্য করা দরকার। ওকে অন্ততঃ একটা নতুন ধূতি দেয়া হোক। তাহলে ও আর পাঁচজন সভ্যভব্য লোকের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারবে।

পরের দিন কলেজের প্রিন্সিপালকে আদেশ দেওয়া হল—কলেজের বার্ষিক সভা ডাকা হোক এবং সমস্ত পদের সঙ্গে ম্যানেজারেরও নির্বাচন করা হোক। প্রিন্সিপাল অনেক বোঝালেন যে নতুন নির্বাচন করা দরকারী নয়, জরুরীও নয়। কিন্তু বৈদ্যজী নাছোড়, বললেন—তুমি থামো। এটা নীতির ব্যাপার।

কিন্তু প্রিন্সিপাল থামার পাত্র নন। বলে চললেন—আরে কোন খবরের কাগজে সমালোচনা হয়নি, ওপরমহলে নালিশ যায়নি, না কোন মিছিল বেরিয়েছে, না কেউ অনশনে বসেছে। সব শ্যালক নিজের নিজের গর্তে সেঁধিয়ে রয়েছে। কেউ তো বার্ষিক সভা ডাকার কথা বলছে না, আর যে বলছে সে ব্যাটা কে? সেই ব্যাটা খান্না মাস্টার, সেই রামাধীন ভীখমখেড়বী আর ওনার দু’চারটে চামচে। ওদের চালে ফেঁসে সভা ডাকার ফল ভাল হবে না।

বৈদ্যজী সব শুনলেন, তারপর বললেন—তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এসব তোমার বুদ্ধির অগম্য। কারণ এটা হল নীতিগত সিদ্ধান্ত। যাও, গিয়ে সভা ডাকার ব্যবস্থা কর।

সেদিনই সন্ধ্যে নাগাদ গয়াদীনের বাড়িতে পাঠানো হল। উদ্দেশ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ওনার মতিগতির একটু আঁচ পাওয়া। গয়াদীন হলেন কলেজ কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। কাজেই এখন ওনার অপরিসীম গুরুত্ব। জানা দরকার যে উনি এবার কাকে ম্যানেজার করার কথা ভাবছেন। আর যদি ওনার ভাবনা বৈদ্যজীর পক্ষে না হয়, তাহলে কী কৌশলে ওনার হৃদয়-পরিবর্তন করা যেতে পারে? রঙ্গনাথ এবং রুপ্পনবাবু প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করতে ওখানে গেছেন।

তবে গয়াদীন গোড়া থেকেই পুরো ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন। উনি দু’জনকে আপ্যায়ন করে চারপাইতে বসালেন, রঙ্গনাথের শহুরে শিক্ষার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওদের বিশুদ্ধ ঘী দিয়ে তৈরি মটরী ও লাড্ডু খাওয়ালেন, তারপর নির্বাচনের কথা উঠতেই সাফ বলে দিলেন—“সব কাজ ভাল করে ভেবেচিন্তে করা উচিত। সময়ের হাওয়ার সঙ্গে বয়ে গেলে চলবে না। ম্যানেজার পদের জন্য নির্বাচন করাতে হবে, ভাল কথা। কিন্তু ম্যানেজার বৈদ্যজী মহারাজই থাকবেন, কারণ কলেজটা ওনারই। অন্য কাউকে ম্যানেজার করার প্রশ্ন উঠছে কেন? এসব ভাল করে ভাবা উচিত”।

ওনার কথাশুনে মনে হল যেন খোদ রঙ্গনাথ আর রূপ্পনবাবু বৈদ্যজীর বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছে, এবং বৈদ্যজীর তরফ থেকে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব গয়াদীন নিজে সামলাচ্ছেন। রঙ্গনাথের মজা লাগছে। ও বলল,”আপনারা হলেন পুরানো লোক। প্রত্যেক বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু ওদিকে যে ভীখমখেড়বী আর অন্য কিছু লোকজন মামার জায়গায় অন্য কাউকে ম্যানেজার করতে চাইছে। জানি না কেন এসব করছে”?

গয়াদীনের কাশি উঠল। ধীরে ধীরে বললেন,” অভিজ্ঞতা নেই, তাই। ওরা ভাবছে ম্যানেজার অন্য কেউ হলে ওরা কিছু করে দেখাবে। কিন্তু এভাবে কোন কিছু হয় নাকি”? তারপর একটু থেমে কথা শেষ করলেন,” যেমন নাগনাথ, তেমনই সাপনাথ”।

কথাটা রঙ্গনাথের পছন্দ হল না। এই উপমায় ওর মামাজী বেশ খাটো হয়ে গেলেন যে! ও তাড়াতাড়ি বলল,”সে বুঝলাম, কিন্তু মামাজীর সঙ্গে তুলনায় ওরা দাঁড়াতে পারে?”

উনি ফের ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, “দেখ একথাটা তো আমি আগেই বলে দিয়েছি। কলেজ বৈদ্যজীর, ওনার হাতেই থাকুক। পঞ্চায়েত রামাধীন ভীখমখেড়ীর, সেটা ওর হাতে থাকুক। সবাই নিজের নিজের ঘরে বসে সন্তুষ্ট হোক। ---

“নির্বাচনের তামাশায় আছেটা কী? নতুন লোককে ক্ষমতায় বসাবে? সেও একইরকম খারাপ হবে। সব একই ধরণের। তাই বলছি—যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই নির্বাচিত করে দাও। পড়ে থাকুক নিজের গুহায়। খামোকা ওলট-পালট করে কী লাভ”?

রুপ্পনবাবু বাটিতে পড়ে থাকা শেষ লাড্ডুটিকে মন দিয়ে দেখতে দেখতে “খাব-কি-খাব না” চিন্তায় মগন। যেই শুনেছেন যে গয়াদীন বৈদ্যজীকেই ম্যানেজার বানানোর পক্ষে, ওনার কথাবার্তায় আগ্রহ শেষ হয়ে গেল। উনি বুঝে গেছেন যে এরপরে খালি ফালতু বকোয়াস হবে। কিন্তু রঙ্গনাথ গয়াদীনের ভাবনায় কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পেল।

যেমন, নির্বাচনে যারাই দাঁড়ায়, তাদের অধিকাংশই অধম এবং নীচ প্রকৃতির লোক। তাহলে যাদের বদমাইশি এবং প্যাঁচ-পয়জার লোকজন চিনে ফেলেছে, তাদের সরানো উচিত নয়। রঙ্গনাথ মনে মনে গণতন্ত্রের এই থিওরির নাম দিল ‘গয়াদীনবাদ’। ওর ইচ্ছে হল আরও কিছু শোনে।

গয়াদীন বলছিলেন, “নতুন লোক এসে কিছু করতেও যদি চায়, তো করবেটা কী? যদি লোকে কিছু করতে দেয় তবে না! আজকাল যে সময় পড়েছে, কেউ কাউকে কিছু করতে দেয়? এখন তো খালি---“।

ছংগামল ইন্টার কলেজের ছেলেদের খেলাধূলার জগতের সঙ্গে ভালরকম পরিচয় আছে। কারণ, কলেজ প্রতিমাসে ওদের থেকে খেলাধুলোর ফীস কান ধরে আদায় করে, যদিও কলেজের কাছে খেলেধুলোর জন্য কোন মাঠ নেই। কিন্তু এনিয়ে কারও হেলদোল নেই। সবাই সন্তুষ্ট। খেলাধুলোর দায়িত্ব গেমস টিচারের। ফলে তাঁর কাছে অফুরন্ত সময়। তাই তিনি মাস্টারদের দুটো দলের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে তাদের ভেতরের খবর বের করে নেন।

এতে প্রিন্সিপালেরও খুব আরাম। এখানে হকি স্টিক নিয়ে মারপিট হয় না, কারণ এদের কোন হকি টিম নেই। আর এসব থেকে কলেজের ডিসিপ্লিনেও কোন আঁচ লাগে না। ছাত্রদের বাপও খুশি, কারণ ছেলেদের খেলার ঝামেলা শুধু ফীস দিলেই মিটে যাচ্ছে। আর ছেলেরাও সত্যি সত্যি কোন খেলোয়াড় হবে না। ছেলেদের দলও খুশো। কারণ ওরা জানে যে হাতে হকিস্টিক নিয়ে একটা ঢিলের টুকরোর মত ছোট্ট বলের পেছনে এই গোল থেকে ওই গোলপোস্ট পর্য্যন্ত পাগলের মত দৌড়তে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণে এক কুঁজো তাড়ির রস গেলা যায়। অথবা, জুয়োর আসরে দাঁও লেগে গেলে চার-ছ’টাকা পকেটে পোরা যায়।

এই ছেলেগুলোর হাতেই আজ হকিস্টিক এবং ক্রিকেট ব্যাট। সেগুলো ওরা এমন কায়দায় ধরেছে যেন ওদের হাতে কেউ রাইফেল গুঁজে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশটা ছেলে এইসব হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে কলেজের গেটের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। রঙ্গনাথ ওদের এই অপরূপ সাজসজ্জা দেখে জানতে চাইল—হয়েছেটা কী? আজ কি স্কুল ইনস্পেক্টরের আসার কথা?

ছোটে পালোয়ান উত্তর দেবার চেষ্টা করল, অর্থাৎ কোমর থেকে আলগা হওয়া লুঙ্গির গিঁট কষে বাঁধল। তারপর বলল,”এইসব পটাপট ঝামেলার মধ্যে কার ইনস্পেকশনের দায় পড়েছে? এসব আয়োজন তো বার্ষিক সভার জন্য “।

ছোটে পালোয়ান কলেজের সমিতির সদস্য বটে। ছেলেরা ওকে দেখে হর্ষধ্বনি করল। গেটের কাছে ওর দেখা হল প্রিন্সিপালের সঙ্গে। উনি বললেন,”আসুন ছোটেলালজী! আপনারই অপেক্ষায় আছি।

--“এসেছি যখন, পালিয়ে যাব নাকি? আপনি আমার আগে চলুন”। এটা ছোটেলাল ভালো মনে বলল। রর্ষাকালে কুকুর বৃষ্টিতে ভিজলে এক বিশেষ ধরণের শব্দ করে হাঁচে। অপ্রস্তুত প্রিন্সিপালের হাসির চেষ্টায় গলা দিয়ে খানিক ওইরকম আওয়াজ বেরোল। উনি পালোয়ানের আগে আগে চলতে চলতে বলা শুরু করলেন,” রামাধীনের দলও কোমর কষেছে। বেজেগাঁওয়ের লাল সাহেবের সাহায্যে আরও কয়েকজনকে ভাঙিয়ে নিয়েছে। লালসাহেব কেন যে এই সব ঝামেলায় নাক গলিয়েছেন। থাকেন তো শহরে, কিন্তু গাঁয়ের সব বিষয়ে নাক গলানো চাই”। রামাধীনের দেমাক বেড়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছেনা যে কতজন এদিকে আর কতজন ওদিকে”।

ছোটে পালোয়ান কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে ফুলের কেয়ারির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রিন্সিপাল বিড়বিড় শুরু করলেন –‘বৈদ্যজী মহারাজও মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যে কী আর বলি—কী দরকার ছিল এই নির্বাচন-টির্বাচন করানোর---‘?

পালোয়ান তখন একটা জনপ্রিয় কীর্তনের লাইন আউড়ে দিল—‘কেন শুনি বাকি লোকেদের কথা, আমার কৃষ্ণ যে প্রাণাধিক—‘!

গেট পেরিয়ে ভেতরে যেতে যেতে প্রিন্সিপাল বললেন—‘আপনিও আসুন রঙ্গনাথ বাবু, আপনার কোন মানা নেই’।

রঙ্গনাথ মাথা হেলিয়ে জানালো যে ও আসছে, কিন্তু ভেতরে গেল না। এবার একজন দু’জন করে কলেজ পরিচালক সমিতির সাধারণ সদস্যরাও ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে আসতে শুরু করেছেন। কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের একজন ডায়রেক্টর এলেন পায়ে হেঁটে। কিন্তু এমন বেগে এলেন এবং এত তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলেন যে ছোকরার দল ওনাকে না দেখে নিজেদের মুখ দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে ঠিকেদার সাহেব এলেন –কলেজের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে, ফসল পায়ে দলে। কিন্তু উনি গেলেন অন্যদিকে, যেখানে কিছু মজুর কোন কাজ করছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু জিনিস আকাশে তুলে মাটিতে পটকে দেওয়ার অভিনয় করে উনি হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলেন। একটু পরে এলেন বাবু গয়াদীন, ধীর পায়ে এসে গেটের কাছে কালভার্টের উপর ছোট সিমেন্ট বাঁধানো জায়গাটায় বসে পড়লেন। উনি উদাসী চোখে দেখতে লাগলেন---ছেলেদের হাতে হকিস্টিক আর ব্যাট এবং একটি ছেলের হাতে ক্রিকেট বল। তারপর ওই বলের দিকে এমন একাগ্র হয়ে তা্কিয়ে রইলেন যেন সম্মোহন করছেন।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন—চলুন মেম্বার সাহেব, অন্য সবাই এসে গেছেন।

উনি এমনভাবে তাকালেন যেন ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন, আর ওনাকে সাক্ষীদের সামনে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে যেতে বলা হয়েছে। অসুস্থ গলায় বলেন, ‘চলুন’। তারপর পেঙ্গুইনের মত পা ফেলে ফেলে উনি গেট পেরিয়ে কলেজ ভবনের মধ্যে অন্তর্হিত হলেন।

আরেকটু পরে সড়কে এক ঘোড়সোয়ারের আবির্ভাব হল, তার মাথায় পাগড়ি। দেখলে মনে হবে যেন ইতিহাসের দ্বাদশ শতাব্দীর পাতা থেকে এক্ষুণি ফরফর করে বেরিয়ে এসেছেন। ছোকরাদের মধ্যে একজন বলে উঠল—“এখন আর কেউ বৈদ্যজীর একগাছিও ছিঁড়তে পারবে না। ঠাকুর বলরাম সিং এসে গেছেন”।

বলরাম সিং এসেই ঘোড়ার লাগাম একটি ছেলেকে ধরিয়ে দিলেন। এখন উনি অষ্টাদশ শতাব্দীর চরিত্র। যেন দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহের খবর দিতে আগ্রার কেল্লায় ঢুকেছেন এমনি গতিতে কালভার্ট অব্দি এসে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘মারপিট হয়নি তো’?

--‘কিসের মারপিট? আমরা প্রিন্সিপালের দলে, অহিংসাবাদী’।

বলরাম সিং গোঁফে তা’ দিতে দিতে হেসে ফেললেন।

--‘তোরাও কিছু কম যাস না। হাতে হকিস্টিক আর ডান্ডা, আবার গান্ধীজির চেলাগিরি’!

ছেলেটা-‘মহাত্মাও লাঠি নিয়েই চলাফেরা করতেন। আমাদের হাতে কোন লাথি নেই। আর হকিস্টিক? এতে একটা বলও মরে না, মানুষ কোত্থেকে মরবে’?

প্রিন্সিপাল আবার বাইরে এসেছেন। ‘চলুন মেম্বার সাহেব, ভেতরে চলুন। কোরাম পুরো হয়ে গেছে। এবার মিটিং শুরু হবে’।

বলরাম সিং পাগড়ির কোনা দিয়ে ঘাম মুছলেন। বললেন,’কোন চ্যালাকে বলে দিন, ঘোড়াকে দানাপানি দিতে। আমি ভেতরে গিয়ে কী করব? আমার যত কোরাম, সব এখানেই’।

প্রিন্সিপাল খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন। বলরাম সিং পাঞ্জাবীর পকেটটা শক্ত করে ধরে বললেন,’বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখুন। কেমন কড়া! এটাই আসল কোরাম’।

প্রিন্সিপাল না ছুঁয়েই বললেন,’ ধরে নিন, ছুঁয়েছি। আরে আপনার কথা কি মিথ্যে হতে পারে’?

বলরাম সিং—‘ আসলী বিলেতি মাল, ছ’ঘরা। দেশি দোনলা নয় যে একবার ফুট্ট্‌ হয়ে থেমে যাবে। ঠাঁয় ঠাঁয় শুরু করে দিলে রামাধীনের দলের ছ’জন চড়াই পাখির মত ফুরুৎ হয়ে যাবে’।

--“ আহা, আপনার জবাব নেই! লা-জবাব”! প্রিন্সিপাল এমন ‘বাহ্‌ বাহ্‌’ করে উঠলেন, যেন বলরাম সিং কোন মুশায়েরাতে কাব্যপাঠ করছেন। উনি যেতে যেতে বললেন—“আমি ভেতরের মিটিংয়ে যাচ্ছি। বাইরেরটা আপনি সামলাবেন”। ফের পেছন ফিরে মহাত্মা বিদুরের বাণী ঝাড়লেন, “যাই করুন, শান্তিপূর্ণ ভাবে”।

বলরাম সিং ফের গোঁফে তা’ দিলেন। “ এখানে সব শান্তি। আমার উড়ুর নীচে গোটা পঞ্চাশেক শান্তি বিরাজ করছে”।

প্রিন্সিপাল সাহেব ভেতরে গেলেন। বলরাম সিং ফের কালভার্টের উপর পুলিয়াতে বসে পড়লেন। খানিকক্ষণ পিচির পিচির করে পানের পিক ফেললেন। তারপর যে ছেলেটা নিজেকে মহাত্মা গান্ধীর থেকে বড় অহিংসাবাদী ডায়লগ ঝেড়েছিল তাকে বললেন,” যাও তো ছেলে; একবার গোটা কলেজ চক্কর মেরে এসো। দেখে এস, আমার লোকজন ভেতরে ঠিক ঠিক জায়গা আটকে পাহারা দিচ্ছে কিনা? আর ব্যাটা রমেসরাকে বলে দাও—সালা যেন কারও সঙ্গে হাঙ্গামা না করে। যে বোঝালেও বুঝবে না তাকে এদিকে গেটের কাছে পাঠিয়ে দেয়, ব্যস্‌”।

ছেলেটা হালচাল বুঝতে ভেতরে চক্কর মারতে গেল। ও যেন একটা বয়স্কাউট, যে ভাবছে দেশের জয়-পরাজয় স্রেফ ওর মিশনের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে। আশপাশের ছেলেগুলোর ছটফটানি বাড়ছে। তাই দেখে বলরাম সিং বললেন—“যাও ব্যাটারা; বেশ বড় চক্কর মেরে ঘুরে এস। আর নিশ্চিন্ত থাক, আমি যতক্ষণ পুলিয়াতে বসে আছি কোন দুশমন এদিকে ঘেঁষবে না”।

বেলা তিনটে। রাস্তা দিয়ে ট্রাক আর বলদে টানা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। বলরাম সিং পুলিয়ার উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে স্বপ্নিল চোখে ওই আসাযাওয়া দেখছেন। একবার ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করে উঠল। উনি বললেন,”সাবাশ মেরে চেতক! সবুর কর। সময় হলে দানাপানি পাবি”।

চেতক সবুর করল এবং প্রমাণস্বরূপ খানিক পরে পরে জল ছাড়তে লাগল। ্কিছু ছেলে ওকে ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার নৈসর্গিক কাজকম্মের আগে ওপরের অবস্থা মন দিয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে পেরাইভেট হাসাহাসি করতে লাগল।

হঠাৎ কলেজের সামনের রাস্তায় একটা ট্রাক এসে থামল। একটি লোক তার থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত পায়ে কলেজের দিকে এগোতে লাগল। তার পরণে পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবী-টুপি আর হাতে একটা ছড়ি। ট্রাককে থামতে দেখেই ছেলের পাল এদিক ওদিক থেকে দৌড়ে দৌড়ে পাকলেজের সামনে পুলিয়ার দিকে দলবেঁধে আসতে লাগল। বলরাম সিং ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে বললেন-- আপনার চরণ স্পর্শ করি পণ্ডিত!

লোকটি বিড়বিড় করে কোন আশীর্বচন বলে সিধে কলেজের গেটের দিকে এগোতে লাগলেন। বলরাম সিং বললেন—“পণ্ডিত, একটু ধীরে। কেউ তোমাকে তাড়া করছে না”।


লোকটি থতমত খেয়ে হাসল। বললেন—মিটিং শুরু হয়ে গেছে না?

বলরাম সিং উঠে দাঁড়ালেন। মাপা পায়ে পণ্ডিতের কাছে এলেন। ছেলের দল এগিয়ে আসছে, প্রায় ঘিরে ফেলছে। উনি ধমকে উঠলেন—“ ভেগে পড় ছেলের দল। একটু দূরে গিয়ে খেলাধূলো কর”। তারপর পণ্ডিতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন-“পণ্ডিত, মিটিংয়ে তোমার হাজিরি লেগে গেছে। এবার ফিরে যাও”।

পণ্ডিত কিছু বলতে চাইল। কিন্তু উনি এবার পণ্ডিতের গায়ে গা লাগিয়ে বললেন—“কিছু ভেবেই বলছি। ফিরে যাও”।

পণ্ডিতের মনে হল জঙ্ঘার কাছে কিছু শক্ত জিনিস ধাক্কা দিচ্ছে। উনি বলরাম সিংয়ের পাঞ্জাবীর পকেটের দিকে তাকালেন এবং হড়বড়িয়ে দু’পা পেছনে হটে গেলেন।

ওনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বলরাম সিং ফের বললেন—“পণ্ডিত, চরণ-বন্দনা”!

লোকটি চুপচাপ ফিরে গেল। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, ট্রাক চলে গেছে। ও এবার কোন একদিকে দ্রুত পায়ে চলতে চলতে হঠাৎ দৌড়তে লাগল। একটা ছোকরা বলল—গেছে!

বলরাম সিং বললেন, “পণ্ডিত সমঝদার; বুঝতে পেরেছে”।

“সমঝদার তো বুঝলাম। কিন্তু অমন করে পালাবার কী হয়েছিল?” –একটি ছাত্রের প্রশ্ন।

বলরাম সিং—“এখনো চ্যাঙড়া বয়েস। একটু বড় হও তখন বুঝবে এমন সময়ে সমঝদার মানুষ এভাবেই দৌড়য়”।

একজন বিদ্যার্থী ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছিল। ঘোড়া ফের চিঁহি করে উঠল। এবার বলরাম ধমকে উঠলেন—“চুপ বে চেতক”!

বয়-স্কাউট ছেলেটি ফিরে এসেছে। বলরাম ঘোড়াকে ধমকানোর সুরেই বলেন, “ কিঁউ বে, ক্যা খবর হ্যায়”?

স্কাউট গেল ঘাবড়ে। ক্লাসে ঘাবড়ে যাওয়া সাধারণ পড়ুয়ারা যেমন দাঁত বের করে তেমনি করে

হেসে বলল,” হ্যাঁ ঠাকুর সা’ব; সব ঠিকঠাক চলছে”।

“ক’জন আদমী এসেছিল”?

“সবাই বুঝে গেছে? নাকি কেউ অবুঝপনা করেছে”?

“সব্বাই বুঝে গেছে”। ছেলেটার সাহস ফিরে এল। দূরে পালাতে থাকা পণ্ডিতের দিকে ইশারা করে বলল, “ওনার মতই ধড়ফড় করে সবাই ফিরে গেল”।

ছেলেটা এবার প্রাণ খুলে হাসল। বলরাম সিং বললেন,” বেশি বুঝে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত”।


কলেজের ভেতর থেকে জয়ধ্বনি ভেসে আসছে। কেউ বলছে—‘ বোল্‌ সিয়াবর রামচন্দ্রকী জয়’!

জয় বলার ব্যাপারে হিন্দুস্তানিদের মোকাবিলা কে করবে? শুরু হল ‘সিয়াবর রামচন্দ্র’ থেকে, ফের ‘পবনপুত্র হনুমানের জয়’। ফের, কেউ জানেনা কেমন করে, ঝটপট মহাত্মা গান্ধীর জয়ে পৌঁছে গেল।

--“বোল্‌ মহাত্মা গান্ধী কী জয়”! ব্যস্‌ সবুজ পতাকা নাড়া হয়ে গেছে। পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু একবার ‘জয়’ পেলেন। তারপর প্রদেশের সব নেতাদের একটা করে। এক-একটা জেলার নেতাদের। এবার আসল জয়ধ্বনি—“ বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী জয়”!

বর্শায় বেঁধা শুওরের মত চিঁচিঁ করতে করতে প্রিন্সিপাল সাহেব বাইরে এলেন। উনিও চেঁচিয়ে উঠলেন—বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী!

‘জয়’ বলার জন্যে পরের প্রজন্ম গেটের সামনে হাজির ছিল।

কলেজের সামনে যেন মেলা বসেছে। প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বোঝাতে লাগলেন, “চলুন, বৈদ্যজী মহারাজ ফের সর্বসম্মতিতে ম্যানেজার নির্বাচিত হয়েছেন। এবার দেখুন কলেজ কেমন দ্রুত উন্নতি করে—ধকাধক, ধকাধক, ধকাধক! ্তুফান মেলের মত গতি”! উত্তেজনায় ওনার চেহারা ক্রমশঃ লাল হচ্ছে।

ছোটে পালোয়ান বলল, “এ প্রিন্সিপাল, বেশি ভড়ভড় করবে না তো। আমারও একটা কোথা শুনে নাও। এই যে ছোঁড়াগুলো হকির ডান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের এক একটা বলও ধরিয়ে দাও। আর বলো কিছু লক্ষ্যভেদ করা শিখতে। এদের মধ্যে একটাও নেই যে বলে ডান্ডা মারতে পারে। সবকটা সাপমারার মত করে ধুলোর মধ্যে লাঠি পেটায়”।

-“অবশ্য, মেম্বার সাহেব, অবশ্য। খেলাধূলোর ব্যবস্থাও হবে। আগে এই ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পাই —“।

ছোটে, “রেহাই তো পেয়ে গেছ। এবার আমাকে বলতে দাও। সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলা তোমার একটা স্বভাব। কিন্তু তোমার লাঙল-চষা ক্ষেতে একটা মূলোও জন্মায় না। খেলাধূলোর ব্যাপারটাও তাই। তোমার ছেলেগুলো শুধু হকির ডান্ডাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজকেই যদি দরকার পড়ত তো ওরা খালি হাওয়াতে ডান্ডা ঘোরাতে থাকত, ব্যস্‌। কারও পিঠে নিশানা করে চালালে সেটা লাগত হাঁটুতে। দরকারের সময় নিশানা ঠিক হওয়া চাই”।

পেছন থেকে বৈদ্যজীর কন্ঠস্বরঃ “খেলাধূলোরও গুরুত্ব আছে প্রিন্সিপাল সাহেব! ছোটের কথা অনুচিত নয়”।

“হেঁ হেঁ”, প্রিন্সিপাল পালোয়ানের দেহসৌষ্ঠব প্রেমিকার চোখে দেখে বললেন, “এ পালোয়ান, নাকি হাসিঠাট্টার ফুলঝুরি! এ কখনও অনুচিত কিছু বলে না”।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






উনিশ

কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষের চেতনা এখনও হয়নি । গাছ কাটা এখনও অব্যাহত আছে ।তাইতো এত গরম ।বৃষ্টির দেখা নেই ।বিজয় খুবই চিন্তার মধ্যে আছে । রাতে তার ঘুম হয়না । বর্ষাকাল চলছে ।সমুদ্র ফুলে উঠেছে আক্রোশে ।কি হয় ,কি হয় ।খুব ভয় ।বিজয় ভাবে,মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বেইমানি করেছে । এর প্রতিশোধ প্রকৃতি নেবেই । তারপর অন্য কথা ।একদিন বর্ষাকালে রাতে সবাই ঘুমিয়ে আছে কিন্তু জেগে আছে সমীর আর বন্যার জলের বিষাক্ত ফণা । মাঝ রাতে বন্যার একটা বড় ঢেউ এসে সমীর ও তার গ্রামের সবাই কে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ধ্বংসের পথে । এখন সেই গ্রাম শ্মশানের মত ফাঁকা ।প্রকৃতি এখনও সুযোগ দিয়ে চলেছে বারে বারে । সাবধান হলে বাঁচবে । পৃথিবীকে সবুজের ঘেরাটোপে সাজাতে হবে। বাঁচার একমাত্র পথ গাছ, শুধু গাছ। বন্যা কমে গেলে নদীর পাড়ে ভাঙা বাঁধটা দশ গ্রামের লোক এসে একত্রে বাঁধলো মাটি আর বাঁশ দিয়ে শক্ত করে। বিজয় বলে সকল গ্রামবাসীকে , আমাদের গ্রামটা সবুজ গাছ করে দাও সবাই একত্রে গাছ রোপণ করে।তাহলে আমদের গ্রাম বাঁচবে।...

একদল বলাকার দল উড়ে এল রিমির মনমেঘে।তখন সে সাদাশাড়িতে সতের।দেহের সাগর ঘিরে উথালপাথাল ঢেউ।ঠিক সেই সময়ে নোঙর করে তার মনের তীরে পূর্ব প্রেমিক সমীরণের ছোঁয়ায় তার শিরশিরে পানসি নৌকার অনুভব।ধীরে ধীরে পালতোলা জাহাজের মত দুজনের প্রেম তরতরিয়ে এগিয়ে চলে।শত ঝিনুকের মুক্তোর সোহাগে দুজনেই রঙীন হয়ে উঠত।

চিন্তার রেশ কাটতেই বিপিন বলে উঠল,রিমি তুমি এত কী চিন্তা করছ?

- কিছু না।এমনি করেই কাটুক সময়।

- আমাদের বিয়ের পাঁচ বছরে একটা অনুষ্ঠান করলে হয় না?

- থাক ওসবে আর কী হবে? এই বেশ বসে আছি নদীর তীরে।

- তোমার অতীতের কথা বলো। আমি শুনব।

- কেন তোমার অতীত নেই

- আমার অতীত বর্তমান হয়ে রাজুর বউ হয়ে বসে আছে।

- ও, রাজুর বউ তোমার পূর্ব প্রেমিকা ছিল?

- হ্যাঁ ছিল একদিন। গ্রামের মন্ডপতলায় গেলেই মনে পড়ে বাল্যপ্রেম।কাঁসর ঘন্টা বাজত আরতির সময়।আমি ভালো কাঁসর বাজাতাম।আর তাছাড়া ওর মুখ দেখার লোভে ছুটে চলে যেতাম পুজোমন্ডপে। আরতির ফাঁকে দেখে নিত ওর চোখ আমাকে।তার চোখের নজর আমার দিকেই থাকত। সারাদিন তাকিয়ে থাকতাম ওদের বাড়ির দিকে।যদি একবারও দেখা যায় ওর মুখ। অসীম খিদে চোখে কেটে গেছে আমার রোদবেলা।

- আমারও অতীতের ভালোবাসা সমীরণ, ভেসে গেছে অজানা স্রোতে।এসো আজ আমরা আবার নতুন মনে এক হই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ চেয়ে।

- হ্যাঁ ঠিক বলেছো তুমি। পুরোনো ব্যাথায় মলম লাগাব দুজনে দুজনকে।চলো আজ নৌকাবিহারে আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করি।

- চলো। নব উদ্যমে এগিয়ে যাই আমরা নবসূর্যের আহ্বানে।

রিমি লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর ভক্ত।বিপিন পুণ্যদাস বাউলের গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।কিন্তু দুজনে দুজনের পছন্দকে শ্রদ্ধা করে।

রিমি বিপিনকে বলে তার প্রিয় লেখিকার কর্মজীবনের কথা,সাহিত্যের কথা।রিমি বলে, পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুরের শবর জনজাতির সঙ্গে মহাশ্বেতা জড়িয়ে ছিলেন আজীবন । তাকে মা হিসেবে মেনে নিয়েছিল শবরাও । পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর ব্লকে লােধা শবর , বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ , রাইপুর এবং পুরুলিয়ার তেরােটি ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী খেড়িয়া শবরদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষে কাজ করেছেন তিনি । এদের উন্নয়নে মহাশ্বেতারকর্মসূচি ছিল শিশুশিক্ষা , বয়স্কশিক্ষা , নারীশিক্ষা , শবরদের মদ্যপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি , তাদের হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করা এবং ব্রিটিশ যুগ থেকে শবরদের গায়ে লেগে থাকা ‘ অপরাধপ্রবণ জনজাতি’রতকমা থেকে তাদের মুক্ত করা।

বিপিন বলে,আমি পড়েছি,এজন্য আইনি লড়াইয়েও পিছপা হননি তিনি । ২০০৩ সালে এই শবরমাতা ম্যাগসাইসাই ’ পুরস্কারের ভূষিত হন । পুরস্কার মূল্যের দশ লক্ষ টাকা পুরােটাই তিনি দিয়েছেন এদের উন্নয়নার্থে । গ্রামে কোন সমস্যা হলেই তিনি সেইসব গ্রামে সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে গেছেন ।

রিমি আবার বলে, মহাশ্বেতার সাহিত্যিক জীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল আরাে অনেক বছর আগে । ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় পদ্মিনী ও যশোবন্তি গল্পদুটি লেখেন মহাশ্বেতা দেবী । পঞ্চাশের দশকের গােড়ায় মহাশ্বেতা দেবী গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে ।১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রাণী, এইমধ্যপ্রদেশের লােককথা ও ইতিহাসের মিশেলে তৈরি । ষাট দশকের গােড়ায় অবিভক্ত বিহারে পালামৌ , হাজারিবাগ , সিংভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সেখানকার বেগার শ্রমিক প্রথা এবং জনজাতিদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে লেখেন ‘ অপারেশন বসাই টুডু, অরণ্যের অধিকার এবং ‘ চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর ‘ । ১৯৭৪ সালে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘ হাজার চুরাশির মা ‘ বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল । পরবর্তীতে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের বিভিন্ন বাংলা পাঠ্যপুস্তকও সম্পাদনা করেন মহাশ্বেতা । ১৯৭৯ সালে বাবা মণীশ ঘটকের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘ বর্তিকা’র দায়িত্ব নেন । ১৯৮৩ সালে পুরুলিয়ার অবহেলিত জনজাতিদের উন্নতির জন্য গড়ে তােলেন পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি । তিনি তার বহু পুরস্কারের অর্থ দান । করেন এইসমিতিকে ।
1

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৯ পর্ব

ব্রিটিশদের লুন্ঠন এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

ব্রিটিশের এই লুণ্ঠন চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। ঐতিহাসিকেরা বলেন ১৭৫৭ থেকে ১৮১৫ সাল (পলাশি থেকে ওয়াটারলু) পর্যন্ত লুন্ঠনের পরিমাণ তখনকার হিসাবে প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড যার আজকের হিসাবে অর্থমূল্য ২২৫০০ কোটি পাউন্ড অথবা কুড়িলক্ষ কোটি টাকা!! (তথ্যসূত্র পি জে মার্শাল রচিত প্রবলেমস অফ এম্পায়ার –ব্রিটেন এন্ড ইন্ডিয়া-১৭৫৭-১৮১৭)। ঈশ্বরপ্রেরিত এই সম্পদে একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠলো ব্রিটেন।বাংলার শরীর থেকে নির্গত রক্তের রঙ লাল থেকে সাদা হয়ে প্রবাহিত হতে থাকলো ব্রিটেনের দিকে বছরের পর বছর ধরে। ইতিমধ্যে ১৭৬৯-৭০ এ প্রকৃতি বাধ সাধলো।বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সে বছর ধান এবং অন্যান্য শস্যের ফলন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলো। চাষীদের ঘরে হাহাকার উঠলো। নদীয়ার উত্তর থেকে বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় শস্যহীন হয়ে পড়লো। ভারতীয় এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা যারা আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল যে শস্যাভাবে এবং খাদ্যাভাবে ধুঁকতে শুরু করবে বাংলা এবং বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তারা আগেভাগে ধান এবং শস্য কমদামে কিনে গুদামে মজুত করে রাখলো। এই রক্তচোষা মজুতদারেরা বারে বারে দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মুনাফার পাহাড় বানিয়েছে। পরে সেই মজুত করা শস্য দ্বিগুন তিনগুন দামে বিক্রি করতো এই মজুতদারেরা। ১৭৭০ সালের গ্রীষ্মে অবস্থা চরমে উঠলো। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারা যেতে শুরু করলো। নিরুপায় মানুষ তাদের গরু ছাগল, চাষের সরঞ্জাম দুমুঠো ভাতের জন্য জলের দরে বিক্রি করে দিল মজুতদারদের কাছে। নিজেরা বাঁচার জন্য নিজের ছেলে মেয়েদের বিক্রি করে দিতে লাগলো মানুষ। অবশেষে যখন আর ছেলে মেয়ে বিক্রি করার জন্য খদ্দের পাওয়া গেলনা তখন গাছের পাতা চিবিয়ে খেতে শুরু করেছিল মানুষ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। মানুষের মৃতদেহ শিয়াল কুকুরের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিল মানুষ। ত্রিশলক্ষ দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে দশলক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল কয়েকমাসে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে এই ভয়ঙ্কর সময়ে কোম্পানি ডিরেক্টররা প্রশাসনের কাছে কম খাজনা আদায়ের জন্য কৈফিয়ত চেয়ে চিঠি পাঠালো । সেইসময় খাজনা আদায়ের প্রধান আধিকারিক ওয়ারেন হেস্টিংস যে পরবর্তীকালে ১৭৭৩ সালে বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে আসীন হয়েছিল সে নিশ্চিত করেছিল যে খাজনা আদায়ের পরিমাণ তার আগের বছরের চেয়ে যেন কম না হয়। কিছু কিছু জেলায় আদায়ের পরিমাণ কম হলেও মোট আদায়ের পরিমাণ একই ছিল বলে জানা যায়। ত্রাণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে খরচের পরিমাণ ছিল ৯০০০ পাউন্ড অর্থাৎ আজরের হিসাবে কুড়িলক্ষ পাউন্ড অথবা ১৮ কোটি টাকা।

মিরকাশিমের হাতে জগতশেঠ মাধবরাই আর তার ভাইপো মহারাজ স্বরূপচাঁদ নিহত হবার পর জগৎশেঠেরা আর তাদের হৃতগৌরব ফিরে পায়নি। মাধবরাই এর বংশধরেরা আরও বেশ কিছুদিন ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল। এমনকি ১৭৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ধারও নিয়েছিল। সম্পর্ক আরও কিছুদিন চলেছিল যদিও স্পষ্টতই জগৎশেঠেদের ব্যবসা পরিকল্পিত ভাবেই ব্রিটিশরা খতম করে দিচ্ছিল। পলাশি পরবর্তী সময়ে কোম্পানির আর্থিক উন্নতি এমন পর্যায় গিয়ে পৌঁছোয় যে ইউরোপ থেকে বুলিয়ন নিয়ে আসার আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। জগৎশেঠেরা এই সুবিধা ছাড়তে চাইছিল না। ১৭৫৮ সালে কাউন্সিল অফ কলকাতা মোগলরাজের কাছে নালিশ করলো যে তাদের ট্যাঁকশাল ব্যবসার জন্য আর কোনও কাজে লাগছে না। এর প্রথম কারণ ইউরোপ থেকে কোনও বুলিয়ন আসছে না। দ্বিতীয়ত জগৎশেঠেদের কাছে সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ব্যবসায় বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য সিক্কার বিনিময়মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ১৭৫৯ সালে ক্লাইভ নিজে ১৭৭৩৪ টাকা খরচ করে হীরা -জহরতসহ প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে জগতশেঠকে অ্যাপ্যায়িত করেও কোনও কাজ হয়নি। অবশেষে ১৭৬০ সালে ট্যাঁকশাল হস্তান্তরের আদেশনামার সর্ত্তে মিরকাশিমকে মিরজাফরের ওপরে বসাল ব্রিটিশরা। সেই দিন থেকে মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশালের পতন শুরু হল এবং কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল ট্যাঁকশাল। তার সঙ্গে সঙ্গেই জগৎশেঠেদের সৌভাগ্যসূর্য অস্তমিত হয়ে গেল ভাগীরথীর জলে। কোম্পানি আর ব্রিটিশদের সৌভাগ্যসূর্য বিরাজ করতে শুরু করলো মধ্যগগনে। ট্যাঁকশালের ওপর জগৎশেঠেদের একাধিপত্য বিলুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস সিদ্ধান্ত নিল যে সরকার যে টাকা জগৎশেঠেদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বলা হলো- যে পরিবার কোম্পানির উন্নতির জন্য এত সাহায্য করেছে তাদের রক্ষার দায়িত্ব কোম্পানির কর্তব্য। অনতিবিলম্বেই ব্রিটিশ ব্যবাসায়ীরা এজেন্সি হাউস তৈরি করে অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় নেমে পড়লো। ইউরোপিয়ন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রমবর্ধমান পুঁজি সঞ্চিত রাখার জন্য নিরাপদ ব্যাঙ্কিং এজেন্সির সন্ধানে ছিল এতদিন। নতুন এজেন্সি হাউস ব্যবসায়ীদের পুঁজির টাকা গচ্ছিত রেখে ধার দেবার কারবার শুরু করলো। ১৭৭০ সালে তৈরি হলো পশ্চিমি কায়দায় তৈরি নতুন ব্যাঙ্ক –ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্তান। অবশেষে ১৭৯৯ সালে ট্যাঁকশালের যন্ত্রপাতি এবং বাড়ি নিলাম করে দেওয়া হলো। জগৎশেঠেদের বিপুল সম্পত্তির এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ এখনও আছে মুর্শিদাবাদে যা দেখবার জন্য ভারতের লোকেরা ১৫ টাকার আর বিদেশিরা ১০০ টাকার টিকিট কিনে ভিতরে প্রবেশ করে এখন।

খোশবাগ একসময় ছিল মুর্শিদাবাদের রাজা মহারাজা আর বর্ধিষ্ণু লোকেদের নৌকাবিহারের কেন্দ্র। ১৭৪০ সালে নির্মিত এই বিলাস উদ্যানের সংলগ্ন নদীর ঘাটে বড় বড় লোকেদের ময়ূরপঙ্খী এসে ভিড়ত সন্ধ্যাবেলা। বিলাসব্যসনে মত্ত হয়ে উঠত মুর্শিদাবাদের ধনী সম্প্রদায়। আজ সেই বাগানে সারি সারি মৃত মানুষের সমাধি। তারা কেউ প্রেমিক, কেউবা চক্রান্তকারী আবার কেউবা বিশ্বাসঘাতক। প্রথম সমাধিগুচ্ছে কারও নাম লেখা নেই। সেখানে শায়িত আছে আলিবর্দির পত্নী, সিরাজের মাতামহী সার্ফুন্নিসা। অনতিদূরেই আলিবর্দির জ্যেষ্ঠাকন্যা, সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগমের সমাধি। এই ঘসেটি বেগম তার অন্য এক বোনের ছেলে পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জংকে সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়েছিল এবং যার ফলস্বরূপ অকালে সিরাজের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল শওকত জংকে। তাছাড়াও সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ক্লাইভকে যুদ্ধজয়ে সাহায্য করেছিল এই ঘসেটি বেগম যার পোশাকি নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। তার পাশেই শায়িত ঘসেটি বেগমের ছোট বোন , সিরাজের মাতা, আমিনা বেগম।

এই সমাধিগুচ্ছ থেকে একটু দূরে সতেরটি সমাধি। এরা সবাই সিরাজের পরিবারের লোক যাদের এক অভিশপ্ত নৈশভোজে খাদ্যে এবং পানীয়ে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছিল মিরজাফরের পুত্র মিরান। সিংহাসনের অন্য কোনও দাবিদার থাকার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য সিরাজকে হত্যার অব্যবহিত পরেই এই নৈশভোজের আয়োজন করেছিল মিরান।একটু দূরে বাঁদিকে ফকির দানা শাহের সমাধি। পলায়নরত ক্ষুধার্ত সিরাজ ক্ষণিকের জন্য ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছিল এই ফকিরের দাতব্য সরাইখানায়। কিন্তু দানা শাহ সিরাজকে চিনতে পেরে অর্থের লোভে নিদ্রিত সিরাজকে তুলে দেয় মিরকাশিম আর মিরানের হাতে। উপহারস্বরূপ এক হাজার টাকা উপহার দেওয়ার পর দানা শাহকে হত্যা করে মিরান।

এর পরে চারদিক ঘেরা কাঠের থাম এবং প্লাস্টারের ছাদবিশিষ্ট একটি হলঘরে সিরাজের সমাধি। তারই পাশে সিরাজের বিশ্বস্ত অনুচর গুলাম হোসেনের সমাধি। এই গুলাম হোসেনের সঙ্গেই পোশাক বিনিময় করে ছদ্মবেশ ধারণ করে সিরাজ। কিন্তু তার পায়ের জুতো দেখে তাকে চিনতে পেরে যায় দানা শাহ। গুলাম হোসেনের সমাধির দু’পাশে শায়িত আছে সিরাজের হারেমরক্ষক দুই খোজা। মিরান এদেরও হত্যা করেছিল।

সিরাজের নিরাভরণ সমাধির ওপর কোনও কোনও দর্শনার্থীর রাখা গোলাপ, গাঁদা বা অন্য কোনও একটি দু’টি ফুল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বোঝাই যায়না এখানেই শায়িত আছে ব্রিটিশের ত্রাস , দোর্দন্ডপ্রতাপ নবাব সিরাজদ্দৌল্লা। সিরাজের সমাধির পায়ের কাছে শায়িত তার পত্নী লুৎফুন্নিসা। তার ডানদিকে সিরাজের একসময়ের প্রেমিকা, নর্তকী এবং সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহনলালের বোন আলিয়ার সমাধি। সিরাজের মৃত্যুর পর তার মা, মাসি, স্ত্রী, কন্যা জোহরা এবং আরও কয়েকজন আত্মীয়া ও পরিচারিকাকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয় মিরান। সেখানে থেকে নৌকাবিহারের নাম করে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে কয়েকজনকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে মিরান। সিরাজের মা এবং মাসি কী ভাবে মারা যায় তা এখনও অজ্ঞাত। কিন্তু কথিত আছে সিরাজের মৃত্যুর পর মিরজাফর এবং মিরান দু’জনেই লুৎফুন্নিসার পানিপ্রার্থনা করে। পিতা এবং পুত্র দু’জনকেই প্রত্যাখ্যান করে সে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি লুৎফুন্নিসা এবং তার মেয়েকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মাসোহারা ও খোশবাগেই থাকার ব্যবস্থা করে। লুৎফুন্নিসা তার বাকি জীবনের প্রতিটি দিন সিরাজের সমাধিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে মাথা ঠেকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত। এমনি ভাবে পঁচিশ বছর কাটিয়ে পতিশোকে অর্ধোন্মদিনী লুৎফুন্নিসা ১৭৯০ সালে মারা যায়। একেবারে বাঁদিকের সারির প্রথমে আলিবর্দির সমাধি।তার নিচে সিরাজের কন্যা জোহরার সমাধি। আলিবর্দির বাঁদিকের দু’টি সমাধি শওকত জং এবং তার স্ত্রী মোতি বেগমের। মিরজাফর, ঘসেটি বেগম এবং অন্যান্য চক্রান্তকারীদের উস্কানিতে শওকত জং সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সিরাজের মৃত্যুর একবছর আগে সিরাজের হাতেই নিহত হয়। এই খোশবাগেই শায়িত আছে আলিবর্দি এবং সিরাজের সমগ্র পরিবার ও পরিজন।

ভাগীরথীর অপরপ্রান্তে জাফরগঞ্জে আছে মিরজাফরের প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ। প্রবেশপথের ওপর ভাঙ্গা ফটকটিকে স্থানীয় মানুষেরা নিমকহারাম দেউড়ি বলেই ডাকে। মিরজাফরের সমাধিক্ষেত্রে টিকিট কিনে ঢুকতে হয়। মিরজাফর ছাড়াও এখানে আছে মিরকাশিম এবং মিরানের সমাধি। তাছাড়া আছে চার প্রহরী এবং হিসাব রক্ষকের সমাধি। কথিত আছে আরও অনেক নাম না জানা মানুষের সমাধির মধ্যে একটি মিরানের প্রিয় টিয়াপাখির। এই সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি বরাদ্দ এগারো টাকা অনাদিকাল থেকে এখনও পর্যন্ত চলে আসছে। হতভাগ্য রক্ষণাবেক্ষণকারীরা ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা করে সমাধিক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংসার প্রতিপালন করে। শোনা যায় এরা মিরজাফরের বংশধর এবং স্থানীয় মানুষেরা এখনও তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার অভিশাপ আর কতো প্রজন্মকে বহন করতে হবে একমাত্র ভবিষ্যৎই তার উত্তর দিতে পারবে।
0

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in







তীব্র গতিতে পাথর আর লাইন পেরোতে দেখে মাথাটা ছ্যাঁৎ করে ঘুরে যায় ত্রৈলোক্যবাবুর! পিছিয়ে আসেন, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা দ্বিধায়! কিন্তু এগিয়ে যান আবার, লোকাল ট্রেনের দরজায়! সাহস করে ঝুঁকবেন বলে যখন ফের প্রস্তুত হচ্ছেন, সেইসময়েই একটা হাত এসে চেপে ধরে ওনার খাদির পাঞ্জাবীটা!

-"পড়ে যাবেন যে! নামবেন নাকি?"

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রৈলোক্যবাবু ঘাড় নেড়ে জানান "না"!

-"নামবেন না যখন, একটু সরে দাঁড়ালে ভালো হয়! আমরা এখানে একটা রীল বানাবো।"

বাধ্য ছাত্রের মত চুপচাপ দরজা থেকে সরে এসে একটা সীটে বসে পড়েন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বছর সত্তর-বাহাত্তরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহাশয় ছেলে তুষারের ফ্ল্যাটে থাকেন একমাত্র পুত্র, পুত্রবধূ রঞ্জনা ও নাতনী রাহী'র সাথে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা আসতে শুরু করে ভদ্রলোকের জীবনে। সর্বশেষ সমস্যাটা ছিল, পুত্রবধূ রঞ্জনার আধুনিক, স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন, যা খুবই "উচ্ছৃঙ্খল আর অসংযমী" মনে হয়েছিল আদর্শবান, নিয়মনিষ্ঠ একসময়ের সংষ্কৃত শিক্ষক মহাশয়ের চোখে। সেই নিয়ে বাড়িতে প্রায়শই লেগে থাকতো অশান্তি! তুষার প্রথমদিকে এই দ্বন্দ্বটাকে সামলানোর চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রঞ্জনার জেদের কাছে নতিস্বীকার করতেই হয়েছিল। কিন্তু আজ দুপুরের ঝগড়ায় যেরকম শাপ শাপান্ত, বাপ বাপান্ত চললো শ্বশুর আর বৌমার মধ্যে, তাতে ত্রৈলোক্যবাবু ঠিক করেই ফেলেছিলেন, আজ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যাই করবেন! সেইমতো সারা বিকেলটা শুনশান গঙ্গার ধারে কাটিয়ে, সন্ধ্যায় এ রাস্তা সে রাস্তা হেঁটে রাতের লোকাল ট্রেনটা ধরেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো রঞ্জনার বয়সীই আরেকটি মেয়ে! সে ত্রৈলোক্যবাবু'কে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে আধপাগলের মত হাত-পা নাড়িয়ে কিসব অঙ্গভঙ্গি করছে আর মোবাইলে তার ভিডিও করছে একটি শীর্ণকায় ছেলে! তাদের ভিডিও করা শেষ হলে মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো, "আপনাকে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছে দাদু! কোথায় যাবেন?"

-জানি না মা!

-কিছু খাবেন?

-নাহ!

-চলুন, আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিই?

-না না, আমি নিজেই চলে যেতে পারবো!

এবার পাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো, "আমরা জানি, আপনি চলে যেতে পারবেন। কিন্তু আমরা যে পারবো না আপনাকে একা ছেড়ে দিতে ... "

বারকয়েকের জোরাজোরিতে শেষমেশ রাজী হতেই হল ত্রৈলোক্যবাবু'কে। ট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা ভদ্রলোক'কে নামিয়ে দিয়ে গেল ওনার বাড়ির সামনে, আর ট্যাক্সিটা ছাড়ার সময় মেয়েটি বললো, "দাদু, আমরা নতুন যুগের মানুষ! একটু আলাদা হতে পারি আপনার থেকে, কিন্তু দিনের শেষে আমরাও তো মানুষই, তাই না? ভুল বুঝবেন না! এই রইলো আমার মোবাইল নম্বর, সমস্যায় পড়লে নিজের মেয়ে মনে করে কল করবেন, চেষ্টা করবো সাধ্যমত ..."

ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে রাহী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে তার দাদু'কে। মাঝরাতের ভেপার আলোর সীমানা পেরিয়ে ট্যাক্সিটা বহু দূরে মিলিয়ে যেতেই আদুরে নাতনি ত্রৈলোক্যবাবুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,"তুমি কোথায় চলে গেছিলে দাদু? মা আর বাবা সেই সন্ধ্যে থেকে তোমায় কত খুঁজছে আর কাঁদছে!"
0

গল্প - জাকিয়া শিমু







আকাশে সুরমারঙের মেঘের দল, ছুটোছুটি ভুলে যেয়ে হঠাৎ করেই যেন দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর মেঘের বরন কালো হয়ে পাহাড়ের মতো জমাট বেঁধে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে ভাবছি-এমন ভারি মেঘে নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে পাল-পাড়ার মাঠে গোঁড়ালী-ছুঁয়া পানি জমবে। ফুটবলটি মাঠের ধারে অশথগাছের জটাতলে লুকানো আছে। কথা আছে- আকাশ কালো হতে সবাই গাছতলায় জড়ো হব! লাল-হলুদ দলের গতকালের বাকি খেলাটুকু আজ বৃষ্টির ভেতর শেষ হবে। বাকিরা হয়তো এতক্ষণে এসে গেছে! আমি মায়ের কাছ থেকে কোন ছুতু ছাতায় ছাড়া পেলে ভূদৌড়ে ছুটে যাবো মাঠে! কিন্তু মা জিগাআঠার মতো আমার গায়ে আরাম করে হেলান দিয়ে কুরুশকাঁটায় সোয়েটার বুনছেন। আমি খাঁচায়বন্দী চড়ুইয়ের মতো ছটফট করছি। এসময়ে সত্যি সত্যি আকাশ ছেড়ে মেঘেরদল ঝুমঝুম ছন্দে ঝরতে শুরু করলো আর তখনই আমার স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল!

ঘুম ভাঙ্গলেও টিনেরচালে বৃষ্টির ঝুপঝাঁপ-শব্দ আমার কানে রয়ে যায়! আমি জেগে উঠলাম নাকি এখনো স্বপ্নলোকে আছি, বুঝতে পারছি না। ঘরের এককোণায় হারিকেনের মৃদু আলো দেখি। বুঝতে পারি এখনো রাত কাটেনি কিন্তু সময় রাতের কোনভাগে বইছে, ঠাহর করতে পারি না। কান পেতে শুনি,দূরে তাঁতিপাড়ার মাকুর ছন্দধ্বনি। এরপর পাশেরবাড়ির জগা কাকার লালমুরগের ডাক। ভোরের খুব পরিচিত এসব শব্দ শেষরাতের ইশারা দেয়। আরও পরে খোলাসা হই, ও-যে টিপটপ শব্দ তা বৃষ্টি নয়, শিউলি ঝরার শব্দ। এখন আশ্বিন মাস। আমাদের ঘরঘেঁষা পুরনো শিউলিগাছের লম্বা ডাল ঘরের চালের উপর ঝুলে আছে। ডাল থেকে বোটা খসে টুপটাপ শব্দে ফুল ঝরছে টিনের চালে। এসময় আমি অধীর অপেক্ষায় থাকি; কখন বাবা জেগে উঠবেন! এবং খট আওয়াজে কপাটের খিল খুলবেন। কপাটের একপাশটা খুলতেই বাবার হাতের কনুঁয়ের ঠিক নিচ দিয়ে সচেতন পায়ে, মা জেগে উঠার আগে বাড়ির সীমানা পেড়িয়ে যাবো! বাবা মৃদু হাসবেন, ও প্রশ্রয়ের হাসি। ও হাসি আমার সারা দিনের সমস্ত দস্যিপনার আশ্রয়। আমি অনেকটা পথ দৌড়ে বাড়ির পূবদিকে বাংলাঘরের ছঞ্চাতলে খানিকক্ষণ জিরোব। তখনও ভোরের নীল আলো ঠিকঠাক ফোটে ওঠে নাই। আমাদের বাড়ি বেশ পুরনো আমলের,কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস। চার-পাঁচ পুরুষ আগে লাগানো গাছপালায় ভর্তি। রাতে এদের দিকে তাকালে ভয় ধরে যায়। মনে হয় যেন অন্ধকারের পাহাড়! বাড়ির সীমানা ছাড়াতে এক চিলতে নদী-আশ্বিন মাসের পাতলা মেঘের মতো শান্তস্নিগ্ধভাবে বয়ে চলেছে। আমি নদীপাড়ে যেয়ে থামি। অন্ধকার তার শাড়ির আঁচলের ভাঁজ পড়তে পড়তে খুলতে শুরু করে। ততক্ষণে নদীর অপরপাড়ে ঠাকুরঘরের কাছ ঘেঁসে বিশাল যে বটগাছটা আছে,তার মাথা বেধ করে লাল টকটকে গর্ভিণী গোলকাকৃতির সূর্যটা আড়মোড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। অন্ধকার পুরোপুরি বিদায় হয়। সকালের সকালের স্নিগ্ধকোমল রোদের চাদর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

নদীরপাড় ঘেঁষে সাপের দেহের মতো আঁকাবাঁকা সরু চিকন মেটেপথ। পথের দু’ধারে অসংখ্য বন-গুল্ম, ঝোপঝাড়- লতাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের গায়ের বুনোগন্ধ হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। সে হাওয়া গায়ে মেখে অচেনা একস্বপ্ন পথে আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলি। পথে বিছানো দূর্বাঘাসের গায়ে লেপটে থাকা শিশিরের আদরস্পর্শে আমার খালি পা ভিজে ওঠে। নদীর দু’পাশে জেগে উঠা চরে অসংখ্য কচুঁরীপানা আটকা পড়ে আছে। বিস্তীর্ণ তীরজুড়ে রঙের খেলা। হালকা গোলাপির মাঝে নীল আর বেগুনির বেষ্টনী মাঝখানে হলুদের ছুঁয়া- একফুলের পাঁপড়িতে এমন অসংখ্য রঙয়ের আলপনা অন্যকোনো ফুলে আছে বলে আমার জানা নেই। দু’হাত ভরে কচুরিপানা ফুল নিয়ে আমি আবার পথ ধরি।

খানিকটা পথ পেরুলে পথটাকে বাঁশে্রসাঁকো ঠিক মাঝ বরাবর চিঁড়ে আলাদা করে দিয়েছে। পথের ও-প্রান্তে যেতে হলে সাঁকো পেরুতে হবে! আমার সাঁকোতে বড্ড ভয়! একদিন সাঁকোর মাঝ বরাবর যেতে পা পিছলে ধপাস করে পানিতে পড়ে যাই। ভাগিস্য, জগাচাচা অল্পদূরে তিনকোণা জালে ইচা মাছ ধরছিলেন। আমাকে জল কাদায় মাখামাখি অবস্থায় তুলে এনে, চাচার সে কী হাসি! আমি ভয় আতঙ্কে কেঁদেকেটে অস্থির। চাচার হাসির কারণ অবশ্য অমূলক নয়। সাঁকোর নিচের জলের গভীরতা ছিল আমার শরীরে উচ্চতার অর্ধেক। আমি ভয়ে পানিতে না দাঁড়িয়ে, শুয়ে পড়ে একহাড়ি জল পেটে পুরেছি। কিন্তু সাঁকো যে আমাকে পার হতেই হবে।

আমার গন্তব্য ক্ষেত্রমোহন দাদার বাড়ি। বাবা ডাকেন ক্ষেত্রদা’। আমিও তাঁকে সে নামেই ডাকি। অবশ্য দাদার বউকে জ্যাঠি ডাকি। জেঠিকে আমার ভিন্ন জগতের মানুষ মনে হয়। আমার সাথে তার তেমন আলাপি সখ্যতা নেই, আমার ধারণা অনেকের সাথেই নেই। তিনি ভারী ব্যক্তিত্বের মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের আব্রুবেড়া ভেদ করে সংস্পর্শে আসতে পারে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। তবে আমাকে সে খুব স্নেহ মমতায় জড়িয়ে রাখেন। তা অবশ্য আমি বুঝতে পারি। আমি তাঁকে ভয় নয়, সমীহ করি। আমি আজ অবধি তার পুরো মুখখানা দেখতে পাইনি। শুভ্র সাদা জমিনে লালপেড়ে তাঁতের শাড়ির আঁচলে মাথার ঘোমটা কপাল পেরিয়ে চোখের খানিক অংশ ঢেকে থাকে। হেসে উঠলে তার পান খেয়ে লাল করা ঠোঁট দু’খানা ভারি রহস্যময় লাগে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখার চেষ্টা করি। ভাঁজপড়া কপালে লাল টকটকে চন্দনের টিপটাকে আমার কাছে চোত- মাসের পরিষ্কার আকাশে ভোরবেলার লাল টকটকে সূর্যটার মতো মনে হয়। সদ্য স্নানে লম্বা এলোমেলো চুলের গুছা আঁচল পেরিয়ে কোমরে এসে দোলে। আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। পুজোর ডালা হাতে তুলসি তলে তাঁর উলুধ্বনি আমাকে কেমন উদাস করে তোলে। সাদা ধবধবে সুতির লাল পেড়ে শাড়িতে শীর্ণ দেহটাকে কলার খোলসের মত করে ঢেকে যখন ধীর পায়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়ান,আমার মনে হয় মেঘেরদেশ থেকে নেমে আসা শরৎ মেঘেরকন্যা বুঝি মাটিতে নেমে এসেছে। আমার পাঁচ বছর বয়সের কল্পনাজল্পনার প্রায় সমস্তটাই এই মেঘকন্যাকে ঘিরে!

আমি সকাল হলে প্রায়ই এ-বাড়ি চলে আসি। বিশেষ করে হাটবার হলে তো কথাই নেই। আমার বাড়িতে আমার ঠিকঠাক স্বাধীনতা নেই। আমার মায়ের প্রায় সবকিছুতে শাসন, বাধা। আমার অমন বদ্ধ চলায় চরম অনীহা। রাতে বাড়ি ফিরে অবশ্য নিয়মমাফিক মায়ের তালপাতার পাখার প্রহার অবধারিত! ওসব উপেক্ষা করে আমি ক্ষেত্র’দা’র বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করি। বাড়ির বাইরের পথঘাট ঠিকঠাক চিনি না, তবে এবাড়ির পথ আমার জানা। বাঁশের সাঁকোর ওপারে খানিকটা পথ পেরুলে স্বর্ণলতায় জড়ানো বরই গাছটা ঘেঁষে, ডান দিকে খেতেরআল বেঁয়ে যে পথটা গিয়েছে, সেখান থেকে ক্ষেত্র’দা’র বাড়িটা স্পষ্টই দেখা যায়। বাবার সাথে সেই বুঝতে অবুঝ বেলা হতে এপথ ধরে আসা যাওয়া।

ক্ষেত্রদা’র বাড়িটি পটে আঁকা ছবির মতোন। বাড়ির তিন পাশটা জুড়ে ফসলের মাঠ, সেসব ছাড়িয়ে আরও দূরে- ধু ধু চোখে পড়ে গাছগাছড়ায় জড়িয়ে থাকা লোকালয়। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে নানান রঙবর্ণের ফসলে ভরে ওঠে মাঠগুলো। অপরপাশে ময়না পিসির বাড়ি। ময়না পিসিকে নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যথা নেই! অবশ্য ময়না পিসিও তাবৎ দুনিয়ার কিছুকে পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। একখানা পাড়বিহীন শাদা শাড়িতে নিজের শীর্ণকায়া দেহটাকে অবিন্যস্তভাবে গুঁটিয়ে রাখেন। আধঃমাথায় ঘোমটা মাঝেমধ্যে টেনে রাখলেও আব্রুসচেতনটা নিয়ে তার কোন বাড়তি আগ্রহ নেই। সারাদিন নিজের মনে বিরবির করে কথা বলেন। মেজাজের আঁচ অতি উষ্ণ। কথায় কথায় ছ্যাঁত করে উঠেন! দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতর থাকেন। পারতপক্ষে কেউ তাকে ঘাটায় না। ক্ষেত্রদাকে বলতে শুনেছি; অল্প বয়সে একমাত্র ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছেন। ছেলে লায়েক হয়ে ওপার বাংলায় চলে গিয়েছে। মা কে অবশ্য নিজের কাছে নিতে চায় কিন্তু তিনি কিছুতেই স্বামীভিটে ছেড়ে যাবেন না। স্বামীর ভিটে থেকে সরাসরি চিতেয় যাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। ক্ষেত্রদা’র কাছের স্বজন, তিনিই তাকে দেখাশুনা করেন। আমি খুব প্রয়োজন না হলে তার সীমানায় ঘেঁষি না। তবে ময়না পিসির ভিটেয় একটি কাঁচামিঠে বরই গাছ আছে। গাছেরতলা বিছিয়ে থাকে ঝরা-বরই। মাঝেমধ্যে লোভ সামলে উঠতে না পেরে সুযোগ বুঝে বরইতলায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। আর তার চোখে পড়লে রক্ষা নেই, মরা চিৎকার জুড়ে দেন! কী নাকি জাতপাত চলে যায়! আমি মুসলিম, সে সনাতন। আবার ক্ষেত্রদা’, জেঠি এরাও সনাতন। এদের জাতে ঘা না লাগলেও ময়না পিসির জাত যায়। এতসব জটিল কথা বুঝি না, আমি দ্রুত তার উঠোন থেকে পালিয়ে আসি!

ক্ষেত্রদা’ আমাকে তাঁর মেয়ের মতো ভালোবাসেন। তাঁর বাড়িটা আমার নিজের বাড়ির চেয়ে আপন মনে হয়। এখানে আমার স্বাধীনতার ঘাটতি নেই। যা খুশি তাই আবদার চলে। এবাড়িতে সুখের কোন অভাব নেই। তবে বিশেষ একটি দিনে এ-বাড়ির চালচিত্র একদমই মরাবাড়ির মতো হয়ে যায়! সেইদিনে,কালিপদ পোষ্ট মাষ্টার একটা ঝুলি কাঁধে নিয়ে ‘ক্ষেত্রমোহন মহাশয় বাড়ি আছেন’-বলে দরাজ গলায় হাঁক তুলেন। ক্ষেত্রদা’ হয়তো তুলসিতলা ঘেঁষে যে পড়ো-ভিটেটি পড়ে আছে,সেখানে বসে নির্ভারে হুক্কা টানছেন। এবং আমি তাঁর পাশে বসে খড়ি দিয়ে মাটিতে আঁকাঝুঁকি করছি। কালিপদ’র হাঁক শুনে ক্ষেত্রদা’র কুচকুঁচে চেহারায় আরেক প্রস্ত কৃষ্ণবর্ণের প্রলেপ পড়ে। হুঁকা থেকে মুখ তুলে নিয়ে আমাকে চোখের ইশারায় কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের কাছে যেতে বলেন।

আমি হাতের খড়ি ছুঁড়ে ফেলে, এক লাফে কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের সামনে যেয়ে দাঁড়াই। কালিপদ তাঁর কাঁধে ঝুলানো লম্বা খাকি রঙয়ের ঝুলা হতে অনেকগুলো নীল খামের ভিতর থেকে একটা নির্দিষ্ট খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ময়না পিসির উঠোন দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়! জেঠি হয়তো রান্নাঘরে মাটির হাঁড়িতে উপচে পড়া ভাতের ফেনা সামলে উঠতে ব্যস্ত। সেকাজ ফেলে হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকেন, যাতে খামটা দাদার হাতে না পড়ে। আমি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে হাত বাড়িয়ে নীলখামটা জেঠির হাতে দিয়ে ভুদৌড়ে শূন্যভিটেয় ক্ষেত্রদা’র গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু পরিচিত সেই ক্ষেত্রদা’কে আর খুঁজে পাই না। তিনি বিমর্ষ মুখে চুপচাপ বসে থাকেন! সারাদিনে মুখে আর বাক্য ফুটে না! জেঠিও মুখ গোমরা করে থাকেন। ক্ষেত্রদাকে উদ্দেশ্য করে নিজের মনে কথা বলেন! এসময়ে ময়না পিসি ক্ষেত্রদা’র দলে ভিড়েন। ময়না পিসির ছেলের সাথে ক্ষেত্রদা’র দু’ছেলেও চলে গেছেন ওপার বাংলায়। ক্ষেত্রদা’ ভুলেও তাদের নাম মুখে আনেন না। এরপর জেঠির চাপাচাপিতে সন্ধ্যা নামলে ক্ষেত্রদা’ তাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসেন। আমার বাবা গম্ভীর হয়ে নীল খামের ভেতর থেকে পত্র বের করে তাদের পড়ে শুনান। ক্ষেত্রদা’ হু হু করে কেঁদে ওঠেন। পত্রের ভারি কথাগুলো আমার বোধগম্য হয় না যদিও এসময় আমি ক্ষেত্রদা’র গা লেপটে পোষা বিড়ালের মতো বসে থাকি।

ক্ষেত্রদা’র বাড়ির দক্ষিণদিকে দমকলের পানি, নালার পথ ধরে ছুটে যায়, দূর ধানক্ষেতের মাঠে। নালার জল কুচকুচে কালো কিন্তু পরিষ্কার। আমি নালারপাড়ে দু’পা ঝুলিয়ে গোঁড়ালী জলে ভিজিয়ে বসে থাকি। দত্তপাড়ার বউ-ঝিরা এসময় সংসারের যাবতীয় বাসি কাপড়,বাসন কোসন পরিষ্কার করতে নালের পাশে ভিড় করে। এবং নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প পাতে। আমি সেসব গল্পে কান পাতি। ওসব গল্পের পুরোটাজুড়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের কষ্টের কথা থাকে। এপার বাংলা ছেড়ে, যারা ওপার বাংলায় গিয়েছে তাদের বিভিন্ন দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভরে এসব আপনজনের কাছে নীলখামে চিঠি আসে। ক্ষেত্রদা’র মতো চিঠি পেয়ে এরাও ফুঁপিয়ে কাঁদে। একসময় এরা একে একে গোপনে বাড়িঘর বেচাবিক্রি করে নিজদেশ ছেড়ে ওপারবাংলায় চলে যায়। কেনো চলে যায় কিংবা কীসের বেদানায় কাঁদে আমি তখনো এসবের কিছুই বুঝি না তারপরও ওদের কষ্টে আমার বুকটা ভার হয়ে আসে।

ওদিকে ক্ষেত্রদা’র বেলা বয়ে যায়। আজ হাটবার। হুঁকায় গুটিকয় টান দিয়ে আমাকে নালার পানি ছেড়ে উঠে আসতে তাগাদা দেন। আমি ফিরে এসে সকালের নরম রোদমাখা শূূন্যভিটেয় শীতলপাটির বিছানায় জোড়াসনে বসে পড়ি। ক্ষেত্রদা’র বাড়িতে বছরজুড়ে নাড়ুমুড়ির আয়োজন। পূজাপার্বণে অবশ্য পদের সংখ্যা ঢের বেশি থাকে। দুধের ক্ষীর দিয়ে বানানো নারিকেলের নাড়ুর সাথে বাড়িতে ভাঁজা কালিকোড়া চালের মুড়ি অমৃতসম। জেঠি বাঁশের সাজিতে মুড়ির ঠিক মাঝখানে নানান পদের নাড়ু সাঁজিয়ে আমাদের সামনে রাখেন। ক্ষেত্রদা’ আমাকে তাড়া দেন, সবজি তুলতে বেলা বয়ে যায়- হাটবার বলে কথা। কিন্তু ওরকম স্বাদের পদ রেখে উঠতে আমার বড্ড দেরি হয়ে যায়। একসময় ক্ষেত্রদা’ চাঙ্গাড়ি কাঁধে নিয়ে ভিটের পথে হাঁটতে শুরু করলে আমি বাকি নাড়ুমুড়ি কুঁচরে পুরে তাঁর হেঁটে যাওয়া পথে ছুটে যাই।

ক্ষেত্রদা’র ভিটেয়, জমি থেকে ঈষৎ উঁচু জায়গা বলে সবসময় আগাম ফসলে ভরে থাকে। শীতেরসবজি শীত না আসতে ভিটেয় উপচে পড়ছে। মূলা,ধনেপাতা,ঢেড়স,পেঁয়াজ- কাঁচা মরিচ, লাউ- কুমড়ো কী নেই তাতে ! কাঁচা সতেজ সবজির গা জুড়ে শিশির বিন্দু নরম রোদের আঁচড়ে ঝিলমিল করছে। আমি ভিটেয় ফিরে কুমড়ো মাচায় এগিয়ে যাই। কুমড়ো ফুল তুলে নিতে। মটর ডালের সাথে আতপ চালের গুঁড়ায় সামান্য হলুদ আর কাঁচা মরিচে অমৃত স্বাদের কুমড়ো বড়ার স্বাদের তুলনা হয় না। মাচা ভর্তি হলুদ কুমড়ো ফুল, মৌমাছিরা মনের আনন্দে হেসে খেলে মধু নিয়ে ছুটছে। ক্ষেত্রদা’র ভিটে ঘেঁসে ডোবা। ডোবা ভর্তি স্বচ্ছ কালো জল। ডোবায় কচুরিপানা দিয়ে ডিবির মতো উঁচু করে ভেলা বানিয়েছেন। কচুরির ছোবার পুঁটুলি বানিয়ে তাতে লাউয়ের বীজ কৌশলে ঢুকিয়ে দিলে কয়েকদিন না যেতে চারাগাছ শিকড় ছেড়ে ছোবার পুঁটুলি ভেদ করে বেরিয়ে আসে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার আগেই লাউগাছে ছেয়ে যায় ভেলা। তার কিছুকাল পরে লাউয়ে লাউয়ে ভেলা ভরে ওঠে! কী মনোরম সে দৃশ্য! আমি ভিটেয় বসে পা জলে ভিজিয়ে ক্ষেত্রদা’র এসব ছইয়ালি কাজ খুব পরখ করে দেখি। ওদিকে ক্ষেত্রদা’র চাঙ্গাড়ি ভরে উঠে হাটে বেচার শাকসবজিতে।

আমরা সবজি নিয়ে ফিরতে জেঠির ব্যস্ততা বাড়ে। মাটির হাঁড়িতে ধোঁয়া উঠা খুদের ভাতের ভেতর থেকে সেদ্ধ বন শিম,আলু বের করতে ক্ষেত্রদা’ তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাঁক দেয়- বেলা গেলো বলে! জেঠি, এক হাতে পেয়াজের খোসা ছাড়েন, অন্য হাতে শুকনো মরিচে জলন্ত ছাই ঢালেন। গরম ছাই এর ভেতর থেকে বিশেষ কৌশলে পোড়া মরিচ বের করে এনে পেয়াজ,ধনেপাতার সাথে ঘানী ভাঙ্গানো সরিষার তেল মাখেন। ততক্ষণে সাদাবেগুন পোড়ার গন্ধ বেরোয় মাটির চুলা থেকে। আলুমাখায় ঘিয়ের মিশ্রন দাদার খুব প্রিয়। জেঠি শিকেয় তুলে রাখা বয়াম থেকে কয়েক ফোঁটা খাঁটি গাওয়া ঘি সাবধানী হাতে মিশিয়ে দেন আলুমাখায়। গতদিনের শিংমাছের ডিম আলাদা করে খোলা বারান্দায় আড়ার সাথে শিকেয় রাতভর ঝুলানো ছিল। সামান্য লবণ আর হলুদ মেখে কচি লাউয়ের পাতায় মুড়ে রান্না শেষে জ্বলন্ত চুলার ছাইয়ের তলায় এরই মাঝে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। তা না হলে যে ক্ষেত্রদা’ চটবেন! গতকাল ডিমওয়ালা শিং এনে জেঠিকে স্মরণ করিয়েছে যে! জেঠি চটজলদি পাতাসহ মাছের ডিমের সাথে সরিষার তেল, মরিচ-পেঁয়াজ ডলে অমৃত বানিয়ে গরম ভাতে ছড়িয়ে দেন। আমরা আমরা একনিমিষে পরম তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে শেষ করি।

“হাটে ছেলে ধরা আছে’। আর সামান্য বড় হলে তবেই আমাকে সাথে নেওয়া হবে”! হাটবার এলেই ক্ষেত্রদা’র এই আশ্বাস-অজুহাত! পরের সপ্তাহের জন্য আমি অধীর অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু পরের সপ্তাহেও আমি উপযুক্ত বড় হই না। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকি উঠোনের পাশে তুলসী তলায়। ক্ষেত্রদা’ আমাকে আদর করে জেঠি- মা ডাকেন। কিন্তু আমি যদি অতিরিক্ত জ্বালাতন করি,তখন খুকি বলে ডাকে! তবে আমাকে একবার খুকি ডাকা মানে তাঁর সারাদিন বিষিয়ে ফেলা! মুখ ফুলিয়ে বসে থাকি এবং সবরকম কথা বন্ধ! আমার ধারণা খুকি নামটা তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে- ইচ্ছে করে এমন যন্ত্রণা কে কাঁধে নেয়! এরপর সে আমার মান ভাঙ্গাতে কত কী যে করে! ওদিকে হাটের বেলা বয়ে যায়। ক্ষেত্রদা’ ব্যর্থ হয়ে জেঠিকে পাঠায়, আমি স্থানু হয়ে বসে থাকি তুলসীতলে। ওদিকে জোর হাতে ক্ষেত্রদা’ আমার কাছ ঘেঁষে বসে থাকে। আমাদের এমন মান-অভিমান খেলায় জেঠি ভীষণ মজা পান। তিনি পান খাওয়া রক্ত জবার মতো ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে ধরে- আমার পক্ষ হয়ে ক্ষেত্রদাকে ভৎসনা করেন। ওদিকে বেলা বাড়তে থাকে। ক্ষেত্রদা’ মাফ পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে-ই থাকে! শেষমেশ অবশ্য আমিই জিতে যাই। মণ্ডা মিঠাই, বিন্নি বাতাসা আর মণ্ডলের দোকানের ফুলরি আমার খুব পছন্দের ফর্দ তাঁকে ধরিয়ে দিয়ে সে যাত্রায় মাফ করে দিই। এবং ক্ষেত্রদা’ ধবধবে সাদা ধুতির উপর হালকা নীল রঙয়ের পাঞ্জাবি গায়ে জড়াতে জড়াতে হাটের পথে দ্রুত পা বাড়ান।

বেশকিছুদিন ধরে কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের আনাগোনা বড্ড বেড়ে যায়। নীল খামের চিঠিগুলোর ভারে ক্ষেত্রদা’ আজকাল অতিরিক্ত বিমর্ষ থাকেন। তুলসিতলার কাছে উঠোনে পা মাথা নিচু করে বসে থাকেন। আমি তাঁকে তাড়া দিই- নামার বিলে শালুক তুলতে যাবো বলে। কিন্তু সে নড়ে না ঠায় বসেই থাকে। জেঠি ক্ষেত্রদা’কে খুব ভালোবাসেন। সে-ও তাঁর পাশে চুপচাপ বসে থাকে। পাল পাড়ার রণজিৎ পাল,ক্ষেত্রদা’র খুব কাছের বন্ধু। তিনি তাঁর বাড়ির পরে এলে তাঁকে ধরে হাঁউমাঁউ করে মরা কান্না জুরে দেন। সময় সময় আমাকে ধরেও ঢুকরে কেঁদে ওঠেন। জেঠিকে আমি আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি। সেই জেঠিও তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে কাঁদেন। ময়না পিসির বিরবির করে কথা বলার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে ক্ষেত্রদা’র বাড়ির স্বাভাবিক চিত্র খুব দ্রুত বদলে যায়! আমি এসবের রহস্য ভেদ করতে পারি না। কিন্তু কষ্টে আমার বুকটা ভেঙ্গে যায়! প্রচণ্ড রাগ হয়, কালিপদ পোষ্ট মাষ্টারের উপর। নীল খামের ভেতর ভাঁজ করা কাগজটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে ইচ্ছে হয়।

একদিন ভর সন্ধ্যায়, জেঠিসহ ক্ষেত্রদা’ আমাদের বাড়ি এসে খুব কান্নাকাটি করেন! আমাকে জড়িয়ে ধরে বেহুঁশে মতো হয়ে যান। বাবা তাঁকে বুঝান, কীসের যেন প্রতিশ্রুতি দেন! এরপরও ক্ষেত্রদা’ কাঁদেন কিন্তু গলা ছেড়ে নয়। কী যেন সবাই লুকায় কিন্তু ওটুকু বয়সে আমি টের পাই না! তবে তাঁর বুকের ভেতর কষ্টের পাহাড় সেটা বুঝতে পারি! বিদায় বেলায় আমাকে বললেন, দিন কয়েকের জন্য বেড়াতে যাবেন এবং ফিরে এসে আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবেন। খালি বাড়িতে যাতে না যাই।

এরপর দিন যায়, মাসও কেটে গেল কিন্তু ক্ষেত্রদা ফিরে আসল না! আমি অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হই। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। আমি স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলে যাই কিন্তু মন পড়ে থাকে ক্ষেত্রদা’র বাড়ি- দাদা, জেঠির কাছে। কিন্তু ক্ষেত্র দা’ আর ফিরলেন না! আমি হাঁপিয়ে ওঠি। আমার ভেতর ভয়ংকর ভাঙ্গাগড়া চলে। আমার প্রচণ্ড জ্বর হয়। জ্বরের ঘোরে আমি ক্ষেত্রদা’ বলে চিৎকার করি। আমাকে নিয়ে আমার বাড়ির মানুষ অস্থির হয়। ডা.আমাকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হয়। এতকিছুর পরও ক্ষেত্রদা’রা ফিরে আসে না!

একদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে খুব ভোরবেলায় অন্ধকারে পালিয়ে ক্ষেত্রদা’র বাড়ি যাই। কিন্তু বাড়ির সামনে যেয়ে থমকে দাঁড়াই! এই যে এক ভিন্ন জায়গা! ক্ষেত্রদা’র বাড়ির সাথে এর ছিটেফোঁটা মিল নেই! আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। তখন অন্ধকার কেটে সূর্য প্রায় উঠো উঠো করছে। আমার ভ্রম হয়। সংশয় হয়, ভুল করে ভিন্ন বাড়ি চলে এসেছি না তো! কিন্তু না,সবই ঠিক আছে কিন্তু বাড়িটি যে এর পূর্বের বাড়িটি নেই! জেঠির সেই লেপাপোছা ধবধবে শাদা মাটির ঘরটি নেই, আধঃখোলা রান্নাঘর সেটাও নেই,পড়ো ভিটেটি সেও উধাও! বাড়িটির সমস্ত ভিটেগুলো গুঁড়িয়ে সমান করা হয়েছে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে উঁচু করে ইট-বালু স্তুপ পালা দেওয়া! ইট কাটের দালান উঠবে হয়তো। আমি প্রচণ্ড বিমর্ষ হয়ে পড়ি। শরীরটা অবসন্ন লাগে! অনেকটা জোর করে অবশ-পায়ে তুলসীতলার দিকে এগিয়ে যাই। তুলসী গাছের কোন অস্তিত্ব নেই, মরে পচে মাটির সাথে মিশে গেছে! ঘন সবুজ শ্যাওলায় ঢেকে আছে গোবরে লেপা জেঠির সেই তুলসীতলা! ময়না পিসির ঘরটায় একটি নতুন তালা ঝুলছে! অর্থাৎ মালিক বদল হয়েছে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে! বুকেরপাঁজর দুমড়ে মুচড়ে বের হয়ে যাবে মনে হয়! শরীরটা অবশ হতে হতে, চোখদুটো আলগোছে মুদে আসে! এরপর আমি অসীম শূন্যতায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকি! তারপরের কিছু মনে নেই। একটা সময় পর হুঁশ ফেরে। চোখ মেলে দেখি, আকাশ ভরা মেঘ! আমি মেঘের উপর ভাসছি! হঠাৎ মেঘের ফাঁকে চোখ পড়তে চমকে উঠি! দেখি - দূরে আকাশের পরে ক্ষেত্রদা’র বাড়িটি ভাসছে! আমি দু’হাত মেলে উড়ে সেই বাড়ির পথে এগিয়ে যাই!
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in





ঈশ্বর যাদের ভাত বরাদ্দ করেনি
ঈশ্বরে গভীর আস্থা তাদের।

ক্ষিদে নত হতে শেখায়।

আস্থার পরাকাষ্ঠা মানুষগুলো
অলৌকিকের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি করে।

0

কবিতা - শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in






হিজল কাশের দেশে একদিন গিয়েছি বেড়াতে
সবুজ সুপুরি ক্ষেতে জোলো হাওয়া
উদার আকাশ জুড়ে তারাদের দিয়েছে প্রশ্বাস
ধূসর জগত থেকে জেগে ওঠে স্টিমারের সুর
গোয়ালন্দ কতদূর, গোয়ালন্দ আর কত দূর...

কেন এত ব্যবধান ভাটিয়ালী বাউলের মাঝে ?
এপারে ওপারে ব্যথা
এপারে ওপারে কান্না
এপারে ওপারে বাঁশি একই কথা বলে
গোয়ালন্দ আমাদের ধূসর জগত
গোয়ালন্দ একদিন ছিল ।

হিজল কাশের দেশে ফের আমি গিয়েছি বেড়াতে
সবুজ গ্রামের সীমা পার হয়ে ঝকমকে শহরের পথে
উদার আকাশ জুড়ে আজও তারা ফোটে
মেছুয়া মাঝির দল আজও সেই এক সুর বুকে নিয়ে
ভেসে যায় জোয়ারের বুকে
তিরতিরে জোলো হাওয়া আজও ঠিকই বয়
ফিসফিস বলে যায় –
দূরে নয়, গোয়ালন্দ বেশী দূরে নয়...

2

কবিতা - ঝানকু সেনগুপ্ত

Posted in







একটা নদী বুড়ো হলে
পাল্টে যেতে পারে তার বোধ
জেগে উঠতে পারে উচ্চারণের বহুত্ব

একটা নদী বুড়ো হলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in







কুমড়ো পাতার শুক্তো

তেতো ছাড়া শুক্তো করতে হলে এটি বানানো যেতেই পারে। এই শুক্তো বানাতে উপকরণও বেশী কিছু প্রয়োজন নেই। বেশ অনেক গুলি কুমড়ো পাতা, আঁশ ছাড়িয়ে, কুচিয়ে রাখতে হবে। আদা, রাঁধুনি ও সামান‍্য ধনে একসঙ্গে বেটে একটি মশলা তৈরী করে নিতে হবে। সামান‍্য সর্ষে বেটে রাখতে হবে। রাঙালু বা কুমড়ো টুকরো করে কেটে নিতে হবে।

তেল গরম করে বড়ি ভেজে উঠিয়ে রাখতে হবে। সামান‍্য সর্ষে ফোড়ন দিয়ে ওইটুকরো করা সব্জিগুলি দিয়ে ভাজতে হবে। সামান‍্য নুন হলুদ দিয়ে রান্না করতে হবে। মিনিট পাঁচেক পর প্রথমে ওই মশলাটা দিয়ে মিনিট খানেক ভেজে, কুচিয়ে রাখা কুমড়ো পাতাগুলি দিয়ে আঁচ কমিয়ে রান্না করতে হবে। পাতা থেকে জল বের হয়ে সেই জলেই রান্না হবে। পাতা সেদ্ধ হয়ে গেলে সর্ষেবাটা ও বড়ি দিয়ে আরোও একটু সময়ে রান্না করে নামাতে হবে।

রাঙালু বা কুমড়ো দিলে চিনি দেবার প্রয়োজন হয় না। তবে, সেই ধরণের সব্জি না থাকলে আলু ব‍্যবহার করা যেতে পারে বা কোনো সব্জি ছাড়াও পাতা রান্না করা যাবে। সর্ষেবাটা না দিলেও চলে। নুন একটু কম হাতে দেওয়াই ভালো।




0

সম্পাদকীয়

Posted in






বিচারের আশায় ইতিমধ্যে দু'মাস অতিক্রান্ত। প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রিতার যাবতীয় আয়োজন চূড়ান্ত হয়েছে নিয়ম মেনেই। প্রাথমিকভাবে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্বে যাঁদের থাকার কথা ছিল, অনেক আগেই তাঁরা নিজগুণে নিষ্কৃতিলাভ করেছেন। এখন দোষারোপ এবং পাল্টা দোষারোপের খেলা চলছে। অবশ্য আগেই বলা হয়েছিল, 'খেলা হবে'। সে প্রতিশ্রুতির অন্যথা হয়নি।

মুশকিল হল কয়েকটি অবাধ্য ছেলেমেয়েকে নিয়ে। যারা প্রশাসনিক রদবদল এবং আরও কিছু অস্বস্তিকর দাবিদাওয়া নিয়ে আজ দু'সপ্তাহব্যাপী অনশনে। অনেক বিদ্রূপ, প্রলোভন এবং চাপের মুখেও এরা অনড়। অনমনীয়। এদের মূল শক্তি তারুণ্য এবং আদর্শবোধ। যার ভিত্তি নিশ্চিতভাবেই এক ধরনের মূল্যবোধের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা।

এমন দৃশ্য এ রাজ্য তো বটেই, এ দেশও দেখেনি কখনও। জটিল রাজনীতির আবহে এবং আবর্তে ভবিষ্যতে এই আন্দোলনের অভিমুখ কী হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। তবু টগবগে এই ছেলেমেয়েগুলি যে নতুন করে আমাদের ভাবতে শেখালো, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। মেকি অনেক সম্পর্কের খোলস খসে গেল দমকা এই হাওয়ায়। আগলহীন হয়ে পড়ল দম্ভের অট্টালিকাগুলি।

সুস্থ থাকুন। মননে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।
2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


 



         

চারপাশে গাছপালা ঘেরা একটি পুকুর। চাঁদনী রাতের আলোতে তার টলটলে জলে মায়াবী ঝিলিমিলি খেলা। পুকুরের ঘাটে বসে এক তরুণ আনমনে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি। তার মূর্চ্ছনা পৌঁছে যায় এদিক সেদিক। পাশের একটি বাড়ির জানালায় এক কিশোরীর মুখ। বাঁশির সুর তাকে করেছে সম্মোহিত। পরদিন দুজনের দেখা। মেয়েটি বললো, “কাল রাতে আপনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন ? আমি শুনেছি।“

যুবকটি গাছের ছায়ায় শীতলপাটিতে বসে দিনের পর দিন অবলীলায় রচনা করে কবিতা,অনায়াসে বেঁধে চলে কত গান। মেয়েটিকে শেখায় সে গান, গ্রামের অন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। স্বল্পশিক্ষিতা গ্রাম্য তরুণীটি এমন প্রতিভা, এমন অনাবিল স্বতস্ফূর্ত সৃজনী আগে দেখেনি। তার চোখেমুখে বিস্ময়, মুগ্ধতা। আর তরুণটি অভিভূত ঐ ষোড়শী কন্যাটির অনন্যা রূপে। তার সৌন্দর্য্, সৌষ্ঠভ তরুণটির হৃদয়ে এনে দিলো এক অনাস্বাদিত আলোড়ন। জাগিয়ে তুললো সৃষ্টিসুখের উল্লাস।

আর এক দৃশ্য। মেয়েটি জ্বরাক্রান্ত। যুবকের মন ব্যাকুল। সে চায় তার পাশে বসে তার তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু রীতিনীতির বাঁধা। অবশেষে সুযোগ হলো। অনেক বছর পরে লিখেছিলো,”বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে ? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি।“

এরা কালিদাসের কোন কাব্য, সেক্সপীয়রের কোন নাটক, বা শরৎচন্দ্রের কোন উপন্যাসের পাত্রপাত্রী হতে পারত অনায়াসে। কিন্তু এই চরিত্ররা কাল্পনিক নয়, নেহাতই বাস্তব। গ্রামটির নাম কুমিল্লা জেলার দৌলতপুর। তরুণীটির নাম সৈয়দা খাতুন। আর যুবকটি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একদিন নজরুল সৈয়দা খাতুনকে বললেন, “এমন ফুলের মত যার সৌন্দর্য, তার এ নাম কে রেখেছে ? আজ থেকে তোমার নাম নার্গিস।“ সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেলো নার্গিস, পুরো নাম নার্গিস আসার খানম। পারস্যদেশের একটি গুল্মের অতি সুগন্ধী শ্বেতবর্ণা ফুলের ফারসি ভাষায় নাম নার্গিস।

প্রেমের এই আলোড়ন নজরুলের সৃজনীসত্বাকেও উদ্বেলিত করেছিল এক বিপুল আবেগে। দৌলতপুরে অবস্থানকালেই নজরুল প্রায় ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায় বেলায়’, ‘হারমানা হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা’, ‘পথিক প্রিয়া’ ইত্যাদি কবিতা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই পর্বের অনেক বছর পরেও একাধিক বিরহ-বেদনা-অভিমানের গান তিনি সৃষ্টি করেছেন, যা এই সময়ের প্রতিফলন বলে অনেকে মনে করেন।

হ্যাঁ, এই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। এর ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র আড়াই মাস, বা তারও কম। অথচ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানও অতি সমারোহে আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান থেকে কোন কারণে নজরুল নিজেকে প্রত্যাহৃত করেন। ঠিক কি ঘটেছিল তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। অনেক নজরুল গবেষক বা জীবনীকাররা অনেক কথাই লিখেছেন। ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, অসততা ইত্যাদির উপাদান সম্বলিত বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত। সে সবের সত্যাসত্য নিয়েও মতভেদ আছে। কিন্তু এই প্রেমপর্বের যে ঘটনাক্রম নিয়ে দ্বিমত নেই, তাই প্রথমে বিবৃত করা যাক।

বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পেয়ে নজরুল তখন কলকাতায়। ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকায় কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করেছিলেন,তখন তাও নেই। এদিক ওদিক কিছু কিছু লেখা বেরিয়েছে কয়েকটি পত্রপত্রিকায়। তবে খ্যাতি-পরিচিতি তখনও তেমনভাবে আসেনি। তিনি তখন যুক্ত ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে, থাকতেন ৩২ কলেজ স্ট্রীটে তাদেরই ভবনে। সেখানে মোহম্মদ মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মহম্মদ শহীদুল্লাহ ইত্যাদি তখনকার তরুণ মুসলিম লেখকরা তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। সদা প্রাণোচ্ছল, হাস্যময় নজরুলের বান্ধববৃত্ত বিস্তৃতই ছিল।

এদেরই মধ্যে একজন ছিলেন আলী আকবর খান। তিনি নজরুলের থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় ছিলেন। কলেজ স্ট্রীটেই দুজনের পরিচয়। আলী আকবর কিছু কিছু লেখালেখি করতেন, একটা নাটক ও কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু তার মান বিশেষ উঁচু ছিল না। তিনি নিজেই সে সব ছাপিয়ে বিক্রী করার চেষ্টা করতেন। ঐ পাড়ায় তাঁর একটি প্রকাশনা ছিল, মূলত পাঠ্যপুস্তকের। অবশ্য নজরুলের সম্ভাবনাময় প্রতিভা চিনে নিতে তাঁর দেরী হয়নি।

এই আলী আকবর খান ছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের এক সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। গ্রামে বিষয়-সম্পত্তি তাঁদের কম ছিল না। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নজরুলকে তাঁদের গ্রামের বাড়ীতে যাবার আমন্ত্রণ করছিলেন। শেষে আলী আকবরের অগ্রজ নেজাবৎ আলীর মেয়ে আম্বিয়া খানম মানিকের বিবাহ উপলক্ষ করে নজরুল দৌলতপুর যেতে রাজি হন।

১৯২১ সালের ৩রা এপ্রিল নজরুল ও আলী আকবর রেলপথে যাত্রা করে পরদিন রাতে কুমিল্লা পৌঁছান। কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব আরও প্রায় ৪০ কিলোমিটার। সে সময়ে রাতের বেলায় অত দূর পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না। কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় আলী আকবরের এক স্কুলের সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ীতে দুজনে থাকা মনস্থ করেন। বাড়ীটি ছিল বীরেন্দ্রর বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের। তাঁর স্ত্রী এবং ইন্দ্রকুমারের মা’র নাম বিরজাসুন্দরী। এই পরিবারটি ছিল সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক এবং উদারমনা। নজরুল-নার্গিস পর্বে এবং নজরুলের পরবর্তী জীবনেও বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবারের একটি বিশেষ ভুমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। এক রাত মাত্র নয়, নজরুলরা এ বাড়ীতে আরও দু-চার দিন অতিবাহিত করেন। এই স্বল্প পরিসরেই নজরুল এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, এবং বিরজাসুন্দরীকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন।

কান্দিরপাড় ছেড়ে নজরুল ও আলী আকবর অবশেষে দৌলতপুরে পৌঁছোন। সেখানে আলী আকবরের পরিবার ও দৌলতপুরবাসীরা নজরুলকে অতি সমারোহে অভ্যর্থনা করেন বলে কথিত আছে।

বিয়ের আসর নজরুল মাতিয়ে দিয়েছিলেন গান গেয়ে আর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছলতা দিয়ে। সেই বিয়েতে গান গেয়েছিল আরেকটি মেয়ে – আলী আকবরের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুন। সেই প্রথম পরিচয়। দুই তরুণ মনের পারস্পরিক আকর্ষণের সুত্রপাত। সৈয়দা খাতুন আলী আকবরের বোন আসমাতুন্নিসার ছয় সন্তানের পঞ্চম। তাদের বাড়ী পাশেই ছিল। শৈশবেই অনাথা হওয়ায় মেয়েটি আলী আকবরের পরিবারের স্নেহ-দাক্ষিণ্য অর্জন করেছিল, তাদের বাড়ীতে অবাধ যাতায়াত ছিল। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের পর সেই যাওয়া আসা আরও বেড়ে গেল। নজরুলের কোঁকরা বাবরি চুল, তীক্ষ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, স্বভাবের উষ্ণতা আর সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রতিভা যে কোন তরুণীকে বশীভূত করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল। আর নজরুল নিজে ? অগ্রজ বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সেই সময়ের এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এক অচেনা পল্লীবালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি যা কোন নারীর কাছে হইনি।“

প্রথম পরিচয় থেকে পুরোদস্তুর প্রেম রূপায়িত হতে এক-দেড় মাসের বেশী সময় লাগেনি। এরই মধ্যে বদলে গেল মেয়েটির নাম, ভালবাসা উদযাপিত হতে লাগল নতুন নতুন গানে কবিতায়, অদম্য হয়ে উঠল দুজনে দুজনকে বেশী করে কাছে পাওয়ার আকুতি। এ সব দৃষ্টি এড়ালো না একজনের। তিনি মামা আলী আকবর খান। অনেকের মতে ঘটনাক্রমের এই বিবর্তনে তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। অচিরেই তিনি দুজনের বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। শোনা যায় তখনকার ‘চালচুলোহীন’ নজরুলকে নিয়ে খান পরিবারে একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু শিক্ষিত বিএ পাশ আলী আকবরের সিদ্ধান্ত শেষে সকলকেই মেনে নিতে হল। আর মিয়াঁ-বিবিকে রাজী করাতেও বেশী সময় লাগেনি। অতএব বিয়ের দিন ধার্য হল ১৭ই জুন ১৯২১ (৩রা আষাঢ় ১৩২৮)।

নজরুল নার্গিসের এই বিবাহানুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করেই আয়োজিত হয়েছিল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ ওস্তাদ আলাউদ্দিন।

খাঁ ও তাঁর ভাই ওস্তাদ আফতাবুদ্দিন ফকির যিনি সেই অনুষ্ঠানে বাঁশিও বাজিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আনা হয়েছিল ২০ জনের একটি গাইয়ে-বাজিয়ের গোষ্ঠি। স্থানীয় গণ্যমান্যদের মধ্যে বাঙ্গরার জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার, সেখানকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনীমোহন মজুমদার ইত্যাদিরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নজরুলের কলকাতার বন্ধুবান্ধবরা কেউই গিয়ে উঠতে পারেননি। অবশ্য কান্দিরপাড়ের বিরজাসুন্দরী, তাঁর স্বামী ইন্দ্রকুমার ও পুত্র বীরেন্দ্রকুমার সহ সেই পরিবারের বেশ কয়েকজন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানের জন্য নাকি ১৫০০০ টাকা খরচা হয়েছিল। আর,

দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাসভবন যেখানে নজরুল-নার্গিসের প্রেম প্রস্ফুঠিত হয়েছিল
      



এমনও শোনা যায় যে নার্গিসের জন্য দেনমোহর ধার্য্য হয়েছিল ২৫০০০ টাকা (মতান্তরে ২০০০০ টাকা)!

কিন্তু বিয়ের আকদ পর্বেই কাবিননামা নিয়ে শুরু হলো সমস্যা, বাঁধল বিরোধ। ঐস্লামিক বিবাহে কাবিননামা বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত একটি চুক্তিপত্র। এই কাবিননামায় একটি শর্ত ছিল এই যে, বিয়ের পর নার্গিসকে নিয়ে নজরুল কোথাও যেতে পারবেন না, তাঁদের দৌলতপুরেই থাকতে হবে। এই শর্তটি নিয়ে বিশেষ মতবৈষম্য কোন বিবরণীতে পাইনি। স্বাধীনচেতা, উচ্ছল বোহিমিয়ান স্বভাবের নজরুলের পক্ষে এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর কাছে এ ছিল তাঁকে ঘরজামাই করে রাখার প্রস্তাব। তিনি অসম্মতি জানালে শুরু হয় প্রবল বাকবিতন্ডা। বরপক্ষে নজরুল ছিলেন একা। অন্যপক্ষ থেকে বর্ষিত হয় নানা কটূক্তি। কিছু আমন্ত্রিত বয়স্কদের মধ্যস্থতায় আবহাওয়া সামান্য শান্ত হলেও নজরুল প্রচন্ড অপমানিত বোধ করেন এবং বিবাহ অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

কোন কোন গবেষকদের মতে নজরুল নার্গিসকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু তরুণী নার্গিস এত বড় ফয়সালা করে উঠতে পারেননি। অগত্যা অসীম তিক্ততা নিয়ে ক্ষুব্ধচিত্ত নজরুল উপস্তিত হন বিরজাসুন্দরীর কাছে, এবং তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। সব শুনে বিরজাসুন্দরীর মনে হয়, সেই মুহুর্তে নজরুলের মনের যা অবস্থা, তাতে তাকে বিরত করা সম্ভব নয়। তখন ঘোর রাত, বাইরে ঝড়বৃষ্টি চলছে। বিরজাসুন্দরী তাঁকে অনুরোধ করেন বীরেন্দ্রকুমারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। অতঃপর নজরুল ও বীরেন সেই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে কর্দমাক্ত রাস্তা খেতখামার পায়ে হেঁটে পার করে কান্দিরপাড় পৌঁছলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকদিন অতিবাহিত করার পর মুজফ্ফর আহমেদের অর্থসহায়তায় নজরুল কলকাতা ফেরৎ যান।

সেই যে গেলেন, আর কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। নার্গিসের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে লেখা নার্গিসের একাধিক চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেননি। অথচ ব্যর্থ প্রেমের জ্বলনে দগ্ধ চিত্তে রচনা করেছেন কখনো ট্র্যাজিক, কখনো ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী গান-কবিতা। বন্ধুকে লিখেছেন, “এই বন্ধন ছিন্ন করে দুঃখ পেয়েছি আমিই সব চেয়ে বেশি। আমার নিজের বুকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে. হিয়ায় হিয়ায় আমার এক বীভৎস খুন-খারাবি . . খানখান খুন! কেমন এক বিদ্রোহ অভিমানে আমার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। নাই নাই, এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা নিয়ন্তা কেউ নাই।“

দৌলতপুরে না গেলেও কুমিল্লায় কিন্তু নজরুল এর পরও গিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। কখনো সাহিত্য সভায় যোগ দিতে, কখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সভায় মিছিলে অংশ নিতে। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন এই কুমিল্লাতেই। কিন্তু অন্য আরেকটি কারণও ছিল কুমিল্লা আসার। তা হল বীরেন্দ্রকুমারের বিধবা জ্যেঠিমা গিরিবালা দেবীর কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা। কান্দিরপাড় থেকে বিরজাসুন্দরীর পরিবারের যে সদস্যরা নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই আশালতাও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর। প্রথম প্রেমের শোচনীয় পরিনতির পর নজরুল যখন কুমিল্লায় আসতে লাগলেন তখন আশালতার সঙ্গে ক্রমে ক্রমে পরিচয়, সখ্যতা পেরিয়ে পুনরায় ভালবাসার উদ্ভব হল, এবং পরিশেষে ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় তাঁদের অনাড়ম্বর বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবার এই পরিণয়ের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু বিধবা গিরিবালার অত্যাশ্চর্য্য দৃঢ়তা এই আন্তরধর্মীয় বিবাহ সম্ভব করেছিল। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম রাখেন প্রমীলা। প্রমীলাই আমৃত্যু নজরুলের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন।

আর নার্গিস ? তিনি সুদীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিলেন। নজরুলকে গোটাচারেক চিঠি লিখেছিলেন। শেষ চিঠিটি ছাড়া আগেরগুলির কোন উত্তর নজরুল দেননি। নার্গিসের চিঠিগুলির বয়ান নজরে আসেনি। তবে শেষ চিঠিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন যে প্রমীলাকে বিয়ে করার জন্য তাঁর কোন অনুযোগ নেই, কিন্তু একবার তিনি নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চান। এমনকি আত্মহত্যার ইচ্ছাও নাকি প্রকাশ করেছিলেন। এর উত্তরে নজরুল একটি বিস্তারিত চিঠি লেখেন। এই গুরত্বপূর্ণ নথিটি কিন্তু সর্বত্র উপলব্ধ। তার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি শুরুতে দিয়েছি, প্রয়োজন মত অন্য জায়গায় আবার উল্লেখ করা যাবে। নার্গিস অবশ্য আত্মহত্যার পথে যাননি। দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং দু-একটি ঘটনার পর তিনিও বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন, ১৯৩৮এর ১২ই ডিসেম্বর, আলী আকবর খানের ঢাকার গ্রন্থন ব্যবসায়ের সহযোগী সাহিত্যিক আজিজুল হাকিমের সাথে।

য়ৌবনে নজরুল
                   



বিবরণীর এই পর্যায়ে আলোচনায় আসি বিবিধ বিতর্কিত বাদ-প্রতিবাদের বিষয়গুলিতে।

নজরুলের গুণগ্রাহীরা তাঁর প্রেমের এই কঠিন বেদনাসম্পৃক্ত পরিণতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছেন আলী আকবর খানকে। এঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোঘ্য নজরুলের অভিভাবকস্থানীয় সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্মৃতিচারণা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’। তিনি সরাসরি আরোপ করেছেন, ‘আলী আকবর খান দাম্ভিক, মিথ্যাভাষী ও শঠ’। স্বপক্ষের অভিমত পোষণকারীরা বলেন, আলী আকবর খানের হাবভাব এবং কোন কোন ক্রিয়াকলাপ নজরুলের কলকাতার বন্ধুরা মোটেই ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁর সঙ্গে দৌলতপুর যাওয়া থেকে বিরত করার জন্য নজরুলকে বন্ধুরা উপদেশ দিয়েছিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের ভাষায় তিনি স্পষ্টতই কবিকে বলেছিলেন, ‘কি মতলবে তিনি তোমায় তাঁদের বাড়ী নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানেন না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন।‘ সরলমতি কবিকে কিন্তু নিরস্ত করা যায়নি। এঁদের মতে, আলী আকবরের অভিসন্ধি ছিল নজরুলের বিরল প্রতিভাকে নিজের প্রকাশনা ব্যবসার একচেটিয়া স্বত্বাধীন করা, এবং সেই উদ্দেশ্যেই পারিবারিক আবদ্ধতার চক্রান্ত ও কাবিননামার ওই শর্ত রচিত হয়েছিল। এই যুক্তির সমর্থনে তৎকালীন দৌলতপুরবাসী মুন্সি আবদুল জব্বারের জবানি উল্লেখযোগ্য: “অন্যদিকে আলী আকবর খান বড় বোন নার্গিসের মাকে যেয়ে বলেছেন, ভাগিনীকে আমরা বিবাহ দিব। .......আমাদের বাড়ীর একটি মেয়েও এই পাত্রের পছন্দ হয় নাই। তোমার মেয়েকে পাত্র পছন্দ করেছে। বর্তমানে যে কোন উপায়ে এই কাজীকে আটকিয়ে রাখতেই হবে। এই কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবী বিখ্যাত এক দার্শনিক কবি হইবে। .....তাহার নমুনা আমরা পাইয়াছি। তাহাকে হাতছাড়া করা যায় না। ......তাহাকে আটকাইয়া রাখিলে ভবিষ্যতের জন্য একটা পথ আবিষ্কার হইতে পারে, তাহাতে সারা জীবনে সুখ থাকিতে পারিবে।“

নজরুল তাঁর বিবাহের সিদ্ধান্ত পত্রযোগে কলকাতার কয়েক বন্ধুদের জানিয়েছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম চিঠিতে (৫ই জুন ১৯২১) এই সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, “.... তোর বয়েস আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, feeling-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী। কাজেই ভয় হয় যে হয়ত বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়। ....... যৌবনের চাঞ্চল্যে আপাতঃ মধুর মনে হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়।” এর উত্তরে নজরুল নার্গিস সম্বন্ধে তাঁর যে অসহায় মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তা আগেই বলেছি। অগত্যা পবিত্রবাবু তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে (২৫শে জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮) নজরুলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও শেষে লিখেছিলেন, “তুই যে এরূপ একটা আজগুবি কান্ড বাঁধিয়ে বসবি, তা সকলে আমরা জানতুম।“ তাঁর কলকাতার বন্ধুরা যে অকস্মাৎ বিয়ের ফয়সালায় বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তা বুঝতে পেরে নজরুল তাঁর আর এক সুহৃদ সাহিত্যিক ও সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে একটি পত্রে সম্ভবত কিঞ্চিত দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তার উত্তরে ওয়াজেদ আলী লেখেন (১৩ই জুন ১৯২১), “আমার বোধ হয় আপনার বন্ধুরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন একটা কারণে। আপনি ‘নারায়ণে’ ‘দহন-মালা’ লিখে নারীর কাছে ক্ষমা চাইলেন; তার পরই এত সত্বর প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়লেন। ‘যৌবনের জোয়ার’ বড় সাংঘাতিক; তাকে ঠেলে রাখা বড় দায় – এ আমি স্বীকার করছি।“

স্বপক্ষীয়রা বলেন, বিবাহ অনুষ্ঠানে নজরুলের বিস্ফোরণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এর প্ররোচনা কিছু দিন ধরে ক্রমাগত দানা বাঁধছিল। আলী আকবর ও তাঁর পরিবারের কোন কোন কথায় আচরণে নজরুল বিরক্ত হয়েছিলেন, এমন কি অপমানিতও বোধ করেছিলেন। কিন্তু নার্গিসের প্রতি সেই সময়ে তাঁর সুগভীর অনুভুতি তাঁকে সহ্যশীল থাকতে বাধ্য করে। শোনা যায়, নার্গিসের আগে আলী আকবর তাঁর এক ভাইঝি হেনার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন। নজরুল রাজী হননি। কিন্তু হেনা বা নার্গিস, কারোর সঙ্গেই নজরুলের বিয়েতে অধিক অমত ছিল আলী আকবরের পরিজনদেরই। তাঁরা এই অদ্ভুত স্বভাবের ছন্নছাড়া নিঃসম্পদ ছেলেটিকে ঘরের জামাই করা মেনে নিতে পারেননি, এবং প্রায়শই নজরুলের সামনেই তাঁদের এ অভিমত প্রকাশ হয়ে পড়ত। নজরুল স্বাভাবিক ভাবেই ব্যথা পেয়েছিলেন। কুমিল্লার সাপ্তাহিক লালমাই পত্রিকার ১লা জুন ১৯৬৯ সংখ্যায় অধ্যাপক বদরুল হাসান লিখেছেন, “.....নজরুলের বাঁধনহারা ভাব তাঁর পরিবারের গুরুজনদের চোখে তাচ্ছিল্যের কারণ ছিল। সম্প্রতি নেজামত আলী খান (আলী আকবরের বড় ভাই) একথা অকপটেই স্বীকার করেছেন।” কিন্তু আগেই বলেছি, শিক্ষিত আলী আকবরের জেদের কাছে তাঁদের নতিস্বীকার করতে হয়। আলী আকবর খান তাঁর সম্বন্ধে নজরুলের কলকাতার বন্ধুদের মনোভাব ভালোই জানতেন। তাই বিয়ে ঠিক হবার পর নাকি তাঁদের চিঠিপত্র নজরুলের হাতে দিতেন না, এবং নজরুলের লেখা চিঠিগুলিও ডাকে তাঁদের কাছে পাঠাতেন না। অনেক বছর পরে নার্গিসের স্বামী আজিজুল হাকিমের উদ্যোগে সে সব চিঠি প্রকাশিত হয়। স্বপক্ষের লোকেরা এমনও বলেন যে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রও আলী আকবর কলকাতার ঠিকানাগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরী করে পাঠান যাতে সেখান থেকে কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌঁছতে না পারেন। অন্য একটি ব্যাপারও নজরুলের কাছে বিসদৃশ লেগেছিল। বিয়ের দিন যখন পাকা, তখন থেকে নার্গিসকে তাঁর মামা নিজের বাড়ীতে এনে রাখেন এবং স্বল্পশিক্ষিতা মেয়েকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই নজরুলের উপযুক্ত করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ও অন্য বিশ্বসাহিত্য থেকে বেছে বিভন্ন নারীচরিত্রের কাহিনী, শহুরে আদবকায়দা ইত্যাদি নার্গিসকে সারাদিন ধরে শেখানো-পড়ানোর ঝোঁক ধরে বসলেন। নজরুল তো নার্গিসকে সেইভাবেই ভাল বেসেছিলেন যেমনভাবে তিনি তাঁকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে এ সব নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু এই সব মতের বিপক্ষেও কিছু দৃষ্টিকোণ সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পেয়েছে।

একটি ধারণা এমন আছে যে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের বিবাহ অনেকেই ভালো ভাবে নিতে পারেননি। তাঁকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা, এবং বিয়ের পর শাঁখা সিঁদুর উপাসনা ইত্যাদি আচারাদি পালনের অনুমতি দেওয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশকে ক্ষুব্ধ করেছিল। উল্টোদিকে ব্রাহ্ম সমাজের মেয়ের আন্তর্ধমীয় বিবাহ নিয়ে ব্রাহ্ম ও হিন্দু সমাজের অনেক মাতব্বরও রূষ্ট হয়েছিলেন। তবে নজরুল-নার্গিস পর্বের নজরুল-স্বপক্ষের মতগুলিকে খন্ডন করতে মাত্র এঁরাই যে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তা নয়। দু’পক্ষেরই দৃষ্টিকোণের সমর্থন বা অন্যথায় স্বতন্ত্র গবেষকরাও আছেন।

বিপক্ষীয়রা বলেন মুজফ্ফর আহমেদের বৃত্তান্ত আলী আকবর খানের প্রতি তাঁর নেতিবাচক পক্ষপাতের ফসল। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক ঈদ সংখ্যায় ‘নার্গিস’ নামে একটি উপন্যাসের লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মত: “নজরুলের বই প্রকাশ করে রাতারাতি ধনী হওয়ার পরিকল্পনা আলী আকবরের মনে আসবে কেন ? বই বিক্রী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন কি নজরুলের জীবনে আদৌ ঘটেছিল ? তাঁর পেছনে প্রকাশকেরা সারি বেঁধে অপেক্ষা করতেন, এমন তথ্যও তো ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় না। বরং এক-দুই শ টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব বিক্রী করার জন্য নজরুল দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, এই নির্মম বাস্তবতাই তো বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থ থেকে পাই।“ এই বিপক্ষীয়দের মত, নজরুল ও নার্গিসের বৈবাহিক জীবনে আর্থিক সুরক্ষা এবং মাথার ওপর আচ্ছাদন সুনিশ্চিত করতেই আলী আকবর মোটা রকমের দেনমোহর ও কাবিননামার ঐ শর্ত প্রস্তাব করেন। সুলতান মাহমুদ মজুমদার দাবী করেন, নার্গিসের সাথে তাঁর একবার সাক্ষাত হয়েছিল, এবং সেই সাক্ষাতের বিবরণী তিনি ‘কবিপ্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন (‘সাপ্তাহিক আমোদ’, ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৭)। সেখানে, এমন ছিল নার্গিসের জবানী: “আমাকে সে নিয়ে যেত কোথায় ? চুরুলিয়ার বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। থাকতো পরের আস্তানায়। তখনও লেখায় তেমন পয়সা পেতো না। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে খরচ দিতে হতো অন্যের......। কুমিল্লায় আসার সময় মামার অতিথি হিসাবে আমার মামাই খরচ দিয়েছিলেন। এই লোক বউ নিয়ে তুলতো কোথায় ? খাওয়াতো কি ? ......আমাদের সামাজিক মান সম্ভ্রম ও আমার মনের দিকটা একবারও কি সে ভেবে দেখেছে ? .....ঘরছাড়া এক পথিক যুবাকে বর করে নিলাম। তাই আমি দোষী, আর সে বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে লিখছে কবিতা, আর আমি জ্বলছি দুঃখ দহনে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে সে হাসে, আমি চোখের জলে ভাসি।“ বিপক্ষগোষ্ঠী বরং নজরুলের দৌলতপুর থেকে পবিত্রবাবুকে লেখা চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে চান যে তিনি কেবল নার্গিসের রূপগুণেই বিভোর হয়েছিলেন এমন নয়, সে পরিবারের দৌলতও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। নার্গিসের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন: “চিরজনমের হারানো গৃহলক্ষী, প্রিয়া..... তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ট।” নার্গিসকে সারাদিন আলী আকবরের প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গে বিপক্ষের অভিমত, নজরুলের ভাবাবেগ তখন এতই প্রবল যে তিনি সর্বদাই প্রিয়ার সঙ্গসুখ চাইতেন, যা তখন সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু ছিল, এবং নার্গিসকে দূরে রাখার জন্যই আলী আকবরের এই ছিল পদ্ধতি। অধ্যাপক মিলন দত্ত তাঁর ‘প্রথম প্রেম ও নার্গিস বেগম’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আলী আকবর খান নার্গিসকে ..... নজরুলের সঙ্গে মেশার সুযোগ না দেওয়ার ইচ্ছায় অধিকাংশ সময় নিজের কাছেই রাখতেন, বিয়ের পূর্বে তাঁদের মেলামেশা নিয়ে সমাজের নানা আলোচনা চলছিলো। মানুষের মুখও তো তাঁকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। কিন্তু এ অবস্থা নজরুলের অসহনীয় ছিল - ......”। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দেরীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কলকাতার বন্ধুদের কাছে পৌঁছনোর কারণ হিসেবে বিপক্ষবাদীদের যুক্তি, তখন রেলপথ ও জলপথ পরিবহন কর্মীদের ধর্মঘট চলার জন্যই এমন হয়েছিল।

নজরুল-নার্গিস উপাখ্যানের যে মাত্র দু-তিনটি নথি জনসমক্ষে পাওয়া যায়, এই নিমন্ত্রণ পত্রটি তার মধ্যে বিশেষ কৌতুহলোদ্দীপক। কলকাতার বন্ধুদের কাছে যথাসময়ে না পৌঁছলেও সে পত্র ‘মোহম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীর হাতে যে করেই হোক পৌঁছয়, এবং তিনি তাঁর পত্রিকায় তা অবিলম্বে ছাপিয়ে দেন। ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে তা ‘বাঙালী’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। এই দীর্ঘ পত্রটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান ‘জগতের পুরোহিত তুমি’র প্রথম দু’ ছত্র দিয়ে। পাত্রের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছিল এই ভাবে: “বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম.........বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভাবান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই।“ এমনও প্রচারিত হয় যে এর বয়ান নাকি স্বয়ং নজরুলের ‘মুসাবিদা’ করা।

পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিমন্ত্রণ পত্র কলকাতার বন্ধুদের গোচরে অবশ্যই আসে। কেউ কেউ নজরুলকে চিঠিতে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানালেও, অনেকেই তার ভাষ্য নিয়ে অখুশী ছিলেন। নজরুলের ঐ বর্ণনা, বিশেষ করে ‘মুসলিম বঙ্গের রবি’ উপাধি (যা তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ দাবী করার তরলমতি প্রয়াস বলে অনেকে মনে করেন), এবং পত্রিকায় এমন নিমন্ত্রণ প্রকাশের ঔদ্ধত্য অনেকের কাছেই অসমর্থনীয় ছিল। মুজফ্ফর আমেদ (২৬শে জুন ১৯২১) এক ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ চিঠিতে নজরুলকে স্পষ্টতই তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে লিখেছিলেন: “পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংস্রবে থাকিয়া আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়, আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। ‘মোহম্মদী’কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি ? তাঁরা ত নিজ হইতেই ও খবর ছাপিতে পারিতেন। .... বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণ পত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে ‘বাঙালী’তে মুদ্রিত হইয়াছে, দেখিলাম। ‘বাঙালী’কে এই নিমমন্ত্রণ পত্র কে পাঠাইল ?”

এ চিঠি যখন লেখা হল, ততদিনে অবশ্য গোমতি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। নজরুল দৌলতপুর ছেড়েছেন, এবং সন্পূর্ণ তথ্য বোধহয় তখনও মুজফ্ফর আহমেদের অজানা। এর কিছুদিন পরে, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’র ২২শে জুলাই সংখ্যায় ‘কবিবরের প্রতিবাদ’ শিরোনামে নজরুলের লেখা একটি চিঠি ছাপা হয়। ঢাকার বাংলা একাডেমী সম্পাদিত ‘নজরুল-রচনাবলী’র টীকায় বলা হয়েছে, “এই চিঠিটি নজরুল-নার্গিস বিবাহ সংক্রান্ত প্রতিবাদলিপি। নজরুল-বিবাহে আলী আকবর খান যে নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপান, নজরুল-বন্ধুরা ধারনা করেছিল সেটা নজরুলের মুসাবিদায় ছাপা হয়। নজরুল ইসলাম তার প্রতিবাদ করেন।“ নজরুলের বিবৃতি ছিল: “প্রথমেই বলে রাখি, আমার এই ‘কবি-বরে’র অর্থ ‘কবি-শ্রেষ্ঠ’ নয়, এ ‘কবি-বরের’ মানে – ‘যে কবি বিয়ের বর’। কারণ, দিন কতক আগে আমি বাস্তবিকই – অন্তত ঘন্টা কয়েকের জন্যে ‘বর’ সেজেছিলুম, যদিও বরের এখনো বধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। যাক সে কথা, আমার ঐ ‘ত্রিশঙ্কু বিয়েতে’ শ্বশুরকুলের কর্তৃপক্ষগণ এক কাব্যিক নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়েছিলেন এবং সেটি চরমে গিয়ে পৌঁছেছে এই জন্যে যে, সেটা আবার আমার সাহিত্যিক ও কবি বন্ধুবর্গকে পাঠানো হয়েছে। সেটা একপ্রকার জামাই বিজ্ঞাপন বললেও হয়। ওতে আমার নামের আগে ও পিছনে এত লেজুড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো চতুষ্পদ জীবেরই অতগুলো ল্যাজ থাকে না।“

নজরুল-নার্গিসের বিবাহ কি সম্পূর্ণ হয়েছিল ?

এই প্রশ্নের উত্তরেও মতান্তর আছে। নজরুলের উপরোক্ত ‘প্রতিবাদ’ পড়লে দেখা যাবে যে, নিমন্ত্রণপত্র তাঁরই রচনা, এ কেবল সে কথারই খন্ডন নয়। মূলত বিয়ের সামগ্রিকতাকেই যেন তিনি অস্বীকার করেছেন। বিয়ের অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত দিয়ে যে ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’ শব্দ তিনি ব্যবহার করলেন, তা আবার বিরজাসুন্দরী দেবীর একটি রচনায়ও পাওয়া যায়। প্রায় বছরখানেক পরে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র শ্রাবণ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নৌকাপথে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে দৌলতপুর যাত্রা ও ঐ বিবাহ অনুষ্ঠানের বর্ণনা প্রসঙ্গে বিরজাসুন্দরী লিখেছিলেন, “বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মত ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা .....।“ স্বপক্ষীয়রা বলেন, যেহেতু বিরজাসুন্দরী স্বয়ং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তাঁর সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে বিবাহ পর্ব সম্পন্ন হয়নি।

মুজফ্ফর আহমেদ মুসলিম বিবাহ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তা আধ্যাত্মিক নয়, মূলত হবু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একধরণের চুক্তি যার কিছু শর্ত থাকে। এই বিয়েতেও শর্ত ছিল, এবং নজরুল তা অনুমোদন করতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া বিয়ের পরে সহবাস না হলে বিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে না। নজরুল বাসর রাত্রিও যাপন করেননি। মুজফ্ফরের মতে, “কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যে সৈয়দা খাতুন ওর্ফে নার্গিস বেগমের বিয়ে (আকদ) হয়নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত হয়েছি।“

কিন্তু বিপক্ষীয়রা বলেন, বিরজাসুন্দরীর প্রবন্ধ নজরুলেরই সম্পাদিত, তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যায় না। তাঁরা বরং একটি চিঠির উপস্থাপনা করেছেন। এটি ‘বিয়ে’র কিছুদিন পরে নজরুল কান্দিরপাড়ে অবস্থানকালীন আলী আকবর খানকে লিখেছিলেন বলে দাবী করা হয়। এটিতে তিনি আলী আকবরকে ‘বাবাশ্বশুর’ সম্বোধনে শুরু করে লিখেছেন, “আপনাদের এ অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার ক’রে এসে যা কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে।........আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি ব’লে, আমি কখনো এতবড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে-যাতে আমাকে কেউ কাপুরুষ বা হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি বলে’ লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্রআত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি।.....বাবা, আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোওয়া করবেন, আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায়, এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসে যায়।..... বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করব।.......চির সত্য, স্নেহ সিক্ত, নুরু।“ বিপক্ষের মত, চিঠিতে আলী আকবরকে বাবাশ্বশুর বা বাবা এবং নিজেকে জামাই সম্বোধন, এবং পুরো চিঠির ভাষা ও বিষয়বস্তু প্রমাণ করে যে নজরুল মেনে নিয়েছিলেন তিনি বিবাহিত, নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং তাঁর অভিমান যে ভুল সে কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু স্বপক্ষীয় গোষ্ঠী ঠিক এই কারণেই এ চিঠির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যিনি বড়জোড় ‘মামাশ্বশুর’ হতে পারতেন, তাঁকে ‘বাবাশ্বশুর’ বা ‘বাবা’ সম্বোধন কতটা গ্রহণযোগ্য ? চিঠির সম্বোধনা বা ভাষ্য, কোনটাই নজরুলের প্রকৃতিগত স্বাভাবিক ভাষা নয় বলে তাঁদের দাবী। তা ছাড়া আরও একটি অসঙ্গতিও ছিল। এই চিঠি কবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে তা জানা যায় না। মুজফ্ফর আহমেদ যখন এ চিঠি দেখেন, তখন তার তারিখ ছিল ২৩ জুলাই ১৯২১, আর স্থান উল্লেখিত ছিল কান্দিরপাড়। কিন্তু ঐ তারিখে নজরুল ছিলেন কলকাতায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত চিঠিতে তারিখ দেখা যায় ২৩শে জুন। মূল চিঠি কোথাও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। স্বপক্ষীয়রা আরও বলেন, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এই চিঠি নজরুলেরই লেখা, তবে তার শেষভাগের বাক্য প্রমাণ করে যে বিবাহের কিছু উৎসব ‘বাকী’ ছিল, অর্থাৎ বিবাহ অসম্পূর্ণ ছিল।

ঐ চিঠি যদি নজরুলেরই লেখা হয়, তা হলেও তিনি সম্ভবত ‘শীগগীর’ কোন ‘বন্দোবস্ত’ করেননি। ফলত আলী আকবর সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় এসে উপস্থিত হ’ন। তালতলা লেনের বাসায় নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে মুজফ্ফর আহমেদও থাকতেন। তাঁর জবানীতে, “নজরুলের স্বভাব ছিল যে নূতন কেউ এলে চেঁচিয়ে আনন্দ প্রকাশ ক’রে সে তাকে গ্রহণ করত।.....সেদিন আলী আকবর খান আসাতে নজরুল কোন উচ্ছাস প্রকাশ তো করলই না, একবার বসতেও বলল না তাকে। শক্ত হয়ে চুপ ক’রে বসে থাকল সে। ..... খান সাহেব নিজেই নজরুলের পাশে তখৎপোশের ওপর বসলেন। তাঁর হাতে বেশ পুরু একতাড়া দশ টাকার নোট ছিল। খুব নীচু আওয়াজে কথা বলছিলেন তিনি, আর নোটের তাড়াটি নাড়ছিলেন-চাড়ছিলেন। অকারণে নাড়াচাড়ার মত দেখালেও আসলে ভাবখানা ছিল এই যে এই নোটের তাড়াটি তোমারই জন্যে।“ এই বিবরণীর সমর্থন বিরজাসুন্দরী দেবীকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতেও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি লিখেছেন, “মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল।“ শেষমেষ নজরুলের কী প্রতক্রিয়া ছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে মোটামুটি ধরা যায়, খান সাহেব যদি কোন একটা মীমাংসার অভিপ্রায়ে এই সাক্ষাতে উদ্যোগী হয়ে থাকেন, তবে তা ফলপ্রসু হয়নি।

দিন কাটতে লাগল। বছর গড়িয়ে গেল। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ লিখে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হল, তাঁর সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’র আবির্ভাব হ’ল। অচিরেই রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হলেন, জেলে অনশন করলেন, কিছু মাস পরে মুক্তিও পেলেন। কবি, সঙ্গীতকার, বিদ্রোহী হিসেবে তাঁর খ্যাতি প্রসারিত হ’ল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন। প্রমীলা এলেন জীবনে। এক সন্তানের মৃত্যু, আরও দুই পুত্রের জন্ম হল। নজরুল গ্র্যামোফোন কোম্পানীতে গীতিকার-সুরকার হয়ে চাকরী করতে লাগলেন।

একদিন যখন তিনি এচ এম ভির স্টুডিওয় বসে কাজ করছেন, বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে একটি চিঠি এনে দিলেন। নার্গিসের লেখা। আগেও এসেছে তাঁর চিঠি, নজরুল উত্তর দেননি। এবারও চিঠি পড়ে শৈলজানন্দকে ফিরিয়ে দিলেন। শৈলজানন্দ বললেন, একটা উত্তর তো দিতে হবে। নজরুল অবিলম্বে লিখে দিলেন একটি গান, “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তা’রে”। বললেন, এটাই তাঁর উত্তর।

এই গানটির রচনাকাল স্পষ্ট নয়। আগেই বলেছি, নার্গিস মোট চারটি চিঠি লিখেছিলেন, সুদীর্ঘ ষোল বছরে। নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র একটি, ১লা জুলাই ১৯৩৭ তারিখে। সে পত্রটিতেও স্থানের উল্লেখে আছে ১০৬ আপার চিতপুর রোড, গ্রামাফোন রিহার্সাল রুম, কলকাতা। তাই অনুমান করা যায়, ঐ গানটিও এই একই সময়ে রচিত। অর্থাৎ, কেবল গান নয়, একটি পত্রও অবশেষে নার্গিস পেয়েছিলেন নজরুলের কাছ থেকে। চিঠির শেষের দিকে লিখেছিলেন, “তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ ছিঠি হোক।“ এই চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে আবেগ, অভিমান, অনুযোগ, আবার আশ্বাসও। কিছু নির্বাচিত উদ্ধৃতিমাত্র দিলাম:

“তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা ক’রে থাকো, তা হলে আমায় ভুল বুঝবে – আর তা মিথ্যা।

“তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি - তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না – আমি ‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। .......ভুলে যেও না আমি কবি – আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। ..... আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।

“আমি কখনো কোন ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোন লোক ত’ নয়ই – স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। ..... আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরের’ সেবা করছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার আমাকে কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়, কিন্তু শক্তি থাকতেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি-তাদের প্রতি আঘাত করিনি।

“সেই কুকুরদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা করেছিল। নৈলে তাদের চিহ্ন-ও থাকত না এ পৃথিবীতে। .... তুমি রূপবতী বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে – তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ? .....

“তোমার আজিকার রূপ কি, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মত আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ-দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ। ....

“দেখা ? নাই হ’ল এ ধুলির ধরায়। .... তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাস, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। .... আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক, তা হলে তোমার মত ভাগ্যবতী কে আছে ? .....

“...... তুমি সুখী হও, শান্তি পাও – এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই – এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।“

চিঠি শেষ করেও আবার একটি PS. দিয়ে লিখেছেন, “আমার ‘চক্রবাক’ নামক কবিতা-পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিল।”

ঐ সময় নার্গিস ঢাকায় থাকতেন। তাঁর চিঠির বয়ান তো উপলব্দ্ধ নয়। তবে নজরুলের উত্তর থেকে তার কিছুটা আন্দাজ হয়তো করা যায়। নজরুল তাঁকে নিজের সম্বন্ধে ‘লোকের কথায়’ বিশ্বাস না করতে বলেছেন। বলেছেন আপোষের জন্য কোন বার্তাবাহক তিনি পাঠাননি। একদা তিনি নার্গিসকে ‘দেবীমূর্তি’তে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও নার্গিস স্বেচ্ছায় সেদিন ‘পাষাণ-দেবী’ হয়েছিলেন, এমন অনুযোগ করেও বলছেন সে বেদনার আগুনে তিনিই দগ্দ্ধ হয়েছেন, এবং সেই দহন থেকেই তাঁর বিদ্রোহী সৃজনী সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে নার্গিসের প্রতি তাঁর কোন ‘জিঘাংসা’ নেই। ‘আত্মহত্যা’র বিশ্লেষণও আছে যার উল্লেখ আগে করেছি। ‘চক্রবাক’ পুস্তকে যে অভিযোগের উত্তরের কথা কবি বলেছেন, তা সম্ভবত তাঁর ‘হিংসাতুর’ কবিতাটিকে নির্দেশ করে।

এই পত্রালাপের মধ্যে একটি ‘ঢাকার কুকুরের’ প্রসঙ্গও এসেছে। এর সম্বন্ধে একটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯২৮ সালে ঢাকার রাস্তায় একদিন রাতের অন্ধকারে নজরুল তাঁর কিছু অনুরাগীদের সঙ্গে পথ চলার সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ক্যাপ্টেন নজরুলের বাহুবলের কাছে আক্রমণকারীরা অচিরেই পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে। খুব সম্ভবত এই কান্ডেরই ইঙ্গিত এসেছে চিঠিতে। এখানে ‘তোমাদেরই ঢাকার কুকুর’ এই বর্ণনা লক্ষণীয়। নজরুল স্বপক্ষবর্গের অনেকেরই বিশ্বাস, ঐ আক্রমণের পিছনে আলী আকবর খানের ভূমিকা ছিল, যদিও তার সমর্থনে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে বলে জানা নেই।

কিন্তু নার্গিস ও তাঁর পরিবারের কাছে চিঠিটির সব থেকে গুরত্বপূর্ণ বাক্য অবশ্যই: “তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ?” যদিও নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকার পঞ্চদশ সংকলনে ‘কুমিল্লায় নজরুল-নার্গিস প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধে শান্তিরঞ্জন ভৌমিক লিখেছেন যে বিয়ের অনুষ্ঠানের সে রাতের পর দুজনের “জীবনে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়নি”, কিন্তু অন্য কতিপয় বিবরণীতে আবার পাওয়া যায় যে নজরুলের ঐ চিঠি পাওয়ার পর সে বছরেই ৪ঠা নভেম্বর কলকাতায় এসে নার্গিস তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দুই মামাতো ভাইকে নিয়ে নার্গিস শিয়ালদদহের কোন হোটেলে এই সাক্ষাৎ করেন বলে তাঁরই জবানীতে দাবী করা হয়েছে। তিনি নজরুলকে নাকি অনুরোধ করেন, তাঁকে প্রথমা স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে, কিন্তু ‘অপ্রস্তুত’ নজরুলের মত ছিল তা প্রমীলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং নার্গিসের ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি এও নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শীঘ্র ঢাকায় গিয়ে তিনি কোন ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কোন কোন ভাষ্যে অবশ্য বলা হয়েছে যে ঐ সাক্ষাৎকারের সময়েই দুজনের ‘তালাক’ পর্ব সম্পন্ন হয়। আবার অন্য কয়েকটি বিবরণে পাওয়া যায় যে, নজরুল-নার্গিসের ‘তালাকনামা’ কলকাতায় সাক্ষীদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৩৭এর ডিসেম্বরে (ডঃ রফিকুল ইসলাম: নজরুল জীবনী, ১৯৭২), অথবা অন্যমতে, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৮এর ২০শে এপ্রিল (এ.এফ.এম মাহবুবুর রহমান, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০২৩), এবং সেখানে নার্গিস উপস্থিত ছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ, এই বিষয়ে হয়ত কিছু ধুসর এলাকা আছে।

স্বপক্ষীয়রা বলেন, যখন বিয়েই সম্পন্ন হয়নি, তখন তালাকের প্রশ্নই আসে না। বিয়ে হয়নি বলেই নজরুল চিঠিতে নার্গিসকে লিখেছিলেন যে তাঁর প্রতি কোন অধিকার নেই এবং তিনি স্বয়ম্বরা হলে আপত্তি নেই। যদি বিয়ে হয়েই থাকত, তবে নার্গিস ও আলী আকবরের পরিবার এত দীর্ঘ অপেক্ষার পরিসরে বিচ্ছেদের ও আর্থিক দাবীর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারতেন, যা তাঁরা করেননি। যদি ‘তালাক’ও হত, তবে নার্গিসের প্রাপ্য ‘মাহর’ নজরুল তাঁকে দিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ বা সাক্ষ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এমন ‘তালাক’ কি করে সিদ্ধ হয় ? সর্বোপরি, বিরজাসুন্দরীর বর্ণনায় ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’, এবং নজরুলের নিজের ভাষ্য ‘বর সেজেছিলুম’ প্রমাণ করে যে এই তথাকথিত বিয়ে তাঁরা স্বীকার করেননি।

বিপক্ষীয়রা বলেন, ঐ বিবাহ সিভিল ম্যারেজ ছিল না, কারণ আইনত নার্গিস তখন নাবালিকা ছিলেন। তাই আইনানুগ উপায়ে বিচ্ছেদ সম্ভব ছিল না। বিয়ে ছিল কাজীর পড়ানো ঐস্লামিক পদ্ধতিগত (যদিও এই মতও স্বপক্ষ মানেন না, আগেই উল্লেখ করেছি)। সেই জন্যই তালাকনামার প্রয়োজন ছিল। তাঁরা এও বলেন, নার্গিস ও নজরুল, দুজনেই দুজনকে ভাল বেসেছিলেন, সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি দূর করে নার্গিস যন্ত্রণা সহ্য করেও একটা মীমাংসা করতে বহুকাল অপেক্ষা করেছিলেন। তা ছাড়া সেই সময়ে সামাজিক সম্মানেরও একটা গন্ডী ছিল। তাই নজরুলের চিঠির পর যখন তাঁরা বুঝলেন যে করণীয় আর কিছুই নেই, তখন তালাকই শেষ উপায় ছিল। নজরুলের প্রতি নার্গিসের অনুরাগবশতই এবং নজরুলের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁরা দেনমোহর বা মাহর পরিত্যাগ করেন।

কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ স্পষ্টতই বলেছেন বিয়ে হয়নি। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলামও মোটামুটি এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে বেগম সামসুন্নাহার, মো. ওয়াজেদ আলী, আব্দুল কাদির প্রভৃতির লিখন ইঙ্গিত করে যে বিয়ে হয়েছিল। কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ, যেমন নার্গিসের চিঠিগুলি, কাবিননামা বা স্বাক্ষরিত তালাকনামার মূল লিপিগুলির বা কোন অনুলিপির কোন হদিস পাওয়া যায়নি, যা হয়তো এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারত। বিষয়টি তাই বিতর্কিতই রয়ে গেছে।

সুদীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার শেষে, কিছু মাস পরে, ১৯৩৮এর সম্ভবত ১২ই ডিসেম্বর ঢাকায় নার্গিস বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন আজিজুল হাকিমের সাথে। আলী আকবর খান তখন ঢাকায় তাঁর পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রীর ব্যবসা করতেন। আজিজুল হাকিম তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও নিজ প্রতিভাগুণে একজন কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি আবার নজরুলের অত্যন্ত গুণগ্রাহীই শুধু ছিলেন না, তাঁর পরিচিত ও স্নেহধন্যও ছিলেন। নার্গিসের এই পরিণয় উপলক্ষে ১৯৩৮এর ১লা ডিসেম্বর নজরুল তাঁকে আরেকটি সংক্ষিপ্ত পত্রে লিখেছিলেন, “তোমাকে পেয়েও হারালাম। তাই মরণে পাবো – সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস করো -আমি প্রতারণা করিনি। আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না।“ সঙ্গে একটি কবিতাও ছিল: ‘তোমার প্রিয় যদি পাশে রয় / মোরও প্রিয় সে করিও না ভয় / কহিব তারে, আমার প্রিয়ারে আমারো অধিক ভালবাসিও।‘

এই বিচিত্র প্রেমপর্ব আর তার পরের সুদূরবিস্তৃত বিরহ-বেদনা নজরুল-সৃষ্ট কাব্যে ও সঙ্গীতে গভীর প্রভাব রেখে গেছে, তা বহু বিশ্লেষিত। শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ভাষায়, “নজরুলের কবিতায় ও গানে নানা অনুষঙ্গে নার্গিস তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সবসময় জাগ্রত ছিল। নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনায় পূর্ণতার ক্ষেত্রে পরোক্ষে নার্গিসের অবদান অসীম।“ এ বিষয়ে আলোচনায় গেলে একটি ভিন্ন নিবন্ধ হতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলাম সুবিখ্যাত। কিন্তু সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানমের লোকপরিচিতি সীমায়িত। তবে তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিও সৃজনীতে পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনিও এক বহু গুণসম্পন্না রমণী ছিলেন। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে তিনি ছিলেন অল্পশিক্ষিতা, হয়তো নিজ সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্তা। সতেরো বছরের নিদারুণ সময় তিনি যে স্থৈর্য ও আত্মস্থতায় অতিবাহিত করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখনীয়। সময়ের কঠিনতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজেকে উন্নততর করার প্রয়াস করেছিলেন। স্বেচ্ছায় ঘরে বসেই তিনি পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন, এবং ১৯৩৭ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইতিমধ্যে আলী আকবর খান তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেখানে বাংলাবাজার এলাকায় একটি বাড়ী নির্মাণ করে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। নার্গিস মামার পুস্তক ব্যবসাও পরিচালনা করতে শুরু করেন, সম্ভবত সে সময়ের একমাত্র সফল মহিলা ব্যবসায়ী।

নার্গিস সাহিত্য রচনায়ও লেখনী ধরেছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং কবিতা ও গান রসিক পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বিচ্ছেদের বেদনা, জ্বালা ও হয়তো কিছুটা তিক্ততা তাঁর রচনাকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর উপন্যাস ‘তাহমিনা’য় তিনি বর্ণনা

  পরিনত বয়সে নার্গিস



করেছেন বীর রুস্তমের স্ত্রী তাহমিনার একাকীত্ব ও দুরূহ সংগ্রামের কথা, যাকে নিঃসঙ্গ করে তার স্বামী যুদ্ধ করতে চলে যায়। প্রচলিত ধারণা এই যে এই উপন্যাসটিই নজরুলকে ‘হিঁংসাতুর’ কবিতা রচনায় প্ররোচিত করেছিল। তেমনি ‘ধূমকেতু’ উপন্যাসে নার্গিস লিখেছেন কোন নারীর শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে কেমন করে ধূমকেতুর মত এক পুরুষের অযাচিত আবির্ভাব ও প্রস্থান সব কিছু ছাড়খার করে দিয়ে চলে যায়। ‘পথের হাওয়া’র নায়কের চরিত্রেও বোহেমিয়ান স্বভাবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। ১৯৮০ সালে নার্গিস যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী প্রদত্ত ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ সম্মাননা লাভ করেন।

নার্গিসের সংস্পর্শে এসেছেন এমন কয়েকজনের বিবরণীতে, এবং তাঁর দেওয়া কতিপয় সাক্ষাৎকারে, এই নারীর স্বভাব ও চরিত্রের বিবিধ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই বিষয়ে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া রচিত ‘কবিপ্রিয়া নার্গিস: তোমাকে যেমন দেখেছি’ (অভিনন্দন, ১৯৯৬) প্রবন্ধ থেকে কিছু উধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক: “যখনই তাঁর সান্নিধ্যে যেতাম, তখনই আমার মনে হতো: আমি এক যন্ত্রণাদগ্ধ মহিয়সী নারী এবং ইতিহাসের কিংবদন্তী নায়িকার মুখোমুখি। নার্গিস যেভাবে এবং যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতেন, আমি বিশ্বাস করি: সমকালে কোনো মুসলিম মহিলার সাথে তাঁর তুলনা হয় না। রূপের রাণী নার্গিস অতিথিপরায়ণা, রুচিশীল, পরিচ্ছন্নপ্রিয়তা, স্বল্পভাষিণী ছিলেন। তাঁর হাসি ছিলো মধুর, মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।......নিজের হাতে রান্না করতেন, নামাজ পড়তেন এবং তিনি অবিশ্বাস্য রকম দায়িত্বশীল ছিলেন। স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন।.....নার্গিস প্রায় নিয়মিত নজরুলসংগীত শুনতেন। বিশেষ করে, নজরুলের বিরহদীর্ণ প্রেমাশ্রয়ী সংগীতমালা শুনে তাঁকে আমি নিরবে কাঁদতেও দেখেছি। নিজে ছিলেন সুকণ্ঠি । শৈশবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতেন, সে কথা নিজেই বলেছেন আমাকে।“

আজিজুল হাকিম ও নার্গিসের দুই সন্তান – পুত্র ডঃ ফিরোজ আজাদ ছিলেন ম্যানচেস্টারে চিকিৎসক, এবং কন্যা ডঃ শাহনারা অক্সফোর্ডে বাস করতেন। ১৯৬২ সালে আজিজুল হাকিমের মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে নার্গিস ম্যানচেস্টারে ছেলের কাছে চলে যান। সেখানেই ১৯৮৫ সালে ৮১ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়, এবং নজরুল-প্রিয়াকে সমাধিস্থ করা হয়।