Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৬

মোষের গোয়াল। এখন ওখানে ছাই আর খড়ের সাহায্যে গোয়ালের ভিজে মেজে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মোষের পেচ্ছাপের ঝাঁঝ ছাইগাদায় চাপা পড়লেই যে পরিষ্কার করছিল সে বুঝে যায় –হ্যাঁ, মেজে সাফ হয়েছে বটে। লোকটা ছাইয়ের উপর একটা লম্বা চওড়া চাটাই বিছিয়ে দিল। তার উপরে একটা ভয়ংকর জমকালো রঙের শতরঞ্জি , তার এক কোণে লেখা—ন্যায় পঞ্চায়েত, ভীখমখেড়া, অর্থাৎ ভীখমখেড়া গ্রাম-পঞ্চায়েতের বিচারসভা।

এবার লোকটা সতরঞ্চির মাঝাখানে একটা কাঠের সিন্দুক আর ময়লা থলে রাখল। তারপর বাইরের বাঁধানো চাতালে গিয়ে দু’বারের চেষ্টায় যতটা থুতু ফেলা যায় সেটা সেরে একটা বিড়ি ধরাল।

শিবপালগঞ্জ গ্রামসভাও এই ন্যায় পঞ্চায়েত, ভীখমখেড়ার অধীন। কুশহরপ্রসাদ এখানে ওর ছেলে ছোটে পালোয়ানের বিরুদ্ধে বাপকে ভালো মতন ঠ্যাঙানোর অভিযোগে মামলা ঠুকেছে। আজ তার তিন নম্বর শুনানি। প্রথম দুই দফায় কাজ বলতে এইটুকু হয়েছিল যে কুশহর এবং ছোটে পালোয়ান—বাদী এবং বিবাদী- হাজির ছিল। পঞ্চদের অনুপস্থিতিতে মামলার শুনানি হতে পারেনি।

চাতালে বসে বিড়ি-ফোঁকা লোকটা পঞ্চায়েতের চাপরাশি। বিড়ি শেষ করে আবার দুই দফা থুতু ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিজের মনে বলল—ওরা কোথায়? মরে গেছে নাকি?

তারপর কোন উত্তর না আসায় আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে ফেলল।

একটু পরে দেখা গেল চারজন একসঙ্গে হেঁটে এদিকে আসছে। দু’জন বাপ আর ছেলে—কুশহরপ্রসাদ এবং ছোটে পালোয়ান। অন্য দুজন পঞ্চায়েত সদস্য বা পঞ্চ। কুশহরপ্রসাদের মাথায় দুটো আঘাতের হালকা চিহ্ন রয়েছে আর সেটাকে সবাইকে দেখানোর ইচ্ছেয় ও নেড়া মাথা হয়ে এসেছে। এখন মাথার উপর মরুভূমিতে আঘাতের দুটো দাগ বেশ স্পষ্ট।

ওরা এসে সতরঞ্চির উপর বসে পড়ল। কিন্তু ছোটে পালোয়ান ওখান থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে রোদ পোহাতে লেগে গেল। একজন পঞ্চ চাপরাশিকে জিজ্ঞেস করল—সরপঞ্চ (মোড়ল) এখনও আসেন নি?

“এখন কী করে আসবেন?”, চাপরাশি জবাব দিল,” শিবপালগঞ্জ গিয়েছিলেন। তহসীল অফিসে কোন কাজ ছিল। বোধহয় সেখানেই আটকে গেছেন”।

গ্যাঁজানো জমে উঠল। একজন পঞ্চ কুশহরকে জিজ্ঞেস করল—‘এখন তোমার চোট কেমন? ঘা’টা শুকিয়েছে মনে হচ্ছে’?

কুশহর খকখক করতে লাগল। তারপর মুখ ফুলিয়ে বলল—আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? ওই যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমাদের শ্রবণকুমার! ওকেই শুধোও না!

ছোটে পালোয়ান নিজেকে শ্রবণকুমারের রোলে ভাবতে রাজি নয়। কাঁধে বাঁক নিয়ে তার থেকে বাবা-মাকে মুরগীর মত ঝুলিয়ে চলা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এসব তো মজদূরের কাজ! ও রেগে গেল। বলল—‘এখানে শ্রবণকুমারের বাপও এক শ্রবণকুমার। ওকেই প্রশ্ন কর। আমাদের বংশে সব শালাই শ্রবণকুমার; শ্রবণকুমারের ঝাড়’!

এক পঞ্চ ওকে বাধা দিল। “গালাগালি করবে না ছোটে। এতে আদালতের অসম্মান হয়”।

ছোটে উত্তর দিল,” শালা কোন গালি নয়”।

এটা বলে ওএসে সতরঞ্চির উপর বসে পড়ল। হঠাৎ খেয়াল হল পঞ্চেরা রেগে যাচ্ছে। তখন ও মুচকি হেসে এমন ভাব করল যেন এতক্ষণ হাসিঠাট্টা চলছে। তাই ডায়লগ ঝাড়ল-“চৌদ্দটা বাচ্চার বাপ হয়েছি আর আমাকেই শেখাবে মেয়েমানুষ কী জিনিস! আমাকে বলছ সালে বলা মানে গালি দেয়া? আরে, এ’তো কথাবলার একটা ঢঙ। আমার কথাবলার কায়দাই হল সালে দিয়ে শুরু করা”।

একজন পঞ্চ আপত্তি করল-না, সালে বলা তো গালি দেয়া!

ছোটে পালোয়ান ফের হাসল, যেন ভালমানুষ সেজে পঞ্চায়েতের সহানুভূতি আদায় করবে। এবার বলল, “ গালি! আসল গালি তো শোননি পণ্ডিতজী! কানে ঢুকলে কলজে নড়ে উঠবে”।

বৈঠকে ঢুকেই সরপঞ্চের (পঞ্চায়েত প্রধান) মনে হল দেরি হওয়ার কারণটা সাথীদের জানিয়ে দেয়া দরকার। উনি গুনগুন স্বরে বলতে লাগলেন।

“চারদিকে দুর্নীতি! তহসীল অফিসে একটা দরখাস্ত দেয়ার ছিল। ভেবেছিলাম পেশকারের হাতে ধরিয়ে চলে আসব। কিন্তু ও বলল- তহসীলদারের সঙ্গে সওয়াল- জবাব শেষ করে যাও”।

একজন পঞ্চ এই কৈফিয়ত মন দিয়ে শোনেনি। সে একটু চড়া সুরে বলল—“তবুও অনেক দেরি হয়েছে। একটা বাজতে চলল। হিন্দুস্থানীদের এই একটা খারাপ অভ্যাস। ইংরেজরা এই ব্যাপারে থিক ছিল। সময়ের খেয়াল রাখত”।

সরপঞ্চ বেশ জোর দিয়ে বলল—“ঠিক আছে। তুমি তো হাজির হয়েছিলে। তুমি কোন ইংরেজের থেকে কম নাকি”?

এবার ওসতরঞ্চির মাঝখানে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে চাপরাশিকে বলল—“শুনানি শুরু করা যাক। হাঁক পাড়ো”।

চাপরাশি দেখেছে যে বাদী-বিবাদী দুই পক্ষই হাজির। তবু দুষ্টুমি করে আদালতের নকল করে উঁচু গলায় হাঁক দিল—‘কুসহর বনাম ছোটে, কেউ হা-আ -আ-আ--- জির’?

ছোটে খেঁকিয়ে উঠল—“হাজির তো বটেই! দেখতে পাওনি? চোখ নাকি জামার বোতাম”?

সরপঞ্চ প্রশ্ন করল-‘পঞ্চায়েত -মন্ত্রী আজও আসে নি”?

‘ওনার শালার ভায়রাভাইয়ের ঘরে আজ কোন অনুষ্ঠান আছে। উনি সেখানেই গেছেন। আমার বাড়িতে খবর পাঠিয়েছেন’। একজন পঞ্চ বা পঞ্চায়েত সদস্যের মন্তব্য।

“এই পঞ্চায়েত মন্ত্রীটিও না, একটি অকর্মার ধাড়ি,-- শিকারের সময় কুত্তার হাগা! প্রত্যেকবার কাজের সময় ফাঁকি। কোন ফাইলটা কোথায় রেখেছে—এটা কে বলবে? নিজে গেছেন নেমন্তন্ন খেতে, আমি রয়েছি ফাইল খুঁজতে”।

সরপঞ্চ রেগে গিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন। ছোটে পালোয়ান এসবে কান না দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সরপঞ্চের অনুযোগ ফুরোয়নি।

-‘ওই ব্যাটা পঞ্চায়েত-সচিব গতবার যখন টাকাপয়সার তছরূপের দায়ে ফেঁসেছিল তখন দিনে চারবার আমার ঘরে আসত। এমন জুতো ঘষেছিল যে আমার দরজার সামনের ধূলো সাফ হয়ে গেছল। এখন এদিকে আসতে হলে এড়িয়ে যায়, অজুহাত খোঁজে। ব্যাটা খানদানী বদমাশ”স্ক

ছোটে পালোয়ান অন্যমনস্ক হয়ে চাতালের সামনের নিমগাছের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ কথা কানে যেতেই চমকে উঠে বলল—‘ সারপঞ্চজী, বদমাশ বললে কাকে’?

সরপঞ্চ চিড়বিড়িয়ে উঠলেন। “তোমার কেন খুজলি হচ্ছে? এতক্ষণ পঞ্চায়েত -সচিবের কথা হচ্ছি্ল। এবার তোমার বদমাইশির ফাইল খুলল বলে—দেখতে থাক”।

ছোটে উঠে পড়ল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ‘এখানে কোন মোকদ্দমা করা বেকার। সরপঞ্চ তো প্রথম থেকেই আমাকে বদমাশ ঠাউরে বসেছেন। ফয়সালা আর কী হবে’?

কুসহরপ্রসাদ এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। হঠাৎ উঠে পড়ে ছোটে পালোয়ানকে বলল—ঠিক আছে। এবার চল, যাওয়া যাক।

তারপর বোধহয় মনে পড়ল যে ছেলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা ওই দায়ের করেছে। ঘাবড়ে গিয়ে ধপ করে বসে নিজের বোকামিকে ঢাকতে গিয়ে বলল—‘ যখন মামলা এখানে দায়ের হয়েছে, তখন পুরো শুনানি এখানেই হবে। সরপঞ্চজীই ফয়সলা করবেন’।

চাপরাশি চাতালে বসে ওখান থেকে সব দেখছিল। সে এবার বলে উঠল—‘ঠিক বলেছ কুসহর! কেউ বলল—আমার মা ফের বিয়ে করেছে। তো অন্যজন বলল—খারাপ কাজ। তখন ছেলে বলল—বিয়ে করে ফের তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যজন বলল—আরও খারাপ।

এই হল বেত্তান্ত। তুমি যখন ছেলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা শুরু করেই দিয়েছ তখন মাঝখানে দোনোমোনো করার কোন মানে নেই’।

কুসহর চাপরাশির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল যার অর্থ ফালতুলোকও যদি কাজের কথা বলে তখন পালটা জবাব দিতে নেই। তারপর ও ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল—‘বসে পড়। আজ মোকদ্দমা হয়েই যাক’।

ছোটে বলল—‘বাপু! তুমি তো দুমুখো সাপ। সামনে পেছনে দু’দিকেই চলতে থাক। এখানে আমাকে শুরুতেই ‘বদমাস’ বলে দিয়েছে। আগে আর কী শুনব? আমি চললাম’।

ও যাবার উপক্রম করতেই সরপঞ্চ হুংকার দিয়ে উঠল—‘এখান থেকে চলে গেলেই হল? এটা কী ইয়ার্কি হচ্ছে? গেলে হাতকড়ি লাগিয়ে টেনে আনব। ভালয় ভালয় বসে যাও। মোকদ্দমা হতে দাও’।

ছোটে পালোয়ান পাত্তা দিয়ে বলল,- এসব আমাকে শিখিও না। আমি তোমার এখানে মোকদ্দমায় রাজি নই। উঠে সোজা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে যাব আর তোমার শুনানি আটকে দেবার জন্য আর্জি পেশ করব, আজকেই’।

এই পঞ্চায়েতি আদালতে একজন পঞ্চ ছিল যে রাষ্ট্রসংঘের সেই সব সদস্যদের মত, যারা মূল সমস্যা থেকে সরে গিয়ে বিশুদ্ধ নীতির কথা আওড়ায়। এই কায়দায় তারা বাস্তবিক কারও বিরোধ করে না, বদলে অন্যরাও এদের বিরোধিতা করে না। “জনগণ শান্তি চায়”, “আমাদের সভ্যতার ভিত্তি হল বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং ভালবাসা” গোছের কেতাবী বাকতাল্লা শুনে পাজির-পাঝাড়া দেশও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। তাতে ওই রাজনীতিবিদের দম্ভ হয় –কেমন খাঁটি কথা বললাম!

তো আমাদের পঞ্চটিও ওইরকম ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে একটি খাঁটি কথা বলার চেষ্টা করলেন—‘ পালোয়ান, শোন। পঞ্চ হল পরমেশ্বর। এই ন্যায়ের আসনে বসে কেউ অন্যায় করতে পারেনা। মুখের ভাষা যাই বেরিয়ে থাক, কলম যখন চলবে তখন ন্যায়োচিত রায়ই বেরোবে। বসে পড়’।

এই নিরামিষ বাণী পালোয়ানকে বেশ প্রভাবিত করল। ধপ্‌ করে মেজেতে বসে বিড়বিড় করতে লাগল—‘আমি কি জানতাম যে পঞ্চদের কলম আসল, মুখের কথা নকল? কিন্তু তুমি যদি ন্যায়বিচারের ভরসা দাও তো আমি বসতে রাজি’।

পঞ্চ উবাচ,” হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভরসা দিচ্ছি তো। তুমি এখানে দম লাগিয়ে মোকদ্দমা লড়ো, সারাজীবন লড়তে থাক; কিন্তু রায় তো কলম দিয়েই বেরোবে’।

কোন নাটক -নৌটংকী ছাড়াই এত সহজে সমস্যার সমাধান হবে-- এটা চাপরাশির ঠিক হজম হল না। সে বলে উঠল—“ কথাবার্তার কোন দাম নেই, পণ্ডিতজী? এটা কী বললেন? কথায় আছে না—মরদের বাত আর ঘোড়ার লাথ কখনও বিফল হয় না”।

সরপঞ্চ মনে মনে নিজের ভুল বুঝে অস্বস্তি বোধ করছিল। চাপরাশিকে ধমকে উঠল—‘কতবার বলেছি মুখটা বন্ধ রাখতে! তা না, সবসময় নিজের চরখা চালানো চাই। দেব নাকি একটা কষে’?

পঞ্চ –একে ছাড়ুন, ফাইল খুলুন।

ফাইল খোলা হল। সরপঞ্চ একজন পঞ্চকে বলল—পড়ুন, কুসহরের জবানবন্দী আসামীকে পড়ে শুনিয়ে দিন।

পঞ্চ ভদ্রলোক ফাইলটা এমন করে এদিক সেদিক উলটে পালটে দেখতে লাগল যেমন কোন হিন্দি জানা ব্যক্তি তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম লিপিতে লেখা দস্তাবেজ নেড়েচেড়ে আবার মাতৃভাষাতেই ফিরে আসে।

এবার ও একটা ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল—“আপনি থাকতে আমি আর কী পড়ব? আপনিই পড়ে মোকদ্দমা শুরু করুন”।

ফাইল নয় তো যেন গরম পোড়া আলু! রাষ্ট্রসংঘ- ছাপ পঞ্চ ওটাকে নেড়েচেড়ে সরপঞ্চকে ফেরত করে দিল। সরপঞ্চ এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে অন্য পঞ্চের হাতে চালান করে দিল। দ্বিতীয় পঞ্চ ফাইলের এককোণায় একটা গোল সীলকে খুব মন দিয়ে দেখছিল। হঠাৎ ফাইল এক নম্বর পঞ্চকে ধরিয়ে দিল। এভাবে ফাইলটি কয়েক হাত ঘুরে উদ্ধার হয়ে গেল।

শেষে বাদী কুসহরপ্রসাদ বলল, ”সরপঞ্চজী, পঞ্চায়েত সচিব তো আজ আসেননি। আপনারা এই ফাইল নিয়ে লেখাপড়ার ঝামেলায় কতক্ষণ ফেঁসে থাকবেন? তারচেয়ে নতুন তারিখ দিয়ে দিন। মোকদ্দমা পরে হবে’খন”।

সরপঞ্চ বীরমূর্তি ধরলেন। “তুমি এসব কী বলছ কুসহর? যে সেপাই হয়ে বন্দুকের গুলি দেখে ঘাবড়ে যায় আর যে সরপঞ্চ হয়ে লেখাপড়ায়, তার তো---“।

ছোটে পালোয়ান হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল, চটচট শব্দ শোনা গেল। তারপর চড়া স্বরে বলল—একঘন্টা ধরে তোমরা কেবল তিন-তেরো করে যাচ্ছ। মোকদ্দমা করবে, নাকি ছোলা ভাজতে থাকবে”?

এটা শোনামাত্র সরপঞ্চ মামলা শুরু করে দিল। ফাইলটা পড়ার ফের চেষ্টা করতে লাগল। একটা পাতা বের করে নিজের মুখের কাছে ধরল। ওর ঠোঁটের কোনায় থুতু জমল। চোখের কোনা কুঁচকে গেল। সেখানে কাকের পায়ের নকশা ফুটে উঠল। মনে হচ্ছে, এটা ওনার জীবনের দুর্লভ মুহুর্ত।

এবার ফাইল ওনার মুখের একেবারে সামনে। উনি একটা লম্বা শ্বাস টানলেন। তারপর ফাইলের একটা পাতাও না চিবিয়ে সবটুকু মেজেতে পটকে দিয়ে বললেন—“আমি কুসহরপ্রসাদের বক্তব্য পড়ে নিয়েছি। ওবলছে যে ওর ছেলে ছোটে ওকে অকারণ লাঠিপেটা করেছে। এটা ‘তাজিরাত হিন্দ’ (ইন্ডিয়ান পেনাল কোড) এর ধারা ৩২৩ এর নালিশ”।

ছোটে এমনভাবে বসে রয়েছে যেন মামলাটার সঙ্গে ওর কোন সম্বন্ধ নেই। সরপঞ্চের দুই ভুরুর মাঝে একটা পাতলা লাইন ফুটে উঠল। উনি প্রশ্ন করলেন, “বল কুসহর, ব্যাপারটা এই তো? আসামী ছোটে তোমাকে পিটিয়েছে”?

--“হ্যাঁ সরপঞ্চজী, হাজার লোকের সামনে মেরেছে। আমার হাড়-পাঁজরা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে”।

সরপঞ্চ গম্ভীর হলেন,” ভেবে কথা বল কুসহর। যদি হাড় ভেঙে গিয়ে থাকে তাহলে মামলা অনেক সঙ্গীন। ফের তোমাকে শহরের আদালতে যেতে হবে। এখানে শুধু ধারা ৩২৩ এর শুনানি হয়। ধারা ৩২৫ লাগলে শহরে গিয়ে কলের জল খাওয়া ছাড়া নিস্তার নেই”।

কুসহর কিছু ভেবে বলল, “আচ্ছা সরপঞ্চজী, আমার হাড়-পাঁজরা সত্যিই ভেঙেছে নাকি? ও তো একটা কথাবলার ভঙ্গী। তবে ও আমাকে খুব মেরেছে। খড়ের গাদায় লাঠিপেটা করার মতন। এই দেখুন, মাথায় এখনও ঘা’ রয়েছে। ও ব্যাটা আমার ছেলে নয়, দুশমন”!

একজন পঞ্চ চাটাইয়ের এক কোনা চেপে বসে চুপচাপ মালা জপছিল। কপালে শ্বেত তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা! বয়সে প্রবীণ। দেখলে মনে হয় ইনি রাশিনক্ষত্র- তিথি -লগ্ন এসবের বিচারে পটু। পুরুতের কাজ করেন এবং বৈদ্যজীর ভূমিকায় চিকিৎসাও করেন। এবং এসব করে গ্রামীণ এলাকায় বেশ সুখে আছেন। শুধু তাই নয়, সুযোগ পেলে ওনার প্রতিভার জাদু শহুরে এলাকাতেও দেখাতে পারেন। ওখানে গিয়ে বড় বড় অফিসারের সাড়ে সাতি বা শনির দশা দূর করে এবং প্রমোশন বা বিলেত যাত্রা নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করে ওদের থেকে মোটা দক্ষিণা এবং তার চেয়ে বড় সরকারী অনুদান বাগাতে পারেন।

কুসহরের মুখ থেকে যেই শুনলেন যে ছোটে ওর ছেলে নয়, দুশমন –অমনি ওনার মালা জপা থেমে গেল। ্মুখ থেকে বেরিয়ে এল—হে প্রভো!

ছোটে গলা খাঁকরে এই উক্তির সমর্থন করল। সরপঞ্চ বললেন—“ কী ব্যাপার! বড় কাশি উঠছে যে”?

পালোয়ান বলল, “আমার বাবা বিধবার মত কান্নাকাটি শুরু করেছে। ওর কথা আগে শুনে নাও। আমার কাশির হিসেব তারপরে কর”।

সরপঞ্চ কুসহরকে বললেন, “তোমার হাড়-টাড় ভাঙেনি তো? তাহলে মামলাটা ধারা ৩২৩ এর মোতাবেক হবে”।

একটু থেমে কথাটা দ্বিতীয়বার বললেন, “তাহলে মামলাটা ধারা ৩২৩ এরই হবে। লাঠি চলেছে, কোঁচ-বর্শা তো চলেনি? যদি চলে থাকে তো এখনই বলে দাও । তখন মামলাটা ৩২৫ হয়ে যাবে”।

এবার কুসহর গেল ঘাবড়ে। “না না সরপঞ্চজী, আমাদের কোঁচ-বর্শার কাজ নয়। সাতপুরুষ ধরে আমাদের বংশে শুধু লাঠিবাজীই হয়েছে”।

উনি বললেন—“ ঠিক। কুসহর, এবার বলো ছোটে তোমাকে মারল কেন”?

ছোটে বলল, “ও আর কি বলবে, আমিই বলছি”।

সরপঞ্চ মুচকি হাসলেন। “মোকদ্দমায় নম্বর হিসেবে চলতে হয় পালোয়ান। প্রথমে ফরিয়াদী, তারপর আসামী। ঘাবড়িও না, তোমার নম্বরও আসবে”।

--“কে ঘাবড়াচ্ছে! আর তুমিও ঘাবড়িও না। ভগবান চাইলে একদিন তোমার নম্বরও এসে যাবে”।

সরপঞ্চ এর জবাব না দিয়ে কুসহরকেই ফের জিজ্ঞেস করল,”তো বলে ফেল ভাই, ছোটে তোমাকে মারল কেন”?

--“কী আর বলব। কেন মারল? নতুন শিঙ-ওঠা বলদ কেন কাউকে গুঁতোয়—এটা কোন প্রশ্ন হল? নওজোয়ান, তায় পালোয়ান। গাঁয়ে কেউ সাহস করে এর সঙ্গে লড়তে যায় না। তো এর শরীর মসমস করে, হাত চুলকোয়। এসবের জ্বালায় আমার গায়েই হাত তুলল—“।

-“একদম ভুল। একহাতে তালি বাজে না। তুমিও কিছু-না-কিছু অবশ্য করে থাকবে”।

কুসহর গলার স্বর নরম করে বলল,”আমি কী করতে পারি সরপঞ্চজী? আমি কি ছোটের সঙ্গে কুস্তি লড়ব”?

সরপঞ্চজী মুখ বেঁকালেন। নীচের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে যেন খুব চিন্তা করছেন এমন ভঙ্গীতে বললেন, “তুমি এত সোজা নও কুসহর। এখানকার আদালত তোমাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। আমি গোপনে চর লাগিয়ে আসল ঘটনা জেনে নিয়েছি। এই বয়সেও তোমার মেয়েবাজির সখ যায়নি। আমাকেই ঢপ দিচ্ছ মহারাজ? তুমিও কিছু কম নও”।

কুসহর বলল, “সরপঞ্চজী, আমাকে বাড়িতে লাঠিপেটা করল। আর এখানে তুমি কথার ঘায়ে মারছ , এটা কী রকম ন্যায়”?

মালা জপতে থাকা পঞ্চ সরপঞ্চকে বলল, “যা ঢাকা রয়েছে তা ঢাকা থাকুক প্রভো! আর তুমি বেশি খুঁচিও না কুসহর মহারাজ! তুমি ভারি মহাত্মা! সব জানা আছে”।

ইউএনও মার্কা সত্যবাদী পঞ্চ সরপঞ্চকে বলল, “মামলা চলুক। কুসহর যাই হোক, যেমনই হোক, আমাদের সামনে মামলাটা তো ৩২৩ ধারার। ওতেই লেগে থাকুন”।

কিন্তু সরপঞ্চের মাথায় মামলার গরম চড়ে গেছল। তেরিয়া হয়ে বলল, “তুমি কী জান কোথায় কী হচ্ছে? একটু আগে তহসীল অফিস থেকে ফিরছিলাম। পথে অনেকের সাথে কথা হল। শনিচরও ছিল। সবাই যা যা বলল, শুনে কান নোংরা হয়ে গেল। এই কুসহর কারও চেয়ে কম নয়। যতটুকু মাটির উপরে ততটাই মাটির নীচে। গ্রামের---“।

এই অপমান কুসহরকে ধ্বসিয়ে দিল। ও অসহায় ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। বয়সকালে ও খুব গরম মেজাজের ছিল, তবে সবটাই মারপিটের সময়ে। কায়দা-কানুনের সামনে ও সবসময় দীনহীন। এই সময় ও দশদিকেই হাতজোড় করতে লাগল। ওর চোখ থেকে দুঃখ ঝরে পড়ল বলে।

কিন্তু দুই পঞ্চ আর সরপঞ্চ আরামসে বসে চুপচাপ ওর কাহিল অবস্থা দেখে চলেছে। কুসহর এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকাল। আর ওদিকে দেখতেই ওর মুখ হাঁ হয়ে গেল।

ছোটের ভ্রু টেরা হয়েছে, ঠোঁট শক্ত করে চাপা। ও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে উঠে সরপঞ্চকে বলল , “এই কথার পাঁচফোড়ন! টিকটিক করা বন্ধ কর। একটা কানের নীচে তড়াক্‌ করে দিলেই ফাইল-টাইল নিয়ে মাটির নীচে সেঁধিয়ে যাবে। দু’ঘন্টা ধরে দেখছি, আমার বাপকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হারামী বলা হচ্ছে। আমার বাপ হারামী হলে তোমার বাপ কী”?

বলতে বলতে ছোটে’র আওয়াজ গমগম করে উঠল। “আমি এখনও মরে যাইনি। যদি আসল বাপের হোস্‌ তো আমার বাপকে গালি দিয়ে দেখ”।

চারপাশে সন্নাটা! চাপরাশি ধীরে ধীরে চালের অন্য দিকে সরে গিয়ে বেড়ালের মত একলাফ দিয়ে লুকিয়ে পড়ল। সরপঞ্চ হতভম্ব। মালা জপতে ব্যস্ত পঞ্চ চোখ বুঁজে বলল—প্রভো!

ছোটে একইভাবে গর্জাতে লাগল।–“এ প্রভো! তোমার মালাটালা মুখে ঠুঁসে পেট দিয়ে বার করব। এই প্রভো-প্রভোওয়ালা তামাশা পিচ করে বেরিয়ে যাবে। তুমিও আমার বাপকে গালি দিচ্ছিলে”।

কুসহরের মুখে এবার বোল ফুটল,” এ ছোটুয়া! ঢের হয়েছে। এবার চুপ কর। আদালতের ব্যাপার। উল্টে মামলা হতে পারে”।

“তুমি এইসব ভেবে চুপ করে থাক বাপু। আমি সব জানি। কাল শহরে যাচ্ছি। আর এদের বিরুদ্ধে মামলা লাগিয়ে আসছি। ব্যাটারা ভরা সভাতে তোমাকে না জানি কী কী সব বলেছে! যদি এদের এক-একটাকে জেলের কোঠিতে চাক্কি না পেষাই, তো আমি তোমার পেচ্ছাপ থেকে পয়দা হইনি”।

এইসব বলতে বলতে ও কুসহরের হাত ধরল এবং একরকম হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বাইরে নিয়ে গেল।

(চলবে)




0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(শেষপর্ব)

ঠিক ৫ বছর পরে

.........................

বর্ধমান রাজাদের অনুগ্রহে গোলকপতির পাকাপোক্ত জীবিকার ভিত্তিটি পোক্ত হয়ে গেছিল রানীমা বিষণকুমারীর বদান্যতায়। যদিও রানীমা এখন আর ইহলোকে নেই তবুও গোলকপতির কর্মদক্ষতা ও সততার সাথে বর্তমানের রাজা তিলকচাঁদেরও কোন বিরোধ হয়নি বলে সে এখনও টিকে আছে।

পুরনো ও বিশ্বাসী যে ক'জন রাজকর্মচারী আপাতভাবে বিষণকুমারীর আমলে রাজবাড়িতে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে অতিগোপন ষড়যন্ত্রসম্পর্কিত নানা সংবাদের সরবরাহকারী ও বাজার সরকার গোলকপতিকে যে কেন তিনি বহাল রেখে দিলেন তার উপযুক্ত কারণটি বোধহয় বর্ধমানেশ্বরী মহাদেবী সর্বমঙ্গলা ছাড়া আর কারুর গোচর নয়। যদিও শাস্ত্রমতে রুধিরপ্রিয়া গৌড়েশ্বরী তাঁর অনন্তকালের প্রশ্রয়ে সেন রাজাদের সর্বদা পালন করে এসেছেন বলে জনশ্রুতি, তাই বোধহয় এই দূর্ভাগা বংশাবতংশটিকে তিনি মহাকারুণ্য থেকে আর বঞ্চিত করেননি।

....

তন্তুবায় গৃহে তাদেরও সেই ঘনায়মান রাত্রির মধুক্ষরা পরিণতিটি শেষঅবধি বেশীদিন অধরা থাকেনি। পরদিন খুব ভোরে এদের আশ্রয়টি ত্যাগ করে ও দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীধনের হস্তধৃত গোলকপতি সেদিন অতি সগৌরবে রাজবাড়ি ফিরে এসেছিল।

শৈলবালার সীমন্তরেখায় প্রাকপ্রত্যূষে তার প্রদত্ত রক্তধারার রক্তিম অভিজ্ঞানটি এক অলৌকিক উপায়ে মন্ত্রশুদ্ধি হয়ে আজীবন থেকে গেছিল বলে ক্রমে সে ভুলতে পেরেছিল আজীবনের জন্মযন্ত্রণাটিকে।

সংসারে বাঁধা পড়ার এত স্বাভাবিক উদ্যোগটিও বহু ঘটনার পরে যে এভাবে স্থিতি হতে পারে সেটা প্রাকচল্লিশ বছর বয়স হবার আগে সে তা ভেবে ওঠার অবকাশ পায়নি।

.....

প্রিয় জন্মভূমিতে ভারতের মুকুটহীন রাজাটির আর ফিরে আসা হলনা। দিনসাতেকের মেনিনজাইটিস রোগের প্রকোপে নবদিগন্তের রেশটিকে বয়ে এনে পূর্বাচলের মাটিতে তাই আর জানানো হলনা আগামীকালের পটপরিবর্তনের ইতিকথা। রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন মসৃণ তৃণরাজি বিধৌত আর্নেস্ট ডেল এর প্রান্তরে। সফেন সমুদ্রের অবিরল মুখরতা যেন সশ্রদ্ধ চিত্তে ঘুমপাড়ানি গানের তালে তালে যেন তাঁকে কেবল বলে উঠতে লাগল,

" পিতা নোহসি

পিতা নো বোধি

নমস্তেহস্তু,

........মা মা হিংসীঃ।"

......

তবে ভারতবর্ষ থেকে এর কিছুকাল পরেই আসবেন রামমোহনের অভিন্নাত্মা আর একজন বঙ্গসন্তান। শবদেহটি পুনরোত্থানের পর ব্রিস্টলে আবার নতুন করে যেমন গড়ে তুলে দিয়ে যাবেন একটি চারুময় শ্রদ্ধাবেদী, আবার তেমনই মাটি কিনে যাবেন এই দেশেই, চিরশয়ানের দিনে বন্ধুর উষ্ণতাকে আবার বরণ করে নেওয়ার দিনে। রামমোহনের সেই অনুজপ্রতীম বন্ধুটির নাম, দ্বারকানাথ ঠাকুর! তিনিও বিলেতের মাটীতে পা রাখতে চলেছেন.....কালসন্দর্ভ যে তাঁকেও খুব শীঘ্র আহ্বান করবে এখানে আসার জন্য !

......

বদনতলার মাঠ যেখানে ক্ষীরপাশা গ্রামের দিকে বেঁকে গেছে নিস্তব্ধ পর্থপ্রর্দশনার আবহে সেখানে ক'দিন হল এক বৃদ্ধ তান্ত্রিক এসে কুটির বেঁধে রয়েছেন। সাধকটি মাতা রুদ্রাণীর অনুগামী। এখন বঙ্গালের আকাশে বাতাসে প্রবল নিনাদে বৈদেশিক শাসকের রণভেরী বেজে চললেও গ্রামেগঞ্জে এখনও দু'চার জন অবধূত বা বজ্রযানী সাধকদের দেখা মেলে। তবে এঁরা জনবহুল স্থান সাধারণতঃ এড়িয়ে চলেন বলে জনমানসে এঁদের প্রচার কম।

সাধক কেনারাম তেমনই একজন সাধক।সহজিয়া মাতৃকাপূজনের যে রীতি রাজা রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ বা কমলাকান্তের মত কবিমনষ্ক উন্মার্গীদের সাথে আমাদের দেখা করিয়ে ভাবতরঙ্গে ভাসিয়ে এসেছেন, ইনিও তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরী।

কুটিরে বসে সন্ধ্যাহ্নিক শেষ করে তিনি আজ বড় উতলা। পল-অনুপলে তাঁর যেন কার জন্য আজ মন বড় চঞ্চল! কৌশিকী অমাবস্যার পূণ্য তিথি আজ প্রায় সমাপনের পথে! কিন্তু সে কি আজকে আর আসবেনা? সাধক জানেন আগামী চতুর্দশীর দিনেই তিনি ভববন্ধন পার করে সাধনমার্গে উত্তরণ করবেন চিরকালের মতন।

চিন্তা যে একটাই তাঁর অবর্তমানে রুদ্রাণী ও মহাভৈরবের পবিত্র শিলাদুটি কার দায়িত্বে রেখে যাবেন? কে তবৃ বংশপরম্পরায় এসে তাঁর বসতভিটার রক্ষয়িত্রী সেই ক্ষীণকটি ও দীর্ঘকায়া কালীমূর্তিটির সম্বৎসরের পূজার ভার

নেবে? মহাদেবীর এই পূজনরীতি হস্তান্তর না করতে পারা অনুশোচনাটি নিয়েই কি তবে ছাড়তে হবে ব্যর্থকাম জীবদেহটিকে?

দক্ষিণা কালিকা'র স্তবমন্ত্র নীরবে জপ করতে করতে শুনতে পেলেন অদূরে একটি পদশব্দ যেন এগিয়ে আসছে তাঁর দিকেই! এ যেন কেবল এক আগমন নয়, যথার্থ যুগপরিবর্তনের ভারপ্রাপ্ত এক যুগলের চরণধ্বনি যেন !

সাধক যেন নিজের ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার ত্রিবেণী সঙ্গমে যেন টের পেলেন উদ্দীপনের সংকেতবার্তা।

....

গোলকপতি কাছাড়িবাড়িতেই এক মুৎসুদ্দীর কাছ থেকে ক'দিন হল পেয়েছে এক সাধকের আগমনবার্তা। তাই সে তার তিনমাসের সদ্যজাত শিশুটি ও তার মাতাটিকে নিয়ে এসেছে সাধকের আশীর্বাদসহ পদরেণু সংগ্রহ করতে।

.....

সাধক কেনারাম উৎসুক দৃষ্টিতে গোলকপতিদের শিশুসন্তানে দেহলক্ষণটি দেখে আশ্বস্ত হলেন। তার পর শৈলবালার নতমুখটি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ঈষৎ উপরে তুলে ধরে শান্ত স্বরে বললেন,

" মা..শৈল...আমায় চিনতে পেরেছিস্ তো?...আমি কিন্তু তোকে ঠিক চিনেছি! "

শৈলবালা তখন অস্ফূট কন্ঠে ডুকরে উঠে বলল,

" একী! মাধবকাকা! আপনি একোনো বেঁচে আছেন? কাকীমা আর রাধু যে আজও আপনার জন্য চোকের জল ফেলে ! "

গোলকপতির নির্বাক অবয়বটি দেখে সাধক বলতে শুরু করলেন,

- " যদিও সন্ন্যাসীর পক্ষে পূর্বাশ্রমের কথা আলোচনা করা মহাপাপ! তাও আজ তোমাদের এসবের কিছুটা বলে যাওয়া প্রয়োজন...এক বিশেষ কারণেই আমার পূর্বকল্পের এই স্বীকারোক্তি !"

শৈলবালা কোলে তার শিশুটিকে নিয়ে একটু যেন সন্ত্রস্ত হয়ে বসে কেনারামের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

কেনারাম এবারে বলতে শুরু করলেন,

" শৈল'র বাপ আর আমি দুজনে জ্ঞাতি ভ্রাতা। আমার বিবাহের কিছুদিন পরে একবার কার্তিকমাসের এক চতুর্দশীর রাতে আমার চোখে এক দিগমন্ডল উদ্ভাসী রামধনুর আলো এসে ধরা পড়ে ও আমি তারপর থেকে যেন ক্রমে বদলে যেতে থাকি ও সবশেষে আমার শিশুকন্যাটির জন্মের অল্পদিন পরেই গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস নিয়ে রামায়ণ বর্ণিত জনস্থানে গিয়ে কুড়ি বছর ধরে গোপনে শক্তিসাধনা করি ও ক্রমে গুরুকৃপায় সিদ্ধিলাভ ঘটে। মাতা রুদ্রাণী ও ব্রহ্মযামল তন্ত্র আমার আরাধ্যারূপে ক্রমাগত দান করে গেছেন ঐশীসাধনের সম্পদ।

আমার গুরু তাঁর অপ্রকটকালে আমাকে দুটি রুদ্রশিলা গচ্ছিত রেখে এক বিরল শক্তিমন্ত্রের তহবিলদারের পদে অভিষিক্ত করে যান। তবে সেই মন্ত্র ও শিলামূর্তিটি পরবর্তী কালে আমার পৌত্রীর স্বামীর বংশের কূলদেবীরূপে পূজিত হবেন সেকথাটিও বলে যান। আর সেই বংশের অবতংশটিকে চেনার জন্য এক সংকেতও আমাকে প্রদান করে গেছিলেন যার সন্ধানে এতকটি বৎসর ধরে আমি প্রতীক্ষমান।

তাই আজ তোমাদের সন্তানটির বক্ষদেশে একটি রক্তবর্ণের আঁচিল চিহ্ন দেখে আমি বুঝেছি যে আমার এই গুরুবাক্যটিও মিথ্যা হবার নয়।

আমি গৃহাশ্রম ত্যাগ করলেও পরিবারের সমস্ত সংবাদ দু'একজন ঘনিষ্ঠজনের মারফৎ লাভ করে এসেছি গত কুড়িটি বৎসর ধরে। এও জানি যে আমার জামাতাটি গতবৎসর সর্পাঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে ও আমার অন্তঃসত্ত্বা কন্যাটি আপাতত তার মাতার কাছে এসে রয়েছে। ঈশ্বরাদিষ্টে তোমার এই পুত্রটির সাথে ভবিষ্যতে আমার পুত্রীর আসন্নসম্ভবা নবজাতিকা কন্যাটির শুভপরিণয় হবে ও দৈবানুগ্রহে রুদ্রশীলাটির কৌলিক পূজনটিও প্রচলিত হবে। "

সাশ্রুনেত্রে গোলকপতি ও শৈলবালা প্রবীণ সাধকের কথাগুলি শুনতে শুনতে ক্রমশঃ স্তম্ভিত হয়ে যায়। নীরবতার গাম্ভীর্য ভঙ্গ করে তাদের ক্রোড়ে শিশুপুত্রটি যেন এবারে অযাচিত ক্রীড়ামোদী চিত্তে কলহাস্য করে ওঠে। সাধক পরম স্নেহে তখন সেই শিশুটির ক্ষুদ্র ললাটে তর্জনীচালনা করে লিখে দেন, "ওঁ শৌং শৌং সঃ"- দক্ষিণাকালিকার এই বীজ মন্ত্রটি ও তাকে পরম আহ্লাদে সম্ভাষণ করে ওঠেন "ঈশ্বরচন্দ্র" সম্ভাষণে।

......

যুগান্তের কালধর্ম এভাবেই ক্রমে একটি পুরুষ থেকে প্রবাহিত হতে থাকে বংশের ধারাপতনে। কিছু মানুষ তার ক্ষুদ্র কালসন্দর্ভে এভাবেই অনন্ত আলোকবর্তিকাটি জ্বালাতে জ্বালাতে ক্রমে এগিয়ে যায় আধুনিকতম পৃথিবীর বর্ণময় বিচিত্রময়তায়।

তাই জীবনের প্রবাহমান হাসিকান্না এভাবেই এক প্রজন্মে অপরিচিত থাকলেও পুনর্যাপন করে চলে প্রজন্মান্তরেই।

আমরা এভাবেই যেন প্রতীক্ষা করে থাকি একেকটি নতুন কাহিনীসূত্রের। আমাদের এই জীবনধারণ যেন প্রবাহকালের অনন্ত যাত্রাপথের একেকজন বিচিত্র পথিক হয়েই।

................সমাপ্ত.....................

কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

১) বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব - নীহার রঞ্জন রায়।

২) বর্ধমানের ইতিকথা - শ্যামসুন্দর বেরা।

৩) রামমোহন রায় - ব্রজেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

ডঃ রক্তিম মুখার্জ্জী।

শ্রী তমাল দাশগুপ্ত।

শ্রীমতী কুন্তলা সরকার।

এবং

বর্ধমানের সেন সরকার পরিবার।
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





আঠারো

জানো মুন,ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ ।আমি এইসব ভাবছি। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো। খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো। যদি কেউ দেখে ফেলে।তুমি শুনছো মুন।মুন বললো,লেখক মশাই শুনছি। এইসব আবেগের কথাও লিখে ফেলো গল্পে।ভালো লাগবে।

তারপর শোনো মুন, কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল,শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি। গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো। আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি। বলছে,লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।

আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।

চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো না,ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। হাসি,খুশি সহজ সরল জীবন।

ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । সেই ঘরে থেকেই আমরা ভয় দেখাতাম সুদখোর মহাজনকে।সুদখোর ভূতের ভয়ে চাঁদা দিতো বেশি করে। বলতো, তোরা পাহারা দিবি। তাহলে চাঁদা বেশি দেবো।

পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ । মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে । এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই । জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।

বিজয় এবার থামলো। মুন গল্প শুনে খুব খুশি। স্বামী তার লেখক। এই গরবে মুনের গরবিনী হৃদয় দুলে উঠলো।সমস্ত অভাব, না পাওয়ার দুঃখ নিমেষে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মুন পরম আনন্দময় চাঁদের পদধ্বনি শুনতে পেলো তার অনুভবে।

মুন বলল,তুমি বাবা হতে চলেছ।

বিজয় বলল,কী আনন্দের কথা। কই একবার তার পদধ্বনি শুনি।বিজয় মুনের ভরাপেটে কান দিয়ে শুনল আগমনী সংগীত।হবু সন্তান পেটের ভিতরে পা ছুঁড়ছে। বিজয় মুনকে বলে,জীবনের প্রবাহ থেমে থাকে না।

সভ্য হওয়ার আগে মানুষ বনে বনে ঘুরে বেড়াতো ।তখন এত হিংসা ছিলো না । বনে পশু পাখি ঘুরে বেড়াত। সবুজ গাছ মানুষের মন জুড়িয়ে দিত । তখন এত গরম আবহাওয়া ছিল না ।মানুষের রোগ বালাই এত ছিল না । এই কথাগুলো বল ছিলো সমীর তার ছেলে মেয়েদের ।

বিজয় নদীর কাছাকাছি একটি গ্রামে বাস করতো। পড়ানোর পাশাপাশি সে গাছ লাগাত ছাত্রদের নিয়ে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে ।স্ত্রী রমা খুব কাজের মহিলা ছিলেন । কাজের ফাঁকে গাছ লাগাতেন ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে । বিজয় গ্রামে গিয়ে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে গাছ লাগাত ।আবার সময় পেলেই বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে অনেক অজানা তথ্য গ্রামবাসীদের শোনাত । একজন ছাত্র প্রশ্ন করল,

--- বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে কি বোঝায় গো বিজয় দা?একজন গ্রামবাসী জিজ্ঞাসা করলেন ।

বিজয় বলল,--আমাদের পৃথিবীর নানা দিকে বরফের পাহাড় আছে ।অতিরিক্ত গরমে এই বরফ গলে সমুদ্রের জল স্তর বাড়িয়ে দেবে ।ফলে সুনামী , বন্যায় পৃথিবীর সবকিছু সলিল সমাধি হয়ে যাবে ।

---তাহলে এই বিপদ থেকে বাঁচার উপায় কি?

-মানুষকে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে ।

গ্রামের একটা লোক বলল,--কি পদ্ধতি বলুন দাদা । কি করতে হবে আমাদের?

---এই যে পাখি ওপশুরা মল ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে তার সঙ্গে গাছের বীজ থাকে ।এই বীজ গুলি থেকে বিভিন্ন গাছের চারা বেরোয় । বাবলা,গুয়ে বাবলা,নিম, বট,প্রভৃতি চারা প্রকৃতির বুকে অযাচিত ভাবেই বেড়ে ওঠে ।শিমূল গাছের বীজের থেকে তুলো একটি ছোট বীজসহ উড়ে চলে আসে । একে আমরা বুড়ির সুতো বলি । তারপর বর্ষাকালে জল পেয়ে বেড়ে ওঠে ।

---তাহলে আমাদের কাজ কি?

---আমাদের কাজ হলও ওই চারা গুলি বড় করা ।তার জন্য আমাদের বাঁশের খাঁচা বানিয়ে ঢাকা দিতে হবে । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ যদি এই নিয়মে মেনে গাছ লাগায় তবেই একমাত্র বিশ্ব উষ্ণায়নের কোপ থেকে রক্ষা পাবে ।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৮ পর্ব

ক্লাইভের তৃতীয় এবং শেষ ভারত আগমন এবং অন্তিম প্রত্যাবর্তন।

ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে সকলে তাকে বিজয়ী বীরের মর্যাদায় স্বাগত জানালো। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ব্যবসা এবং যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই যে পারদর্শিতা সে দেখিয়েছে তাকে যথাযোগ্য সম্মান জানালো ব্রিটিশ সরকার। উইলিয়ম পিট যে পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল ক্লাইভকে ‘ঈশ্বর প্রেরিত সেনাপতি’ আখ্যানে ভূষিত করলো। ১৭৬১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্লাইভ স্রুইসবেরির সাংসদ হিসাবে শপথ গ্রহণ করে। ১৭৬২ সালে ক্লাইভ ব্যারন উপাধিতে ভূষিত হয় এবং তার দু’বছর পরে তাকে নাইটহুড প্রদান করা হয়। পলাশি যুদ্ধোত্তর পর্যায়ে প্রশাসনিক দূর্বলতা এত প্রকট হয়ে উঠলো যে ব্রিটিশ সরকার ক্লাইভকে ১৭৬৫ সালের মে মাসে ভারতবর্ষের সর্বময় কর্তা হিসাবে পুনরায় প্রেরণ করলো। ব্যবসা, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর সর্বময় কর্তা হিসাবে ক্লাইভ ভারতবর্ষে ফিরে এল।

ক্লাইভ ফিরে এসে দেখলো মিরজাফরের দ্বিতীয় পুত্র ১৫ বছর বয়সী নাজামুদৌল্লা মসনদে আসীন। এই মসনদ দখলের অনুমতির মূল্য হিসাবে সে ১লক্ষ ৪০ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ১১ লক্ষ টাকা কলকাতা কাউন্সিলের সদস্যদের ভাগ করে দিয়েছে। সেই বছরই অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা বাধ্য হয়েই বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত এবং পলায়নরত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দিওয়ানি তুলে দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তা না করলে নিজের জায়গা উত্তরপ্রদেশকেও হারাতে হতো তাকে। নিজেদের খুশীমত ব্যবসা করার সঙ্গে সঙ্গে খাজনা আদায়ের অধিকারও চলে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। মোট আদায়ীকৃত খাজনার পরিমাণ তখন ছিল আজকের হিসাবে ৭০০০ কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের রাজদরবারের নিয়ন্ত্রক থেকে নবাবে পরিণত হলো কোম্পানির সর্বময় কর্তা লর্ড ক্লাইভ। ক্লাইভ প্রবর্তন করলো দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। রাজ্যশাসনকে দু’ভাগে ভাগ করা হলো। আইন কানুন রক্ষা এবং বিচারের দায়িত্বে থাকবে ‘নবাব’ এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকবে ‘দেওয়ান’। ১৭৬৬ সালের মে মাসে যখন খাজনা আদায়ের বার্ষিক হিসাব নিকাশের সভা হয় তখন পুতুল নবাব নাজামুদৌল্লার ডানদিকে দেওয়ানের আসনে ছিল লর্ড ক্লাইভ। এই প্রথম দেওয়ানের আসনে দেখা গেল এক ব্রিটিশকে। অদূর ভবিষ্যতে নবাবের আসনেও যে ব্রিটিশদের দেখা যাবে এই দৃশ্য তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এই অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরেই ক্লাইভের সম্মানে আয়োজিত এক অজানা জ্বরে মারা যায় নাজামুদৌল্লা। পরের বছর অর্থাৎ ১৭৬৭ সালে এই বার্ষিক অনুষ্ঠান পালিত হয় আরও জাঁকজমকের সঙ্গে। সেই অনুষ্ঠানে নবাবের পাশে আসীন ছিল বাংলার নবনিযুক্ত গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট। নবাবের আসনে ছিল মিরজাফরের আর এক পুত্র সৈফুদৌল্লা। নবাবের আসনে বসার জন্য সৈফুদৌল্লা যে রীতি অনুযায়ী বিশাল অঙ্কের টাকা কাউন্সিলের সদস্যদের দিয়েছিল তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ক্লাইভের ভারত অধ্যায় এখানেই শেষ। ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ দেশে ফিরে বাকি জীবন সমান মর্যাদা , খ্যাতির সঙ্গে রাজনীতির অঙ্গনে অতিবাহিত করে। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতবর্ষে ক্লাইভের অপশাসন এবং ব্যক্তিগত সম্পদবৃদ্ধির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে। ক্লাইভ সেখানে জানায় যে সে অবাক হয়ে যাচ্ছে যে আত্মত্যাগের এবং সংযমের যে পরাকাষ্ঠা সে ভারতবর্ষে সে প্রদর্শন করেছে তারপরেও তাকে অপশাসন এবং দূর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হচ্ছে। প্রত্যাশিতভাবেই সেই তদন্তের ফলাফল ক্লাইভের পক্ষে যায়। কিন্তু তারপর ক্লাইভের শরীর দুর্বল হতে শুরু করে এবং কথিত আছে সে নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অনেক ঐতিহাসিক বলেন ক্লাইভ নাকি ঐ সময় আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। ১৭৭৪ সালের ২২শে নভেম্বর মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ক্লাইভের বার্কলে হাউসের বাড়ি থেকে কন্ঠনালী কাটা অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এটি আত্মহত্যা না হত্যা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তার মৃত্যুর পর লন্ডনের একটি দৈনিকে তাকে লর্ড ভালচার হিসাবে চিত্রায়িত করা হয় যাতে দেখানো হয় একটি শকুনি মন্বন্তরে মৃত এক ভারতবাসীর হাড় ঠোঁটে করে তুলে নিচ্ছে।

১৭৬০ সালে পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভ যখন দেশে ফিরে যায় তখন যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সে সঙ্গে করে নিয়ে যায় আজকের হিসাবে তার পরিমাণ ৬ কোটি পাউন্ড বা ৬০০ কোটি টাকা। সেই সময় ভারতবর্ষে তার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি ও সম্পত্তি থেকে তার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল আজকের হিসাবে ৫২ কোটি টাকা। ১৭৬৫ সালের ৩রা মে ক্লাইভ যখন তৃতীয়বারের জন্য কলকাতা এসে পৌঁছোল তখন খবর পেল যে মিরজাফর ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য বিপুল অর্থ রেখে গেছে যার পরিমাণ আজকের দিনে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। একমাত্র ক্লাইভ একাই যদি এত অর্থ ব্যক্তিগত ভাবে ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে যায় তাহলে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ এদেশ থেকে লুন্ঠিত হয়েছিল তা ভাবতে গেলেও বিস্মিত হতে হয়। ক্লাইভ যে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল ১৭৭২ সালে তা অবলুপ্ত করে দেওয়া হয়। বাংলা ,বিহার এবং উড়িষ্যার শাসনব্যবস্থায় নবাবের আর কোনও ভূমিকা রইলো না। ১৭৭৩ সালে ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেল কলকাতায়। এর পরের প্রায় দু’শ বছরের ইংরাজ শাসন এবং ভারতবর্ষের পরাধীনতার ইতিহাস শেষ হল ১৯৪৭ সালে। বর্মা এবং শ্রী লঙ্কার ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় ১৯৪৮ সালে। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করে ফরাসিদের বাংলা এবং দাক্ষিনাত্য থেকে নির্মূল করে দেয় ব্রিটিশেরা। বক্সারের যুদ্ধে মোগল সম্রাটকে হারিয়ে বাংলা এবং বিহারের খাজনা আদায়ের অধিকার হাতে পেয়ে এই উপমহাদেশে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিল ব্রিটিশ। ১৭৭২ সালে হ্যারি ভেরেলস্টের উত্তরসূরী হিসাবে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়। ১৭৭৩ সালে তার পদোন্নতি হয় গভর্নর জেনারেলের পদে। ভারতবর্ষের দন্ডমুন্ডের কর্তা হেস্টিংস একদিকে ছোট ছোট রাজ্য এবং অঞ্চলের স্থানীয় রাজা, জমিদারদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে অথবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিস্বাক্ষর করাতে বাধ্য করতে লাগলো এবং অন্যদিকে শাসনব্যবস্থায়, শিক্ষায় এবং সংস্কৃতিতে ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুপ্রবেশ ঘটাতে লাগলো। পরবর্তী বারো বছরে ব্রিটিশ আইনানুসারে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন, মন্বন্তরের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করে খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়া পুনরারম্ভ এবং মাইসোরে মারাঠাদের এবং রোহিলখন্ডে পাঠানদের বিদ্রোহকে দমন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বাংলা বিহারের সীমানা অতিক্রম করে পশ্চিমে মুম্বাই, দক্ষিণে চেন্নাই এবং উত্তরে প্রায় দিল্লী অবধি সম্প্রসারণ ছিল হেস্টিংসের মূল সাফল্য।

পলাশির যুদ্ধের পর আজকের হিসাবে ৫০০০ কোটি টাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মিরজাফর। মিরজাফর কথা রাখতে পারেনি বলে তার জায়গায় নিযুক্ত করা হয়েছিল তার জামাতা মিরকাশিমকে। নিজের নবাব হবার মূল্য ছাড়াও বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রাম জেলার খাজনা আদায়ের সম্পূর্ণ অধিকার মিরকাশিম দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের বরাত দিয়েছিল কয়েকজন জমিদারকে যারা অন্যদের চেয়ে বেশি টাকা তুলে দেবার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পলাশি যুদ্ধের এক দশক পরে কোম্পানি সমগ্র বাংলার খাজনা আদায়ের অধিকার লিখিয়ে নেয় তৎকালীন মোগলরাজের কাছ থেকে। এই খাজনার পরিমাণ ছিল আজকের হিসাবে আনুমানিক ৭০০০ কোটি টাকা। এই খাজনার মাত্র ৫-৭ শতাংশ দেওয়া হতো দিল্লীর মোগলসম্রাটকে আর বাকি টাকা যেত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পকেটে।
0

গল্প - চন্দন মিত্র

Posted in







ওড়িশার পিপিলি ব্লকের বেশ কিছু গ্রামের মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন দূরবর্তী আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বা ভিন্ন কোনো আশ্রয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে আপনারা অনেকেই ঘটনাটি জেনে ফেলেছেন। পিপিলি ব্লকের মানুষগুলি যে কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন, তা জেনে আপনারা অনেকেই আশ্চর্য হয়ে ভেবে নিয়েছেন— ফেক নিউজ হবে বোধহয়। কিন্তু বিষয়টা মোটেও বানোয়াট নয়, কারণ এহেন খবর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়ক ভূমিকা রাখার মতো তেজস্ক্রিয় নয়। সামান্য বুনো পিঁপড়েদের দলে দলে গ্রাম ঘিরে ফেলার ফলশ্রুতিতে এই অভূতপূর্ব অঘটনটি ঘটেছে। কামাখ্যাফেরত বাঘা বাঘা তান্ত্রিকের মারণ-উচাটন, গ্রামগুলির চৌহদ্দিতে আগুন জ্বালিয়ে রাখা, গ্রামের বাইরে পিঁপড়েদের পঙক্তিভোজনের ব্যবস্থা করা, সরকারি তরফে কীটনাশকবর্ষণ ইত্যাদি কোনো পদ্ধতিই সুফলদায়ী হয়ে ওঠেনি। ভাবুন একবার, তুচ্ছ পিঁপড়ের ভয়ে মানুষ গৃহ-গৃহসামগ্রী-তৈজসপত্রাদি ত্যাগ করে এককাপড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। একে ঘোর কলিকাল বা মহাপ্রলয় বা রোজ কেয়ামতের সংশয়াতীত ইশারা ছাড়া আর কীই বা বলবেন ! আপনি যদি গ্রামের মানুষ হন, তাহলে সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে শুধিয়ে দেখুন,,তিনি বলবেন কস্মিনকালেও এমন ঘটনার কথা শোনেননি। ভাবুন, নগণ্য পিঁপড়ের অভিযানে যদি এমন অবস্থা হয়, সুচতুর হায়েনার হামলা হলে তাহলে কী ঘটত !

ভাবছেন, আমি পিঁপড়ের কিসসা শুরু করে ধান ভানতে শিবের গীতের মতো অকস্মাৎ কেন হায়েনার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়লাম ! আসলে পিপিলির পিপীলিকা দঙ্গলের মনুষ্য-বিতাড়নের অনুষঙ্গে যূথবদ্ধ হায়েনার তাড়নায় বাস্তুচ্যুত মানুষের কচুরিপানার মতো ভেসে চলার একটি কিসসা মাথায় এসে গেল যে। এই যে কচুরিপানার কথা বললাম, জানেন তো কচুরিপানাও আদতে ছিন্নমূল; তিনি এসেছেন আমাজনের অগম জলের স্মৃতি বুকে নিয়ে। এসেছেন বললে ভুল হবে, আনীত হয়েছেন। প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা; তখন বাংলায় চলছে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন। জনৈক স্কটিশ নাগরিক জর্জ মর্গান, পাটের ব্যবসা করতে এলেন মদীয় দেশে। তিনি ঘোর সবুজ পাতার মায়াবী গড়ন আর তার অবর্ণনীয় রঙের সুবিন্যস্ত পুষ্পমঞ্জরীর মোহে এমন মোহিত ছিলেন যে, তাঁকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারেননি। জাহাজে ওঠার আগে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সযত্নে ঝোলায় ভরে ফেলেছিলেন। মর্গানসাহেব থিতু হয়েছিলেন বঙ্গীয় এক বাগানবাটিতে; তাঁর উদ্যানের পরিখায় ডানা মেলা প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়াতেন সেই বহুবংশবিস্তারী সপুষ্প সুন্দরী। কালক্রমে তাঁর সন্তানসন্ততিরা বাংলার জলায় জলায় ভাগ্যান্বেষণে ভেসে পড়েছিলেন। আজও তাঁদের যাত্রা অপ্রতিরোধ্য। হয়তো তাঁদের কেউ কেউ বাউল-ভাটিয়ালিমাখা শরীর নিয়ে পৌঁছে গেছেন আমাজনের গহীনে। বস্তুত, পরিযান হল জীবের নিয়তি; তা স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্যতামূলক। পিপলির মানুষগুলো যদি না তাঁদের বাস্তুভিটে উদ্ধার করতে পারেন, তাঁদেরও খুঁজতে হবে নতুন বাসভূমি; তবে জন্মভিটের সুগন্ধ যে তাঁদের আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াবে, সে বিষয়ে সন্দেহ না-রাখাই ভালো।

পিপলির মানুষগুলোর আয়ুরেখা বোধহয় দীর্ঘ ও গভীর এবং বৃহস্পতিও হয়তো তুঙ্গে, তাই তাঁরা হন্যমান হায়েনার কবলে পড়েননি। নগণ্য বুনো পিঁপড়ের সঙ্গে হায়েনার তুলনাই হয় না। হায়েনার কথা আপনাদের নতুন করে কী আর বলব, তাদের সম্পর্কে আপনারা প্রায় সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল। তবে জেনে অবাক হবেন যে, হায়েনারা বিশ বা বাইশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে। তখনও পৃথিবীতে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স প্রজাতিটি জন্মায়নি। ফলে তাদের রক্ষাকর্তা হিসাবে তখনও ইশ্বর–আল্লা-গড প্রভৃতি ভূমিষ্ঠই হননি। কোনোরকম অতিলৌকিক আশীর্বাদ ছাড়া, কেবল দলবদ্ধতা এবং সুতীক্ষ্ণ দাঁত-নখ ও নিখাদ হিংস্রতায় পরিপূর্ণ জন্মান্ধ মননের গুণে হায়েনারা এই একবিংশ শতাব্দীতেও ধরণীর প্রাণদায়ী ভূমিতে সমানে দন্তবিকীর্ণ করে চলেছে। আর একটি আশ্চর্য তথ্য এই যে, প্রাণিকুলের মধ্যে সম্ভবত মানুষ ছাড়া কেবল এই হায়েনারাই হাসতে পারে। হ্যাঁ নিছক হাসতেই পারে, অন্যকে ছিন্নভিন্ন করে তার আত্মানাশ করার মুহূর্তেও। যদি তারা কাঁদতে পারত, সেটাও খুব একটা সুবিধের হত না শিকারের পক্ষে। কারণ কেউ হাসতে হাসতে তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে এ দৃশ্য সহ্য করা সহজ হলেও, কেউ কাঁদতে কাঁদতে তার কলজে উপড়ে নিচ্ছে এটা যথেষ্ট চাপের হত গোবেচারা শিকারের কাছে।

হায়েনা কবলিত ভূভাগ কতটা বীভৎস, কতটা শ্বাসরুদ্ধকর, কতটা অপমানের, কতটা অনিশ্চয়তার, অনভিজ্ঞের কাছে সে অভিজ্ঞতা চিরকাল অধরাই থেকে যাবে। আপনারা যাঁরা জন্মসূত্রে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ভূখণ্ডে বাস করেন, হায়েনার সঙ্গে সহবাস করা দূরের কথা, কোনোদিন হায়নার সমবেত দন্তঘর্ষণের উচ্চকিত কিচিকিচি শীৎকার কর্ণকুহরে নেননি, ঘ্রাণে নেননি তাদের বিবমিষা উদ্রেককারী ঐতিহ্যবাহী বদগন্ধ, তাঁরা হায়েনাহতদের আত্মার রক্তক্ষরণের বিমর্ষ সংগীতের রাগিণী সম্পর্কে চিরকাল অনবগত থেকে যাবেন। অবশ্য সেটাকে আশীর্বাদ হিসাবেই আপনাদের নেওয়া উচিত এবং আপনাদের নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিকর্ত্রীর প্রতি এইজন্য নতজানু হওয়া উচিত যে, তাঁরা আপনাদের সৃজনের জন্য এক সুরক্ষিত স্থানই নির্বাচন করেছিলেন। দান্তের ইনফার্নো থেকে শুরু করে বিবিধ কিসিমের ধর্মশাস্ত্রে যে নরক নামের পূতিগন্ধময় কল্পস্থানের বর্ণনা আছে, তা বোধহয় হায়েনাকবলিত ভূমির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত স্মৃতিচারণ। আমাদের গৌরচন্দ্রিকা বা মুখবন্ধ যেহেতু এখানেই থেমে যেতে চাচ্ছে, সেহেতু আমরা এখন আমাদের কিসসার চলার পথটি উন্মুক্ত করে দেব। এতক্ষণ যে বাক্যসম্ভার উপস্থাপিত হল, বস্তুত তা নিছক ভণিতামাত্র নয়; আশা করি এতক্ষণে আপনারা তা অনুমান করতে পেরেছেন।

আদতে আমাদের এই ভূভাগের কোথাও নিখাদ হায়না অধ্যুষিত দেশ নেই। যে-কোনো দেশই যে-কোনো মুহূর্তে হায়েনার নখেদাঁতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তেমনই একটি মুমূর্ষুপ্রায় দেশের পটভূমিতে আমি কিসসাটি বুনতে চলেছি। কিসসার অন্দরমহলে ঢুকে দৈবাৎ যদি আপনাদের মননে সাদৃশ্যবশত কোনো বাস্তবিক স্থানকাল ইত্যাদির ভূত উঁকি মারে, তা নেহাতই কাকতালীয়। আপনারা এমন এক নদীমাতৃক দেশের কথা কল্পনা করুন, যেখানে মাটি নদীর স্নেহময় সান্নিধ্যে উর্বর; যেখানে গৃহস্থকে নিশ্চিন্তে রাখে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ। সে দেশে এক প্রসন্ন গৃহস্থবাড়িতে ছিল পিতা-মাতা, তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যা। বুনিয়াদি শিক্ষানিকেতনের পণ্ডিতমশাই পিতৃদেব যখন ইহলীলা সংবরণ করলেন, কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীটিও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৌঁছে গেলেন সাধনোচিত ধামে। বিশ্ববিদ্যানিকেতনে পাঠরত জ্যেষ্ঠপুত্রটি বিপন্নের মতো সেই ঝটিকাপ্রবাহে সংসারনৌকার হালটি প্রাণপণে ধারণ করলেন। ‘বড়ো গাছেই ঝড় লাগে’, প্রবাদটি আপনারা শুনে থাকবেন আশা করি। জ্যেষ্ঠবৃক্ষটি মস্তকে সমূহ ঝটিকাবেগ ধারণ করে রক্ষা করলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও ভগিনীকে।

ইতোমধ্যে ইতিহাসের অনেকগুলি প্রসঙ্গ আমার মাথার ভিতরে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছেন, তাঁদের দাবি এই কিসসায় তাদেরও স্থান দিতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী ইতিহাসে এত সালতামামি, এত রাজরাজড়াদের চরিতকথা যে সেগুলি মুখস্থ করা ছাড়া উপায় থাকে না। আমি আবার ওই বিদ্যায় নিতান্ত অপারগ। তাই একটা অজুহাত খাড়া করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের বললাম, হে আমার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অবস্থানরত প্রিয় ভাই ও বোনেরা আপনাদের আবদারে যথেষ্ট যুক্তি থাকা সত্ত্বেও এই স্বকপোলকল্পিত কিসসার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আমি আপনাদের যথাযোগ্য সমাদর জানাতে পারছি না, এজন্য আমি দুঃখিত। তাঁরা কী বুঝলেন জানি না, শেষমেশ আমাকে সানন্দে নিস্তার দিয়ে বাধিত করলেন। ঐতিহাসিক দায়ভার এড়াতে পেরে আমার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে গেল। দেখুন এবার আমার চিন্তাতরঙ্গের মাথায় লাফাতে লাফাতে কেমন তরতরিয়ে এগিয়ে যায় কিসসার সাম্পান।

জ্যেষ্ঠপুত্রটি আইনের বদান্যতায়, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছায় এবং কনিষ্ঠভ্রাতার যারপরনাই উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত যোগ্যতা না-থাকায় পিতার চাকরিতে বহাল হলেন। হাসিমুখে তিনি সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিলেন। কনিষ্ঠভ্রাতাটি অক্ষরভীতু, আকাট ও আদ্যোপান্ত বয়ে যাওয়া বখাটে ছেলে; কিন্তু যথেষ্ট হিসাবি। পিতার চাকুরিটি যখন হাতছাড়া হল, সে জমিজমা, ফলের বাগান, মাছের পুকুর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেখভাল শুরু করে দিল। কয়েক বছর যেতে-না-যেতে সে বিয়ে করে আনল তার পছন্দের এক পাত্রীকে। কালক্রমে তার সংসার দুই শিশুপুত্রের কলরোলে মুখরিত হয়ে উঠল। এদিকে উচ্চবিদ্যালয়ে পাঠরতা বোনটিও স্থানিক ও কালিক বিচারে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে ততদিনে। ক্রমে অকৃতদার জ্যেষ্ঠভ্রাতার চোখে উঠল চশমা, পাক ধরল চুলে। আত্মপরের ভেদজ্ঞানরহিত, সহজসরল, সৎ ও পরোপকারী মানুষটি পিতার মতো ‘পণ্ডিতমশাই’ আখ্যা পেয়ে গেলেন আপামরের কাছে। এভাবেই চলছিল দিনকাল, অতঃপর ঘনিয়ে এল মানুষের সর্বনাশ ও হায়েনাদের পউষমাসের কালো অধ্যায়ের করুণ দিনাবলি।

কানাঘুষো চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরে, হায়েনাদের দল নাকি মানুষের মহল্লায় হানা দেওয়ার ছক সাজাচ্ছে। কিন্তু উদারমতি জ্যেষ্ঠভ্রাতা বিশ্বাস করতে চাননি, সেসব আতঙ্ক-খচিত অযাচিত কথামালাকে। কনিষ্ঠটির কান ছিল সজাগ, সে নিজেকে এবং স্ত্রীপুত্রকে আড়াল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল গোপনে গোপনে। তাহলে আমাদের কিসসায় অরক্ষিত থাকল দুই জন, জ্যেষ্ঠভ্রাতা ও অনূঢ়া ভগিনি; বাস্তবে কয়েক সহস্র অসহায় নরনারী। তাদের কান্না-ঘাম-রক্ত-ইজ্জত-আব্রু এ কিসসায় স্থান পাবে না; কারণ তা নিছক কল্পনা নয়, কল্পনাতীত। ফলে তারা আপাতত কিসসা-বৃত্তের বাইরে অবস্থান বিক্ষোভ দেখালে দেখাক।

সকাল দেখে বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে, এই মর্মে একটি ভুবনবিদিত প্রবাদ আছে ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু সবসময় যে এই সূত্রটি খাটে না সেদিনের প্রশান্ত সকালটিকে অশান্ত সন্ধ্যা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। ঘাসের ডগায় শিশিরের বিন্দুতে কাঁচাসোনারোদ জ্বলে উঠে সকালকে অভিনন্দিত করল। বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে চলল জামির ফুলের স্মৃতি-জাগানিয়া সুবাস। আকাশের নীল গাঙে ভেসে বেড়াতে লাগল দুধসাদা মেঘেদের পলকা পানসির দল। সন্ধ্যায় উদিত হবে সোনার থালার মতো চাঁদ; নিকোনো উঠোন-খামারকে মনে হবে অতিকায় ক্যানভাস, তাতে ছায়াছবি আঁকবে সুপুরিগাছের সারি। পুকুরের জলে আলপনা এঁকে দেবে ঝরে পড়া হিজলফুলের লালিমা, বাদুড়েরা ঊর্ধ্বপদ হেঁটমুণ্ডে দোল খাবে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার শাখায়। এমনিতে পূর্ণচন্দ্রের উদয় আকাশের মতো মানুষের মনের ভিতরে যে শূন্যতা আছে যেখানে সময়ে সময়ে চিন্তার সাদাকালোরঙিন মেঘের তরঙ্গ ভেসে যায়, সেখানেও জ্বেলে দেয় অনির্বচনীয় আনন্দবাতি; পরব থাকলে তো আর কথাই নেই। গৃহে গৃহে সাড়া পড়ে যায়, সুখাদ্য প্রস্তুত হয়, সহজ শিল্পকর্মে ভরে ওঠে আঙিনা-দেয়াল, পাড়ায় পাড়ায় বেরোন অবসরপ্রাপ্ত হারমোনিয়াম, মৃদঙ্গ, করতাল প্রমুখ। এমনই হওয়ার ছিল যে তিথিটি সন্ধ্যা ও রাতের উদার প্রশ্রয়ে, কিন্তু সন্ধ্যাটি অকস্মাৎ নিহত হল, যেন গপ করে চাঁদটাকে গিলে খেল কেউ। ঝোপঝাড়ে বিষাক্ত লালা ছড়িয়ে মহল্লায় ঢুকে পড়ল সার সার শ্বাপদ হায়েনা। তাদের নখেদাঁতে ফলফুল সম্ভাবনা লোপাট হতে থাকল; বৃন্দগানের বদলে হায়েনাদের দাঁতের ঘর্ষণজাত কিচকিচ ধ্বনিমালা পাড়াগাঁর বাতাসকে বিষিয়ে দিল।

হাতে ধরা দীপাধারসহ ভগিনী আছড়ে পড়ল আলোছায়ামাখা আঙিনায়, তার বুকের উপর গুটিকয়েক হায়না ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন তাদের সন্ধানে আছে বক্ষস্থানে লুকোনো কোনো গুপ্তধন। ঘটনার আকস্মিকতায় বারান্দায় বসে পুথিপাঠরত জ্যেষ্ঠভ্রাতা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি একপ্রকার লাফ দিয়ে আঙিনায় নামতেই তাঁকে ঘিরে ধরল একঝাঁক দপদপে চোখের হিংস্র জানোয়ার। তাদের থাবার তলায় শুয়ে শুয়ে তিনি দেখলেন ভগিনীর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহটিকে খনি ভেবে খননকর্মে লিপ্ত হয়েছে পিশাচেরা। ভাগ্যিস জ্যোৎস্নায় লাল রং ঠিক ফোটে না, না-হলে দৃশ্যটি মাত্রাতিরিক্ত বীভৎস রসে ভরে উঠত। অকস্মাৎ নাওয়ের লগি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রৌঢ় মাঝি। তিনি কৈশোর থেকে পণ্ডিতবাড়ির পারিবারিক নৌযানটির কর্ণধার। তাঁর কোলেপিঠে বড়ো হয়েছে বাড়িটির ছেলেমেয়েরা। প্রৌঢ় হলেও আপৎকালে মাঝির পেশিতে বিদ্যুৎ খেলে যেত; তাঁর লগুড়ের তাড়নায় মুক্ত হলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা। তিনি হ্যাঁচকা টানে তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড় দিলেন পুকুরের পাড় ধরে নিকটস্থ নদীটির দিকে। ‘বোনটি যে পইড়্যা থকে, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, বউমা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা। নৌকায় উঠে তিনি বিস্মিত নয়নে দেখলেন ছইয়ের ভিতর সংসার নিয়ে বসে আছে কনিষ্ঠ ভাইটি। তিনি হিসাব মেলাতে পারলেন না, ভাবলেন স্বপ্ন বোধহয়; হায়েনার আক্রমণসৃষ্ট ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্তে আর্দ্র তিনি। মাঝি তাঁকে নৌকার প্রশস্ত পাটাতনের একদিকে শুইয়ে দিলেন। চেতন-অবচেতনের লীলা শুরু হল জ্যেষ্ঠভ্রাতার মনের আঙিনায়। সেখানে এসে দাঁড়ালেন প্রাজ্ঞ পিতৃদেব। তিনি বললেন, ‘বড়োখোকা তোকে কৈশোরে কতবার কয়্যা ছিলাম, অন্তত লাঠিখান ধরা শিখ্যা নে। তুই কয়্যা ছিলা, বাবা আমি বড়ো বড়ো পুথি পইড়্যা পণ্ডিত হইব। তুই সেদিন লাঠি ধর‍্যা শিখ্যা নিলে বোনটারে হয়তো বাঁচাইতে পারতা। খোকা আমিও পড়াইতাম অসির চেয়ে মসী বড়ো। কিন্তু যদি জানটাই চলি যায়, মসী রইব কোথা ?’ জ্যেষ্ঠভ্রাতা পিতার পদযুগল হাতড়াতে হাতড়াতে বললেন, ‘বাবা, আমি আজ বুঝছি আত্মকে রক্ষা করার বিদ্যা জানা না-থাকিলে সকল বিদ্যা মিথ্যা হইয়া যায়।’ নৌকা স্রোতের মুখে পড়ে ছিন্নমূল কচুরিপানার মতো ভেসে চলল। জ্যেষ্ঠভ্রাতা ঘোরের ভিতরে বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনোখানে...’
0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in





একাডেমীতে ‘শকুন্তলম’ থিয়েটার সাকসেসফুল। প্রচুর হাততালির সাথে স্ক্রিন ড্রপ হতেই প্রথম সারির সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শ্রীদেবী। ধীরে ধীরে স্টেজের পেছনে পৌঁছে গেল। সে দেখলো দুষ্মন্ত আলো ঝলমল রাজার পোষাকে দাঁড়িয়ে কন্বদেবকে কিছু বলছে। শ্রীদেবী আবেগময়, কিছুটা সম্মোহিত! রাজা দুষ্মন্তের ভূমিকায় অয়নকুমারের নায়কোচিত পারফর্মেন্স তার খুব ভালো লেগেছে!
‘দারুণ অ্যাক্টিং মিস্টার অয়নকুমার! টোটাল প্রোগ্রামটাই খুব ভালো হয়েছে। আপনি কি আর কোন গ্রুপের সাথে অ্যাটাচড?’- এক ঝলক খুশির আবহ শ্রীদেবীর কমপ্লিমেন্টে।
‘থ্যাঙ্কউ ম্যাডাম, তেমন কিছু না! এই শখের থিয়েটার করা, আর কি! কয়েকটা নাটকের গ্রুপ, আমাদের কলেজের সিনে ক্লাব এসবেতেই আছি!’
‘আমি তো সিনিয়র হিসেবে আপনাকে তুমিই বলতে পারি। খুব ভালো লেগেছে তোমার অভিনয়। এজন্যেই তো ব্যাকস্টেজে এসে তোমাকে কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে গেলাম। বাই বাই! আবার কখনো দেখা হবে!’
কন্বদেব, দুই সখী, শকুন্তলার মেকআপে মল্লিকা আর ব্যাকস্টেজের মানুষগুলো। ওরা সবাই অবাক হয়ে দেখল, স্টেজ থেকে স্মার্টলি নেমে যাচ্ছে এ সময়ের বাংলা ছবির হট ফ্লিমস্টার শ্রীদেবী! থিয়েটার হলে তার উপস্থিতি অবশ্যই সাড়া জাগানো ব্যাপার!

তার পরে অয়নের বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। নানা কাজ, আগামী প্রস্তুতি ‘তেপান্তরের রাত’, একটা শর্ট ফ্লিমের অফার, ইউনিভার্সিটির পিএইচডির কিছু অ্যাসেসমেন্ট – এসব নিয়ে সপ্তাহ খানেক বেশ ব্যস্ত ছিল অয়ন। অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছিল ‘শকুন্তলম’এর দিনটায় শ্রীদেবীর সেদিনকার কনাগ্রাচুলেশের স্মৃতি।

সেদিন রাত্তির এগারোটায় মোবাইল বেজে উঠলো। অয়ন স্ক্রীনে দেখল, ট্রু-কলারে ভেসে উঠেছে নাম - শ্রীদেবী। সঙ্গে রাবীন্দ্রিক কলার টিউন - ‘তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’!
অয়ন ভাবতেই পারে নি, শ্রীদেবী তাকে ফোন করবে। এ কি সেই অ্যাকট্রেস, নাকি ফেক কোন ফোন কল?
‘হ্যালো অয়ন, আমি শ্রীদেবী বলছি। তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল! তাই ফোন করলাম। ডিস্টার্ব করলাম না তো? একাডেমীতে সেদিন তোমাদের থিয়েটার খুব এনজয় করেছি! শুনেছি, ‘শকুন্তলম’এর টিমটা ব্যারাকপুরের। তুমি কি ব্যারাকপুরে থাকো?’
‘না ম্যাডাম! বিধাননগরে একটা ফ্লাটে আমি রেন্টে থাকি। প্রেসিডেন্সিতে কেমিস্ট্রি নিয়ে পিএইচডি করছি।’
ওদিক থেকে মোবাইল সিগন্যালে উড়ে আসছে অভিনেত্রীর কন্ঠস্বর – ‘আচ্ছা! তাই বুঝি! অয়ন, খুব সুন্দর অ্যাক্টিং তোমার! থিয়েটার ছেড়ে যদি চাও তুমি তো ফ্লিম ইণ্ডাস্ট্রিতে আসতেই পারো। খুব ভালো তোমার পারফরমেন্স।’
অয়ন কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না!
‘ওকে ডিয়ার অয়নকুমার! গুড নাইট। ভালো থেকো। পরে দেখা হবে।’

গ্রুপ থিয়েটার, কয়েকটা শর্টফিল্মে অয়ন অভিনয় করেছে, কয়েকটার ইউটিউব বেরিয়েছে - এসব ঠিকই। শখের অভিনেতা বলে কলেজে অয়নের একটা পরিচিতি আছে। তবে এই রাতে বাংলা সিনেমার পরিচিত অভিনেত্রী শ্রীদেবী্র ফোনে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছিল।

কয়েকদিন বাদের কথা। রাত প্রায় বারোটা। ফ্লাটে একা বসে বসে অয়ন পিএইচডির সাবজেক্টটাতে চোখ বোলাচ্ছিল। আবার সেই পরিচিত কলার টিউন - ‘তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার ……’!

ওপাশ থেকে ভেসে এলো শ্রীদেবীর কথাগুলো, ‘অয়ন, সময় বের করে তোমাদের থিয়েটার ক্লাবের ইউ-টিউব আর ওয়েব-সাইটে পোষ্ট করা শর্টফ্লিমগুলো দেখলাম! এক্সেলেন্ট, অয়ন! তোমার অভিনয় সত্যিই দারুণ!’
‘ম্যাডাম, আপনি তো সিনেমার নামকরা অভিনেত্রী। থিয়েটারও কি আপনি খুব পছন্দ করেন?’
‘ডিয়ার অয়ন, আমাকে তুমি ম্যাডাম বোলো না। আমি ফ্লিম লাইনের অ্যাকট্রেস হলেও মাঝে মাঝে থিয়েটার দেখি। একসময়ে গ্রুপ থিয়েটার করতাম কিনা! তুমি খুব ট্যালেন্টেড – একটা নায়ক নায়ক ভঙিমা তোমার দুচোখে, তোমার চলনে, অভিনয়ে! আমি চাই তুমি ধীরে ধীরে ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে এসো।’
শ্রীদেবীর কথাগুলো অয়ন তো বিশ্বাসই করতে পারছে না! সে ডুব জল থেকে মাথা তুলে একটু নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করলো। - ‘আপনার মতো একজন স্টারের সামনে নিজেকে অভিনেতা ভাবতে সত্যিই আমি লজ্জা পাচ্ছি!’
‘অয়ন! আমার খুব ইচ্ছে, তোমার সাথে সিনেমাতে দু-একটা কাজ করি!’
‘আপনি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন! তাছাড়া ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে কে ই বা আমাকে চান্স দিচ্ছে?’
‘নিশ্চয়ই দেবে! অয়ন, সেটা তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও! বলেছি না তোমার মধ্যে একটা আলাদা ট্যালেন্ট আছে!’
‘ম্যাডাম!’
‘ডিয়ায় অয়ন, আবার সেই ম্যাডাম! আমি টালিউড-বলিউডের কোনো স্টার না! আমাকে তুমি শ্রীদেবী বলেও ডাকতে পারো।’
কয়েকটা সেকেন্ডের নীরবতা!
‘গুড নাইট, মাই ডিয়ার অয়ন! হ্যাভ এ নাইস ড্রিম!’

রাত্রি তখন সাড়ে বারোটা। অয়নের ভাড়া নেয়া ছোট্ট ফ্লাটের জানালা থেকে বড়ো রাস্তার চৌমাথায় জ্বলতে থাকা এলএডি ল্যাম্পটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নির্জন বড়ো রাস্তাটা দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে দমকলের একটা গাড়ি ছুটে গেল। হয়তো বা কোথাও আগুন লেগেছে। আজ আর পিএইচডির সাবজেক্টটাতে মন বসবে না। তার কানে বাজছে প্রিয় অভিনেত্রী শ্রীদেবী ব্যানার্জী মায়াবী কন্ঠস্বর!

সে রাতে আচ্ছন্ন তন্দ্রার মধ্যে তার চোখে স্বপ্নের মতো ভেসে বেড়াতে লাগলো সেই মুখ! শ্রীদেবী ব্যানার্জী কোলকাতার একজন নামজাদা অভিনেত্রী। কি অসাধারণ দেখতে! ফর্সা টুকটুকে চেহারা। চোখদুটো কথা বলে। অভিনেত্রীর বয়স তো প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশের কাছাকাছি। ফ্লিম অ্যাকট্রেস শ্রীদেবী কি করে অয়নকে একজন নায়ক হিসেবে পছন্দ করলো? এও কি সত্যি? না কি এসব ছিল মধ্যরাতের মরীচিকা!
পরদিন সকালে সুদীপদার ফোনটা এলো। সুদীপদা ওদের কলেজের সিনে ক্লাবের সেক্রেটারি! ‘অয়ন, আজ মালঞ্চতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাস! অনেক কাজ আছে।’
‘হ্যাঁ, সুদীপদা! ‘তেপান্তরের রাত’এর প্রিমিয়ার শো। তাছাড়া ইরাণীয়ান মুভিটার জন্যে প্রোজেক্টর সেট করে রাখতে হবে। তুমি ভেবো না। আমি তিনটের আগেই হলে পৌঁছে যাবো।’
অয়ন ভাবছে শ্রীদেবীর ফ্লিমে নামার প্রোপোজালটা আজ কি সে সুদীপদাকে শেয়ার করবে? শেষে মনে হলো, এ সব পার্সোনাল কথা। এখন চেপে যাওয়াই ভালো।
ওদের গ্রুপ থিয়েটারের কয়েকটা নাটক ইউ-টিউবে পোষ্ট করা হয়েছিল। যেমন - আন্তিগোনে, রোদ্দুর বিক্রি, চাঁদ বনিকের খেয়া। তাছাড়া সিনে ক্লাবের তরফে কতগুলো শর্টফ্লিম আর ইউ-টিউব বাজারে বেশ চলছে। যেমন ‘ওথেলোর দুঃস্বপ্ন’তে নাম ভূমিকায় অয়ন। ‘পথসন্ধি’- পনেরো মিনিটের ফ্লিম; নায়কের ভূমিকায় সে নিজে। ‘অউদিপাউসের জীবন’এ রাজার ভূমিকায় অয়ন। এসব থিয়েটার আর শর্টফ্লিমের ইউ-টিউবগুলো কি শ্রীদেবী দেখেছে?

সেদিন অয়ন সময় মতোই মালঞ্চ হলে পৌঁছে গেলো। সেখানে নতুন শর্টফ্লিম ‘তেপান্তরের রাত’এর প্রিমিয়ার শো! এখানে অয়নের চরিত্র - সে একজন স্বপ্ন দেখা যুবক; তার বিপরীতে প্রেমিকার চরিত্রে সেই শকুন্তলা, তার কলেজের থার্ড ইয়ারের মল্লিকা!
ওদের ‘তেপান্তরের রাত’ শর্ট ফিল্মটা প্রিমিয়ার শো’এর শেষে খুব প্রশংসা পেলো। এই ফ্লিমের দুটো মেইন ক্যারেক্টার -অয়ন আর মল্লিকা। ওদেরকে কেউ কেউ অভিনন্দন জানালো। কিছুক্ষন বিরতি!
এরপর ইরাণীয়ান ছবিটা শুরু হলো। ফ্লিমটা যখন চলছে, ঠিক তখনই ভাইব্রেশন, সাইলেন্টে রাখা মোবাইলে ফুটে উঠলো তার অভিনেত্রীর মুখখানা। শ্রীদেবীর কন্ঠস্বর – ‘অয়ন, তুমি কোথায়?’
কায়দা করে মল্লিকাকে পাশ কাটিয়ে হলের সীটগুলো পেরিয়ে সে এক্সিট লেখা লাল অক্ষরগুলোর নীচ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
‘আমাদের একটা প্রোগ্রামটা চলছে, মালঞ্চ হলে। একটা ইরাণীয়ান ফ্লিম চলছে। আমি বেরিয়ে এসেছি।’
‘সরি, ডিস্টার্ব করলাম!’ - ওপার থেকে ভেসে এলো অয়নের প্রিয় অভিনেত্রীর কথাগুলো - ‘তুমি কবে আমার সাথে দেখা করছো?’
অয়ন উন্মুখ হয়ে রইলো মোবাইলের দিকে। ভিডিও কলের স্ক্রিনে জেগে আছে শ্রীদেবীর উজ্জ্বল দুটো চোখ।
‘শোনো ডিয়ার, এই চব্বিশ তারিখে। দিয়ালিয়া - বে-অফ-বেঙ্গল সমুদ্রতটের কাছেই! শুনেছো জায়গাটার নাম? দিয়ালিয়া ছোট্ট ট্যুরিষ্ট স্পট। ওখানে আমাদের কিছু শুটিং আর অন্যান্য কিছু প্রোগ্রাম থাকবে। তেমন চাপ নেই, ওখানে আমি রিলাক্স থাকবো। ২৪, ২৫, ২৬ – এই তিনদিনই তোমার ওখানে থাকার ইনভাইটেশন। আমি আকাশমহল নামে একটা হাভেলিতে থাকবো। ওখানে তুমি আসবে, রোজই আসবে। আমার সাথে দেখা করবে। তোমার সাথে আমাদের প্রোডিউসার, ডিরেক্টরদের আলাপ করিয়ে দেবো।’

ডিরেক্টরের সাথে আলাপ হোক বা না হোক, সেটা সেকেন্ডারী। অয়নকে ডেকে পাঠিয়েছে অভিনেত্রী শ্রীদেবী ব্যানার্জী। অয়নের পক্ষে এ আমন্ত্রণ কি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? অভিনয় সে ভালোবাসে। ভবিষ্যতে সেও একজন বড়ো অভিনেতা হতে চায়।
একটু ভেবে অয়ন বললো - ‘ঠিক আছে, ম্যাডাম! আসবো। অবশ্যই আসবো। আপনার সাথে ২৪ তারিখে আকাশমহলে দেখা হবে! কিন্তু জায়গাটা?’
‘শোনো তোমার ওয়াটসঅ্যাপে সব ডিটেলসগুলো পাঠিয়ে দেবো। দিয়ালিয়াতে ২৪-তারিখ দুপুর থেকে চার দিনের জন্যে একটা হোটেল বুক করা থাকবে। সমস্ত ব্যবস্থাই আমার। তুমি সেখানেই উঠবে। দিয়ালিয়া থেকে আকাশমহল ৩/৪ কিলোমিটার। খুব একটা দূরে না। আমি ডিরেকটরকে বলে রেখেছি। নেক্সট ফ্লিমে তুমি আমার সাথে সিনেমা করবে! চব্বিশ তারিখ – মনে থাকবে তো?’
চব্বিশ তারিখ দুপুরেই অয়ন দিয়ালিয়াতে পৌঁছে গেলো।
ওর জন্যে চারদিন হোটেলটা বুক করেই রাখা ছিলো। পুরো পেমেন্ট করা আছে! একটু বিশ্রাম করে ফ্রেসট্রেস হয়ে সে বেরিয়ে পড়ল পড়ন্ত সন্ধ্যাতে। কাছ থেকেই ভেসে আসছে সমুদ্রের আয়েসী হাওয়া। তার সঙ্গে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে অয়নের স্বপ্ন। সিনেমাতে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন। দিয়ালিয়াতে আসা দুচার দল ট্যুরিষ্টদের আনাগোনা তার তেমন নজরে এলো না। তখন মাথায় ঘুরছে অভিনেত্রীর কণ্ঠস্বর, নীল আকাশের মতো ভেসে থাকা নায়িকার দুটো গভীর চোখ।
আকাশমহল? আকাশমহল?
একটা অটো রিক্সাকে ডাকতেই লোকাল ড্রাইভারটা একটু অবাক হলো! এই সন্ধ্যাবেলায় আকাশমহলে যাবে?
- ‘আকাশমহল? সে তো গ্রামের দিকে!ওখানে ফিলিম টিলিম যারা বানায় তারা বড়ো বড়ো গাড়ি নিয়ে যায়। অটোকে ওখানে ঢুকতে দেয় না।’
অয়ন লোকটাকে বোঝালো, ‘যেভাবেই হোক, আকাশমহল-এ এখন আমাকে যেতেই হবে।’
‘একটা কাজ করুন, আমি আপনাকে আকাশমহল-এর পেছনের দিকের গেটের বাইরে ছেড়ে আসতে পারি। ওখান থেকে সামান্য হেঁটে আকাশমহলে পৌঁছে যাবেন।’
দিয়ালিয়া অঞ্চলের পাকা রাস্তাটা ধরে কিছু দূর গিয়ে একটা গ্রামের মধ্যে তারা ঢুকলো। রাস্তার দুপাশে গাছপালা। অটোটা আরো কিছুটা এগোতেই অয়ন দেখলো, উজ্জ্বল একটা পরিসর আর একটা আলোকিত হাভেলি!

এটাই আকাশমহলের পেছন দিকটা। অয়নকে নামিয়ে দিয়ে আটোরিক্সাটা ফেরত চলে গেলো। ধারে কাছে জনমনুষ্যি নেই।
লোহার বিশাল গেট। কাছেই গার্ড-রুম। মনে হলো, সেখানেও কেউ নেই।

অয়ন গেটটা ঠেললো। ভীষণ ভারী। মনে হলো, ওটার লোহার কব্জাতেও জংধরা! গেটটা একচুলও নড়ছে না। সামনে আলোকিত আকাশমহলটা। কিন্তু ভেতরে সে কি করে যাবে? গেটটা যদি না খোলে? অয়ন ভাবছিল, একবার শ্রীদেবীকে ফোন করবে? ঠিক তখনই অন্ধকার ফুঁড়ে একজন গার্ড এসে হাজির।
অয়নকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে গার্ডটা দু’মিনিট ভেতরে কারো সাথে কথা বললো। তারপর সসম্ভ্রমে জানালো, -‘আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন। আপনি শ্রীদেবীর কাছে যাবেন। আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি। আসুন আমার সাথে।’

আকাশমহলের পেছন দিককার এই রাস্তাটা ঘাস, মাটি আর মোরামের। দুপাশে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। হাস্নুহানা আর রজনীগন্ধা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। আধো আলো-অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে, এই রাতেও রাস্তার দুধারে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে।
যেতে যেতে অয়ন গার্ডটাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনাদের আকাশমহলে এতো আলো। অথচ এখানে আসার এই রাস্তাটা এতো অন্ধকার কেন? আপনাদের গেটটা ভীষণ ভারী, আর মরচে ধরা! ওটাকে তো ঠেলে খোলাই কঠিন! এখানে লোকেরা আসে কি ভাবে?’
গার্ড বললো – ‘যারা আসবার, তারা ঠিকই আসে। আসলে এই দুনিয়ায় ভেতরে ঢোকবার কায়দাটা জানা থাকা চাই। আপনি যে গেটটা দিয়ে এসেছেন, ওটা পেছনের গেট। আকাশমহলের সামনে আরো তিন তিনটে গেট আছে।’
কিছুটা এগিয়ে যেতেই আলোকিত পরিসরটা বিস্তৃত হলো। দেখে মনে হলো আকাশমহলের পুরোনো স্থাপত্যটা তিন-চারশো বছরের পুরোণো।

কাছাকাছি আসতেই স্পষ্ট হলো ভেতর থেকে ভেসে আসা লোকজনদের কথাবার্তার আওয়াজ। সে তো পেছন থেকে ঢুকেছিল। এখন দেখলো আকাশমহলের প্রধান প্রবেশপথ, তার সামনে আলো ঝলমল পার্কিং-প্লেস। নামী দামী অনেকগুলো গাড়ী সারি সারি দাঁড়ানো।
গার্ডটা অয়নকে আকাশমহলের সিঁড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিল। বললো, ‘আপনি অভিনেত্রী শ্রীদেবীর সাথে দেখা করবেন তো? প্রথম ফ্লোরটা পারফরমেন্স-ফ্লোর, তার উপরে ক্যাপাসিটি-ফ্লোর। অ্যাচিভমেন্ট-ফ্লোরটা তিন তলায়। আপনি ওখানেই শ্রীদেবীকে পেয়ে যাবেন। তিনি আছেন রোমান্টিক-এক নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে’।

বখশিসের জন্যে হাত পাতলে অয়ন গার্ডটার হাতে একশোটা টাকা গুঁজে দিলো। অয়ন তার প্রিয় অভিনেত্রী শ্রীদেবীর কাছে যাচ্ছে। সে সিনেমাতে অভিনয় করবে। একটা গোপন আবেগ কিংবা ভীরুতা। তার বুকটা কাঁপছিল।

আকাশমহলের সিঁড়ি ধরে অয়ন উপরে উঠছে। অনেকটা পরিসর নিয়ে মহলের একতালাটা, ইংরেজীতে লেখা – ‘পারফর্মেন্স ফ্লোর’। জমজমাট গান বাজনার আওয়াজ! অয়নের নজরে এলো, কয়েকজন নর্তকী ও সিনেমার মানুষজন। তারা কিছু পারফর্ম করছে! ক্যামেরাম্যানেরা ফটো তুলছে। আশপাশে ঘোরা ঘুরি করছে বেশ কয়েকজন অল্প বয়েসী তরুণ তরুণী।
অয়ন সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো দোতালায়। ব্যালকনিতে লেখা- ‘ক্যাপাসিটি ফ্লোর’। সেটার ভেতরেও কেমন একটা ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী ব্যস্ততা!

তিনতলায় উঠতেই একটা সুগন্ধি ভেসে এলো। সামনে লেখা – ‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’। একটা বিশাল নন-ট্রান্সপারেন্ট কাঁচের দরোজা। বন্ধ দরোজা ঠেলে তাকে ভিতরে ঢুকতে হবে?
সুইং-ডোরের কাচের দরোজাটা সামান্য ঠ্যালা দিতেই সেটা খুলে গেলো। ‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’এর তিনতালাটা হোটেল আর অডিটোরিয়ামের সমন্বয়। এখানে কোথায় এক নম্বর রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্টটা? একটু সময় নিয়ে সে দেখলো, হলঘরের একপাশে কতগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। হোটেলের মতো। ভিআইপি গেষ্ট বা নায়ক নায়িকাদের বিশ্রামের জন্যে? পাশেই চওড়া অডিটোরিয়াম, একটা স্টেজ। যেন কোন দামী উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলন কক্ষ। সারিবদ্ধ অনেকগুলো সৌখীন সোফা ও সেন্টার টেবিল। কিন্তু এখন কোনো লোকজন নেই।

পাশাপাশি চারটে ঘর। অ্যাপার্টমেন্টগুলোর নামও কেমন অদ্ভুত! রোমান্টিক – এক, দুই, তিন, চার! ‘রোমান্টিক – এক’ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই একজন পরিচারিকা বেরিয়ে এলো। সে হেসে তাকে অভ্যর্থনা করলো – ‘অয়নকুমার? আসুন, ভেতরে আসুন।’
অ্যাপার্টমেন্টটাতে একটা রুমের ভেতরে আরেকটা প্রাইভেট রুম। পরিচারিকাটি তাকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেল। অয়ন দেখল, তার স্বপ্নের নায়িকা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে।
শ্রীদেবীই হাত নেড়ে তাকে ডাকলো - ‘এসো অয়ন, এসো, এসো।’
সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্ট। রুমে মুখোমুখি দুটো সোফা, একটাতে অয়নকে বসতে বললো। অন্যটাতে শ্রীদেবী মুখোমুখি বসলো। তার অভিনেত্রী সত্যিই সুন্দরী, গোলগাল মুখ। পরিপাটি করে বাঁধা চুল। যেন কত যুগের চেনা!

একটা আনন্দ, একটা বিস্ময় নিয়ে অয়ন মাথা নীচু করে বসে রইলো।
শ্রীদেবী নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বললো, ‘হাই অয়ন, তোমার জন্যেই ওয়েট করছিলাম। তোমাকে এখানে পেয়ে রিয়েলি ফিলিং ফ্যান্টাসটিক!’
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম! এই ইনভাইটেশনটা পেয়ে আমারও খুব ভালো লাগছে! কখনো ভাবি নি, এমন একটা আশ্চর্য জায়গায় আপনার সাথে দেখা হবে!’

শ্রীদেবী দুচোখ তুলে অয়নের দিকে তাকিয়ে রইলো। - ‘আজকে সারাদিন স্যুটিং ছিল। ডিরেক্টর অনিল মেহেতা কোলকাতায় ফিরে গেছে। কালকে আবার আসবে। কালকেই ফ্লিম দুনিয়ার মানুষদের এখানে একটা গেট -টুগেদার আছে। তখন ডিরেক্টর মেহেতার সাথে তোমাকে ইন্ট্রো করিয়ে দেবো। এসো, তোমার ব্রাইট-ফিউচারের নামে আজকে রাতটা আমরা সেলিব্রেট করি!’

টেবিলে রাখা একটা ঘণ্টা টিপে দিতেই বন্ধ রুমের দরোজা ঠেলে সেই পরিচারিকাটি ঢুকলো।
‘দু গ্লাস চিলড বিয়ার, স্ন্যাকস। দু প্লেট ডিনারও রেডি রাখো। যখন বলবো, তখনই সার্ভ করবে।’
নির্জন একটা রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্ট। শ্রীদেবী অয়নের খুব কাছে, মুখোমুখি! অয়ন তার প্রিয় নায়িকার শরীরে সেন্টের মাদক গন্ধ পাচ্ছে!
‘তুমি কি সিনেমাতে আমার সাথে মেইন ক্যারেক্টারে অভিনয় করতে রাজী আছো?’
অয়নের সসম্ভ্রম উত্তর – ‘ডিরেক্টর আর আপনি চাইলে চেষ্টা করতে পারি!’
‘ডিরেক্টরের হাতে একটা সিনেমা আছে, যার জন্যে আমার কাছে অফার আছে। যার স্ক্রিপ্টটা এরকম, নায়িকা একজন দেহব্যবসায়ী, মানে প্রস! আর নায়ক একজন সাইনটিষ্ট। এর জন্যে ভাল একজন অ্যাকটর খোঁজা হচ্ছে। তুমি রাজি?’
অয়ন কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারলো না!

বড়ো মোহময় রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্ট। নানা কথায় কথায় দুজনের বেশ কিছুটা সময় কাটলো।
গল্প করতে করতে শ্রীদেবী অয়নের খুব কাছে এসে বসলো। তার পলকহীন চোখ বাইশ বছরের এক যুবকের দিকে! অভিনেত্রী অয়নের হাতটা ধরলো। তাকে বুকের কাছে টেনে নিলো। অয়ন অনুভব করলো, একজোরা নরম স্তনের স্পর্শ, গোলাপের সুগন্ধ!

প্রিয় নায়িকার দুটো ঠোঁট তার ঠোঁটে। শ্রীদেবী অয়নকুমারকে চুমু খেলো।
‘জানো অয়ন। তোমাকে দেখার পর, কেন জানি না! মনে মনে তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি! লোকেরা বলে, তারা নাকি শ্রীদেবীর সিনেমা দেখে খুব সহজে প্রেমে পড়ে যায়। আমার কিন্তু সবার মতো যখন তখন প্রেম আসে না। তুমিই কিন্তু একসেপশন! সত্যি বলছি অয়ন, ‘শকুন্তলম’-এ তোমার অভিনয় দেখার পর থেকে আমি ধীরে ধীরে তোমার জন্যে কেমন ইনফ্যাচুয়েটেড হয়ে পড়েছি! আমি তো অভিনেত্রী, টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি এসব কোন কিছুই আমার কম নেই। কিন্তু এ পর্যন্ত আমার আর কোন সংসার করা হলো না! আমি যে ভালোবাসার কাঙাল!’
সেই নির্জন রাতের বেশ অনেকটা সময় দুজনের! বড়ো একান্ত আর অন্তরঙ্গ সে সময়! তখন রাত প্রায় দুটো। শ্রীদেবী অয়নকে বললো, - ‘কালকে আর পরশু। এ দুদিনই তুমি আজকের মতো সময়ে, রাত আটটাতে এখানে আসবে! প্রমিস!’
- ‘প্রমিস!’

অভিনেত্রীর পরিচারিকাটি অয়নকে কার স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিলো। আকাশমহলেরই একজন ড্রাইভার গাড়িতে করে অয়নকে দিয়ালিয়াতে পৌঁছে দিলো।

দিয়ালিয়ার হোটেলে তার নিজস্ব রুম। শ্রীদেবী ওর শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অয়ন টের পেলো তার সারা শরীরটা ভীষণ উত্তপ্ত। অনুভূতিতে তখনো তার প্রিয় অভিনেত্রীর গোলাপী গন্ধটা। বাকী রাতটুকু অয়নের টুকরো টাকরা ঘুম হলো। বিছানায় তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল একজন মহিলা। মিসেস শ্রীদেবী ব্যানার্জী – নায়িকা, যার বয়েস চল্লিশ বা বিয়াল্লিশ – কোলকাতার একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী!

পরের দিন সন্ধ্যায় অয়ন অটো ধরে সময়মতোই আকাশমহলে পৌঁছে গেল। পেছন দিকটাতে। গতকালের সেই পরিচিত গেটে। সে দেখলো, সেই গার্ডটাই আজও হাজির আছে। গার্ডের অপেক্ষা না করে অয়ন আজ জঙ-ধরা গেটটাকে ঠ্যালা দিল। ভারী লোহার গেটের পাল্লাদুটো সহজেই খুলে গেলো। প্রচন্ড ভারী গেটটাকে দ্বিতীয়দিনে তেমন ভারী মনে হলো না। গত একদিনের অভিজ্ঞতাতেই লোহার ব্যারিকেডটা তার কাছে অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে!

গার্ড – ‘আপনি তো গতকালও এসেছিলেন। অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরে যাবেন তো? যান যান, ভেতরে যান’।
আকাশমহলের দিকে অয়নকুমার এগিয়ে গেলো। আজকে সে আবার নজর দিয়ে ভালো করে দেখলো মহলটাকে। বাইরে থেকে কাঠামোটাকে দেখলে মনে হবে রাজস্থানের দেখা কোন পরিত্যক্ত বিশাল রাজমহল। মহলের পুরোনো আদলটা বজায় রেখে ভেতরটাকে অত্যন্ত আধুনিক ভাবে সংস্কার করা হয়েছে। আজকে সন্ধ্যায় মহলটা কিন্তু গতকালের চাইতে অনেক বেশী জমজমাট লাগছে! তিন-তিনটে তলাই আলোয় আলোয় ভাসছে।

আলোকিত মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। প্রথম দিনের মতো অয়ন এগিয়ে যেতে লাগলো ওর প্রিয় অভিনেত্রী আর আকাঙ্খিত অভিনয়ের দুনিয়ার দিকে। তার গন্তব্য আকাশমহলের তিনতালায় – অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরে।

একতালার পারফর্মেন্স ফ্লোর, দোতালায় ক্যাপাসিটি ফ্লোর পেরিয়ে সিঁড়িতে পা মেপে মেপে অয়ন তিন তলার অ্যাচিভমেন্ট-ফ্লোরে পৌঁছালো।

তিনতলাটা আজ গতকালের মতো নির্জন নয়, খুব জমজমাট! ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের অ্যাচিভমেন্ট-ফ্লোর এর প্রবেশদ্বার। হালকা করে ভেজানো কাঁচের দরজাটা। ভেতরে শোনা যাচ্ছে নারী আর পুরুষদের কথাবার্তা।

সুইং ডোর ঠেলে অয়ন ভেতরে ঢুকলো। অনেক মানুষ – সমৃদ্ধ সব চেহারা। প্রায় সমস্ত অডিটোরিয়াম জুড়ে মুখোমুখি সারিবদ্ধ অনেকগুলো সোফা। দুটো সোফার মাঝে সেণ্টার টেবিল। সুন্দর করে সাজানো। অনেক নারী পুরুষের মুখ। তারা কি সবাই সিনেমার লোক? অভিনেতা অভিনেত্রী?
গতকালের ‘রোমান্টিক – এক’ অ্যাপার্টমেন্টের দরোজাটা আজ বাইরে থেকে বন্ধ। তা হলে তার অভিনেত্রী শ্রীদেবী এখন কোথায়?

একেকটা সোফায় একেকজন নায়িকা বসে আছে। তার বিপরীতে মুখোমুখি এক এক জন নায়ক! ওরাও কি সবাই অভিনেতা? নাকি বিখ্যাত সব মানুষজন, নাকি কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট? ওদের মধ্যে হয়তো নির্দেশক আর প্রোডিউসাররাও আছে! ওই ভীড়ের মধ্যে অয়ন তার প্রিয় অভিনেত্রীকে খুঁজতে লাগলো। বিশাল হলঘরটার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সে কয়েকবার হাঁটলো। সমস্ত পুরুষ-মহিলারা একজন আরেক জনের সাথে গল্প করছে। দু’একজন সোফায় বসে নিজের নিজের মোবাইল দেখছে। এটাই তাহলে ফ্লিম দুনিয়ার মানুষদের গেট -টুগেদার, যার কথা শ্রীদেবী বলেছিলো।
মিলন সম্মেলন? না কি একজন পুরুষ আরেক জন মহিলাকে নিয়ে এখানে সময় কাটাতে এসেছে? সে কি ভুল সময়ে এখানে এসে পৌঁছেছে? না, গতকাল শ্রীদেবী ডিরেক্টরের সাথে দেখা করানোর জন্যে তাকে এমন সময়তেই আসতে বলেছিলো!

অয়ন শ্রীদেবীকে অনেক খুঁজলো। প্রায় সমস্ত মহিলাদের দিকে চুপিচুপি নজর বোলালো। কিন্তু সে কই? তার মনে হলো, শ্রীদেবী অন্য কোন নায়িকার মুখোশে আত্মগোপন করে আছে! গতরাতে যে প্রিয় অভিনেত্রীর সাথে অয়ন অনেকটা সময় একসাথে কাটিয়েছে, আজ সে কোথায়?
ওখানে যারা উপস্থিত ছিল, তারাও অয়নকে দেখছিল। কিন্তু বিশেষ পাত্তা দিলো না। তারা ভাবলো লোকটা হয়তো ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির কেউ, কিংবা আকাশমহলের কোনো যুবক-কর্মচারীও হতে পারে!
শ্রীদেবীকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ পরে অয়ন আকাশমহলের তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে সটান নেমে এলো নীচে। গাড়ীর পার্কিং-এর সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনতলার দিকে মুখ রেখে অয়ন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। পরপর কয়েকটা কল করলো, শ্রীদেবীর নাম্বারে। রিং বেজেই চল্লো, কিন্তু কোন উত্তর এলো না।

ক্ষোভে অভিমানে কেমিস্ট্রির একটা কঠিন কম্পাউন্ডের নাম ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। কথাগুলো শোনালো কোনো গালি কিংবা একটা পাগলের প্রলাপের মতো।
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একজনের গাড়িতে লিফট নিয়ে সে ফিরে এলো নিজের হোটেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দ্বিতীয় রাতে নায়িকার সাথে তার আর কোন যোগাযোগই হলো না। প্রথম রাতের নায়িকার ঠোঁটের চুমু তার ঠোঁটে লেগেই ছিল! কিন্তু কি হবে তার সিনেমা জগতের আগামী ভবিতব্য? ডিরেক্টারের সাথে তার আজ আর দেখা হলো না!

দিয়ালিয়ার হোটেলে তৃতীয় দিনের সকাল। অয়নের তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। চোখে মুখে অনিদ্রা জনিত ক্লান্তি। হোটেল ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় রাস্তায় ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরলো। অয়ন ভুলে গেলো, সে কোলকাতা ইউনিভার্সিটির পিএইচডির স্টুডেন্ট।
অয়নকে চলচ্চিত্র জগতের নায়ক হতেই হবে। এখন সে কেমিস্ট্রির ছাত্র নয়, ইউনিভার্সিটির কোন ট্যালেন্টেড যুবক নয়! গ্রুপ থিয়েটারের কোন উদীয়মান অভিনেতা নয়! সে এখন নায়ক অয়নকুমার। শ্রীদেবীর সাথে সে বড়ো পর্দায় অভিনয় করবে! এ জন্যে তাকে টলিউডের একজন ভালো অভিনেতা হতেই হবে।

পথচলতি একটা ব্যাঙ্কে ঢুকে সে দেখে নিতে থাকলো, একজন ম্যানেজার ক্যামন করে রিভলভিং চেয়ারে বসে তার সামনে বসা অধস্তন কোনো কর্মীকে ধমকায়। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে সে দেখলো, একটা রিক্সায়ালা প্যাডেল মারতে মারতে কি করে তার গায়ের ঘাম মোছে। বাসস্ট্যান্ডের একটা বেঞ্চে বসে সে রিক্সায়ালার দু’পা-চালানো আর গামছা দিয়ে ঘাম মোছাটাকে নকল করলো। অয়ন পথচলতি লোকজনদের মুভমেন্টগুলো মন দিয়ে দেখতে লাগলো। সে নকল করার চেষ্টা করলো, কি করে একটা কুলী একসঙ্গে দুটো স্যুটকেস মাথায় চাপিয়ে বা-হাতে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বাসস্ট্যান্ডের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যায়। তাকে আরো দুর্দান্ত অভিনয় করতে হবে। তাকে শ্রীদেবীর যোগ্য নায়ক হয়ে উঠতে হবে।

সেদিন, মানে তৃতীয় দিনের বিকেল। হোটেলে ফিরে অয়ন নিজেকে সুসজ্জিত করলো। গায়ে সেন্ট, পায়ে জুতো, সুন্দর শার্ট প্যান্ট। সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লো আকাশমহলের দিকে। শ্রীদেবীর তাকে বলেছিল পরপর তিনদিন, প্রত্যেকদিনই সন্ধ্যা আটটা নাগাদ আকাশমহলে আসতে। গতকাল শ্রীদেবীর সাথে দেখা হয় নি তো কি হয়েছে? আজ নিশ্চয়ই তার সাথে অয়নের দেখা হবে! তারা দুজন কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটাবে! একজন আরেক জনকে মনের কথা খুলে বলবে। শ্রীদেবী বলেছিলো, তাদের নতুন সিনেমা ডিরেক্টর মিস্টার রুংতার সাথে অয়নকে ইন্ট্রো করিয়ে দেবে।
অটো নয়, তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় অয়ন শহরের একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিলো। আজকে আর অন্ধকার পেছনের গেট নয়, আলো-ঝলমল সামনের গেট দিয়ে সে আকাশমহলে ঢুকলো। দু’কদম এগোতেই মহলের মার্বেল পাথরের সিঁড়ি।
কটা নায়কোচিত ভঙ্গীতে তেতালায় উঠতে যাবার আগে অয়ন ভাবলো। আজ একতালা আর দোতালাটা ভালো করে ঘুরে দেখা যাক।

একতালা। পারফরমেন্স ফ্লোর। সেখানে চলছিল গান বাজনা, সঙ্গীত, অ্যাক্টিং-অভিনয়, ফটোগ্রাফি, ক্যামেরার কারিকুকি। সবাই নিজের নিজের পারফর্মেন্স দেখাচ্ছে। অয়নকে কি এখানে তার পারফরমেন্স দেখাতে হবে? তার অভিনেত্রী শ্রীদেবী তো শকুন্তলম-এ তার পারফর্মেন্স দেখেই তাকে আকাশমহলে ডেকেছে!

পারফরমেন্স ফ্লোরে মকবুল ফিদা হোসেনের মতো দেখতে একজন লোক তাকে জিজ্ঞেস করলো আপনার কোয়ালিফিকেশন আর স্পেশালাইজেশন কি? আপনার চেহারাটা তো নায়কের মতো। কিন্ত আজকাল ফ্লিমে চান্স পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?
অয়ন একটু হাসলো। মুখে কিছু বলতে পারলো না।

পারফরমেন্স ফ্লোর ছাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে এলো দোতলায়। আজকে এই ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে অয়ন সবকিছু ভালো করে দেখতে লাগলো। এর নাম- ক্যাপাসিটি ফ্লোর। ক্যাপাসিটি মানে ফাইনানন্সিং, ব্যাঙ্কিং, ইনভেস্টমেন্টএর নানা অফিস। পয়সায়ালা লোকজন ঘোরাঘুরি করছে! তারা কেউ অয়নের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত না। অয়নের বাবার তো শিলিগুড়িতে ছোট্ট একটা চায়ের ব্যবসা! কিছু মানুষ বুঝে গেল, অয়নের পকেটে খরচা করার মতো বেশী টাকা পয়সা নেই। তখন লোকগুলো তার ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখালো না। ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত একজন তো তাকে বলেই দিল - ভাই, তুমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছো। এই জায়গাটা, মানে, এই আকাশমহল তোমার জন্যে ঠিক উপযুক্ত না। তুমি কি করো? তোমার বাবার কত সম্পত্তি? তিনি কি তোমার খরচাপত্তর টানতে পারবেন?

লোকটার এরকম ফালতু কথায় অয়ন কিছুটা বিব্রত হলো। ক্যাপাসিটি ফ্লোর থেকে সে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি ভেঙ্গে অয়ন পা বাড়ালো তিন তলার দিকে।
অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর। আগের দুদিনের মতোই পরিচিত ঘসা-কাচের দরোজাটা। কিন্তু আজকের তিন তলাটা বড়ো বেশী মিইয়ে পড়া, নির্জন নিঃশব্দ! দেখলো, দরোজার বাইরে সাজানো ফুলগুলো নেতিয়ে আছে।

অয়ন ভাবছে – তার অভিনেত্রী নিশ্চয়ই একলা একলা রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্টে অপেক্ষা করছে। সত্যিই কি শ্রীদেবী তার জন্যে ইনফ্যাচুয়েটেড? যদি দেখা হয়, তাকে মুখ খুলে আজকে বলতেই হবে - ‘শ্রীদেবী, আমি সিরিয়াসলি তোমার সাথে থাকতে চাই, তোমার সাথে নায়কের ভূমিকায় অ্যাক্টিং করতে চাই’! সত্যিই কি শ্রীদেবী তাকে নায়কের ভূমিকায় নেবে? চল্লিশ বছর বয়েসী এই অভিনেত্রী কি সত্যি সত্যি তাকে ভালোবাসে? নাকি অয়ন নিজেই শ্রীদেবীর জন্যে ইনফ্যাচুয়েটেড?

সুইংডোর ঠেলে আগের দু’দিনের মতোই সে অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরের ভেতরে ঢুকলো। বিশাল হলঘরটাতে আজ এখন একরাশ নির্জনতা। বন্ধ ঘরের মধ্যে আটকে থাকা সেন্ট আর বাসিফুলের গন্ধ। এলো মেলো অনেকগুলো সোফা, সেন্টার টেবিল, পরিত্যক্ত কিছু কসমেটিক সামগ্রী। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুলের মালা আর বাসি রজনীগন্ধার তোড়া।

এখানকার সবগুলো রোমান্টিক অ্যাপার্মেন্ট বাইরে থেকে বন্ধ! শ্রীদেবীর অ্যাপার্টমেন্ট রোমান্টিক-এক ঘরটা, গত পরশুর নিশিযাপনের গোলাপী স্মৃতি, যার ভেতরে! সেটারও বাইরে থেকে তালা ঝুলছে।
তাকে অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরে অপেক্ষায় রেখে সবাই কি যে যার মতো ফিরে গেছে?
তার জন্যে শ্রীদেবী আজকেও নেই। অথচ তার অভিনেত্রী বার বার প্রমিস করিয়েছিল, পর পর তিন দিনই তাকে আসতে হবে। রাত আটটায়, আকাশমহলের অ্যাপার্টমেন্টে! অথচ তার নায়িকা শ্রীদেবীরই কোন পাত্তা নেই!

নিঃশব্দে মার্বেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো সে। কার পার্কিং-এর সামনে, লনটায় দাঁড়ালো। অয়ন দেখলো, তিনতলার ‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’টা খুব ম্লান, সামান্য আলোকিত। তার উপরেও একটা আবছায়া স্ট্রাকচার আছে।
‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’এর তিনতালার উপরে যে একটা চারতালা আছে গতদুদিন অয়ন তা খেয়াল করে নি! ওখানে কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশমহলের উপরতালাটা আগে তার নজরে আসে নি কেন? কল্পনাতে পরিপূর্ণ যে কোনো আকাশমহল, তার উপরতলটা কি স্বপ্নভঙ্গের মতোই সবসময়েই এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে?

হঠাৎ অয়নের মনে হলো তার বান্ধবী, একাডেমীর থিয়েটারের শকুন্তলা, তার কলেজের থার্ড ইয়ারের মল্লিকা, আকাশমহলের অন্ধকারাচ্ছন্ন চারতালার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে! সে দুষ্মন্তকে গুডবাই দিচ্ছে! মল্লিকা কি করে জানলো আকাশমহল আর শ্রীদেবীর কথা?
অয়নের সাথে শ্রীদেবীর কি আর কখনোই দেখা হবে না?

আলোকিত আকাশমহলের একতালা-দোতালা থেকে থেকে ছিটকে পড়ছে হাল্কা আলোর রশ্মি। সেই হতাশ আলোয় দাঁড়িয়ে মোবাইল স্ক্রিনে অয়ন শ্রীদেবীর নামটা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তার নামটা এখন আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। কন্টাক্ট-নাম্বার আর সেভ করা শ্রীদেবীর ছবিটা অয়নের মোবাইল থেকে কিভাবে যেন নিজে নিজেই ডিলিট হয়ে গেছে!
0

কবিতা - রঞ্জন রায়

Posted in





নিশির ডাকেৱ মত
মাঝরাতে তিনবার সমুদ্রগর্জন।
দরজায় খিল আঁটা তবু জাগে ওরা তিনজন।

বাইরে ফুঁসছে ঝড়
ফুলে ওঠে সিংহের কেশর,
সমুদ্রঘোড়ায় চড়ে চলে গেল ওরা তিনজন।

ঝড় কবে থেমে গেছে
মরা চাঁদে লেগেছে গ্রহণ।
নৌকো সব ফিরে এল
ফেরেনি তো ওরা তিনজন।

বালিতে পায়ের দাগ মুছে দিল জোয়ারের জল,
একা একা ঘরে ফিরি
হা-হা করে চন্দনের বন।।
0

কবিতা - ঋজু রেজওয়ান

Posted in






বিজ‌য়ের সব মুহূ‌র্তেই...
                                      তার অ‌ধিকার!
কেন্দ্র হোক আর কেন্দ্রা‌তিগ ব‌লের আসন;

কেউকেউ বোরকায় রমনীয় স‌ঙ্গানুসঙ্গের;
ওহ‌মের কাছা ও কা‌ছির অ‌ভিবাবকসুলভ
নিঃশ‌ব্দে ব‌সে আছে... মিস না ম্যাডাম?

ক্লা‌শের সবাই উঠে দাঁড়াইল [ধর‌তে পা‌রেন]
নত-ই হইল
কোন সমস্যা দে‌খি না— Monotonously.
বেহালার স্টীলপ্লে‌টে যে স্ট্রিং, বাঁধায় বাজে।

সিল্কের মতই টানটান— উত্তেজিত গুনগুন
যেন, প্রান্তটি ধরেই নিয়ন্ত্রণও করছে কেউ!

তবুুও করছে দাবী, ভেতরের অদৃশ্য তরঙ্গ।
হাতের ভাঁজগুলিও খুলে গেল!
কেন জানি, শুকনো ঠোঁটেও বিজয় দেখছি..
0

কবিতা - কুমকুম বৈদ্য

Posted in






একচিলতে জীবন ভিজুক
রোদ বৃষ্টি জলে
আমরা সবাই নাম লেখাবো
দস্যি হওয়ার দলে

ছাদের উপর আকাশ নামুক
ফাগুন ছড়াক গাছ
লতায় পাতায় জড়িয়ে প্রেম
চোখে রোদের আঁচ

কার সাথে কার মিলবে নয়ন
কে দেবে আজ রং
ঈর্ষা আমায় রাঙিয়ে দিলো
আজকে দোলের ঢং

গাছের পাতায় বিরহ ছড়ায়
ছটাক ঢোলের বোল
চৌকাঠে আজ ফাগুন দাঁড়ায়
মনের দরজা খোল
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in






নাপা ক্যাবেজ দিয়ে অমলেট

খুবই সামান্য উপকরণে মন এবং পেট ভরা একটি খাবারের হদিশ রইলো।

উপকরণ ::

নাপা ক্যাবেজ বা চাইনিজ ক্যাবেজ (ছবি দেওয়া আছে)
ডিম
রসুন কুচি
নুন
গোলমরিচ গুঁড়ো
অলিভ অয়েল
গাজর কুচি (অপশনাল)
চিজ (একেবারেই অপশনাল)

পদ্ধতি :: নাপার পাতা খুলে নিয়ে ধুয়ে ভালো করে জল ঝরিয়ে কুচিয়ে নিতে হবে। রসুন কুচিয়ে নিতে হবে। ডিম ভেঙে, গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে ঘাঁটিয়ে রাখতে হবে। অলিভ অয়েল কিছুটা গরম হলেই রসুন কুচি, নাপার কুচি, গাজর কুচি, নুন দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিয়ে রান্না করতে হবে। জল বেরোলে, ঢাকা খুলে নাড়িয়ে নাড়িয়ে জল শুকোতে হবে। জল শুকিয়ে গেলে আঁচ একদম কমিয়ে ডিমের গোলা ঢেলে ঢিমে আঁচে রান্না করতে হবে। ওপর দিয়ে কুরিয়ে নেওয়া চিজ দিয়ে ঢাকা দিয়ে আঁচ বন্ধ করে, কিছু সময় প্যানের মধ্যে গরমে রেখে চিজ গলিয়ে নিতে হবে। গরম গরম পরিবেশন।

অলিভ অয়েল কিন্তু অন্যান্য তেলের মতো পুরো গরম হলে তবে রান্না করতে হবে, তেমন নয়। বেশী গরম করলে অলিভ অয়েলের গুণ নষ্ট হয়ে যাবে। কাঁচালঙ্কার কুচি দিলেও খুব ভালো লাগবে।


0

সম্পাদকীয়

Posted in






আবার সেই উৎসবের দোরগোড়ায় আমরা। কিন্তু উৎসবের অর্থ কী? তার প্রয়োজনীয়তার গণ্ডি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত? এইসব প্রশ্ন অনেকাংশে উত্তরগর্ভ। সেইসব উত্তর আবার জন্ম দিতে পারে বিবিধ জিজ্ঞাসার।

একথা অবশ্য অনস্বীকার্য এই বিষয়টির দুটি মূল ধারা - সামাজিক এবং ধর্মীয়। আবার এই দুই ধারার মধ্যে প্রধান সাযুজ্য স্বতস্ফূর্ততা। এই আপন অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত বহতা নদীর মতো সহজিয়া ভঙ্গীটিই এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মানুষের সানন্দ যোগদান - যার অনুপস্থিতিতে একটি উৎসব কখনওই তার যথার্থ মর্যাদা পেতে পারে না। তাহলে এমন যদি ভাবা হয়, কোনও বিশেষ উপলক্ষ্যে দলবদ্ধভাবে মানুষের নিঃসঙ্কোচ একত্র হওয়াই একটি উৎসবের প্রাথমিক শর্ত, ভুল হবে কি? সেই যুক্তিতে যে কোনও উৎসবের একটি মানবিক মুখ থাকা নিতান্ত জরুরি।

আসন্ন বার্ষিক উৎসবের প্রেক্ষাপটে এই ভাবনাগুলি অত্যন্ত সঙ্গত মনে হওয়ার কারণ উৎসব পালনে ফতোয়ার ঘোষণা। আর একথা কি আমাদের জানা নেই যে ফতোয়া আর মৌলবাদ সর্বদা হাত ধরাধরি করে থাকে। সেক্ষেত্রে উদযাপনের মূল সুরটির যায় তাল কেটে। ফুটন্ত ভাতের গন্ধে মাতোয়ারা মানুষের চেয়ে উৎসবপ্রিয় আর কে আছে?

সুস্থ উৎসবে থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।