Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















চতুর্দশ পর্ব

সিরাজের পলায়ন এবং শেষ পরিণতি

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে সারারাত ঘোড়া চালিয়ে সিরাজ মুর্শিদাবাদ এসে পৌঁছোয় পরেরদিন সকাল ৮টায়। বেশ কিছু সৈনিক তার আগেই পালিয়ে এসেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। কয়েকজন বিশ্বাসী সৈন্য এবং প্রহরীদের সঙ্গে নিয়ে সিরাজ প্রথমে গেল তার প্রাসাদ হীরাঝিলে। প্রাসাদে পৌঁছে সিরাজ বুঝতে পারল যে ক্ষমতা হারালে মানুষ কত অসহায় হয়ে পড়ে। যে সব সেনাপ্রধানরা একদিন তার কথায় উঠত বসত আজ তারা কেউ সিরাজের অনুরোধে কর্ণপাত করলো না। সিরাজ অনুরোধ করেছিল যেটুকু সময়ে সে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে তার পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করছে সেটুকু সময়ে যেন তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরাজিত নবাবের কথায় কান দেবার সময় কার আছে? একদা তারই বেতনভুক সেনাপতিরা সিরাজকে বিপদের মধ্যে ফেলে যে যার নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। উপায় না দেখে সিরাজ তার শ্বশুরমশাই মহম্মদ ইরাজ খানের পদতলে নিজের রাজমুকুট নামিয়ে রেখে অনুরোধ করল যে রাজমুকুটের বিনিময়ে যদি তিনি কিছু সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে তাকে একটু নিশ্চিন্ত বিশ্রামের এবং প্রয়োজন পড়লে সম্মানের সঙ্গে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় তবে সে বাকি জীবন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। জামাতার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে নিজের পথে রওনা দিল মির্জা ইরাজ। উপায়ান্তর না দেখে সিরাজ নির্দেশ দিল যে তার নিরাপত্তার জন্য প্রাসাদের পাহারার কাজে যারা রাজি হবে তাদের যেন কোষাগার থেকে তাদের চাহিদামত অর্থ বিনাপ্রশ্নে দিয়ে দেওয়া হয়। দেখতে দেখতে কোষাগারের সামনে সৈনিকদের ভিড় জমে গেল। সিরাজ হুকুম দিল সমস্ত সৈনিককে যেন তিনমাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দেওয়া হয়। দরবারের অনেকে পরামর্শ দিল যে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করাই এই মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত। সিরাজ রাজি হলনা। সে বললো আত্মসমর্পণ বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। আত্মসমর্পণ করার হলে অনেক আগেই তা করা যেত। দরবার ভেঙে দিল সিরাজ। জানালো যে কারও পরামর্শের কোনও দরকার নেই তার। পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত সে একাই নেবে কিন্তু কোনওমতেই আত্মসমর্পণ সে করবে না। দরবার থেকে বেরিয়ে সিরাজ হারেমে পৌঁছে জানাল যে সকলে যেন প্রাসাদ ছাড়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। নিজেদের অলংকার এবং মূল্যবান সামগ্রী ছাড়া আর কিছু যেন সঙ্গে না নেয়। তারপর ভগ্ন্যোদ্যম বিশ্বাসী সেনাপতি মোহনলালকে ডেকে তাদের সকলকে এবং পঞ্চাশটি হাতিতে আসবাব এবং মালপত্র নিয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পূর্ণিয়া চলে যেতে বলল। সেদিন গভীর রাতে সিরাজ তার প্রধান মহিষী লুতফুন্নিসা, তার কয়েকজন পরিচারিকা, হারেমের অতিবিশ্বস্ত এক খোজা এবং বহু মূল্যবান রত্ন এবং রত্নালঙ্কার সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদের ২০কিমি উত্তর-পূর্বে ভগবানগোলার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আলিবর্দি খানের আমলে প্রয়োজনে গঙ্গা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য যে ঘাট নির্মাণ করা হয়েছিল সেই ঘাট থেকে নৌকাযোগে ভগবানগোলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো সিরাজ। পিছনে পড়ে রইল প্রাসাদ হীরাঝিল আর বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য।

মিরজাফর সেদিন মুর্শিদাবাদ পৌঁছেছিল সন্ধ্যা নাগাদ। হয়ত সেই কারণেই সিরাজকে মুর্শিদাবাদ ছাড়ার ব্যাপারে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। মুর্শিদাবাদ পৌঁছেই মিরজাফর সিরাজের খোঁজ করতে দিকে দিকে সৈন্য পাঠাল। মিরজাফর চাইলে আরও আগে মুর্শিদাবাদ পৌঁছতে পারত এবং তাতে হয়ত সিরাজকে আরও তাড়াতাড়ি অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ ছাড়ার আগেই বন্দি করা যেত। কিন্তু মিরজাফর হাওয়া না বুঝে মুর্শিদাবাদ আসতে চায়নি। সাধারণ মানুষ তাকে সমর্থন করছে না করছে না সেটা আন্দাজ করার চাইতেও মিরজাফরের অনেক বেশি দরকার ছিল মানুষ তখনও সিরাজের প্রতি সহানুভূতিশীল কিনা সেটা আন্দাজ করা। এক সাধারণ মানুষের বেশে মুর্শিদাবাদ ছাড়তে হলো সিরাজকে। পরেরদিন সকাল আটটায় মিরজাফর ক্লাইভকে জানাল যে সিরাজ প্রাসাদে নেই কিন্তু যে ভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করে ক্লাইভের হাতে তুলে দিতে সে বদ্ধপরিকর। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা মিরজাফরের কাছ থেকে আর একটি চিঠি এসে পৌঁছলো ক্লাইভের কাছে। তাতে লেখা আছে সিরাজ প্রাসাদেই আছে এবং তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য ক্লাইভ যেন সৈন্যবাহিনী পাঠানোর আদেশ দেয়। পরেরদিন ক্লাইভের উপস্থিতিতে তাকে বন্দি করে তার হাতে তুলে দেওয়া হবে।

মিরজাফরের উপর কোনও সময়েই সম্পূর্ণ আস্থা ছিল না ক্লাইভের। পলাশির যুদ্ধে মিরজাফরের নিষ্ক্রিয়তা তাকে মিরজাফর সম্বন্ধে আরও সন্দিহান করে তুলেছিল। ক্লাইভের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সিরাজকে সরিয়ে ব্রিটিশের অনুগত এক পুতুল নবাবকে সিংহাসনে বসানো। সেই পুতুল নবাব মিরজাফর। মিরজাফরের ব্যাপারে যাবতীয় অস্বস্তি দূরে সরিয়ে রেখে বিশ্বস্ত অফিসার স্ক্র্যাফটনকে পাঠাল মিরজাফরের কাছে। সঙ্গে পাঠাল একটি চিঠি যাতে লেখা আছে,’ যুদ্ধজয়ের জন্য আপনাকে অভিনন্দন। এই জয় আমার নয় , আপনার। আপনি যদি কাল দাউদপুরে আসেন এবং আমার বিজয়যাত্রার সঙ্গী হন তাহলে আমি খুব আনন্দিত হবো। মিঃ স্ক্র্যাফটন আমার পক্ষে আপনাকে অভিনন্দন জানাবেন। সর্বসমক্ষে আপনাকে নবাব ঘোষণা করার সৌভাগ্যজনক মুহূর্তের অপেক্ষায় রইলাম।‘ পরের দিন সকালে স্ক্র্যাফটনকে মুর্শিদাবাদ পাঠানো হল মিরজাফরকে সঙ্গে করে দাউদপুরে ক্লাইভের তাঁবুতে নিয়ে আসার জন্য। মিরজাফরের মনে হলো এত সব আয়োজন তাকে খতম করার জন্য নয়তো! সে নিজেও জানে পলাশির যুদ্ধে সে সিরাজকে সাহায্য করেনি কিন্তু সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশদেরও সাহায্য করেনি। তা সত্ত্বেও তাকে নবাবের পদে অভিষিক্ত করার লোভ দেখিয়ে ডেরায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ক্লাইভ তাকে একেবারে সরিয়ে দিতে চাইছে না তো ? একরাশ ভয় আর সন্দেহ বুকে নিয়ে মিরজাফর হাতির পিঠে চেপে ক্লাইভের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সঙ্গে চললো তার ছেলে মির মিরান।

ব্রিটিশ তাঁবুতে প্রবেশ করে হাতির পিঠ থেকে নিচে নামতেই বন্দুকধারী সৈন্যরা তাদের বন্দুক নামিয়ে মিরজাফরকে অভিবাদন জানাল। মিরজাফরের অপরাধী মন। তার মনে হলো এসব তাকে হত্যা করবার প্রস্তুতি। ভয় গেল যখন ক্লাইভ এসে তাকে আলিঙ্গন করলো এবং স্যালুট জানালো। তারপর দু’জনের মধ্যে প্রায় একঘন্টা আলোচনা চললো। ক্লাইভ তাকে মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে সিরাজ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে এবং দেখতে যে এই সুযোগে সিরাজের কোষাগার এবং ধনসম্পত্তি যাতে লুন্ঠিত না হয়ে যায়। রাজনৈতিক চক্রান্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলা যেতে পারে। এবার চক্রান্তের অর্থনৈতিক দিকটা দেখার সময়। মিরজাফর মুর্শিদাবাদ ফিরে গেল।

ওদিকে সিরাজ ভগবানগোলা পৌঁছে সেখান থেকে নৌকা বদল করে তার একান্ত অনুগত প্রাক্তন ফরাসি প্রধান ল-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। একসময় নিজে ব্রিটিশদের রোষ থেকে বাঁচার জন্য সিরাজ এই ল-কে কাশিমবাজার থেকে চলে যেতে বলেছিল। সিরাজের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের ভয়ে লুকিয়ে থাকা ল-এর সঙ্গে দেখা করে একত্রে পাটনার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। সেখানকার গভর্নর রামনারায়ণ এত কিছুর পরেও সিরাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রদর্শনে কার্পণ্য করেনি। এর কারণ সম্ভবত রামনারায়ণের তীব্র ব্রিটিশবিরোধিতা।

সন্দেহমনস্ক ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করার ঝুঁকি নিতে চাইলো না। শহরের বাইরে দলবল নিয়ে পৌঁছনোর পর ওয়াটস এবং জন ওয়ালশকে একশ সেপাই সহযোগে মিরজাফরের কাছে পাঠিয়ে শহরের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলো। ওয়াটস এবং ওয়ালশ বিকাল তিনটে নাগাদ মিরজাফরের কাছে উপস্থিত হলো। তার একটু পরেই বিশাল ব্রিটিশবাহিনী সিরাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। সিরাজের পালিয়ে যাওয়ার খবর শহরবাসীদের গুজব মনে হলেও ওয়াটস এবং ওয়ালশের সসৈন্যে শহরে আসা দেখে শহরবাসীদের বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে ক্ষমতা সিরাজের হাত থেকে ব্রিটিশদের হাতে চলে গেছে। কিন্তু ব্রিটিশরা তখনও খাতায় কলমে রাজত্বের অধিকার পাওয়া থেকে অনেক দূরে।

চক্রান্তকারীদের পরবর্তী পদক্ষেপ হলো যে শূন্যস্থান সিরাজ নিজে তৈরি করে গেছে তা অবিলম্বে পূরণ করা। মিরজাফরকে বসানো হবে বাংলা, বিহার , উড়িষ্যার মসনদে। মিরজাফর অনতিবিলম্বেই নিজেই নিজেকে নবাব বলে ঘোষণা করে জামাতা মিরকাশিম এবং রাজমহলের ফৌজদার ভাই মিরদাউদকে সিরাজের সন্ধানে পাঠিয়ে দিল। মিরজাফর জানতো যে ক্ষমতাহীন সিরাজকে বন্দি করা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। ২৫শে জুন বিকালে ধরা পড়ল মোহনলাল এবং তার সঙ্গে পলায়নরত সিরাজের কয়েকজন আত্মীয়। মিরজাফর ক্লাইভকে জানাল যে মোহনলাল এবং তার পুত্রকে বন্দি করা হয়েছে। সিরাজের খোঁজ চলছে এবং আশা করা যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সিরাজকে বন্দি করা যাবে।

সিরাজের নৌকা তিনদিনব্যাপী অবিশ্রাম যাত্রার পর রাজমহলের কাছেই একটি ঘাটে নোঙ্গর করলো। ক্লান্ত এবং অভুক্ত মাঝিমাল্লারা এবং সিরাজের সঙ্গীরা অর্থাৎ স্ত্রী, কন্যা এবং অন্যান্য পরচারিকারা গ্রামের এক পরিত্যক্ত বাগানে আশ্রয় নিল। দানা শাহ নামে এক ফকির ঐ গ্রামে অভুক্ত পথযাত্রীদের এবং নৌকাযাত্রীদের বিশ্রাম এবং খাবারের ব্যবস্থা করত। আর সকলের মত দানা শাহ সিরাজ এবং তার সহযাত্রীদের জন্য খিচুড়ি এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে গিয়ে লক্ষ্য করলো যে এদের পরণের বসন মলিন হলেও পায়ের জুতো রাজকীয়। দানা শাহের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো। মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলো এরা কারা। প্রায় একবছরেরও কিছু সময় আগে নিজের ভাই সওকত জঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কোনও এক অজ্ঞাতকারণে এই ফকিরের কান এবং নাক কেটে নেওয়ার আদেশ দিয়েছিল সিরাজ। এমন ঈশ্বরপ্রেরিত সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না দানা শাহ। ফকির নবাব সিরাজকে সাদর আমন্ত্রন জানিয়ে পরম যত্নে সুস্বাদু খিচুড়ি পরিবেশন করার আগেই সিরাজের এখানে আসার খবর গোপনে পাঠিয়ে দিল মিরদাউদের কাছে। মিরদাউদের বাহিনী তখন রাজমহলের আশেপাশেই ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিরদাউদের বাহিনী এসে সিরাজ ও তার সঙ্গীদের বন্দি করে রাজমহলে নিয়ে এল। সেখান থেকে মিরকাশিম সিরাজকে নিয়ে এল মুর্শিদাবাদে।সিরাজের কাতর প্রার্থনায় কেউ কর্ণপাত করলো না। পথের মধ্যে মিরকাশিম লুতফুন্নাসার উপর কখনও ভালো কথায়, কখনও ভয় দেখিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলো। জানতে চাইলো কোথায় লুকোনো আছে সেই মহামূল্যবান রত্নভান্ডার যে রত্নভান্ডার সিরাজ প্রাসাদ ছাড়ার সময় সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল। ওদিকে মিরদাউদ সিরাজের পরিচারিকাদের উপর অত্যাচার শুরু করলো রত্নভান্ডারের খোঁজ পাওয়ার জন্য। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুট হয়ে গেল সিরাজের রত্নভান্ডার যার বেশিরভাগটাই গেল মিরকাশিম আর মিরদাউদের দখলে। ২৬শে জুলাই লন্ডনে কোর্টকে ক্লাইভের লেখা চিঠি অনুযায়ী আর কয়েকঘন্টা দেরি হলে সিরাজকে বন্দি করা সহজ হতো না। সিরাজ বন্দি হবার প্রায় তিনঘন্টা পরে ল এবং তার দলবল রাজমহলে পৌঁছোয়। সেখানে সিরাজের বন্দি হওয়ার খবর শুনে দ্রুত পাটনার দিকে রওনা দেয়। ল পরবর্তী কালে জানতে পারে যে পলাশির যুদ্ধের আগে থেকেই রাজমহলের ফৌজদার মিরদাউদ সিরাজের পত্রবাহকদের আটক করতে শুরু করে। মুর্শিদাবাদ ফিরে আসার অনুরোধ করে ১৩ই জুন ল’কে লেখা চিঠি পৌঁছোয় ২২শে জুন অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধের ঠিক আগের দিন।সিরাজকে লেখা ল’ এর চিঠি সিরাজের কাছে পৌছোয়নি।

সিরাজকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয় ২রা জুলাই।সিরাজকে বন্দি করা হবে না নির্বাসনে পাঠানো হবে না হত্যা করা হবে সে বিষয়ে একঘন্টাব্যাপী আলোচনায় কিছু স্থির করা গেল না। এর আগের দিন অর্থাৎ ১লা জুলাই জগৎশেঠের সহায়তায় রাজকোষাগার অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল ক্লাইভের লোকজনেরা। ৪ঠা জুলাই পাঠানো হলো প্রথম দফার অর্থভান্ডার যার পরিমাণ ছিল ৭৫লক্ষ টাকা। এই টাকার ভাগ কে কত পাবে তা নির্ধারিত ছিল আগে থেকেই। জলবাহিনী, স্থলবাহিনীর সৈনিক এবং সেনাপতিরা , কয়েকজন ইউরোপিয়ান অফিসার এবং কয়েকজন ভারতীয়ের মধ্যে এই অর্থ ভাগ করে দেওয়া হবে। ১০০টি নৌকায় ৭০০টি ট্রাঙ্কে সেই মুদ্রা বোঝাই করে স্ক্র্যাফটনের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী রওনা হয়ে গেল কলকাতার দিকে। হুগলি নদীতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আরও দু’শো নৌকা এই শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। তিনশ নৌকার এই বিশাল শোভাযাত্রা বাজনা বাজিয়ে, ঢাক পিটিয়ে,পতাকা উড়িয়ে ফরাসি এবং পর্তুগিজদের নাকের ডগা দিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল।

সিরাজকে যেদিন মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হলো সেদিন ফোর্ট উইলিয়মে পাঠানো এক চিঠিতে ক্লাইভ লিখলো যে সেই সন্ধ্যায় তার উপস্থিতিতে মিরজাফরের সামনে সিরাজকে হাজির করা হবে এবং সে আশা করে যে মানবিক, উদার এবং শিষ্টাচারী নবাব মিরজাফর সিরাজকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করবে। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা সিরাজকে দেওয়া হবে। কিন্তু পরেরদিন অর্থাৎ ২রা জুলাই আর একটি চিঠিতে যেটি সম্ভবত আগেরদিন রাত্রে লেখা হয়েছিল ক্লাইভ জানালো যে ২রা জুলাই সিরাজকে বন্দি অবস্থায় দেখে সিরাজের অনুগত কয়েকজন জমিদার এবং কিছু সৈনিক গন্ডগোল শুরু করলে সিরাজকে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরে ৪ঠা জুলাই ফোর্ট উইলিয়মে তার সহকর্মীদের লেখা চিঠিতে ক্লাইভ জানালো যে সিরাজ আর নেই। যদিও নবাব মিরজাফর তাকে কারাগারে পাঠাতে চেয়েছিলেন তার ছেলে মির মিরান এবং আরও কিছু সভাসদ নবাবকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে সিরাজকে জীবিত রাখলে তাকে মুক্ত করার জন্য সেনা অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। সেইজন্য সিরাজকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকারী করে ৪ঠা জুলাই সর্বসমক্ষে খোসবাগে আলিবর্দি খানের সমাধির পাশে তার মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছে।

২রা জুলাই বন্দি সিরাজকে নিয়ে আসা হয় তারই নিজের প্রাসাদে যেখানে তারই সিংহাসনে বসে ছিল নতুন নবাব মিরজাফর। আলিবর্দির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য মিরজাফর চেয়েছিল সিরাজকে জীবিত রাখা হোক। বাকি জীবন কারাগারের অভ্যন্তরেই কাটাতে হবে তাকে। দরবারে উপস্থিত অনেকে চাইলো সিরাজকে নির্বাসনে পাঠাতে। ভীত সন্ত্রস্ত সিরাজ বারবার করজোড়ে তাকে জীবিত রাখার জন্য অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। কিন্তু মিরজাফরের ছেলে মির মিরান এবং কয়েকজন সভাসদ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সিরাজকে হত্যার পক্ষে সওয়াল শুরু করলো। বললো সিরাজকে এই মুহূর্তে হত্যা না করলে সেনা অভ্যুত্থানের সমূহ সম্ভাবনা । সতের বছর বয়সের মির মিরান নিষ্ঠুরতায় সিরাজকেও অতিক্রম করে গিয়েছিল। তার পোষাক-আশাক, শরীরের ভাষা, কথাবার্তায় তার নিষ্ঠুরতা ফুটে বেরতো প্রতি মুহূর্তে। মানুষ হত্যার নেশা ছিল মির মিরানের। সিরাজের অনেক অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও মিরজাফর তার ছেলের প্রস্তাবের বিরোধিতা করলো না, চুপ করে রইলো।

মিরজাফর এবং অন্যান্য সভাসদেরা দরবার ছেড়ে চলে যাবার পর সিরাজকে হীরাঝিলের এক নির্জন কক্ষে (মতান্তরে জাফরগঞ্জে মিরজাফরের প্রাসাদে ) নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে সিরাজ আর্তনাদ করে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে সিরাজ নিজের হাত-পা ধুয়ে শেষবারের মত প্রার্থনা করার অনুরোধ জানায়। নিষ্ঠুর মির মিরান সিরাজের শেষ নামাজের এমনকি শেষ তৃষ্ণা নিবারণের জন্য একটু জলের জন্য কাতর প্রার্থনায় কর্ণপাত না করে মামুদ বেগ নামে তার এক বিশ্বস্ত অনুচরকে সিরাজকে অবিলম্বে হত্যা করার আদেশ দেয়। তারই প্রাসাদের অন্নভুক, একদা আলবর্দি খানের এবং সিরাজের বাবার স্নেহভাজন পারিবারিক পরিচারক মামুদ বেগের হাতে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নিহত হতে হলো হতভাগ্য নবাব সিরাজদৌল্লাকে।
0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in







কাঁধে রাইফেল – বর্ডারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যাচ্ছে লোকটা। বেনজির খান – ব্যাটেলিয়ান নম্বর ১১, তার ডিউটির জায়গাটা দুই দেশের কাঁটা-তার ঘেরা সীমান্তে। ওর দলের আর পাঁচ জন সীমান্ত রক্ষীর মধ্যে ও ছিল সব থেকে পেছনে, বাকী চার জন অনেকটা এগিয়ে গেছে।
তার-জালের ফাঁক দিয়ে বেনজির দেখছে ওপারের পরিচিত দৃশ্য - একটা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ, একটু দূরেই গ্রামের মানুষজন, কচিৎ কখনো ওপারের সীমান্তরক্ষীদের আনাগোনা।
টহল দিতে দিতে হঠাৎই বেনজির খানের নজরে এলো। তাদের এলাকাতে একটা বাচ্চা মেয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সীমান্তের এপারটা তো জনমানব শূণ্য এলাকা। নিশ্চয়ই বাচ্চাটা সীমান্তের ওপারের জনবসতি থেকে এপারে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ঢুকলোটা কিভাবে?
এদেশের সীমান্তের লোকজন কচিৎ কখনো চোরা পথে এপার ওপার করে। কখনো সস্তা খাবারের লোভে, কখনো বেআইনী কোনো চোরাচালানের উদ্দেশ্যে। কখনো বা সীমান্তের ওপারে নিজের আত্মীয় পরিজনদের সাথে মিলতে যাবার জন্যে। কিন্তু এইটুকু বাচ্চা মেয়ে! এ দেশে কি উদ্দেশ্যে ঢুকলো, আর কি ভাবেই বা ঢুকলো?
কাঁটা তারের বেড়া। বেনজির খান ভেবে কুল কিনারা করতে পারছে না! তারের বেড়া আর জমির মাটির মধ্যে সামান্য ফাঁক-ফোকর আছে। শেষে আন্দাজ করলো, হয়তো বাচ্চাটা মাটিতে শুয়ে শুয়ে নিজের ছয়ইঞ্চি পুরু শরীরটাকে বেড়ার নীচ থেকে গলিয়ে দিয়ে ওপার থেকে এপারে চলে এসেছে! কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটা কি?
বেনজির খান মেয়েটার কাছেই থেমে গেলো। কাঁধের বন্দুকটা এক হাতে মাটির উপর দাঁড়া করানো। অন্য হাতের ইশারাতে বাচ্চা মেয়েটাকে ডাকলো – হেই লড়কী উধার সে ইধার কিউ আয়া?
বাচ্চা মেয়েটা জবাব দিলো – পাপাকো ঢুন্ডনে কে লিয়ে। তুম মেরা পাপাকো দেখা?
তাহলে মেয়েটা ওর বাবাকে খুঁজতে ওপার থেকে এপারে এসে পড়েছে। ও তো আর সীমান্তের নিয়ম কানুন জানে না!
‘তুমহারা ঘর কিধার?’
বাচ্চাটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ওপারের সীমান্ত।
‘তুমহারা নাম কেয়া?’
‘মিমি।’
চার বছরের বাচ্চা মেয়েটার মুখ দেখে বেনজির খানের মনে পড়ে গেলো, বাড়িতে তো ওর এমনই একটা বাচ্চা মেয়ে আছে! কতদিন সে সালমাকে দেখে নি! সালমার বয়েস তো এই মিমির মতোই হবে।
বেনজির খান মনে মনে ঠিক করে নিলো। ওর করণীয় কর্তব্যটা কি। এই বাচ্চা মেয়েটা, কি যেন নাম, - মিমি - ওকে যে করেই হোক কাঁটাতারের ওপারে পৌঁছে দিতে হবে। যাতে করে ও নিরাপদে নিজের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে যায়।
ততক্ষনে বাচ্চাটাকে খুঁজতে খুঁজতে ওপারের গ্রামগুলো থেকে ওর মা তারজালের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তের ওপারে দেখা যাচ্ছে সালোয়ার কামিজ পরা এক মহিলা। ওপারে দাঁড়িয়ে মেয়েলোকটি ‘মিমি – মিমি’ বলে কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে। বারবার বলছে – ‘মিমি এদিকে চলে আয়। ওরে, ওরা তোকেও বন্দুকের গুলিতে শুইয়ে দেবে।’
পুরো সীমান্তটাই লম্বা লম্বা খাম্বা আর তারের জালে ঘেরা। মিমি শুনতে পাচ্ছে মায়ের কান্না। কিন্তু চার বছরের মেয়েটা বুঝতে পারছে না, এপার থেকে ওপারে কি করে নিজের মায়ের কাছে আবার ফিরে যাবে!
বেনজির খান একটা সহজ উপায় বের করলো। কাছেই একটা জায়গায় বর্ডারের ফেন্সিং মেরামতের জন্যে একটা মই আর রশি রাখা ছিলো। মইটাকে তারকাঁটা বসানো একটা খাম্বার উপর হেলান দিয়ে দাঁড় করালো।
মিমিকে বল্লো, ‘গুড়িয়া, ডরো মাত। হাম তুমকো মদত করেগা।’
বেনজির বাচ্চাটার পেট বরাবর একটা রশি বেঁধে দিলো। তারপরে সে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। ভয়ে তো মেয়েটা কাঁদছে!
তারপর সীমান্তরক্ষী লোকটা তরতর করে মই বেয়ে উপরে উঠে গেলো। নিজের উর্দি কাঁটায় লেগে হাতের কাছটাতে ছিঁড়ে গেলো। কোন মতে ধীরে ধীরে দড়িটাকে ঝুলিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে নামিয়ে দিলো। সালোয়ার কামিজ পরা মহিলাটি, মিমির মা, দড়ির বাঁধন খুলে মেয়েটাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। নিজের হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফেরত পাবার এ এক অপূর্ব দৃশ্য!
ইতিমধ্যে সীমান্তের ওপারে তখন আরো কিছু পুরুষ মহিলা জড়ো হয়ে গেছে। ভিন দেশী মহিলাটি নিজের মেয়েটাকে কোলে চেপে ধরেছে। চোখ দিয়ে তার গড়িয়ে পড়ছে জল। ভিন দেশী মা ওপারের সীমান্ত রক্ষীটাকে স্যালুটের ভঙ্গীতে অভিবাদন করলো– ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইয়োর কাইন্ডনেস’।
বেনজির খান দেখছে, মিমির মার চারপাশে তখন আরো লোক জমে গেছে। তারাও সমস্বরে সীমান্ত রক্ষীটিকে অভিবাদন জানালো – ‘থ্যাঙ্ক ইউ - থ্যাঙ্ক ইউ’।
ভীড়ের মধ্য দিয়ে একজন মাতব্বর মার্কা পুরুষ লোক এগিয়ে এসে কাঁটা তারে গাল ঠেকিয়ে বেনজির খানকে উদ্দেশ্য করে বললো – ‘খুব ভালো করেছেন! বাপ হারা মেয়ে। ওর বাবা সীমান্তরক্ষীর গুলিতেই মারা গেছে। গত মাসের তেরো তারিখে।’
‘কবে, কোন ডেট বললেন? তেরোই আগষ্ট?’ - বেনজির খান জিজ্ঞেস করলো!
ওই মাতব্বর মার্কা লোকটার সাইডব্যাগে ব্যাগে ভাজ করা একটা পুরোনো খবরের কাগজ, তাতে হিন্দীতে লেখা। সে কাগজটা তাকে দেখিয়ে গড় গড় করে পড়তে লাগলো – ১৩ আগষ্ট - বিনা প্ররোচনায় সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে অনেকজন লোক হতাহত।
এইটুকু পড়ে লোকটা একটু থামলো। তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে চোখ বোলালো কাগজের পরবর্তী লাইনগুলোতে। ধীরে ধীরে সীমান্তরক্ষীটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে যেতে লাগলো খবরের লাইনগুলো - ...... ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ারের কাছে পাওয়া গেছে জার্নেল সিং এর লাশ। ... সমঝে ভাইয়া! মিমির মাকে দেখিয়ে লোকটা বললো – ইনি জার্নেল সিং এর ওয়াইফ আর সীমান্তের ওপারে আপনাদের দেশে নিজের বাপকে খুঁজতে গেছিল যে ছোট্ট বাচ্চাটা সে জার্নেল সিং এর মেয়ে – মিমি! মিলিটারি দাদা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ – আপনি বাবা মরা মেয়েটাকে সময়মতো তার মায়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক আশীর্বাদ করবে।
বেনজির খানের হাতের জামা কাঁটাতারে ছিড়ে কনুইএর পেছন দিয়ে যে রক্ত বেরোচ্ছে তা সে তখন টের পেলো না! তার মাথায় ঘুর পাক খেতে লাগলো – দুটো কথা – তেরোই আগষ্ট আর ২৩-নম্বর ওয়াচ টাওয়ার! হ্যাঁ, তার স্পষ্ট মনে আছে তেরোই আগষ্ট তাদের তরফ থেকে একটা এনকাউন্টার করা হয়েছিলো! উপর থেকে আদেশ ছিলো। সন্ধ্যা ৭-৫৫ মিনিটে সীমান্তের ওপার লক্ষ্য করে আচমকা গুলি চালাতে হবে! সেদিনের কথা ভাবলে তার কষ্ট হয়। কেন এমন আদেশ? একেই কি বলে মিলিটারি স্ট্রাটেজি! তার মনে আছে, পরবর্তী সময়তে দুটো পাশাপাশি দেশের সামরিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া, সে সব অনেক কথা!
এখন তার চোখের সামনে ভাসছে সীমান্তের ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ার! আর বাচ্চা মেয়েটার মুখ, তার কথাগুলো - তুম মেরা পাপাকো দেখা?
বন্দুকটা কাঁধে করে বেনজির খান উলটো দিকে হাঁটা লাগালো। প্রায় আধা কিলোমিটার পেছনে এগোতেই ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ার!
সেখানে নিজের দেশের জন মানব শূন্য কাঁটাতারের বেড়ার উপর কাঁধের বন্দুকটাকে হেলান দিয়ে দাঁড়া করিয়ে দিলো। বেনজির খান নিজে মাটির উপরে বসে পড়লো। মাটির দিকে ঝুঁকে আছে তার হেলমেট পরা মাথা। কর্কশ একটা হাতের-পাতা ঘর্মাক্ত কপালের উপর ছোঁয়ানো।
কত দিন সে তার নিজের মেয়ে সালমাকে দেখে নি। কত দিন সে সালমার মা’কে আদর করে নি! কতদিন সে ছুটিতে বাড়ি যায় নি! বেনজির ভাবলো, ওপারের সীমান্তক্ষীর গুলিতে সে যদি নিহত হয়, তাহলে সালমাও কি তার বাপকে খুঁজতে সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে ও দেশে পৌঁছে যাবে?
মনে পড়লো তাদের কমান্ডান্টের সেদিনকার স্পেশাল অর্ডারের কথা। সেদিনটা ছিল ১৩ই আগষ্ট। সেদিন এখানেই তার ডিউটি ছিল। এই ২৩ নম্বর ওয়াচ টাওয়ারএর কাছে কাঁটা-তারের ফাঁফ দিয়ে সে তার রাইফেলে যে তিন রাউন্ড বন্দুক চালিয়েছিলো তাতে একটি মাত্র লোকই মারা গেছিল! বেনজিরের কানে এসেছিল একটা অজানা পুরুষ লোকের মৃত্যুকালীন আওয়াজ! – সেই লোকটিই কি তাহলে মিমির বাবা!
বেনজির খানের মনে হলো এক হাজার মিমির কন্ঠস্বর আকাশ থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাটির দিকে নেমে আসছে। সেই সম্মিলিত আওয়াজে কাঁদতে কাঁদতে কারা যেন বলছে – ‘সালমা সাবধান! সীমান্ত রক্ষীর গুলি যে কোনো মুহূর্তেই ছুটে এসে ফেলে দেবে তোর আব্বার লাশ। সালমা! তুই তোর বাবাকে বল – বন্দুক জমা দিয়ে এক্ষুনি সে যেন তার ঘরে ফিরে আসে! সালমা সাবধান! সালমা সাবধান!’ আকাশ থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর সত্যিই কি মিমির, নাকি মিমির মতো আরো অন্য কারোর? ওই হাজার হাজার কন্ঠস্বরের মধ্যে কি তার মেয়ে সালমার কন্ঠস্বরও মিশে নেই?
0

গল্প - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in







প্রায়ান্ধকার একটা ঘর। এক কোণে একটা প্রদীপ জ্ৱলছে। মেঝেয় খড়ি দিয়ে অর্দ্ধচন্দ্রাকারে কতকগুলো বৃত্ত আঁকা। সে‌ই অর্দ্ধচন্দ্রের কেন্দ্রস্থলে আরেকটি বৃত্ত। আকারে একটু বড়। একটা ভারী কাঁসার বাটি তাতে বসানো। বাটির ওপর তর্জ্জনী আলতো করে ছোঁয়ানো। যার তর্জ্জনী, তিনি মহিলা; পরনে লালপেড়ে সাদা শাড়ি। চুল খোলা। মাথা ঈষৎ ঝোঁকানো। মহিলা কি যেন একটা বিড়বিড় করছেন। একটু খেয়াল করলে শোনা যাবে যে তিনি বলছেন—

“বাবা, তুমি কি এসেছ?”

একটানা কথাগুলো বলে চলেছেন নীচুস্বরে, প্রায় স্বগতোক্তির মত। ঘোরের মধ্যে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নে‌ই। থাকার মধ্যে আছে শুধু এ‌ই একটাই প্রার্থনা, যা প্রায় আকুতির মত শোনাচ্ছে।

“বাবা, তুমি কি এসেছ? এসেছ তুমি? এস।”

হঠাৎ কাঁসার বাটিটা নড়ে উঠলো!

“প্রশ্ন কর।” প্রায় আদেশের সুরে বললেন মহিলা।

যার উদ্দেশে বললেন সে ঘড়ের বাইরে দুয়ারে দাঁড়িয়ে। যুবক। বয়েস আন্দাজ তে‌ইশ-চব্বিশ। দুয়ারে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। তার হলদেটে আলো গিয়ে পড়ছে বাড়ির উঠোনে, যেখানে জনা কুড়ি নারী ও পুরুষ বসে রয়েছে চাটাইয়ের উপর। চুপচাপ। নিজেদের মধ্যে কেউ কোন কথাও বলছে না। সবাই অপেক্ষায়। যুবক এক মাঝবয়েসী মহিলাকে হাতের ইশারায় ডাকলো। মহিলা শশব্যস্ত হয়ে উঠে এল দুয়ারে; দরজার গোড়ায় গিয়ে বসল।

ভক্তিভরে প্রণাম করল। তারপর বলল—

“মা, ছেলেটার চাকরী হচ্ছে না কিছুতে‌ই। অনেক চেষ্টা-চরিত্তির করছে। কিন্তু লাগছে না। বাড়িতে এতগুলো পেট। তার উপর বৌমা পোয়াতি। একটা কিছু কি হবে না, মা?”

ঘড়ের ভেতর লাল পাড় শাড়ি পরা মহিলা মৃদু কণ্ঠে বললেন—

“বাবা, এর ছেলের চাকরি কি হবে?”

প্রশ্ন শোনামাত্র বাটি চলতে শুরু করল! কোথা থেকে কোন এক অদৃশ্য প্রাণশক্তি যেন সঞ্চারিত হয়েছে একটা সামান্য কাঁসার বাটিতে। হাত থেকে প্রায় বেড়িয়ে যেতে চাইছে। বাটি সোজা গিয়ে থামলো পরিধির কাছে থাকা অনেকগুলি বৃত্তের মধ্যে একেবারে ধারের বৃত্তটিতে। সেখানে লেখা — “হ্যাঁ”। তার পাশের বৃত্তে লেখা ছিল “না”; বাটি সেখানে যায় নি। “হ্যাঁ” লেখা বৃত্ত থেকে বাটি এবার ফিরে এল তার আগের জায়গায়। ফেরার সময় তাড়া নে‌ই। ধীরে-সুস্থে ফিরে এল।

মহিলা এরপর খড়ি দিয়ে চট্‌ করে “না” লেখা বৃত্তের পরের বৃত্তটিতে লিখলেন “এ বছর”, তার পাশের বৃত্তে “সামনের বছর”, আর পরেরটায় “তারও পরে”।

এরপর প্রশ্ন করলেন—“কবে হবে?”

বাটি প্রায় ছিট্‌কে বেড়িয়ে যেতে চাইছে। মহিলার আঙ্গুল গতির সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। হাত 
প্রসারিত করে বাটির সঙ্গে অনুগমন করছে। বাটি গিয়ে দাঁড়ালো “সামনের বছর” লেখা বৃত্তে। ফিরে এল আগের মত‌ই ধীরে-সুস্থে।

মহিলা উঁচু কন্ঠে বললেন—“চাকরী হবে, তবে আগামী বছর।”

“মা আরেকটা প্রশ্ন ছিল।”

“আর, নয়। পরের জনকে পাঠিয়ে দে।” শেষের আদেশ যুবকের উদ্দেশে।

এরপর একের পর এক মহিলা ও পুরুষ ক্রমান্বয়ে দাওয়ায় উঠে এসে প্রশ্ন রাখতে থাকলো—কারোর জিজ্ঞাসা মেয়ের বিয়ে, কারোর শরীর-গতিক, কারোর বা সন্তান হবে কি না ইত্যাদি-ইত্যাদি। যা-যা প্রশ্ন, আবহমান কাল ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এ‌ই পৃথিবীতে তাড়িত করে এসেছে, তা‌ই উঠে আসতে লাগলো। জীবনের দাবী- দাওয়া অনেক।

যাবার আগে যুবকের হাতে যার যা সাধ্যমত দিয়ে গেল। কোন বাঁধাধরা হিসেব নে‌ই। সবা‌ই প্রায় গ্রামের গরীব-গুর্বো দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। বেশীর ভাগ‌ই দশ-বিশ টাকা দেয়। শহর থেকে বড়লোকেরা এলে তারা দেয়-থোয় ভালো। কিন্তু নিজে থেকে চাওয়ায় বারণ আছে।

শেষের জন চলে গেলে, যুবকটি ইতস্তত করে দরজায় দাঁড়ালো। বলল—“মা, আমার বিষয়টা যদি আরেকবার জিজ্ঞেস কর—”

“এক প্রশ্ন বারবার করিস কেন? আগের সপ্তাহে‌ই তো বললাম।”

“তাও আরেকবার যদি—”

“একটু পরে মহিলা বললেন—“আগে যা বলেছিলেন, তাই বলছেন। হবে, কিন্তু দেরী হবে।”

“যদি—”

“আহ! বিরক্ত করিস না। বাবা আর থাকতে চাইছেন না।” এ‌রপর, মহিলা বিড়বিড় করে বললেন—“বাবা, তুমি

এখন আসতে পার।” এ‌ই বলে মহিলা মেঝেতে মাথা ছুঁইয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে উঠে এলেন।

দরজার শেকল লাগিয়ে দিয়ে যুবককে রাগত স্বরে বলল—“তোকে বলেছি না, এক প্রশ্ন বারবার করবি না। বাবা পছন্দ করেন না। সময় বলেছেন তো। তার আগে তো হবে না। তাহলে? হয়, ধৈর্য্য ধর, না হলে অন্য মেয়ে দেখ।

দেশে কি আর মেয়ে নে‌ই? বাবা তো বলে‌ইছে এ‌ই মেয়ে তোর জন্য ভালো হবে না। সুখী হবি না তু‌ই এ‌ই বিয়েতে।

তাও জেদ ধরে বসে আছিস। প্রতি সপ্তাহে এক‌ই প্রশ্ন করছিস!”

পরের সপ্তাহে, অর্থাৎ শনিবার সন্ধ্যেবেলা যথারীতি লোকসমাগম হয়েছে উঠোনে। মহিলা ভেতরে। কখন ডাক আসে সে‌ই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে উপস্থিত জনতা। একটু অস্থির হয়ে উঠেছে। যুবকটি সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। গুঞ্জন ক্রমশঃ বাড়ছে। ঘড়িতে সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ডাক আসছে না। সন্ধ্যে গড়িয়ে এখন রাত। যুবক অপ্রস্তুত; এমন তো কখনো হয় না। কিন্তু ভেতর থেকে ডাক না এলে যাওয়ার হুকুম নে‌ই।

অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও লোক আসে। এর বেশী রাত হয়ে গেলে, তারা ফেরার গাড়ি পাবে না। তাই, বাধ্য হয়ে‌ই যুবকটি দোরের কাছে গেল। উঁকি মেরে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। মহিলা থম্‌ মেরে বসে আছেন। হাতের ইশারা করে নীচু গলায় মহিলা বললেন—“ওদের আজ যেতে বল।”

যুবকটি একটু অবাক হল। কিন্তু পরক্ষণে‌ই সামলে নিয়ে উঠোনে গিয়ে বিনীতভাবে বলল—“আজ একটু অসুবিধে হচ্ছে। মায়ের শরীরটাতো ভালো নে‌ই। আপনারা সামনের সপ্তাহে আসুন।” লোকজনও বেশ অবাক‌ই হল। এমনতো তারাও কখনো দেখেনি। নিজেদের মধ্যে এ‌ই অভূতপূর্ব্ব বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে করতে চলে গেল।

গাঁয়ে-ঘরের জীবন নিস্তরঙ্গ। তার‌ই মধ্যে এ‌ই ছোট্ট ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তুললো। এতো আর এক-দুদিনের ব্যাপার নয়। বছরের পর বছর ধরে তারা দেখে আসছে। বিশুর ব‌উ, মানে ভট্‌চাজ বাড়ির বৌয়ের প্রতি শনিবার ভর হয়। সারা সপ্তাহ সে গ্রামের বাকি গৃহবধূদের মত‌ই। কিন্তু শনিবার দিনটা সে আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা।

শনিবার দিনে আর পাঁচটা মানুষ যা জানে, সে তাদের চেয়ে বেশী‌ই জানে; আর পাঁচজন যা দেখে, সে তাদের চেয়ে বেশী‌ই দেখে; যা আর পাঁচজনে দেখে না, সে তাও দেখতে পায়। সেদিন সে সকলের মা। এ‌ই শনিবারে হল কি?

সূর্য্য কি পশ্চিমে উঠলো?

পরের শনিবার এলে দেখা গেল, এক‌ই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তার পরের শনিবার পেড়িয়ে গিয়ে তারও পরের শনিবার এসে গেল। কিন্তু বৌমার কাছে আর কোন জবাব মেলে না। হঠাৎ করে যেন প্রকৃতির হুঁশ ফিরে এসেছে; এমন একটা বেনিয়ম যেন তার অগোচরে‌ই ঘটে আসছিলো এতদিন। খেয়াল হওয়ায়, তড়ি-ঘড়ি সে‌ই রাস্তা—যে রাস্তায় মানুষের হাঁটা নিষেধ—সে‌‌ই রাস্তায় সে আগল তুলে দিয়েছে।

কিন্তু গ্রামের মানুষ পড়েছে ফাঁপরে। জীবনের জ্বালা তো কম নয়। যিনি জীবন দিয়েছেন, তিনি আহারের ব্যবস্থা করেন নি। দিবারাত্রি পেটের তাগিদে ছুটে চলা মানুষ—নিরন্তর জীবনের ঘাটে-আঘাটে লাথি খাওয়া মানুষ—খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে, হাত পাতে, জীবনের দেখা-শোনার চেনা সীমার বা‌ইরে দাঁড়িয়ে থাকা অচেনা আগন্তুকের কাছে। কিন্তু তিনিও আজ না করে দিলেন।

সমস্যায় পড়েছে বিশুর বৌও। সমস্যাটা যে ঠিক কি, সেটা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। তার সিদ্ধাই চলে গেছে সেটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু কেন গেল, সে‌ইটে সে ঠাওর করতে পারে না। কেমন যেন মনে হয় সে হেরে গেছে; কিন্তু কার কাছে, কে তার প্রতিপক্ষ সে‌ইটা সে বুঝে উঠতে পারে না। মনটা তাই খচ্‌খচ্‌ করে। কেন হল এমন?

এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। কতদিনের বাটি! তখন সবে হায়ার সেকন্ডারী দিয়েছে। টুটুলদি, জেঠুর মেয়ে, বেড়াতে এসেছিল ছুটিতে। ও‌ই দেখিয়েছিল প্রথম। ও কোথা থেকে শিখেছিল কে জানে! দু‌ বোন মিলে ভরসন্ধ্যেতে পরীক্ষা করে দেখেছিল লুকিয়ে। হায়ার সেকন্ডারী শেষ হয়েছে। তাই জানতে চেয়েছিল “পাশ করব না ফেল?” বাটি নিরুত্তর। বারবার জিগ্গেস করাতেও বাটি নড়েনি এতটুকু। “ফেলও করব না, পাশও করব না — ধুস্‌ তাই আবার হয় ন্যাকি? যত্তসব গ্যাঁজাখুড়ি জিনিষ।” বলে উঠেছিল ও। টুটুলদি বলল “দাঁড়া, দাঁড়া। ওকে জিগ্গেস কর কমপার্টমেন্টাল পাবি কিনা”। জিগ্গেস করতে‌ই বাটি সোজা ছুটে গিয়েছিল “হ্যাঁ” লেখা ঘরে! ভয়ে পেয়েছিল খুব।

মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল কমপার্টমেন্টাল পাবে শুনে; যদিও পুরোপুরি বিশ্বাস করে নি। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হল রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল ও কমপার্টমেন্টাল‌ই পেয়েছে; ফিজিক্সে ব্যাক এসছে। সে‌ই শুরু। কে আসছে, কোন শক্তি কোনদিন তা নিয়ে খুব একটা ভাবে নি। ভবিষ্যৎ জানার আনন্দে মশ্‌গুল ছিল। আজ চলে যাবার পর সারাদিন বসে ভাবে কে আসত আর কেন‌ই বা সে আসা বন্ধ করে দিল। এতদিন পরে কি হল? কোথায় গরবর হয়ে গেল? তবে কি বারবার এক‌ই প্রশ্ন করায় বিরক্ত হয়ে চলে গেল?

মানুষটা যেন কেমনধারা হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। ছেলেটা প্রায়‌ই লক্ষ করে মা সন্ধ্যের দিকে কোণের ঘরে গিয়ে বাটিটার দিকে চেয়ে থাকে আনমনা হয়ে। কি যেন ভাবে বসে বসে!

মঙ্গলবার, বিশুর ছেলে গঞ্জে গেসলো বিকেল দিক করে। ফিরে আসতে আসতে ভর সন্ধ্যে। ফিরে এসে কলতলায় হাত পা ধুতে ধুতে চিৎকার করল “ক‌ই গো, চিঁড়ে-মুড়ি কিছু দাও”। রান্নাঘরের আলো নেভা। শোবার ঘরে শেকল তোলা। গেল কোথায় মা? দুবার ডাকলো। সাড়া নে‌ই। সন্ধ্যেবেলা কোথাও তো যায় না। চোখে পড়ল বাড়ির কোণের দিকের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, ঘর অন্ধকার। গেল ওদিকে। অন্ধকার হাঁতরে আলো জ্বালতে‌ই চমকে উঠলো! মেঝেতে পড়ে আছে মা। মুখ দিয়ে ফেনা কাটছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলো। শরীরে সাড় নে‌ই। দৌড়ে কলতলা থেকে ঠান্ডা জল এনে ছিটিয়ে দিতে লাগলো মুখে চোখে। মহিলা গোঁ-গোঁ শব্দ করে উঠলেন। 

কাঁসার ভারি বাটিটা মহিলার পাশে‌ই পড়ে ছিল।

সারা বাড়ির আলো জ্বেলে দিয়েছে বিশুর ছেলে। মা আর ছেলে দাওয়ায় বসে। মা এখন অনেকটা সুস্থ, তবে দুর্বল।

থম্‌ মেরে আছেন।

—কি হয়েছিল? তুমি আবার বাটিটার কাছে গিয়ে বসেছিলে!

উত্তর নে‌ই। গা ঠেলে আবার জিগ্গেস করল। এতক্ষণে যেন মহিলা শুনতে পেলেন। প্রায় অস্ফুটে বললেন—ফেলে দিয়ে আয়—নুড়ি পুকুরে আজ‌ই ফেলে দে বাটি—এ অন্য কেউ—একে আমি চিনি না। চোখে মুখে আতঙ্ক।

—সে না হয় দেব। কিন্তু কি হয়েছিল বল।

—আগে ফেলে আয়।

বাড়ির লাগোয়া পুকুর। ছেলে ছুটে গেল ঘরে। বাটিটা নিয়ে উঠোনের ধারে এসে টান মেরে ফেলে দিল পুকুরের দিকে।

রাতের অন্ধকারে আওয়াজ উঠলো ঝুপ্‌।

মহিলা এখন একটু স্বাভাবিক। যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। ছেলে পাশে এসে বসলো।

“সন্ধ্যেবেলায় ঘরটায় ধূপ দিতে গেছিলাম, যেমন যাই প্রতিদিন। হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে চমকে উঠলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। দেখি বাটিটা তির্‌তির্‌ করে কাঁপছে; তু‌ই বিশ্বাস কর। নিজের থেকে‌ই। যেন আমায় ডাকছে। ভয় পেয়ে গেলাম খুব। কিন্তু পরক্ষণে‌ই মনে হল তাহলে কি বাবা ফিরে এসেছেন? বাবাকে না ডাকলে তো বাবা আসেন না। তবে কি, এতদিন আসেন নি বলে আজ নিজের থেকে‌ই এলেন? এক-পা দু-পা করে এগিয়ে গেলাম। ভয় হচ্ছিল, আনন্দও হচ্ছিল। মনে মনে ভাবলাম, বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। না জেনে ভুল করে ফেলেছি। আর একবার মনে হল যাব না; মনে হল গেলে অমঙ্গল হবে। কিন্তু কেমন যেন ঘোর লেগে গেল।

এগিয়ে গেলাম। মাটিতে বসে বাটিটা স্পর্শ করার সাথে সাথে‌ই মনে হল আমার সারা শরীর থেকে সমস্ত শক্তি যেন শুষে নিচ্ছে ঐ বাটি! তারপর আমার আর জ্ঞান নে‌ই।
0

গল্প - ময়ূরী মিত্র

Posted in







বাজার বন্ধের আকাল তখনো আসেনি | অক্সিজেন নিয়ে খেলু খেলুতে অকালে মরেনি পরিপূর্ণ যুবকের দল | ভাবেইনি পৃথিবী ----সভ্যতার এই পূর্ণকুম্ভগুলো ঝাঁপ ফেলবে কিংবা কালো ঢাকনার আড়ালে চলে যাবে |

সেসব সকালে ভরা বাজার বসত | মন খুলে মানুষ আওয়াজ তুলত | কী খুশি লাগত গো | মনে হত দিন ফুটল পুষ্পগন্ধে | চারপয়সার জিনিষের জন্য কুড়ি টাকার হাঁটতাম | এই ছিল আমার দস্তুর | জিনিষ কেনা শেষ হল তো অজানা মানুষ দেখা শুরু করতাম | কতক অজানা আর কতককে নিয়মিত দেখে চেনা | দেখে এবং কখনো রব দিয়ে কখনো মনে মনেই ক্রেতা বিক্রেতার সাথে কথা বলে গল্প নাটক বানানো | মনে মনেই | যেদিনের কথা বলছি সেদিনের একটা বাজারনাট্য আজ আপনাদের জন্য ---


★ ফার্স্ট সিন :

সবজির দোকানে বৃদ্ধ , ছেলের বউ এবং আট দশ বছরের নাতনী | অতটুকু মেয়ের হাতে দুটো বিশাল ব্যাগ | কাত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কাঁদছে না | একটু বইছে তারপর আবার নামাচ্ছে | শ্বাস নিয়ে নিয়ে তুলছে আর নামাচ্ছে | তবু ব্যাগ ছাড়বে না | একা একা বইবেই | দাদু কত বলতে লাগলেন --দে ভাই ! একটা দে | দে ঠিক পারব |

যত দেখছিলাম অবাক হচ্ছিলাম | শুনলাম ছোট্ট নাতনীটি বলছে ----
----না না এই রোদে কষ্ট হবে তোমার | মাথা ঘুরবে বনবনিয়ে | কিছুতে দেব না |

এবার মার কুশ্রী চিৎকার ---ন্যাকামি করবি না | দে দাদুর হাতে |
--- না আ আ আ | চুল ঝাঁকাচ্ছে মেয়ে | এবার দুটো থলে একহাতে | অন্যহাতের আঙুলগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছে একটি বুড়ো হাতের ফাঁকে | ছোট্ট শরীরটার সমস্তটুকু দিয়ে দাদুকে পাকিয়ে ধরছে আরো | দাদুকে বইবে আরো যত্নে | হঠাৎ দেখলাম বৃদ্ধকে নিয়ে ছুটতে শুরু করেছে শিশু | পাছে মা ভারী ব্যাগদুটো তার দাদুর হাতে গুঁজে দেয় এগোচ্ছে দ্রুত পায়ে | আর আমার পা ? সেতো দাঁড়িয়ে গেছে বাজারধূলায় | মনে মনে কথা শুরু হল আমার | বললাম মাকে -- ওরে তোর এমন ফুল ! তাকে ফুটতে দে ভাই | বিরাট করে | স্নিগধ গন্ধে ভরুক ঘরদুয়ার |

ভরসা রাখ শিশুর ওপর | মতি ফিরবে তোর --- নদীর শুদ্ধ স্রোত হয়ে |


★ সেকেন্ড সিন :

ডিমের দোকান | হেব্বি ভিড় | না বলতেই সরে জায়গা করে দিলেন একজন | দেখলাম যিনি জায়গা দিলেন তাঁরও প্রচুর মাল | কেনা হয়ে গেছে | টাকা দিয়ে চলে যাবেন | ইতিমধ্যে " এটা দিন সেটা দিন " করে দোকানিকে পাগল করে দিচ্ছি আমরা | দোকানি এবং আমরা সবাই ভুলে গেছি ভদ্রলোকটিকে | প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ভিড় সরল |

ভদ্রলোক বসে পড়েছেন বেঞ্চে | ----কী আশ্চর্য ! রাগলেন না | হাসলেন | আলতো করে জাস্ট বললেন ----- দেখলেন তো সবার আগে জিনিষ কিনে টাকা দেবার জন্য এতক্ষণ বসে | কষ্ট হচ্ছিল ওঁর জন্য | কষ্ট হল বলে রাগ এল পিছু পিছু | বললাম -- টাকার হিসেব না বুঝে সবাইকে এত এগিয়ে দেয়ার কী দরকার ছিল আপনার ? বলতে বলতে আরো রেগে যাচ্ছিলাম | বোধহয় নিজের ওপর |

ফের এক পশলা হাসি |---" মাঝে মাঝে বাকিদের এগোবার জন্য নিজেকে পিছতে হয় দিদি | বাড়ি গেলে বড়জোর বউ একটা সলিড ঝাড় দেবে | এতটুকু তো ক্ষতি !" -- ---হাসতে হাসতেই চললেন বৌয়ের গাল খেতে ! আমি পেলাম আমার আদরণীয় |

সিন ড্রপ : সৌরভ | সৌরভ | আজ আমার আমোদ সলিড |

বন্ধ বাজার খুলুক |
আমার নাট্য চাই |
মানুষের |
বিবেচক তারা |
0

কবিতা - নীপা সেনগুপ্ত

Posted in






' মরুবিজয়ের কেতন উড়াও হে শূন্যে…'

হৃদয় যে সব রুক্ষ ধূ ধূ, মরুভূমি আজ।
সেই মরুতেই পুঁতবে চলো একটি চারাগাছ।
হৃদয় যে সব রুক্ষ ধূ ধূ, মরুভূমি আজ।

বাড়ুক যত্নে সেই চারাটি, ছড়াক ফুলের ঘ্রাণ
মনের আঁধি কাটবে যতই, ভরবে আলোয় প্রাণ।
বাড়ুক যত্নে সেই চারাটি ছড়াক ফুলের ঘ্রাণ।

আর কতদিন! মরেও এমন বেঁচে থাকার ভান!
'একটি গাছ ও একটি প্রাণ'-র মিথ্যেই স্লোগান।
আর কতদিন! মরেও এমন বেঁচে থাকার ভান!

ফিরুক সুরে বিশ্বজুড়ে বেসুর যত প্রাণ,
ধূসর মনকে সবুজ করো, তবেই পরিত্রাণ।
ফেরাও সুরে বিশ্বজুড়ে বেসুর যত প্রাণ।

মনুষ্যত্বে সজীব, স্নিগ্ধ জীবনের স্পন্দন,
তোলো জীবনের স্পন্দন।
তারই হাত ধরে উঠবেই গড়ে বিশ্ব বনবিতান।
0

কবিতা - শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in






এমন করে স্বপ্ন দেখাও
যেন সে সব সত্যি কথা
যেন সে সব ঘটেই গেছে
কিম্বা ঘটার ব্যকুলতা,
অথচ তা ঘটবে না যে
দুজনেই তা ভালই জানি
তবুও তো স্বপ্নে বিভোর
গভীর সাগর চোখ দুখানি ।

এমন করে কাছে ডাকো
বিভ্রম হয় সব ভুল-ঠিক
ভালবাস, যত্ন করো
কষ্টও দাও কি সাংঘাতিক,
অথচ যে সবই অলীক
দুজনেই তা ভালই জানি
একটু শুধু জীবন যাপন
স্বপ্ন দেখার সেই পারানি ।

এমন করে জড়িয়ে থাকো
ছাড়লে দুহাত গভীর পতন
গাছের বুকে জড়িয়ে থাকা
স্বর্ণলতা প্রাণের মতন,
অথচ কি আলগা বাঁধন
দুজনেই তা ভালই জানি
নশ্বর এই গল্প-গাথা
আবহমান এক কাহিনী ।
4

কবিতা - ঝানকু সেনগুপ্ত

Posted in







তারপর সেও একদিন
তোমার জন্য বৃষ্টিকে নিলাম আজলা ভরে
একমুঠো রোদ্দুর তাও নিলাম
মেঘের কাছে এক টুকরো রঙ

তুমি আমার ছেঁড়া বাড়ি
আর ভাঙ্গা জানালা দেখে মুখ ফেরালে
অথচ আমার কোনও ভনিতা ছিল না

সবুজ বনের কথা আর নাই বা বললাম!
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in



পুর ভরা কুমড়ো ফুলের বড়া

সেন্ট্রাল টেক্সাসে এসে দেখলাম, ফার্মার্স মার্কেট এখানে খুবই জনপ্রিয়। নিজেদের বাগানে ফলানো সব্জি নিয়ে বিক্রি করেন কিছু মানুষ। এর পাশাপাশি, নিজেদের হাতে তৈরী সাবান, কাঠের জিনিস, গয়না, খাবার, কুকুরদের খাবার, মাংস, ডিম, দুধ আরও কত কী। সে ভারি মজার বাজার। সেইখানে দেখি বাক্স করে কুমড়োফুল বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতা-ক্রেতা উভয়েই অভারতীয়। বুঝলাম, তার মানে, বাঙালীরাই শুধু নন, এঁরাও কুমড়োফুল খেতে ভালোই বাসেন। খুঁজতে শুরু করি, ওঁদের রেসিপি। দেখলাম, ওঁরাও বড়াই ভাজেন, তবে ফুলের ভেতর নানান কিছুর পুর দিয়ে তারপর একটা গোলায় ডুবিয়ে ভাজা। পুর হিসেবে কেউ মাংসের কিমা ব্যবহার করছেন তো কেউ চিজ বা হ্যাম। আইডিয়াটা দারুণ লাগায়, আমি বানালাম ছানার পুর ভরে।

ছানাকে ভালো করে জল ঝরিয়ে সামান্য নুন, মিষ্টি, গরম মশলার গুঁড়ো দিয়ে মেখে রাখতে হবে। এরপর কড়ায়ে তেল গরম করে শাদা জিরে, শুকনো লঙ্কা, মিহি করে কুচোনো পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে ভালো করে ভেজে তার মধ্যে ছানা দিয়ে ভাজতে হবে। বেশ শুকনো আঠালো মতো হয়ে এলে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে।

কুমড়ো ফুলের বৃত্যাংশ গুলি ফেলে, ফুলের ভেতর থেকে সাবধানে পুংকেশরটি বের করে ফেলতে হবে। ফুলটি ভালো করে ধুয়ে, নিম্নমুখী করে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। বেসন ও সামান্য চালের গুঁড়ো মিশিয়ে একটু গাঢ় মতো একটি গোলা বানাতে হবে।

ফুলের ভেতর পুর ভরে, বেসনের গোলায় ডুবিয়ে ডুবো তেলে ভেজে নিলেই রেডি, মুখরোচক পুর ভরা কুমড়োফুলের বড়া।



0

সম্পাদকীয়

Posted in



একজন কবি এক বিপ্লবীর হত্যার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলেন, 'চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়'। লিখেছিলেন, 'আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার'। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি সমর্থন কবিতাটির ছত্রে ছত্রে। রাষ্ট্রশক্তি, যা কখনও, কোনও কালে বিপ্লবের হাত ধরতে পারে না, দমন এবং নিপীড়নই কেবল করতে পারে, দ্বিধাহীনভাবে তার বিরোধিতা করেছিলেন সেই কবি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাতিয়ার কিন্তু তিনি তুলে নিতে পারেননি। দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে তাঁর ব্যর্থতা ঘোষণা করেছিলেন।

সময়টা ছিল ১৯৬৭-র পরবর্তী। বলিভিয়ার জঙ্গলে চে গেভারার শরীরকে রাষ্ট্রের বুলেট ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন লাইনগুলি।

প্রায় ষাট বছর পর দেখা গেল হাতিয়ার তুলে নিলেন সত্তরোর্ধ এক কবি। সম্প্রতি স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর শরীরে নির্ভুল নিশানায় নিজের লাইসেন্সড রিভলবার থেকে পাঁচ - পাঁচটি বুলেট পাঠিয়ে দিলেন ইউরায়ি জিন্টুয়া, যিনি কবি হিসাবে সেদেশে সুপরিচিত। অতীতে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার হয়েছেন তিনি। বাকি সব রাস্তা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে বলেই কি আগুনের জবাব আগুন দিয়েই দিতে চাইলেন জিন্টুয়া? তাঁর জীবনের যাবতীয় লিখিত শব্দ যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে পারেনি, ওই পাঁচটি বুলেট যে সেই কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারলো, এমন ভাবা হয়ত একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, কিন্তু এক কবি কোনও একদিন যা করতে চেয়েছিলেন, যা না করতে পারা জন্ম দিয়েছিল অবিস্মরণীয় কয়েকটি পংক্তির, সেই অসম্পূর্ণ কর্মটিই যেন নতুন এক মাত্রা পেল এই ঘটনায়।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















“ধর্মাবতার,

আপনি কি জানেন

আমাদের জনগণমনে

আপনার আসন রয়েছে পাতা ঈশ্বরের কাছাকাছি

হয়তো বা ঈশ্বরের দেড় ইঞ্চি নীচে।


অনেক বিলকিস আজও আপনার নামের মালা জপে

প্রতীক্ষায় আছে;

অনেক উঁচুতে আপনি

-- ঈশ্বরের কাছাকাছি,

ঈশ্বরের দেড় ইঞ্চি নীচে”।


কিসসা - ইলেক্টোরাল বণ্ড

[ইলেক্টোরাল বণ্ড নিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কোন রাজনৈতিক দল কত কোটি টাকার বণ্ড উপহার পেয়েছে এবং কোন কোন কোম্পানি নিজেদের লাভের চেয়েও বেশি টাকা বিশেষ রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়েছে –এসব এখন প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সবাই জানেন।

কিন্তু এর অনৈকতা বুঝতে হলে, অর্থাৎ কীভাবে একটি ঘুষ দেওয়ার প্রকল্পকে আইনের চোলা পরিয়ে দেওয়া হল—সেটা বুঝতে পড়ুন এই লেখাটি]

গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ পাঁচ বছর ধরে লটকে থাকা ‘ইলেক্টোরাল বণ্ড স্কীম ২০১৮’ এর সাংবিধানিক যুক্তিযুক্ততার প্রশ্নে করা রিট পিটিশনের রায় ঘোষণা করে । ওই রায়ে সর্বসম্মতিতে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭ এবং তার অন্তর্গত ওই নির্বাচনী বণ্ড যোজনাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয় যা তৎকাল প্রভাবশীল হয়।

ঐতিহাসিক রায়টিতে বলা হয় যে কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৮ সালের নামহীন ক্রেতার নির্বাচনী বণ্ড (Electoral Bond 2018) সংবিধানের আর্টিকল ১৯(১) --জানবার অধিকার-- এবং ১৯(১)(ক) -- মতপ্রকাশের অধিকার--এর পরিপন্থী।

অতএব, ওই আইন খারিজ করে স্টেট ব্যাংককে নতুন কোন বণ্ড জারি করতে নিষেধ করা হচ্ছে এবং তাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে অবিলম্বে আজ অব্দি জারি করা সমস্ত বন্ডের ক্রেতার নাম, কেনার তারিখ, কার জন্যে এবং কত টাকার—সব বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দিতে হবে যাতে ওরা আগামী ১৩ই মার্চের মধ্যে ওদের সাইটে সমস্ত তথ্য জনসাধারণের গোচরে পেশ করতে পারে। তাহলে সাধারণ ভোটার, সরকারের পলিসি এবং তার সঙ্গে কোন বিশেষ দানদাতা কর্পোরেট হাউসের স্বার্থ জড়িত আছে কিনা (quid pro quo), সেটা নিজেরা দেখে বিচার করে নির্ণয় নিতে পারবে।

এই রায় পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চের সর্বসম্মতিতে জারি করা হয়েছে। ফলে এর বিরুদ্ধে আপিল হতে পারবে না। বড়জোর সরকার বর্তমান রায়ের পুনর্বিচার (revision) চেয়ে আবেদন করতে পারে। সেটার শুনানি ওই একই পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে হবে।

উক্ত রিট পিটিশনের চার আবেদনকারীরা হলেন মানবাধিকার সংস্থা The Association of Democratic Reforms (ADR), কংগ্রেস নেত্রী জয়া ঠাকুর, Communist Party of India (Marxist) এবং আরেকটি মানবাধিকার সংস্থা Common Cause।

প্রথম ভাগ

বণ্ডের উদ্দেশ্য এবং বিধেয়ঃ

বিগত ২০১৭ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট অধিবেশনের সময় তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলি ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭ বিলের অন্তর্গত এই ‘অনামা দাতাদের ইলেক্টোরাল বণ্ড যোজনা’ লোকসভায় পেশ করেন।

তখন তিনি বলেছিলেন যে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ফান্ডে দানের ব্যাপারটা স্বচ্ছ না হলে নির্বাচন অসম প্রতিযোগিতা হয়ে যাচ্ছে। আর সবার জন্য সমান খেলার মাঠ ( level playing ground) আমাদের সংবিধানের মূল ভাবনার (basic feature) অনুরূপ। এটি প্রদান করা রাষ্ট্রের কাজ। অথচ বিগত ৭০ বছর ধরে এ’বাবদ কিছুই হয়নি। এবার এই বণ্ডের মাধ্যমে স্বচ্ছতা আসবে, দানদাতারা সুরক্ষিত থাকবে। তাদের অপছন্দের দল জিতে সরকার বানালে প্রতিহিংসা নেবে, ব্যবসায়ে বাধা দেবে –এই ভয় থাকবে না। তাদের পরিচয় গোপন থাকবে এবং তারা নির্ভয়ে নিজের নিজের পছন্দের দলকে চাঁদা দিতে পারবে।

এই বন্ড জারী করার সময় সরকার পক্ষের আরও বক্তব্য ছিল যে এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারে কালো টাকার প্রভাব বিদেয় করে সাদা টাকার ব্যবহার প্রচলনে আনা। বিশেষ করে নগদ টাকার ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে ব্যাংকের এবং ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয়কে স্বচ্ছ করা।

মনে রাখা দরকার, তার মাত্র কয়েক মাস আগে অক্টোবর ২০১৬এর এক রাত আটটায় দু’বছর আগে নির্বাচিত নতুন প্রধানমন্ত্রী ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটের বিমুদ্রীকরণের (demonitization) নাটকীয় ঘোষণা করেন।

এই নতুন বিত্তীয় ইন্সট্রুমেন্ট হবে ধারক বণ্ড (bearer bond)। এর বৈশিষ্ট্য হবে বিনা সুদের promissory note ধরণের। এগুলো হবে পাঁচ রকম মূল্যের গুণিতকে—একহাজার, দশ হাজার, এক লাখ , দশ লাখ এবং এক কোটির।

দানদাতা স্টেট ব্যাংকের যে কোন শাখা থেকে এই বণ্ড কিনে নিজের পছন্দের এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী তহবিলে সেটি দান করতে পারে।

এই বিল কী করে রাজ্যসভায় পাশ হল? ২০১৭ সালে বর্তমান শাসক দল বিজেপি রাজ্যসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না তো?

সত্যি কথা। তাই বিলটি রাজ্যসভায় পেশ করা হয় নি। লোকসভায় মানি বিলের মোড়কে পেশ করা হয়েছিল। ‘মানি বিল’এর জন্যে রাজ্যসভার অনুমোদন লাগে না। তবে একে মানি বিলের তকমা দেওয়া কতখানি আইনসম্মত সে’নিয়ে বিতর্ক আছে। এই নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে রিট ঝুলে আছে। কিন্তু ইলেক্টোরাল বণ্ড আইনটিই বাতিল হয়ে যাওয়ায় ওই প্রশ্ন এবং পিটিশন হয় তো তামাদি হয়ে গেছে।

কে কিনতে পারে?

দেশের যে কোন নাগরিক বা ভারতে গঠিত কোন কর্পোরেট সংস্থা এটি কিনতে পারে। এমন কি বিদেশের কোন কোম্পানির ভারতে রেজিস্টার্ড কোন সাবসিডিয়ারিও স্টেটব্যাংক থেকে এই বন্ড কিনতে পারবে। এর জন্য কোন আয়কর দিতে হবে না, উলটে ১০০% ছাড় পাবে। আয়কর অধিনিয়মের ধারা 80 GGC অনু্যায়ী রাজনৈতিক দল বা নির্বাচনী ট্রাস্টে চাঁদা দিলে পুরোটাই আয়কর ছাড় পাওয়ার যোগ্য।

তাকে শুধু স্টেট ব্যাংকের কোন শাখায় এই বন্ড কেনার জন্য একটি বিশেষ অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে এবং তার জন্য আবশ্যক শর্ত পূরণ (KYC norms) করতে হবে।

এক ব্যক্তি বা কোম্পানী অধিকতম কত টাকার বণ্ড কিনতে পারে?

--যে কোন পরিমাণ, কোন উর্ধসীমা নেই।

আগে কী ছিল?

---আগে ব্যবসায়ী সংস্থার জন্যে নিয়ম ছিল যে কেবল কোন মুনাফা অর্জনকারী সংস্থাই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী তহবিলে চাঁদা বা দান দিতে পারে। কিন্তু সেই টাকা কোনমতেই তার মুনাফার ৭.৫% এর বেশি হবে না। কিন্তু ২০১৮ সালের বণ্ডের সময় কোম্পানী অ্যাক্টে সংশোধন করে সেই লক্ষণরেখা মুছে দেওয়া হয়েছে।

ফলে যে কোন সংস্থা, এমনকি যার মুনাফা নেই বা লোকসানে চলছে, সে’ও অসীমিত পরিমাণ রাশির ইলেকশন বণ্ড গোপনে কিনতে পারে। আয়কর বিভাগ বা ইডি কোন প্রশ্ন করবে না।

এই চাঁদার রাশির বিস্তৃত বিবরণ কি কোম্পানীর ব্যালান্স শীটে দেখা যাবে?

--না, শুধু কোন বছরে মোট কত টাকা নির্বাচনী চাঁদা দেওয়া হয়েছে তা দেখাতে হবে; কতভাগে এবং কাকে কাকে কবে দেওয়া হয়েছে সেটা গোপন থাকবে।

এই বণ্ড ভাঙানোর সময়সীমা কতটুকু ?

--১৫ দিন। তারপর সেটি তামাদি হয়ে যাবে।

ওই সময়ের মধ্যে যদি কোন বণ্ড ভাঙানো না হয়, তখন সেই বণ্ডের টাকার কী গতি হবে?

--- সোজা পিএম কেয়ার ফান্ডে জমা হবে।

সত্যিই কি এই বণ্ডের ক্রেতা ও প্রাপকের নাম গোপন থাকে?

ওই বণ্ড কিনতে হলে স্টেট ব্যাংকের কোন শাখায় ‘ডেজিগ্নেটেড অ্যাকাউন্ট’ খুলতে হবে , অর্থাৎ যা শুধু ঐ বণ্ড কিনতেই ব্যবহৃত হবে এবং তার জন্যে KYC norm (Know Your Client) পূর্ণ করতে হবে। ফলে স্টেট ব্যাংকের কাছে ক্রেতার ঠিকুজি কুষ্ঠি পুরো থাকবে, এবং সেই তথ্য দরকারমত সরকারের কাছে পৌঁছে যেতে পারে।

কিন্তু নির্বাচন কমিশন জানতে পারবে না ওই বণ্ডের অন্তিম ‘লাভার্থী’ কোন রাজনৈতিক দল। কে কত টাকার বণ্ড কিনে কোন দলকে কত দিল সেই তথ্য “দাতাদের স্বার্থে” নির্বাচন কমিশনের কাছেও অজানা থাকবে।

আগে কী হত?

--- এর আগে সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই তাদের আয়কর রিটার্ন জমা করার সময় নির্বাচনী তহবিলে ২০,০০০/- টাকার চেয়ে বেশি চাঁদা দেওয়া লোকের নামধাম নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হত ।

কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ড কিনলে সেসব জানানোর প্রয়োজন নেই। বছরে মোট কত টাকা বণ্ডের মাধ্যমে পাওয়া গেছে সেটা জানালেই হল। বণ্ড ক্রেতার নাম কোনরকমেই ব্যাংক ও রাজনৈতিক দল ছাড়া কেউ জানবে না।

এইরকম “অনামাদাতা” ইলেক্টোরাল বণ্ডকে ২০১৮তে কার্যকরী করতে কোন কোন আইনে সংশোধন করতে হয়েছে?

উপরোক্ত উদ্দেশ্যে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭তে তিনটে গুরুত্বপূর্ণ আইনে সংশোধন করা হয়। যথা, জনপ্রতিনিধি আইন, ১৯৫১ (আর পি এ), আয়কর আইন, ১৯৬১ এবং কোম্পানি আইন, ২০১৩।

জনপ্রতিনিধি আইন, ১৯৫১ ধারা ২৯সি অনু্যায়ী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে একটি আর্থিক বছরে কুড়ি হাজার টাকার বেশি যত দান পেয়েছে সেটা ঘোষণা করতে হত। বিশেষ করে জানাতে হত যে কোনগুলো ব্যক্তির থেকে পাওয়া আর কোনগুলো কোম্পানির থেকে।

ফাইনান্স অ্যাক্ট, ২০১৭ সংশোধনী জুড়ে দিল যে এই নিয়ম ইলেক্টোরাল বণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

আয়কর আইন, ১৯৬১ ধারা ১৩ এ (বি) অনুযায়ী রাজনৈতিক দলকে সদস্যদের চাঁদার বাইরে কারও স্বেচ্ছায় দেওয়া চাঁদা বার্ষিক মোট আয়ের মধ্যে গুণতে হবে না। কিন্তু একটি রেজিস্টারে ২০০০০ টাকার চেয়ে বেশি চাঁদার পুরো রেকর্ড রাখতে হবে। তাতে অমন দানদাতাদের নাম-ঠিকানা সব নথিবিদ্ধ করতে হবে।

ফাইনান্স অ্যাক্ট, ২০১৭ সংশোধনী জুড়ে দিল যে এই নিয়ম ইলেক্টোরাল বণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

কোম্পানি আইন, ২০১৩ ধারা ১৮২(১) অনুযায়ী কোন কোম্পানি একটি আর্থিক বছরে কোন রাজনৈতিক দলকে তার গত তিন আর্থিক বছরের শুদ্ধ মুনাফার (net profit) গড় রাশির ৭.৫% এর বেশি চাঁদা/দান দিতে পারবে না।

ধারা ১৮২(৩) অনুযায়ী সমস্ত কোম্পানি যা যা চাঁদা/দান যে যে রাজনৈতিক দলকে দিয়েছে সব জানাতে বাধ্য, মায় দলের নাম এবং কাকে কত টাকা।

ফাইনান্স অ্যাক্ট, ২০১৭ ওই দুটো ধারাই বাতিল করে বলল যে কোন কোম্পানি কোন রাজনৈতিক দলকে যতখুশি টাকা দিতে পারে, এবং সেইসব গ্রাহক দলের নাম ও কাকে কত টাকা কিছুই জানানোর দরকার নেই। খালি আর্থিক বছরে মোট কতটাকা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়েছে সেটুকু ব্যালান্স শীটে দেখালেই হবে। তাতে ১০০% আয়কর ছাড় পাওয়া যাবে।

সুপ্রীম কোর্ট তাদের বর্তমান রায়ে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭র মাধ্যমে করা উপরোক্ত তিনটি আইনের সংশোধন বাতিল করে আগের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে এনেছে।

২ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সর্বাধিক বণ্ড বিক্রি হয়েছে কোলকাতায়। গত ৬ বছরে কোলকাতার স্টেট ব্যাংক অফ ইণ্ডিয়ার শাখাগুলো থেকে বিক্রি হয়েছে ৭৮৩৪ বণ্ড। মুম্বাই ৫৪২৬, হায়দ্রাবাদ ৪৮১২, দিল্লি ৩৬৬২, চেন্নাই ১৮৬৯, গান্ধীনগরে ১১৮৯। সবচেয়ে কম পাটনায়, মাত্র ৮টি।

এই বন্ডের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দল কত টাকার চাঁদা পেয়েছে?

কিছুদিন ইলেকশন কমিশনের সাইটের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট ঘুরছিল। তাতে দেখান হয়েছে যে সিপিএম দলও ৩৬৭ কোটি টাকার বণ্ডের চাঁদা পেয়েছে। সত্যিটা কী?

--- লাইভ ল’ সাইট অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচুড় অন্যতম পিটিশনার সিপিএমের উকিল ফরসাতকে প্রশ্ন করেন—এ ডি আর এর রিপোর্ট অনুযায়ী আপনারাও তো কিছু ইলেক্টোরাল বন্ড পেয়েছেন।

ফরসাত—না ধর্মাবতার। আমরা বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট করেছি যে আমরা কোন বণ্ড নিই নি।

গত ফেব্রুয়ারি ১৫ , ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিট) এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি দিল্লিতে সংবাদ সংস্থা এ এন আইকে বলেন যে সিপিএমই একমাত্র রাজনৈতিক দল যে ইলেকশন বণ্ডের মাধ্যমে চাঁদা দেওয়াকে আর্থিক দুর্নীতিকে আইনের জামা পরিয়ে দেওয়া বলে ঘোষণা করে । এমনকি আইন অনুয়ায়ী স্টেট ব্যাংকে যে ডেজিগ্নেটেড আকাউন্ট খোলার কথা তা’ও খোলে নি। বাকি অপপ্রচার। সিপিএমের উকিল চিফ জাস্টিসকে সেটাই বলেছেন। সিপিএম ইলেকশন বণ্ড মামলায় সুপ্রীম কোর্টে অন্যতম পিটিশনার।

Funds received through electoral bonds from 2017-18 to 2022-23

In Rs. Crore

BJP 6566

Cong 1123

TMC 1093

BJD 774

DMK 617

BRS 384

YSRCP 382

TDP 147

Shiv Sena 107

AAP 94

NCP 64

JD(S) 49

JD(U) 24

SP 14


Source: Supreme Court, Created with Datawrapper



দ্বিতীয় ভাগ

আইনের মারপ্যাঁচ

এই বিল তৈরির সময় কোন সরকারি সংস্থা বিত্ত মন্ত্রকের কাছে আপত্তি করেনি?

--করেছে তো! রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ও তৎকালীন নির্বাচনী কমিশন কড়া আপত্তি করেছিল, শোনা হয় নি।

কী তাদের আপত্তি?

রিজার্ভ ব্যাংকঃ বিত্ত মন্ত্রকের সঙ্গে ইলেকশন বণ্ড নিয়ে কয়েক দফা আলোচনার সময় রিজার্ভ ব্যাংক জানুয়ারি ২০১৭ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৭ নাগাদ যে আপত্তিগুলো করেছিল তা মোটামুটি এইরকমঃ

যদি রিজার্ভ ব্যাংক ছাড়া অন্য কোন বাণিজ্যিক ব্যাংককে অমন ধারক বণ্ড (bearer bond instrument) জারি করতে দেওয়া হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিয়ারার বন্ড জারি করার ‘একমাত্র অধিকার’ ক্ষুণ্ণ হয়ে বিত্তীয় অরাজকতা হবে। অধিক সংখ্যায় জারি ইলেকশন বন্ড বাজারে এলে রিজার্ভ ব্যাংকের জারি টাকার উপরে মানুষের আস্থা কমে যাবে।

( নোটঃ রিজার্ভ ব্যাংক সমস্ত টাকা ইস্যু করে এবং সেসবই বিয়ারার বা ধারক বন্ড, ফলে ইলেকশন বন্ডও হাত ফেরতা হয়ে টাকার ভূমিকা পালন করবে এবং তাতে বাজারে টাকার যোগানের ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাংকের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।)

এটা ঠিক যে বণ্ডের প্রথম ক্রেতা এবং শেষ প্রাপ্তকর্তার পরিচয় ব্যাংকের কাছে গোপন থাকবে না, কিন্তু এর মাঝে যত লোকের হাত ফেরতা হয়ে বন্ড ব্যাংকে ফেরত আসবে, তাদের পরিচয় জানার কোন উপায় নেই। এটা প্রিভেনশন অফ মানি লণ্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ (টাকার বেনামি হাওলা লেনদেনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা কবচ), এর নীতির বিরুদ্ধে।

(নোটঃ ধরুন, ক এক লাখ টাকার ইলেকশন বন্ড কিনল, খ তার থেকে ওই বন্ড নগদ এক লাখ পঁচিশ হাজার দিয়ে কিনে নিল। গ তার থেকে ওই বন্ড দেড় লাখ টাকায় কিনে কোন ‘দেশভক্ত’ দলের অ্যাকাউন্টে জমা করে দিল।

ওই লেনদেনের মাধ্যমে ক এবং খ দুজনেই পঁচিশ হাজার করে কালো টাকা নগদে অর্জন করল এবং গ তার দেড় লাখ কালো টাকা সাদা করে ফেলল।)

রিজার্ভ ব্যাংকের শেষ বক্তব্যটি হল যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয় যে নির্বাচনী চাঁদা নগদ বা কালো টাকার বদলে আয়কর দেওয়া সাদা টাকার থেকে আসুক, তাহলে সেটা চেক, ডিমান্ড ড্রাফট বা ইলেক্ট্রনিক এবং ডিজিটাল ট্রান্সফারের মাধ্যমেই ভাল ভাবে সম্পন্ন হতে পারে। অহেতুক আলাদা করে ‘বিয়ারার বন্ড’ জারি করা কেন?

সেপ্টেম্বর ২০১৭ নাগাদ, যখন ইলেকশন বন্ডের ফাইনাল ড্রাফট তৈরি হচ্ছিল তখনও রিজার্ভ ব্যাংক তাদের আপত্তিতে অটল ছিল। আশংকা করছিল যে দেশি-বিদেশি শক্তির নকল (‘শেল’ কোম্পানি) এই বন্ড হাওলা লেনদনে ব্যবহার করবে। এছাড়া বাজারে দেশে বা সীমান্তের ওপার থেকে নকল বণ্ড আসার ভয় রয়েছে।

ইলেকশন কমিশন

কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৭ সালের বাজেটে ফাইনান্স অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর ইলেকশন কমিশন মে’ মাসেই বিত্ত মন্ত্রককে চিঠি লিখে তাদের তিনটে আপত্তির কথা জানাল। তাদের আপত্তি ছিল জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, আয়কর আইন এবং কোম্পানি আইনে যে সংশোধন করা হয়েছে তাতে রাজনৈতিক দলের বিত্তপোষণ নিয়ে আবশ্যক স্বচ্ছতার উপর বিরাট ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

যে সংশোধনের ফলে রাজনৈতিক দলকে ইলেক্টোরাল বণ্ড থেকে প্রাপ্ত বড় বড় চাঁদা/অনুদানের তথ্য দেওয়া থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা একটি প্রতিগামী কদম (retrograde step) সেটা রদ করতে হবে। কারণ, ওটা আবশ্যক স্বচ্ছতার জন্য ক্ষতি করবে।

কোম্পানি আইনে সংশোধনের ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে যে কোন রাজনৈতিক দলকে কে কত চাঁদা দিয়েছে তা গোপন রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি বাতিল করে তাদের ‘লাভ-ক্ষতির হিসেবে’ (Profit Loss A/c) সেসব স্পষ্ট করে দেখানোর নির্দেশ দিতে হবে।

আগের নিয়মে একটি কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলকে মোট কত চাঁদা দিতে পারে তার উর্ধ্বসীমা বাঁধা ছিল। এখন নতুন আইনে কর্পোরেট ফান্ডিং এর অসীমিত ক্ষমতা দেওয়ায় শেল কোম্পানির মাধ্যমে রাজনৈতিক বিত্তপোষণে কালো টাকার ভূমিকা বেড়ে যাবে।

সুপ্রীম কোর্ট বর্তমান রায়ে সরকার পক্ষের যুক্তি না মেনে উপরের আশংকাগুলোর সম্ভাবনাকে স্বীকার করে ফাইনান্স অ্যাক্ট ২০১৭তে উপরোক্ত তিনটে আইনের সংশোধনকে খারিজ করেছে।

সুপ্রীম কোর্টের মূল বক্তব্যঃ

এই বন্ড ভোটারের প্রার্থীর সম্বন্ধে জানবার এবং স্বাধীন বক্তব্য ও মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার -- আর্টিকল ১৯(১)-- হনন করছে।

এই বণ্ডের বা সরকারের উদ্দেশ্য যতই মহান হোক, এটা বাস্তবে আদৌ স্বচ্ছ না হয়ে আরও বেশি অস্পষ্ট (opaque) হয়েছে।

এই বণ্ডে সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকারের চেয়ে কর্পোরেট ঘরানার ‘গোপনীয়তা’কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন ছাত্র, একজন শিক্ষক, কৃষক বা কর্মচারির তুলনায় একজন শিল্পপতি কেন বিশেষ সুবিধে পাবে?

আগে শুধু মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিই নির্বাচন ফান্ডে দান দিতে পারত, তারও মুনাফার উর্ধসীমা ৭.৫% বাঁধা ছিল। এবার সেসব তুলে দিয়ে বিদেশি কোম্পানী , শেল কোম্পানী (জালি) -সবার জন্যে রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে।

কোন লোকসানে চলা কোম্পানী কেন দান দেবে? কোত্থেকে দেবে? তাও যত ইচ্ছে? অবশ্যই কালো টাকা থেকে। তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে কালো টাকার প্রবেশের পথ বন্ধ করার বদলে তাকে আইনি জামা পরিয়ে দেওয়া হল। যা সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্যের বিপরীত।

সরকার এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে কালো টাকা সাফ করার জন্যে এই ইলেকশন বন্ড জারি করা ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোন সহজ এবং স্বচ্ছ বিকল্প ছিল না।

গোপনে বিশাল টাকা কোন কর্পোরেট হাউস কেন দেবে? অবশ্যই বদলে কিছু প্রতিদান (quid pro quo) পাওয়ার আশায়। জনতার জানার অধিকার আছে সরকারের কোন নীতি কি দেশের হিতে নেওয়া হচ্ছে নাকি কোন ব্যবসায়ী ঘরানাকে বিশেষ লাভ পাইয়ে দিতে।

উল্লেখযোগ্য তথ্য হল ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ অব্দি যত বন্ড বিক্রি হয়েছে তার ৯০% এক কোটি মূল্যের। অর্থাৎ এই সবই কেনা হয়েছে খুব বড় বড় কর্পোরেট ঘরানা থেকে।

সুপ্রীম কোর্টের আগের বিভিন্ন রায়ে ( আধার কার্ড, ডিমনিটাইজেশন ইত্যাদি) একটি নীতিকে বারবার জোর দেওয়া হয়েছে। তা হল আনুপাতিক তুলনার পরীক্ষা (Proportionality Test)। অর্থাৎ যদি দুটো মৌলিক অধিকারের মধ্যে বিরোধ বাধে, তাহলে রাষ্ট্রকে কোন দিকে যাওয়া উচিত? যেটায় মৌলিক অধিকারে কম কাটছাঁট হবে সেদিকে। মানে রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারে যত কম হস্তক্ষেপ করে তত ভাল। দেখতে হবে ব্যক্তি নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার আর সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদির সামুহিক কল্যাণে তথ্য জানবার অধিকার—কোনটা বেশি জরুরী।

এখানে প্রশ্ন ছিল দানদাতার গোপনীয়তার মৌলিক অধিকার এবং সাধারণ ভোটারের জানবার মৌলিক অধিকারের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচারের। সরকার জোর দিচ্ছিল কর্পোরেট হাউসের দাতাদের গোপনীয়তা রক্ষার দিকে, কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের মতে সাধারণ ভোটারের জানবার অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাস্টিস খান্না তাঁর আলাদা লিখিত রায়ে বলেছেন—দানদাতার গোপনীয়তা রক্ষা রাষ্ট্রের ন্যায়সংগত লক্ষ্য হতে পারে না এবং ভোটারের জানবার অধিকার রাজনৈতিক ফান্ডিং এর গোপনীয়তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অতএব এই আইন বাতিল করে স্টেট ব্যাংককে নতুন কোন বণ্ড জারি করতে নিষেধ করা হচ্ছে এবং তাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে অবিলম্বে আজ অব্দি জারি করা সমস্ত বন্ডের ক্রেতার নাম, কেনার তারিখ, কার জন্যে এবং কত টাকার—সব বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দিতে যাতে ওরা ওদের সাইটে সমস্ত তথ্য প্রদর্শন করে জনসাধারণকে সরকারের পলিসি এবং quid pro quo দেখে নিজেরা বিচার করে নিতে পারে।

উপসংহার

এর পর কী হবে?

একটি আলোচনা চক্রে সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মদন লোকুর বলেন যে ওই রায়ের নির্দেশগুলো ঠিকমত কার্যকর না হলে এই ঐতিহাসিক রায় একটি ‘অ্যাকাডেমিক এক্সারসাইজ’ হয়ে ইতিহাসে স্থান পাবে।

কেন্দ্রীয় সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু একই সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে ‘রিভিশন’ এর পিটিশন দায়ের করতে পারে। তাতে শুনানি সম্পূর্ণ হতে হতে সংসদের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে।

আর যতদিন রায়ের পুনর্বিচারের আবেদন চলছে, ততদিন ব্যাপারটি বিচারাধীন বলে স্টেট ব্যাংক এবং নির্বাচন কমিশন দাতাদের সূচী জনতার সামনে আনার কাজ স্থগিত রাখতে পারে।

সুপ্রীম কোর্টের থেকে আর কী আশা ছিল?

সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট কপিল সিব্বল বলেন যে নতুন করে ইলেকশন বণ্ড জারি হবে না বটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত যা হয়েছে তাতে শাসক দল বিজেপির কাছে ওই বণ্ড বাবদ ৬৫৬৬ কোটি টাকা গচ্ছিত আছে। সেই টাকা বিজেপিকে, এবং অন্যান্য দল যা পেয়েছে সেটা, ডোনরকে ফেরত করে দেওয়া উচিত।

কারণ, বাতিল হওয়া ইলেকশন বণ্ড আইন যদিও সিভিল আইন তবু ওই বন্ড সুপ্রীম কোর্টের আইন অনুয়ায়ী সংবিধান বিরোধী। অতএব সেই বণ্ড কেনাবেচা সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেন বে-আইনি লেনদেনের ফল। সুতরাং অন্তিম প্রাপক অর্থাৎ রাজনৈতিক দলকে সে টাকা ফেরত দেওয়া উচিত। এই আদেশ সুপ্রীম কোর্ট জারি করলে ভাল হত।

আমার টিপ্পনীঃ কোন সামান্য নাগরিক বা বেতনভোগী কর্মচারী যদি সরকারের বা ব্যাংকের ত্রুটিতে অন্যায্য কোন টাকা পায়, বা তার অ্যকাউন্টে জমা হয়—তাহলে সেই টাকা তার থেকে ফেরত নেওয়া হয়। তাহলে এখানে কেন তার ব্যতিক্রম হবে?

এই টাকা দলের ফান্ডে গেছে। কিন্তু ইলেকশন ফান্ডের টাকা নির্বাচনেই খরচ হয়েছে কিনা তার প্রমাণ কী? ডিজিটাল খরচের কথা বলা হলেও নির্বাচনে বেশির ভাগ খরচ—গাড়িভাড়া, ভলান্টিয়ারদের পকেট মানি, খাওয়াদাওয়া, পোস্টার ইত্যাদির পেমেন্টের বেশির ভাগ এখনও নগদে হয়। তাহলে?

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি বলেছেন যে নির্বাচন প্রার্থীর ব্যয়ের উর্ধ্বর্সীমা নির্ধারিত আছে –বিধানসভায় ৫৫ লাখ, লোকসভায় ৯০ লাখ। তাদের নির্বাচন শেষ হলেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খরচের হিসাব দাখিল করতে হয়, অডিট করাতে হয়।

কিন্তু রাজনৈতিক দলকে পুরনো আইনেও শুধু নির্বাচনী তহবিলে আয়ের হিসেব বা চাঁদার হিসেব দেখাতে হয়, খরচের নয়, তাহলে?

সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট কপিল সিব্বলের এবং কুরেশির মতে এই মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে সুপ্রীম কোর্ট বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মামলাটা ঝুলিয়ে রাখায় বিজেপি ইলেকশন বণ্ডের মাধ্যমে কর্পোরেট হাউসের থেকে নিয়মিত বিশাল টাকা পেয়ে ২০১৯ এর সাধারণ নির্বাচন এবং পরবর্তী বেশ কিছু বিধানসভা নির্বাচনে অন্যদলের তুলনায় বিষমানুপাতিক দরে খরচ করার সুবিধে পেয়ে গেল।

কিন্তু এতে কুইড প্রো কুয়ো গেম খেলাটি কীরকম?

সিব্বলের মতে অনেকরকম।—একটা চোখে পড়ছে, মাত্র গোটা কয়েক কর্পোরেট হাউসের অধিকাংশ মিডিয়া একের পর এক কিনে ফেলা, সেখান থেকে সরকারকে প্রশ্ন করা সাংবাদিকদের সরিয়ে রাজনৈতিক পরিদৃশ্যের একমাত্রিক আখ্যান নিয়মিত প্রচারিত করা এবং বদলে বিশাল অংকের সরকারী বিজ্ঞাপন পাওয়া।

আর কী হতে পারে?

এই রায়ের ফলে সুপ্রীম কোর্টে সাংবিধানিক প্রশ্নে লম্বিত আরও কয়েকটি মামলার সকারাত্মক (positive) রায়দানের সম্ভাবনা বেড়ে গেল, যেমন পিএম কেয়ার ফান্ডের মামলা। যে ফান্ডে ভারত সরকারের লোগো ব্যবহার হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী , গৃহমন্ত্রীরা পদাধিকারী এবং বিভিন্ন সরকারী সংস্থা ওতার কর্মীদের থেকে দান নেওয়া হচ্ছে সে নাকি ‘প্রাইভেট এনটিটি’! অতএব তার তথ্য চেয়ে সুচনার অধিকার ২০০৫ (আর টি আই) আইনে আবেদন করা যাবে না; সরকারি সংস্থার মত অডিটও করা যাবে না!

প্রাক্তন মুখ্য কেন্দ্রীয় কমিশনার (আর টি আই) যশোবর্ধন আজাদ, আইপিএসের আশা যে ইলেকশন বন্ডের রায়ের ফলে আর টি আইকে আবার পুনর্জীবিত করার দিকে এগুনো যাবে। বর্তমানে ওই স্বতন্ত্র সাংবিধানিক পদটিকে আইন পাশ করিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বেতনভোগী আমলা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনের ঘোটালা নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের সক্রিয় হস্তক্ষেপের পর ওই সম্ভাবনা একটু বেড়েছে। আশায় বাঁচে চাষা।
0

প্রবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in






‘বিশেষ স্থানে গিয়ে, বিশেষ মন্ত্র প’ড়ে, বিশেষ অনুষ্ঠান ক’রে মুক্তিলাভ করা যায়, এই বিশ্বাসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথাটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্যে এসেছিলেন যে, স্বার্থত্যাগ ক’রে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার ক’রে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় ক’রে ফেললে তবেই মুক্তি হয়; কোনো স্থানে গেলে, বা জলে স্নান করলে, বা অগ্নিতে আহুতি দিলে, বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না।

এই কথাটি শুনতে নিতান্তই সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্যে একটি রাজপুত্রকে রাজ্যত্যাগ ক’রে বনে বনে, পথে পথে, ফিরতে হয়েছে।’ - এই ছিল বুদ্ধদেবের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন।

প্রতি ২-৩ বছর অন্তর বৈশাখী পূর্ণিমা ঘুরে ফিরে আসে ২৫শে বৈশাখের আশেপাশেই। তবে বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী জন্মদিন কাছে থাক বা দূরে--- শাক্যসিংহের প্রভাব রবীন্দ্রমননে যে কতটা প্রসারিত তা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়।

যে জীবনদেবতার ধারণা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা দেখতে পাই একদম তরুণ বয়স থেকেই, তার তার উৎস বহুবিধ হলেও তাতে বুদ্ধদেবের ভূমিকা ছিল ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জীবনদেবতা যিনি অন্তর্মুখী। মানুষের রোজকারের জীবনের সঙ্গে, তাদের সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ, আনন্দ, ক্লেশের সঙ্গে মিলেমিশে সঙ্গী হয়ে থাকেন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ভারতবর্ষ গ্রন্থের 'মন্দিরের কথা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেন 'বুদ্ধদেব যে অভ্রভেদী মন্দির রচনা করিলেন, তাহারই মধ্যে... মানবের মধ্যে দেবতার প্রকাশ, সংসারের মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠা, আমাদের প্রতি মুহূর্তের সুখদুঃখের মধ্যে দেবতার সঞ্চার ছড়াইয়া পড়িল'।

বৌদ্ধধর্মের সারমর্মে যে বাসনাহীন ত্যাগ আর বিশ্বনিখিলের প্রতি যে প্রেমের কথা বলা আছে তা ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দর্শনের সমভাবাদর্শ। অন্য ধর্মে যেখানে পরম ব্রহ্মকে খুঁজে পেতে ভিন্ন উপায়ের কথা ব্যাখ্যা করা হয় সেখানে বুদ্ধ প্রেমকেই ব্রহ্ম বলে মেনে নিতে বলেন। ক্ষেত্রবিশেষে সে প্রেম কখনও হয় করুণা, কখনও বা মৈত্রী, কখনও বা ক্ষমা। কিন্তু তার মূলে আছে বিশ্ব মানবপ্রেমের কথা। এর সাথে যোগ হয় অহং বা স্বার্থ বিহীন ত্যাগ, যা মানুষকে দিতে পারে এক অনির্বচনীয় আনন্দের উপলব্ধি।

এই দর্শনে প্রভাবিত হয়েই জীবনের প্রথম ভাগেই রবীন্দ্রনাথ পালি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন 'ধম্মপদ'। যুগ্মগাথা, চিত্তবর্গ, পুষ্পবর্গ - এই রকম অনেক শাখায় এই অনুবাদ নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষাকে নতুন করে সমৃদ্ধ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যেটা হলো যে এই অনুবাদে শ্লোকের কাব্যগুণ অটুট থাকে, অথচ বুদ্ধের বাণী এবং দর্শনের কোনো বিচ্যুতি ঘটে না।

ভক্তদের জন্য বুদ্ধের মূল বক্তব্যই ছিল "আত্মদীপো ভব, আত্মশরণ্যে ভব", অর্থাৎ কিনা অন্ধ বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে নয়, নিজেই নিজের প্রদীপ হও, জ্ঞানের দীপ্তি জ্বালিয়ে জ্বলে ওঠো। বিশ্বমানবের স্বার্থে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দাও, নিজের ক্ষমতায় আস্থা রাখো, নিজেই নিজের শরণ নাও। বুদ্ধ-নির্দেশ্য এই শরণ বা আস্থার কথা খুব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে উল্লিখিত রবীন্দ্ররচিত কবিতাগুলোর সারমর্মে।

এই দর্শনের প্রভাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে, নাটকে, প্রবন্ধে। 'শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা' বা 'নগরলক্ষ্মী' কবিতাগুলোর মধ্যে এই স্বার্থ বিহীন ত্যাগের কথা খুব পরিষ্কার করে ফুটে ওঠে। যেখানে রাজ শাসনে নয়, বরং আত্ম উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে এই ত্যাগের আনন্দ অনুভূত হয়।

নগরলক্ষ্মী কবিতায় শ্রাবস্তীর ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া বৌদ্ধধর্মের করুণা ও সেবার মূর্ত প্রতীক মহান আদর্শে বলেন ‘প্রকাশ করে নতুন করে/ আমার ভাণ্ডার আছে ভরে/ তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে।/ তোমরা চাহিলে সবে/ এ পাত্র অক্ষয় হবে।/ ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা/ মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।’

'অভিসার' কবিতায় দেখা যায় সেই বিশ্ব প্রেমের বা মানবতার এক রূপ। সন্ন্যাসী উপগুপ্ত পরিত্যক্তা বাসবদত্তার কাছে ফিরে আসে তার সবথেকে কঠিন সময়ে, তার সেবক হয়ে। এখানে উপগুপ্তর প্রেম অহং বর্জিত, তাই সে সেবার মধ্যে দিয়েই আনন্দের সন্ধান পায়।

তেমনি আবার শ্যামা নাটকে বজ্রসেনের 'ক্ষমিতে পারিলাম না যে/ ক্ষমো হে মম দীনতা' আসলে সেই বুদ্ধের সেই ক্ষমাসুন্দর দর্শনকেই নতুন করে প্রকাশ করে।

বুদ্ধের এই সর্বত্যাগী দর্শন যেমন অনেক সাধারণ মানুষকে টেনে এনেছিল বৈদিক আচার-সর্বস্ব ধর্মাচরণ থেকে, তেমনই এতে আকৃষ্ট হতে দেখা যায় তৎকালীন কিছু শাসককে। ধর্মপ্রচারে তথাগতের জন্য ছিল এটা ছিল ব্যতিক্রমী সাহায্য। এমনকি বিম্বিসারের মতো শাসকদের আনুকূল্য বুদ্ধ পেতে শুরু করেন বোধিলাভের অনেক আগে থেকেই। কিন্তু তা বলে যে প্রথম থেকেই এটা সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছিল তা কিন্তু নয়। সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষ করে রাজ পরিবার বা প্রভাবশালী অংশের মধ্যে এর বিরোধিতাও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। হয়তো তার একটা বড়ো কারণ ছিল এর ধর্মচর্চার দিকটা। ব্রাহ্মণ্যবাদের রীতি থেকে বেরিয়ে এসে বা বিলাসবহুল জীবন থেকে নিজেদের বিচ্যুত করে আক্ষরিক অর্থে সর্বত্যাগী হওয়া সোজা কথা নয়।

এই ত্যাগ ও ভোগের দ্বন্দ্বের পরিসরটা রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকাকারে দেখিয়েছেন 'নটীর পূজা'য়। যেখানে রাজমহিষী লোকেশ্বরীর হাহাকার বেরিয়ে আসে তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। তার আনুকূল্যে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদে, সে নিজে ভিক্ষুদের অন্নবস্ত্র দান করেছে, নিষ্ঠার সাথে তথাগতের থেকে ধর্মোপদেশ শুনেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে আজ সে হয়েছে রিক্ত। রাজা বিম্বিসার সিংহাসন ত্যাগ করেন--- একমাত্র পুত্র বুদ্ধের অনুগামী হয়ে ভিক্ষুজীবন বেছে নেয়, তখন সে নিজেকে সর্বস্বান্ত ভাবে। তাই আবার ফিরে যেতে চায় পুরোনো বিশ্বাসে, ক্রোধে অন্ধ হয়ে বলে ওঠে ‘অহিংসা ইতরের ধর্ম। হিংসা ক্ষত্রিয়ের বিশাল বাহুতে মাণিক্যের অঙ্গদ, নিষ্ঠুর তেজে দীপ্যমান। দুর্বলের ধর্ম মানুষকে দুর্বল করে। দুর্বল করাই এই ধর্মের উদ্দেশ্য। যত উঁচু মাথাকে সব হেঁট করে দেবে।’

কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব ঘুচে যায় শ্রীমতীর ভক্তি দেখে, নিবেদিত নিষ্ঠা দেখে। মানবতার প্রেম বিতরণের মন্ত্র শ্রীমতী নিয়েছে, তাই শিয়রে মৃত্যু নিয়েও অকুতোভয় শ্রীমতি নাচের অর্ঘ্য দান করে বুদ্ধের প্রতি, সব শাসন দূরে সরিয়ে গেয়ে ওঠে 'যা-কিছু মলিন, যা-কিছু কালো/ যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো,/ ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ।/ হে মহাজীবন, হে মহামরণ,/ লইনু শরণ, লইনু শরণ।'

আর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তখন সমবেত হয়ে গেয়ে ওঠে 'সকল কলুষ তামস হর,/ জয় হ'ক তব জয়,/ অমৃতবারি সিঞ্চন কর/ নিখিল ভুবনময়।'

পথের শেষে সবাই এসে আশ্রয় নেয় বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘের ত্রিশরণে। জয় হয় সেই অহিংসার আর মানবতার।

বুদ্ধের দর্শনে সামাজিক সাম্যের কথা যোগ করে এক নতুন মাত্রা, সরাসরি আঘাত হানে সামাজিক বর্ণভেদের ওপর, যা ভাঙ্গন ধরায় ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিষ্ঠানিক চিন্তাধারাকে। সেই আঘাতের আঁচ এসে লাগে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর ওপর। তাই রাজমহিষী বা রাজকুমারীরা মেনে নিতে পারে না যখন দেখে রাজবাড়ীর নটী পেয়ে যায় বুদ্ধের পুজোর দায়িত্ব আর বুদ্ধের অন্য ভিক্ষু বা অনুচররাও আসে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে।

প্রকট সেই বৈষম্যের মাত্রা প্রকটতর হয় ‘চণ্ডালিকা’য় এসে। পৃথিবীতে খুব কম ধর্মই আছে যা মান্যতা দেয় জন্মান্তরবাদকে। হিন্দু আর বৌদ্ধ হয়তো তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তবে দুই ধর্মের দর্শনে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দুই ধর্মেই জন্মান্তরবাদের সাথে জুড়ে আছে কর্মফল। হিন্দুধর্মে এই কর্মফলের সঙ্গে যেখানে জুড়ে রয়েছে বর্ণভেদ, কিন্তু বুদ্ধের দর্শন কখনই কর্মফলের অজুহাতে বর্ণভেদ বা অস্পৃশ্যতাকে অনুমোদন করেনি।

আপাত সাদৃশ্যের আড়ালে অন্তর্লীন বিরোধের চরিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠতে দেখি ‘প্রকৃতি’র বিদ্রোহে। সে দৃপ্ত ঘোষণায় জানায় সে মানে না এই ধর্ম, বলে, ‘যে-ধর্ম অপমান করে সে-ধর্ম মিথ্যে। অন্ধ ক’রে, মুখ বন্ধ ক’রে সবাই মিলে সেই ধর্ম আমাকে মানিয়েছে।’ মরিয়া হয়ে উঠে বলে, ‘যে-বিধানে কেবল শাস্তিই আছে, সান্ত্বনা নেই, মানব না সে বিধানকে।’ হাহাকার করে বলে ওঠে, ‘যে আমারে পাঠাল এই অপমানের অন্ধকারে, পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।’

অন্ধকূপের সেই জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে সে আশ্রয় চায় আনন্দের কাছে। আনন্দ তাকে বলে 'যে-মানুষ আমি তুমিও সেই মানুষ; সব জলই তীর্থজল যা তাপিতকে স্নিগ্ধ করে, তৃপ্ত করে তৃষিতকে', আনন্দ তাকে নতুন করে জীবনের অর্থ শেখায়, আশ্বাস দিয়ে বলে 'যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।' প্রকৃতি বিহ্বল হয়ে পড়ে, এক জন্মের মধ্যেই তার আরেক নবজন্ম হয়। আরও একবার জিতে যায় মানবধর্ম।

বুদ্ধের জীবন বা ধর্মীয় দর্শনের বাইরে এসে একটা বড়ো দিক হল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে (এক্ষেত্রে ধর্মও একটা প্রতিষ্ঠান)--- বিশেষত কোনো প্রতিষ্ঠান যখন একজন দূরদর্শী মানুষের তৈরী এবং সেই মানুষটির দূরদৃষ্টি যখন নিজ-দর্শনে প্রতিষ্ঠানটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে নিজের সময়ের থেকে অনেক বেশি যুগ ধরে, তখন অনেক কিছুর মধ্যে--- প্রকট হয় কিছু গুরুতর সমস্যা যা প্রতিষ্ঠানকে অনেকটাই আত্মধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

তার মধ্যে অতি পরিচিত অথচ প্রচলিত দিক হল নিয়মের বেড়াজাল। যে নিয়ম ভাঙার প্রথা নিয়ে প্রতিষ্ঠান শুরু করেন হোতাগণ, সময়ের সাথে তাঁরা নিজেরাও বাঁধা পড়ে যান এই নিয়মের বেড়াজালে। এই জালে বুদ্ধদেব নিজে পড়েছেন বারেবারে (ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এর শিকার)। সেই বেড়াজাল কাটানোর কথা, তার অচলাবস্থাকে তুলে ধরেছেন ‘অচলায়তন’ নাটকে।

আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন সাম্রাজ্যলোভে বুদ্ধের দোহাই দিয়ে অন্য দেশ আক্রমণ করে, তখন সেই ধিক্কারে রবীন্দ্রনাথ লেখেন (‘বুদ্ধভক্তি’):

'জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি, জাপানি সৈনিক
যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে যুদ্ধমন্দিরে
পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে,
ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।'

বোধিসত্ত্বের কথা নিখাদ ধর্মকথা নয়, একে ধর্মের কোনো বেড়াজালে বেঁধে রাখা যায় না। এ মানবতার গোড়ার কথা, যা কয়েক সহস্রাব্দ পেরিয়ে এসেও একই রকম প্রযোজ্য, প্রাসঙ্গিকতা হারায় না এতটুকু। আজীবন তাই সেই বুদ্ধদেবকে লালন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, কোথাও কোনো বিচ্যুতি দেখলে তার সমালোচনা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। বুদ্ধদেবের কাছে নিজের অর্ঘ্য সাজিয়েছেন তাঁকে ভারতবর্ষের মহামানবের আখ্যা দিয়ে, যিনি জাতির বাইরে বেরিয়ে মানুষের অন্তরাত্মাকে আহ্বান করেছেন। গানের মধ্যে দিয়ে কবি ব্যক্ত করেছেন বুদ্ধের প্রতি তাঁর চিরপ্রণতি:

'দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে ॥
ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে ॥'
0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in






আচ্ছা, ভগবান বুদ্ধদেব কি কৃষক ছিলেন? এই প্রশ্নটা শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন। কিন্তু ঘটনাটি একেবারেই সত্য। সেটাই ভগবান বুদ্ধের জন্মমাসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এই আশ্চর্যের বিষয়টি এখানে আলোকপাত করব।

সেবার ভগবান বুদ্ধদেব মগধের একনাল গ্রামে ছিলেন। সেই গ্রামে বৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটা ছিল ঠিক বীজ বপনের সময়। সকালবেলা যখন পাতাগুলো তখনও শিশিরে ভেজা ছিল। সেই সময় বুদ্ধদেব এক ক্ষেতে গেলেন। সেখানে তখন একজন ধনী ব্রাহ্মণ ছিলেন যাঁর নাম ভরদ্বাজ বা কাশী ভরদ্বাজ। তিনি একজন ব্রাহ্মণ কৃষক হলেও ধনবান ছিলেন কেননা তাঁর পাঁচশো লাঙ্গল দিয়ে চাষ করতেন। তা তিনি একবার তাঁর‌ ফসল উৎসব পালন করছিলেন। সেই সময় বুদ্ধদেব তাঁর ভিক্ষার বাটি নিয়ে খাদ্য ভিক্ষা করতে এলেন ভরদ্বাজের কাছে। তথাগত বুদ্ধ যে সময়ে সেখানে পৌঁছে ছিলেন ঠিক তখনই ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ শ্রমিকদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছিলেন। তা, গৌতম বুদ্ধ সেখানে ভিক্ষা পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিলেন। সন্ন্যাসী গৌতম বুদ্ধকে দেখে বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধা জানালো। কিন্তু ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ বুদ্ধের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট হলেন ও রেগে গিয়ে বললেন, "ওহে শ্রমণ (বৌদ্ধ বা ভিক্ষু), ভিক্ষা করার চেয়ে কাজে যাওয়া আপনার জন্য ভালো হবে। আমি চাষ করি এবং বীজ বপন করি। আর চাষ ও বীজ বপনের পরে খাই। আপনি যদি একই কাজ করতেন, তাহলে আপনিও খেতে পারতেন। হে তপস্বী, আপনিও চাষ করুন এবং বীজ বপুন, তারপর খাবেন।"

তাঁর এই কথা শুনে তথাগত বুদ্ধ উত্তর দিলেন যে, "হে ব্রাহ্মণ, আমিও আপনার মতো চাষ করি এবং বীজ বপন করি আর চাষ ও বীজ বপনের পরে খাই।"

একজন সন্ন্যাসীর মুখে এই ধরণের কথা শুনে ভরদ্বাজ বেশ অবাক ও কৌতূহলী হয়ে বললেন, " আপনি বলছেন যে আপনি চাষ করেন এবং বীজ বপন করেন। অর্থাৎ, আপনি কি নিজেকে কৃষক হওয়ার দাবি করছেন? কিন্তু, আমি তো আপনাকে চাষ করতে তো দেখছি না। আপনি চাষ করলে, আপনার ষাঁড় কোথায়? বীজ এবং লাঙলই বা কোথায়?"

এই কথার উত্তরে বুদ্ধদেব খুব সুন্দর একটা উত্তর দিয়েছিলেন। তথাগত বুদ্ধ বললেন, "বিশ্বাস হল বীজ যা আমি বপন করি। আমার শিক্ষা, ভালো বা সৎ কর্ম হল সেই বৃষ্টি যা তাকে সার দেয় বা উর্বর করে তোলে। জ্ঞান হল ধুরা এবং নম্রতা হল লাঙল বা লাঙ্গলের ফাল। আমার মন হল নিয়ন্ত্রণকারী লাগাম‌ বা দড়ি। মননশীলতা হল লাঙ্গলের ফাল এবং চালনা। আমি ধর্মের হাত ধরে থাকি। আন্তরিকতা হল আমার ব্যবহৃত ঠেলা। আর চেষ্টা হল আমার টানা গরু। আমি কর্মে, কথায় এবং খাদ্যে সংযত। এই চাষ করা হয় মায়ার আগাছা ধ্বংস করার জন্য। এই চাষ যে ফসল দেয় তা হল নির্বাণের অমর জীবন, এবং এইভাবে সব দুঃখের অবসান হয়।" এই নির্বাণ হল বৌদ্ধ সাধনার চরম পরিণতি বা পরম প্রাপ্তি এবং এই জগতের সমস্ত দুঃখ বা জন্ম-মৃত্যুর যে চক্রাকার তার থেকে মোক্ষলাভের শর্ত। নির্বাণ হল তৃষ্ণা বা জাগতিক সমস্ত চাহিদার বিনাশ। এই নির্বাণ হল সেই পরম অবস্থা যেখানে জন্ম-মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, শোক, মনস্তাপ, হতাশা— এসব কিছুর স্থান নেই। এমনকি সেখানে পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ, তারা, জল, তেজ, বায়ু, অন্ধকার— কোনও কিছুই নেই। এখানে সংসার স্রোতের গতি যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে।

এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজের মন গলল। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন এবং খুব খুশি হয়ে গৌতম বুদ্ধের ওপর সদয় হলেন। তিনি একটি সোনার বাটিতে পায়েস ঢেলে বুদ্ধদেবকে উৎসর্গ করলেন। আর বললেন, "হে মানবজাতির গুরু, এই পায়েস গ্রহণ করুন। কারণ, পরম পূজনীয় গৌতম এমন এক চাষ করেন যা মানবজাতিকে অমরত্বের ফল প্রদান করে।"

কিন্তু গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিক্ষার বিনিময়ে খাবার গ্রহণ করতে পারবেন না বলে সেই খাবারটি অস্বীকার করলেন। তখন ধনী কৃষক ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ ভগবান বুদ্ধের পায়ে পড়লেন। আর পায়ে পড়ে তিনি বুদ্ধদেবকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দলে যোগ দিতে চান তা জানালেন। এই ঘটনার কিছুকাল পরেই, ভরদ্বাজ অর্হৎ অর্থাৎ নির্বাণ প্রাপ্তিলাভ করেছিলেন।

আসলে, সেই বিখ্যাত একটা গান আছে না - “মন রে কৃষিকাজ জানো না, এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা।” সেই গানের সূত্র ধরেই বলছি বুদ্ধদেব মানুষের মনের চাষ করতেন। সেই চাষের ফলে যাতে সেই মানুষটি সমাজে একটি সোনারূপে প্রকাশিত হত। দেশ ও দশের কাজে যেন লাগে। অঙ্গুরীমালের মতো ডাকাতকে তিনি নিজের মঠের ভিক্ষু বানিয়ে তাকে স্বাভাবিক মানুষের জীবনে এনেছিলেন। আবার অন্যদিকে একজন পতিতাকেও তিনি ঘৃণা না করে তাকে বৌদ্ধ মঠের ভিক্ষুণী বানিয়েছিলেন। যার সন্ন্যাসে মন নেই সংসারে মন তিনি তাকে সন্ন্যাসী জীবন থেকে আবার সংসারে ফিরে কাজ করতে বলেছিলেন। সন্ন্যাস বা সংসারে যেকোনও মাধ্যমে থেকেই কাঙ্খিত নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। তিনি তাঁর অসাধারণ বোঝনোর ক্ষমতা ও আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা কুব্যক্তিকেও সুপথে চালনা করেছিলেন। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি যাবতীয় বিভেদ মুছে দিয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের বুকে এক নতুন মানবতার ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম প্রথমদিকে হিন্দুধর্মের থেকে হিংসাত্মক প্রতিরোধ পেলেও এই ধর্মের কিন্তু হ্রাস হয়নি বরং ভারতবর্ষের বাইরেও বিভিন্ন দেশে স্বমহিমায় প্রচারিত হয়েছে। এই ব্যাপক প্রচারের পেছনে রয়েছে সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সত্য, অহিংস এবং মানবতার বাণী প্রচার করা। আর এই ধর্ম মানবজাতিকে জানিয়েছে চারটে সত্য কথা বা চতুরার্য সত্য আর সেটা হলঃ- ১) এই জগৎ দুঃখের। ২) এই দুঃখের কারণ আছে আর তা হল তৃষ্ণা বা আকাঙ্খা। এই তৃষ্ণা ইন্দ্রিয় সুখের প্রতি বা জীবনধারণের প্রতি বা যেকোনো কিছুর প্রতি হতে পারে। ৩) সেই তৃষ্ণা নিরোধ বা অবসানের মাধ্যমে দুঃখের নিরোধ বা অবসান ঘটানো সম্ভব। ৪) দুঃখ নিরোধ বা অবসানের জন্য একটি পথ আছে আর সেই পথটি আটটি নীতি নিয়ে গঠিত, যাকে ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বলা হয়।

এই দুঃখ অবসানের মার্গ বা উপায়কে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। আর এই আটটি মার্গ একত্রে দুঃখের অবসান ঘটিয়ে নির্বাণলাভের দিকে নিয়ে যাবে। এই আটটি মার্গগুলি একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং পরস্পর সংযুক্ত হয়ে নির্বাণলাভ করার জন্য এক সম্পূর্ণ পথ সৃষ্টি করে থাকে।

সেই অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলঃ-

১) সম্যক দৃষ্টি বা সঠিক উপলব্ধি- এর ফলে চতুরার্য সত্যগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারা যায়।

২) সম্যক সংকল্প- অর্থাৎ, দৃঢ় বাসনা রাখা সত্য বা নির্বাণলাভ করার জন্য।

৩) সম্যক বাক্য- কোনোরকম মিথ্যাকথা, কটু বা কঠোর বাক্য, পরনিন্দা, বৃথা আলাপ ও মূর্খের মতো বাক্যালাপ না করা।

৪) সম্যক আচরণ- কোনোরকম প্রাণীহত্যা, চুরি, অন্যায় ও অসংযম আচরণ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজে বিরত থাকা।

৫) সম্যক আজীব- সুস্থ ও সবল থাকার জন্য সদালাপ ও সদাচারে অভ্যস্ত হয়ে সৎ উপায়ে বা সৎভাবে জীবন ধারন করা। সম্পূর্ণভাবে পাপ ও কলূষমুক্ত হয়ে জীবন কাটানো।

৬) সম্যক প্রচেষ্টা- মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র রাখার জন্য সব সময় অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকার ও ভালো কাজের চেষ্টা করা।

৭) সম্যক স্মৃতি- দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ সজাগ ও সচেতন রাখা।

৮) সম্যক সমাধি- পরিপূর্ণ একাগ্রতা বা সমাধি বা ধ্যান। সমাধির চারটি স্তর আছে এবং শেষ স্তরে গিয়ে নির্বাণ লাভ হয়। এই নির্বাণ অবস্থায় মানুষের যাবতীয় মোহ, চাহিদা, লোভ, তৃষ্ণা বা আকাঙ্খা এবং অবিদ্যা চিরতরে দূর হয়ে যায়। সেই ব্যক্তি জন্ম-মৃত্যুর জাল থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং তাঁর সমস্ত দুঃখের অবসান হয়।

এইভাবে গৌতম বুদ্ধ কৃষকরূপে আমাদের মনে সত্য ও নির্বাণলাভের আকাঙ্খার বীজ বপন করে আমাদের যাবতীয় ভালো গুণগুলোর চাষ করে আমাদের প্রকৃত মানবতার পথ দেখিয়েছেন এবং সোনার ফসল ফলিয়েছেন। দুঃখ নামক আগাছাকে একেবারে সরিয়ে আমাদের পরম সুখ বা নির্বাণলাভের পথ দেখিয়েছেন। ভগবান বুদ্ধদেব একজন যেন প্রকৃতপক্ষে মানব-জমিনের অন্যতম সেরা কৃষক।