গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
Posted in গল্পএক ঘন্টা আগে বৃষ্টি হয়ে এখন থেমে গেছে।এখন রাত ৮ টা ৫০! দীপু ঠিক করল এখুনি বেরুবে।দীপুর শরীর আজ ভালো নেই।গা ম্যাজম্যাজ করছে। অল্প জ্বর। কড়া করে আদা দিয়ে চা খেয়েও উপকার হয়নি। এখানে হালকা শীতের আমেজ। টুপি আর মোজা পরে নিলেই হবে।মন ভালো নেই।
দীপুর মন খারাপের দুটো কারণ থাকতে পারে।
একটা হল দেশের জন্য চাপা একটা কষ্ট।ও জানে এর কোনো মানে নেই।ওর দেশ ওকে চায়না। ওকে প্রায় চোরের মতো দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল।সেও ১৫ বছর হয়ে গেছে। এখন এসব আর গায়ে লাগে না। তবুও স্বপ্নে দেশের বাড়ি বারবার ফিরে আসে। বাড়ির পেছনে কুয়োতলা , পুকুরঘাট.. মনে হয় ঘুম ভাঙলেই আবার দেখা যাবে।
মন খারাপের দ্বিতীয় কারণটি অদ্ভুত। একটা মেয়ে ওকে মাঝে মাঝে মেসেজ করে। কখনও মেসেঞ্জারে কখনও হোয়াটসঅ্যাপে। মেয়েটি বিবাহ বিচ্ছিন্ন।একা থাকে। কবিতা আবৃত্তি করে। পড়াটা বেশ সুন্দর। তবে অনেক মেয়ের মতো এর ভিতরেও রহস্য আছে।কী যে রহস্য দীপু বুঝতে পারে না।
আজ মনে হয় পারল। মেয়েটির একটা মেসেজ ওকে অবাক করে দিয়েছে। মেয়েটা দীপুকে মাঝে মাঝে ওর একা একা লড়াই করার কথা বলে। প্রিয় লেখকদের কথা বলে কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের পর কোনো নতুন বন্ধুর কথা বলে না।
বলে,স্যর একা একাই ভালো আছি।আর ও নাকি একটা সরকারী স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক।
আজ হঠাৎ জানাল,স্যর আপনাকে একটা মিথ্যে বলেছি। যে আমার সঙ্গে কারো যোগাযোগ বা বন্ধুত্ব নেই।গত তিন মাস ধরে একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিকের সঙ্গে আমার আলাপ ও কথাবার্তা হচ্ছে। ওকে আমার খুব ভালো লাগে। বলিনি পাছে ভাবেন আমি এই সব করে বেড়াই।
এতে দীপুর খুশি কিংবা আশ্বস্ত হবার কথা। যাক ওর একটা বন্ধু হলে তো ভালোই।কিন্তু ওর খারাপ লাগছে। মানুষের মন কত বিচিত্র। এটা ভেবে দীপু নিজেই অবাক।
ও যেন এই বন্ধুত্বে খুশি না।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর দীপুর মন বলল, বাড়ি ফেরা দরকার।ওর হাতে জিপিএস ট্র্যাকিং করা মোবাইল ফোন নেই। বাড়ি চিনতে পারবে তো?
ঝোঁকের মাথায় সেল ফোন ছাড়া বেরিয়ে এসেছে। এখন বুঝতে পারছে রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে?
এখন রাত ৯ টা ৪৫ মিঃ। বিদেশ বিভুঁইয়ে পথ হারিয়ে ফেলার উপযুক্ত সময়।কী হবে?
পর্ব ২
শিউলি যেখানে থাকে তার খুব কাছেই একসময় জীবনানন্দ দাশ থাকতেন। এখন সেখানে একটা ছেলেদের হোস্টেল তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে রাত্তিরে হৈ হল্লার শব্দ ভেসে আসে। কখনও খুব জোরে ইংরেজি গান বাজে।
শিউলি এই বাড়িতে একা থাকে।ওর নিজের বাড়ি। এই বাড়িটা ওর বাবা বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন। বিয়েটা আড়াই বছর টিকে ছিল।ওর বর ছিল ভালো মানুষ। দেশে কিছু জমি জমা আছে। বাড়ির ছোট ছেলে।সখের বাজারে একটা স্টেশনারি দোকান আছে ওদের।বেশ ভালো ও স্বচ্ছল ভাবে চলে যাওয়ার কথা।বর ৫ ফুট আট,দোহারা চেহারা।ডান ভুরুর ওপর কাটা দাগ আছে। বিয়ের ৩ মাসের মধ্যে শিউলি টের পায় লোকটা স্বাভাবিক নয়। হঠাৎ হঠাৎ ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে।কারা নাকি ওকে ধরতে আসছে।ওর বাড়ির লোকেরা জানত কিন্তু বলেনি। ভেবেছিল বিয়ে করলে সেরে যাবে। অনেক চেষ্টা করে নিউরোলজিস্ট এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল শিউলি।দেখে শুনে তিনি বললেন,নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে।সব সময় সতর্ক থাকা দরকার। এই রোগ উপশম হবে কিন্তু পুরোপুরি সারবে না। শিউলি ৫ ফুট ৪, একমাথা ঘন কালো চুলের অধিকারী, মেঘের মতো রঙ। বন্ধুরা বলত ওকে নাকি রবি ঠাকুরের বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মতো দেখতে।কিশোরী বয়স থেকে এই কথা শুনে শুনে ওর মনে হত, হতেও তো পারে। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর ও ভার্সিটি থেকে বি এড করে বাড়ির কাছেই একটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কো এড স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে এবং কাউন্সেলর ও স্পেশাল এডুকেটরের দায়িত্ব সহ চাকরি পায়।
এর এক বছরের মাথায় বাবা ওর বিয়ে দেন।
বিয়েটা টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেছিল শিউলি।কারণ বর মানুষটি ছিল ভালো।পরে ও বুঝতে পারে ওর বর ওষুধ না খেয়ে ফেলে দেয়।তার বদ্ধমূল ধারণা ওষুধের মধ্যে বিষ আছে। বাড়াবাড়ি হলে মানুষটাকে মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করতে হয়।৩ মাস পরে আবার একবার ।দোকান বিক্রি করে ওর বর নিজের বাড়িতেই চলে যায়।আর ফেরেনি। শিউলিও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এরপর শিউলি সপ্তাহে তিন দিন হাই স্কুল ও কলেজের কিছু ছাত্র ছাত্রীকে ইংরেজি পড়ানো শুরু করে নিজের বাড়িতে।এ ছাড়াও ও গোপনে কবিতা ও ডায়রি লেখে। আবৃত্তি সংসদে কবিতা আবৃত্তির ক্লাস করে। তার প্রিয় কবি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তবে জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এমনকি ভারতের দীপক রায়ের কবিতাও তার ভালো লাগে। ফেসবুকের পাতায় ও দীপক রায়ের কবিতা পড়ে ফিদা হয়ে যায়।
'আমি তার অলিখিত চিঠি মনে মনে পড়ে ছিঁড়ে ফেলি'।
এই লাইনটা ওকে কিছুদিন আচ্ছন্ন করে রাখে। তারপর একদিন ভয়ে ভয়ে দীপক রায়কে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
নো রেসপন্স।৭ দিন ×২৪ঘন্টা কেটে যাবার পর
ও যখন লজ্জায় রিকোয়েস্ট উইথড্র করবে ভাবছে তখন হঠাৎ করেই একটা মেসেজ আসে মেসেঞ্জারে।
শিউলি, আপনি কি রিয়াল?
মানে?
জানতে চাইছি আপনি কি মানবী না যান্ত্রিক?
কথা শুরু হয় এইভাবে।
কবিতা থেকে রাজনীতি নানা ধরণের কথা। খুব একটা ব্যক্তিগত কিছু নয়।গোড়ার দিকে।সেই থেকে দীপুদা এবং তুমি।ও যদিও আপনি এবং স্যর সম্বোধন চালিয়ে যাচ্ছে।
সেদিন রাতে কথাবার্তার ফাঁকে দীপুদা বলে: তুমি বিয়ের আগে কাউকে ভালবাসতে?
শিউলি বলে: আমি অংশু বলে একটা ছেলেকে খুব পছন্দ করতাম।
তারপর?
তারপর আর কি?
ওর বোধহয় আরো স্মার্ট সুন্দরী মেয়ে পছন্দ ছিল।তাই একজনকে বিয়ে করেছে। সুন্দর দেখতে। পাঁচতারা হোটেলে রিশেপশনে বসে।
একটা বাচ্চা আছে। তবে...
তবেটা কী?
যা হয়। অংশু অধ্যাপনা সেরে বাড়ি ফিরে বাচ্চা সামলায়। অংশু আর ওর মা।
মেয়েটা রাত করে অন্য পুরুষের গাড়িতে বাড়ি ফেরে।
পর্ব ৩
দীপুর শরীর ভালো নেই।গলা খুশ খুশ করছে।গলার স্বর অচেনা। মাঝে মাঝে কাশি হচ্ছে। হাইপার রিয়ালিটির মধ্যে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা ওর আছে।তার জন্য উমবার্তো ইকো পড়তে হবে?কেন?ও মনে মনে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল। আর এই শিউলি নামের মেয়েটা ওকে ভাবাচ্ছে।একই সঙ্গে সরল এবং জটিল। হস্টেলে থাকতে রবি ঠাকুরের সঙ্গে ওর একটা ছবি পোস্ট করেছিল। মৃণালিনী দেবীর জায়গায় নিজের মুখ বসিয়ে।সে কি হৈ চৈ! সেটা ছিল যুবক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবি।
এর কিছুদিন পরে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আর একটা ছবি পোস্ট করে।
ও বলে এটা ছিল একটা খেলা।প্রিয় মানুষের সঙ্গে নিজেকে কেমন দেখায় সেটা পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া। তখন ও বি এ ক্লাসের ছাত্রী।অনেকে বলত ওর মুখের আদল কাদম্বরী দেবীর মতো।ও মাঝে মাঝে মিলিয়ে দেখত। তবে কাদম্বরী দেবীর পরিণতি ও চায়না।
দীপুর একটা কবিতা পড়ে ও লিখেছিল : কবিতা সত্যি এতটা পারে? আপনি কবিতাকে এতটাই বিশ্বাস করেন?
কি আশ্চর্য তারপর থেকে দীপু আর কবিতা লিখতে পারছে না। ইচ্ছেও করছে না। পৃথিবীর দুই গোলার্ধে মেঘ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে।আর দীপু কবিতা না লিখে অনলাইনে দাবা খেলছে এক অচেনা প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে।
:স্যর আপনাকে একটা মিথ্যে কথা বলেছি। ভাবলাম সত্যি বললে যদি খারাপ ভাবেন। যদি ভাবেন,ও, তার মানে এইসব করে বেড়ানো হয়।গত তিন মাস যাবত এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। কথাবার্তা হচ্ছে মাঝে মাঝে। ওকে আমার ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আপনাকে বলতে কুন্ঠা হচ্ছিল।
এতে আশ্বস্ত হবার বদলে দীপুর একটু খারাপ লাগছে কেন? ঈর্ষা? আলফা ইগো?
ওর একজন অনুরাগীর কাছে গুরুত্ব কমে যাওয়ায় ভয়?
প্রথমে ঠিক করেছিল, উত্তর দেবেনা।পরে মত পাল্টে লিখল, ফাঁকা থাকলে ভিডিও কল করো। নতুন শহরটা তোমাকে দেখাব। রাস্তা,বাড়ি,ম্যাপল পাতা, আরো অনেক কিছু..
উত্তর এল: ভিডিও করে পাঠিয়ে দিন। নিশ্চয়ই দেখব।
কল করলে আপনার পরিবারের লোকজন বিরক্ত হবেন। আমি এটা বুঝতে পারি।
দীপু এর উত্তর না দিয়ে অন্য কিছু ভাবছে। ভাবছে সত্যি সত্যি মুগ্ধতার আয়ু কতদিন থাকে? কবিতা কি মানুষকে ধরে রাখতে পারে? কতদিন?
এর উত্তর রবীন্দ্রনাথ জানতেন। জীবনানন্দ জানতেন। দুজনেই তাদের কবিতায় উত্তর দিয়েছেন।
দীপু ওরফে দীপক রায় বড়ো কবি নয়। একজন রক্ত মাংসের মানুষ।ওর মনে পড়ল সম্প্রতি একজন বাংলা ভাষার কবি মারা গেছেন।তার একটা ব ই এর নাম ছিল যুঁই ফুলের জন্য স্তবগাথা। শোনা যায় একজন ঔপন্যাসিককে উৎসর্গ করে
বইটা লেখা।শোকসভায় তিনি, সেই ঔপন্যাসিক,নাকি এসেছিলেন। স্মৃতিচারণ ও করেছেন।কবি জানতে পারেনি। মৃত্যুর পর কিছু জানা যায়না।্আরেকজন কবি বিনয় মজুমদার একজন বিখ্যাত মানুষকে নিয়ে একটা আস্ত বই লিখেছেন।কী হয়েছে তাতে?
বিখ্যাত মানুষটি নাকি বিনয়কে চিনতেন না।
দীপু এখন বারান্দায় পায়চারী করছে।ওর হোয়াটসঅ্যাপ হঠাৎ বেজে উঠল।
স্যর, আমি শিউলি! অনেক রাত। এখনও জেগে আছেন? আমার ওপর রাগ করেছেন?
না করিনি।কেন করব?
আমি জানি। করেছেন।যা লিখেছি সব বানানো। মিথ্যে। আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য।
এখন একটা ভিডিও কল করতে চাই। আমাকে আপনার নতুন বাড়ি, সামনের রাস্তা, আপনার নতুন শহরের রাত্রি দেখাবেন না?










