গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in গল্পএই শান্ত ইছামতী, নীলজল, বালিমাটি, অবিরাম স্রোত – এই নদীর পাশেই আমাকে বসিয়ে রাখো। আমি আর ঘরে যাবো না!
আমার ঘর? কোথায়? বসিরহাট? ধালতিথা গাঁয়ে? সত্যিইই কি এখানে আমি থাকি? এক সময়ে তো আমাদের দেশ ছিল পূর্ব পাকিস্থানে। তারপরে বাবা-মার সাথে পালিয়ে চলে গেলাম বার্মায়। সেখান থেকে এই পশ্চিমবাংলায়। এখানে এসেও বাংলার একোন ওকোন ঘুরেছি। সেসব অনেক বেত্তান্ত! অনেকদিন হয়ে গেলো ডেরা বসিয়েছিলাম বসিরহাটে।
আমার পুরোণো দিনের গল্প? না না ওসব ছেদো কথা আর কেই বা শুনতে চায়! বউ অভিমান করে আকাশে চলে গেছে। আমি এখন একলাই বলা যায়। অবশ্যি গাঁয়ে আমার একটা বাড়ি আছে, জমি আছে। বাড়িতে গরু আছে, জমি দেখাশোনা করবার লোক আছে।
একমাত্র ছেলেটা পড়াশুনা করলো, ভালো চাকরী পেলো, বিয়ে করলো। তারপর ফ্লাট কিনলো কোলকাতার নিউটাউনে। এখন সে বউ বাচ্চা নিয়ে সেখানেই থাকে।
বসিরহাটের এই গাঁয়ে আমার ছেলে থাকবে না! এখানে থাকতে ওর অসুবিধে। তাছাড়া অফিস টপিস অনেকটা দূরে! কি আর করবো। আমি একলাই এখানে থাকি। মাঝে মধ্যে ছেলের ফোন আসে, আমাকে বলে বসিরহাটের বাড়ি আর জমিটা বিক্রি করে নিউটাউনের ফ্লাটে চলে আসতে।
ভাবছি, ছেলেকে বলবো, তুইই খদ্দের ডেকে বসিরহাটের সম্পত্তিটা বেচার ব্যবস্থা কর। ল্যাটা চুকে যাক। তারপর এই আকাশ আমার, এই ইছামতী নদী আমার। আমি না হয় এখানেই একটা ঝুপড়ি ঘরে ভাড়া থাকবো! তোর মতো এ জায়গা ছেড়ে আমি শহরে যাবো না।
# # #
অনেকক্ষণ ধরে দেখছি নদীতে কতগুলো নৌকা ভাসছে। হঠাৎ একটা নৌকা কাছে এগিয়ে এলো। সেটাকে পাড়ে থামিয়ে দিয়ে কাদের মিঞা ডাকলো – ‘মজুমদার কাকা! যাবে নাকি আমার নৌকায়?’
‘কোথায় যাবো? মাছ ধরতে? তা চলো বাপু। এমনি তো বসেই আছি। তোমার সাথে এট্টু ঘুরেই আসি।’
ডিঙি নৌকা। তাতেই চড়ে বসলাম। কাদের মিঞা নৌকা ভাসিয়ে দিলো নদীতে। ভাসছি আর ভাসছি। জলের দেশে কোনো জমি নেই, ঘরের পাঁচিল নেই, ফ্লাটের কলিং বেল নেই। আছে খোলামেলা আকাশ আর মহাসাগরের দিকে বয়ে যাওয়া জলস্রোত।
মাছের আশটে গন্ধ। কাদের মিঞার জালে মাছ উঠছে। শির শির হাওয়া বইছে। বললাম, ‘কাদেরভাই, এট্টা বিড়ি দাও দেহি।’
বিড়ি ফুকতে ফুকতে এই মুহূর্তে আমি নিজেকে একজন ভেসে যাওয়া মানুষ ভাবতে লাগলাম। ভেসে যাওয়া মানুষ কেমন হয়? যেমন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন একটা বুড়ো, যেমন অগুন্তি মানুষের ভীড়ে হেঁটে যাওয়া এক উদ্বাস্তু, যেমন ঝাকরা চুল বিশাল গাছের থেকে হাওয়াতে উড়ে যাওয়া একটা পাতা। দেখো, এই ইছামতীর স্রোতে ভেসে ভেসে দিশাহীন সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা নিঃসঙ্গ কচুরীপানা। একটা নয়, অনেকগুলো!
# # #
ওদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে একটা অন্তর্জলি চিন্তায় আমার দুচোখ ভরে জল এলো।
এমন সময়ে মোবাইলের কে কল করছে? ও বাবুসোনা! ভেসে এলো ছেলের কথাগুলো – ‘বাবা, বসিরহাটের জমিজমা আর বাড়িটার জন্যে একটা ভাল কাস্টমার পেয়ে গেছি। রোববার দুপুরে আমি আসছি। তুমি একদম ঘরে থেকো, এদিক ওদিক যেও না কিন্তু!’