প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রবন্ধযদি সাংসদ/ বিধায়কেরা ঘুষ খান?
গত মার্চ মাসের তিন তারিখে সুপ্রীম কোর্টের সাত সদস্যের কন্স্টিট্যুশনাল বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছে যা অনেক সাধারণ নাগরিকের আহত বোধবুদ্ধিতে মলম লাগানোর কাজ করবে।
যখন ১৯৯৮ সালে, একই সুপ্রীম কোর্টের অন্য একটি কন্স্টিট্যুশনাল বেঞ্চ (পাঁচ সদস্যের) নরসিংহ রাও বনাম ভারত সরকার(সিবিআই কোর্ট) কেসে, ৩-২ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে, রায় দিয়েছিল যে আইনপ্রণেতারা আইনসভায় (পড়ুন সংসদে/বিধানসভায়) ভোট দেবার জন্য উৎকোচ নিলে তাঁদের ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারায় শাস্তি দেবার জন্য কোন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না, তখন আমরা চমকে উঠেছিলাম।
এ কেমন কথা? ঘুষ নিলে শাস্তি হবে না? ছোটখাটো সরকারি কর্মচারিকেও ঘুষ নেবার অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেলে যেতে হয়, চাকরি চলে যায়। আর এঁরা?
আইনপ্রণেতারা?
আমাদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে এটাই ধরা হত যে তাঁদের তো সীজারের পত্নীর মত সাফসুতরো পবিত্র হওয়া উচিত। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিল যে তাঁরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। আমরা অবাক। তাহলে কি ভোট দিয়ে আমাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করি ঘুষ নেবার জন্যে?
আমাদের অন্তরাত্মা না না করে উঠেছিল। বলছিল—দিস ইজ নট ডান্।
কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বেঞ্চ ওই রায় দিয়েছেন, তাঁদের আইনের ব্যাখ্যা এবং জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করার এবং অধিকার ও সাহস আমাদের মত হরিদাস পালের কী করে হবে? আবার কখন যে আদালতের গোঁসা হবে এবং আদালত অবমাননার দায়ে কেস খেতে হবে তাই বা কে বলতে পারে!
সেইজন্যেই গত ৩ মার্চের সুপ্রীম কোর্টের রায় আমাদের আহত বিবেকে কিঞ্চিৎ পুলটিস দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
এর থেকে দুটো কথা বা দুটো প্রশ্ন উঠে আসে—এক, সর্বোচ্চ আদালতের মহামান্য বিচারকেরা কি সর্বজ্ঞ? দেখতেই পাচ্ছি, তা নয়। নইলে একই আসন থেকে আগের রায় ১৮০ ডিগ্রি বদলে যায় কী করে? ইন্ডিয়ান পেনাল কোডও একই রয়েছে, সংবিধানের মূল ভাবনা বা বেসিক নেচার আজও বদলে যায় নি। তাহলে?
অবশ্যই তাঁরা সর্বজ্ঞ নন, ত্রিকালদর্শী তো নন বটেই, তাহলে তো তাঁরা ভগবানই হয়ে যেতেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, দেশের আইন এবং সংবিধানের ব্যাপারে তাঁরাই শেষ কথা। তাই তাঁদের স্থান ঈশ্বরের ঠিক দেড় ইঞ্চি নীচে।
দুই, আরেকটা ব্যাপার। আম জনতার যে প্রাকৃতিক ন্যায়ের বোধ আছে তাকে শিক্ষিত মননে একেবারে অগ্রাহ্য করা ঠিক নয়। আইনেও এই প্রাকৃতিক ন্যায়ের ধারণার (cannon of natural justice) স্বীকৃতি রয়েছে।
তবু মনটা খচখচ করে। সেই ২৬ বছর আগে, ১৯৯৮ সালে, যাঁরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও এবং ঝারখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেনের তথাকথিত লেনদেন নিয়ে –যা তখন স্যুটকেস কান্ড নামে কুখ্যাত হয়েছিল—সি বি আইয়ের স্পেশাল কোর্টের রায় বাতিল করে অমন একটা ইউনিক রায় দিয়েছিলেন তাঁরাও তো কিছু ভেবেই অনেক বিচারবিমর্ষ করেই রায় দিয়েছিলেন।
জাজমেন্টে বহু পাতা খরচ হয়েছিল। তাতে সি বি আই কোর্টের রায় কেন ভুল তার চুলচেরা ব্যাখ্যা লিখতে হয়েছিল। তাহলে আইনের বা সংবিধানের কোন নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচুড়ের নেতৃত্বে এই সাতজনের সংবিধান পীঠ একমত হয়ে আগের রায়কে উলটে দিল?
সেটা বুঝতে আমরা পুরনো স্মৃতি ঝালিয়ে নিয়ে সেই ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেব।
আগের রায়ের যুক্তিগুলো একটু দেখব, তারপরে বর্তমান রায়ের।
ঘটনাটি কী ছিল?
তারিখটি ২৬ জুলাই ১৯৯৩। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের নরসিংহ রাও।
চমৎকার জোড়াতালি দিয়ে অল্পমতের সরকার চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত বিতর্কিত বিষয়ে নিষ্ক্রিয় থাকেন। মনে করেন সমস্যা নিজে নিজেই তার সমাধান খুঁজে নেবে। তাঁর হস্তক্ষেপ অনাবশ্যক। মাত্র আট মাস আগে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ তারিখে তাঁর কথিত নিষ্ক্রিয়তার ফলে কয়েক শতাব্দী পুরনো বাবরী মসজিদ কয়েক ঘন্টায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কুলোকে বলে—এই কথিত নিষ্ক্রিয়তার পেছনে তাঁর মৌন সমর্থন ছিল।
এই টালমাটাল সময়ে সিপিএম দলের এক সাংসদ অজয় মুখোপাধ্যায় ওই তারিখে সংসদে নরসিংহ রাও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। তখন ৫২৮ সীটের সংসদে কংগ্রেসের ছিল ২৫১ জন; আবশ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে ১৩ কম।
কিন্তু বিপক্ষের ১৪ জন অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ায় রাও সরকার অল্পের জন্যে বেঁচে গেল। একবছর পরে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে ঝারখণ্ড মুক্তিমোর্চার সাংসদেরা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য ঘুষ নিয়েছিলেন। আরও শোনা গেল জনতা দলের নেতা অজিত সিংও (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিংয়ের ছেলে এবং বর্তমান রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতা জয়ন্ত চৌধুরির পিতা) ভোটাভুটির সময় অনুপস্থিত থাকার জন্যে টাকা নিয়েছিলেন।
সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন ১৯৯৬ সালে তদন্ত শুরু করে এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও, ভারতীয় লোকদল নেতা অজিত সিং এবং ঝারখন্ড মুক্তিমোর্চার ছ’জন সাংসদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে। অভিযুক্তরা দিল্লি হাইকোর্টে গেলে হাইকোর্ট তাদের আবেদন খারিজ করে দেয়। তখন তাঁরা সুপ্রীম কোর্টের শরণাপন্ন হন।
সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ সদস্যের পীঠের সামনে বিচার্য বিষয় ছিলঃ সংবিধানের আর্টিকল ১০৫(২) এবং ১৯৪ (২) এর হিসেবে আইন প্রণয়নকারীরা , তাদের পদের সুবিধার্থে ক্রিমিনাল প্রসিকিউশন থেকে বিশেষ রেহাই পেতে পারেন কিনা।
বহুসংখ্যক মতের নেতা বিচারপতি ভারুচা এবং বিচারপতি রাজেন্দ্রবাবুর মতে যারা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্যে ঘুষ নিয়েছেন তাঁদের আদালতে শাস্তি দেওয়া যায় না। কারণ আর্টিকল ১০৫(২) অনুসারে সাংসদদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না; তাঁরা সুরক্ষিত।
আর্টিকল ১০৫ (২) বলছেঃ সংসদের কোন সদস্যকে আইনসভায় বা কোন সমিতিতে কোন বক্তব্য রাখার জন্য বা কোন বিষয়ে ভোট দেওয়ার জন্য কোন আদালতে দণ্ডিত করা যাবে না।
আর আর্টিকল ১৯৪ (২) একই কথা বলছে, তবে বিধানসভার সদস্যদের জন্যে। এইরকম সুরক্ষা কবচের উদ্দেশ্য কী?
জাস্টিস ভারুচা বলছেন এর উদ্দেশ্য সংসদে সদস্যদের বাক স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়া, যাতে তাঁরা নির্ভয়ে, কোন বদলার আশংকা থেকে মুক্ত হয়ে, স্বাধীনভাবে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁর মতে এর উদ্দেশ্যকে একটু ব্যাপক অর্থে বুঝতে হবে যাতে সাংসদদের -- সংসদে যা বলেন ও করেন তার জন্য-- কোনরকম দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত না হতে হয়। জাস্টিস জি এন রে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সহমত।
এই রায়ের ফলে ঝারখন্ড মুক্তি মোর্চার সাংসদরা রেহাই পেয়ে গেলেন। কিন্তু অজিত সিং নন। কারণ, উনি সংসদে ভোটও দেন নি, কোন বক্তব্যও রাখেন নি। তেমনি নরসিংহ রাও রেহাই পেলেন না; কারণ উনি ঘুষ নেন নি, দিয়েছেন! তাই জেলে গেলেন।
অর্থাৎ, ঘুষ দিলে শাস্তি, নিলে নয়! আইনের এই ব্যাখ্যায় আমাদের মতন সাধারণ মানুষের মাথা তাঝঝিম মাঝঝিম করে উঠল।
কিন্তু বাকি দু’জন বিচারপতি এস সি আগরওয়াল এবং জাস্টিস ডক্টর এ এস আনন্দ এই ব্যাখ্যায় একেবারেই সন্তুষ্ট নন। তাঁদের মতে ঘুষ খাওয়ার অপরাধে যদি শাস্তি না হয়, উলটে আইনের কূট ব্যাখ্যায় সুরক্ষা কবচ দেওয়া হয় তাহলে আইনপ্রণেতাদের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবেনা। তাঁরা আইনের উর্ধে বিচরণ করবেন। সংবিধানের আর্টিকল ১০৫ (২) প্রণয়নের উদ্দেশ্য তো এমন নয়।
যে সাংসদ সংসদে তাঁর স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতাটি ঘুষের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলেন তাঁকে রেহাই দেওয়া মানে আগামী দিনে আরও অপরাধ করার লাইসেন্স দেওয়া। এঁদের মতে সঠিক ব্যাখ্যা হল সংসদে কোন বক্তব্য রাখা বা কোন পক্ষে বিপক্ষে ভোট দেওয়া আর তার আগে ঘুষ নেওয়া—দুটোকে আলাদা করে দেখা এবং বিচার করা। তাহলে ভোট বা বক্তব্যের জন্য দণ্ডিত করা যাবে না, কিন্তু ঘুষ নেওয়ার জন্য যাবে।
বিচারপতি আগরওয়ালের মতেঃ যে মুহুর্তে কেউ ঘুষ গ্রহণ করল সেই মুহূর্তে অপরাধটি সংঘটিত হল। ঘুষ নেওয়ার পরে সাংসদ ঘুষের শর্ত অনুযায়ী ভোট দিলেন কি দিলেন না –সেটা অবান্তর। অর্থাৎ, কেউ যদি ঘুষের টাকা নিয়ে যেমন শর্ত ছিল সেরকম ভোট না দিয়ে নিজের ইচ্ছেমত দেয়, তবু সে ঘুষ নেবার অপরাধের দণ্ড থেকে ছাড় পাবে না। ঘুষ দাতাদের কথামত কাজ করি নি—এই ডিফেন্স চলবে না।
এত কথাও বলার উদ্দেশ্য –সেই সময়ের ওই অল্পসংখ্যকের মতটি আজকে সাতজনের সাংবিধানিক পীঠ মেনে নিয়েছে। ছাব্বিশ বছর আগের বহুসংখ্যকের রায়টি খারিজ করা হয়েছে।
বর্তমান সাংবিধানিক পীঠের ব্যাখ্যাঃ
এঁদের মতে বৃটিশ পার্লিয়ামেন্টে হাউস অফ কমন্সের সদস্যদের বহুযুগ ধরে যে “প্রাচীন এবং নির্বিবাদ” সুবিধেগুলো রয়েছে—সেগুলি ইংল্যাণ্ডের রাজা এবং পার্লিয়ামেন্টের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের ফলে অর্জিত। ভারতে ওগুলো এসেছে ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকে। স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কথিত সুবিধেগুলো আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। আজ দরকার সেগুলোর এমন ব্যাখ্যা যা আজকের ভারতের সংবিধানের মূল ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পার্লিয়ামেন্টারি প্রিভিলেজ বা সংসদের বিশেষাধিকারের দুটো ভাগঃ
এক, যা সংসদ সামুহিক রূপে উপভোগ করে। যেমন সংসদের অবমাননার জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া, বা নিজেদের কাজকর্ম নিজেদের নিয়মানুযায়ী পরিচালনা করা।
দুই, সাংসদদের ব্যক্তিগত বিশেষাধিকার। যেমন, সংসদে স্বাধীনভাবে নিজের বক্তব্য রাখার অধিকার। সুপ্রীম কোর্টের মতে এই অধিকার অসীমিত নয়, একে আবশ্যকতার কষ্টিপাথরে (test of necessity) পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এই বিশেষাধিকার অবশ্যই এমন হতে হবে যা না থাকলে সাংসদ স্বাধীনভাবে নিজের কাজ করতে পারবেন না।
স্পষ্টতঃ যে অর্থে সংসদে মতপ্রকাশের এবং ভোট দেবার স্বাধীনতা আইনপ্রণেতাদের সফল ভূমিকা পালনের পূর্বশর্ত, সেই অর্থে ঘুষ নেবার অধিকার তাঁদের ভূমিকা পালনের পূর্বশর্ত হতে পারে না। সর্বোচ্চ আদালত আরও বলেনঃ আইনপ্রণেতাদের ভ্রষ্টাচার এবং ঘুষ দেওয়ানেওয়া ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এগুলো সংবিধানের আদর্শকে ধ্বংস করছে এবং নাগরিকদের দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের লাভ থেকে বঞ্চিত করে এক ভ্রষ্ট রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করছে।
এরপর সুপ্রীম কোর্ট বিচার করল সেই পুরনো প্রশ্নটিক-- quid pro quo!
ধরা যাক, একজন সাংসদ ঘুষ নিল , অথচ ঘুষদাতার নির্দেশ মত ভোট না দিয়ে নিজের বিবেকের হিসেবে ভোট দিল। অর্থাৎ, কোন ক্ষতিকারক লেনদেন (quid pro quo) হল না, তাহলেও কি তার টাকা নেওয়ার কাজটি ঘুষ বলে ধরা হবে এবং দণ্ডনীয় হবে?
সাংবিধানিক পীঠ প্রশ্নটিকে ভ্রষ্টাচার নিরোধক অধিনিয়মের (Prevention of Corruption Act) ধারা ৭ এর প্রেক্ষিতে বিচার করল। এতে “সরকারি কর্মচারিদের ঘুষ নেওয়া বিষয়ক অপরাধে”র ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী –কোন বিশেষ কাজ ‘করা’ বা ‘না করা’র বদলে কোন অন্যায় সুবিধে নেয়ার জন্যে মাত্র ‘চেষ্টা’ করা বা ‘গ্রহণ’ করাই এই অপরাধ সিদ্ধ হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। অতএব, আবশ্যক নয় এটা দেখা কি, যে কাজ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ঘুষ দেওয়া হয়েছে সেটা করা হল কিনা। টাকা নেয়াই যথেষ্ট। সরকারি কর্মচারি বা জনপ্রতিনিধিটি শেষে কী করলেন বা, কি করেন নি—সেটা বিচার্য বিষয় নয়।
কিন্তু এই শেষ নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলঃ জনপ্রতিনিধি বা আইনসভার সদস্যদের আদালত বিচার করতে পারে কি ?
পার্লিয়ামেন্টেরও ক্ষমতা আছে ঘুষ নিয়ে সংসদের সম্মানহানির করার জন্যে তার সদস্যদের শাস্তি দেবার। সেটা সংসদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা বা জেলে পাঠানোও হতে পারে। তাহলে কি আদালতের এ’ব্যাপারে নাক গলানো উচিত?
একই অপরাধে দুটো বিচার এবং দু’রকম শাস্তি? এটা কতদূর ন্যায়সংগত?
সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক পীঠের রায়ঃ
আইনপ্রণেতাদের ঘুষ নেবার অপরাধের জন্যে আদালত এবং সংসদের বিচার সমান্তরাল ভাবে চলতে পারে। কারণ, সংসদে অপরাধী সাংসদদের শাস্তি দেবার উদ্দেশ্য আলাদা আর দেশের আদালতে পেনাল কোডে বিচারের উদ্দেশ্য আলাদা।
পাঠকদের মনে পড়বে ২০০৫ সালে ১১ জন সাংসদের( ১০ জন লোকসভা, ১ জন রাজ্যসভা) সংসদে প্রশ্ন করার শর্ত হিসেবে টাকা নেওয়ার ভিডিও যা “আজ তক” নিউজ চ্যানেলের স্টিং অপারেশনের ফল। এর মধ্যে ৬ জন বিজেপি দলের, বাকিদের মধ্যে কংগ্রেস, আরজেডি এবং বিএসপি (১) । তখন রাজনৈতিক দলগুলো অপরাধী এমপিদের সাসপেন্ড করে।
কিন্তু তৎকালীন স্পীকার প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় খুব কড়া মনোভাব নিয়ে দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে এর তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশে দোষী সাংসদদের সদস্যপদ হারাতে হয়।
সদস্যেরা ঘুষ নিলে সংসদের সম্মানহানি হয়; নাগরিকদের চোখে সংসদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তাই সংসদ দোষীদের নিলম্বিত করে। কিন্তু ঘুষ নেবার অপরাধ দেশের আইনের চোখে গোটা সমাজের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ।
কাজেই সাংসদের ঘুষ খাওয়ার বিচার শুধু সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়না। আদালতে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারায় বিচার হওয়া উচিত।
টেলপীসঃ
অজিত সিং এবং পিভি নরসিংহ রাও দুজনেই বহুদিন হল প্রয়াত। অপরাধীর মৃত্যুর সঙ্গে তার ক্রিমিনাল লায়াবিলিটি সমাপ্ত হয়ে যায়। আর নরসিংহ রাও কিছুদিন জেলেও ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল -বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার, মাত্র ক’দিন আগে, প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওকে মরণোপরান্ত ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত-রত্ন’ প্রদান করেছেন।
জয় হিন্দ্ !
(১) টাইমস অফ ইণ্ডিয়া, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৫।