গল্প - সুস্মিতা হালদার
Posted in গল্প(এক)
সকাল থেকে একটা ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছে, ফেসবুকে। আর তা নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কেচ্ছা চলছে গোটা সোশ্যাল মিডিয়া জগতে। দুধে-আলতা রঙের একটা চিকন শিফন শাড়িতে একটি মেয়ে। বয়েস এই বাইশ-তেইশ হবে। কাপড়ের গোলাপ বসানো শর্ট স্লিভ ব্লাউজ়ে। ক্লাচার দিয়ে আলগাভাবে আঁটা পশমের মতো হালকা-বাদামি চুলগুলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে কাঁধের কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে একজন বছর চল্লিশ-পঞ্চাশের ‘ভদ্রলোক’। একটা সি গ্রিন কালারের এক্সিউভি গাড়িতে আলগাভাবে ঠেস দিয়ে মেয়েটা তাকিয়ে রয়েছে অন্যদিকে। পাশের লোকটির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। লোকটি বারবার চেষ্টা করেই চলেছেন তাঁর দিকে মুখ ফেরাতে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে রাখা গাড়িটা। লালফুলে ঢেকে আছে রাস্তাটা। গাড়ির ওপরও পড়ে রয়েছে কিছু ফুল। এমন একটা রোমান্টিক মুহূর্তের দুটো অসম বয়েসি নারী-পুরুষের প্রেম কার চোখ এড়াতে পারে? লোকটির মুখটা দেখা যাচ্ছিল না প্রথম দিকে। ক্যামেরাম্যানের দুর্ভাগ্য সেটা। মেয়েটিকেই দেখা যাচ্ছিল শুধু। বৃষ্টিভেজা একটা বিকেল। মেয়েটির মুখটাও অভিমানের মেঘে ঢাকা।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। ভিডিওটাতে দুটি চরিত্রের কারোর কোনও কথা শোনা যাচ্ছে না। মিউজ়িকে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। মানভঞ্জনের পালা চলতে চলতে হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে যায়। মেয়েটির অভিমানের মেঘ গাঢ় হতেই সে চলে যেতে চায়। লোকটি জোর করে কাছে টানেন তাকে। টাল সামলাতে না পেরে মেয়েটি লোকটির প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়ে। তখনই ফাঁস হয়ে যায় লোকটির পরিচয়। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব চিরদীপ ভট্টাচার্য বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত? তাও আবার একটা ‘হাঁটুর বয়েসি’ মেয়ের সাথে? মুখরোচক খবর ছড়িয়ে পড়তে কি আর দেরি হয়?
(দুই)
ভিডিওটা ‘ভাইরাল’ হওয়ার পর থেকে অনেকবার করে দেখছি জানেন। নিজের ভিডিও তো। বাবা অভিনয় জগতে থাকলেও আমি তো আর সে জগতে থাকতে পারলাম না। মা-বাবার ডিভোর্সের পর আমি রয়ে গেলাম মা’র কাছে। বাবা নতুন বিয়ে করলেন। নতুন সংসার টিকিয়ে আমার সাথে আর ওঁর দেখা হয় কতটুকু? তাও যেটুকু হয়, বাড়ির বাইরে। আমাদের বাড়িতে যে বাবা ঢুকবেন না! অবশ্য মাও ঢুকতে দেবেন না। মাও তো আবার বিয়ে করেছেন, ডিভোর্সের পর, অন্য একজনকে, যিনি সমাজে বাহ্যিকভাবে আমার বাবা হিসেবে পরিচিত হলেও আমি ভালোবাসি ওই মানুষটাকেই... যাঁকে আমার প্রেমিক বানিয়ে কোনও অজ্ঞাত ক্যামেরাম্যান এমন সুন্দর একখানা ভিডিও উপহার দিলেন। আমি তো তাঁরই সৃষ্টি, তাঁরই ‘সাধের সাধনা’। উগ্র একটা ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজ়িকে ভালোই বানিয়েছেন, যার পরতে পরতে ঝরে পড়ছে নারী-পুরুষের যৌনতা। ডাউনলোড করলাম ভিডিওটা। এডিটিং সফটওয়্যারে বসালাম। ট্রোল্ড হতে বেশ ‘মজাই’ লাগছিল, জানেন। আমার বাবাও দেখেছেন, মানে আপনাদের মিস্টার নীল ওরফে নীলাঞ্জন। চাইলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাল্টা জবাব দিতেই পারতাম। থাক না, লাভ কী?
ভিডিওটা এডিটিং সফটওয়্যারে অ্যাড করে, ওই উগ্র মিউজ়িকটা অফ করলাম। অন্য একটা গান দিলাম। বাবা-মেয়ের ‘মিষ্টি সে পিছু ডাক’-এর গান।
“আয়রে আমার কাছে আয় মামণি
সবার আগে আমি দেখি তোকে
দেখি কেমন খোঁপা বেঁধেছিস তুই
কেমন কাজল দিলি কালো চোখে।”
মনে পড়ে, বাবা-মেয়ের সেই কালজয়ী জুটির কথা? ভিডিওতে দেখা যায়, বাবা তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে। একহাতে আমার হাতটা ধরা। আলতো করে আমার মাথাটা টেনে নিচ্ছে নিজের বুকে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমার চুলগুলো উড়ছে। বাবা আলতোভাবে আলগোছে গুছিয়ে দিচ্ছে সেগুলো আমার পিঠে। বাবার গাল ঠেকে আছে আমার কপালে। বর্ষার বিকেলের পড়ন্ত রোদ পড়েছে দুজনের মুখে। ভেজা বাতাসে মিশে সেই সুর ছুঁয়ে যাচ্ছে পর্দার দুই অসম বয়েসি নারী-পুরুষকে...
“ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে
সবাই আমার মতো বড় হয়ে যায়
জানিনা কজনে আমার মতন
মিষ্টি সে পিছু ডাক শুনতে যে পায়
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।”