প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধয়ুদিয়ার গভর্নর পন্তীয় পিলাতের বিচারে যিশুর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়ে গেল। ত্রিশ বছরের যিশু নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছেন সেই কাঠের ক্রশ যার ওপরে তাঁর দু হাত ও দু পায়ে লোহার শলাকা বিদ্ধ করে আমৃত্যু গেঁথে রেখে দেওয়া হবে। জেরুসালেম শহরের বাইরে এক উন্মুক্ত জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে বধ্যভূমির জন্য যাতে অনেকে সেই দৃশ্য দেখতে পায়। জায়গাটার নাম গালগাট্টা (Golgatha), মানুষের মাথার খুলির মত আকৃতি। পুরনো শহরের যে রাস্তা দিয়ে যিশু নিত্য যাতায়াত করতেন সেই রাস্তা দিয়েই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দু পাশে নারী-পুরুষের শোকার্ত, কান্নায় ভেঙে পড়া মুখ। হোঁচট খাচ্ছেন মাঝে মধ্যেই। মোটা কাঠের তৈরি ক্রশ, বেশ ওজনদার। রোমান পুলিশ চলেছে পেছনে পেছনে। রাস্তায় পড়ে গেলে তারাই তুলে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে কিছুটা পথ তারাই নিয়ে চলেছে সেই কাঠ যতক্ষণ না যিশু ঠিকমত চলতে পারে। একসময় সেই ‘দীর্ঘ’ পথ শেষ হল। যে সমস্ত মহিলারা তাঁকে অনুসরণ করে আসছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে যিশু বললেন, “জেরুসালেমের কন্যারা, আমার জন্যে কেঁদো না। বরং কাঁদো তোমার নিজের জন্যে আর তোমাদের সন্তানদের জন্যে। দেখবে এমন দিন আসবে যখন ওরা বলবে এর চেয়ে সেই মেয়েই ভাল যার গর্ভে সন্তান আসবে না এবং স্তন থাকবে শুকনো মরু।”
এপ্রিল মাসের সাত তারিখ শুক্রবার ক্রুশবিদ্ধ যিশু রক্তাক্ত। হাতের তালু, পায়ের পাতা থেকে রক্ত ঝরছে। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ যারা ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর মতকে বিশ্বাস করত। যিশুর সামনে তখন তাঁর মা মেরি। অন্য চার ভাই জেমস, জোসেফ, জুদাস ও সাইমন যিশুর অনুগত নয়, গোঁড়া খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী রোমান রাজার পক্ষে। পালক বাবা জোসেফ প্রয়াত। যিশু তাঁর অন্যতম বিশ্বস্ত অনুগামী জনকে বললেন, “আমার মাতা তোমাদেরও মাতা। তাঁর যথাযথ ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তোমার।” মাতা মেরি ছাড়াও সেখানে আরও তিনজন মেরি নামে মহিলা ছিলেন, যিশুর মাসি মেরি সালোম, জোসেফের ভাই ক্লপার স্ত্রী মেরি, আর মেরি ম্যাগডালিন। এই ম্যাগডালিনের সাথে যিশুর বহু দিন ধরে আলাপ এবং দীর্ঘদিন ধরে যিশুর একান্ত অনুগামীও বটে। যিশুর শেষযাত্রার সঙ্গী এবং ক্রুশে বিদ্ধ হতে দেখেছেন। বলা হয়, যিশুর সাথে ম্যাগডালিনের প্রেম ছিল। অনেকের মতে তাদের বিয়েও হয়েছে এমন কি সন্তানাদিও ছিল। ড্যান ব্রাউন ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ বইতে লিওনার্দোর আঁকা বিখ্যাত ফ্রেস্কো ‘দ্য লাস্ট সাপার’ দেখিয়ে বিশ্লেষণ করছেন, যিশুর দু পাশে ছ জন করে বারো জন পুরুষ অনুগামী আছে। টেবিলে তেরোটা সুরাপাত্র আর যিশুর হাতে আলাদা একটা পানপাত্র। বারোজন অনুগামীর জন্যে তেরোটা সুরাপাত্র, তাহলে ত্রয়োদশ ব্যক্তিটি কে? ব্রাউন দেখিয়ে দিচ্ছেন মধ্যমণি যিশুর ঠিক ডানদিকে আবছায়া একটা প্রতীক যা আসলে এক নারীর প্রতিমূর্তি। ভিঞ্চি ম্যাগডালিনকে এভাবেই স্মরণীয় করেছেন।
যিশুর মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের কথা লেখা থাকলেও তাঁর মায়ের কথা কোনও খ্রিস্ট ধর্মবাণী বইতে খুব একটা পাওয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, মাতা মেরির উল্লেখ খ্রিস্টিয় ধর্মসম্মত প্রচারপুস্তিকা এবং কোরানে খুবই কম উল্লেখ আছে। যিশুর ধর্মপ্রচার করেন তাঁর চার অনুগামী, জন, লিউক, ম্যাথ্যু এবং মার্ক। নাজারেথের গালীলিয় ইহুদী কন্যা অবিবাহিত এবং কুমারী মেরির গর্ভজাত সন্তান যিশু। গর্ভাবস্থায় মেরি জোসেফকে সাথে করে বেথেলহেমের গির্জায় যায় এবং সেখানেই যিশুর জন্ম হয়। এরপর মেরির উল্লেখ পাওয়া যায় যিশুর বারো বছর বয়সে। ইহুদিদের প্রথা অনুসার এক অনুষ্ঠানে গিয়ে যিশু হারিয়ে যায়। তিনদিন পরে তাকে পাওয়া গেলে বিপন্ন মেরি তাকে খুব বকাবকি করেন। এর পরের উল্লেখ এক অলৌকিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে। মন্ত্রীসভায় তখন যিশুর তিন বছর চলছে। গালীলের কানা নগরে এক বিয়ের ভোজসভায় সুরা ফুরিয়ে গেলে মেরি তাঁর ছেলেকে বলেন কিছু ব্যবস্থা করতে। যিশু মায়াবলে দেড়শো গ্যালন জলকে সুরায় পরিণত করে মাতা মেরি সমেত সবাইকে চমকে দেন। সেটাই ছিল যিশুর প্রথম অলৌকিক ঘটনার কথা। এরপর যিশু মায়ের সাথে বাড়ি যান। তখন কিন্তু জোসেফের উল্লেখ না থাকায় অনুমান করা হয় তিনি প্রয়াত। তখন থেকে যিশু তাঁর অনুগামীদের কাছে নিজেকে মসিহা বলে প্রচার করতে শুরু করেন। এই প্রচারের থেকে বিরত থাকার জন্যে মা এবং ভাইদের অনুরোধ উপেক্ষা করেন। এরপরই মেরির উল্লেখ পাওয়া যায় বিচারসভা এবং বদ্ধভূমিতে। শেষ উল্লেখ পাওয়া যায় যিশুর পুনরুত্থানের পর পঞ্চাশতম দিনে ইহুদিদের পেন্টেকস্ট উৎসবের অনুষ্ঠানে মেরির উপস্থিতি। এসবই ওই চারজন সন্তের যিশুর ধর্মপ্রচার বইতে পাওয়া যায়। মাতা মেরির পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আর কোনো কথা ধর্মীয় কোন বইয়ের কোথাও লেখা নেই। বাইবেলেও না। স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে মাতা মেরির শেষ আশ্রয় কোথায় ছিল।
যেহেতু লিখিত কিছু নেই, একেকজন একেকটা গল্প বানাতে লাগল। প্রথমে মনে করা হত যে যিশুর পুনরুত্থানের পর মাতা মেরি এবং অন্য তিন মহিলা জনের সাথে জেরুসালেমেই তাদের বাড়িতে ওপরের তলায় ফিরে আসেন এবং সকলে মিলে প্রার্থনায় যোগ দেন। কিছু লোকের মতে মেরি জেরুসালেমে ওই বাড়িতেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। যিশুর পদচিহ্ণের খোঁজে তাঁর শেষ যাত্রার পথে রোজ হাঁটতেন। সেখানেই মেরির মৃত্যুর সাক্ষী আছেন যিশুর বাণী প্রচারকেরা। অলিভ পাহাড়ের ওপর যে গির্জা আছে সেখানেই মাতা মেরির সমাধি রাখা আছে এবং প্রাচ্য গোঁড়া খ্রিস্টিয় যাজকেরা সেখানেই প্রার্থনা করেন। জেরুসালেমেই ডর্মিশন গির্জায় মেরির সমাধি আছে বলে বেনেডিক্টীয় সাধুরা বিশ্বাস করেন।
ব্রোঞ্জ যুগে আপাসা ছিল আর্যাওয়া রাজ্যের রাজধানী, যার থেকে গ্রিক এফেসস। তুরস্কে বেড়াতে গিয়ে প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম প্রিয় গ্রীক দেবী আর্টেমিসের মন্দির দেখতে এফেসসে গিয়েছিলাম। এফেসস পাহাড়ের ওপরে গিয়ে দেখি সেখানে রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্য। কথিত আছে যিশুর মৃত্যুর পর তাঁর আদেশানুসারে সন্ত জন মাতা মেরিকে নিয়ে এফেসাসে এসে এই পাহাড়ের ওপর বসবাস শুরু করেন। জীবনের শেষ কটা দিন মেরি এখানেই থাকেন। সেই বাসস্থান ঘিরে রয়েছে মন্দির। পর্যটকেরা মোমবাতি জ্বালিয়ে মনের বাসনা এবং প্রার্থনার সাথে কাপড়ের টুকরোও বেঁধে রাখেন। জনের লেখায় এর উল্লেখ পাওয়া যায় না কিন্তু এই বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে একদল গবেষক ও অনুগামী। বলা হয় দেবী আর্টেমিসের জন্যেই ভক্তদের কাছে এই পূণ্যস্থান সন্ত মেরির শেষ নিবাস হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন সন্ত জন। যিশুর মৃত্যুর এগারো বছর পর এখানেই মেরি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, এবং পরে জনও। সত্যাসত্য নিয়ে অনেক বাগবিতণ্ডা আজও চলে তবে প্রথম ৪৩১ খৃস্টাব্দে এফেসস কাউন্সিলের এক চিঠিতে বলা আছে সেখানে সন্ত জন এবং যিশুর মা সন্ত মেরি থাকতেন এবং মারা যান।