ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক৯
ভগবান আছেন। আমাদের উপর ঠাকুরের কৃপা আছে।
সবাই গেল চান-টান করে স্কুলে ;আমরা তিনমূর্তি বাঁকুড়া মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে। সবুজ পর্দা ঘেরা চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা। চিকিৎসার জন্যে আসা অল্পবয়েসের মেয়েদের দিকে ঝারি কষা, আর তারপরে এক এক করে ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়া; শেষে নাচতে নাচতে হস্টেলে ফেরা-- আজকে স্কুল যেতে হবে না।
সবকটা চ্যাংড়া বিকেলে খেলতে না গিয়ে আমার ঘরে জড়ো হল, অগ্রণী অবশ্যই গুরু অমিয়দা।
আমাদের এক এক করে বলতে হল ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে সওয়াল জবাব। কী আশ্চর্য! আমাদের সবার জন্যে ওঁদের আলাদা আলাদ প্রেসক্রিপশন। বিপ্লবকে বলা হল--রাত্তিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে, আমাকে দেরি করে আর রমেনকে বলা হল ঘুমোনোর আগে বিবেকানন্দের লেখা থেকে একটা অধ্যায় পাঠ করে শুতে যেতে!
সবাই কনফিউজড্ বল্লে কম বলা হয়।
গুরু উবাচ-- তোরা ভেবেছিস ডাক্তারদের ঝুটমুট গল্প বলে বোকা বানিয়েছিস। আসলে ডাক্তাররা তোদের মত গাধাদের বোকা বানিয়েছে। এমন ট্রানস্পারেন্ট লাই!
গুরু আবার চটে গেলে ইংরেজি বলে।
তাই বললাম--চটছ কেন?
-- চটব না? তোরা সব বালের গল্প শুনিয়ে একদিন স্কুল থেকে ফোকটের ছুটি এনজয় করবি আর আমরা?
কী আশ্চর্য! গুরুর ডানহাত আমাকে মানে বাঁহাতকে সাপোর্ট করে বলে উঠল-- বালের গল্প কেন? ওর জোরে সাসপেনশন থেকে বেঁচে গেল, এ কি কম কথা? রমেন যদি পরপর দু'বার সাসপেন্ড হত তো?
-- কী আর হত, আমাদের ফ্রি-তে বৈজয়ন্তীমালার নাচ দেখা বন্ধ হয়ে যেত আর ওই হারামজাদা বিমল! ও আরও ছোট ছোট ছেলেদের রেপ করত। কমসেকম রমেনের বীচি টিপে দেওয়ায় কিছুদিন সমঝে চলবে।
সমবেত হো-হো-হি-হি-র মধ্যে রমেন হাত তুলল।
-- কী কেস, রমেন?
--আমি একটা কথা বলতে চাই।
-- বল না বাল! কে তোর মুখ চেপে রেখেছে?
-- আমরা বায়োলজির ব্যাপারে অনেক কিছু ভুলভাল জানি।
বৈষ্ণব ছেলেটি বলল-- যথা?
--যথা নম্বর-এক; আমরা জানতাম আশি ফোঁটা রক্ত থেকে একফোঁটা রস হয়। তাই নাইট ফল হলে আমাদের এত দুর্বল লাগে, ঘুম পায়। এই কথাটা ডাক্তারবাবুকে বলতে উনি হো- হো করে হেসে ফেললেন।
--সে কী রে! তুই এইসব মধুসূদন ডাক্তারকে জিগ্যেস করলি? তোর ধক আছে মাইরি! আর কী কী ভুল জানি।
--- আরে অনেকে বলে না যে বীর্যপাত হলে শক্তিক্ষয় হয়। আর বীর্য স্টক করলে বাড়তে বাড়তে গিয়ে ব্রহ্মতালুতে ঠেকলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়! তাই বরানগরে গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে গিয়ে স্বামীজির বীর্যপাত হলে উনি হাতে নিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন যাতে স্টক না কমে? সেটার ভ্যালিডিটি চেক করলাম। একেবারে লিটমাস টেস্ট, সোজা ডাক্তারবাবুকে।
--- তোকে তোর বাপ-মা কী খেয়ে পয়দা করেছিল রে?
রমেনের মুখের রঙ বদলাচ্ছিল।
কিন্তু গুরু ঠিক সময়ে ফাউলের বাঁশি বাজাল। বলল--এই ব্যাপারে কেউ কারও বাপ-মা তুলবে না।
প্রশান্ত বলার চেষ্টা করল-- বাপমা- রা বেশ ভারী। আমরা ছোট ছোট ছেলে, কী করে তুলব?
--- ধূস্ শালা! ডাক্তার কী বললেন সেটা বল না!
--- ডাক্তার পাশের চেম্বার থেকে আরও দুজন স্টেথো গলায় কাকুকে ডেকে আনলেন। ওরা বড় বড় চোখ করে আমদের দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। শেষে একজন টাকমাথা সিরিয়াস মুখ করে বলল-- শোন ছেলে। এসব বাজে গল্প; উদ্ভট কল্পনা। এসব বিশ্বাস কর না। আগামী বছর বায়োলজির বই পড়ে নিয়ো। কী করে সীমেন শুক্রাণু তৈরি হয় সব জানতে পারবে।
--- তাহলে ফল হলে খাওয়া ভুল? স্বামীজি?
-- অবশ্যি ভুল; কক্ষণো খাবে না। আর স্বামীজি অনেক শিক্ষিত ছিলেন। এসব গেঁয়ো অজ্ঞ লোকের তৈরি ফালতু গল্প। উনি এ'ধরণের কিছুই করেন নি।
-- ও কে! তোর গল্প শেষ তো? আর কেউ ডাক্তারবাবুদের কিছু জিজ্ঞেস করেছে? কী রে বিপ্লব?
-- না মানে আমি ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করলাম মাস্টারবেশন করলে পাপ হয় কি না?
-- উরিত্তারা!
-- উনি চশমা খুলে আবার পড়লেন, তারপর আমাকে মাস্টারবেশনের স্পেলিং জিগ্যেস করলেন।
--- সে কী?
--- হ্যাঁ রে! আরও জানতে চাইলেন যে এর বাংলা প্রতিশব্দটি জানি কি না? কোন ডিক্শনারি আর কোথায় প্রথম শুনেছি।
--- কী ডাক্তার মাইরি!
--- অ্যাই, তোরা চুপ কর তো! ডাক্তার কী বললেন তাই বল--পাপ হয় কি হয় না?
-- বললেন-- পাপ-পুণ্যের ব্যাপরটা ওনার ডিপার্টমেন্ট না; বরং মহারাজদের জিগ্যেস করলেই ভাল হয়। তবে খামোকা বেশি বেশি এই চক্করে পড়লে ক্লান্তি আসবে, পড়াশুনো থেকে মন চলে যাবে। অন্য কোন শারীরিক ক্ষতি হয় না।
আমরা খানিকক্ষণ চুপ।
অমিয়দা এবার মুখ খুলল-- আর পোদো! আমার বাঁ-হাত, তুই কিছু এমনি প্রশ্ন করিস নি?
--গুরু, ভাবছিলাম করব, কিন্তু করি নি।
-- বলে ফেল কী সেই প্রশ্ন যাহা জিগাইতে শ্রীমান পোদো শেষ মুহূর্তে নার্ভাস হইয়াছেন।
--গুরু, ভাবছিলাম মধূডাক্তারকে জিগ্যেস করব যে নাইট ফল-টল কি খালি ছেলেদেরই হয়?
প্রশান্ত ও নিখিলেশ আমার মাথায় তবলা বাজিয়ে দিল। এই না হলে গুরুর বাঁ-হাত! এমন আতাক্যালানে প্রশ্ন আর কার মাথায় আসবে? ভাগ্যিস মুখ বন্ধই রেখেছিলি।
-- লাইনে আয়। এইসব সাসপেনশন, রমেনের বিমলকে মারা, হ্যানোত্যানো-তে আমার অরিজিনাল প্রোজেক্ট ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। রাতপাহারা আর হোমোকেস দেখলে ধোলাই দেওয়া-- আবার শুরু করা যায় কি না? তোরা কি বলিস?
নিখিলেশ বলল-- গুরু, ছেড়ে দাও। সামনে একটাই প্রোজেক্ট--অ্যানুয়াল পরীক্ষা , এখন ওইসব ছাড়। তারপর তো সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। নতুন বছরে ফের দেখা যাবে।
বিশু বলল-- এর মধ্যে কোনটা প্রেম আর কোনটা কাম, সেটা কী করে আলাদা করা যাবে? মানে ওই আত্মেন্দ্রিয়- প্রীতি আর কৃষ্ণেন্দ্রিয়--প্রীতি?
প্রশান্ত-- সোজা কথা। যেখানে একপক্ষের জোরজবরদস্তি--সেটা আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি। সেরকম কমপ্লেন পেলে আমি ধরে ক্যালাবো এবং সোজা কানাই মহারাজের অফিসে নিয়ে যাবো। উনি করুন সাপেন্ড!
-- সবই হল। এবার পোদো লাস্ট ডায়লগ দে।
--গুরু, এইসব আত্মেন্দ্রিয়-কৃষ্ণেন্দ্রিয় বাতেলা ছাড়ান দাও। একটু ভাব, এসব চুলকুনি খালি আমাদের হয় কেন? কই, আমাদের সঙ্গে যে ডে-স্কলার ছেলেগুলো পড়ে তাদের এই রোগ হয় না কেন? হুঁ হুঁ বাবা! এবার স্পিকটি নট্!
--তুই কী বলতে চাস?
-- আচ্ছা, ছুটিতে যে বাড়ি যাও, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মার, তাদের কারও এইসব নিয়ে মাথাব্যথা দেখেছ?
--- না; তা তো দেখি নি। তবে?
--- ওরা কী নিয়ে কথা বলে?
-- কেন, ফুটবল , সিনেমা, কেরিয়র-- আমাদের মতই।
-- আর?
-- মানে? আর কী? ওঃ, প্রেম, লাইন মারা; আমাদের মতই।
-- কাদের সঙ্গে প্রেম? কাদের লাইন মারে?
-- কাদের আবার কুসুমকলিদের। ডবকা ছুঁড়িদের।
-- ঠিক ঠিক। আমরা কাদের লাইন মারি? কাদের প্রেমে পড়ি?
-- ভাগ শালা! কারও প্রেমে পড়ি নি। কাউকেই লাইন মারি না।
-- বেশ, তুমি হলে নিত্যগোপাল। কিন্তু যারা প্রেমে পড়েছে? যারা লাইন মারছে? বা প্রেমে পরার জন্যে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
প্রশান্ত হেসে ফেলে। এখানে মেয়ে কোথায়? তাই যা পাওয়া যায়।
রমেন বলে--আমাদের বিহারেও লৌন্ডা নাচা হয়। ওদের সঙ্গে প্রেম হয়। একটু মেয়েলি ছেলেদের মাল বলা হয়।
অমিয়দা ভীষণ রেগে যায়।
-- শোন, এসব ফালতু ক্যাওড়ামি। যে কয়েকটা ছেলে কারও সঙ্গে কিছু করছে বা যাদের ইয়ারকি করে স্বামী-স্ত্রী বলা হচ্ছে ওদের হাতে নয়, আঙুলে গোণা যায়। তাই দিয়ে তুই আশ্রমের সবাইকে মাপবি?
-- রেগে যেও না। একটু ভাব। তোমার পাড়াতেও কটা ছেলে মেয়ে প্রেম করে? করতে চায়, সুযোগ পায় না। পাড়ায় একটা মেয়ের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে গেলেই কিচাইন হবে। দুজনের বাড়িতে রিপোর্ট যাবে। ঠ্যাঙানি খাবে। রোমিও জুলিয়েট হাতে গোণা যায়। আমি মাইন্ড সেট এর কথা বলছি। বলতে চাইছি এই ছেলেগুলো এই আশ্রমে না থেকে বাড়িতে বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে বড় হলে পাড়ার স্কুলে পড়লে কি এমন করে ছেলেদের প্রেমে পড়ত না তোমার ওইসব হোমো চক্করে নোংরামি করে বেড়াত?
নিখিলেশ ফিচেল হাসে। ওরে আমার ধর্মাবতার যুধিষ্ঠির রে! এদিকে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, ওদিকে জ্ঞান দিচ্ছে! ' নেকী মাগী তোর কয় ছেলে? বড়টাকে নিয়ে নয় ছেলে'।
আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি। এ আবার কী! কোত্থেকে ক্যাচ করলি?
--আরে পাড়ার এক দজ্জাল বুড়ির ঝগড়া থেকে। কান পেতে শুনলে যা সব মণিমুক্তো কানে আসে না। কিন্তু কথা ঘোরাস না, নিজের কথা বল।
-- তুইই বল, কী বলতে চাস?
-- আমার বাবা ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। তুই যে এতবড় লেকচার ঝাড়লি তা তো আর বিপ্লবের ব্যাপারটা কী? আপনি আচরি ধর্ম!
বিপ্লবের মুখ রাগে থমথম করে। বিশু আর রমেনের মুখে ফিচেল হাসি। অমিয়দা যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আমার দিকে কড়া চোখে তাকায়।
--কী ব্যাপার রে?
-- না মাইরি! সত্যি বলছি।
-- কীসের না মাইরি?
-- মানে আমাদের মধ্যে শুধু দোস্তি, খুব দোস্তি মানছি; কিন্তু আর কিছু না।
-- না হলেই ভাল। হলে কি্ন্তু দুজনেই ধোলাই খাবি। ফিফটি-ফিফটি! আমার গ্রুপে আমি এসব সহ্য করব না। অন্যেরা যা করছে করুক গে।
সবাই উঠে পড়ে।
যেতে যেতে বিশু আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে গুনগুন করে--" রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায়,
রজকিনী রূপ কিশোরী স্বরূপ দ্বিজ চন্ডীদাসে কয়"।
***************************************************
গত সপ্তাহে একটা ঝড় বয়ে গেছে, শীতকালের ঝড়, শিলাবৃষ্টি সহ। তার জেরে ভেঙে পড়েছে আমাদের পুকুরপাড়ের নারকোল গাছগুলো। ভেঙে গেছে বাগানের পাঁচিল, নুইয়ে পড়েছে করবী আর কলকে ফুলের ডাল।
কী করে বোঝাব এই ঝড়ের তান্ডবকে! এই ঝড় গেছে শুধু আমাদের আশ্রমের উপর দিয়েই। তার দাপটে আমরা আশ্রমিক বালকের দল হতভম্ব। মাথায় উঠেছে ডিসেম্বরের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। কেমন অনাথ অনাথ লাগছে, আসলে আমাদের আশ্রমের প্রাণপুরুষ কানাইদা চলে গেছেন। চলে গেছেন গেরুয়াবস্ত্র ত্যাগ করে,ফেলে গেছেন তানপুরা , হারমনিয়াম, গানের বই আর নিজের হাতে তৈরি ব্যান্ডপার্টি ও কালীকীর্তনের দলকে।
না; উনি চলে যেতে চান নি। কিন্তু চলে যেতে হল। বাধ্য হয়ে। মিশনের হেডকোয়ার্টার ওঁকে মার্চিং অর্ডার দিয়েছে--বরাবরের মত। ওঁদেরও হয়ত উপায় ছিল না।
না, আমাদের মতামত কেউ জানতে চায় নি, প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যে নেহাৎই অপোগন্ড। তাই ঝড় ঘনিয়ে আসছিল বুঝতে পারি নি। ব্যারোমিটারের পারদ নীচে নেমে যাচ্ছে--খেয়াল করি নি।
বড়দের থেকে শুনে আর আশ্রমের বিভিন্ন ঠেকে গুজব মিলিয়ে একটা ছায়া ছায়া কাহিনী দানা বাঁধছিল।
কিছুদিন ধরে ইলেভেন ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ঝামেলা চলছিল। সূত্রপাত সেই বিনা নোটিশে দুধ বন্ধ করে দেওয়া আর মাছের টুকরোর সাইজ ছোট হয়ে যাওয়া।
এ নিয়ে কম্প্লেইন, তর্কাতর্কি এইসব। তেমন গা করি নি। কিছু সিনিয়র ছেলে বিদ্রোহ করে প্রেয়ারে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
গত মঙ্গলবারে কানাইদা ওদের সকালবেলায় অফিসে ডেকে পাঠিয়ে ওদের এবম্বিধ ব্যবহারের কৈফিয়ৎ চান। ওদের মতে একজন উল্টে মাসে মাসে ছ'টাকা দেওয়া সত্ত্বেও কেন দুধ দেওয়া হচ্ছে না সে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলে।
এ হেন দুঃসাহসে স্তম্ভিত কানাইদা মেজাজ হারিয়ে তক্ষুণি ওদের সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চিঠি লিখতে শুরু করেন। কিন্তু সেই সময় পুরুলিয়া হেড কোয়ার্টার থেকে ফোন আসায় উনি ফোন ধরতে পাশের কামরায় যান।
আসামীদের মধ্যে ছিল আমার ঘরের এক্স-ক্যাপ্টেন রাজকুমারদা। ওরা ভয় পেয়ে গেছল আর সমঝোতার রাস্তা পাওয়া যায় কি না সেই নিয়ে ফুসুর ফুসুর করছিল। এমন সময় রাজকুমারদার চোখে পড়ে যায় রাইটিং প্যাডের নীচের থেকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া একটি কাগজের টুকরো।
সেটাকে যত্ন করে তুলে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রাখতে যাবে এমন সময় চোখ গেল কাগজের মধ্যে কানাইদার সুন্দর গোটা গোটা করে লেখা চিঠিটির দিকে। একনজর পড়েই সেটা রাজুদা পকেটে পুরে ফেলল আর সাথীদের বলল--ভগবান আছেন! উনি আমাদের ব্রহ্মাস্ত্র জুগিয়েছেন। ভয় পাস না।
তারপর ওরা মহারাজের সমস্ত বকাঝকা মাথা নীচু করে চুপচাপ শুনল। শাস্তি ঘোষণা করে কানাই মহারাজ শেষ চেষ্টা করলেন। ওদের বললেন যে একদিন সময় দিলাম। ভেবে দেখ। কাল যদি তোমরা সবাই মিলে একটি কাগজে লিখে দাও যে তোমরা তোমাদের অসভ্য ব্যবহারের জন্যে অনুতপ্ত আর নিজেদের শুধরে নেবে তাহলে আমি ঘরে চিঠি দেব না। তোমরা হোস্টেলে থেকেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিতে পারবে।
ওরা মাথা হেলিয়ে সায় দিল। ঘরে ফিরে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে সেই কাগজের টুকরোটার হাতে লিখে পাঁচ-পাঁচটা কপি করতে বসল।
কী ছিল সেই চিরকুটে? আমার গুরু যা জানিয়ে ছিল-- সেটা ছিল বিল্টুদিকে লেখা কানাই মহারাজের প্রেমপত্র। তাতে উনি সম্বোধন করছেন 'আমার রাণী' বলে। আর নিজেকে লিখছেন 'তোমার রাজা'। তাতে উনি কবুল করছেন রাণীবাঁধে বাড়ি তৈরির ও ভবিষ্যতে এই আশ্রম ছেড়ে ওখানে গিয়ে ওঠার পরিকল্পনার কথা।
ওরা ক্ষমা চাইল না, বাড়ি ফিরে গেল না, উল্টে সেই কপি মিশনের হেডকোয়ার্টারে রেজিস্ট্রি করে পাঠিয়ে দিল। আর এক কপি দিল আশ্রমের এগজিকিউটিভ কমিটির কানাইদার বিরোধী গ্রুপের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে। আর নিজেরা তিনটে কপি তিনজনের কাছে রাখল।
কমিটি ওদের চাপ দিল অরিজিনাল জমা করতে। কিন্তু ওদের একজনের উকিল বাবার পরামর্শে ওরা সেটা করতে অস্বীকার করল। শুধু দুজনকে সামনে বসে অরিজিনালের সঙ্গে কপি মিলিয়ে দেখতে দিল।
-- কেন এমন করলে?
--পোদো, তোর মাথায় গোবর। অরিজিনাল দিলে আমরা সবকটা মহারাজের ও আশ্রমের মিথ্যে মিথ্যে বদনাম করার অপরাধে রাস্টিকেট হয়ে যেতাম যে!
সাতদিন। ওই সাত-সাতটা দিন ছিল ঝড়ের, ভূমিকম্পের। ধীরে ধীরে খবরটা টিচাররাও জেনে গেছেন। সবাই দম বন্ধ করে আছে। কী হ্য়! কী হয়! অনেকেই ফেন্সিংএ বসে। কোন পক্ষ নিচ্ছেন না।
এই অসম লড়াইয়ে কে মাটি নেবে?
কানাইদা প্রেয়ার হলে আসছেন না। অফিসেই ব্যস্ত। অনেক অচেনা লোকজন আসছে। মিটিং এর পরে মিটিং।
রোববার রাত্তিরে সুনীল মহারাজ ডাইনিং হলে ঘোষণা করলেন-- তোমাদের কানাইদা কাল চলে যাচ্ছেন। সকালে জলখাবারের পরে সবাই ওঁর ঘরে গিয়ে দেখা করে প্রণাম করে নিও।
অনেক রাত অবদি গুলতানি চলল। সিনিয়রদের মুখে বিজয়ের হাসি। নানান ইয়ার্কি, ঠাট্টা, আগামী মহারাজ কে আসছেন, তিনি কেমন হবেন --এই নিয়ে নানা গুজব। সবাই ভাবছি কাল গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করার কথা। ঘুম হল না।
সকাল হল। প্রেয়ার যেন শেষ হতে চায় না। আজ আর ড্রিল হল না। জলখাবারের জন্যে ডাইনিং হলে যেতে গিয়ে চোখে পড়ল বাইরের বারান্দায় নোটিস বোর্ডের কাছে বাচ্চাদের ভীড়। ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি ওই নোটিস বোর্ডে একটা বড় কাগজ আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া। তাতে কানাইদার হাতের লেখায় গোটা গোটা করে লেখা -
" ক্ষমা কর, ধৈর্য্য ধর, হউক সুন্দরতর তোমাদের মন,
মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়, নহে বিচ্ছেদের ভয়, শুধু সমাপন।
------ আরও কতগুলো লাইন।
আমি আর পড়তে পারছি না। সব ঝাপসা দেখাচ্ছে।
{ প্রথম ভাগ সমাপ্ত}