ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিকপর্ব (৪)
ভারত ফরাসডাঙার ঘাটে পৌঁছে একদম হতবাক হয়ে এদিকওদিক দেখতে থাকে। ফরাসীরা বেশ কায়দা করে নগরটি সাজিয়েছে তো! গঙ্গার দু ধারে কত ফোয়ারা আর তার সংলগ্ন অনেকগুলো বিচিত্র ভঙ্গীর শ্বেতপাথরের বিবসনা নারীমূর্তিগুলোই সবার আগে তার চোখ টেনেছে। কি জীবন্ত ! যেন এক্ষুণি কথা বলে উঠবে ! ফরাসীদের মেয়ে বউরা গায়ে কাপড় দেয়না বুঝি? খানিকটা এগিয়ে এসে একটা মূর্তির সামনে ভারতচন্দ্র দাঁড়িয়ে পড়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। একটি যুবতী নগ্নিকা মাতৃমূর্তি কোলে তার সদ্যজাত শিশুটি, সেও অবশ্য নিরাভরণ। নারীটি তার বিম্বফলের মতো পুষ্ট একটি স্তন শিশুটিকে সস্নেহে পান করাচ্ছে অন্য স্তনটি চাদরের উপর থেকে উদ্ভাসিত। এর পুরোটাই আসলে একটা মর্মর ভাস্কর্য্য। দেখে মন ভরে গেল ভারতের। পৃথিবীর পবিত্রতম জাগতিক দৃশ্যকল্পটি আপ্লূত করল তাকে। মনে মনে এর অজ্ঞাত শিল্পীটিকে কূর্ণিশ করে সে কাছারি দপ্তরের খোঁজ করতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।
সামনের বটতলায় দেখতে পায় একটা জটলা বেঁধেছে। একজন টুপি আর সাদা আলখাল্লা পড়া সাহেবের সামনে কিছু কাচ্চাবাচ্চা আর মেয়েপুরুষ হাঁ করে তার কথা শুনছে। লোকটি সুর করে ভারী অদ্ভূত বাংলা ভাষায় কিসব কথা বলছে। এমন ধারা বাংলা ভাষা ভারত এর আগে কারো মুখেই শোনেনি। প্রভু যীশু বলে কোন একজন লোকের মহিমার কথা তার বক্তিমেতে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে। আর থেকে থেকে পিচকিরির মত কিছু একটা জিনিস থেকে আতরজল ছেটাচ্ছে। এরপর সব্বাইকে লোকটা একটা গোল রুটির মত কি যেন একটা খাবার খেতে দিতে চাইছে কিন্তু অনেকেই তার হাত থেকে নিতে ইতঃস্ততঃ বোধ করছে। বাচ্চাগুলোর কেউ কেউ তা লোভের বশে অবশ্য সেগুলো মুখে পুরে দিয়েছে ইতিমধ্যে। ভীড়ের মধ্যেই একজন লোক চাষাভুষো শ্রেণীরই হবে খুবই বিরক্ত কন্ঠে ভারতকে বলল -
" এই এক নতুন রঙ্গ হয়েচে ! কেরেস্তান করার জন্য এরা একন উঠে পড়ে নেগেচে! দিন রাত যীশু আর যীশু! চৌপর বটতলায় সায়েব নিজে ধরে ধরে কেরেস্তান করার জন্য ফাঁদ পেতে বসচে! একোনো কেবল ধরে বেঁধে কয়েকঘর বাগদী, মালো, চামার রুটি আর পয়সা পাওয়ার লোভে জাত খুইয়েচে! কিন্তু ভদ্দরলোকদের শুদু কব্জা কর্তে পারচেনি ! "
ভারত এর আগে অবশ্য ' যীশু' নামের লোকটির ব্যাপারে কোনও কথাই শোনেনি। 'যীশু'র নাম বলে সাহেবটা কেনই বা সবাইকে পয়সা আর রুটি বিলোচ্ছে তাও তার খুব একটা বোধগম্য হল না। যাইহোক সময় নষ্ট না করে এখন কাছারিবাড়িটা খুঁজে বের করে সেখানে এখন জলদি পৌঁছতে হবে।
বন্ধুবর মদনমোহনের বাড়ি থেকে আজ বেশ আশ্বস্ত হয়েই পথে নেমে কলুটোলার দিকে সোজা হাঁটা লাগালেন ঈশ্বরচন্দ্র। কলকাতার সারস্বত সমাজে এই তেজস্বী বিদ্যাদৃপ্ত ব্রাহ্মণ সন্তানটি এক জ্যোতিষ্ক বিশেষ। আপাতত মদনমোহন ছ'শো টাকার জোগাড় করে দিতে পারবে বলে তাঁকে নিশ্চিন্ত করেছে। ঈশ্বরচন্দ্রের এখন একটি নিজস্ব ছাপাখানার আশু প্রয়োজন। বিলেতী সিভিলিয়ানদের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যে বাংলা পাঠ্যপুস্তকগুলি আসে তা মূলত বর্ণশুদ্ধিতে ভরা। আর তার কাগজের মানও ভাল নয়। বাংলাভাষাকে আস্তে আস্তে তার পয়ারী কাব্যময়তার স্বরূপ থেকে গদ্যের অবয়বেই মূর্ত করতে হবে। আধুনিক যুগের এটাই চাহিদা। কথ্য বাংলা আর ব্যবহারিক বাংলার সাথে রসপূর্ণ বাংলাকে না মেলাতে পারলে একদিন ব্রজবুলির মত এটিও বাতিল হয়ে যাবে। সামনের দিনে যে ইংরেজী ভাষাটির প্রাবল্য যে ক্রমবর্ধমান তা আর আজকে অস্বীকার করার নয়। কলেজের অধ্যাপনার সাথেই একদিকে বাংলা গদ্যরীতির প্রবাহের ধারা নির্মাণের স্বেচ্ছানির্মাণের কঠিন সাধনার সঙ্গে আরো দুটি যুগন্ধর কাজে তিনি আজকাল খুব ব্যস্ত। একটি হল স্ত্রী শিক্ষার প্রসার অন্যটি বিধবাবিবাহের স্বপক্ষে শাস্ত্রমন্থন। তিনি নিশ্চিত এ কাজের যে খুব কম স্বদেশবাসীরই সাহায্য ও আনুকূল্য তিনি লাভ করবেন এই দুটি কাজে। তিনি অবশ্য নিজেও বেপরোয়া ও একরোখা। বরং বীটন ও হেয়ার এই দুই ইংরেজসন্তান বাংলাদেশে বিদ্যাচর্চা বিশেষ করে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোয় খুব আগ্রহী। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করিয়ে রামমোহন রায় তো মেয়েদের তো প্রাণে বাঁচালেন কিন্তু এই জীবন্মৃত বিধবাদের ভবিষ্যতটি ভাবার অবকাশ তিনি আর পেলেন না। এইসময় আরেক জন রামমোহন থাকলে তাঁর কাজটা একটু সহজ হত এই যা। তবে সার্বিক শিক্ষার প্রসারেই যে একদিন নতুন চিন্তাধারার ভোরটি উদিত হবে সেই বিশ্বাসে ভর দিয়ে তিনি সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করতে এখন ব্রতী হয়েছেন।
মদনমোহনের বক্তব্যটি মনে ধরেছে তাঁর। যদি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে ভারতচন্দ্রকৃত 'অন্নদামঙ্গল' এর মূল পুঁথিটি জোগাড় করে তার যদি একটা উত্তম সংস্করণ কলকাতায় প্রস্তুত করা যায় তবে তার একশোটি কপি কলেজেই বিক্রী করে প্রেসের দেনাটিও শোধ হয়ে যায়, উপরন্তু বাকী বই গুলির বিক্রয় থেকে বেশ ভালো আয়ের সম্ভাবনাটিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায়না। গত শতাব্দীতে ভারতচন্দ্রের মত কবিকীর্তির সমতূল্য আর কেউই নেই বললে চলে।ঈশ্বরচন্দ্র ছাত্রদের সামনে বিদ্যাসুন্দর পড়ানোর সময় এইষকদিন আগেও রতিরঙ্গগুলির দৃশ্য বর্ণনার সময় একটু আড়ষ্টই থাকতেন। আসলে অনেক ছাত্রই তাঁর চেয়ে বয়সে বড় আবার কিছু সমবয়স্কও আছে। তাই মদনমোহন একদিন একরকম তিরস্কার করেই বললেন - " ঈশ্বর তুমি তো কুমারসম্ভবম্ , রঘুবংশম্ ইত্যাদি সবই পাঠ করিয়াছ ! কালিদাসের রতি কি ভারতচন্দ্র হইতে পৃথক? বাঙ্গালাভাষায় লিখিত বলিয়াই কি আমাদিগকে এই শৃঙ্গার রসের প্রতি ঘোর অবিচারটি দেখাইতে হইবে? যাহা সংস্কৃতে শোভন তাহা বাঙ্গালায় হইলেই অশ্লীল? তুমি একাধারে পন্ডিত ও রসজ্ঞ হইয়া এইরূপ ছুঁৎমার্গিতাটিকে কেন প্রশ্রয় দাও?"
হেদুয়ার রেলিং এর ধারে সদ্য কেনা ঝাল নুন মাখানো ছোলাসেদ্ধর পাতাটি বন্ধুবরের দিকে সস্নেহে এগিয়ে ' হা হা ' করে সশব্দে হেসে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র। খানিক সামলে মদনমোহনকে বলেন -
" ভায়া ! তবে একটি গুপ্ত সত্য উদ্ঘাটন করি তোমার কাছে। ভ্রাতার বিবাহোপলক্ষে মাতৃআজ্ঞার নিমিত্তে যে ভরা বর্ষার দামোদর নদ সন্তরণের ঘটনা আমাকে প্রায় পবনন্দনের সাগর উল্লম্ফনের তূল্য গৌরবে বাধিত করিয়াছে, তাহার প্রেক্ষিতে আসল সত্যটি তবে শুন ! তখন ছিল জ্যৈষ্ঠমাস। আমার গমনপথের অংশের দামোদরটি ছিল আদপে ক্ষীণকায়াই। নদীটি তৎস্হানে কিঞ্চিৎ চরায় পর্যবসিত বলিয়াই সে রাত্রে উহা পদব্রজেই পার হইয়াছিলাম। সুতরাং বাল্যের সন্তরণবিদ্যার প্রয়োগটি আদপেই প্রযুক্ত হয় নাই! আর মধ্যরাত্রির আগন্তুক হইয়া গৃহাভিমুখী হইবার প্রকৃত কারণটিও পূজনীয়া মাতৃদেবী কেবল নহে! পুত্র নারায়ণ তদবধি মাতৃগর্ভে নীত হয় নাই। তোমার বৌঠানের সাথে দীর্ঘ অদর্শনহেতু কিঞ্চিৎ রসাভ্যাসে ছেদ পড়িয়া ছিল বলিয়া, বধূ মিলনের জন্য স্বয়ং আমিও উন্মুখ হইয়া পড়িয়াছিলাম ! ইহা এতদিন শুধুই আমি জানিতাম! আজ তুমিও জ্ঞাত হইলে। এর পরেও কি আমাকে রসিক বলিতে তোমার বাধিবে?"
অন্তরঙ্গ হাস্যরসিকতার আবহটি পথের দুপাশে বসন্তের বিকালটিতে দুই বন্ধু ছড়িয়ে দিতে দিতে যে যার নিজের বাড়ির পথ ধরলেন।
দেওয়ানীর কাছারিটি বেশ অনেকটা জায়গা জুড়েই । তার সামনে আজকে অনেক সেপাই সান্ত্রী গিসগিস করছে। ফরাসী চন্দননগরের সর্বময় কর্তা ডুপ্লে সাহেব আজ কাছারী পরিদর্শনে আসছেন।তাই চারিদিকে এত সাজোসাজো রব। এত লোক চোখের সামনে হঠাৎ দেখে ভারত প্রথমটা হকচকিয়ে গেল। একটা মস্ত থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে একটা ঝালর দেওয়া হাতির দাঁতের কাজ করা তাঞ্জাম এসে দরজায় দাঁড়াল। একজন নাদুসনুদুস লাল মুখো সাহেব খুব ভারিক্কী চালে একজন দেশীয় চাপরাশীর কাঁধে বাঁ পা'টি রেখে তারপর তাঞ্জাম থেকে নামলো। এই সাহেবই তা হলে 'ডুপ্লে সাহেব' ! সকলে তটস্থ হয়ে সেলাম ঠুকে অভিবাদন জানানোর পর সাহেবটি দুলকি চালে কাছারির ভিতরে ঢুকে গেল। ভারত ভাবতে লাগল তা হলে কি আজ আর কর্তার সঙ্গে দেখা হবেনা ! অর্থের যা সংকুলান তাতে বারবার আসা যাওয়ার খরচ রোজ জোগানো মুশকিল। অগত্যা আজকে অপেক্ষা করা ছাড়া আর অন্য কোনও গতিই নেই। প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর ভীড়টা পাতলা হল। সাহেব বেড়িয়ে চলে যাবার পরই কাছারিটি যেন অন্যদিনের স্বাভাবিক ঢিলেঢালা মেজাজটিতে ফিরে এল।
ভারত একজন আমীন গোছের লোককে চৌহদ্দিতে দেখতে পেয়ে ইন্দ্রনারায়ণের কথা কুন্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাসা করল যে এখন তাঁর সাথে একবার দেখা করা যাবে কিনা?
বিনাবাক্যব্যয়ে আমীনটি তার বাঁ হাতটি ভারতের দিকে বাড়িয়ে দিল। লোকটির মুদ্রাদোষটি আপাতত একটি তামার আধুলি দিয়ে নিবৃত্ত করে সে অবশেষে ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র পেল।
বিশাল বপুর দেওয়ানজী ইন্দ্রনারায়ণ মানুষটি কিন্তু বেশ আন্তরিক। ভারতের সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে, খানিক ভেবে নিজের প্রকাণ্ড ঝোলা গোঁফটিতে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন - " শোনো বাপু ! এদিককার হাওয়া সুবিধার নয়!ইংরেজরা তলে তলে নবাবকে গদী থেকে সরাতে চাইচে! আর নবাবটিও হয়েছেন তেমন, ফরাসীকুঠির প্রতি প্রথম থেকেই যেন একটু বেশী সদয়। ইংরেজ কোম্পানির তা সইবে কেন? ওরা নিজেদের পচন্দ করা এমন লোককেই গদীতে বসাতে চায় যে দেওয়ানী নিজামত সব মুখ বুজে ওদের পায়ে সঁপে দেবে ! বুঝলে কিচু ! এর চেয়ে বেশী কতা এখেনে বসে বলাটা ঠিক নয় ! আজ রাত্তিরটা না হয় আমার অতিথিশালায় থাকো ! আর কাল ভোরে কেষ্টনগর বেড়িয়ে পড়। রাজা কেষ্টচন্দর আমার বন্ধুমানুষ, আর গুণীর কদরও করে বলে শুনিচি। আমি না হয় দস্তখৎ করে চিঠি লিকে দেবখন ! বামুনের ছেলে হয়ে বিদ্যাচর্চা কর্বে সে তো ভাল কতা ! "
অতিথিশালায় এসে ব্রজদাস বলে একজন কন্ঠীধারী লোকের সাথে আলাপ হল। লোকটি বৈষ্ণব ও শান্তিপুরে তার নিবাস। ফরাসডাঙায় সে ডাকহরকরার কাজ করে, কাল ভোরে সে ফরাসীকুঠির ডাক নিয়ে বেরিয়ে পড়বে মূর্শিদাবাদের পথে। ভারতকে সে কৃষ্ণনগর অবধি সঙ্গ দেবে বলে কথা দিয়েছে। সারাদিনের পথপরিশ্রমে আর ক্লান্তিতে ভারতের দুচোখে ঘুম নেমে আসে। অতিথিসেবায় লুচি, কুমড়োর ছক্কা আর গুড় খেয়ে পেটটা ভরে গেছে একেবারে। খাওয়ার সময় রাধার কথা তখন খুব মনে হচ্ছিল। কতদিন এসব ব্যঞ্জন তাদের গরীবের পাকশালায় প্রবেশ করেনি ! ভারত সকলের অগোচরে গোটাকয়েক লুচি কোঁচড়ে লুকিয়ে নিয়েছে। কাল কেষ্টনগর যাবার কালে পথে জলযোগটা এগুলো দিয়েই হয়ে যাবে না হয়।
খুব ভোরে উঠে ভারত সবেমাত্র দাঁতনটি মুখে দিয়েছে এমন সময় অতিথিশালার দরজায় একজন পাইকের দর্শন মিলল। তার হাতে একটি পাকানো বালির কাগজ। ভারত কাগজটি হাতে নিয়ে প্রথমে মাথায় ঠেকালো। সামনের নিমগাছটির ফাঁক দিয়ে লাল টকটকে সূর্যটা ততোক্ষণে উঠে পড়েছে। ভারত সেই স্বর্গীয় ভোরবেলাটি সর্বাঙ্গে গায়ে মাখতে মাখতে ভাবে যে পুরাকালের ঋষিরা আদতে আগে শিল্পীই। নইলে জবাকুসুমের বর্ণসাদৃশ্যটি এভাবে আরাধ্য দেবতার রূপকল্পে ব্যবহার করতে পারতেন না। মনটা অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে ওঠে ভারতচন্দ্রের। মন বলছে, সময় বদলাচ্ছে এতদিনে, খুব দ্রুতই বদলাতে চলেছে।
ব্রজদাসের গানের গলাটি বেশ। কীর্তনের আখর গাইতে গাইতে সে ভারতের সাথে সাথে চলল। তার পায়ের ঘুঙুর ঝুমঝুম করে তাতে তাল মেলাচ্ছিল। ভারত এই যাত্রাপথটিতে আজ খুব আনন্দ পাচ্ছে। এরকমের সহজ সিধে মানুষই সে বরাবর পছন্দ করে। চাতরা পৌঁছেই তল্পিতে বাঁধা লুচিগুলোর সদ্ব্যবহার হল ভালোরকম। ভাতজঙ্গলার মাঠ অবধি ব্রজদাস ভারতের সাথে সাথেই রইল। এরপর সে উত্তরদিশায় চলবে। যাবার কালে ভারত তার হাত দুটি ধরে একবার বললো - 'বন্ধু! দেখা হবে আবার!'
কৃষ্ণচন্দ্রের 'শিব নিবাসে'র দেউড়ীতে ভোজপুরী দারোয়ান সুখলাল চৌবে তার হাতের পিতলবাঁধানো মোটা রায়বেঁশে লাঠি দিয়ে ভারতকে পথ আটকালো। ভারতের বেশবাস পরিচ্ছন্ন যদিও তবু তাকে সচ্ছল ভদ্রলোক বলা যায় কি?
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজে যথেষ্ট দয়াবান ও দানশীল। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাঙালীদের প্রতি রবিবার কাপড় আর টাকা দান করেন। তার সঙ্গে রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে থাকে ঢালাও ভোগের ব্যবস্থাও। কিন্তু তাই বলে আজ তো আর রবিবার নয় ! বজ্রগম্ভীর হুঙ্কারে সে বলে - 'কেয়া মাংতা ! আজ কুছু হোবে টোবে না! পরশু কি রোজ আও! যাও ভাগো আভি! '
ক'দিন ধরে তার এক এক করে সব পথের কাঁটা দূর হচ্ছে দেখে ভারত তাই নিজের মনের জোরটি এবারে আর হারালো না। দারোয়ানজীকে ঝোলা থেকে ওই চিঠিটি যেই বের করে দেখাতে যাবে ঠিক এমন সময় সেখানে একজন উদাসী অবিন্যস্ত পোশাকের অথচ দিব্যকান্তি, মধ্যবয়সী পুরুষ কোত্থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হঠাৎ আবির্ভূত হল । কুঞ্চিত ঘন কালো দাড়িগোঁফের আড়ালে তার মুখে এক স্মিত অপার্থিব আলোকিত আনন্দের উদ্ভাস। সুখলাল লোকটিকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে করজোড়ে নমষ্কার করে সুর বদলে বলে উঠলো - " আরে বাপ্ রে ! আইয়ে আইয়ে! আপ্ জলদি জলদি আইয়ে ! আপকা বাড়ির খোবোর টোবোর সোব সহী আছে তো হাঁ ! মহারাজ সোকাল সোকাল দু'তিন বার খবর কিয়েছেন! উনি মহালে আপনার জন্য কোখোন থেকে ইন্তেজার কার্ছেন!"
লোকটি চকিতে ভারতের দিকে ফিরে বলে! সেই ভালো! চল ভায়া !আমরা বরং ভেতরে গিয়ে জল টল খাইগে! কাল থেকে অনেকটা পথ হাঁটা হয়েচে! " সুখলালও আর কোনও কথা না বাড়িয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভারত বিস্মিত হয়ে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করে -" মানে ! আমায় কি করে.. আপনি.. ? হা..হা.. হা করে একটা সজোরে অট্টহাসি হেসে সে বলে - " ভায়া ! আমি যে মানবজমিনের জায়গীরদার ! আমি তোমার চোক দুটো দেখেই বুঝেচি যে অনেক অনাবাদী জমি আছে তোমার বুকে ! তাতে অনেক অনেক সোনার ফসল এবার ফলাতে হবে যে! চল ! চল! এই দেকো দিকি নামটাই জিজ্ঞাসা করিনিকো ভায়া'র এতক্ষণে - আমি হলুম গিয়ে কালীর ব্যাটা রামপেসাদ ! কুমারহট্টে থাকি! পরশু মা'র মন্দিরে উৎসব ! তাই মহারাজ মা'কে গান শোনাতে আমায় ডেকেছে। আমি আবার আসলে টাসলে রাজার অতিথিশালায় উঠিনা! ওই মন্দিরে চাতালেই একটা কোণ বেছে নিয়ে এসে শুই।" ভারত এই মানুষটিকে বিস্ময়ভরে চেয়ে দেখে কিছুক্ষণ। এতটা সহজ- সরল অকপট আজকের দিনে কোনও মানুষ সত্যি কি হতে পারে ! মন্দিরের চাতালে পাশাপাশি বসে ভারত কুন্ঠিত ভাবে দেওয়ানজীর চিঠিটি রামপ্রসাদকে বের করে দেখায়ে আর নিজের সব কথা একে একে উজাড় করে দেয়। প্রসাদও ধৈর্য্য ধরে তার সব বৃত্তান্তই মনযোগ দিয়ে শোনে। সাধারণতঃ সদালাপের মাতৃনাম ছাড়া এইসব জাগতিক অভাব, অনটন, জঠরচিন্তা এসব প্রসঙ্গের আলোচনায় রামপ্রসাদের যদিও বেশীক্ষণ রুচি থাকেনা, কিন্তু ভারতের চোখে সে সব তুচ্ছ জিনিস ছাড়াও আগামীদিনের এক মহান সৃষ্টির বীজটিকে সে ঠিক চিনতে পেরেছে , তাই সেও আর ভারতকে কথার মাঝখানে নিবৃত্ত করলনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনের মধ্যে একটা বেশ গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেল । দেখে কে বলবে তাদের পরস্পরের মধ্যে পরিচয়টি সবেমাত্র আজ সকালেরই।