ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক২
একটা গোটা বছর। কখন যে কীভাবে চলে গেল!
আমার ও বিপ্লবের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব এখন হোস্টেলের গসিপ কলামে স্বীকৃত তথ্য। সিনিয়র দাদারা যারা হেয়ার স্কুল থেকে আসা ভাল ইংরেজি বলতে পারা ও কঠিন অংক কষতে পারদর্শী কোঁকড়াচুলের ছিপছিপে ছেলেটির সঙ্গে দোস্তি করতে আগ্রহী ছিল তারা ফুটে গেছে। আমি বেশ গর্বিত। বিপ্লব আমাকেই তার আসল বন্ধু ভাবে। কেন? তা জানি না।
আমরা পড়াশুনো গান নাটক গল্পের বই পড়া এবং আড্ডা মারায় ব্যস্ত থাকি। ফুটবল খেলি না, কিন্তু ক্রিকেট ও ভলিবল খেলি। হোস্টেলে দুজন ছেলের একসঙ্গে ওঠাবসা চোখে পড়লেই সবার মুখে একটা অশ্লীল হাসি ফুটে ওঠে। তারপর কিছু তির্য্যক মন্তব্য।
—কী রে! তোদের কেমন চলছে আজকাল?
—মানে?
—মানে তোদের সংসার ধর্ম? কে কর্তা আর কে গিন্নি? এখনও পাকাপাকি ঠিক করিস নি? হেল্প চাই?
—ফালতু কথা বলবেন না। আমরা এসব পছন্দ করি না।
—আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। ভাল হলেই ভাল। আমাদের কী?
কখনও কোন সিনিয়র এসে আমার পিঠ চাপড়ে দেয়। বিপ্লবের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে প্রোপোজ করেছিলাম। ও বলল যে ওর একটাই বন্ধু—প্রদ্যুম্ন; আর সংখ্যা বাড়াতে পারবে না। আমি বললাম তো ঠিকই আছে। প্রদ্যুম্ন বেশ ভালো ছেলে। তোদের মত উদাহরণ এখানে খুব কম। আশা করি তোদেরটা টিকে থাকবে।
বিপ্লব নাক কোঁচকায়। এরা এভাবে কথা বলে কেন? দুজনের বন্ধুত্বের কি একটাই মানে? সেই অনিবার্য আঁশটে ব্যাখ্যা?
কী করা যাবে! কবে থেকে শুরু জানি না। এ চলে আসছে। কিন্তু আমরা এসবের বাইরে থাকব। বুঝলি? সে আর বলতে।
এখন ক্লাস নাইন। ও সায়েন্স নিয়েছে, ম্যাথস্। ওর বাবা ইঞ্জিনিয়র, ছেলেও তাই হবে। আমি আর্টস্ নিয়েছি। আমি কবি হতে চাই।
আমরা স্কুলের সময়টা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতে চাই। প্রেয়ার হলে ডাইনিং হলে পাশাপাশি বসি। কিন্তু আলাদা রুম। দুটো আলাদা উইং।
এবারে গরমের ছুটির পর আমাকে ৫ নম্বর ঘর অ্যালট করা হয়েছে।প্রত্যেক রুমে চারটে জানালা, পাঁচটা করে খাট, থুড়ি চৌকি। প্রত্যেক রুমে সিনিয়র ছেলেটি ক্যাপ্টেন। আমাদের রুমে তিনজন ক্লাস নাইনের, একজন টেন ও একজন ইলেভেন। রাজকুমারদা ইলেভেন, অতএব ক্যাপ্টেন। আমরা পালা করে ঘর ঝাঁট দিই, ঘর মুছি। সপ্তাহে একদিন প্রেয়ার হলে দল বেঁধে সাফ করতে যাই।রাজকুমারদা ওসব কিচ্ছু করে না। ওর পালিটাও আমরাই পালা করে মেরে দিই। তবে নির্ঝঞ্জাট লোক। নিজের মনে থাকে। জুনিয়রদের সঙ্গে বেশি কথা বলে না, পড়াশুনো নিয়ে জ্ঞান দেয় না। খালি বলে—ঘরের মধ্যে কেউ সিগারেট খাবে না।আমি কোন ফালতু ক্যাচাল কম্প্লেন পছন্দ করি না। আর রাত দশটার মধ্যে সব ঘরে ঢুকবে। আমি সাড়ে দশটায় লাইট অফ করব। পড়াশুনো করতে বা গল্পের বই পড়তে হলে ভোরে উঠে লাইট জ্বালাবে। নইলে বারান্দায় চেয়ার টেনে নিয়ে যাবে।
বই পড়া নিয়ে ওর কোন মাথাব্যাথা নেই। ওদের চালের হোলসেল বিজনেস। টেনে টুনে পাশ করে যায়। সারাবছর স্বামীজিরা ওর মত ছেলেদের খুব খেয়াল করে দেখেন না। কিন্তু বছরে একবার কালীপুজো বা সাধুসেবার সময় ওদের দারুণ কদর। আশ্রমের গাড়ি করে ওদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে রসীদ বই নিয়ে আশ্রমের কেউ হোমরাচোমরা। উদ্দেশ্য মহৎ। ওদের বাবা-কাকাদের থেকে প্রতিমার দাম বা সাধুসেবার চালের জোগান নেওয়া।
উত্তম কাট চুল আর মিডিয়াম পেস বোলিং—রাজকুমারদার অনেক ফ্যান। ও কিন্তু নিজের ব্যাচ ছাড়া কারও সঙ্গে বেশি মেশে না।
ব্যতিক্রম একজন। ক্লাস টেনের বিমানদা। বিমানদাদের বাঁকুড়া জেলায় কোথায় একটা সিনেমা হল আছে। ওই প্রথম হোস্টেলে টি-শার্ট নিয়ে আসে। ওটাকে প্রথম প্রথম বম্বে শার্টও বলা হত। বিমানদা রোজ স্নানের পর পাউডার মাখে। গলা ও ঘাড়ে দাগ দেখা যায়। বিমানদা কখনও আমাদের চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলে না। বড্ড ঘ্যাম। তাতে আমার কী!
আমার যে কী তা আগে যদি জানতাম!
কী করে জানব? আগে তো কখনও রাজকুমারদার সঙ্গে একরুমে জুনিয়র হয়ে থাকি নি। এখন ভাবি—কী করে রুম বদলানো যায়। বন্ধুরা বলল—এভাবে বদলানো যায় না। বড়দের সম্বন্ধে নালিশ করবি? তারচেয়ে মুখ বুজে চারটে মাস কাটিয়ে দে। তারপরই পুজোর ছুটি। তখন তো রুম ফের বদলে যাবে।
বেশ, তাই সই। চারমাস? মুখ বুজে কাটাবো? কী করে?
রোজ ভোরে উঠতে হয়। তাই সারাদিনের পর আলো নিভিয়ে বিছানায় মশারি গুঁজে গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা বুজে যায়।
কিন্তু খানিকক্ষণ পরে, বোধহয় একঘন্টা হবে, জানলায় খুট খুট শব্দ। না, আমার জানলায় নয়, ক্যাপ্টেনের জানলায়, সে ও গাঢ় ঘুমে। খুট খুট এবার খট খট হয়। কেউ চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে ডাকছে—রাজু! এই রাজু!
একটু ভয় পাই। কে? কে ওখানে?
পাশের বিছানা থেকে মানস ফিসফিসিয়ে বলে— চুপ কর। কথা বলিস না।
তারপর ও উঠে আস্তে করে দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের মশারিতে সেঁদিয়ে যায়।
একটা ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে; তারপর রাজু, থুড়ি রাজকুমারদার মশারি তুলে ঢুকে পড়ে। ভয়ে ও অবাক বিস্ময়ে আমার ঘুম উপে গেছে।
মশারির মধ্যে ঘুমজড়ানো গলায় রাজকুমারদা কিছু বলে। পাশ ফিরে শোয়। আগন্তুক নাছোড়বান্দা। সে ক্রমাগত রাজু, ওঠ, আমি এসেছি বলে চলে।
একটু পরে দুজনের চাপাগলায় গল্প শুরু হয়। একটা চড়ের মত আওয়াজ হল কি? না, ওরা তো হাসছে। হ্যাঁ, দুজনেই। তারপর এটা কী? কেমন যেন বেড়াল চুরি করে দুধ খাচ্ছে! কিন্তু এখানে বেড়াল কেন আসবে?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন সকালে স্নানে যাওয়ার আগে মানসকে চেপে ধরি।
কী ব্যাপার বল তো? কাল রাত্তিরে যা ভয় পেয়েছিলাম না? কে এসেছিল রে?
— শোন, ভয় পাওয়া ভাল। তাহলে মুখ বন্ধ থাকবে।
— ভাগ শালা! ন্যাকামি না করে ঝেড়ে কাশ দিকি! কে এসেছিল?
— বিমানদা, ক্লাস টেন।
— রাজকুমারদার মশারিতে কেন ঢুকেছিল?
— কেন আবার? বিমানদা রাজকুমারদার সঙ্গে প্রেম করছে তাই!
— সেকি! কবে থেকে এসব হচ্ছে?
— দু’বছর ধরে। সবাই জানে শুধু তোর মতন আতাক্যালানে ছাড়া।
— তা মশারির ভেতরে ঢুকেছিল কেন?
— দূর গাধা! ভালবাসে বলে।
— তা বলে এই গরমে এক মশারিতে?
— তুই কি রে! ওরা স্বামী-স্ত্রী তাই।
— কী বললি? কে কার স্বামী?
— ঠিকই শুনেছিস। রাজকুমারদা স্বামী আর বিমানদা। তাই রোজ রাতে সবাই শুলে স্ত্রীরা হেঁসেল গুছিয়ে লাইট নিভিয়ে স্বামীর বিছানায় যায় না? তেমনি।
— বিমানদা ক্যাপ্টেনকে রাজু বলে ডাকছিল কেন?
— ধেত্তেরি! তোর বগলে কাঁইবিচি। বল্লাম তো ভালবাসে বলে। বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখ, তোর বাবা তোর মাকে একটা অন্য নামে ডাকেন নিঘ্ঘাৎ।
চন্ডাল রাগে ওর কলার ধরে ঝাঁকাতে থাকি। কী বললি! জিভ ছিঁড়ে নেব। দুজনে জড়াজড়ি করে বারান্দায় গড়াতে থাকি। অন্যদের চোখে পড়ে; ওরা দৌড়ে এসে ছাড়াতে যায়। আমাদের টেনে তোলে।
— কী হয়েছে? দুটো দামড়া তায় রুমমেট, মারপিট কেন?
— দেখ না; এই শুয়োরের বাচ্চা মানস আমার বাপ-মা তুলেছে।
— কী রে মানস?
— বাজে কথা। আমি খালি বলেছি ভালবাসলে একজন আর একজনকে আরেকটা আলাদা নিজস্ব নাম দেয়। যেমন আমার বাবা প্রাণেশ আর মা স্বর্ণলতা। তো বাবা মাকে সোনিয়া বলে ডাকে, আমাদের সামনেই। মা বাবাকে বলে রাজা, কিন্তু আমাদের আড়ালে। ওর বাবা-মা হয়ত নিজেদের তেমন ভালবাসেন না, তাই কোন স্পেশাল নাম নেই।
আমি আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম কিন্তু তিনজোড়া হাত আমাকে আটকায়।
সিনিয়র একজন জিজ্ঞেস করে— সামনে হাফ ইয়ারলি, তোদের পড়াশুনো ছেড়ে হঠাৎ প্রেম-ভালবাসা নিয়ে ঝগড়া হল কেন?
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মানস চোখের ইশারায় চুপ করতে বলে। নিজেই এগিয়ে এসে বলে আসলে জয়শ্রী সিনেমার পাশের দোকান থেকে রোজ লাউডস্পীকারে পান্নালালের ওই গানটা শোনা যাচ্ছে তো!
সবাই ভেবলে যায়।
— কোন গানটা?
— সেই যে ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরি, সকলি ফুরায়ে যায় মা’।
—ওঃ, ওটা? ট্রেনের ভিকিরির দল গায়।তার থেকে প্রেম-ভালবাসা? ফান্ডা ক্লিয়ার হল না।
অনিরুদ্ধ অধৈর্য হয়ে যায়।
— আরে? ওই লাইনটা দেখুন—যেথা আছে শুধু ভালবাসাবাসি সেথা যেতে প্রাণ চায় মা!
সবাই হেসে ওঠে। প্রশান্ত ট্রেনের গায়কদের নকল করে বিকৃত সুরে দু’কলি গেয়ে দেয়।
ঢং ঢং ঢং ঢং!
স্নানের ঘন্টা বেজে ওঠে।
আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার ঘরের দিকে ছুটি। গামছা নিয়ে এসে কলতলায় লাইন ধরতে হবে। আধঘন্টার মধ্যে। তারপর নাকে মুখে দুটো গুঁজে স্কুল।
“কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইল রে!”
সেদিন বিকেলে আর খেলতে যাওয়া হয় নি। মানস বলেছে প্রেয়ার হলের পেছনের বারান্দায় বিকেল পাঁচটায় দেখা করতে।
সাদা ধবধবে শ্বেতপাথরের মেজে। তিনদিকেই ঢালা বারান্দা। বাঁদিকের আর সামনের বারান্দায় লোকজনের আনাগোনা। পেছনের বারান্দায় একটু অন্ধকার মত। কিছু জবা ও অন্য ফুলের আর বেল ফলের গাছ। তারপরে মানুষপ্রমাণ এক ইঁটের পাঁচিল। তার ওপাশে দু’তিনটে বাড়ি। আমাদের ওদিকে তাকানো বারণ। কখনও ওদের জানলায় দাঁড়ানো কোন বউ বা মেয়ের দিকে অসভ্য ইঙ্গিত করার কমপ্লেন এসেছিল। অপরাধীকে পত্রপাঠ টিসি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আর আশ্রমের ঘেরাটোপের বাইরে যে নানান প্রলোভন। আমরা জানি যে স্বয়ং বুদ্ধদেব আর একটু হলেই মারের আক্রমণে কাবু হয়ে যাচ্ছিলেন। শিবের তপস্যা কি এমনি এমনি ভঙ্গ হচ্ছিল? মদনভস্মের গল্প আমাদের রোববারের সকালের ধর্মক্লাসে পড়ানো হয়ে গেছে। ব্রহ্মচর্য্য যে কতভাবে নষ্ট হয়! বাইরের দুনিয়া সারাক্ষণ চক্রান্ত করছে আমাদের ব্রহ্মচর্য্য নষ্ট করার জন্যে।
একজন বলেছিল যে রবিঠাকুর একটা গান লিখেছেন—প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!
তো অনিলদা, মানে অনিল মহারাজ বললেন— রবিঠাকুর সরস্বতীর বরপুত্র। উনি ঠাকুর। উনি এ সব ছ্যাবলা গান লিখতে পারেন না।
আমরা কয়েকজন জোর দিয়ে বললাম যে সত্যি উনি লিখেছেন। লাইব্রেরি থেকে রচনাবলী এনে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। অনিলদা এত সহজে হার মানবেন কেন? উনিও সমান জোর দিয়ে বললেন যে আমরা ক্লাস নাইনেই বখে যাচ্ছি। গানের বিকৃত অর্থ করছি। রবি ঠাকুরের গানে পূজা ও প্রেম মিলেমিশে যায়। এ ফাঁদ, ঈশ্বরের ভক্তের জন্যে পাতা ফাঁদ। ওই গানটা খেয়াল কর— বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ কেমনে দিই ফাঁকি!
দুঃসাহসী নিখিলেশ বিবেকানন্দের জন্যে কেউ ফাঁদ পেতে ছিল কি না জিজ্ঞেস করে বেত খেল, তবে সেদিনের মত ধর্মক্লাসের হাত থেকে ছুটি পেয়েছিলাম।
সে যাকগে, মানস কেন ডাকল সেটা নিয়ে একটু ভয় ছিলই। সকালের মারপিটের দ্বিতীয় ইনিংস নয় তো? তাই আমিও একা যাই নি। বিপ্লব সঙ্গে এল।
বিশাল বারান্দা, খালি। কেউ নেই।
— কী রে! ফালতু বিকেলটা নষ্ট হবে নাকি!
— শুয়োরের বাচ্চা আচ্ছা বোকা বানাল! ঝাড় খেয়ে এখন শোধ তুলছে!
— আর একটু দেখি।
— দ্যাখ, আমি কিন্তু খেলা শেষের লম্বা ঘন্টা পড়লেই কাটব। হাত-পা ধুয়ে ‘খন্ডন ভব-বন্ধন’ করতে আসতে হবে না? ফালতু লেট এর খাতায় নাম তুলতে দেব না।
কিন্তু ঘন্টা বাজার অনেক আগেই মানস এসে গেল। কিন্তু ও একা নয়। সঙ্গে মিথিলেশদা। আমাদের হস্টেলের টিমের গোলকীপার। পড়ে ক্লাস ইলেভেনে।
কিন্তু মিথিলেশদা কেন? মারবে? মানস মিথ্যে কথা বলে খেপিয়ে আনে নি তো?
আমাদের আশ্রমে বড়রা ছোটদের মারতে, থুড়ি শাসন করতে পারে। কোন আপিল চলে না। তবে বেয়াদপি বা বড়দের অসম্মান করা— এই জাতীয় ভ্যালিড কারণ থাকতে হবে। সাক্ষী থাকলে আরও ভাল।
আর যারা মহারাজের বা ম্যানেজমেন্টের খোচরের কাজ করবে তাদের বলা হবে দালাল। তার থেকে দালু বা পচা আলু। পরে বুঝেছিলাম যে বড়দের একচেটিয়া ঠ্যাঙানোর অধিকারের বিরুদ্ধে ছোটদের একটা সেফগার্ড হল দালালদের ভয় পাইয়ে দেওয়া বা একঘরে করা।
এই মানস ব্যাটাও ক্লাস সিক্স-সেভেনে দালাল উপাধি পেয়েছিল। শীতকালে ওর লেপে জল ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সবাই আশ্রমের নিয়ম মেনে কলাই করা থালা-মগ ব্যবহার করি। ও বাড়ি থেকে কাঁসার থালা নিয়ে এসেছিল। সেই থালার সদগতি হল আশ্রমের পচাপানার পুকুরে।
আমরা ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালাম। বসতে বলল মিথিলেশদা, একটু হাসল। এটা কি বলির আগে কাঁঠালপাতা খাওয়ানো?
— মানস বল; কী হয়েছে?
মানস কাল রাত্তিরের ঘটনা সংক্ষেপে বলল। তারপর বলল—প্রদ্যুম্ন মেনে নিতে পারছে না। ভাবছে মহারাজের কাছে যাবে।
মিথিলেশদা গম্ভীর হল।
তারপর বলল— আর কে কে জানে? প্রদ্যুম্ন, আর কাকে বলেছিস?
— কাউকে না। আমি আর মানস।
— শোন, বড়দের ব্যাপার ওদেরই বুঝে নিতে দে, নাক গলাস না। তোর প্রবলেমটা কী?
— না মানে মানস বলছিল!
— কী বলছিল?
— বলছিল যে বিমানদা নাকি আমাদের ক্যাপ্টেন রাজকুমারদাকে ভালবাসে? তাই ওকে রাজু বলে ডাকে। ওরা নাকি স্বামী-স্ত্রী?
— ঠিকই তো বলেছে; তাতে তোর কোথায় চুলকোচ্ছে?
— না, মানে ছেলেতে ছেলেতে ভালবাসা? এরকম তো আগে কখনও শুনি নি। তাই।
— এই আশ্রমে আসার আগে অনেক কিছুই শুনিস নি। তো? কীভাবে সবার বাচ্চা হয় জানিস? বায়োলজি নিয়েছিস?
—না, ও তো আর্টস নিয়েছে, কবি হবে।
— আমার ইয়ে হবে। স্কুলের ম্যাগাজিনে চালের সঙ্গে ডালের মিল দিয়ে পদ্য লিখে নিজেকে রবিঠাকুর ভাবতে লেগেছে?
ঢং ঢং করে খেলা শেষের টানা ঘন্টা বেজে উঠল। আধঘন্টা বাদে প্রেয়ারের ঘন্টা বেজে উঠবে, শুধু একবার—ঢং!
আমরা উঠলাম। সবাই ।
মিথিলেশদা বলল—দাঁড়া। কথাটা মন দিয়ে শোন। ফালতু দালালি মেরে নালিশ করতে যাস না। কোন লাভ হবে না।ওরা দুজন ডিনাই করবে, এরকম কিছু হয় নি। মানস বলবে— তুই আসলে কাল খারাপ স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলি। তারপর আমরা কয়েকজন সিনিয়র মিলে তোকে ভাল করে ক্যালাবো, বড়দের নামে মিথ্যে মিথ্যে চুকলি করার জন্যে। আর তুই হবি তোদের ব্যাচের নতুন দালাল। এবার যা!
ঘরে এসে আমি আর বিপ্লব নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা বলি। ছেলেতে ছেলেতে ভালবাসা। এ কী করে সম্ভব। যোগ দেয় নিখিলেশ আর প্রশান্ত।
— কেন হয় না? আমরা কি একে অন্যকে ভালবাসি না?
— হ্যাঁ হ্যাঁ; তুই কি তোর বাবা-মাকে ভালবাসিস না? ভালবাসা কি জেন্ডার স্পেসিফিক হতেই হবে?
— কী বললি কথাটা? নতুন কোন ঢপ?
— আরে না। আমার দাদা শিবপুর বি ই-তে পড়ে। ওর কাছে শুনেছি।
— এ শালার জুটেছে এক দাদা। ওর থেকে নতুন নতুন শব্দ শিখে আমাদের কাছে ঘ্যাম নেয়।
— বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ, চল ডিকশনারি দেখি। বাজি?
— আমি জুয়াড়ি না। শালা বাজি ধরতে হয় তো শনিবার শনিবার ঘোড়ার ল্যাজে ধর। সে ব্যাপারে দম নেই।
— ছাড় তো! ক্লাস নাইনে পড়ে রেস খেলবে! পোঁদে নেই ইন্দি, ভজ রে গোবিন্দি! ফুটবল ম্যাচ দেখার পয়সা নেই আর উনি!
— আমাদের পাড়ার নবীনকাকু খেলে। রোববার দিন ওদের বাড়িতে খুব চেঁচামেচি হয়।
— কেন?
— আরে বেশিরভাগ দিন পকেট খালি। কাকিমা বাসন আছড়ে ফেলেন।
— সেকি রে! একবারও জেতে না?
—দেখি নি তো! জিজ্ঞেস করলে বলে—বুঝলি প্রশান্ত, এবার যে ঘোড়াটাকে ধরেছিলুম না, একেবারে বাঘের বাচ্চা! দেখি সবকটা ঘোড়াকে তাড়া করে আসছে! বলে হ্যা হ্যা করে হেসে গেলাসে চুমুক! এই হল তোর রেসের কিস্সা।
— কী রে নিখিলেশ! রেস খেলার রেস্ত না হোক নতুন কিছু শব্দ তো মুখস্থ করে হোস্টেলে ফান্ডা ঝাড়তে পারিস।
নিখিলেশ রাগতে গিয়ে হেসে ফেলে।
— সে কি তোর থেকে জ্ঞান নেবার জন্যে বসে থাকবো? ওসব আগেই ক্যাচ করে নিয়েছি।
— শোনা না দু-একটা?
— টোটে এত, উইনে এত, হ্যান্ডিকাপে বা জ্যাকপটে।
— এ শালা কিস্যু জানে না। আনন্দবাজারের খেলার পাতা থেকে মুখস্থ করেছে।
চারজনের হো-হো-হি-হি শেষ হওয়ার আগে বিশু এসে পড়ে—আরেক ফান্ডাবাজ।
ওর গলায় কন্ঠিমালা। ওদের বিষ্ণুপুরে পারিবারিক কীর্তনের দল আছে।মল্লরাজাদের মন্দিরে নিয়মিত গায়। আমাদের আশ্রমে একবার ওদের পার্টি এসে ফাটাফাটি পালা গেয়েছিল। সখীসম্বাদ আর মাথুর। ওর বাবা মূল গায়েন। হেবি হেবি আখর দিয়েছিলেন। আর বিশু করতাল হাতে জুড়ি ধরেছিল।
আমরা নতুন করে তর্কে মেতে উঠি। ছেলেয় ছেলেয় ভালবাসা কী করে সম্ভব?
বিশু বলে— তোদের উদাহরণগুলো বড় ছড়ানো। বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্কের রস হল বাৎসল্য, বন্ধুদের সঙ্গে সখ্য, মানে ফ্রেন্ডশিপ। ভালবাসার অনেক রকমফের, অনেক নাম।
প্রশান্ত বলে— গোঁসাইঠাকুর, সে তো বুঝলাম। কথা হচ্ছে ছেলেতে ছেলেতে স্বামী-স্ত্রীর মত ভালবাসা হয় কী করে?
নিখিলেশ— এটা বোধহয় একরকম ইয়ার্কি! বা বিকৃত কাম।
বিশু— দ্যাখ, নারীপুরুষের ভালবাসাকে বলে মধুর রস বা শৃংগার। এতে প্রেম ও কাম মিলেমিশে থাকে। কোথাও কাম বেশি, কোথাও প্রেম।
— যত্ত ভুলভাল ফান্ডা! কথা গুলিয়ে দেওয়া। প্রেম ও কামের তফাৎ কী করে বুঝবো?
— এত অধৈর্য হোস কেন? গোস্বামী কবিরাজ সেটাও স্পষ্ট করে বলে গেছেন।
“আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম,
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম”।
— রাখ তোর কবিরাজের মকরধ্বজ বটিকা। আরও গুলিয়ে গেল। দুটো ছেলেমেয়ে বা ছেলে ছেলের মধ্যে কৃষ্ণ কোত্থেকে এল?
বিশু মাথা চুলকোয়।
— আমিও ভাল বুঝি নি। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, এর মানে সত্যিকারের ভালবাসার কষ্টিপাথর হল ত্যাগ করা। যাকে ভালবাসি তার জন্যে।
— কী যে বলিস? আমি যাকে ভালবাসি তাকে তো পেতে চাইব, ধরে রাখতে জান লড়িয়ে দেব। ওকে ত্যাগ করব কেন?
খাওয়ার ঘন্টা বেজে ওঠে। মাত্র দুটো স্ট্রোক।