Next
Previous
0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in
১৭৯৩ সাল। এ’দেশে শাসক ইংরেজদের গড়া কলকাতার নিকটবর্তী বিখ্যাত বটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট কিড মে মাসে প্রয়াত হলেন। তাই সেই বছরের নভেম্বর মাসে এই উদ্যানের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৪২ বছর বয়সী চিকিৎসক ও উদ্ভিদবিদ উইলিয়াম রক্সবার্গ। বলাবাহুল্য, অদম্য উৎসাহ নিয়েই এলেন এই স্কটীয় সাহেব। যেমনটা নিয়ে এসেছিলেন অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিত ব্রিটিশদের এই উপনিবেশে। তাঁর সেই অদম্য উৎসাহ এবং তার সাথে নিরলস প্রচেষ্টা অল্পদিনের মধ্যেই বটানিক্যাল গার্ডেনকে এক বিশিষ্ট উদ্যান হিসেবে গড়ে তোলে। আসলে, বটানিক্যাল গার্ডেনে নতুন পদ ও দায়িত্বকে এক বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন উইলিয়াম রক্সবার্গ। কি সেই বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জ? তা হল, উদ্যানকে আরও সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ, বিশ্বের মাঝে বটানিক্যাল গার্ডেনের নাম যাতে উজ্জ্বল হয় তার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো। বলাবাহুল্য, আজকের দিনে বলাই যায় যে, তিনি এই কাজে সফলতা লাভ করেছিলেন। তা এই চ্যালেঞ্জকে সফলভাবে রুপায়ন করার জন‍্যে তিনি কি কি করেছিলেন? উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সেগুন(Teak), বেঙ্গল হেম্প(Bengal hemp), ভার্জিনিয়া তামাক(Virginia tobacco), আরবীয় কফি(Arabian coffee) এবং নীল(Indigo)-এর চারা সংগ্রহ করেছিলেন। তারপর, এইসব চারাগুলো নিয়ে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে বাগানে চাষাবাদ শুরু করেছিলেন।
উইলিয়াম রক্সবার্গ

এর পরের বছরের অর্থাৎ ১৭৯৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তিনি ২০০০ কি তার বেশি চারা বা বীজ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এমন কি বিদেশে যেমন ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং সেন্ট হেলেনায় পাঠান। এরসাথে, বিদেশি নতুন গাছপালা যাতে এখানে জন্মায় তারও চেষ্টা করেন রক্সবার্গ। যেসব বিদেশি নতুন গাছপালা তিনি কলকাতার বটানিক্যাল গার্ডেনে জন্মাবার চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গাছগুলি হলঃ- ফ্রেঞ্চ অলিভ( French Olive) এবং জামাইকার মসলা (Jamaican spice)। তাঁর উদ্ভিদ রোপণের কর্মকাণ্ড কেবলমাত্র বটানিক্যাল গার্ডেনে সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৭৯৭ সালের অক্টোবর মাসে জায়ফল(Nutmeg)-এর কয়েকটা চারা নমুনা হিসেবে আদালত প্রাঙ্গণে রোপণ করেছিলেন রক্সবার্গ। এইসব চারাগুলি অনেকদিন টিকে ছিল। এর পরের মাস নভেম্বরে তিনি প্রায় ১৭০টি উদ্ভিদের চারা এবং প্রায় ১২০টি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বীজ রোপণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে যেসব উদ্ভিদের জন্মানোর চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলঃ- ভারতীয় শন(Indian hemp), তিসি এবং আঁশবিশিষ্ট আরও কিছু ফসল। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাত্র গুটিকয়েক শস্যজাতের উপর কৃষকদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টাও তিনি করেছিলেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উদ্ভিদ-চাষের মাধ্যমে। তাঁর এই নানারকম উদ্ভিদের চাষ করার অদম্য উৎসাহ এবং নানারকম গবেষণামূলক কাজের জন্য ইংল্যান্ডের সোসাইটি অফ আর্টস(Society of Arts) তাঁকে শুধু একবার নয় বরং তিনবার স্বর্ণপদক প্রদান করে।

আচ্ছা, কত গাছ লাগিয়েছিলেন রক্সবার্গ? জানা যায় যে, তিনি যখন বটানিক্যাল গার্ডেনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তখন সেই গার্ডেনে প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছপালা ছিল। গাছপালার প্রজাতির সেই সংখ্যাটাই রক্সবার্গের অবসরের সময় অর্থাৎ ১৮১৩ সালে দাঁড়ায় প্রায় ৩৫০০ অর্থাৎ প্রায় দশগুণেরও বেশি।

এবার আসি ফিরে যাই উইলিয়াম রক্সবার্গের জীবনের প্রথমাংশে। দক্ষিণ-পশ্চিম স্কটল্যান্ডের আয়ারশায়ার দেশে ২৯শে জুন, ১৭৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন রক্সবার্গ। বিশ্ববিখ্যাত এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়াকালীন বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক জন হোপ(১৭২৫-১৭৮৬)-এর সান্নিধ্যলাভ করে উদ্ভিদবিদ্যার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। এই আকর্ষণ বা আগ্রহই তাঁকে একজন বিখ্যাত উদ্ভিদবিশারদ করে তোলে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চিকিৎসাশাস্ত্র অধ‍্যয়নের পর একজন সার্জন বা শল‍্যচিকিৎসকের সহযোগী হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজে তাঁর চাকরি জীবন শুরু হয়। শুধু উদ্ভিদবিজ্ঞানী জন হোপ নন, আরেককজনও ছিলেন যিনি উইলিয়ামকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে বিশেষ আকৃষ্ট করে তুলেছিলেন। এবার তাঁর কথাই বলবো। ১৭৭৬ সালের ২৮শে মে তিনি ভারতের মাদ্রাজ জেনারেল হাসপাতালের সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োজিত হন। সেখানে জীববিজ্ঞানে প্রাণী ও উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যার জনক কার্ল লিনিয়াসের বিশিষ্ট ছাত্র যোহান জেরহার্ড কোয়েনিগ (১৭২৮-১৭৮৫)-এর দ্বারা উদ্ভিদবিজ্ঞানচর্চায় বিশেষ অনুপ্রেরণা পান। ১৭৮০ সালে তিনি সার্জন হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। চাকরির প্রথমভাগ তার কাঁটে মাদ্রাজ থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার উত্তরে গ‍্যারিসন ষ্টেশন নামক এক সেনা কেন্দ্রে। সেখানে প্রতিফলন ঘটে তাঁর উদ্ভিদচর্চার এক পরীক্ষামূলক উদ‍্যান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই উদ্যানে তিনি চাষ করেন কফি, মরিচ, দারচিনি, নীল এবং ব্রেডফুট। এই উদ্ভিদগুলোর পাশাপাশি তিনি লাক্ষাজাতীয় পতঙ্গের পোষক ওপান্টিয়া (Opuntia)-রও উপর পরীক্ষা চালাতেন। ১৭৯০ সালের ১২ই জানুয়ারি এবারডীনের মারিসচাল কলেজ থেকে এমডি ডিগ্রি প্রাপক ও এডিনবার্গের রয়‍্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস-এর নির্বাচিত ফেলো উইলিয়াম রক্সবার্গ উদ্ভিদচিত্র আঁকার ব্যাপারেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি কয়েকজন ভারতীয় চিত্রশিল্পীকে বিভিন্ন উদ্ভিদের চিত্র আঁকার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আবার তাঁদের দিয়েই স্থানীয় গাছপালার প্রায় ৩০০টি কি তার বেশি চিত্র আঁকান। এইসব শিল্পীদের আঁকা বিভিন্ন স্থানীয় উদ্ভিদের চিত্রের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছিল প্রত্যেকটি উদ্ভিদের নাম-ধাম, সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, ব্যবহার বা উপকারিতা এবং নানান আনুষঙ্গিক তথ্যভাণ্ডার। স্থানীয় গাছপালার উপর এই চিত্রগুলি তিনি বিখ‍্যাত ইংরেজ পকৃতিবিদ, উদ্ভিদবিদ স‍্যার জোশেফ ব‍্যাঙ্কস-কে পাঠাতেন যিনি সেগুলো ‛Plants of the Coast of Coromandel’ নামে মে ১৭৯৫, ১৮০২ এবং মে ১৮২০ সালে প্রকাশিত করেন।

এই চিত্র প্রসঙ্গে বলা যায় যে, রক্সবার্গ ২৫৩৩টি বিজ্ঞানসম্মত চিত্র রেখে গিয়েছিলেন। এছাড়াও, তিনি অসংখ্য উদ্ভিদের শুষ্প নমুনা(dry specimens) ও রেখে ইয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে, এই সমস্ত উদ্ভিদের চিত্র ও শুষ্প নমুনা পরবর্তীকালে এই দেশের তথা উপমহাদেশের অন্যতম এক বিশিষ্ট হার্বেরিয়াম (herbarium) বা উদ্ভিদের সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার সূচনা করে। ১৮১৩ সালে শারীরিক অসুস্থতার দরুন উইলিয়াম রক্সবার্গ ভারত ছেড়ে স্কটল্যান্ড চলে যান এবং যাওয়ার আগে তাঁর পরবর্তী উদ্যানের সুপারিনটেনডেন্ট উইলিয়ম কেরী-কে ‘Flora Indica’ নামে এক পাণ্ডুলিপি দিয়ে যান।যা ১৮২০ সালে কেরী সাহেব প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। বইটি প্রকাশের আগে উদ্যানের এক কর্মকর্তা ন্যাথানিয়েল ওয়ালিক আরও কিছু উদ্ভিদের বর্ণনা তাতে সংযোজন করেছিলেন। যাইহোক, বইটির প্রথম খণ্ড ওই বছরেই প্রকাশিত হয়।বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮২৪ সালে। এই দ্বিতীয় খণ্ডেও ওয়ালিক আরও অনেক নতুন তথ্য ও বর্ণনা সংযোজন করেন।তবে, রক্সবার্গের ‘Flora Indica’ বইটি ১৮৩২ সালে কেরী অপরিবর্তিত আবস্থাতেই তিন খণ্ডে পুনর্মুদ্রণ করেন। এই বইটি ভারতীয় উদ্ভিদ সম্পর্কে নিঃসন্দেহে একটি দুর্লভ এবং মূল্যবান বই।

১৮১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উইলিয়াম রক্সবার্গ এডিনবার্গের পার্ক প্লেস-এ এই পৃথিবী ও তাঁর প্রিয় উদ্ভিদদের ছেড়ে চলে যান। তিনি রেখে যান উদ্ভিদ-প্রেমীদের প্রতি অনুপ্রেরণা হিসেবে তাঁর ভারতীয় উদ্ভিদের উপর গবেষণা ও নিরলস প্রচেষ্টা। সর্বপ্রথম ভারতীয় উদ্ভিদের একটি ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল বিবরণ প্রকাশ করার ব্যাপারে তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর যাবতীয় উদ্ভিদের চিত্র ও শুষ্প নমুনা যেমন এক বিশিষ্ট হার্বেরিয়াম বা উদ্ভিদের সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছে তেমনি তাঁর রচিত ‘Flora Indica’ এই উপমহাদেশের উদ্ভিদসংক্রান্ত গবেষণার কাজেরও সূচনা করেছে। এইসব কারণের জন্যই নিঃসন্দেহে তাঁকে এই দেশের তথা উপমহাদেশের উদ্ভিদবিদ্য্যার পথিকৃৎ তথা জনক বলাই যায়।