ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক
। নয়।
পিতৃদেব অসুস্থ, ঢাকায় বসে খবর পেলেন রামমোহন। মা-বাবার আদরের সন্তান তাকে বলা যাবে না, কিন্তু এই খবর শুনে খুবই উদ্বেগ বোধ হ’ল তার। ঢাকার কালেক্টর টমাস উডফোর্ড তার বস, সটান তার কাছে গিয়ে জানালেন, ছুটি চাই।
টমাস বললেন, কী ব্যাপার, রয়? এখন ছুটি –
রামমোহন বললেন, বাড়ি থেকে খবর পেয়েছি, বাবার শরীর খুব খারাপ। আমি সেখানে যেতে চাই।
টমাস বললেন, বাবাকে দেখতে যেতে চাও? তুমিই না বলেছিলে, তোমার বাবা তোমাকে দেখতে চান না! একবার না, দু-দুবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। সেই বাবাকে দেখতে এখন তোমায় ছুটতে হবে?
রামমোহন বললেন, সে তুমি বুঝবে না। আমি যাচ্ছি।
টমাস বললেন, যাচ্ছি মানে কী? হুট করে বলা নেই কওয়া নেই, যাচ্ছি বললেই হ’ল? তোমার এই দেওয়ানগিরি কে করবে এখানে? আমি? আগে একটা লোক খুঁজে বের করি, তাকে কাজকর্ম বুঝিয়ে দাও, তারপর যাওয়ার কথা ভেব। কতদিনের জন্যে যেতে চাও?
ফট করে মুখের ওপর ইস্তফাপত্র বের করে ছুঁড়ে দিলেন রামমোহন। হনহন করে বেরিয়ে এলেন তার কক্ষ থেকে। ঢাকা থেকে খানাকুল যেতে অনেক সময় লাগবে, বেলায় বেলায় বেরিয়ে পড়াই ভাল।
উডফোর্ড লোকটা খারাপ না, একে তিনি অনেক দিন ধরেই চেনেন। শুধু উডফোর্ড না, কলকাতায় যাতায়াতের শুরু থেকেই ইংরেজদের সঙ্গে তার ওঠাবসা মন্দ না। যখন তার বছর চব্বিশ বয়স, বাবা রামকান্ত দানপত্র করে জমিজমা বিলিবন্টন করে দিলেন পুত্রদের মধ্যে। রামমোহনের ভাগে যা পড়ল, তা নেহাত কম না। তার খাজনা আদায় করে সরকারের ঘরে রাজস্ব জমা দিয়ে আর সেই সংক্রান্ত খরচাপাতি বাদ দিলেও তার হাতে থেকে যেত বছরে প্রায় হাজার বাইশ টাকার মত। সে তো অনেক টাকা। সেই টাকা ফেলে না রেখে রামমোহন তার সুব্যবস্থা করতে কলকাতায় যাতায়াত শুরু করেন সে সময়। কলকাতায় তখন উঠতি বয়সের ইংরেজ ছোকরাদের ভীড়। ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ ভর্তি হয়ে এরা আসে, কলকাতায় কম্পানির কোনও কাজে তারা বহাল হয়ে যায়, আর মাইনের টাকায় ফুর্তিফার্তা করে। মদ-মাংসের ঢালাও কারবার। একবার এর স্বাদ পেয়ে গেলে চরিত্র নীচে নামতে তো বেশি সময় লাগে না, ফলে এদের অনেকেরই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ব্যাঙ্ক বলে তখন কোনও বস্তু তৈরি হয়নি আর কম্পানির ঊর্ধতন কারও কাছে হাত পাতা যায় না, তাতে চাকরিটা খোয়ানোর সম্ভাবনা, তাই তারা টাকা ধার করত দেশি লোকদের কাজ থেকে। রামমোহন এদের টাকা ধার দিয়ে বেশ দু’পয়সা আয়ের রাস্তা খুঁজে পেয়ে গেলেন।
এ রকম ধারের কারবার করত আরও কিছু দেশি বাবু, রামমোহনের সাথে তাদের আলাপ হলো। তবে এদের চেয়ে ইংরেজদের সাহচর্যই তার বেশি ভাল লাগত। ওদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ কারবার করতে করতে ইংরাজি ভাষাটা বেশ আয়ত্বে এসে গেল তার। ধারের কারবার মূলতঃ বিশ্বাসের ওপরেই। একখণ্ড কাগজে বড় জোর লেখা থাকে, এত টাকা ঋণস্বরূপ বুঝিয়া পাইলাম।
এইভাবেই একদিন অ্যান্ড্রু র্যামজের সঙ্গে আলাপ। সে এক রাইটার, মানে কম্পানির খাতাপত্র লেখে। তার সাথে পড়াশুনার বদভ্যাসও আছে। সেই পড়াশুনার অভ্যাসটা সঞ্চালিত হয়ে গেল রামমোহনের মধ্যেও। ইংরাজি বই পড়ে তার চোখের সামনে খুলে গেল এক নতুন দুনিয়া। আরও বেশি করে সেই দুনিয়াকে জানার আগ্রহ পেয়ে বসল তাকে।
একদিন অ্যান্ড্রু তার কাছে ধার চেয়ে বসল সাড়ে সাত হাজার টাকা। সে কী এক ব্যবসায়ে সেই টাকা লাগাতে চায়। একসাথে এতগুলো টাকা একজনকে এখনও অবধি ধার দেননি রামমোহন। একটা কাগজে লিখে এতগুলো টাকা দেবেন, যদি ফেরৎ না পাওয়া যায়! লোকটা বন্ধুর মতো হলেও তো বিদেশি। ভেবে ঠিক করলেন, কাগজে লেখার বদলে আইনি সাহায্য নেওয়াই ভাল, অ্যাটর্নি ধরে দলিল-টলিল লিখিয়ে তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন রামমোহন। দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, হ্যাঁ, এই ব্যবস্থাটাই ভাল। আমাদের দেশে অবশ্য এ ধরণের আইন-টাইন কিছুই ছিল না, লোকে ধর্মমতে যা ভাল মনে করে, সেটাই আইন, কিন্তু বিদেশিদের ব্যাপার তা না, তাদের সব কিছু লেখাপড়া করা থাকে – এই কাজটা দোষের, এতে এই শাস্তি।
এই দলিলে সই করেই আইন ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে গেলেন রামমোহন। এর পর থেকে যাকেই টাকা ধার দেন, সব আইনের কাগজে সই সাবুদ করিয়ে। আর এ সব করতে সদর দেওয়ানি আদালতেও তাকে ঘুরতে হতো ভালই, তিনি শিখে নিলেন মুসলমানি আইন, পরিচিত হলেন তার সাথে যুক্ত মৌলবিদের সঙ্গেও। ছোটবেলায় শেখা আরবি-ফার্সি ঝালিয়ে নিতে লাগলেন তাদের সঙ্গে আদান-প্রদানের মাধ্যমে।
টমাস উডফোর্ডের সঙ্গে আলাপও এই টাকা ধারের সূত্রেই। রামমোহনের কাছ থেকে যে উপকার তিনি পেয়েছিলেন, তার প্রতিদানেই পরে যখন তিনি ঢাকার কালেক্টর নিযুক্ত হন, রামমোহনকে তার দেওয়ানির চাকরি দেন তিনি। রামমোহন তখন বাড়ি থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বিতাড়িত।
সুরাই মেলের কুল
ব্যাটার বাড়ি খানাকুল
ওঁ তৎসৎ বলে ব্যাটা বানিয়েছে ইস্কুল ...
সুরাই মেলের ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম রামমোহনের। এই খানাকুল বর্ধমান চাকলার (পরবর্তীতে হুগলী জেলায়) এক গ্রাম। দ্বারকেশ্বর নদীর এক তীরে কৃষ্ণনগর, অন্য তীরে রাধানগর। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী যে কৃষ্ণনগর, এটা সেই কৃষ্ণনগর নয় বলে লোকমুখে এর নাম খানাকুল কৃষ্ণনগর। রামমোহনের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদে নবাবের অধীনে সরকারী কর্মচারী ছিলেন, নবাবের কাছ থেকে রায় উপাধি পেয়ে তিনিও কৃষ্ণচন্দ্র রায় নামে পরিচিত হন। মুর্শিদাবাদের শাঁকাসা গ্রামে ছিল তার নিবাস, সেখান থেকে নবাবের শাসনে বর্ধমানরাজের অধীনে বেশ কিছু গ্রামের জমিদারি দেখভালের সুযোগ পেয়ে তিনি প্রথমে খানাকুল কৃষ্ণনগরে বসতি স্থাপন করেন, পরে নদীর অন্য তীরে রাধানগরে উঠে যান। রাধানগরেই রামমোহনের জন্ম হয়।
কৃষ্ণচন্দ্রের তিন পুত্রের কনিষ্ঠ ব্রজবিনোদ মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার অধীনে সম্ভ্রান্ত পদে বহাল ছিলেন। পরে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে রাধানগরে ফিরে যান। জীবনের অন্তিমকালে পরম বৈষ্ণব ব্রজবিনোদ যখন ভাগীরথীতীরে অবস্থান করছিলেন, তখন শ্রীরামপুরের চাতরা নিবাসী শাক্ত ভঙ্গকুলীন শ্যাম ভট্টাচার্য তার কাছে এসে প্রার্থনা করেন, তার পুত্রদের একজন যেন শ্যামের কন্যাকে গ্রহণ করেন। বৈষ্ণব-শাক্তে বিবাহ এক রকম দুরূহ ব্যাপার, কিন্তু গঙ্গাতীরে এই অবস্থায় একজনের অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়াও যায় না। নিরুপায় ব্রজবিনোদ সম্মত হয়ে তার সাত পুত্রকে এক এক করে অনুরোধ করতে লাগলেন শ্যামের কন্যা তারিণীর পাণিগ্রহণ করতে। বড় মেজ সেজ ন’ পর পর চারপুত্র সেই প্রস্তাবে আমল দিল না। পঞ্চম পুত্র রামকান্ত এক রকম পিতৃসত্য রক্ষার্থেই মেনে নিল এই অসম-বিবাহ। তারিণী শ্বশুরালয়ে ফুলঠাকুরানি নামে প্রতিষ্ঠিত হলেন।
এই রামকান্ত-তারিণীর দ্বিতীয় পুত্র রামমোহন। জগন্মোহন তার সহোদর দাদা। রামলোচন নামে এক বৈমাত্রেয় ভাই ছিল তাদের।
আর পাঁচটা শিশুর মতোই রামমোহনের ছেলেবেলা শুরু হয়। পড়াশুনায় তার মতি ছিল খুব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে গুরুগৃহ, ভট্টাচার্যের চতুষ্পাঠী আর মৌলবিদের আরবি-ফার্সি শেখার জায়গা। বাড়িতেই রামমোহন সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ও কিছু ফার্সি ভাষা শেখেন। মুখে মুখে শিখতে হতো সংস্কৃত শ্লোক, শুভঙ্করী আর্যা আর তালপাতায় হাতের লেখা মকশো করতে হতো। মোগল যুগে ফার্সিই রাজভাষা, সরকারি সব ব্যাপারে ফার্সি জানতেই হয়। পিতা-পিতামহ এই ভাষা জানতেন, তার কিছু রামমোহনে সঞ্চারিত হয়। পরে আরবি শেখার জন্য রামকান্ত তাকে পাটনা পাঠিয়ে দেন। সেখানে আরবি ভাষায় অ্যারিষ্টটল ও ইউক্লিডের বই পড়ে ফেলেন রামমোহন। সঙ্গে ছিল আরবি ভাষায় কোরান পাঠও। পাটনায় শিখগুরু গোবিন্দ সিঙের জন্ম হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, এখানেই আছে তখত পাটনা সাহেব বা হরমন্দির সাহেব গুরদোয়ারা। গুরদোয়ারার মৃদঙ্গ সঙ্গীত তাকে স্পর্শ করেছিল। অল্প বয়সে একাধিক ধর্মের গ্রন্থপাঠ ও তাদের সংস্কারের অনুভবের মাধ্যমে তার মধ্যে একেশ্বরবাদের ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে। সুফিদের সহজিয়া দর্শন তাকে আকর্ষণ করে প্রবলভাবে।
পাটনায় বছর তিনেক কাটানোর পর রামকান্ত রামমোহনকে পাঠিয়ে দেন কাশীতে পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শেখার জন্য। আগে থেকেই ধর্মগ্রন্থ পাঠে মতি ছিল বলেই খুব অল্প সময়ে রামমোহন বেদ ও বেদান্তে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রাচীন হিন্দু ব্রহ্মজ্ঞান ও মুসলমানি একেশ্বরবাদের সামঞ্জস্য লক্ষ করে ক্রমে ক্রমে তার মধ্যে প্রচলিত হিন্দু-সংস্কারের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতে থাকে। কাশী থেকে ফিরে এসে এই নিয়ে রামকান্ত ও রামমোহনের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে যায়।
মাত্র ষোল বছর বয়সে রামমোহন এক পুস্তিকা লিখে ফেলেন – ‘হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী’ নাম দিয়ে। ছাপা বই না, হাতে লেখা, তবে তার ছত্রে ছত্রে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। বাবা রামকান্ত প্রচণ্ড ধর্মভীরু, তিনি এসব অন্যায় আর বরদাস্ত করতে পারলেন না। বাড়ি থেকে বের করে দিলেন রামমোহনকে।
বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি কিছুকাল তিব্বতে কাটিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের আচার-ব্যবহার-কথাবার্তা সম্যকরূপে পর্যবেক্ষণ করে রামমোহন একসময় ফিরে এলেন। তিব্বতে দেখে এলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনযাত্রা।
প্রায় বছর চারেক তিনি এইভাবে ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছিলেন। বাবা রামকান্ত ছেলেকে তাড়িয়ে দিয়ে বিশেষ সুখী ছিলেন না, তিনি এর মধ্যেই পুত্রের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় লোক পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রেরিত লোকের সঙ্গেই একদিন রামমোহন ফিরে এলেন নিজের গৃহে। বাবা আনন্দের সঙ্গেই ছেলেকে গ্রহণ করলেন। ভাবলেন, বিয়ে দিয়ে ছেলেকে সংসারী করে দিলে এই বাউণ্ডুলেপনা, এই অধার্মিক মনোভাব দূর হয়ে যাবে। মা তারিণী দেবীও হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে শোকের সমুদ্র থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
বিয়ে হ’ল রামমোহনের। একটা না, এক এক করে তিনবার। প্রথমা স্ত্রী বেশিদিন বাঁচেননি, তিনি গত হতেই দ্বিতীয় ও পরে তৃতীয়বারের জন্যে দার পরিগ্রহ করেন রামমোহন – সবই পিতৃ-অনুগ্রহে। সেই সঙ্গে চলল আবার আগের মতই প্রবল আগ্রহে সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ পাঠ। আবার পিতা-পুত্রে বিবাদ বাধতে লাগল। রামমোহন পিতাকে শ্রদ্ধা করলেও নিজের মত ষ্পষ্টভাবে জানাতে দ্বিধান্বিত নন। রামকান্ত প্রচলিত মতের পক্ষে, যদিও বৈষ্ণব, সুতরাং স্বভাববিনয়ী, কিন্তু তার পক্ষেও রামমোহনের উগ্র মনোভাব মেনে নেওয়া শক্ত।
ততদিনে অবশ্য রামকান্ত জমিজমা ছেলেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়েছেন। রামমোহন সেই দান নিতে অস্বীকার করেও তার দেখাশুনা করছেন নিয়মিত। রাজস্ব জমা করছেন বর্ধমানের রাজার কোষে। উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন কলকাতা। সেখানে চলছে তার ইংরাজি শিক্ষা, আইন শিক্ষা, আরবি-ফার্সি চর্চা।
রামকান্ত ভেবেছিলেন একবার বাইরে গিয়ে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে ছেলের। এবার সে ধর্মকর্ম ছেড়ে সংসারে মন দেবে, জমিজমা বাড়াবে। সেদিকে মন নেই রামমোহনের। তার জন্মের মাত্র দু’বছর আগেই বাংলায় ঘটে গেছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। সেই ঘা শুকায়নি এখনও। হেস্টিংস ও পরে কর্ণওয়ালিশ এসে রাজস্ব ব্যবস্থার নীতিনির্ধারণ করেছেন বটে, তবে তাতে সাধারণ মানুষ বিশেষ স্বস্তিতে নেই। কর্ণওয়ালিশ প্রথমে জমিদারি পাঁচ বছরের জন্যে ইজারা দিয়ে হাঁড়ির চাল পরীক্ষা করে নিলেন, পরে দশ বছরের জন্যে। পাঁচশালা ও দশশালা ব্যবস্থায় কম্পানির ঘরে খাজনা আসা শুরু হতেই সেটাকে করে দিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
এসব চলাকালীন অনেকেই প্রচুর কামিয়ে নেন, অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। রামকান্ত বেশ অনেকটা জমির জমিদার হয়েছিলেন, তবে আইন এমনই কড়া যে দিনের দিন রাজস্ব যে কোনও কারণে জমা না পড়লে জমিদারকে জেলে ভরে দেওয়া হবে আর তার জমিদারি ফের নিলামে উঠবে। দাম দিয়ে তা কিনে নেবে অন্য কোনও জমিদার।
এই সব সমস্যা এড়াতেই জমি ভাগ করে বন্টন করে দিলে খানিকটা সুবিধে, রামকান্ত তাই করলেন। কিন্তু ছেলের বেয়াদপি এমনই বেড়ে চলল, যে দ্বিতীয়বারের জন্যে তাকে ঘাড়ধাক্কা দিতেই হ’ল। আগের বারের মত পুরোপুরি তাড়িয়ে দিলেন না, মাঝে মাঝে পয়সাকড়ি পাঠাতে লাগলেন কলকাতায়, তবে ঐ অবধিই।
কলকাতা থেকে রামমোহন চলে গেলেন ঢাকা, টমাস উডফোর্ডের দেওয়ান হয়ে। রামমোহনের জমি দেখাশুনা করতে লাগলেন রামকান্ত। রামমোহন জানতে পারলেন না, যে জমিদারি সামলে রাজস্ব আদায় করে তিনি বহু টাকা উদ্বৃত্ত হিসাবে ঘরে তুলতেন, সেই একই জমির রাজস্ব অনাদায়ে রামকান্ত গ্রেপ্তার হয়ে জেলে চলে গেছেন। তাকে রাখা হয়েছে হুগলির দেওয়ানি জেলে। পরের বছর একই দায়ে পৃথক জমির জমিদার বড়দা জগন্মোহনও চলে গেল মেদিনীপুর দেওয়ানি জেলে। জেলেই রামকান্তর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সোনাদানা ও অন্যান্য সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয় বর্ধমানের বাড়িতে। সে খবর যায় রামমোহনের কাছে। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রামমোহন বাড়ির পথ ধরেন।
পিতার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হ’ল না রামমোহনের, খানাকুল পৌঁছানোর আগেই তিনি মর্মন্তুদ খবর পেলেন – পিতৃদেব প্রয়াত। শুধু তাই নয়, মাতৃদেবী নিজের গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে শ্রাদ্ধশান্তিও চুকিয়ে ফেলেছেন অপৌত্তলিক রামমোহনের জন্য অপেক্ষা না করেই। তিনি চাননি ম্লেচ্ছভাবাপন্ন ‘বিধর্মী’ পুত্রের কোনও সংস্পর্শ থাকুক পিতার অন্তিম সংস্কারে। বড়দা জগন্মোহন তখনও মেদিনীপুর জেলে বন্দী, সেই জেলের মধ্যে বসে তিনি পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেছেন যতটুকু করা সম্ভব সেভাবে।
হতাশ রামমোহন কলকাতা ফিরে এলেন। তার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। এই জাত-পাত-ধর্ম-পুতুলপুজো-বিবাহ-সন্তান-সম্পত্তি সব এক বিপুল শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সাধারণ মানুষ এ সবের ওপরে ভাবতেই পারে না। লেখাপড়া জানে না মানুষ, শেখার ইচ্ছেই নেই। একজন যা বলল, তা নিয়েই নাচতে শুরু করে অন্য হাজারজন। ইংরাজি বইপত্তর পড়ে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি – ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন – ও তৎসংক্রান্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নাম শুনেছেন রামমোহন। সে সব এ দেশে কই? কবে আসবে? কে আনবে? ইংরেজ এ দেশে প্রভু হয়ে বসেছে, তাদের সব কিছু কার্যকলাপ তাদের নিজেদের সুযোগ সুবিধার জন্যেই। এ দেশের মানুষের সুযোগ সুবিধার কথা তবে কে ভাববে?
কলকাতার গঙ্গাতীরে পিতৃশ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করলেন রামমোহন। তিনি পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী নন তো কী! তিনি হিন্দুই। সন্তান পিতার শ্রাদ্ধ করবে, এটাই হিন্দু সংস্কার, তিনিও করবেন। অতি প্রত্যূষে গঙ্গার তীরে এসে দাঁড়ালেন রামমোহন। পুবের আকাশে রঙ ধরছে, আর একটু পরেই দিনমণি উদিত হবেন।
পবিত্র গায়ত্রীমন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে এসে লাগল দিনের প্রথম সূর্যকিরণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূর্য। নতুন শতাব্দী সদ্য শুরু হয়েছে, সদ্যোজাত শিশুর মত হামাগুড়ি দিচ্ছে সে। মনুষ্যশিশুকে মানুষ করে তুলতে হলে তার হাত ধরতে হয়, তাকে হাঁটা শেখাতে হয়। এর জন্যে কাউকে দায়িত্ব নিতেই হয়। ভারতবর্ষের নতুন শতাব্দীকে ঘুম থেকে জাগানোর দায়িত্ব তিনিই নেবেন।
পরলোকগত পিতৃদেবকে স্মরণ করে রামমোহন মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন – মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ ...
(প্রথম খণ্ড সমাপ্ত)