ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
দিনমণি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
(১)
তখনও অন্ধকারের কুয়াশা কাটে নাই, আকাশে দুই/একটি তারা ফুটিয়া আছে। রাতচরা পাখিরা একটি একটি করিয়া কুলায় ফিরিতেছে। জানালার ভিতর দিয়া অল্প একটু উঁকি মারিয়া দিনমণি বুঝিতে চেষ্টা করিলেন ঠিক কতখানি সকাল হইয়াছে। তাহার পর তক্তাপোষ হইতে নামিয়া ঋজু হইয়া দাঁড়াইলেন। ধুতির ন্যায় সরু কালো পাড় সাদা থান শাড়ীটি গায়ে মাথায় ভালো করিয়া জড়াইয়া দুটি হাত যুক্ত করিলেন, ঈষৎ ক্ষীণ স্বরে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রণতি জানাইলেন। প্রত্যুষে প্রার্থনা দিয়া তাঁহার দিন আরম্ভ হয়। ঈশ্বর বিনা সত্তর বৎসরের গ্রাম্য বাল্য বিধবার এই পৃথিবীতে আর আছে কে?
ঘরের কবাট খুলিয়া দিনমণি বাহিরে আসিলেন। বৃহৎ দরদালান পার হইয়া প্রশস্ত উঠানে পা রাখিলেন। উঠানের চারিধারে ঘর, শুধু উত্তরের কোণে একটি বৃহৎ দরজা, বাহিরে যাইবার। রাত্রি প্রায় বারটার সময় গৃহের মনিব, অতিথি-অভ্যাগত, আত্মীয়-স্বজন, চাকর-বাকর সকলে ফিরিলে তাহা বন্ধ হয়। খুলিবার কোন নির্দিষ্ট সময় নাই। এখন সবে শীতকাল পড়িতে শুরু করিয়াছে, কিন্তু শীত এখনও থাবা বসায় নাই, সবে হাসি-মস্করা শুরু করিয়াছে। যে অগ্রে উঠিবে, সেই দরজা খুলিয়া ঠেকা দিয়া রাখিবে, দরজা বন্ধ হইবে আবার নির্দিষ্ট সময়ে। দিনমণি ধীরে ধীরে সেইদিকে অগ্রসর হইলেন। বন্ধ দরজার কবাটের হাতলে হাত দিয়াছেন, অমনি একটি ঘরের দ্বার খুলিয়া গেল, একটি কিশোর বালক উঠানে নামিয়া আসিল। খালি পা, পরনে একটি হাফপ্যান্ট, সূতীর জামা। গায়ে কোনও উড়নি নাই। ভোরের হাওয়ায় শীত শীত করিতেছিল। বালকটি দুই হাত বুকের উপরে জড়ো করিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর দিনমণির পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিয়া চুপি চুপি কহিল, ‘‘যাই, পিসি?’’
বালকের চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিলেন দিনমণি। ‘‘এসো বাবা, কিন্তু উড়নি না নিয়ে গেলে তোমার যে ঠাণ্ডা লাগবে, মাণিক! এরপরে শীত পড়বে। দাঁড়াও...’’ বলিয়া ত্বরিত গতিতে ভিতরে গেলেন বৃদ্ধা। আলনা হইতে তাঁহার সাদা, মলিন সিল্কের চাদরটি হাতে লইয়া কি যেন ভাবিলেন। তাহার পর প্রণামী পাওয়া একটি আধুলিও হাতে লইয়া পুনরায় উঠানে আসিলেন। আধুলিটি হাতে দিয়া উড়নিটি গায়ের উপর আলগোছে ফেলিয়া দিলেন। বালক অল্প হাসিয়া দিনমণির শাড়ির আঁচলে একবার মুখটি মুছিয়া লইয়া কবাটের বাহিরে আসিল। দিনমণি মুখ বাহির করিয়া দেখিলেন, আরো দুইজন বালক তথায় উপস্থিত হইয়া অপেক্ষা করিতেছে। বালকটিও দিনমণির প্রতি একবার চাহিয়া তাহাদের সঙ্গী হইল।
বালকটির অতি প্রত্যূষে গৃহত্যাগ সম্বন্ধে তাহার আপনার জন কেহই জানিল না। জানিলেন শুধু এই অনাথা বাল্যবিধবা, যাঁহার সহিত এই বৃহৎ পরিবারের কোন সংযোগ নাই। কিন্তু ইহার মত আপনার জনও বালকটির আর কেহ নাই, তাহার আপনার পিতামাতাও নহে। দিনমণি যতদূর দৃষ্টি যায় চাহিয়া রহিলেন। তাহার পর দৃষ্টির আড়াল হইলে কবাট আলগারূপে বন্ধ করিলেন।শাড়ীর আঁচলটি বক্ষে চাপিয়া উর্দ্ধমুখে আকাশের পানে চাহিয়া অশ্রুসিক্ত চক্ষে ঈশ্বরের নিকট মিনতি করিলেন, ‘‘রক্ষা কর ঠাকুর!’’
পূর্ব গগনে তখন রক্তিম আভা, দিনমণি এইবার উদিত হইবেন।
************************
দেবগ্রামের ভট্টাচার্য্য পরিবারটি পাণ্ডিত্যে, ধনে, মানে এই তল্লাটের আর পাঁচটি পরিবার হইতে পৃথক ছিল। পণ্ডিত বংশ হওয়ার কারণে পাণ্ডিত্যের অহঙ্কার ছিল, অধ্যাপনার সহিত কিঞ্চিৎ অর্থও যুক্ত হইয়াছিল, তাহার উপর আবার রাজার অনুগ্রহ ছিল। এই রাজা বিদেশী বিলাতী রাজা নহেন, স্থানীয় স্বদেশী রাজা, ধনে মানে তিনিও বড় রাজা ছিলেন। তখনও রাজাদের রাজত্ব যায়নাই, তাঁহারা সুখে রাজত্ব করিতেছেন। স্বভাবতঃই রাজ অনুগ্রহের কারণে সকলে ভয় করিত। পরিবারটিতে বিদ্যার কারণে ভক্তিও যোগ হইয়াছিল। ভয়ে ও ভক্তিতে পরিবারের লোকজন ব্যতীত গ্রামস্থ সকলেই একরকম তাহাদের প্রজা হইল, অন্যান্য প্রজাগণ তো ছিলই।
কিন্তু রাজা হইলে তাহার কিছু বিড়ম্বনাও আছে। ধনী গৃহস্থের ঘরে অভাব নাই। নিত্যদিন শুধুমাত্র সেই কারণেই আত্মীয়, পরমাত্মীয় দেখা দিতে লাগিল। যাঁহারা একদিনের জন্য আসিয়াছিলেন, বহুদিন কাটাইয়া গেলেন। কেহ কেহ আসিয়া সারাজীবন রহিয়া গেলেন, যাইবার ইচ্ছাও রহিলনা। এইভাবে অমুক পিসি, তমুক মাসি, অমুক খুড়া, তমুক জ্যাঠার দল আসিতে লাগিল। অট্টালিকার একতলার ঘরগুলি তাহাদের দখলেই গেল। ক্রমে ক্রমে কোন্দল, তথা হইতে নালিশ এবং সর্বশেষে কর্তারনিকট যাওয়া দুষ্কর মনে করিয়া গৃহিণীর মন রাখিবার প্রয়াস চলিতে লাগিল। ইহাদেরই একজন দিনমণি, গৃহকর্তার কোন সুবাদে পিসি হইয়া এই গৃহে আসিয়াছিলেন, তাহা কেহ জানে না। কি মনে করিয়া তাঁহাকে এই বাড়িতে চিরতরে স্থান দেওয়া হইয়াছিল, তাহাও কেহ জানে না। তবে দিনমণি কাহাকেও ছাড়িয়া কথা কহেন না, কখনও বা গৃহিণীকেও নহে। আবার প্রয়োজনে সারারাত জাগিয়া বসন্ত রোগীর সেবা করিতে তাঁহার মত আর কেহ পারেন না, দিনরাত এক করিয়া রোগী ক্রোড়ে করিয়া বসিয়া থাকেন। এমন সেবাপরায়ণা নারীও বড় চোখে পড়ে না। দিনমণির এই কোমল দিকটির পরিচয় পাইয়াছিল আজিকার বালকটি। দিনমণিও সেই বাৎসল্যের সুবাদে তাহাকে আপন বলিয়া মনে করিতেন, আর কেহ তাঁহার আপন ছিল না।
গৃহে একমাত্র দিনমণিই জানিতেন বালকের অভিপ্রায়।
(ক্রমশঃ)