রম্যরচনা : নারায়ণ রায়
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
একটা ছোট্ট পর্দায় সিনেমা
কিম্বা
যত বড় ঘর তত বড় টি ভি
নারায়ণ রায়
১৯৭২ সাল, এপ্রিল মাস, পশ্চিম বঙ্গের একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে ২৩-২৪ বছরের এক গ্রাম্য যুবক কলকাতায় এসেছে চাকরি করতে। ছেলেটার নাম পল্টন ।পল্টন এতটাই গাঁইয়া যে একদিন কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে একটা হাওড়া-গামী বাসে উঠে কন্ডাকটরকে দশ পয়সা দিয়ে বলল একটা শিয়ালদার টিকিট দিন তো? কনডাকর বাস থেকে নমিয়ে দিয়ে বলল, “শিয়ালদা উল্টোদিকে, এটা শিয়ালদা থেকেই আসছে।” তখন পল্টন কলেজ স্ট্রীট জংশনে নেমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস ঠিক করে নিল যে ডান দিকটা হাওড়া স্টেশন আর বাম দিকটা শিয়ালদহ স্টেশন। তবে বহুক্ষেত্রেই এই ধরনের মানুষের সরলতাকে লোকে মুর্খামি বলে মনে করে। পল্টন কিন্তু মুর্খ নয়, সে উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বিভাগ এবং পলিটেকনিকে প্রথম শ্রেনী। তবে এতটাই সরল যে কলকাতায় ওকে মাত্র গত দু বছরের মধ্যেই বেশ কয়েকবার ঠকতে হয়েছে। অফিসেও ওর বন্ধুরা কারণে অকারণে ওকে নিয়ে মজা করে। এমনকি উপরওয়ালাও যতসব ঝামেলার কাজগুলো, যেগুলো কায়দা করে সবাই এড়িয়ে যেতে চায়, সেগুলোই ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। যেমন অফিস টাইমে একটা ব্যস্ত রাস্তার একদিক বন্ধ করে কাজ হচ্ছে, আর সারাদিন পথ চলতি হাজার হাজার লোকের গালা-গাল, টিপ্পনি সহ্য করে সেই কাজ সুপার ভাইজ করা সহজ কথা নয়। এমনও হয়েছে যে জামা ধরে টানা টানি, এমনকি গায়ে দু-চারটে চড়-থাপ্পড়ও যে পরেনি তাও নয়। আর এই ধরনের কাজ দেখার জন্য অবধারিত ভাবে পল্টনের ডাক পড়বে।
১৯৭৪ সাল, পল্টনের প্রায় বছর দুয়েক চাকরী হল, সেদিনও তেমনই একটা ঝামেলার কাজের তদারকি করছিল পল্টন, দক্ষিন কলকাতার শরৎ বোস এভিনিউ-এ, সাউথ কলকাতা গার্লস কলেজর সামনে। রাস্তা খুড়ে ড্রেন পাইপ বসানোর কাজ হচ্ছে, এদিকে কলেজের ছুটি হয়েছে, পিল পিল করে মেয়েরা বেরিয়ে পড়েছে, এলাকাটা পুরো জ্যাম। আস্তে আস্তে পল্টনও একটু চালাক চতুর হচ্ছে, সে টুক করে ভীড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে একটা দোকানের সামনে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে গেল যে তাকে যেন কেউ ওই কাজের সঙ্গে যুক্ত লোক বলে চিনতে না পারে। অথচ ওখান থেকেও ও ওর শ্রীময়ীকেও দেখতে পাবে। এত শত শত মেয়ের মধ্যে ওকে যেন পল্টনের চোখে অন্যরকম লাগে। শরীরের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভুতি, যেটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মেয়েটির নাম অবশ্য ও জানে না, শ্রীময়ী তার দুই বন্ধুকে নিয়ে তিনজন একসঙ্গে বেরোয় তারপর বাসে বালিগঞ্জ স্টেশন আর সেখান থেকে দক্ষিনমুখি কোন ট্রেনে চাপে। একদিন পল্টন সেটা চুপি চুপি লক্ষ্য করেছে। ওই তিনজনের মধ্যে মেয়েটির বেশ নেতা নেতা ভাব আছে। শ্রীময়ী নামটি অবশ্য পল্টনেরই দেওয়া, ওর ধারনা এই ধরনের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা সুমুখশ্রী মেয়ের নাম শ্রীময়ীই হওয়া উচিৎ। আর ওর বাড়ি নিশ্চই ধবধবি, সূর্যপুর কিম্বা দক্ষিন বারাসত স্টেশনের কাছে এক বৃক্ষরাজি শোভিত সবুজ গ্রামে। মুহুর্তেই পল্টন তার কল্পরাজ্যে চলে যায়। এই ঘিঞ্জি শহর ছেড়ে একটি ছোট্ট স্টেশনে নেমে গাছ-পালা ঢাকা গঞ্জের রাস্তা ধরে কয়েক পা হেঁটে গেলেই একটি সুন্দর ছবির মত বাড়ি আর তার “ঐ জানালার ধারে বসে আছো তুমি করতলে রাখি মাথা…..।”
হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে পল্টন সম্বিত ফিরে পেল। এদিকে তখন শরৎ বসু রোডে সাউথ কলকাতা গার্লস কলেজের বিপরীতে একটা রেডিও, গ্রামফোনের দোকানের সামনে বেশ জটলা। পল্টন যথরীতি কৌতুহলি হয়ে অনেক চেষ্টা করে ভীড় ঠেলে উঁকি মারতেই ….. উফ্ ফ্ ফ্ সে কি রোমাঞ্চ, উফ্ ফ্ ফ্ সমগ্র শরীরে সে কি শিহরণ। দোকানে শোকেসের ভিতরে একটা টি ভি চলছে, পল্টন জীবনে এই প্রথম টি ভি দেখল। ঠিক যেন একটু বড় সড় দেখতে একটা রেডিওর মত একটা চৌকো বাক্স, তার সামনের দিকে পর্দায় ঠিক যেন একটা সিনেমা চলছে। এ যেন হলে দেখা সিনেমারই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। তখন টি ভি তে টেবিল টেনিস খেলা দেখানো হচ্ছিল।
বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল কলকাতায় এবার টেলিভিশন আসছে। জানা গেল সে বছর অক্টোবরে কলকাতায় “ওয়ার্ল্ড টি টি চাম্পিয়নশিপ” হবে, আর ঐ খেলার সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে কলকাতায় টেলিভিশনের উদ্বোধন হবে। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী রেডিওতে আর খবরের কাগজে তাই নিয়ে কত বিবৃতি দিলেন। ধনী, দরিদ্র, আবাল বৃদ্ধ বনিতা, সকলের মধ্যে একটা দারুণ কৌতুহল। অবশেষে কলকাতায় সেইদিনটি এল এবং প্রথম দিনেই পল্টন তার সাক্ষী হয়ে থাকতে পেরে এতটাই আনন্দে আত্মহারা হ’ল যে উপস্থিত আর পাঁচজনের মত পল্টনও হাতদুটোকে মাথার উপর তুলে জোরে জোরে হেসে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। আর ঠিক সেই সময়ে ঐ ভীড়ের মধ্যে তার পাশ দিয়ে দুই বন্ধু সহযোগে যেতে যেতে পল্টনকে শুনিয়ে শ্রীময়ী বলে গেল, “হাঁদারামর মত টি ভি দেখে অত লাফা লাফি করার কি আছে? একটা ছোট্ট পর্দায় সিনেমা হচ্ছে ভেবে নিলেই হয়!”
১৯৮৪ সাল, পল্টনের ইতিমধ্যে বিয়ে হয়েছে, এবং একটি চার বছরের কন্যাকে নিয়ে সুখের সংসার। পল্টনের স্ত্রী ভাগ্য সত্যিই খুব ভালো, যেমন দেখতে শুনতে তেমনই কাজে কর্মে, ছন্নছাড়া পল্টনের সংসারটির শ্রী ফিরিয়ে দিয়েছে সে। বছর খানেক হ’ল কিস্তিতে একটা সাদা-কালো টিভিও কিনেছে। তখন টিভিতে সারাদিনে বাংলা অনুস্ঠান বলতে একটা মাত্র চ্যানেলে সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে আটটা। তার মধ্যে আবার সপ্তাহে একদিন চিত্রমালা আর একদিন বাংলা সিনেমা ছাড়া বাকী সব অনুষ্ঠানই প্রায় সরকারী প্রচারমূলক। তবে একটা জিনিস ওরা স্বামী স্ত্রী লক্ষ্য করেছে যে ওদের চেয়ে টিভির প্রতি ওদের চার বছরের মেয়ের আকর্ষণটাই বেশী। টিভি খুললেই সামনে বসে পড়ে আর হাঁ করে ধান চাষ থেকে রাগপ্রধান গান সবই গোগ্রাসে গিলে যায়। ঐ বয়সের বাচ্ছাদের ভাত খাওয়ানো এক সমস্যা, কিন্তু টিভি চালিয়ে দিলে টিভির সামনে বসিয়ে ওর মা যা খাইয়ে দেয় তাই খেয়ে নেয়। পাশের ফ্লাটের আন্টি পর্যন্ত ওর নাম দিয়েছেন ‘টিভিগার্ল’।
এদিকে মেয়ের দুরন্তপনা বাড়ার পর অনেকদিন দুজনের একসঙ্গে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয়নি, পাড়ার সিনেমা হলে সত্যজিৎ রায়ের “ঘরে বাইরে” এসেছে।একদিন পল্টন আর ওর স্ত্রী দুজনে ঠিক করলো যে দুজনে সিনেমা দেখতে যাবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ, সেই রবিবার সন্ধ্যাবেলায় মেয়েকে কোলে নিয়ে হলে ঢুকলো ওরা। এমনিতে ঐটুকু একটা বাচ্ছার কি ওই অন্ধকার ঘরে চুপ করে বসে থাকতে ভালো লাগে? তারপর আবার তেমন ছেলে ভোলানো বাচ্ছাদের বই হলে তবু কথা ছিল। হলে ঢুকে অব্দি কখনও জল খাবো, কখনও খিদে পেয়েছে, কখনও গরম করছে বলে বাবা মা কে পাগল করে দিতে আরম্ভ করলো।পল্টন বার বার মেয়েকে ভোলাবার জন্য হলের বাইরে নিয়ে চলে আসে, সিনেমাটা সেইভাবে দেখাই হ’ল না। যাই হোক অবশেষে শো শেষ হলে মেয়েকে কোলে নিয়ে দুজনে বাড়ি ফিরল। ওদেরকে বাড়ি ফিরতে দেখে পাশের বাড়ির আন্টি পল্টনের স্ত্রী শ্রীময়ীর কোল থেকে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে জিগ্যেস করলেন, “কি রে টিভি গার্ল, কেমন সিনেমা দেখলি?” টিভিগার্ল উত্তর দিল, “জানো আন্টি, ওদের টিভি টা না কি বড়!” তারপর তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত করে বলল, “যত বড় ঘর তত বড় টি ভি ।” হটাৎ শ্রীময়ী আর পল্টনের মনে পড়ে গেল দশ বছর আগের সেই দিনটির কথা, “ হাঁদারামের মত টি ভি দেখে অত লাফা লাফি করার কি আছে? একটা ছোট্ট পর্দায় সিনেমা হচ্ছে ভেবে নিলেই হয়!” আর এ কথা মনে পড়তেই দুজনের মনটা খুসিতে নেচে উঠল।