ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক২৪.১
গাঁয়ের এক পাশে একটা ছোট পুকুর মত ছিল যা দেখলে মনে পড়বে “থাকিলে ডোবাখানা, হবে কচুরিপানা”। নোংরা পাঁক, দুর্গন্ধে বজবজ করছে। কিছু টাট্টু ঘোড়া, ধোপার গাধা, ঘেয়ো কুকুর আর শুয়োর ওটা দেখে খুশিতে ডগোমগো। পোকামাকড়, ডাঁশ, মশা মাছি ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর জটিলতার থেকে সরে গিয়ে সমানে অযুত নিযুত হারে বংশবৃদ্ধি করে চলেছে। ওরা বোধহয় আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে যে আমরাও যদি ওদের কায়দায় বাঁচতে শিখি তাহলে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি বলে কোন সমস্যা থাকবে না।
নোংরামি কিছু কম পড়িয়াছে ভেবে গাঁয়ের দু’ডজন ছেলে পেটের স্বেচ্ছাচার থেকে নিস্তার পেতে নিয়মিত এখানে আসে-- সকাল সন্ধ্যে বা দিনের যে কোন সময়। এরা এসে এই ডোবার কিনারে --কঠিন, তরল ও বায়বীয়—তিনরকম পদার্থ ত্যাগ করে হালকা হয়ে ঘরে ফেরে।
কোন পিছিয়ে থাকা দেশেরও যেমন কোন- না- কোন আর্থিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকে, তেমনই এই নোংরা ডোবাটারও বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এর আর্থিক বিশেষত্ব হোল গায়ে লাগা ঢালু জমিতে খুব ভাল ঘাস জন্মায় আর গ্রামের এক্কাওলাদের ঘোড়াগুলোর খাদ্যসমস্যা এভাবেই দূর হয়। রাজনৈতিক গুরুত্ব হোল শনিচর এখানে এসে এক্কাওলাদের ভেতর ওর পঞ্চায়েতি নির্বাচনে মোড়ল হওয়ার জন্যে ভোট চাইতে এসেছে।
শনিচর যখন ডোবার কিনারে পৌঁছল তখন দু’জন ঘেসেড়ে ঘাস কাটছিল। ওরা পেশায় ঘেসেড়ে নয়, বরং এক্কাওলা। এমন যে এলাকায় সাইকেল রিকশার চলন হওয়ার পরও প্রাণে ধরে পেশা ছাড়েনি, ঘোড়াগুলোর সঙ্গে এখন অবধি টিকে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাইকেল-রিকশা চালকদের হুজুম যে ভাবে দ্রুত বেড়ে উঠছে তার থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে দেশের আর্থিক নীতি খুব ভাল আর দেশের ঘোড়াগুলো কোন কাজের নয়। আর এটাও বোঝা যাচ্ছে যে আমরা সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি। প্রথমে ঘোড়া ও মানুষের প্রভেদ দূর করেছি এখন মানুষে মানুষে ভাগাভাগি দূর করতে হবে।
এসব তো যুক্তি দিয়ে সিদ্ধ করা যায়, কিন্তু এই যে শিবপালগঞ্জ ও শহরের পথে এক ডজন সাইকেল-রিকশা চলছে, তারপরেও দুটো এক্কাগাড়িওলা আর ওদের ঘোড়া এখনও হাপিস হয় নি কেন —তার যুক্তি কী?
মানলাম, ঘোড়াগুলো এই ডোবার পাড়ে ঘাস খেয়ে বেঁচে আছে, কিন্তু এক্কাওলারা? ওরাও কি এদের কায়দাতেই পেট ভরাবে? উঁহু, খাদ্যবিজ্ঞানের সূত্র বলে মানুষের বুদ্ধি মাঝে মাঝে ঘাস খেয়ে পুষ্ট হতে পারে বটে, কিন্তু খোদ মানুষ এভাবে বাঁচতে পারে না।
শনিচর যখন এক্কাওলাদের কাছে গেল তখন ওর মনে এত সব গম্ভীর আর্থিক সামাজিক ভাবনা ছিল না। ওর মাথায় একটাই চিন্তা—ভোট চাই। সুতরাং ও কোন ভুমিকা ছাড়াই সোজাসুজি কাজের কথায় এল।
--দেখ, আমি এবার পঞ্চায়েত প্রধান হবার জন্যে কাগজ জমা করেছি। যদি নিজের ভাল চাও, তো আমাকে ভোট দাও।
একজন এক্কাওলা শনিচরকে উপর থেকে নীচ আর নীচ থেকে উপর অব্দি একনজর মেপে নিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করল—“ এ হবে প্রধান? পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি”!
ভোট ভিক্ষায় পথে নামলে অনেক বড় বড় নেতাও নম্র হয়ে যান। আর এ তো শনিচর! জবাব শুনে ওর তেজ গায়েব হোল, দাঁত বেরিয়ে এল। বলল, “আরে ভাই, আমি প্রধান হব নাম-কে-ওয়াস্তে। আসল প্রধান তো বৈদ্যজী মহারাজ। ব্যস, এটা মেনে নাও যে তুমি ভোটটা আমাকে নয় বৈদ্যজীকে দিচ্ছ। ধরে নাও, আমি নই স্বয়ং বৈদ্যজী তোমার কাছে ভোট চাইতে এসেছেন”।
ওরা একে অন্যকে দেখল, তারপর চুপ মেরে গেল। শনিচর বলল, “বল ভাই, কী ভাবছ”?
“বলার কী আছে”? অন্যজন মুখ খুলল, “বৈদ্যজী নিজে ভোট চাইছেন ! ওনাকে কে মানা করবে? আমরা কি ভোট নিয়ে আচার দেব? নিয়ে যান! বৈদ্যজীই নিয়ে যান”।
প্রথমজন উৎসাহিত। “ভোট সালা কোন একশ টাকার চিজ? যে কেউ নিয়ে যাক”।
অন্যজন প্রতিবাদ করল, “যে কেউ কেন নেবে? এই প্রথম বৈদ্যজী আমাদের কাছে কিছু চেয়েছেন। উনিই পাবেন, নিয়ে যান”।
শনিচর বলল, “তাহলে পাকা কথা ধরে নিই”?
দুজনে একসাথে যা বলল তার সার—মরদের কথার নড়চড় হয় না। আমাদের দেবার মত কিছু নেই, তবে বৈদ্যজী কিছু চাইছেন, ওনাকে ‘না’ বলা কঠিন। আশা করি তুমিও প্রধান হয়ে গেলে মাটিতে পা ফেলবে, আকাশে বাঁশ দিয়ে খোঁচাবে না”।
শনিচর চলে গেছে। ওরা দু’জন খানিকক্ষণ চুপচাপ ঘাস কাটতে লাগল। আর মাঝে মধ্যে আজকাল ঘাস কেন কমে যাচ্ছে সে নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। হঠাৎ চোখে পড়ল একজন লোক চলে যাচ্ছে। ওর আসল নাম কেউ জানে না, সেটা শুধু সরকারের কাগজে লেখা রয়েছে। সবাই ওকে বলে “রামাধীনের ভাইয়া”। ও হচ্ছে শিবপালগঞ্জের গ্রামসভার বর্তমান প্রধান। তবে গ্রামের সবাই মনে করত আসল প্রধান হলেন রামাধীন ভীখমখেড়িজী।
বিগত বছরগুলোয় গ্রামের দীঘিগুলোর মাছের নীলাম বেশ উঁচু দরে হয়েছিল। আর পড়তি রুক্ষ জমির পাট্টা জারি করেও সভার আয় বৃদ্ধি হয়েছিল। গ্রাম পঞ্চায়েত কখনও সখনও চিনি আর ময়দার কোটা বিতরণের কাজ করছিল। এইসব মিলে গ্রামসভা বড়লোক হচ্ছিল। তবে শিবপালগঞ্জে সবাই জানত যে গ্রামসভার বড়লোক হওয়া আর সভার প্রধানজীর বড়লোক হওয়া একই কথা। ফলে প্রধানের পদ বেশ লাভপ্রদ হয়ে গেল।
শুধু তাই নয়, প্রধানের পদ বেশ সম্মানেরও বটে। বছরে দু-একবার থানাদার ও তহশীলদার ওকে ডেকে এনে দু’চারটে গাল দেয় বটে, সে দিক গে। আলো-আঁধারিতে গাঁয়ের একাধ গুন্ডা ওকে পাঁচ দশটা ঢিল ছোঁড়ে , তা ছুঁড়ুক গে’। তাতে ওই পদের সম্মান বা মর্যাদায় কোন আঁচ লাগে না। কেননা আমাদের গোটা দেশে এবং শিবপালগঞ্জে সম্মান সেই পায় যে বড়লোক হয়েছে, সে যেভাবেই হোক না কেন! এছাড়া গোটা দেশের মত এখানেও কোন সংস্থার পয়সা ফোকটে হজম করে গেলে বড়লোকের সম্মান কমে যায় না।
এইসব কারণে রামাধীনের বড়দার ইচ্ছে এবারেও প্রধানের গদি আঁকড়ে থাকার।
এখন উনি ওনার ছোলার ক্ষেতের পাশে পড়শির ক্ষেত থেকে একগাদা চারা তুলে ফেলে বড় বোঝা বগলে পুরে ঘরে যাচ্ছিলেন এবং যেতে যেতে উঁচু গলায় গাল পাড়ছিলেন –যাতে লোকে জেনে যায় যে আসলে ওনার ক্ষেত থেকেই ছোলাগাছ চুরি হয়েছে।
উনি ডোবার পাশে এক্কাওলাদের সঙ্গে শনিচরের গুজগুজ দেখতে পেলেন। অমনি পথ বদলে পুকুরপাড়ে চলে এলেন। এক্কাওলারা দেখে নিল শনিচর দূরে চলে গেছে কিনা। তারপর ওনাকে সেলাম ঠুকে বলল, “ভাইয়া, তুমি এবারেও প্রধানগিরির জন্যে ভোটে দাঁড়াচ্ছ তো”?
রামাধীনের বড়দা প্রথমে ক্ষেত থেকে চানাচুরির গল্পটা শোনালেন। তারপর বললেন—দেখছ তো, আমার প্রধানগিরির সময় ফুরিয়ে আসছে, তাই চোর ব্যাটারা আবার সাহস করে পুরনো বদমায়েসি শুরু করেছে। যত্তক্ষণ আমার শাসন ছিল, এরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিন গুনছিল।
ওনার যুক্তি হোল, এই গঞ্জহা ব্যাটারা (শিবপালগঞ্জের লোকজন) যদি নিজের ভাল বোঝে, সুখ-শান্তি চায় তাহলে শালারা নিজের থেকেই আমাকে ফের প্রধান বানাবে। আমায় কিছু করতে হবে না। শেষে উনি বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে বললেন—আচ্ছা, শনিচর ব্যাটা কী বলছিল?
--ভোট চাইছিল।
--তোমরা কী বলেছ?
--বলেছি নিয়ে নিও, ভোট নিয়ে আচার পাতব নাকি?
-- ওকে ভোট দেবে? নিজের ভালমন্দ, উঁচুনীচু সব দেখেটেখে তবে দিও।
--সব দেখে নিয়েছি। তুমি ভোট চাইছ, আচ্ছা, তোমাকেই দেব’খন।
প্রথমজন ফের বলল—আমরা ভোট নিয়ে কি আচার পাতব?
রামাধীনের ভাইয়া বলল—তাহলে শনিচরকে ভোট দিচ্ছ না?
--তুমি বললে ওকেও দিতে পারি। যাকে বলবে তাকেই দিয়ে দেব। আমরা তোমার হুকুমের চাকর। ওই শালার ভোট নিয়ে কিসের আচার—
বড়দা ওর কথার মাঝখানে বলে উঠলেন—শোন, কোন শনিচর ফনিচরকে ভোট দেবে না, ব্যস।
--ঠিক আছে, দেব না।
--আমাকে দেবে।
--দিয়ে দেব। বললাম তো, নিয়ে যাও।
রামাধীনের বড়দা ফের ছোলাচোরের বাপান্ত করতে করতে ঘরের রাস্তা ধরলেন। চলার গতির সঙ্গে ওনার গালির রূপ ও আকার বদলে যেতে লাগল। কারণ, মহল্লা এসে গেছে। ওনার ইচ্ছে লোকজনকে বুঝিয়ে দেয়া যে উনিও একধরণের গুণ্ডা এবং আজ ওঁর মেজাজ খারাপ।
চামারটোলা ও উঁচুজাতের মহল্লার মাঝখানে তৈরি হয়েছে গান্ধী চবুতরা (মণ্ডপ)। অন্যদিন সেটার উপর কুকুর শুয়ে থাকে এবং চেঁচায়। কিন্তু আজ ওখানে মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনের অল্প ক’দিন আগে রামাধীনের ভাইয়া ওটার মেরামত করিয়েছেন। কারণ, নির্বাচনের আইনে বোধহয় এমনটা করার নির্দেশ রয়েছে! অথবা নির্দেশ থাক বা না থাক, সব বড় বড় নেতা, না জানি কেন, নির্বাচনের দুয়েক মাস আগে নিজের নিজের নির্বাচনী এলাকায় মেরামত বা সংস্কার করাতে লেগে যান।
কেউ নতুন পুল বানিয়ে দেন, কেউ রাস্তা; অন্যেরা গরীবদের মধ্যে কম্বল এবং চাল-গম বিতরণ করেন। সেই হিসেবে রামাধীনের বড়দা ওই চবুতরার চেহারা বদলানোর চেষ্টা করেছিলেন।
ওখানে একটা লম্বা-চওড়া নিম গাছ দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বুদ্ধিজীবীর মত গাছটাও অনেক শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে বটে, কিন্তু ভেতরটা ফোঁপরা। ভাইয়া ওর নীচে একটা কুয়ো বানিয়েছিলেন। আসলে ওখানে কুয়ো আগে থেকেই ছিল। উনি সেটা মেরামত করিয়ে সরকারি কাগজপত্তরে ‘নবীন কূপ নির্মাণ’ এন্ট্রি করিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য মোটা সরকারি ভর্তুকি হাতিয়ে ফেলা। কাগজাটা হয়ত ঠিক নৈতিক হল না, তবে একরকম রাজনৈতিক তো হল। আগে এই কুয়ো বর্ষার দিনে উঁচু জমি থেকে বয়ে আসা জল নিজের পেটে পুরে গ্রামকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করত। এখন ওর চারপাশে উঁচু বাঁধানো পাড়। বোঝাই যাচ্ছে এর সম্বন্ধ রয়েছে কোন পঞ্চবার্ষিক যোজনার সঙ্গে। এই কথাটা বড় গলায় বলার জন্যে ওই পাড়ের দু’পাশে দুটো উঁচু থাম তোলা হয়েছে। একটার গায়ে রয়েছে এক ‘শিলালেখ’ঃ
‘তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক যোজনা। গাঁও-সভা শিবপালগঞ্জ। পশু-চিকিৎসক শ্রী ঝাউলাল এই কুয়োর ‘শিলান্যাস’ করেছেন। সভাপতি শ্রী জগদম্বা প্রসাদ’।
কুয়োর পাড় পাকা করে দেয়ায় বাইরের জল আর কুয়োতে আসে না। কিন্তু ভেতরের জল বাইরে আসে। মানে, ওর ভেতর থেকে শীতল-মন্দ-সুগন্ধ বা পচা জলের গন্ধ নাকে টের পাওয়া যায়। যেন ও গ্রামের লোকজনকে ডাক দিচ্ছে—পেটের কৃমির অভিজ্ঞতা তোমাদের হয়েছে বটে, এবার ওটা ছেড়ে ম্যালেরিয়া আর ফাইলেরিয়াকেও নিয়ে যাও।
কুয়োর মেরামতের সঙ্গে গান্ধী-চবুতরারও কপাল ফিরে গেল। ক’টা নতুন ইঁট জুড়ল আর তার গায়ে এমন সিমেন্ট যে ঠিকেদারের হাতে লাগানোর পনের দিন পরেও খসে পড়ে নি। এই আবহাওয়ায় চবুতরা বেশ আকর্ষণীয় হয়েছে। কলেজের যত ফালতু ছেলে কখনও সখনও এখানে বসে জুয়ো খেলতে লাগল। সন্ধ্যের সময় বদ্রী পালোয়ানের কুস্তির আখড়া থেকে কয়েকজন চ্যালা আসতে শুরু করল। ওদের হাবভাব দেখলে মনে হয় এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য বসে বসে গায়ে এঁটে থাকা মাটিকে চুলকে চুলকে তুলে ফেলা।
আজকে গ্রামসভার ভোট। কলেজের ছুটি। নির্বাচন তো অন্য জায়গায় হওয়ার কথা ছিল, নিঃসন্দেহে চামারটোলা থেকে দূরে। কিন্তু আজ গান্ধী-চবুতরায় ভারি ভীড়। আর সবরকম লোক একসাথে মিলেমিশে বসে আছে—যেমনটি গান্ধীজি চাইতেন। জুয়ো-খেলুড়েরা তাস পকেটে পুরেছে। আখড়ার চ্যালারা আজ কুস্তি করেনি, গায়ে মাটি মাখে নি, শুধু তেল মালিশ করে এসেছে। ফলে তার উগ্র গন্ধ দিগবিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
রূপ্পনবাবু আজ যেন ক্লান্ত চরণে আসছেন। মুখের ভাবে রোজকার স্ফুর্তি আর চালাকির ঝলক দেখা যাচ্ছে না। ওনাকে গাব্ধী চবুতরার দিকে আসতে দেখে এক উঠতি পালোয়ান চোখ মেরে বলল, “কহো বাবু, ক্যা হাল”?
জবাবে রূপ্পন বাবু অন্যদিনের মত চোখ মারলেন না বা এটাও বললেন না যে তুমিই বল রাজা! তোমার কী হাল? উনি এমনভাবে মাথা নাড়লেন যার মানে—ঠাট্টা করছ! আমার ভাল লাগছে না। মুড খারাপ।
উনি চোখে কালো চশমা লাগিয়ে গলায় রেশমি রুমাল বেঁধে ধীরে ধীরে এসে চবুতরায় ধপ করে বসে পড়লেন। খানিকক্ষণ উপস্থিত ভদ্রজনের মধ্যে শান্তি বিরাজ করতে লাগল।
ছোকরা পালোয়ানটি অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙে কনুই ভাঁজ করল। ওর কনুইয়ের উপরে নেংটি ইঁদুরের মত একটা ছোট্ট মাংসপেশি জেগে উঠল। ও বড় আদর করে ওটাকে বার বার হাত বুলিয়ে ফের রূপ্পন বাবুর কাছে গিয়ে বসল। ও আবার চোখ মারল, তারপর রূপ্পন বাবুর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ কী ব্যাপার বাবু! আজকের রঙ যেন একটু বদরঙ লাগছে”!
শিবপালগঞ্জের বিখ্যাত প্রবাদ—“প্রেমিকের তিন নাম,
রাজা, বাবু, পালোয়ান”।
সে হিসেব ধরলে রাজার বদলে বাবু সম্বোধনে রূপ্পন বাবুর সম্মান কিছু কম হল মনে হতে পারে। তবে শিবপালগঞ্জ এটাও জানে যে এই ছোকরা পালোয়ানকে রূপ্পন বাবু অনেক ছাড় দিয়ে রেখেছেন। যেন গান্ধীজি সর্দার প্যাটেলকে কড়া কথা বলার ছাড় দিয়েছিলেন। সুতরাং দু’জনের নিজেদের মধ্যে এইসব কথাবার্তাকে আমরা ‘মহাপুরুষদের মহারঙ্গ’ বলে ধরে নেব।
কিন্তু রূপ্পন তো তাঁর চ্যালার গায়েপড়া ভাব ও ঠাট্টা খেয়াল করছেন না। একেবারে চুপটি করে মুখটি বুজে রয়েছেন। কলেজের একটি ছাত্র বলল,--গুরু, আমাদের কী করতে হবে? তুমি এখনও কিছু বলনি। এবার রামাধীনের দলে যেমন উত্তেজনা গরমাগর্মি ভাব, শনিচরের দলে তেমন কিছুই নেই’।
রূপ্পন বাবু পাতাল থেকে আসা আওয়াজে বললেন—‘এখন ঠান্ডাগরম নিয়ে কথা বলা বেকার। ভোটের ফলাফল একটু আগে বেরিয়ে গেছে। শনিচর জিতে গেছে’।
ছোকরা পালোয়ানের দল আর কলেজের ছাত্রদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল। চারদিকে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগল, “ আরে কী করে? কী ভাবে? শনিচর ব্যাটা জিতল কোন কায়দায়”?
রূপ্পন বাবুর চ্যালা ছোকরা পালোয়ান চোখ মেরে বলল, ‘ বলো পালোয়ান, শনিচর ব্যাটা জিতল কোন দাঁও লাগিয়ে”?
“মহীপালপুরওলা দাঁও”। রূপ্পন বাবুর গলার স্বরে অসীম ক্লান্তি।
************************************************************************
ভোটে জেতার তিনরকম দাঁও-প্যাঁচ আছেঃ রামনগরওয়ালা, নেবাদাওলা আর তিন নম্বর হোল মহীপালপুরওলা।
একবার গ্রানসভার নির্বাচনে রামনগর গ্রাম থেকে দু’জন ভোটে দাঁড়িয়েছিল—রিপুদমন সিং ও শত্রুঘ্ন সিং। দুজন একই জাতের, ফলে জাতের ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। ঠাকুর সমাজের লোকজনের ভারি মুশকিল। ইনিও ঠাকুর, তিনিও ঠাকুর—ভোট দেব কাকে! আবার যারা ঠাকুর সমাজের নয় তারা ভাবল—এরা নিজের জাতের মধ্যেও রেষারেষি করছে, এমন প্রার্থীকে ভোট দিলেই কি, আর না দিলেই কি!
কিছুদিন পরে জানা গেল যে রিপুদমন আর শত্রুঘ্ন --দুটোর মানে একই; অর্থাৎ এমন এক সিংহ যে শত্রুকে গিলে খায়। এটা জানার পর গ্রামের লোকজন গণতন্ত্রের অনুকুল সিদ্ধান্তে পৌঁছল—ওরা একজন আর একজনকে গিলে খাক, অথবা গ্রামসভার প্রধান হোক—আমাদের কী আসে যায়!
নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে পর্য্যন্ত ভোটের হাওয়া একদম গায়েব। প্রার্থীরা গাঁয়ে গিয়ে ভোট চাইলে লোকজন বলে দেয়—আমরা ভোট নিয়ে কি আচার দেব? যাকে দিতে বলবে তাকেই ভোট দেব।
ফলে দু’জনেই ভাবল—কেউ ওদের ভোট দেবে না। ওরা ঘাবড়ে গিয়ে গণতন্ত্রের দোহাই দিল, মানুষজনকে ভোটের মূল্য বোঝাতে লাগল। যেমন—তুমি যদি তোমার দামি ভোট ভুল লোককে দাও তাহলে প্রজাতন্ত্রের সমূহ বিপদ! বেশির ভাগ লোকে এসব বড় বড় কথা বুঝল না। যারা বুঝল, তারা বলল—ভুল লোককে ভোট দিলে গণতন্ত্রের কোন বিপদ হয় না। তুমি তোমার ভোট দিতে পারছ, সেটাই গণতন্ত্রের জন্যে যথেষ্ট। ভুল ঠিক তো চলতেই থাকে। দেখ না, আজকাল যা হচ্ছে----।
এধরণের কথা বলার লোক হাতে গোণা যায়। তবে গণতন্ত্রকে ফালতু প্রমাণিত করতে এরাই যথেষ্ট। তখন দুই ক্যান্ডিডেট প্রচারের কায়দা বদলে নিল। বলতে লাগল গ্রামসভার প্রধানের ক্ষমতার কথা। যেমন, প্রধান চাইলে গ্রামের সব পড়তি জমি অন্যদের বিলি করতে পারে এবং যারা বে-আইনি ভাবে পড়তি জমি দখল করে রেখেছে তাদের বেদখল করতে পারে।
যাঁরা প্রেমচন্দের ‘গোদান’ পড়েছেন বা ‘দো বিঘা জমিন’ ফিলিম দেখেছেন তাঁরা জানেন যে কৃষকের সবচেয়ে প্রিয় হল জমি। শুধু তাই নয়, ওদের নিজের জমির চাইতে অন্যের জমি বেশি প্রিয় এবং সুযোগ পেলেই ওদের পড়শির ক্ষেতের দিকে নোলা সকসক করে। এর পেছনে কোন সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ গড়ার স্বপ্ন নয়, বরং সহজিয়া প্রেমের ভাবনা কাজ করে। সেই প্রেমের তাগিদে ও নিজের ক্ষেতের আলে বস পড়শির ক্ষেতে পশু চরতে দেয়। আখ খাবার জন্যে নিজের ক্ষেত ছেড়ে পাশের ক্ষেত থেকে আখ উপড়ে নেয়, আর সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলে—দেখছ তো, আমার ক্ষেত থেকে কেমন চুরি হচ্ছে!
কথাটা ভুল নয়। কারণ, ওর পড়শিও একইভাবে তার পাশের লাগোয়া ক্ষেত থেকে আখ চুরি করে উপড়ে নেয়। অন্যের সম্পত্তিকে নিজের মনে করার পেছনে কাজ করে সহজিয়া প্রেমের তাড়না।
এই কথাগুলো গোদান উপন্যাসে স্পষ্ট করে বলা হয় নি। আর বোম্বাইয়া সিনেমাতেও—সম্ভবতঃ কৃষণ চন্দর এবং খাজা আহমদ আব্বাসের ভয়ে—অথবা প্রগ্রেসিভ হওয়ার ঝোঁকে অন্ধ হয়ে, কিংবা স্রেফ বদমাইশি করে—খোলাখুলি দেখানো হয় নি। এই জন্যে আমি খানিকটা পরিষ্কার করে বললাম। মানছি, দেশ থেকে জঞ্জাল দূর করার কাজ শিল্পী=সাহিত্যিকের নয়, তবুও---।
হল কি, যেই গাঁয়ের লোকজন বুঝে ফেলল পঞ্চায়েতের সম্বন্ধ জমির লেনদেনের সঙ্গে এবং পড়শির ক্ষেত হাতিয়ে নেয়া সম্ভব, অথবা অমুক কৃষক নিঃসন্তান মারা গেলে নিজেকে ওর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে রাজতিলক পরা যেতে পারে—ব্যস, চাষিদের সহজিয়া প্রেমভাবনা উথলে উঠল। তখন জমির প্রেম ভোটারদের গ্রাম পঞ্চায়েতের দিকে ঠেলা মারল, পঞ্চায়েতের প্রতি প্রেমে ওরা মোড়ল পদের প্রার্থীদের দিকে ধাক্কা দিল। ফলে ওদের মস্তিষ্ক একদম সক্রিয় হয়ে উঠল।
এরপর ওদের সামনে এল সেই সমস্যা যা চিনা হামলার সময় আচার্য কৃপলানী গোটা দেশের সামনে হাজির করেছিলেন। ওরা ভাবতে লাগল নিরপেক্ষ থাকা একদম ফালতু, এতে দুর্বলতা বাড়ে এবং লোকসান হয়। যদি তুমি শান্তিতে থাকতে চাও তাহলে রিপুদমন অথবা শত্রুঘ্নের মধ্যে কাউকে বেছে তার সঙ্গে ঝুলে পড়। আর বেশি নিরপেক্ষ ভাব দেখালে দু’দিক থেকেই মরবে।










