ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক১৩
অনেকদিন গের্ট, ইনেস আর দুষ্টু পোষ্য ফ্লকের খোঁজখবর পাইনি আমরা। শেষোক্ত প্রাণীটির জীবনযাপনে সেরকম কোনও পরিবর্তন হয়নি। ইনেসের ঘরের সামনের করিডরে সে ঘুমোয়। তার বাস্কেটে একটা লালরঙের কম্বল আছে। বাস্কেটের পাশে একটা এনামেল করা পাত্র রোজ সন্ধ্যায় জল ঢেলে ভর্তি করা হয়। ফ্লক নিশ্চিন্তে এবং শান্তিতে ঘুমোয়; সকালে উঠে সে নিজের থাবা দিয়ে ঘরের দরজাটা আঁচড়াতে শুরু করে, যতক্ষণ না সেটা খুলে দেওয়া হয়। তারপর তার ঝোড়ো আদুরে ভাবভঙ্গির উত্তরে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ছোট করে ইনেস তাকে সুপ্রভাত জানায়। ফ্লক তাতে অবাক হয় না, দুঃখ পায় না। কারণ সে জানে যে ইনেস অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গেও একই ধরনের ব্যবহার করে থাকে। ব্যাপক আবেগী ভাবভঙ্গির সামনে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায় সবসময়।
ইনেস লাল রঙের চপ্পল পরেছে। রঙটা ফ্লকের কম্বলের সঙ্গে ম্যাচিং। লম্বা একটা ড্রেসিং গাউন পরেছে সে; তার পোশাক থেকে অবর্ণনীয় সুন্দর একটা সুবাস আসছে। যখন ইনেস ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তার নখের পরিচর্যা করে, তখন ফ্লক তার পোশাকের প্রান্তের নরম পশমে নাক ডুবিয়ে বসে থাকতে ভালবাসে। ইনেস সেটা লক্ষ্য করে তাকে একটু দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে; তবে দূরে যেতে বলার আগে অবশ্যই সে এক মুহূর্তের জন্য তার উষ্ণ এবং ঋজু হাতে তাকে আদর করতে থাকে এক দুই মুহূর্তের জন্য। ‘এবার এসো, ভালো কুকুরছানা!”… ইনেসের কথাগুলির মধ্যে যে এক মহান কোমলতা লুকিয়ে আছে সেটা ফ্লক অনুভব করে এবং এই অনুভূতিকে সে গের্টের আবেগের বিস্ফোরণ এবং ছোট্ট বের্নহার্ডের নিয়ত এবং বেশ অসহনীয় টোকা মেরে যাওয়া আদরের থেকেও অনেক বেশি পছন্দ করে। ফ্লক খুব ভাল এক পর্যবেক্ষক, যদিও সে এটা বোঝে না যে বের্নহার্ড যখন তাকে টোকা মেরে আদর করে, সেটা শুধুই তাকে আদর করবার ইচ্ছে হয় বলে করে না। যখন ইনেস এবং গের্ট বের্নহার্ডের উপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে যায়, তখন নিজের অস্বস্তি গোপন রাখবার জন্য বের্নহার্ড তাকে আদর করে। কিম্বা যখন বিশেষ কোনও আলোচনায় বের্নহার্ড অংশগ্রহণ করতে চায় না, কোনওভাবে এড়িয়ে যেতে চায়, তখন সে ফ্লককে আদর করে। ঘটনাচক্রে, বের্নহার্ড প্যারিসে চলে যাবার পর থেকে শনিবারের বিকেলে গাড়ি চড়ে হাওয়া খেতে যাওয়া অনেকটা কমে গেছে। যেহেতু ফ্লক ওদের সবাইকে খুব ভালবাসে, সেহেতু একথা বলাই যায় যে ফ্লক বের্নহার্ডের উপস্থিতির অভাব অনুভব করে।
তবে ফ্লক রোজ খায়দায়, ঘুমায়, হাঁটতে যায়। তার দিনলিপির নিয়মের খুব সাঙ্ঘাতিক কোনও হেরফের ঘটে না। মোটের উপর এককথায় বলা চলে যে ফ্লক ভাল আছে।
কিন্তু ইনেস নানারকমের চিন্তা ভাবনায় জর্জরিত। যদিও সে খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা আছে, তবুও সম্প্রতি সে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কখনো কখনো। প্রতি ক্ষেত্রে সে ভেবে চলেছে যে ঠিক কী ভাবে করলে কাজটা ঠিকভাবে করা সম্ভব। যেমন, সে ভাবছে যে নিজের কেরিয়ারের উপরে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমি হয়তো আগে পরিষ্কার করে বলিনি যে ইনেস কোনও চাকরি করে না, যদিও সে খুবই আধুনিকমনা নারী। ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। সাধারণ মানুষজনের চেয়ে তার বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানগম্যি আছে এবং পরিশীলিত আদবকায়দাসম্পন্না; তার উপরে দেখতে সুন্দরী এবং যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। তার এত গুণের সেরকম কোনও সদ্ব্যবহার সে করছে না। সে কালেভদ্রে বাড়ির বাইরে বেরোয়। অতিরিক্ত সামাজিকতা পালন করা কিম্বা সমাজে বিশেষ ভাবে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল দেখাবার কোনও তাগিদ নেই তার। তার বাবার এই ব্যাপারে বেশ আক্ষেপ আছে। কারণ সে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতিভার যথাযথ প্রয়োগ করছে না। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই ইনেস নিজের মত থাকতে ভালবাসে এবং তাঁর বাবা নিজস্ব মতামত মেয়ের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নন। অবশ্য তার অর্থ এমন নয় যে ইনেস তাঁর বাবার মতামতকে কোনও গুরুত্ব দেয় না। ইনেসের বাবা খুব বুদ্ধিমান, নিজস্ব ব্যবসা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন, শিক্ষিত, দূরদর্শী এবং মুক্তমনা ব্যক্তি। ইনেস বাবাকে খুবই ভালবাসে কিন্তু নিজের জীবনের কিম্বা তাঁর বন্ধুবান্ধব বেছে নেওয়া কিম্বা নিজস্ব সময় কাটানোর কোনও সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই বাবার মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয় না। কারণ সে মনে করে যে তাঁর জীবনের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা প্রয়োজন। স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাইরের প্রভাব যদি ভুল হয়, সেক্ষেত্রে জীবনে ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। “পরিস্থিতি বুঝে চলা আর সেটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া”… সে বলে, “এটাই তো জীবনে বেঁচে থাকার আসল কৌশল। তবে সেটা কখন কী ভাবে করব, সেটা অবশ্যই আমার পছন্দ! তবে দিনের শেষে আমি জানি যে বাবা আছেন এবং আমি সবসময় তাঁর উপরে ভরসা করতে পারি।”
উদাহরণস্বরূপ, তাঁর বাবা যদি জানতে পারেন যে গের্টের বাড়ির বন্ধুদের আড্ডায় সে ছাড়া আর কোনও মেয়ে যায়নি, তাহলে কেমন আচরণ করবেন? তাছাড়া সে যে সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝে গের্টের সঙ্গে বেড়াতে চলে যায়, সেটার জন্যেও যদি সে অনুমতি চায়, বাবা কখনই রাজি হবেন না। যদিও আমরা জানি যে তিনি যথেষ্ট মুক্তমনা, উদারচিত্ত, তবুও তিনি আপত্তি করতেই পারেন এই কথা বলে যে ইনেস যদি এদের সঙ্গে এইভাবে মেলামেশা করে, তাহলে তাঁর সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে।
কিন্তু ইনেস তাঁর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের বন্ধুদের আড্ডা এড়িয়ে থাকতে পারে না। যেমন ফার্দিনান্দ, ইনেসকে যার খুব দরকার; তাছাড়া বের্নহার্ড, সে তো ইনেসের বাড়িতেও এসেছে। গের্টের সঙ্গে সপ্তাহান্তের শেষে লং ড্রাইভ সে শুধুই সামাজিক সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে বন্ধ করে দিতে পারে না। গ্রীষ্মের সময়ে গ্রামের দিকের পরিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেওয়া সপ্তাহে অন্তত একদিন তাঁর, ফ্লকের এবং গের্টের জন্য খুব প্রয়োজন।
ইনেস তাঁর বাবার আপত্তির কারণগুলো বুঝতে পারে। কিছুটা সে বিবেচনা করেই চলে। কিন্তু সব কথা মেনে চলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বাবার মূল্যবোধ আলাদা। তিনি মনে করেন যে গরমের ছুটি কাটানোর মজার থেকেও সামাজিক সম্মান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ভবিষ্যতের কথা তলিয়ে ভাবেন, অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী। অন্যদিকে ইনেস সামাজিক মানসম্মান নিয়ে ততখানি ভাবিত নয়। ভবিষ্যতের ব্যাপার নিয়ে ভাবতেও তাঁর বয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ তাঁর মতে খুব অনিশ্চিত এবং অনেক দূরের ব্যাপার। আপাতত সে আগামী শনিবার ফ্লক আর গের্টের সঙ্গে জঙ্গলের দিকে লং ড্রাইভে যাবে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পুরো পাহাড়টা পেরিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে তাদের। পাহাড়ের উপরে একটা লেক আছে। সেখানে বসে তারা মাছভাজা খাবে আর বের্শেনের কথা ভাববে, যে প্যারিসে গেছে পিয়ানো শিখবে বলে। ফ্লকের গলার কলারটা খুলে দিয়ে তাকে ইচ্ছেমত দৌড়াতে দেবে ইনেস। যদিও ব্যাপারটায় ঝুঁকি আছে, কারণ ফ্লক খামকা ঘেউঘেউ করে সরাইওয়ালার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তারপর আবার তাকে শান্ত করতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়ে যাওয়া চঞ্চল খরগোশগুলোকে ধরবার মত ক্ষমতা ফ্লকের নেই। অবশেষে অন্ধকার হয়ে আসবে। গের্টের মেজাজ খারাপ হবে। সে ফ্লককে বলবে অপদার্থ জন্তু, কারণ ফ্লক সব্বার মিলিত শিসের শব্দ অবধি শুনছে না, নিজের ইচ্ছেমত দৌড়ে কোথায় লুকিয়ে বসে আছে।
কিন্তু ফিরবার সময় কে জানে কোত্থেকে ফ্লক হঠাৎ এসে হাজির হবে ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে। আনন্দে, খুশিতে লাফাতে লাফাতে গড়াতে গড়াতে এসে সব্বার আগে আগে নিজের নাকটা উপর দিকে তুলে চলতে থাকবে সে। সরাইখানাটাকে অবশ্য ঠিক হোটেল বলা চলে না। ঘরোয়া ব্যবস্থাপনা। বিশাল বিশাল খাটগুলোতে অনেক বালিশ আর ডোরাকাটা উলের কম্বল। গের্ট ওয়াইন অর্ডার করবে আর প্রমাণ করবার চেষ্টা করবে যে সে একটুও ক্লান্ত হয়নি। ইনেস জোর করে ঘুমাতে চলে যাবে। ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়েও পড়বে। বের্শেন যে ভাবে রবিবারে জেগে উঠতে চায়, ঠিক সেইভাবেই সবার ঘুম ভাঙবে। ঝরনার জলের কুলকুল শব্দে, সূর্যের সোনালি আশাবাদী রশ্মি যা পাথরের সব ফাটলের মধ্যে ঢুকে চারদিক আলো করে দেয় এমন সকালে জেগে উঠবে তারা।
গের্ট সবসময় ইনেসের চেয়ে আগে উঠে যায় ঘুম থেকে। তারপর সে ইনেসের ঘরের সামনে বাইরে থেকে ইনেসকে ডাকবে। তারপর সরাইখানায় যে মেয়েটা প্রাতরাশ পরিবেশন করে, তাঁকে বলবে ইনেসের ঘরে সবার খাবার দিয়ে যেতে। গের্ট অনেক রুটি খেয়ে ফেলবে। তারপর সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে মেয়েটাকে বলবে আরও দুধ দিয়ে যেতে। তারপর প্লেটে ঢেলে চুপিচুপি বেশ কিছুটা দুধ ফ্লককে খাইয়ে দেবে।
কিন্তু সন্ধের মধ্যে ইনেস খুব ক্লান্ত হয়ে যাবে। রবিবারের সন্ধেটা খুব তাড়াতাড়ি আসে। এটা বের্শেন বলে। ফুলে ফুলে ঢাকা উপত্যকার মধ্য দিয়ে গাড়িতে ফিরবে তারা। যাবার পথে দিগন্তরেখার আকাশ প্রথমে উজ্জ্বল ছিল, তারপর ধীরে ধীরে বিষণ্ণ ফ্যাকাসে নীল হয়ে আলো নিবে আসবে।
বাতাসে উত্তাল পথ দিয়ে দিগন্তরেখার দিকে গাড়ি চালিয়ে যাবে গের্ট। পথে রাত হয়ে যাবে কখনো কখনো। একটা উজ্জ্বল চাকতির মত দেখতে চাঁদ ওদের পথের সঙ্গী হবে। ফ্লক ইনেসের হাতের মধ্যে নাক গুঁজে ঘুমিয়ে পড়বে।
আবার পরের শনিবার ইনেস ফ্লক আর গের্টকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাবে। তাতে তাঁর সামাজিক সম্মান থাকল না গেল, সেটা নিয়ে সে ভাবে না। তবে যাবার আগে সে কখনই তাঁর বাবার কাছে অনুমতি চায় না কিম্বা এই ভ্রমণ নিয়ে বাবার সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না। কারণ সে জানে যে বাবা ব্যাপারটা সেভাবে অনুমোদন করেন না, তিনি সামাজিক সম্মান নিয়ে ভাবিত। ফলে অনাবশ্যক এই বিষয়ে আলোচনা করে বিতর্ক বাড়িয়ে সে তাঁর বাবাকে দুঃখ দিতে চায় না। তাছাড়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে যে কোনও ঘটনা ঘটে যাবার পরে সেটার মধ্যে আর ততখানি ধার থাকে না, অথচ কোনও ঘটনা ঘটবার আগে সেটা নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা এবং নানা আশঙ্কা মানুষের জীবনে অশান্তি ডেকে আনে।
কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি যে শনিবারের এই ভ্রমণ আগের মত ঘনঘন হচ্ছে না বের্শেন প্যারিসে চলে যাবার পরে এবং সেটার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে ফ্লক। অবশ্যই না বেরোবার বেশ কিছু কারণ আছে। সেটার মধ্যে অন্যতম হল যে ইনেস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকে আজকাল।
(চলবে)