ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত
Posted in ধারাবাহিক১. বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা
জ্যোৎস্না-ধোয়া সাদা বাড়ির ভেতর থেকে কেউ চাপা গলায় হেসে উঠল যেন! খটকা লাগল। থামলাম। নাহ্, মনের ভুল- আমি ফের পা চালাাই। সেই বিশেষ অসমান জায়গাটার কাছে এসেই হুমড়ি খেলাম। জায়গাটার সিমেন্ট, বুনো ফুল এবং অযত্নে বাড়া ঘাসের ঝাড় হাপিস হয়ে গেছে। আামি বাসু মনে পড়ছে আমার কথা? দশ বছর ধরে আমি এই একই রাস্তায় সকাল-সন্ধ্যা মাইলের পর মাইল হাঁটছি কিন্তু অদ্যাবধি এক মুহূর্তের জন্যেও আরেকটি প্রাণের দেখা মেলে নি। সুস্মির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আমি এবং সুস্মি প্রেমিক- প্রেমিকা। ও আমাকে ওর ছেলেবেলার অনেক গল্প শোনাত। ওর বাবা প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যেতো। ওর মা ওর সব জামাকাপড় বানিয়ে দিতো। ওর দিদার গা থেকে সবসময় ডিল ব্রেড ও ভ্যানিলার গন্ধ মৌ মৌ করে ভেসে আসতো। আমি হা করে এসব গল্প গিলতাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হোত যদিও সেটা করতে পারতাম না। আর সেইসব রূপকথা যেগুলোকে ও ভাবতো যে সবার জীবনেই আছে সেগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সুস্মি অনেক বছর দেশের বাইরে আমাদের ঠিক কেন কবে কোন কারণে কথা বন্ধ হয়েছিল আমার মনে নেই। মৃত একটা সম্পর্ক নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি, কিন্তু এতবছর পরে সু্স্মির হাতে লেখা চিঠি যখন হেমন্তের এক বিকালে ধূলোমাখা ডাকবাক্সে আলো ছড়াচ্ছিল তখন ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল শীতার্ত মনে।
খাম খুলে বেশ অবাক হলাম। চারটি সাদার পৃষ্ঠার পরে পঞ্চম পাতার শেষে লেখা-
‘সুন্দর জ্যোৎস্না ভেঙেচে নদীজলে- কি অপূর্ব্ব শোভা! ভগবানকে ডেকে বললুম- তোমার নিত্য সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই- ঐ সন্ধ্যাতারার মত রহস্যের মধ্যে, জ্যোৎস্নালোকিত আকাশের উদার ব্যাপ্তির মধ্যে, বনপুষ্পের সুবাস ও বিহঙ্গকাকলীর মধ্যে আমায় তোমার খেলার সঙ্গী করে রেখো যুগে যুগে। তুমি আপন মনে বিশ্বের বনতলে নবীন কিশোর সেজে বনফুলের মালা গলায় উদাসী হয়ে বেড়াও- কে তোমায় পোঁছে? কেউ না। সবাই ধন, জন, মান, যশ নিয়ে ব্যস্ত। কে দেখেচে এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশার অপূর্ব্ব মনমাতানো শোভা! আমায় দেখবার চোখ দিও জন্মে জন্মে।’
– ইতি, সুস্মি
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্মির প্রিয় কথাসাহিত্যিক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৭ মে ১৯৪৩ সালে লেখা ডায়েরি থেকে সুস্মি এটা লিখেছে, এটা লিখতে গিয়ে চারটি পাতা খালি রাখার রহস্য বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে খামে জ্বলজ্বল করা সুস্মির ঠিকানায় একটা চিঠি লেখার লোভ সহসা পেয়ে বসলো। মোহাচ্ছন্ন আমি খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম।
সুপরিচিতাষু সুস্মি,
এক যুগ পরে তোমাকে লিখছি। কেমন আছো? হেমন্তের পড়ন্ত বিকালে তোমার চিঠি পেলাম। চার পাতায় যা যা লিখবে ভেবেছিলে আমি যেন তা পড়তে পারছি সাদা পাতায়। আমার মনে হলো তোমার চিঠির উত্তর তোমার প্রিয় লেখকের কথাতেই দেই। ২৮ অগাস্ট, ১৯২৫-এ, ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন: ‘…Sadness জীবনের একটা অমূল্য উপকরণ- Sadness ভিন্ন জীবনে profundity আসে না- যেমন গাঢ় অন্ধকার রাত্রে আকাশের তারা সংখ্যায় ও উজ্জ্বলতায় অনেক বেশী হয়, তেমনই বিষাদবিদ্ধ প্রাণের গহন গভীর গোপন আকাশে সত্যের নক্ষত্রগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত ও জ্যোতিষ্মান হয়ে প্রকাশ পায়। তরল জীবনানন্দের পূর্ণ জ্যোৎস্নায় হয়ত তারা চিরকালই অপ্রকাশ থেকে যেত।’
প্রকৃতিপ্রেমিক, রোম্যান্টিক এমন নানা অভিধায় বিভূতিভূষণকে ধরা যায়, এ কথা ঠিক। কিন্তু বিভূতিভূষণের সৃষ্টি মৃত্যুর কথাও বলে, যে মৃত্যু শাল-পিয়ালের বনে সন্ধ্যা নামার মতো নিবিড়। তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে মন চাইছে, খুব খুব জানতে ইচ্ছে করছে তরুণী সু্স্মির মনে দোলা দেয়া বিভূতিভূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতিপ্রেম ছাপিয়ে কি বিগতা যৌবনার মনে কোথাও বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা ছায়া ফেলেছে? যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় তবে বলতেই হবে বয়স হয়েছে তোমার! তোমার মনে আছে কিনা জানিনা। কলেজের দিনগুলোয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় মৃত্যুচেতনা নিয়ে কথা বলায় তুমি খুব রেগে বলেছিলে জীবনানন্দ দাশ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি গুলিয়ে ফেলেছি। সেইদিন বলতে না পারলেও আজ এতগুলো বছরের শেষে তোমাকে লিখতেই পারি আমার ভাবনা। রাগ করবে না আশা করি।
বিভূতি-সাহিত্যে মৃত্যুর ধারণাটির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদের একটি কাহিনির কথা মনে পড়ে। ঘটনাচক্রে, সৌরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে বিভূতিভূষণ বলছেন, ‘আমি সারা জীবন ধরে জন্ম-মৃত্যু রহস্যের আলোচনা করেছি ও রহস্য জেনে ফেলেছি।’ ওই চিঠিতেই তিনি বিশেষ ভাবে ‘বৃহদারণ্যক’ ও ‘ঈশোপনিষদ’-এর কথা উল্লেখ করছেন। এই সূত্রেই ওই কাহিনিটির অবতারণা। সেখানে মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন, ‘ধরা যাক, গোটা পৃথিবী বিত্তে পরিপূর্ণ। তা আমার নিজস্ব সম্পত্তি হলে, আমি কি ‘অমৃতা’ হব?’ যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর, ‘বিত্তের দ্বারা ‘অমৃতত্ত্বের’ আশা করা নিরর্থক।’ বস্তুত, অমৃতের একটি অর্থ যদি অমরত্ব হয়। অন্য একটি নিগূঢ় অর্থ, আনন্দ।— জীবন-মৃত্যুর ধারণা নিয়ে বিভূতিভূষণ এই আনন্দেরই পিয়াসী। সেই তেষ্টা থেকেই তাঁর ‘আর্টের’ জন্ম।
জীবনের শেষ পর্বে বিভূতিভূষণ যখন ব্যারাকপুরে ছিলেন তখন সেখানে দেখা পেয়েছিলেন এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে। ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছেন জেনে, বিভূতিও তাঁর কাছে নিত্য যাতায়াত বাড়িয়েছিলেন। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! বিভূতিভূষণ রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে। তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস। মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে। মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা? শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে? কী ভাবে উড়ে যায়? ফিরে আসে কি? সব প্রশ্নের উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে তাঁর লেখায়। মৃত্যুর আগের জীবন সম্পর্কে আমরা সকলেই ওয়াকিবহাল কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে এটাই মানুষের চির-কৌতূহলের বিষয়। এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে দেবযান। উপন্যাসটা পড়া শেষ করে মনে হয়েছে, এ তো শুধ মৃত্যু চেতনা নয় এর ভিতরে ধরা আছে স্রষ্টার গভীর চিন্তা ও বিশ্বাসের জগৎ। আছে সুগভীর রোমান্টিক চেতনাবোধ। তোমার সতের কিংবা আঠারতম জন্মদিনে তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম দৃষ্টিপ্রদীপ ও দেবযান। বইগুলো কি তোমার সঙ্গে আছে নাকি বন্ধ বাড়ির বুকসেলফে উদাস তাকিয়ে আছে? এখনো নিয়ম করে রোজ রাতে কবিতা পড়ো? নাকি কর্মব্যস্ত কর্পোরেট জীবনে কবিতারা বই বন্ধি হয়ে পড়ে থাকে ল্যাপটপের পাাশে নিঃসঙ্গতায়? তুমি তো জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস করতে। তাই না? ভারতীয় নিয়তিবাদ দুটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে— জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ। প্রথমে উদ্ভূত হয় জন্মান্তরবাদ, এবং লক্ষণীয় যে, প্রথম উল্লেখে এটি পুনর্জন্ম নয়, পুনমৃত্যু। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ধারণাটি প্রথমে মানুষকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত হয়নি, দেবতাদের সম্পর্কেই এর আদিমতম উল্লেখ। জন্মান্তরবাদ প্রবর্তিত হল কেন? একটা সহজ কারণ হল, মানুষের জীবনপ্রীতি; মৃত্যুর ওপারে জীবনকে বিস্তারিত করে দেখার বাসনা এবং সে কারণেই যুক্তিগত ভাবে জন্মের পূর্বেও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, জন্মান্তরে বিশ্বাস করলে এক জীবনে যত অভিজ্ঞতা হওয়া সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞতালাভের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তৃতীয়ত, এ বিশ্বাস অনুসারে মানুষের এ জীবনের ভুলত্রুটি জন্মান্তরে সংশোধনের একটা অবকাশ পাওয়া যেতে পারে। চতুর্থত, এ বিশ্বাসে চূড়ান্ত অন্তিমতা বা আত্যন্তিকতার আতঙ্ক মন থেকে অন্তর্হিত হয়, যে-আতঙ্ক মানুষকে সর্বদেশে সর্বকালে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু এ-ও সত্য যে কেবলমাত্র জন্মান্তরবাদ মানুষের আধ্যাত্মিক বা ব্যবহারিক উন্নতির আশ্বাস বহন করে না। যাই হোক ধান ভাঙতে এসে শিবের গাজন গাওয়ার মতো কথা বলছি। বিভূতিভূষণের লেখায় মৃত্যুচেতনা বারবার চোখে পড়ে।
‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ এবং ‘দেবযান’ পরলোক এবং জন্মান্তরবাদ বিশ্বাসের কথা বলে। জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়তো অবিশ্বাস করার উপায়ও ছিলনা। প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’-র প্রকাশের সময় (পরে এই অংশটি বাদ যায়) তার মধ্যেও ছিল সেই অপার্থিবের ছায়া – ‘‘এ আমি কাকে দেখলুম বলব? আমাদের এই পৃথিবীর জীবনের বহু ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত রাজ্যে অনন্তের পথের যাত্রীরা আবার বাসা বাঁধবে, হয়তো সে দেশের আকাশটা রঙে রঙে রঙিন, যার বাতাসে কত সুর, কত গন্ধ, কত সৌন্দর্য, কত মহিমা, ক্ষীণ জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া কত সুন্দরী তরুণীরা যে দেশের পুষ্পসম্ভার-সমৃদ্ধ বনে উপবনে ফুলের গায়ে বসন্তের হাওয়ার মতো তাদের ক্ষীণ দেহের পরশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই অপার্থিব দিব্য সৌন্দর্যের দেশে গিয়ে আমাদের এই পৃথিবীর মা-বোনেরা যে দেহ ধারণ করে বেড়াবেন – এ যেন তাঁদের সেই সুদূর ভবিষ্যৎ রূপেরই একটা আভাস আমার বউদিদিতে দেখতে পেলুম।’’
‘দেবযান’- উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল, সারান্ডার জঙ্গলে ভ্রমণের সময়। অরণ্যের ‘সমাহিত স্তব্ধতায়’ লেখা উপন্যাসটির পরিকল্পনা বিভূতিভূষণ সম্ভবত সব থেকে বেশি দিন ধরে করেছিলেন। জন্ম-মৃত্যুর ভাবনাকে এক সূত্রে বাঁধতেই কি তাঁর এই সময় নেওয়া? আবার ‘তৃণাঙ্কুর’-এ যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো করে তিনি প্রত্যাশা করছেন, অন্ধকার ‘জ্যোতির্ময় হউক’। এ ভাবেই হয়তো মৃত্যুও একটি প্রাণচক্রের অংশীভূত হয়ে এক বিরাট পরিধিতে ধরা দেয়। এখান থেকেই অভীষ্ট ‘অমৃত’ তথা আনন্দের সঙ্গে এক সরলরৈখিক গাঁটছড়া বাঁধে মৃত্যু ও জন্ম।
স্বভাব-উদাসীন এই মানুষটি নিজের লেখার বিরূপ সমালোচনা নির্লিপ্তভাবেই নিতেন, কিন্তু অতিলোকচিন্তা নিয়ে তর্ক উঠলে নিজের অভিজ্ঞতায় ভর করে সোচ্চার হয়ে উঠতেন। সজনীকান্ত দাস তাঁর আত্মস্মৃতিতে বলেছেন – “আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আচারে ব্যবহারে কালাপাহাড় বলে অখ্যাতিও আছে।” পরলোকচর্চার জন্য বিভূতিভূষণকে তীব্র ব্যঙ্গ করতেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন – “পথভ্রষ্ট(?) বৈজ্ঞানিকদের আলোচনায়ও দেখিয়াছি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে অনেক তত্ত্ব জানিয়াছি। বিভূতিকে বাহির হইতে কখনও আমল দিই নাই, ঠাট্টা করিয়া তাহার দৃঢ় বিশ্বাসকে উড়াইয়া দিয়াছি ; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফল্গু ধারার মতো মৃত্যু পরপারের এই টুকরা রহস্যটি আমাকে বরাবরই প্রভাবিত করিয়াছে আর বিভূতিকে স্বীকার করিয়াছি।”
পথের পাঁচালীর দুর্গার মৃত্যু মাইলফলক হয়ে আছে। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে মৃত্যু সর্বদা একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে এসেছে। মহাভারতের মতো অতি বড় বীর, অনিবার্য যার প্রয়োজন সেও অবলীলায় ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্গা ও অপুর বেড়ে ওঠা, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দুর্গা ধীরে ধীরে পরিণতি পায়। আকস্মিক দুর্গা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেলে কণ্ঠ ছিঁড়ে কান্না আসে। মৃত্যুকে বিভূতিভূষণ তার উপন্যাসে এক প্রতীকী মাত্রায় তুলে ধরেছেন,—‘দুর্গা আর চাহিল না। আকাশের নীল আস্তরণ ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে অনন্তের হাতছানি আসে—পৃথিবীর বুক থেকে ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া গিয়া অনন্ত নীলিমার মধ্যে ডুবিয়া নিজেদের হারাইয়া ফেলে—পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূর পারে কোনো পথহীন পথে—দুর্গার অশান্ত, চঞ্চল প্রাণের বেলায় জীবনের সেই সর্বাপেক্ষা অজানা ডাক আসিয়া পৌঁছাইছে।’ দুর্গার মৃত্যুর অবব্যহিত পরে ‘নতুন কাপড় পরাইয়া ছেলেকে সঙ্গে লইয়া হরিহর নিমন্ত্রণ খাইতে যায়। একখানা অগোছালো চুলে-ঘেরা ছোট মুখের সনির্বন্ধ গোপন অনুরোধ দুয়ারের পাশের বাতাসে মিশাইয়া থাকে—হরিহর পথে পা দিয়া কেমন অন্য মনস্ক হইয়া পড়ে।’ পাঠক চোখে অশ্রু না এনে পারে না।
‘অপরাজিত’-য় নদীর পাড়ের আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর এক নব-রূপ প্রতীত হয়। মনে হয় জন্ম-মৃত্যুর চক্রটি এক ‘দেবশিল্পীর হাতে আবর্ত্তিত হইতেছে...সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি— বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট।’
ইছামতী উপন্যাসে অত্যাচারী নীলচাষি শিপটন সাহেবের মৃত্যুদৃশ্যও আমাদের নাড়া দেয়। সুদূর ইংল্যান্ডের কোনো এক গ্রাম থেকে আসা। মৃত্যুকালে রক্ষিতা গয়া মেম আর রাম কানাই কবিরাজ মুচি বাগদিরা ছাড়া তেমন কেউ তার পাশে ছিল না। যখন সাহেবের কথা বন্ধ, শ্বাসকষ্ট—দেওয়ান হরকারী বলল, এ কষ্ট আর দেখা যায় না। মৃত্যুর চূড়ান্তপর্বে কষ্ট হয় কি না—মানুষের জানা সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ লিখলেন—
শিপটন সাহেবের কষ্ট হয় নি। কেউ জানত না সে তখন বহুদূর স্বদেশের ওয়েস্টমোরল্যান্ডের অ্যান্ডসি গ্রামের ওপরকার পার্বত্যপথ রাইনোজ পাস দিয়ে ওক আর এলম গাছের ছায়ায় ছায়ায় তার দশ বছর বয়সের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে চলেছিল খরগোশ শিকার করতে, কখনো বা পার্বত্য রদ এল্টার-ওয়াটারের বিশাল বুকে নৌকায় চড়ে বেড়াচ্ছিল, সঙ্গে ছিল তাদের গ্রেট ডেন কুকুরটা...
হয়তো মৃত্যুর আগে মানুষের অবচেতনে তার শৈশবের স্মৃতিই বেশি ভেসে ওঠে।
আসলে ‘মৃত্যুকে কে চিনিতে পারে, গরীয়সী মৃত্যু-মাতাকে? পথপ্রদর্শক মায়ামৃগের মতো জীবনের পথে পথে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে, অপূর্ব রহস্যভরা তার অবগুণ্ঠন কখনো খোলে শিশুর কাছে, কখনো বৃদ্ধের কাছে..।’
মানুষ নিজের মধ্যেও অনেকবার মরে যায়, তার দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে। শারীরিক অস্তিত্ব বিলয়ের জন্য যদি দুঃখবোধের উদয় হয়। কিন্তু কোন সে শরীর, মৃত্যুর সময় আমরা কোন শরীরের কথা বলি। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, এমনকি বার্ধক্যেও মানুষ এক রূপ থেকে অন্য রূপে যায়।
অশনি সংকেত নতুন করে পড়ে দেখতে পারো, পড়তে পড়তে মৃত্যুকে বিজয়ের প্রতীক মনে হবে কিংবা মৃত্যুর কাছে বর্ণের হার দেখে শত কষ্টেও সুখ অনুভব করবে।
মতির মৃতদেহ আমতলাতেই পড়ে আছে। কত লোক দেখতে আসচে। দূর থেকে দেখে ভয়ে ভয়ে চলে যাচ্চে। আজ যা ওর হয়েচে, তা তো সকলেরই হতে পারে! ও যেন গ্রামের লোকের চোখ ফুটিয়ে দিয়ে গেল। একটি মূর্তিমান বিপদের সংকেত স্বরূপ ওর মৃতদেহটা পড়ে রয়েচে আমগাছটার তলায়। অনাহারে প্রথম মৃত্যুর অশনি সংকেত।
কিন্তু মৃত্যু থেকেই এক নবজন্মের শুরু হয়। এই আখ্যান সেই কালের যে কালে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নীচু জাতের তফাৎ ছিল খুব বেশি। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যু যেন সেই তফাৎকে ঘুচিয়ে দিল। অনঙ্গর অনুনয়কে ফেলতে পারেনা গঙ্গাচরণ, ব্রাহ্মণ ভটচাযও যোগ দেয়। সঙ্গে কাপালীদের ছোট বৌ। দুর্ভিক্ষের মৃত্যু এক নতুন সমাজের জন্ম দিল, জাতপাতের ঊর্ধে মানুষ মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে পারলো। অনঙ্গ-বৌ এর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হার মানতে হয়েছে গঙ্গাচরণের ব্রাহ্মণত্বের অহমিকাকে।
তেমার খুব প্রিয় আরণ্যক উপন্যাাসে আছে কলেরা নামক মহামারীর ছোবলের কথা। কী নির্মমভাবে মহামারীতে গ্রামের অগণিত মানুষ অকালে ঝরে পড়ছে; চিকিৎসার অভাব, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব- এ জনপদে কী ভয়াবহ ইতিহাস গড়ে তুলছে, তারই বিশ্বস্ত ভাষ্য নির্মাণ করেছেন বিভূতি পরম মমতায় আর অভিজ্ঞতার নির্যাসে। প্রকৃতপক্ষে আরণ্যক এমন এক উপন্যাস যেখানে জীবনের বৃহৎ পরিসরে বিচিত্র রূপে মৃত্যুই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। মৃত্যু ভালো না জীবন ভালো আমরা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারি না। বিভূতিভূষণের উপন্যাস ছাড়া ছোটগল্পেও মৃত্যুর নানা প্রতীকী ব্যবহার যেমন আছে তেমন বিশালভুবন তাঁর মৃত্যু দিয়ে গড়া। ‘পুঁইমাচা’ গল্পটির উল্লেখ না করলে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক্ষেন্তির মৃত্যু কিন্তু মরণের গল্প নয়, এ জীবনেরই গল্প, যখন দেখি লেখক মাচার উপর দিয়ে পুঁইঝাড়ের দৃশ্য রচনা করলেন। বিভূতিভূষণ মৃত্যুভীতি থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো কথাসাহিত্যে শ্রমের নিরলস তাজমহল নির্মাণ করে চলেছিলেন।
সব ঘরেই মৃত্যু আছে, মৃত্যু ছাড়া প্রাণ নেই। একদিন এক বৃদ্ধ মা তার একমাত্র সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে বুদ্ধের কাছে মাতম করে বললেন, ‘হে মহাস্থবির আমার পুত্রের জীবন ভিক্ষা দিন। বুদ্ধ বললেন, যাও, একটি বিল্বপত্র নিয়ে এসো—সেই বাড়ি থেকে, যে বাড়িতে কেউ মারা যায় নি।’ যেখানে বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় আটটি পথের ক্রমাগত অনুশীলন বলে দর্শানো হয়েছে, বিভূতিভূষণ সেই দুরূহ পথের প্রতিস্থাপন করেন প্রকৃতিকে দিয়ে। আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গটিকে বোঝা যাক। বিভূতিভূষণ লিখছেন,
‘জগতের অসংখ্য আনন্দের ভান্ডার উন্মুক্ত আছে। গাছপালা, ফুল, পাখী, উদার মাঠঘাট, সময়, নক্ষত্র, সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না রাত্রি, অস্ত সূর্য্যের আলোয় রাঙা নদীতীর, অন্ধকার নক্ষত্রময় উদার শূন্য… এসব জিনিস থেকে এমন সব বিপুল, অবক্তব্য আনন্দ, অনন্তের উদার মহিমা প্রাণে আসতে পারে, সহস্র বৎসর ধরে তুচ্ছ জাগতিক বস্তু নিয়ে মত্ত থাকলেও সে বিরাট অসীম, শান্ত উল্লাসের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই কোন জ্ঞান পৌঁছয় না।… সাহিত্যিকদের কাজ হচ্ছে এই আনন্দের বার্ত্তা সাধারণের প্রাণে পৌঁছে দেওয়া… তাদের অস্তিত্বের এই শুধু সার্থকতা।’
সংসার যদি দুঃখের সাগর হয়, তা হলে তার প্রতিকার, এই অসীম আনন্দের চাবি তিনি তুলে দিলেন প্রকৃতির হাতে। আর সাহিত্যিকের কী ভূমিকা? সাহিত্যিক হলেন যাজক। তিনি প্রকৃতি আর বিস্মৃত সাধারণ মানুষদের যোগস্হাপন করেন, মার্গপ্রদর্শক। অসীম আনন্দের আকরের সন্ধান দেওয়া তাঁর কাজ। আশ্চর্যের বিষয়, স্বভাববিনীত বিভূতিভূষণের প্রত্যয় এই ব্যাপারে বেশ দৃঢ়, বিশ্বের প্রেক্ষিতে তাঁর ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই। একটা কথা এখানে বলা হয়তো প্রয়োজন। দুঃখের অনুভুতিকে বিভূতিভূষণ অবাঞ্ছিত রূপে দেখেননি, বরং জীবনের প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হিসাবে দেখেছেন।
সময় অণুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধূলো ওড়ে না। ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই তার! সন্ধ্যা গড়িয়ে কখন রাত নেমে এসেছে বুঝতেও পারিনি। তোমার উত্তর পাবো কিনা জানিনা তবে অপেক্ষায় থাকবো। চিঠির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘এই জীবনের ওপারে সেই বিরাট জীবনের জন্যে সকলে অপেক্ষায় থাকুক।’— এই অপেক্ষাতেই আমরা না হয় দু’দণ্ড রইলাম!
ভালো থেকো নিরন্তর।
ইতি-
বাসু
০৩ নভেম্বর,২০২৪