ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৪
বের্শেন ইনেসের কথাই ভাবছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন…
‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না যে তোমার বন্ধুর গ্লাস একেবারে খালি? আরেকটু মনোযোগী হও। এইসব বিষয়ে আরও শিখতে হবে তোমাকে।’
বের্শেনের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। সে একটা গবলেট নিয়ে গের্টের জন্য ওয়াইন ঢালতে শুরু করলো (গের্ট একটা গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে বসেছিল)। কেন জানা নেই, হঠাৎ তার একটা অস্বস্তি হতে লাগল এবং মনে হল এটা নিয়ে পরে গের্ট তার সঙ্গে তামাশা করবে। তাড়াহুড়ো করে গের্টের দিকে ওয়াইন ভর্তি গবলেটটা ঠেলে রাখবার সময় এক দু’ ফোঁটা ওয়াইন চলকে পড়ল টেবিলক্লথে। বের্শেনের মা সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বোতলটা রেখে দিলেন ওয়াইনের দাগ ধরা জায়গাটার উপরে।
খাবার পর কালো কফি খেতে খেতে বের্নহার্ড ভাবছিল যে এবার ঘুমোতে গেলেই হয়; আসলে সেভাবে তার দিকে কারো নজর নেই। তার অভিমান হচ্ছিল, কিন্তু সে প্রকাশ করল না। তবে সে খুবই খুশি হয়েছে এটা দেখে যে তার বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে বাড়িতে সবার মনে একটা ভাল ধারণা তৈরি হয়েছে। সে ফ্লকের সঙ্গে মেঝেতে বসে খেলতে শুরু করল। নানা আদুরে নামে তাকে ডাকতে লাগল। রান্নাঘর থেকে রুটি নিয়ে এল সে ফ্লকের জন্য। তবে রুটির মাঝে সসেজের টুকরো গুঁজে দিয়েছিল সে, নাহলে ফ্লক শুধু শুকনো রুটি একেবারেই খাবে না।
সে যখন ফ্লকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার নোংরা পশম ঝেড়ে দিচ্ছিল, তখনি কে যেন এসে তার ঘাড়ে হাত রাখল। বের্শেন মুখ ফিরিয়ে দেখল যে ইনেস। ইনেস নিচু হয়ে অনুচ্চকণ্ঠে বলল যে তাদের এখন বেরতে হবে। বের্শেন মনে মনে চমকে উঠল। সে তার বন্ধুদের চলে যাবার ব্যাপারটা এতক্ষণ ভাবেনি। তার মাথাতেই আসেনি যে ওরা এখন ফিরে যাবে ওকে এখানে রেখে। যদি ওরা অন্তত ফ্লককে রেখে যেতেও রাজি হয়…
পরে, নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বের্শেনের মনে পড়ল যে তার হোমওয়ার্কের ফাইলটা শহরেই পড়ে আছে এবং সে আগামীকাল নিজের হোমওয়ার্ক করতে পারবে না।
‘ধুত্তোর’… বলেছিল গের্ট। কিন্তু নিজের কাজ তার কাছে কতটা দরকারি, সেটা গের্ট বুঝবে কী ভাবে? এখন গের্ট ইনেস আর ফ্লককে নিয়ে ড্রাইভ করে ফিরছে। হঠাৎ ভীষণ রাগ, অভিমান একসঙ্গে এসে বের্শেনের মন ভারি করে দিল। সে বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করল।
বের্নহার্ড থিয়েটারস্ট্রাসে* ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। সবে সাতটা বেজেছে। ওর সঙ্গীসাথির দল কেউই এসে এখনও পৌঁছায়নি। সাড়ে সাতটার আগে অবশ্য কেউ আসবেও না। আজকে ওরা সবাই মিলে কোণের ছোট পাবে খেতে যাবে, তারপর যাবে গের্টের বাড়িতে। আজ ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টি, যে আগামীকাল বার্লিনে চলে যাবে। ফার্দিনান্দের তেইশ বছর বয়স; সে মিউজিক কন্ডাকটর হতে চায়। সে ভীষণ ভাল বেহালা বাজায়। শহরের থিয়েটার হলে বেহালাবাদকের চাকরি তার পাকা। এমনকি সঙ্গীতশিক্ষকেরাও তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই চাকরিটা নিয়ে নেবার জন্য। কিন্তু ফার্দিনান্দের ভেতরে একটা অদ্ভুত একগুঁয়ে অদম্য আবেগী উচ্চাশা আছে। যে চাকরি পাওয়ার জন্য তার সঙ্গীসাথিরা সবাই তাকে ঈর্ষা করছিল, সে কিনা সেই চাকরিটা হেলায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে! জেদ ধরে প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় বার্লিন চলে যাচ্ছে সে। সে বলে সে ফুর্টভ্যাংলার এবং ব্রুনো ওয়ালটারের সঙ্গীত শুনতে চায়। আরও শুনতে চায়, আরও শিখতে চায় সে। বলে যে পড়াশুনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করে সে পয়সা রোজগার করবে। খুব রোগা আর লম্বা চেহারা ফার্দিনান্দের। এত রোগা যে ওর জামার কলারগুলো পর্যন্ত বিরাট বলে মনে হয় ওর অবয়বের উপরে। সুদর্শন বলা যাবে না তাকে। মুখটা এত ফ্যাকাশে যে ধূসর বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। মুখে দৃঢ় একটা অভিব্যক্তি সবসময়। সে যখনই ঠোঁটদুটো ফাঁক করে, মনে হয় যেন খুব তেষ্টা পেয়েছে তার। শুধু তার চোখগুলো তার মুখে অদ্ভুতরকম বেমানান। শুধু বড় নয়, চোখগুলো বিশাল আয়তাকার, কিন্তু লাজুক এবং বিষণ্ণ। ইনেস বলে যে শুধু চোখ দেখেই ওই ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ।
তাহলে ফার্দিনান্দ আগামীকাল যাচ্ছে। সঙ্গে থাকবে বেহালা, একটা পুরনো হাতব্যাগ আর ছোটখাট কিছু প্যাকেট যেগুলো বন্ধুরা স্টেশনে নিয়ে যাবে। কেক, আপেল, রুমাল, নানা ছোটখাট জরুরি জিনিসপত্র থাকবে সেই উপহারের প্যাকেটে। বের্শেন এমন একটা উপহার নিয়ে যাচ্ছে, যেটা ফার্দিনান্দকে একইসঙ্গে অবাক এবং খুশি করবে। সে নিয়ে যাবে ইনেসের একটা ছবি, যেটা সে চুপিচুপি ইনেসের কাছ থেকে চুরি করেছে। কারণ ফার্দিনান্দও ইনেসকে ভালবাসে। হ্যাঁ, নিশ্চিত ভালবাসে!
বের্শেন ঘড়ির দিকে তাকায়। এখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে এবং তার খিদে পেয়ে গেছে। সে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রেস্তোরাঁর আলোআঁধারি ঘরটায় ঢুকে পড়ল। ছোট ছোট টেবিলে ছাত্ররা বা মোটা মোটা সরকারি কর্মচারীরা বসে তাস খেলছে। সে সঙ্গীতশিক্ষার্থীদের জন্য রিজার্ভ করে রাখা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। তারপর বাঁধাকপির স্যালাদ আর সসেজ অর্ডার করল বেশ উচ্চস্বরে।
‘স্যার, আপনি কি খাবারের সঙ্গে বিয়ার পান করবেন?’ ওয়েট্রেস জিজ্ঞেস করল তাকে।
বের্শেনের একটু অস্বস্তি হলেও সে পাল্টা একটা ধন্যবাদ দিল পরিবেশনকারিনীকে।
ফার্দিনান্দের হয়তো পাবে বসেই একটু একটু নেশা হয়ে গিয়েছিল। এখন সে গের্টের বাড়িতে একটা বিশাল চেয়ারে এলিয়ে পড়ে আছে সিলিঙের দিকে চেয়ে। তার চোখেমুখে এক বিষণ্ণ অভিব্যক্তি। বাকিরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে খোশমেজাজে জোরে জোরে আড্ডা মেরে যাচ্ছে। গের্ট, যে কিনা এখন বাড়ির মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে সমানে এদিক ওদিক যাচ্ছে, সিগারেট নিয়ে আসছে এবং এখন একটু অনুকম্পামিশ্রিত সৌহার্দের সঙ্গে ফার্দিনান্দের সঙ্গে কথা বলছে। এই পার্টিতে মেয়েরা কেউ আসেনি। যদিও সঙ্গীত শিক্ষালয়ের ছাত্রদের অনেকেরই মেয়েবন্ধু আছে, তাছাড়া শিক্ষালয়ে একই ক্লাসে ছাত্রীরাও আছে; কিন্তু এই ধরণের পার্টিতে সাধারণত মেয়েদের ডাকা হয় না। যদিও তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষদের কাছে ব্যাপারটা একটু হুমকির মত শোনাবে, যদিও ব্যাপারটা পুরুষদের নিজেদের যথেষ্ট আধুনিক হিসেবে প্রমাণ করবার পরিপন্থী, তবুও এটা এখানে পুরুষ ছাত্রদের বিয়ার টেবিলের প্রচলিত রীতি। অবশ্য সব রীতির ব্যতিক্রম আছে। এখানে এই ব্যতিক্রমের নাম ইনেস। ইনেসকে সব সময় আমন্ত্রণ করা হয়। যদিও সে অনেক মেয়েদের চেয়ে গম্ভীর আচরণ করে এবং স্বল্পবাক, তবুও সে এই জমায়েতে যোগদান করতে অস্বস্তিবোধ করে না। দশ পনের জন পুরুষের মাঝে একমাত্র মহিলা হিসেবে তাকে সবসময় অসাধারণ দেখায়। কিন্তু আজ সে আসেনি।
এদিকে ফার্দিনান্দ বার বার ইনেসের কথা জিজ্ঞেস করছে। এখন আবার বলছে যে ইনেসকে নাহয় আবার ফোন করে ডাকা হোক। বাকিরা গের্টের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘এখন প্রায় রাত এগারোটা, ওই বুড়ো… ওর বাবা ওকে বেরতে দেবে না এখন। তাছাড়া ইনেসও ভাববে যে আমরা অভদ্র আচরণ করছি’… গের্ট অসহায় কণ্ঠে নিজের দ্বিধা ব্যক্ত করে।
‘তাহলে বের্নহার্ড ফোন করুক।’ ফার্দিনান্দ বলে
‘আহা, সেটাও কি খুব ভাল হবে?’
‘অবশ্যই ভাল হবে। কারণ ইনেস বের্শেনের উপর রাগ করবে না।’
‘খুব ভাল। বের্শেন!’
বের্নহার্ড এত কথা কিছুই শোনেনি। তাকে জোর করে আধা গেলাস বিয়ার খাইয়ে দিয়েছে। তার বিয়ার খেতে খুব বিশ্রী লাগছিল। কেমন টক টক স্বাদ। কিন্তু গের্ট এবং ফার্দিনান্দ চেপে ধরে খাইয়ে দিয়েছে তাকে। সে এখন গের্টের বিছানায় আধোঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। সে এখন ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে নানা কথা ভাবছে। গের্ট তাকে মডেল করে যে ছবিগুলো এঁকেছিল, তার মধ্যে চার পাঁচটা গের্টের ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে। সেগুলো সবাই দেখেছে এবং সেগুলো নিয়ে খিল্লি করছে। বের্নহার্ড বুঝতে পারছে না কেন তার এত বিরক্ত লাগছে। তার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। কেমন যেন লজ্জা করছে সবার মাঝে থাকতে। তবে ছাত্ররা সবাই তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু এই মুহূর্তে বের্নহার্ড একা একা একটু ঘুমোতে চায়। সে চায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এরা যেন এই ঘর ছেড়ে চলে যায়। তার বদলে এরা চারদিকে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি চালিয়ে যাচ্ছে। সবাই চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘আরে, তোমরা চাও কি শুনি? কি চাও?’ চুপ করার বদলে সবাই আরও জোরে হেসে ওঠে।
(চলবে)
*স্ট্রাসে (straße) শব্দের অর্থ সরণী।