Next
Previous
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






উনিশ

কিন্তু দুঃখের বিষয় মানুষের চেতনা এখনও হয়নি । গাছ কাটা এখনও অব্যাহত আছে ।তাইতো এত গরম ।বৃষ্টির দেখা নেই ।বিজয় খুবই চিন্তার মধ্যে আছে । রাতে তার ঘুম হয়না । বর্ষাকাল চলছে ।সমুদ্র ফুলে উঠেছে আক্রোশে ।কি হয় ,কি হয় ।খুব ভয় ।বিজয় ভাবে,মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বেইমানি করেছে । এর প্রতিশোধ প্রকৃতি নেবেই । তারপর অন্য কথা ।একদিন বর্ষাকালে রাতে সবাই ঘুমিয়ে আছে কিন্তু জেগে আছে সমীর আর বন্যার জলের বিষাক্ত ফণা । মাঝ রাতে বন্যার একটা বড় ঢেউ এসে সমীর ও তার গ্রামের সবাই কে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ধ্বংসের পথে । এখন সেই গ্রাম শ্মশানের মত ফাঁকা ।প্রকৃতি এখনও সুযোগ দিয়ে চলেছে বারে বারে । সাবধান হলে বাঁচবে । পৃথিবীকে সবুজের ঘেরাটোপে সাজাতে হবে। বাঁচার একমাত্র পথ গাছ, শুধু গাছ। বন্যা কমে গেলে নদীর পাড়ে ভাঙা বাঁধটা দশ গ্রামের লোক এসে একত্রে বাঁধলো মাটি আর বাঁশ দিয়ে শক্ত করে। বিজয় বলে সকল গ্রামবাসীকে , আমাদের গ্রামটা সবুজ গাছ করে দাও সবাই একত্রে গাছ রোপণ করে।তাহলে আমদের গ্রাম বাঁচবে।...

একদল বলাকার দল উড়ে এল রিমির মনমেঘে।তখন সে সাদাশাড়িতে সতের।দেহের সাগর ঘিরে উথালপাথাল ঢেউ।ঠিক সেই সময়ে নোঙর করে তার মনের তীরে পূর্ব প্রেমিক সমীরণের ছোঁয়ায় তার শিরশিরে পানসি নৌকার অনুভব।ধীরে ধীরে পালতোলা জাহাজের মত দুজনের প্রেম তরতরিয়ে এগিয়ে চলে।শত ঝিনুকের মুক্তোর সোহাগে দুজনেই রঙীন হয়ে উঠত।

চিন্তার রেশ কাটতেই বিপিন বলে উঠল,রিমি তুমি এত কী চিন্তা করছ?

- কিছু না।এমনি করেই কাটুক সময়।

- আমাদের বিয়ের পাঁচ বছরে একটা অনুষ্ঠান করলে হয় না?

- থাক ওসবে আর কী হবে? এই বেশ বসে আছি নদীর তীরে।

- তোমার অতীতের কথা বলো। আমি শুনব।

- কেন তোমার অতীত নেই

- আমার অতীত বর্তমান হয়ে রাজুর বউ হয়ে বসে আছে।

- ও, রাজুর বউ তোমার পূর্ব প্রেমিকা ছিল?

- হ্যাঁ ছিল একদিন। গ্রামের মন্ডপতলায় গেলেই মনে পড়ে বাল্যপ্রেম।কাঁসর ঘন্টা বাজত আরতির সময়।আমি ভালো কাঁসর বাজাতাম।আর তাছাড়া ওর মুখ দেখার লোভে ছুটে চলে যেতাম পুজোমন্ডপে। আরতির ফাঁকে দেখে নিত ওর চোখ আমাকে।তার চোখের নজর আমার দিকেই থাকত। সারাদিন তাকিয়ে থাকতাম ওদের বাড়ির দিকে।যদি একবারও দেখা যায় ওর মুখ। অসীম খিদে চোখে কেটে গেছে আমার রোদবেলা।

- আমারও অতীতের ভালোবাসা সমীরণ, ভেসে গেছে অজানা স্রোতে।এসো আজ আমরা আবার নতুন মনে এক হই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ চেয়ে।

- হ্যাঁ ঠিক বলেছো তুমি। পুরোনো ব্যাথায় মলম লাগাব দুজনে দুজনকে।চলো আজ নৌকাবিহারে আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করি।

- চলো। নব উদ্যমে এগিয়ে যাই আমরা নবসূর্যের আহ্বানে।

রিমি লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর ভক্ত।বিপিন পুণ্যদাস বাউলের গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।কিন্তু দুজনে দুজনের পছন্দকে শ্রদ্ধা করে।

রিমি বিপিনকে বলে তার প্রিয় লেখিকার কর্মজীবনের কথা,সাহিত্যের কথা।রিমি বলে, পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুরের শবর জনজাতির সঙ্গে মহাশ্বেতা জড়িয়ে ছিলেন আজীবন । তাকে মা হিসেবে মেনে নিয়েছিল শবরাও । পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর ব্লকে লােধা শবর , বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ , রাইপুর এবং পুরুলিয়ার তেরােটি ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী খেড়িয়া শবরদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষে কাজ করেছেন তিনি । এদের উন্নয়নে মহাশ্বেতারকর্মসূচি ছিল শিশুশিক্ষা , বয়স্কশিক্ষা , নারীশিক্ষা , শবরদের মদ্যপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি , তাদের হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করা এবং ব্রিটিশ যুগ থেকে শবরদের গায়ে লেগে থাকা ‘ অপরাধপ্রবণ জনজাতি’রতকমা থেকে তাদের মুক্ত করা।

বিপিন বলে,আমি পড়েছি,এজন্য আইনি লড়াইয়েও পিছপা হননি তিনি । ২০০৩ সালে এই শবরমাতা ম্যাগসাইসাই ’ পুরস্কারের ভূষিত হন । পুরস্কার মূল্যের দশ লক্ষ টাকা পুরােটাই তিনি দিয়েছেন এদের উন্নয়নার্থে । গ্রামে কোন সমস্যা হলেই তিনি সেইসব গ্রামে সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে গেছেন ।

রিমি আবার বলে, মহাশ্বেতার সাহিত্যিক জীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল আরাে অনেক বছর আগে । ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় পদ্মিনী ও যশোবন্তি গল্পদুটি লেখেন মহাশ্বেতা দেবী । পঞ্চাশের দশকের গােড়ায় মহাশ্বেতা দেবী গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে ।১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রাণী, এইমধ্যপ্রদেশের লােককথা ও ইতিহাসের মিশেলে তৈরি । ষাট দশকের গােড়ায় অবিভক্ত বিহারে পালামৌ , হাজারিবাগ , সিংভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সেখানকার বেগার শ্রমিক প্রথা এবং জনজাতিদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে লেখেন ‘ অপারেশন বসাই টুডু, অরণ্যের অধিকার এবং ‘ চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর ‘ । ১৯৭৪ সালে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘ হাজার চুরাশির মা ‘ বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল । পরবর্তীতে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের বিভিন্ন বাংলা পাঠ্যপুস্তকও সম্পাদনা করেন মহাশ্বেতা । ১৯৭৯ সালে বাবা মণীশ ঘটকের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘ বর্তিকা’র দায়িত্ব নেন । ১৯৮৩ সালে পুরুলিয়ার অবহেলিত জনজাতিদের উন্নতির জন্য গড়ে তােলেন পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি । তিনি তার বহু পুরস্কারের অর্থ দান । করেন এইসমিতিকে ।