Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৮ পর্ব

ক্লাইভের তৃতীয় এবং শেষ ভারত আগমন এবং অন্তিম প্রত্যাবর্তন।

ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে সকলে তাকে বিজয়ী বীরের মর্যাদায় স্বাগত জানালো। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ব্যবসা এবং যুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই যে পারদর্শিতা সে দেখিয়েছে তাকে যথাযোগ্য সম্মান জানালো ব্রিটিশ সরকার। উইলিয়ম পিট যে পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল ক্লাইভকে ‘ঈশ্বর প্রেরিত সেনাপতি’ আখ্যানে ভূষিত করলো। ১৭৬১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্লাইভ স্রুইসবেরির সাংসদ হিসাবে শপথ গ্রহণ করে। ১৭৬২ সালে ক্লাইভ ব্যারন উপাধিতে ভূষিত হয় এবং তার দু’বছর পরে তাকে নাইটহুড প্রদান করা হয়। পলাশি যুদ্ধোত্তর পর্যায়ে প্রশাসনিক দূর্বলতা এত প্রকট হয়ে উঠলো যে ব্রিটিশ সরকার ক্লাইভকে ১৭৬৫ সালের মে মাসে ভারতবর্ষের সর্বময় কর্তা হিসাবে পুনরায় প্রেরণ করলো। ব্যবসা, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর সর্বময় কর্তা হিসাবে ক্লাইভ ভারতবর্ষে ফিরে এল।

ক্লাইভ ফিরে এসে দেখলো মিরজাফরের দ্বিতীয় পুত্র ১৫ বছর বয়সী নাজামুদৌল্লা মসনদে আসীন। এই মসনদ দখলের অনুমতির মূল্য হিসাবে সে ১লক্ষ ৪০ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ১১ লক্ষ টাকা কলকাতা কাউন্সিলের সদস্যদের ভাগ করে দিয়েছে। সেই বছরই অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা বাধ্য হয়েই বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত এবং পলায়নরত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দিওয়ানি তুলে দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তা না করলে নিজের জায়গা উত্তরপ্রদেশকেও হারাতে হতো তাকে। নিজেদের খুশীমত ব্যবসা করার সঙ্গে সঙ্গে খাজনা আদায়ের অধিকারও চলে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। মোট আদায়ীকৃত খাজনার পরিমাণ তখন ছিল আজকের হিসাবে ৭০০০ কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের রাজদরবারের নিয়ন্ত্রক থেকে নবাবে পরিণত হলো কোম্পানির সর্বময় কর্তা লর্ড ক্লাইভ। ক্লাইভ প্রবর্তন করলো দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। রাজ্যশাসনকে দু’ভাগে ভাগ করা হলো। আইন কানুন রক্ষা এবং বিচারের দায়িত্বে থাকবে ‘নবাব’ এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকবে ‘দেওয়ান’। ১৭৬৬ সালের মে মাসে যখন খাজনা আদায়ের বার্ষিক হিসাব নিকাশের সভা হয় তখন পুতুল নবাব নাজামুদৌল্লার ডানদিকে দেওয়ানের আসনে ছিল লর্ড ক্লাইভ। এই প্রথম দেওয়ানের আসনে দেখা গেল এক ব্রিটিশকে। অদূর ভবিষ্যতে নবাবের আসনেও যে ব্রিটিশদের দেখা যাবে এই দৃশ্য তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এই অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরেই ক্লাইভের সম্মানে আয়োজিত এক অজানা জ্বরে মারা যায় নাজামুদৌল্লা। পরের বছর অর্থাৎ ১৭৬৭ সালে এই বার্ষিক অনুষ্ঠান পালিত হয় আরও জাঁকজমকের সঙ্গে। সেই অনুষ্ঠানে নবাবের পাশে আসীন ছিল বাংলার নবনিযুক্ত গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট। নবাবের আসনে ছিল মিরজাফরের আর এক পুত্র সৈফুদৌল্লা। নবাবের আসনে বসার জন্য সৈফুদৌল্লা যে রীতি অনুযায়ী বিশাল অঙ্কের টাকা কাউন্সিলের সদস্যদের দিয়েছিল তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ক্লাইভের ভারত অধ্যায় এখানেই শেষ। ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ দেশে ফিরে বাকি জীবন সমান মর্যাদা , খ্যাতির সঙ্গে রাজনীতির অঙ্গনে অতিবাহিত করে। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতবর্ষে ক্লাইভের অপশাসন এবং ব্যক্তিগত সম্পদবৃদ্ধির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে। ক্লাইভ সেখানে জানায় যে সে অবাক হয়ে যাচ্ছে যে আত্মত্যাগের এবং সংযমের যে পরাকাষ্ঠা সে ভারতবর্ষে সে প্রদর্শন করেছে তারপরেও তাকে অপশাসন এবং দূর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হচ্ছে। প্রত্যাশিতভাবেই সেই তদন্তের ফলাফল ক্লাইভের পক্ষে যায়। কিন্তু তারপর ক্লাইভের শরীর দুর্বল হতে শুরু করে এবং কথিত আছে সে নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অনেক ঐতিহাসিক বলেন ক্লাইভ নাকি ঐ সময় আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। ১৭৭৪ সালের ২২শে নভেম্বর মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ক্লাইভের বার্কলে হাউসের বাড়ি থেকে কন্ঠনালী কাটা অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এটি আত্মহত্যা না হত্যা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তার মৃত্যুর পর লন্ডনের একটি দৈনিকে তাকে লর্ড ভালচার হিসাবে চিত্রায়িত করা হয় যাতে দেখানো হয় একটি শকুনি মন্বন্তরে মৃত এক ভারতবাসীর হাড় ঠোঁটে করে তুলে নিচ্ছে।

১৭৬০ সালে পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভ যখন দেশে ফিরে যায় তখন যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সে সঙ্গে করে নিয়ে যায় আজকের হিসাবে তার পরিমাণ ৬ কোটি পাউন্ড বা ৬০০ কোটি টাকা। সেই সময় ভারতবর্ষে তার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি ও সম্পত্তি থেকে তার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল আজকের হিসাবে ৫২ কোটি টাকা। ১৭৬৫ সালের ৩রা মে ক্লাইভ যখন তৃতীয়বারের জন্য কলকাতা এসে পৌঁছোল তখন খবর পেল যে মিরজাফর ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য বিপুল অর্থ রেখে গেছে যার পরিমাণ আজকের দিনে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। একমাত্র ক্লাইভ একাই যদি এত অর্থ ব্যক্তিগত ভাবে ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে যায় তাহলে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ এদেশ থেকে লুন্ঠিত হয়েছিল তা ভাবতে গেলেও বিস্মিত হতে হয়। ক্লাইভ যে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল ১৭৭২ সালে তা অবলুপ্ত করে দেওয়া হয়। বাংলা ,বিহার এবং উড়িষ্যার শাসনব্যবস্থায় নবাবের আর কোনও ভূমিকা রইলো না। ১৭৭৩ সালে ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেল কলকাতায়। এর পরের প্রায় দু’শ বছরের ইংরাজ শাসন এবং ভারতবর্ষের পরাধীনতার ইতিহাস শেষ হল ১৯৪৭ সালে। বর্মা এবং শ্রী লঙ্কার ব্রিটিশ শাসন শেষ হয় ১৯৪৮ সালে। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করে ফরাসিদের বাংলা এবং দাক্ষিনাত্য থেকে নির্মূল করে দেয় ব্রিটিশেরা। বক্সারের যুদ্ধে মোগল সম্রাটকে হারিয়ে বাংলা এবং বিহারের খাজনা আদায়ের অধিকার হাতে পেয়ে এই উপমহাদেশে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিল ব্রিটিশ। ১৭৭২ সালে হ্যারি ভেরেলস্টের উত্তরসূরী হিসাবে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়। ১৭৭৩ সালে তার পদোন্নতি হয় গভর্নর জেনারেলের পদে। ভারতবর্ষের দন্ডমুন্ডের কর্তা হেস্টিংস একদিকে ছোট ছোট রাজ্য এবং অঞ্চলের স্থানীয় রাজা, জমিদারদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে অথবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিস্বাক্ষর করাতে বাধ্য করতে লাগলো এবং অন্যদিকে শাসনব্যবস্থায়, শিক্ষায় এবং সংস্কৃতিতে ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুপ্রবেশ ঘটাতে লাগলো। পরবর্তী বারো বছরে ব্রিটিশ আইনানুসারে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন, মন্বন্তরের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করে খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়া পুনরারম্ভ এবং মাইসোরে মারাঠাদের এবং রোহিলখন্ডে পাঠানদের বিদ্রোহকে দমন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বাংলা বিহারের সীমানা অতিক্রম করে পশ্চিমে মুম্বাই, দক্ষিণে চেন্নাই এবং উত্তরে প্রায় দিল্লী অবধি সম্প্রসারণ ছিল হেস্টিংসের মূল সাফল্য।

পলাশির যুদ্ধের পর আজকের হিসাবে ৫০০০ কোটি টাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মিরজাফর। মিরজাফর কথা রাখতে পারেনি বলে তার জায়গায় নিযুক্ত করা হয়েছিল তার জামাতা মিরকাশিমকে। নিজের নবাব হবার মূল্য ছাড়াও বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রাম জেলার খাজনা আদায়ের সম্পূর্ণ অধিকার মিরকাশিম দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের বরাত দিয়েছিল কয়েকজন জমিদারকে যারা অন্যদের চেয়ে বেশি টাকা তুলে দেবার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পলাশি যুদ্ধের এক দশক পরে কোম্পানি সমগ্র বাংলার খাজনা আদায়ের অধিকার লিখিয়ে নেয় তৎকালীন মোগলরাজের কাছ থেকে। এই খাজনার পরিমাণ ছিল আজকের হিসাবে আনুমানিক ৭০০০ কোটি টাকা। এই খাজনার মাত্র ৫-৭ শতাংশ দেওয়া হতো দিল্লীর মোগলসম্রাটকে আর বাকি টাকা যেত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পকেটে।