Next
Previous
0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in





একাডেমীতে ‘শকুন্তলম’ থিয়েটার সাকসেসফুল। প্রচুর হাততালির সাথে স্ক্রিন ড্রপ হতেই প্রথম সারির সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শ্রীদেবী। ধীরে ধীরে স্টেজের পেছনে পৌঁছে গেল। সে দেখলো দুষ্মন্ত আলো ঝলমল রাজার পোষাকে দাঁড়িয়ে কন্বদেবকে কিছু বলছে। শ্রীদেবী আবেগময়, কিছুটা সম্মোহিত! রাজা দুষ্মন্তের ভূমিকায় অয়নকুমারের নায়কোচিত পারফর্মেন্স তার খুব ভালো লেগেছে!
‘দারুণ অ্যাক্টিং মিস্টার অয়নকুমার! টোটাল প্রোগ্রামটাই খুব ভালো হয়েছে। আপনি কি আর কোন গ্রুপের সাথে অ্যাটাচড?’- এক ঝলক খুশির আবহ শ্রীদেবীর কমপ্লিমেন্টে।
‘থ্যাঙ্কউ ম্যাডাম, তেমন কিছু না! এই শখের থিয়েটার করা, আর কি! কয়েকটা নাটকের গ্রুপ, আমাদের কলেজের সিনে ক্লাব এসবেতেই আছি!’
‘আমি তো সিনিয়র হিসেবে আপনাকে তুমিই বলতে পারি। খুব ভালো লেগেছে তোমার অভিনয়। এজন্যেই তো ব্যাকস্টেজে এসে তোমাকে কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে গেলাম। বাই বাই! আবার কখনো দেখা হবে!’
কন্বদেব, দুই সখী, শকুন্তলার মেকআপে মল্লিকা আর ব্যাকস্টেজের মানুষগুলো। ওরা সবাই অবাক হয়ে দেখল, স্টেজ থেকে স্মার্টলি নেমে যাচ্ছে এ সময়ের বাংলা ছবির হট ফ্লিমস্টার শ্রীদেবী! থিয়েটার হলে তার উপস্থিতি অবশ্যই সাড়া জাগানো ব্যাপার!

তার পরে অয়নের বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। নানা কাজ, আগামী প্রস্তুতি ‘তেপান্তরের রাত’, একটা শর্ট ফ্লিমের অফার, ইউনিভার্সিটির পিএইচডির কিছু অ্যাসেসমেন্ট – এসব নিয়ে সপ্তাহ খানেক বেশ ব্যস্ত ছিল অয়ন। অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছিল ‘শকুন্তলম’এর দিনটায় শ্রীদেবীর সেদিনকার কনাগ্রাচুলেশের স্মৃতি।

সেদিন রাত্তির এগারোটায় মোবাইল বেজে উঠলো। অয়ন স্ক্রীনে দেখল, ট্রু-কলারে ভেসে উঠেছে নাম - শ্রীদেবী। সঙ্গে রাবীন্দ্রিক কলার টিউন - ‘তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’!
অয়ন ভাবতেই পারে নি, শ্রীদেবী তাকে ফোন করবে। এ কি সেই অ্যাকট্রেস, নাকি ফেক কোন ফোন কল?
‘হ্যালো অয়ন, আমি শ্রীদেবী বলছি। তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল! তাই ফোন করলাম। ডিস্টার্ব করলাম না তো? একাডেমীতে সেদিন তোমাদের থিয়েটার খুব এনজয় করেছি! শুনেছি, ‘শকুন্তলম’এর টিমটা ব্যারাকপুরের। তুমি কি ব্যারাকপুরে থাকো?’
‘না ম্যাডাম! বিধাননগরে একটা ফ্লাটে আমি রেন্টে থাকি। প্রেসিডেন্সিতে কেমিস্ট্রি নিয়ে পিএইচডি করছি।’
ওদিক থেকে মোবাইল সিগন্যালে উড়ে আসছে অভিনেত্রীর কন্ঠস্বর – ‘আচ্ছা! তাই বুঝি! অয়ন, খুব সুন্দর অ্যাক্টিং তোমার! থিয়েটার ছেড়ে যদি চাও তুমি তো ফ্লিম ইণ্ডাস্ট্রিতে আসতেই পারো। খুব ভালো তোমার পারফরমেন্স।’
অয়ন কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না!
‘ওকে ডিয়ার অয়নকুমার! গুড নাইট। ভালো থেকো। পরে দেখা হবে।’

গ্রুপ থিয়েটার, কয়েকটা শর্টফিল্মে অয়ন অভিনয় করেছে, কয়েকটার ইউটিউব বেরিয়েছে - এসব ঠিকই। শখের অভিনেতা বলে কলেজে অয়নের একটা পরিচিতি আছে। তবে এই রাতে বাংলা সিনেমার পরিচিত অভিনেত্রী শ্রীদেবী্র ফোনে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছিল।

কয়েকদিন বাদের কথা। রাত প্রায় বারোটা। ফ্লাটে একা বসে বসে অয়ন পিএইচডির সাবজেক্টটাতে চোখ বোলাচ্ছিল। আবার সেই পরিচিত কলার টিউন - ‘তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার ……’!

ওপাশ থেকে ভেসে এলো শ্রীদেবীর কথাগুলো, ‘অয়ন, সময় বের করে তোমাদের থিয়েটার ক্লাবের ইউ-টিউব আর ওয়েব-সাইটে পোষ্ট করা শর্টফ্লিমগুলো দেখলাম! এক্সেলেন্ট, অয়ন! তোমার অভিনয় সত্যিই দারুণ!’
‘ম্যাডাম, আপনি তো সিনেমার নামকরা অভিনেত্রী। থিয়েটারও কি আপনি খুব পছন্দ করেন?’
‘ডিয়ার অয়ন, আমাকে তুমি ম্যাডাম বোলো না। আমি ফ্লিম লাইনের অ্যাকট্রেস হলেও মাঝে মাঝে থিয়েটার দেখি। একসময়ে গ্রুপ থিয়েটার করতাম কিনা! তুমি খুব ট্যালেন্টেড – একটা নায়ক নায়ক ভঙিমা তোমার দুচোখে, তোমার চলনে, অভিনয়ে! আমি চাই তুমি ধীরে ধীরে ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে এসো।’
শ্রীদেবীর কথাগুলো অয়ন তো বিশ্বাসই করতে পারছে না! সে ডুব জল থেকে মাথা তুলে একটু নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করলো। - ‘আপনার মতো একজন স্টারের সামনে নিজেকে অভিনেতা ভাবতে সত্যিই আমি লজ্জা পাচ্ছি!’
‘অয়ন! আমার খুব ইচ্ছে, তোমার সাথে সিনেমাতে দু-একটা কাজ করি!’
‘আপনি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন! তাছাড়া ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে কে ই বা আমাকে চান্স দিচ্ছে?’
‘নিশ্চয়ই দেবে! অয়ন, সেটা তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও! বলেছি না তোমার মধ্যে একটা আলাদা ট্যালেন্ট আছে!’
‘ম্যাডাম!’
‘ডিয়ায় অয়ন, আবার সেই ম্যাডাম! আমি টালিউড-বলিউডের কোনো স্টার না! আমাকে তুমি শ্রীদেবী বলেও ডাকতে পারো।’
কয়েকটা সেকেন্ডের নীরবতা!
‘গুড নাইট, মাই ডিয়ার অয়ন! হ্যাভ এ নাইস ড্রিম!’

রাত্রি তখন সাড়ে বারোটা। অয়নের ভাড়া নেয়া ছোট্ট ফ্লাটের জানালা থেকে বড়ো রাস্তার চৌমাথায় জ্বলতে থাকা এলএডি ল্যাম্পটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নির্জন বড়ো রাস্তাটা দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে দমকলের একটা গাড়ি ছুটে গেল। হয়তো বা কোথাও আগুন লেগেছে। আজ আর পিএইচডির সাবজেক্টটাতে মন বসবে না। তার কানে বাজছে প্রিয় অভিনেত্রী শ্রীদেবী ব্যানার্জী মায়াবী কন্ঠস্বর!

সে রাতে আচ্ছন্ন তন্দ্রার মধ্যে তার চোখে স্বপ্নের মতো ভেসে বেড়াতে লাগলো সেই মুখ! শ্রীদেবী ব্যানার্জী কোলকাতার একজন নামজাদা অভিনেত্রী। কি অসাধারণ দেখতে! ফর্সা টুকটুকে চেহারা। চোখদুটো কথা বলে। অভিনেত্রীর বয়স তো প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশের কাছাকাছি। ফ্লিম অ্যাকট্রেস শ্রীদেবী কি করে অয়নকে একজন নায়ক হিসেবে পছন্দ করলো? এও কি সত্যি? না কি এসব ছিল মধ্যরাতের মরীচিকা!
পরদিন সকালে সুদীপদার ফোনটা এলো। সুদীপদা ওদের কলেজের সিনে ক্লাবের সেক্রেটারি! ‘অয়ন, আজ মালঞ্চতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাস! অনেক কাজ আছে।’
‘হ্যাঁ, সুদীপদা! ‘তেপান্তরের রাত’এর প্রিমিয়ার শো। তাছাড়া ইরাণীয়ান মুভিটার জন্যে প্রোজেক্টর সেট করে রাখতে হবে। তুমি ভেবো না। আমি তিনটের আগেই হলে পৌঁছে যাবো।’
অয়ন ভাবছে শ্রীদেবীর ফ্লিমে নামার প্রোপোজালটা আজ কি সে সুদীপদাকে শেয়ার করবে? শেষে মনে হলো, এ সব পার্সোনাল কথা। এখন চেপে যাওয়াই ভালো।
ওদের গ্রুপ থিয়েটারের কয়েকটা নাটক ইউ-টিউবে পোষ্ট করা হয়েছিল। যেমন - আন্তিগোনে, রোদ্দুর বিক্রি, চাঁদ বনিকের খেয়া। তাছাড়া সিনে ক্লাবের তরফে কতগুলো শর্টফ্লিম আর ইউ-টিউব বাজারে বেশ চলছে। যেমন ‘ওথেলোর দুঃস্বপ্ন’তে নাম ভূমিকায় অয়ন। ‘পথসন্ধি’- পনেরো মিনিটের ফ্লিম; নায়কের ভূমিকায় সে নিজে। ‘অউদিপাউসের জীবন’এ রাজার ভূমিকায় অয়ন। এসব থিয়েটার আর শর্টফ্লিমের ইউ-টিউবগুলো কি শ্রীদেবী দেখেছে?

সেদিন অয়ন সময় মতোই মালঞ্চ হলে পৌঁছে গেলো। সেখানে নতুন শর্টফ্লিম ‘তেপান্তরের রাত’এর প্রিমিয়ার শো! এখানে অয়নের চরিত্র - সে একজন স্বপ্ন দেখা যুবক; তার বিপরীতে প্রেমিকার চরিত্রে সেই শকুন্তলা, তার কলেজের থার্ড ইয়ারের মল্লিকা!
ওদের ‘তেপান্তরের রাত’ শর্ট ফিল্মটা প্রিমিয়ার শো’এর শেষে খুব প্রশংসা পেলো। এই ফ্লিমের দুটো মেইন ক্যারেক্টার -অয়ন আর মল্লিকা। ওদেরকে কেউ কেউ অভিনন্দন জানালো। কিছুক্ষন বিরতি!
এরপর ইরাণীয়ান ছবিটা শুরু হলো। ফ্লিমটা যখন চলছে, ঠিক তখনই ভাইব্রেশন, সাইলেন্টে রাখা মোবাইলে ফুটে উঠলো তার অভিনেত্রীর মুখখানা। শ্রীদেবীর কন্ঠস্বর – ‘অয়ন, তুমি কোথায়?’
কায়দা করে মল্লিকাকে পাশ কাটিয়ে হলের সীটগুলো পেরিয়ে সে এক্সিট লেখা লাল অক্ষরগুলোর নীচ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
‘আমাদের একটা প্রোগ্রামটা চলছে, মালঞ্চ হলে। একটা ইরাণীয়ান ফ্লিম চলছে। আমি বেরিয়ে এসেছি।’
‘সরি, ডিস্টার্ব করলাম!’ - ওপার থেকে ভেসে এলো অয়নের প্রিয় অভিনেত্রীর কথাগুলো - ‘তুমি কবে আমার সাথে দেখা করছো?’
অয়ন উন্মুখ হয়ে রইলো মোবাইলের দিকে। ভিডিও কলের স্ক্রিনে জেগে আছে শ্রীদেবীর উজ্জ্বল দুটো চোখ।
‘শোনো ডিয়ার, এই চব্বিশ তারিখে। দিয়ালিয়া - বে-অফ-বেঙ্গল সমুদ্রতটের কাছেই! শুনেছো জায়গাটার নাম? দিয়ালিয়া ছোট্ট ট্যুরিষ্ট স্পট। ওখানে আমাদের কিছু শুটিং আর অন্যান্য কিছু প্রোগ্রাম থাকবে। তেমন চাপ নেই, ওখানে আমি রিলাক্স থাকবো। ২৪, ২৫, ২৬ – এই তিনদিনই তোমার ওখানে থাকার ইনভাইটেশন। আমি আকাশমহল নামে একটা হাভেলিতে থাকবো। ওখানে তুমি আসবে, রোজই আসবে। আমার সাথে দেখা করবে। তোমার সাথে আমাদের প্রোডিউসার, ডিরেক্টরদের আলাপ করিয়ে দেবো।’

ডিরেক্টরের সাথে আলাপ হোক বা না হোক, সেটা সেকেন্ডারী। অয়নকে ডেকে পাঠিয়েছে অভিনেত্রী শ্রীদেবী ব্যানার্জী। অয়নের পক্ষে এ আমন্ত্রণ কি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? অভিনয় সে ভালোবাসে। ভবিষ্যতে সেও একজন বড়ো অভিনেতা হতে চায়।
একটু ভেবে অয়ন বললো - ‘ঠিক আছে, ম্যাডাম! আসবো। অবশ্যই আসবো। আপনার সাথে ২৪ তারিখে আকাশমহলে দেখা হবে! কিন্তু জায়গাটা?’
‘শোনো তোমার ওয়াটসঅ্যাপে সব ডিটেলসগুলো পাঠিয়ে দেবো। দিয়ালিয়াতে ২৪-তারিখ দুপুর থেকে চার দিনের জন্যে একটা হোটেল বুক করা থাকবে। সমস্ত ব্যবস্থাই আমার। তুমি সেখানেই উঠবে। দিয়ালিয়া থেকে আকাশমহল ৩/৪ কিলোমিটার। খুব একটা দূরে না। আমি ডিরেকটরকে বলে রেখেছি। নেক্সট ফ্লিমে তুমি আমার সাথে সিনেমা করবে! চব্বিশ তারিখ – মনে থাকবে তো?’
চব্বিশ তারিখ দুপুরেই অয়ন দিয়ালিয়াতে পৌঁছে গেলো।
ওর জন্যে চারদিন হোটেলটা বুক করেই রাখা ছিলো। পুরো পেমেন্ট করা আছে! একটু বিশ্রাম করে ফ্রেসট্রেস হয়ে সে বেরিয়ে পড়ল পড়ন্ত সন্ধ্যাতে। কাছ থেকেই ভেসে আসছে সমুদ্রের আয়েসী হাওয়া। তার সঙ্গে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে অয়নের স্বপ্ন। সিনেমাতে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন। দিয়ালিয়াতে আসা দুচার দল ট্যুরিষ্টদের আনাগোনা তার তেমন নজরে এলো না। তখন মাথায় ঘুরছে অভিনেত্রীর কণ্ঠস্বর, নীল আকাশের মতো ভেসে থাকা নায়িকার দুটো গভীর চোখ।
আকাশমহল? আকাশমহল?
একটা অটো রিক্সাকে ডাকতেই লোকাল ড্রাইভারটা একটু অবাক হলো! এই সন্ধ্যাবেলায় আকাশমহলে যাবে?
- ‘আকাশমহল? সে তো গ্রামের দিকে!ওখানে ফিলিম টিলিম যারা বানায় তারা বড়ো বড়ো গাড়ি নিয়ে যায়। অটোকে ওখানে ঢুকতে দেয় না।’
অয়ন লোকটাকে বোঝালো, ‘যেভাবেই হোক, আকাশমহল-এ এখন আমাকে যেতেই হবে।’
‘একটা কাজ করুন, আমি আপনাকে আকাশমহল-এর পেছনের দিকের গেটের বাইরে ছেড়ে আসতে পারি। ওখান থেকে সামান্য হেঁটে আকাশমহলে পৌঁছে যাবেন।’
দিয়ালিয়া অঞ্চলের পাকা রাস্তাটা ধরে কিছু দূর গিয়ে একটা গ্রামের মধ্যে তারা ঢুকলো। রাস্তার দুপাশে গাছপালা। অটোটা আরো কিছুটা এগোতেই অয়ন দেখলো, উজ্জ্বল একটা পরিসর আর একটা আলোকিত হাভেলি!

এটাই আকাশমহলের পেছন দিকটা। অয়নকে নামিয়ে দিয়ে আটোরিক্সাটা ফেরত চলে গেলো। ধারে কাছে জনমনুষ্যি নেই।
লোহার বিশাল গেট। কাছেই গার্ড-রুম। মনে হলো, সেখানেও কেউ নেই।

অয়ন গেটটা ঠেললো। ভীষণ ভারী। মনে হলো, ওটার লোহার কব্জাতেও জংধরা! গেটটা একচুলও নড়ছে না। সামনে আলোকিত আকাশমহলটা। কিন্তু ভেতরে সে কি করে যাবে? গেটটা যদি না খোলে? অয়ন ভাবছিল, একবার শ্রীদেবীকে ফোন করবে? ঠিক তখনই অন্ধকার ফুঁড়ে একজন গার্ড এসে হাজির।
অয়নকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে গার্ডটা দু’মিনিট ভেতরে কারো সাথে কথা বললো। তারপর সসম্ভ্রমে জানালো, -‘আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন। আপনি শ্রীদেবীর কাছে যাবেন। আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি। আসুন আমার সাথে।’

আকাশমহলের পেছন দিককার এই রাস্তাটা ঘাস, মাটি আর মোরামের। দুপাশে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। হাস্নুহানা আর রজনীগন্ধা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। আধো আলো-অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে, এই রাতেও রাস্তার দুধারে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে।
যেতে যেতে অয়ন গার্ডটাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনাদের আকাশমহলে এতো আলো। অথচ এখানে আসার এই রাস্তাটা এতো অন্ধকার কেন? আপনাদের গেটটা ভীষণ ভারী, আর মরচে ধরা! ওটাকে তো ঠেলে খোলাই কঠিন! এখানে লোকেরা আসে কি ভাবে?’
গার্ড বললো – ‘যারা আসবার, তারা ঠিকই আসে। আসলে এই দুনিয়ায় ভেতরে ঢোকবার কায়দাটা জানা থাকা চাই। আপনি যে গেটটা দিয়ে এসেছেন, ওটা পেছনের গেট। আকাশমহলের সামনে আরো তিন তিনটে গেট আছে।’
কিছুটা এগিয়ে যেতেই আলোকিত পরিসরটা বিস্তৃত হলো। দেখে মনে হলো আকাশমহলের পুরোনো স্থাপত্যটা তিন-চারশো বছরের পুরোণো।

কাছাকাছি আসতেই স্পষ্ট হলো ভেতর থেকে ভেসে আসা লোকজনদের কথাবার্তার আওয়াজ। সে তো পেছন থেকে ঢুকেছিল। এখন দেখলো আকাশমহলের প্রধান প্রবেশপথ, তার সামনে আলো ঝলমল পার্কিং-প্লেস। নামী দামী অনেকগুলো গাড়ী সারি সারি দাঁড়ানো।
গার্ডটা অয়নকে আকাশমহলের সিঁড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিল। বললো, ‘আপনি অভিনেত্রী শ্রীদেবীর সাথে দেখা করবেন তো? প্রথম ফ্লোরটা পারফরমেন্স-ফ্লোর, তার উপরে ক্যাপাসিটি-ফ্লোর। অ্যাচিভমেন্ট-ফ্লোরটা তিন তলায়। আপনি ওখানেই শ্রীদেবীকে পেয়ে যাবেন। তিনি আছেন রোমান্টিক-এক নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে’।

বখশিসের জন্যে হাত পাতলে অয়ন গার্ডটার হাতে একশোটা টাকা গুঁজে দিলো। অয়ন তার প্রিয় অভিনেত্রী শ্রীদেবীর কাছে যাচ্ছে। সে সিনেমাতে অভিনয় করবে। একটা গোপন আবেগ কিংবা ভীরুতা। তার বুকটা কাঁপছিল।

আকাশমহলের সিঁড়ি ধরে অয়ন উপরে উঠছে। অনেকটা পরিসর নিয়ে মহলের একতালাটা, ইংরেজীতে লেখা – ‘পারফর্মেন্স ফ্লোর’। জমজমাট গান বাজনার আওয়াজ! অয়নের নজরে এলো, কয়েকজন নর্তকী ও সিনেমার মানুষজন। তারা কিছু পারফর্ম করছে! ক্যামেরাম্যানেরা ফটো তুলছে। আশপাশে ঘোরা ঘুরি করছে বেশ কয়েকজন অল্প বয়েসী তরুণ তরুণী।
অয়ন সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো দোতালায়। ব্যালকনিতে লেখা- ‘ক্যাপাসিটি ফ্লোর’। সেটার ভেতরেও কেমন একটা ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী ব্যস্ততা!

তিনতলায় উঠতেই একটা সুগন্ধি ভেসে এলো। সামনে লেখা – ‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’। একটা বিশাল নন-ট্রান্সপারেন্ট কাঁচের দরোজা। বন্ধ দরোজা ঠেলে তাকে ভিতরে ঢুকতে হবে?
সুইং-ডোরের কাচের দরোজাটা সামান্য ঠ্যালা দিতেই সেটা খুলে গেলো। ‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’এর তিনতালাটা হোটেল আর অডিটোরিয়ামের সমন্বয়। এখানে কোথায় এক নম্বর রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্টটা? একটু সময় নিয়ে সে দেখলো, হলঘরের একপাশে কতগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। হোটেলের মতো। ভিআইপি গেষ্ট বা নায়ক নায়িকাদের বিশ্রামের জন্যে? পাশেই চওড়া অডিটোরিয়াম, একটা স্টেজ। যেন কোন দামী উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলন কক্ষ। সারিবদ্ধ অনেকগুলো সৌখীন সোফা ও সেন্টার টেবিল। কিন্তু এখন কোনো লোকজন নেই।

পাশাপাশি চারটে ঘর। অ্যাপার্টমেন্টগুলোর নামও কেমন অদ্ভুত! রোমান্টিক – এক, দুই, তিন, চার! ‘রোমান্টিক – এক’ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই একজন পরিচারিকা বেরিয়ে এলো। সে হেসে তাকে অভ্যর্থনা করলো – ‘অয়নকুমার? আসুন, ভেতরে আসুন।’
অ্যাপার্টমেন্টটাতে একটা রুমের ভেতরে আরেকটা প্রাইভেট রুম। পরিচারিকাটি তাকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেল। অয়ন দেখল, তার স্বপ্নের নায়িকা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে।
শ্রীদেবীই হাত নেড়ে তাকে ডাকলো - ‘এসো অয়ন, এসো, এসো।’
সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্ট। রুমে মুখোমুখি দুটো সোফা, একটাতে অয়নকে বসতে বললো। অন্যটাতে শ্রীদেবী মুখোমুখি বসলো। তার অভিনেত্রী সত্যিই সুন্দরী, গোলগাল মুখ। পরিপাটি করে বাঁধা চুল। যেন কত যুগের চেনা!

একটা আনন্দ, একটা বিস্ময় নিয়ে অয়ন মাথা নীচু করে বসে রইলো।
শ্রীদেবী নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বললো, ‘হাই অয়ন, তোমার জন্যেই ওয়েট করছিলাম। তোমাকে এখানে পেয়ে রিয়েলি ফিলিং ফ্যান্টাসটিক!’
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম! এই ইনভাইটেশনটা পেয়ে আমারও খুব ভালো লাগছে! কখনো ভাবি নি, এমন একটা আশ্চর্য জায়গায় আপনার সাথে দেখা হবে!’

শ্রীদেবী দুচোখ তুলে অয়নের দিকে তাকিয়ে রইলো। - ‘আজকে সারাদিন স্যুটিং ছিল। ডিরেক্টর অনিল মেহেতা কোলকাতায় ফিরে গেছে। কালকে আবার আসবে। কালকেই ফ্লিম দুনিয়ার মানুষদের এখানে একটা গেট -টুগেদার আছে। তখন ডিরেক্টর মেহেতার সাথে তোমাকে ইন্ট্রো করিয়ে দেবো। এসো, তোমার ব্রাইট-ফিউচারের নামে আজকে রাতটা আমরা সেলিব্রেট করি!’

টেবিলে রাখা একটা ঘণ্টা টিপে দিতেই বন্ধ রুমের দরোজা ঠেলে সেই পরিচারিকাটি ঢুকলো।
‘দু গ্লাস চিলড বিয়ার, স্ন্যাকস। দু প্লেট ডিনারও রেডি রাখো। যখন বলবো, তখনই সার্ভ করবে।’
নির্জন একটা রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্ট। শ্রীদেবী অয়নের খুব কাছে, মুখোমুখি! অয়ন তার প্রিয় নায়িকার শরীরে সেন্টের মাদক গন্ধ পাচ্ছে!
‘তুমি কি সিনেমাতে আমার সাথে মেইন ক্যারেক্টারে অভিনয় করতে রাজী আছো?’
অয়নের সসম্ভ্রম উত্তর – ‘ডিরেক্টর আর আপনি চাইলে চেষ্টা করতে পারি!’
‘ডিরেক্টরের হাতে একটা সিনেমা আছে, যার জন্যে আমার কাছে অফার আছে। যার স্ক্রিপ্টটা এরকম, নায়িকা একজন দেহব্যবসায়ী, মানে প্রস! আর নায়ক একজন সাইনটিষ্ট। এর জন্যে ভাল একজন অ্যাকটর খোঁজা হচ্ছে। তুমি রাজি?’
অয়ন কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারলো না!

বড়ো মোহময় রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্ট। নানা কথায় কথায় দুজনের বেশ কিছুটা সময় কাটলো।
গল্প করতে করতে শ্রীদেবী অয়নের খুব কাছে এসে বসলো। তার পলকহীন চোখ বাইশ বছরের এক যুবকের দিকে! অভিনেত্রী অয়নের হাতটা ধরলো। তাকে বুকের কাছে টেনে নিলো। অয়ন অনুভব করলো, একজোরা নরম স্তনের স্পর্শ, গোলাপের সুগন্ধ!

প্রিয় নায়িকার দুটো ঠোঁট তার ঠোঁটে। শ্রীদেবী অয়নকুমারকে চুমু খেলো।
‘জানো অয়ন। তোমাকে দেখার পর, কেন জানি না! মনে মনে তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি! লোকেরা বলে, তারা নাকি শ্রীদেবীর সিনেমা দেখে খুব সহজে প্রেমে পড়ে যায়। আমার কিন্তু সবার মতো যখন তখন প্রেম আসে না। তুমিই কিন্তু একসেপশন! সত্যি বলছি অয়ন, ‘শকুন্তলম’-এ তোমার অভিনয় দেখার পর থেকে আমি ধীরে ধীরে তোমার জন্যে কেমন ইনফ্যাচুয়েটেড হয়ে পড়েছি! আমি তো অভিনেত্রী, টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি এসব কোন কিছুই আমার কম নেই। কিন্তু এ পর্যন্ত আমার আর কোন সংসার করা হলো না! আমি যে ভালোবাসার কাঙাল!’
সেই নির্জন রাতের বেশ অনেকটা সময় দুজনের! বড়ো একান্ত আর অন্তরঙ্গ সে সময়! তখন রাত প্রায় দুটো। শ্রীদেবী অয়নকে বললো, - ‘কালকে আর পরশু। এ দুদিনই তুমি আজকের মতো সময়ে, রাত আটটাতে এখানে আসবে! প্রমিস!’
- ‘প্রমিস!’

অভিনেত্রীর পরিচারিকাটি অয়নকে কার স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিলো। আকাশমহলেরই একজন ড্রাইভার গাড়িতে করে অয়নকে দিয়ালিয়াতে পৌঁছে দিলো।

দিয়ালিয়ার হোটেলে তার নিজস্ব রুম। শ্রীদেবী ওর শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অয়ন টের পেলো তার সারা শরীরটা ভীষণ উত্তপ্ত। অনুভূতিতে তখনো তার প্রিয় অভিনেত্রীর গোলাপী গন্ধটা। বাকী রাতটুকু অয়নের টুকরো টাকরা ঘুম হলো। বিছানায় তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল একজন মহিলা। মিসেস শ্রীদেবী ব্যানার্জী – নায়িকা, যার বয়েস চল্লিশ বা বিয়াল্লিশ – কোলকাতার একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী!

পরের দিন সন্ধ্যায় অয়ন অটো ধরে সময়মতোই আকাশমহলে পৌঁছে গেল। পেছন দিকটাতে। গতকালের সেই পরিচিত গেটে। সে দেখলো, সেই গার্ডটাই আজও হাজির আছে। গার্ডের অপেক্ষা না করে অয়ন আজ জঙ-ধরা গেটটাকে ঠ্যালা দিল। ভারী লোহার গেটের পাল্লাদুটো সহজেই খুলে গেলো। প্রচন্ড ভারী গেটটাকে দ্বিতীয়দিনে তেমন ভারী মনে হলো না। গত একদিনের অভিজ্ঞতাতেই লোহার ব্যারিকেডটা তার কাছে অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে!

গার্ড – ‘আপনি তো গতকালও এসেছিলেন। অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরে যাবেন তো? যান যান, ভেতরে যান’।
আকাশমহলের দিকে অয়নকুমার এগিয়ে গেলো। আজকে সে আবার নজর দিয়ে ভালো করে দেখলো মহলটাকে। বাইরে থেকে কাঠামোটাকে দেখলে মনে হবে রাজস্থানের দেখা কোন পরিত্যক্ত বিশাল রাজমহল। মহলের পুরোনো আদলটা বজায় রেখে ভেতরটাকে অত্যন্ত আধুনিক ভাবে সংস্কার করা হয়েছে। আজকে সন্ধ্যায় মহলটা কিন্তু গতকালের চাইতে অনেক বেশী জমজমাট লাগছে! তিন-তিনটে তলাই আলোয় আলোয় ভাসছে।

আলোকিত মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। প্রথম দিনের মতো অয়ন এগিয়ে যেতে লাগলো ওর প্রিয় অভিনেত্রী আর আকাঙ্খিত অভিনয়ের দুনিয়ার দিকে। তার গন্তব্য আকাশমহলের তিনতালায় – অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরে।

একতালার পারফর্মেন্স ফ্লোর, দোতালায় ক্যাপাসিটি ফ্লোর পেরিয়ে সিঁড়িতে পা মেপে মেপে অয়ন তিন তলার অ্যাচিভমেন্ট-ফ্লোরে পৌঁছালো।

তিনতলাটা আজ গতকালের মতো নির্জন নয়, খুব জমজমাট! ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের অ্যাচিভমেন্ট-ফ্লোর এর প্রবেশদ্বার। হালকা করে ভেজানো কাঁচের দরজাটা। ভেতরে শোনা যাচ্ছে নারী আর পুরুষদের কথাবার্তা।

সুইং ডোর ঠেলে অয়ন ভেতরে ঢুকলো। অনেক মানুষ – সমৃদ্ধ সব চেহারা। প্রায় সমস্ত অডিটোরিয়াম জুড়ে মুখোমুখি সারিবদ্ধ অনেকগুলো সোফা। দুটো সোফার মাঝে সেণ্টার টেবিল। সুন্দর করে সাজানো। অনেক নারী পুরুষের মুখ। তারা কি সবাই সিনেমার লোক? অভিনেতা অভিনেত্রী?
গতকালের ‘রোমান্টিক – এক’ অ্যাপার্টমেন্টের দরোজাটা আজ বাইরে থেকে বন্ধ। তা হলে তার অভিনেত্রী শ্রীদেবী এখন কোথায়?

একেকটা সোফায় একেকজন নায়িকা বসে আছে। তার বিপরীতে মুখোমুখি এক এক জন নায়ক! ওরাও কি সবাই অভিনেতা? নাকি বিখ্যাত সব মানুষজন, নাকি কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট? ওদের মধ্যে হয়তো নির্দেশক আর প্রোডিউসাররাও আছে! ওই ভীড়ের মধ্যে অয়ন তার প্রিয় অভিনেত্রীকে খুঁজতে লাগলো। বিশাল হলঘরটার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সে কয়েকবার হাঁটলো। সমস্ত পুরুষ-মহিলারা একজন আরেক জনের সাথে গল্প করছে। দু’একজন সোফায় বসে নিজের নিজের মোবাইল দেখছে। এটাই তাহলে ফ্লিম দুনিয়ার মানুষদের গেট -টুগেদার, যার কথা শ্রীদেবী বলেছিলো।
মিলন সম্মেলন? না কি একজন পুরুষ আরেক জন মহিলাকে নিয়ে এখানে সময় কাটাতে এসেছে? সে কি ভুল সময়ে এখানে এসে পৌঁছেছে? না, গতকাল শ্রীদেবী ডিরেক্টরের সাথে দেখা করানোর জন্যে তাকে এমন সময়তেই আসতে বলেছিলো!

অয়ন শ্রীদেবীকে অনেক খুঁজলো। প্রায় সমস্ত মহিলাদের দিকে চুপিচুপি নজর বোলালো। কিন্তু সে কই? তার মনে হলো, শ্রীদেবী অন্য কোন নায়িকার মুখোশে আত্মগোপন করে আছে! গতরাতে যে প্রিয় অভিনেত্রীর সাথে অয়ন অনেকটা সময় একসাথে কাটিয়েছে, আজ সে কোথায়?
ওখানে যারা উপস্থিত ছিল, তারাও অয়নকে দেখছিল। কিন্তু বিশেষ পাত্তা দিলো না। তারা ভাবলো লোকটা হয়তো ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির কেউ, কিংবা আকাশমহলের কোনো যুবক-কর্মচারীও হতে পারে!
শ্রীদেবীকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ পরে অয়ন আকাশমহলের তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে সটান নেমে এলো নীচে। গাড়ীর পার্কিং-এর সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনতলার দিকে মুখ রেখে অয়ন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। পরপর কয়েকটা কল করলো, শ্রীদেবীর নাম্বারে। রিং বেজেই চল্লো, কিন্তু কোন উত্তর এলো না।

ক্ষোভে অভিমানে কেমিস্ট্রির একটা কঠিন কম্পাউন্ডের নাম ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। কথাগুলো শোনালো কোনো গালি কিংবা একটা পাগলের প্রলাপের মতো।
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একজনের গাড়িতে লিফট নিয়ে সে ফিরে এলো নিজের হোটেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দ্বিতীয় রাতে নায়িকার সাথে তার আর কোন যোগাযোগই হলো না। প্রথম রাতের নায়িকার ঠোঁটের চুমু তার ঠোঁটে লেগেই ছিল! কিন্তু কি হবে তার সিনেমা জগতের আগামী ভবিতব্য? ডিরেক্টারের সাথে তার আজ আর দেখা হলো না!

দিয়ালিয়ার হোটেলে তৃতীয় দিনের সকাল। অয়নের তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। চোখে মুখে অনিদ্রা জনিত ক্লান্তি। হোটেল ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় রাস্তায় ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরলো। অয়ন ভুলে গেলো, সে কোলকাতা ইউনিভার্সিটির পিএইচডির স্টুডেন্ট।
অয়নকে চলচ্চিত্র জগতের নায়ক হতেই হবে। এখন সে কেমিস্ট্রির ছাত্র নয়, ইউনিভার্সিটির কোন ট্যালেন্টেড যুবক নয়! গ্রুপ থিয়েটারের কোন উদীয়মান অভিনেতা নয়! সে এখন নায়ক অয়নকুমার। শ্রীদেবীর সাথে সে বড়ো পর্দায় অভিনয় করবে! এ জন্যে তাকে টলিউডের একজন ভালো অভিনেতা হতেই হবে।

পথচলতি একটা ব্যাঙ্কে ঢুকে সে দেখে নিতে থাকলো, একজন ম্যানেজার ক্যামন করে রিভলভিং চেয়ারে বসে তার সামনে বসা অধস্তন কোনো কর্মীকে ধমকায়। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে সে দেখলো, একটা রিক্সায়ালা প্যাডেল মারতে মারতে কি করে তার গায়ের ঘাম মোছে। বাসস্ট্যান্ডের একটা বেঞ্চে বসে সে রিক্সায়ালার দু’পা-চালানো আর গামছা দিয়ে ঘাম মোছাটাকে নকল করলো। অয়ন পথচলতি লোকজনদের মুভমেন্টগুলো মন দিয়ে দেখতে লাগলো। সে নকল করার চেষ্টা করলো, কি করে একটা কুলী একসঙ্গে দুটো স্যুটকেস মাথায় চাপিয়ে বা-হাতে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বাসস্ট্যান্ডের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যায়। তাকে আরো দুর্দান্ত অভিনয় করতে হবে। তাকে শ্রীদেবীর যোগ্য নায়ক হয়ে উঠতে হবে।

সেদিন, মানে তৃতীয় দিনের বিকেল। হোটেলে ফিরে অয়ন নিজেকে সুসজ্জিত করলো। গায়ে সেন্ট, পায়ে জুতো, সুন্দর শার্ট প্যান্ট। সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লো আকাশমহলের দিকে। শ্রীদেবীর তাকে বলেছিল পরপর তিনদিন, প্রত্যেকদিনই সন্ধ্যা আটটা নাগাদ আকাশমহলে আসতে। গতকাল শ্রীদেবীর সাথে দেখা হয় নি তো কি হয়েছে? আজ নিশ্চয়ই তার সাথে অয়নের দেখা হবে! তারা দুজন কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটাবে! একজন আরেক জনকে মনের কথা খুলে বলবে। শ্রীদেবী বলেছিলো, তাদের নতুন সিনেমা ডিরেক্টর মিস্টার রুংতার সাথে অয়নকে ইন্ট্রো করিয়ে দেবে।
অটো নয়, তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় অয়ন শহরের একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিলো। আজকে আর অন্ধকার পেছনের গেট নয়, আলো-ঝলমল সামনের গেট দিয়ে সে আকাশমহলে ঢুকলো। দু’কদম এগোতেই মহলের মার্বেল পাথরের সিঁড়ি।
কটা নায়কোচিত ভঙ্গীতে তেতালায় উঠতে যাবার আগে অয়ন ভাবলো। আজ একতালা আর দোতালাটা ভালো করে ঘুরে দেখা যাক।

একতালা। পারফরমেন্স ফ্লোর। সেখানে চলছিল গান বাজনা, সঙ্গীত, অ্যাক্টিং-অভিনয়, ফটোগ্রাফি, ক্যামেরার কারিকুকি। সবাই নিজের নিজের পারফর্মেন্স দেখাচ্ছে। অয়নকে কি এখানে তার পারফরমেন্স দেখাতে হবে? তার অভিনেত্রী শ্রীদেবী তো শকুন্তলম-এ তার পারফর্মেন্স দেখেই তাকে আকাশমহলে ডেকেছে!

পারফরমেন্স ফ্লোরে মকবুল ফিদা হোসেনের মতো দেখতে একজন লোক তাকে জিজ্ঞেস করলো আপনার কোয়ালিফিকেশন আর স্পেশালাইজেশন কি? আপনার চেহারাটা তো নায়কের মতো। কিন্ত আজকাল ফ্লিমে চান্স পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?
অয়ন একটু হাসলো। মুখে কিছু বলতে পারলো না।

পারফরমেন্স ফ্লোর ছাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে এলো দোতলায়। আজকে এই ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে অয়ন সবকিছু ভালো করে দেখতে লাগলো। এর নাম- ক্যাপাসিটি ফ্লোর। ক্যাপাসিটি মানে ফাইনানন্সিং, ব্যাঙ্কিং, ইনভেস্টমেন্টএর নানা অফিস। পয়সায়ালা লোকজন ঘোরাঘুরি করছে! তারা কেউ অয়নের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত না। অয়নের বাবার তো শিলিগুড়িতে ছোট্ট একটা চায়ের ব্যবসা! কিছু মানুষ বুঝে গেল, অয়নের পকেটে খরচা করার মতো বেশী টাকা পয়সা নেই। তখন লোকগুলো তার ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখালো না। ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত একজন তো তাকে বলেই দিল - ভাই, তুমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছো। এই জায়গাটা, মানে, এই আকাশমহল তোমার জন্যে ঠিক উপযুক্ত না। তুমি কি করো? তোমার বাবার কত সম্পত্তি? তিনি কি তোমার খরচাপত্তর টানতে পারবেন?

লোকটার এরকম ফালতু কথায় অয়ন কিছুটা বিব্রত হলো। ক্যাপাসিটি ফ্লোর থেকে সে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি ভেঙ্গে অয়ন পা বাড়ালো তিন তলার দিকে।
অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর। আগের দুদিনের মতোই পরিচিত ঘসা-কাচের দরোজাটা। কিন্তু আজকের তিন তলাটা বড়ো বেশী মিইয়ে পড়া, নির্জন নিঃশব্দ! দেখলো, দরোজার বাইরে সাজানো ফুলগুলো নেতিয়ে আছে।

অয়ন ভাবছে – তার অভিনেত্রী নিশ্চয়ই একলা একলা রোমান্টিক অ্যাপার্টমেন্টে অপেক্ষা করছে। সত্যিই কি শ্রীদেবী তার জন্যে ইনফ্যাচুয়েটেড? যদি দেখা হয়, তাকে মুখ খুলে আজকে বলতেই হবে - ‘শ্রীদেবী, আমি সিরিয়াসলি তোমার সাথে থাকতে চাই, তোমার সাথে নায়কের ভূমিকায় অ্যাক্টিং করতে চাই’! সত্যিই কি শ্রীদেবী তাকে নায়কের ভূমিকায় নেবে? চল্লিশ বছর বয়েসী এই অভিনেত্রী কি সত্যি সত্যি তাকে ভালোবাসে? নাকি অয়ন নিজেই শ্রীদেবীর জন্যে ইনফ্যাচুয়েটেড?

সুইংডোর ঠেলে আগের দু’দিনের মতোই সে অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরের ভেতরে ঢুকলো। বিশাল হলঘরটাতে আজ এখন একরাশ নির্জনতা। বন্ধ ঘরের মধ্যে আটকে থাকা সেন্ট আর বাসিফুলের গন্ধ। এলো মেলো অনেকগুলো সোফা, সেন্টার টেবিল, পরিত্যক্ত কিছু কসমেটিক সামগ্রী। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুলের মালা আর বাসি রজনীগন্ধার তোড়া।

এখানকার সবগুলো রোমান্টিক অ্যাপার্মেন্ট বাইরে থেকে বন্ধ! শ্রীদেবীর অ্যাপার্টমেন্ট রোমান্টিক-এক ঘরটা, গত পরশুর নিশিযাপনের গোলাপী স্মৃতি, যার ভেতরে! সেটারও বাইরে থেকে তালা ঝুলছে।
তাকে অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোরে অপেক্ষায় রেখে সবাই কি যে যার মতো ফিরে গেছে?
তার জন্যে শ্রীদেবী আজকেও নেই। অথচ তার অভিনেত্রী বার বার প্রমিস করিয়েছিল, পর পর তিন দিনই তাকে আসতে হবে। রাত আটটায়, আকাশমহলের অ্যাপার্টমেন্টে! অথচ তার নায়িকা শ্রীদেবীরই কোন পাত্তা নেই!

নিঃশব্দে মার্বেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো সে। কার পার্কিং-এর সামনে, লনটায় দাঁড়ালো। অয়ন দেখলো, তিনতলার ‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’টা খুব ম্লান, সামান্য আলোকিত। তার উপরেও একটা আবছায়া স্ট্রাকচার আছে।
‘অ্যাচিভমেন্ট ফ্লোর’এর তিনতালার উপরে যে একটা চারতালা আছে গতদুদিন অয়ন তা খেয়াল করে নি! ওখানে কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশমহলের উপরতালাটা আগে তার নজরে আসে নি কেন? কল্পনাতে পরিপূর্ণ যে কোনো আকাশমহল, তার উপরতলটা কি স্বপ্নভঙ্গের মতোই সবসময়েই এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে?

হঠাৎ অয়নের মনে হলো তার বান্ধবী, একাডেমীর থিয়েটারের শকুন্তলা, তার কলেজের থার্ড ইয়ারের মল্লিকা, আকাশমহলের অন্ধকারাচ্ছন্ন চারতালার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে! সে দুষ্মন্তকে গুডবাই দিচ্ছে! মল্লিকা কি করে জানলো আকাশমহল আর শ্রীদেবীর কথা?
অয়নের সাথে শ্রীদেবীর কি আর কখনোই দেখা হবে না?

আলোকিত আকাশমহলের একতালা-দোতালা থেকে থেকে ছিটকে পড়ছে হাল্কা আলোর রশ্মি। সেই হতাশ আলোয় দাঁড়িয়ে মোবাইল স্ক্রিনে অয়ন শ্রীদেবীর নামটা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তার নামটা এখন আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। কন্টাক্ট-নাম্বার আর সেভ করা শ্রীদেবীর ছবিটা অয়নের মোবাইল থেকে কিভাবে যেন নিজে নিজেই ডিলিট হয়ে গেছে!