গল্প - চন্দন মিত্র
Posted in গল্পওড়িশার পিপিলি ব্লকের বেশ কিছু গ্রামের মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন দূরবর্তী আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বা ভিন্ন কোনো আশ্রয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে আপনারা অনেকেই ঘটনাটি জেনে ফেলেছেন। পিপিলি ব্লকের মানুষগুলি যে কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন, তা জেনে আপনারা অনেকেই আশ্চর্য হয়ে ভেবে নিয়েছেন— ফেক নিউজ হবে বোধহয়। কিন্তু বিষয়টা মোটেও বানোয়াট নয়, কারণ এহেন খবর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়ক ভূমিকা রাখার মতো তেজস্ক্রিয় নয়। সামান্য বুনো পিঁপড়েদের দলে দলে গ্রাম ঘিরে ফেলার ফলশ্রুতিতে এই অভূতপূর্ব অঘটনটি ঘটেছে। কামাখ্যাফেরত বাঘা বাঘা তান্ত্রিকের মারণ-উচাটন, গ্রামগুলির চৌহদ্দিতে আগুন জ্বালিয়ে রাখা, গ্রামের বাইরে পিঁপড়েদের পঙক্তিভোজনের ব্যবস্থা করা, সরকারি তরফে কীটনাশকবর্ষণ ইত্যাদি কোনো পদ্ধতিই সুফলদায়ী হয়ে ওঠেনি। ভাবুন একবার, তুচ্ছ পিঁপড়ের ভয়ে মানুষ গৃহ-গৃহসামগ্রী-তৈজসপত্রাদি ত্যাগ করে এককাপড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। একে ঘোর কলিকাল বা মহাপ্রলয় বা রোজ কেয়ামতের সংশয়াতীত ইশারা ছাড়া আর কীই বা বলবেন ! আপনি যদি গ্রামের মানুষ হন, তাহলে সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে শুধিয়ে দেখুন,,তিনি বলবেন কস্মিনকালেও এমন ঘটনার কথা শোনেননি। ভাবুন, নগণ্য পিঁপড়ের অভিযানে যদি এমন অবস্থা হয়, সুচতুর হায়েনার হামলা হলে তাহলে কী ঘটত !
ভাবছেন, আমি পিঁপড়ের কিসসা শুরু করে ধান ভানতে শিবের গীতের মতো অকস্মাৎ কেন হায়েনার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়লাম ! আসলে পিপিলির পিপীলিকা দঙ্গলের মনুষ্য-বিতাড়নের অনুষঙ্গে যূথবদ্ধ হায়েনার তাড়নায় বাস্তুচ্যুত মানুষের কচুরিপানার মতো ভেসে চলার একটি কিসসা মাথায় এসে গেল যে। এই যে কচুরিপানার কথা বললাম, জানেন তো কচুরিপানাও আদতে ছিন্নমূল; তিনি এসেছেন আমাজনের অগম জলের স্মৃতি বুকে নিয়ে। এসেছেন বললে ভুল হবে, আনীত হয়েছেন। প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা; তখন বাংলায় চলছে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন। জনৈক স্কটিশ নাগরিক জর্জ মর্গান, পাটের ব্যবসা করতে এলেন মদীয় দেশে। তিনি ঘোর সবুজ পাতার মায়াবী গড়ন আর তার অবর্ণনীয় রঙের সুবিন্যস্ত পুষ্পমঞ্জরীর মোহে এমন মোহিত ছিলেন যে, তাঁকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারেননি। জাহাজে ওঠার আগে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সযত্নে ঝোলায় ভরে ফেলেছিলেন। মর্গানসাহেব থিতু হয়েছিলেন বঙ্গীয় এক বাগানবাটিতে; তাঁর উদ্যানের পরিখায় ডানা মেলা প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়াতেন সেই বহুবংশবিস্তারী সপুষ্প সুন্দরী। কালক্রমে তাঁর সন্তানসন্ততিরা বাংলার জলায় জলায় ভাগ্যান্বেষণে ভেসে পড়েছিলেন। আজও তাঁদের যাত্রা অপ্রতিরোধ্য। হয়তো তাঁদের কেউ কেউ বাউল-ভাটিয়ালিমাখা শরীর নিয়ে পৌঁছে গেছেন আমাজনের গহীনে। বস্তুত, পরিযান হল জীবের নিয়তি; তা স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্যতামূলক। পিপলির মানুষগুলো যদি না তাঁদের বাস্তুভিটে উদ্ধার করতে পারেন, তাঁদেরও খুঁজতে হবে নতুন বাসভূমি; তবে জন্মভিটের সুগন্ধ যে তাঁদের আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াবে, সে বিষয়ে সন্দেহ না-রাখাই ভালো।
পিপলির মানুষগুলোর আয়ুরেখা বোধহয় দীর্ঘ ও গভীর এবং বৃহস্পতিও হয়তো তুঙ্গে, তাই তাঁরা হন্যমান হায়েনার কবলে পড়েননি। নগণ্য বুনো পিঁপড়ের সঙ্গে হায়েনার তুলনাই হয় না। হায়েনার কথা আপনাদের নতুন করে কী আর বলব, তাদের সম্পর্কে আপনারা প্রায় সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল। তবে জেনে অবাক হবেন যে, হায়েনারা বিশ বা বাইশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে। তখনও পৃথিবীতে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স প্রজাতিটি জন্মায়নি। ফলে তাদের রক্ষাকর্তা হিসাবে তখনও ইশ্বর–আল্লা-গড প্রভৃতি ভূমিষ্ঠই হননি। কোনোরকম অতিলৌকিক আশীর্বাদ ছাড়া, কেবল দলবদ্ধতা এবং সুতীক্ষ্ণ দাঁত-নখ ও নিখাদ হিংস্রতায় পরিপূর্ণ জন্মান্ধ মননের গুণে হায়েনারা এই একবিংশ শতাব্দীতেও ধরণীর প্রাণদায়ী ভূমিতে সমানে দন্তবিকীর্ণ করে চলেছে। আর একটি আশ্চর্য তথ্য এই যে, প্রাণিকুলের মধ্যে সম্ভবত মানুষ ছাড়া কেবল এই হায়েনারাই হাসতে পারে। হ্যাঁ নিছক হাসতেই পারে, অন্যকে ছিন্নভিন্ন করে তার আত্মানাশ করার মুহূর্তেও। যদি তারা কাঁদতে পারত, সেটাও খুব একটা সুবিধের হত না শিকারের পক্ষে। কারণ কেউ হাসতে হাসতে তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে এ দৃশ্য সহ্য করা সহজ হলেও, কেউ কাঁদতে কাঁদতে তার কলজে উপড়ে নিচ্ছে এটা যথেষ্ট চাপের হত গোবেচারা শিকারের কাছে।
হায়েনা কবলিত ভূভাগ কতটা বীভৎস, কতটা শ্বাসরুদ্ধকর, কতটা অপমানের, কতটা অনিশ্চয়তার, অনভিজ্ঞের কাছে সে অভিজ্ঞতা চিরকাল অধরাই থেকে যাবে। আপনারা যাঁরা জন্মসূত্রে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ভূখণ্ডে বাস করেন, হায়েনার সঙ্গে সহবাস করা দূরের কথা, কোনোদিন হায়নার সমবেত দন্তঘর্ষণের উচ্চকিত কিচিকিচি শীৎকার কর্ণকুহরে নেননি, ঘ্রাণে নেননি তাদের বিবমিষা উদ্রেককারী ঐতিহ্যবাহী বদগন্ধ, তাঁরা হায়েনাহতদের আত্মার রক্তক্ষরণের বিমর্ষ সংগীতের রাগিণী সম্পর্কে চিরকাল অনবগত থেকে যাবেন। অবশ্য সেটাকে আশীর্বাদ হিসাবেই আপনাদের নেওয়া উচিত এবং আপনাদের নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিকর্ত্রীর প্রতি এইজন্য নতজানু হওয়া উচিত যে, তাঁরা আপনাদের সৃজনের জন্য এক সুরক্ষিত স্থানই নির্বাচন করেছিলেন। দান্তের ইনফার্নো থেকে শুরু করে বিবিধ কিসিমের ধর্মশাস্ত্রে যে নরক নামের পূতিগন্ধময় কল্পস্থানের বর্ণনা আছে, তা বোধহয় হায়েনাকবলিত ভূমির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত স্মৃতিচারণ। আমাদের গৌরচন্দ্রিকা বা মুখবন্ধ যেহেতু এখানেই থেমে যেতে চাচ্ছে, সেহেতু আমরা এখন আমাদের কিসসার চলার পথটি উন্মুক্ত করে দেব। এতক্ষণ যে বাক্যসম্ভার উপস্থাপিত হল, বস্তুত তা নিছক ভণিতামাত্র নয়; আশা করি এতক্ষণে আপনারা তা অনুমান করতে পেরেছেন।
আদতে আমাদের এই ভূভাগের কোথাও নিখাদ হায়না অধ্যুষিত দেশ নেই। যে-কোনো দেশই যে-কোনো মুহূর্তে হায়েনার নখেদাঁতে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তেমনই একটি মুমূর্ষুপ্রায় দেশের পটভূমিতে আমি কিসসাটি বুনতে চলেছি। কিসসার অন্দরমহলে ঢুকে দৈবাৎ যদি আপনাদের মননে সাদৃশ্যবশত কোনো বাস্তবিক স্থানকাল ইত্যাদির ভূত উঁকি মারে, তা নেহাতই কাকতালীয়। আপনারা এমন এক নদীমাতৃক দেশের কথা কল্পনা করুন, যেখানে মাটি নদীর স্নেহময় সান্নিধ্যে উর্বর; যেখানে গৃহস্থকে নিশ্চিন্তে রাখে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ। সে দেশে এক প্রসন্ন গৃহস্থবাড়িতে ছিল পিতা-মাতা, তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যা। বুনিয়াদি শিক্ষানিকেতনের পণ্ডিতমশাই পিতৃদেব যখন ইহলীলা সংবরণ করলেন, কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীটিও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৌঁছে গেলেন সাধনোচিত ধামে। বিশ্ববিদ্যানিকেতনে পাঠরত জ্যেষ্ঠপুত্রটি বিপন্নের মতো সেই ঝটিকাপ্রবাহে সংসারনৌকার হালটি প্রাণপণে ধারণ করলেন। ‘বড়ো গাছেই ঝড় লাগে’, প্রবাদটি আপনারা শুনে থাকবেন আশা করি। জ্যেষ্ঠবৃক্ষটি মস্তকে সমূহ ঝটিকাবেগ ধারণ করে রক্ষা করলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও ভগিনীকে।
ইতোমধ্যে ইতিহাসের অনেকগুলি প্রসঙ্গ আমার মাথার ভিতরে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছেন, তাঁদের দাবি এই কিসসায় তাদেরও স্থান দিতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী ইতিহাসে এত সালতামামি, এত রাজরাজড়াদের চরিতকথা যে সেগুলি মুখস্থ করা ছাড়া উপায় থাকে না। আমি আবার ওই বিদ্যায় নিতান্ত অপারগ। তাই একটা অজুহাত খাড়া করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের বললাম, হে আমার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অবস্থানরত প্রিয় ভাই ও বোনেরা আপনাদের আবদারে যথেষ্ট যুক্তি থাকা সত্ত্বেও এই স্বকপোলকল্পিত কিসসার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আমি আপনাদের যথাযোগ্য সমাদর জানাতে পারছি না, এজন্য আমি দুঃখিত। তাঁরা কী বুঝলেন জানি না, শেষমেশ আমাকে সানন্দে নিস্তার দিয়ে বাধিত করলেন। ঐতিহাসিক দায়ভার এড়াতে পেরে আমার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে গেল। দেখুন এবার আমার চিন্তাতরঙ্গের মাথায় লাফাতে লাফাতে কেমন তরতরিয়ে এগিয়ে যায় কিসসার সাম্পান।
জ্যেষ্ঠপুত্রটি আইনের বদান্যতায়, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছায় এবং কনিষ্ঠভ্রাতার যারপরনাই উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত যোগ্যতা না-থাকায় পিতার চাকরিতে বহাল হলেন। হাসিমুখে তিনি সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিলেন। কনিষ্ঠভ্রাতাটি অক্ষরভীতু, আকাট ও আদ্যোপান্ত বয়ে যাওয়া বখাটে ছেলে; কিন্তু যথেষ্ট হিসাবি। পিতার চাকুরিটি যখন হাতছাড়া হল, সে জমিজমা, ফলের বাগান, মাছের পুকুর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেখভাল শুরু করে দিল। কয়েক বছর যেতে-না-যেতে সে বিয়ে করে আনল তার পছন্দের এক পাত্রীকে। কালক্রমে তার সংসার দুই শিশুপুত্রের কলরোলে মুখরিত হয়ে উঠল। এদিকে উচ্চবিদ্যালয়ে পাঠরতা বোনটিও স্থানিক ও কালিক বিচারে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে ততদিনে। ক্রমে অকৃতদার জ্যেষ্ঠভ্রাতার চোখে উঠল চশমা, পাক ধরল চুলে। আত্মপরের ভেদজ্ঞানরহিত, সহজসরল, সৎ ও পরোপকারী মানুষটি পিতার মতো ‘পণ্ডিতমশাই’ আখ্যা পেয়ে গেলেন আপামরের কাছে। এভাবেই চলছিল দিনকাল, অতঃপর ঘনিয়ে এল মানুষের সর্বনাশ ও হায়েনাদের পউষমাসের কালো অধ্যায়ের করুণ দিনাবলি।
কানাঘুষো চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরে, হায়েনাদের দল নাকি মানুষের মহল্লায় হানা দেওয়ার ছক সাজাচ্ছে। কিন্তু উদারমতি জ্যেষ্ঠভ্রাতা বিশ্বাস করতে চাননি, সেসব আতঙ্ক-খচিত অযাচিত কথামালাকে। কনিষ্ঠটির কান ছিল সজাগ, সে নিজেকে এবং স্ত্রীপুত্রকে আড়াল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল গোপনে গোপনে। তাহলে আমাদের কিসসায় অরক্ষিত থাকল দুই জন, জ্যেষ্ঠভ্রাতা ও অনূঢ়া ভগিনি; বাস্তবে কয়েক সহস্র অসহায় নরনারী। তাদের কান্না-ঘাম-রক্ত-ইজ্জত-আব্রু এ কিসসায় স্থান পাবে না; কারণ তা নিছক কল্পনা নয়, কল্পনাতীত। ফলে তারা আপাতত কিসসা-বৃত্তের বাইরে অবস্থান বিক্ষোভ দেখালে দেখাক।
সকাল দেখে বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে, এই মর্মে একটি ভুবনবিদিত প্রবাদ আছে ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু সবসময় যে এই সূত্রটি খাটে না সেদিনের প্রশান্ত সকালটিকে অশান্ত সন্ধ্যা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। ঘাসের ডগায় শিশিরের বিন্দুতে কাঁচাসোনারোদ জ্বলে উঠে সকালকে অভিনন্দিত করল। বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে চলল জামির ফুলের স্মৃতি-জাগানিয়া সুবাস। আকাশের নীল গাঙে ভেসে বেড়াতে লাগল দুধসাদা মেঘেদের পলকা পানসির দল। সন্ধ্যায় উদিত হবে সোনার থালার মতো চাঁদ; নিকোনো উঠোন-খামারকে মনে হবে অতিকায় ক্যানভাস, তাতে ছায়াছবি আঁকবে সুপুরিগাছের সারি। পুকুরের জলে আলপনা এঁকে দেবে ঝরে পড়া হিজলফুলের লালিমা, বাদুড়েরা ঊর্ধ্বপদ হেঁটমুণ্ডে দোল খাবে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার শাখায়। এমনিতে পূর্ণচন্দ্রের উদয় আকাশের মতো মানুষের মনের ভিতরে যে শূন্যতা আছে যেখানে সময়ে সময়ে চিন্তার সাদাকালোরঙিন মেঘের তরঙ্গ ভেসে যায়, সেখানেও জ্বেলে দেয় অনির্বচনীয় আনন্দবাতি; পরব থাকলে তো আর কথাই নেই। গৃহে গৃহে সাড়া পড়ে যায়, সুখাদ্য প্রস্তুত হয়, সহজ শিল্পকর্মে ভরে ওঠে আঙিনা-দেয়াল, পাড়ায় পাড়ায় বেরোন অবসরপ্রাপ্ত হারমোনিয়াম, মৃদঙ্গ, করতাল প্রমুখ। এমনই হওয়ার ছিল যে তিথিটি সন্ধ্যা ও রাতের উদার প্রশ্রয়ে, কিন্তু সন্ধ্যাটি অকস্মাৎ নিহত হল, যেন গপ করে চাঁদটাকে গিলে খেল কেউ। ঝোপঝাড়ে বিষাক্ত লালা ছড়িয়ে মহল্লায় ঢুকে পড়ল সার সার শ্বাপদ হায়েনা। তাদের নখেদাঁতে ফলফুল সম্ভাবনা লোপাট হতে থাকল; বৃন্দগানের বদলে হায়েনাদের দাঁতের ঘর্ষণজাত কিচকিচ ধ্বনিমালা পাড়াগাঁর বাতাসকে বিষিয়ে দিল।
হাতে ধরা দীপাধারসহ ভগিনী আছড়ে পড়ল আলোছায়ামাখা আঙিনায়, তার বুকের উপর গুটিকয়েক হায়না ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন তাদের সন্ধানে আছে বক্ষস্থানে লুকোনো কোনো গুপ্তধন। ঘটনার আকস্মিকতায় বারান্দায় বসে পুথিপাঠরত জ্যেষ্ঠভ্রাতা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি একপ্রকার লাফ দিয়ে আঙিনায় নামতেই তাঁকে ঘিরে ধরল একঝাঁক দপদপে চোখের হিংস্র জানোয়ার। তাদের থাবার তলায় শুয়ে শুয়ে তিনি দেখলেন ভগিনীর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহটিকে খনি ভেবে খননকর্মে লিপ্ত হয়েছে পিশাচেরা। ভাগ্যিস জ্যোৎস্নায় লাল রং ঠিক ফোটে না, না-হলে দৃশ্যটি মাত্রাতিরিক্ত বীভৎস রসে ভরে উঠত। অকস্মাৎ নাওয়ের লগি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রৌঢ় মাঝি। তিনি কৈশোর থেকে পণ্ডিতবাড়ির পারিবারিক নৌযানটির কর্ণধার। তাঁর কোলেপিঠে বড়ো হয়েছে বাড়িটির ছেলেমেয়েরা। প্রৌঢ় হলেও আপৎকালে মাঝির পেশিতে বিদ্যুৎ খেলে যেত; তাঁর লগুড়ের তাড়নায় মুক্ত হলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা। তিনি হ্যাঁচকা টানে তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড় দিলেন পুকুরের পাড় ধরে নিকটস্থ নদীটির দিকে। ‘বোনটি যে পইড়্যা থকে, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, বউমা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা। নৌকায় উঠে তিনি বিস্মিত নয়নে দেখলেন ছইয়ের ভিতর সংসার নিয়ে বসে আছে কনিষ্ঠ ভাইটি। তিনি হিসাব মেলাতে পারলেন না, ভাবলেন স্বপ্ন বোধহয়; হায়েনার আক্রমণসৃষ্ট ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্তে আর্দ্র তিনি। মাঝি তাঁকে নৌকার প্রশস্ত পাটাতনের একদিকে শুইয়ে দিলেন। চেতন-অবচেতনের লীলা শুরু হল জ্যেষ্ঠভ্রাতার মনের আঙিনায়। সেখানে এসে দাঁড়ালেন প্রাজ্ঞ পিতৃদেব। তিনি বললেন, ‘বড়োখোকা তোকে কৈশোরে কতবার কয়্যা ছিলাম, অন্তত লাঠিখান ধরা শিখ্যা নে। তুই কয়্যা ছিলা, বাবা আমি বড়ো বড়ো পুথি পইড়্যা পণ্ডিত হইব। তুই সেদিন লাঠি ধর্যা শিখ্যা নিলে বোনটারে হয়তো বাঁচাইতে পারতা। খোকা আমিও পড়াইতাম অসির চেয়ে মসী বড়ো। কিন্তু যদি জানটাই চলি যায়, মসী রইব কোথা ?’ জ্যেষ্ঠভ্রাতা পিতার পদযুগল হাতড়াতে হাতড়াতে বললেন, ‘বাবা, আমি আজ বুঝছি আত্মকে রক্ষা করার বিদ্যা জানা না-থাকিলে সকল বিদ্যা মিথ্যা হইয়া যায়।’ নৌকা স্রোতের মুখে পড়ে ছিন্নমূল কচুরিপানার মতো ভেসে চলল। জ্যেষ্ঠভ্রাতা ঘোরের ভিতরে বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনোখানে...’