Next
Previous
0

গল্প - ইন্দ্রনীল মজুমদার







গুন্ডা দলের সর্দার শাহজাহান বাদশা অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় পায়চারি করছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে সে বেশ চিন্তায় রয়েছে। তাই বেশ জোরে জোরেই পায়চারি করে চলেছে। অনেকক্ষণ হলো তার সাকরেদদের সে পাঠিয়েছে কবি, লেখক তথা সাহিত্যিক নিধুবাবুকে মারার জন্য। শুধু মেরে আসা নয় তার ‘অস্ত্র’-ও কেড়ে নেওয়া চাই।

সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, “ব্যাটা, সেই অস্ত্র নিয়ে অনেক জ্বালিয়েছে। গ্রামের লোককে তাঁতিয়েছে। এই গ্রামে বসেই বাদশার নাকের ডগায় বসে বাদশার কুকীর্তির খুব সমালোচনা করবে তা বাদশা কিভাবে বরদাস্ত করবে? না, না তা হবে না। শেষ হতেই হবে তোকে রে নিধু, শেষ হতেই হবে। তুই কি না আমার গ্রামে বসে আমারই সমালোচনা করবি তা কি করেই বা হয়? ব্যাটা কি না লেখক মানুষ। তাই তিনি না কি ভি আই পি! অনেক বড় বড় মানুষদের সাথে ওঠাবসা আছে। ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের মতো নয় যে সরকারে থাকা দলের ও সেই দলের গুন্ডাদের তেল মারবে। ও কি না সমালোচনা করেছে! তাও কি না কার? না আমার। শাসকদলের পর্যন্ত সমালোচনা করেছে! এখনকার প্রচুর পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছে। থানা-পুলিশও করেছে আমার নামে! তা সেসবে কাজ না হওয়াতে বাইরের রাজ্যে এমনকি বিদেশেও আমাদের কাজের বিস্তর সমালোচনা করে লিখেছে। এমনকি টিভি ও ইউটিউবের চ্যানেলে মুখ দেখিয়েছে। প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে ব্যাটা। তার ফলে, চক্ষু লজ্জার খাতিরে রাজ্য সরকার আমায় লোক দেখানি গ্রেপ্তার করেছে। এই দু-তিনদিন জেল খেটে এসেই ভাবলাম মালটাকে সাফ্ করে দেব। কেউ কিছু টের পাবে না, হা হা। ও বলে ওর অস্ত্রের জোর অনেক বেশি। দেখি কত বেশি ওর সেই অস্ত্রের জোর! আমায় কি না জেল খাটিয়েছে! এত বড় আস্পর্ধা! এটা জানে না যে শাসকদলের এমপি, এমএলএ, থানার বড়-মেজো-ছোট সব বাবু, পুলিশ কমিশনার বলা ভালো গোটা সরকারটাই আমার এই পকেটে। আর তাছাড়া, করেছি বা আমি কি? রাতে গ্রামের মহিলাদের তুলে পার্টি অফিসে নিয়ে যেতাম। আরে, জীবনে এন্টারটেইনমেন্ট দরকার তো, তাই নিয়ে যেতাম। পঁচিশটা পুকুর বুঝিয়ে ফ্ল্যাট বানিয়েছি, দুশোর মতো চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে নষ্ট করে দিয়েছি, অন্তত তিনশোর মতো লোককে মার্ডার করেছি, তার কাছাকাছি সংখ্যক ধর্ষণও লুঠ করেছি, পাচার করেছি বিস্তর। লোককে হুমকি দিয়ে জমি-বাড়ি যে অত হাতিয়েছি তার হিসেব নেই। আর ভোটের সময় সন্ত্রাস-রিগিং– মাত্র এই কটার জন্য এত কিছু হল! এমনকি জেলেও যেতে হল! গোটা গ্রামকে ভয়, সন্ত্রাস দেখিয়ে নিজের পায়ের তলায় রেখেছি। শুধু নিধুটা আর কিছুজন বশ্যতা মানলো না। মহিলারা গর্জে উঠলো আমার বিরুদ্ধে। বেকার ছেলেগুলোও নিধুকে সাপোর্ট করে বসল! নিধু শেষ হবে তো সব ঠান্ডা হবে। তাই, আজ রাতে নিধুকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় করে দেওয়ার জন্যে লোক পাঠিয়েছি। ঐ তো ওরা আসছে।”

দূর থেকে নাক-মুখ ঢাকা, চোখ খোলা রাখা কতগুলো লোক একটা স্যুটকেস হাতে করে নিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তার মধ্যে সেই কাঙ্খিত অস্ত্রটা আছে। দেখে খুশি হল বাদশা। ঐ স্যুটকেসেই আছে সেই মোক্ষম অস্ত্র যা দিয়ে ঘায়েল হতে হয়েছিল বাদশাকে আর তার আঁচ লেগেছিল সরকারে থাকা শাসকদলের ওপর। লোকগুলো এলে বাদশা বলে ওঠে, “যেরকম বলেছিলাম সেরকম করেছিস তো? কোন ফাঁকিবাজি হয়নি তো?”

একজন সাকরেদ বলল, “না বস। মালটাকে ধরে প্রথমে আচ্ছা করে রগড়েছি। লেখক বলে শিক্ষার অনেক ঝোল ঢালছিল। কিন্তু আরও দেওয়াতে কিছুটা ঠান্ডা হলো। তখন জিজ্ঞেস করলাম,– “বল হারামজাদা, তোর সেই ‘অস্ত্র’-টা কোথায়?” মালটা হ্যাবার মতো তাকিয়ে বলল, “কোন অস্ত্র? কিসের অস্ত্র?” তখন আরও মার দিয়ে বললাম, “ন্যাকা! কোন অস্ত্র জানো না বুঝি। যে অস্ত্র দিয়ে বসকে জেলে ঢোকালে। বস জেলে ঢোকার সাথে তুমি বললে যে, “আমার এই অস্ত্র বড়োই কাজের। এতটাই এর ক্ষুরধার যে সরকারও সমালোচনা না শুনতে পেরে বেঁকে বসে যায়। আমার এই অস্ত্রের জন্য আজ বাদশা জেলে। আপনারাও তুলে নিন এই অস্ত্র।”– এই বলে এক থাবড়া দেওয়াতে মালটা প্রায় পড়িমরি করে ওঠে। ওর কলার ধরে আরেকটা থাবড়া দিলে ও বলে, “অস্ত্র টেবিলের ওপর।” আমরা ওর টেবিল থেকে অস্ত্র তুলে নিয়ে এলাম।

— খুব ভালো কাজ করেছিস ইমরান। সাব্বাস বেটা! দোয়া রইলো তোদের ওপর। তা মালটাকে কি করলি?

— মালটা তো আমাদের মার খেয়ে আধমরা হয়ে পড়েই ছিল। আরও মার দিয়ে দেখলাম মরেই গেল। তারপর নিশ্চিত করতে গলার নলিটা কেটে দিলাম ও দূরে একটি ডোবায় লাশটা ফেলে দিয়ে আসলাম। কেউ কিছু টেরটুকুও পাবে না।

বাদশা শুনে তালি দিয়ে বলে ওঠে, “সাবাস! সাবাস বেটা! এই তো চাই। আসলে কি জানিস, এইসব শিক্ষিত তার ওপর আবার লেখক মানুষরাই হল আমাদের ঘোর শত্রু, স্বৈরাচারী সরকারের ঘোর শত্রু। এরা আমাদের ও শাসকদলকে ভয় করে না। উল্টে সরকারে থাকা শাসকদলের কাজের সমালোচনা করে। আসলে বলে না যে, ‘যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে আর তত কম মানে।’ এরা ভয়ও পায় না আমাদের কাউকে। তাই জীবনে অনেক প্রতিবাদী লেখক, শিক্ষক, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও সমালোচক মেরেছি। প্রচুর, প্রচুর মেরে দিয়েছি। এই তথাকথিত শিক্ষিত, সুশীল লোকগুলোকে এই বাদশা একদমই পছন্দ করে না। এরা লেখাপড়া শিখেছে তাই আমাদের মনে করে জঞ্জাল আর সরকারের কৃপায় না চলে নিজেরা নিজেদের মতো করে চলে। এত্ত দুঃসাহস এদের! তাই এদের জীবনে খুব মেরেছি। এমনকি অন্যান্য অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে পরধর্মের লোকেদেরকেই বেশি টার্গেট করেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে, কোনও ধর্মীয় একেবারেই ভেদাভেদ রাখিনি বরং নিজেদের ধর্মের লোকেদেরও খুব মেরেছি। আসলে, এই লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক এইসব শিক্ষিতদের বাড়তে একেবারেই দেওয়া যায় না। এদের সমূলে বিনাশ করা উচিৎ কেননা এদের কাছে থাকে সেই মারণাস্ত্র যা আমাদের কাছে নেই। শুনেছি যে, এরা সেই অস্ত্র অন্যকে দিয়েও দেয়। তা খোল তো দেখি স্যুটকেসটা।

স্যুটকেসটা খোলা হলে হচ্ছে, বাদশা আগ্রহ ভরে দেখছে। কিন্তু হঠাৎ সে থমকে যায়, তা চোখ দিয়ে সেই আগুনের হলকা যেন উভে যায়। আসলে যা হল সেটা একটা পাতি কলম। মাথায় হাত পড়ে যায় বাদশার। তবুও সে সেটি পরীক্ষা করবার জন্য কাগজে লিখে নিশ্চিত হয় যে সেটা একটা পাতি কলম।

এবার সে বেশ চিৎকার করে বলে, “এ কি রে! এ তো একটা পাতি পেন। কতই বা দাম হবে এর? দেখে তো মনে হচ্ছে খুব বড়োজোর কুড়ি কি পঁচিশ টাকা, কি তাও নয়।

সাকরেদরা প্রায় খাবি খেতে খেতে বলল, “বস, ও তো অস্ত্র বলতে তো এটাই দেখালো। তাছাড়া ওর বাড়িতে বই খাতা ছাড়া কিছুই তো ছিল না। এই পেন দিয়েই প্রবন্ধ বা লেখাগুলো লিখত বলল।

বাদশা এবার আরও রেগে গিয়ে পেনটি উঁচিয়ে ধরে বলল, “তোদের মাথাতেও কি এলো না যে এটা একটি পেন।”

দলের একজন বলল, “আমরা লেখাপড়া শিখিইনি তো পেন চিনব কিভাবে? দিনরাত তো তোমার পেছনে পেছন ঘুরে কাটাই। ভাবলাম বন্দুক, ছুঁড়ি কি বোমার মতো এটাও একটা অস্ত্র। বাইরেটা এরকম, ভেতরে হয়তো মাল-মশলা রয়েছে। নয়তো তোমার মতো সুপারম্যানকে ঘায়েল করবে কেন? কিন্তু ভেতরে যে এরকম আতিপাতি তাকে জানতো, বলো?” (সবাই এতে সায় দেয়।)

আরেকজন বলে ওঠে ব্যঙ্গের সুরে, “এটা শেষমেশ তোমাকেই ঘায়েল করল!”

বাদশা এবার মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে ‘হায় হায়’ করতে করতে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে।

কথায় বলে ‘দ্য পেন ইস মাইটার দ্যান এ সোর্ড’। একটা কলমের জোর এতটাই যে সে একজন বন্দুকধারী, ছুঁড়িওয়ালা বোমা নিয়ে চলা ক্রিমিনালকেও ঘায়েল করে দিতে পারে। সাধারণ প্রতিবাদী মানুষ এইসব ক্রিমিনাল ও তাদের মদতদাতা স্বৈরাচারী শাসকদলের বিরুদ্ধে কলম ধরুক। সোশ্যাল মিডিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায়, পত্রপত্রিকায় খুলে লিখুক অত্যাচারের কাহিনী। কলম দিয়েই ভাঙুক অত্যাচারী শাসকের ব্যারিকেড। জয় হোক শুভ বুদ্ধি ও চেতনার, জয় হোক কলমের।