Next
Previous
0

গল্প - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in







বাসুর হাতের কাজ সুতো দিয়ে মোম কাটার মতোই মসৃণ; তা সে-ভিত ইটের হোক বা মাটির। তাই নিয়ে নুরির কী ঠ্যাকার! নুরি বাসুর কেউ না, কিন্তু তাদের চোখে চোখে কথা চলছে – যেকোনো দিন সে বাসুর ঘরে চলে আসবে।

ওস্তাদদের দিন আর নাই। তবু নাই নাই করেও জঙ্গলমহলের এই থানায় তারা এখনও করেকম্মে খাচ্ছে। তার পুরো কৃতিত্ব অবশ্য এই থানার বড়বাবুর। কলিযুগে এমন সৎ, সাত্ত্বিক দারোগা দেখতে পাওয়া ভারী আশ্চর্যের! আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই থানায় তিনি হাবিলদার হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। তারপরে যতবার তার বদলির আদেশ এসেছে, ততবারই তা স্থগিত হয়ে গেছে। নেহাত মাথা খারাপ না হলে এই রুখাশুখা থানায় কেউ আসতে চায় না, মুরুব্বি ধরে আদেশ আটকে দেয়। যারা আসতে বাধ্য হয় তারা বছর না ঘুরতেই বদলির আদেশ তৈরি করিয়ে পালিয়ে যায়। কেবল এনারই কোনো নড়নচড়ন নাই। বাধ্য হয়ে সরকার এনাকে পটাপট প্রমোশন দিয়ে দিয়ে এই থানার বড়বাবু করে রেখে দিয়েছে। সরকারি খাতায় এনার একটা নাম অবশ্যই আছে। কিন্তু সে-নাম এই থানায় কোনো লোকের স্মরণে নাই। এই থানায় লোকই বা কোথায়! জঙ্গলের ধারে ধারে কয়েকটা ছোটো ছোটো গ্রাম আছে আদিবাসীদের। তা বাদে লোক বলতে এই লোধারাই আছেন। তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইংরেজদের খুব আতঙ্ক ছিল এই নিরীহ লোধাদের নিয়ে। সে জন্যেই বোধ হয় তারা এখানে একটা পুলিশ চৌকি বসিয়েছিল। সেটাই ঐতিহ্য মেনে স্বাধীনতার পরে থানা হয়ে বসে আছে। ঘটনাচক্রে সেটাই হাঁ-বাবুর পুনর্বাসনের উপযুক্ত জায়গা হয়েছে, এই হাঁ-বাবু নামটি তাঁকে এখানকার ওস্তাদরাই দিয়েছেন।

ওস্তাদ বলতে তাঁরাই, যাঁরা পুরুষানুক্রমে সিঁদ চালিয়ে সংসারের অন্নবস্ত্রের জোগাড় করে আসছেন। এখন কথা উঠতে পারে, এই থানার মানুষজনের তো নিরন্ন অবস্থা, তাহলে তাঁরা সিঁদটা চালান কোথায়? এর উত্তর নেই। এটা ওস্তাদদের মন্ত্রগুপ্তি বলা যায়, গোদা বাংলায় যাকে বলে ‘টেট সিগ্রেট’। কারবারের অন্য সব ব্যাপারগুলো জলের মতো সরল, লুকোছাপার কোনো কানুন নাই। মালপত্তর যা পাওয়া যায়, রাত পোয়ানোর আগেই মহাজনের ডেরায় সেসব গচ্ছিত করে ঝাড়া হাতপায়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়া। হাতে গোনা দু-চার জন মাত্র মহাজন, খুবই মান্যিগন্যি, নেতা-মন্ত্রী-পুলিশ সকলেই তাদের চেনে, খাতিরদারি চলে, কে কাকে খাতির করে বুঝে ওঠা দায়। আগে আগে পুলিশ, মহাজনের হিসাবের বাইরেও ওস্তাদদের বেআইনিভাবে উত্যক্ত করত। হাঁ-বাবু দারোগা হওয়ার পর সেটা বন্ধ হয়েছে।

এই থানায় বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু বলতে ওই একজনই – হাঁ-বাবু। কেউ কেউ তাকে বড়বাবু ডাকলেও বেশির ভাগই হাঁ-বাবু বলে ডাকেন। তিনি কোনো আপত্তি করেন না। কারণ তাঁর মুখ তো সব সময় হাঁ হয়েই থাকে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর এই অবস্থা। মুখ বন্ধ করলেই তাঁর কান বন্ধ হয়ে যায়, কিছু শুনতে পান না। চোখেও ঝাপসা দেখেন। ঘুমনোর সময় কী হয় কে জানে! ঘুমন্ত মানুষ নিজেকে দেখতে পায় না বলে হাঁবাবু নিজেও জানেন না। একা মানুষ, নিজের কোয়ার্টারে একাই ঘুমোন, তাই অন্য কেউ-ও জানে না।

কেন তিনি বিয়ে করেননি, সেই উত্তর হাঁ-বাবুর কাছেও নেই। বিয়েটা স্রেফ হয়ে ওঠেনি। তাই বলে যে হবে না, তেমনটা বলা যাবে না। লোকে ভাবতে পারে, তাঁর বিয়ের বয়েস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু হাঁ-বাবুর মনে এই নিয়ে সন্দেহ আছে। জীবনের কথা কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না। হতেও পারে তিনি এখনও বিয়ের অপেক্ষায় আছেন।

এই থানায় হাঁ-বাবু ছাড়া তিনজন কনস্টেবলও আছে। তিনজনেরই বাড়ি এই থানারই আলাদা আলাদা গাঁয়ে। দরকার মতো তারা সাইকেলে চেপে থানায় আসে। তাদের সময়মতো হাজিরা দেওয়ার নাকি কোনো আইন নাই। কারণ হাঁ-বাবু তিনশ পঁয়ষট্টি দিন চব্বিশ ঘণ্টা থানাতেই হাজির; হয় থানায়, নয় কোয়ার্টারে। একটা দরজার এদিক-ওদিক।

আজ দেখা যাচ্ছে তিনজন কনস্টেবলই সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই থানায় এসে হাজির। হাঁ-বাবু তো ভোরে উঠেই বাথরুম সেরে কোয়ার্টারের পিছন দিকের দরজা খুলে থানায় এসে ঘাঁটি গাড়েন। একটু আগেই নুরি তাঁকে এক মগ আদা-চা দিয়ে গেছে। তিনি চা খেতে খেতে একেবারে টাটকা প্লাস্টার অব প্যারিসে নেওয়া ছাপটা মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করছেন। দেখা শেষ হলে কালো কালি দিয়ে ছাপের পিছন দিকে ‘বা-৭’ লিখে আলমারিতে তুলে রাখলেন। এই আলমারিতে এই নিয়ে ১৫ টা ছাপ জায়গা পেল। আলাদা আলাদা তিনটা তাকে ছাপগুলো রাখা আছে। ‘বা-৭’, ‘রা-৫’ আর ‘নি-৩’। এই ১৫টা ছাপ ফাইনালে উঠল। এদের মধ্যে তিনটি ছাপ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবে। আসছে মকর-সংক্রান্তিতে এদের পুরস্কার দেবেন হাঁ-বাবু।

তিন কনস্টেবলকে দেখে মুচকি হাসেন হাঁ-বাবু। আজ হাতিশুলির যোগেন মাহাতোর হাজিরার দিন কিনা! এই থানার তিন মহাজনের একজন হলো যোগেন। সে পৌঁছল আরও এক ঘণ্টা বাদে। জোড় হাত মাথার উপর তুলে আকাশের দিকে প্রণাম ছুঁড়ে দিয়ে হাঁ-বাবুর টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে সশব্দে বসে পড়ল। তারপর বলল, --ব্যবসাগুলান যে লাটে তুল্যে দিলেন আঁজ্ঞ্যা!

হাঁ-বাবুর মুখ বন্ধ, যোগেনের কথা শোনার ইচ্ছে নেই তাঁর। বাধ্য হয়ে সে নিজের চেয়ার ঘুরিয়ে কনস্টেবল ভবেনের দিকে তাকাল। বলল, --এই শালা ভবা! ইদগে আয়।

ভবেনেরও বাড়ি হাতিশুলি। যোগেনের সঙ্গেই সে পাঠশালায় পড়েছে। সে কাছে আসতেই যোগেন খেঁকিয়ে ওঠে, --সকাল সকাল ধড়াচূড়া চাপাই লিয়ে থানায় হাজির হয়েছু কেনে জাইনত্যে বাকি নাই আমার। সব শালার নজর আমার গেঁজের দিগে! আর ইদিগে গেঁজেয় যাতে মাল না ঢুকে তলে তলে সেই ব্যবস্থা কর‍্যে হাঁ হয়্যে বসে আছে তোর বড়বাবু। ভবেন বলে, --ক্যানে, বড়বাবু আবার লোতুন কী কইরল?

--ন্যাকা চৈতন্য! কিছুটি মনে হচ্ছে জানুস নাই। শালা আমার এলাকায় ক’টা গিরস্থ বাড়িতে সিঁদ পইড়ছে আজকাল? সিঁদেলগুলান তো আর দেশ ছাইড়্যে পালায় নাই! কুথাও পড়ুক না পড়ুক, তোর বড়বাবুর কুয়াটারে পিতি মাসেই সিঁদ পইড়ছে। আছেটা কী তোর বড়বাবুর কুয়াটারে? কুনোদিনই একটা বাসন তক জমা পড়েনি আমার কাছে। কী যে গ্যাঁড়াকল বসাই রাখ্যেছে বড়বাবু কে জানে!

ভবেনের নজর অনুসরণ করে বড়বাবুর দিকে ফিরতেই যোগেন দেখল তাঁর হাঁ খুলে গেছে। গলার আওয়াজ খানিক মোলায়েম করে সে বড়বাবুকে বলে, --ইটা কি ঠিক হইচ্ছে বড়বাবু! সিঁদেলরা যদি গিরস্থের ঘরে সিঁদ দেওয়া ছাইড়্যে দ্যায়, আমাদের চলে কি করে! সেটা লিয়ে আপনার কুনো ভাবনা নাই, উল্টে আপনি মকর-সংক্রান্তির দিনকে ওস্তাদগুলানকে পেরাইজ দ্যান।

হাঁ-বাবু বললেন,--আহা যোগেন ভায়া, উৎসাহ না দিলে ওরা এই কাজ করবে কেন বলো দিকি! সুখের কাজ তো নয় - ধরা পড়ার ভয় আছে, জেলে যাওয়ার ভয় আছে। অথচ দ্যাখো কীরকম গুণী মানুষ সব। এক একজনের হাতের কাজ দেখলে ভিরমি খেতে হয়। শিল্প, শিল্প! শিল্প বোঝো?

--উসব শিল্প-ফিল্প আপনি বুজুন বড়বাবু। আপনি আমাদের থানায় কায়েম হওয়া ইস্তক অরাই রাজত্ব কইরছে। আমাদে কাছে আলেকালে দু-চাইরটা বাসন-কুসন বাদে আর কুনো মালই ঢুকছেনি। এরম চইল্লে মাস হাজিরা বন্ধ হয়্যে যাবেক কিন্তু বড়বাবু।

হাঁ-বাবু বললেন, --সে তোমার ধর্ম যা বলে তাই করবে যোগেন ভায়া। আমি কি কোনোদিন কাউকে হাজিরা দেওয়ার জন্যে বলেছি?

--সেটাই তো ফ্যাসাদ। বাপের আমল থিক্যেই হাজিরা দিয়ার অভ্যাস। যতো মনে করি আসব নাই নিজের ট্যাঁক খসাতে, দিনটা আল্যেই মনটা কেমন খচখচ করে। না আস্যে থাইকতে লারি।

বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল যোগেন। কোমর থেকে কয়েক বিঘত লম্বা কাপড়ের গেঁজে খুলে তার ভেতর থেকে চারটে ন্যাকড়ার পুঁটলি বের করে টেবিলের উপর রাখল। তারপর গেঁজেটা ফের কোমরে বেঁধে নিয়েই গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। নিমেষেই ভবেন পুঁটলির গায়ে লেখা সাংকেতিক চিহ্ন দেখে একটা পুঁটলি টেবিলে রেখে বাকি তিনটে পুঁটলি তুলে নিল তাদের তিনজনের জন্যে। সকলেই জানে পুঁটলিতে আছে কয়েকটা করে ছেঁড়া-ফাটা নোট আর কয়েন। পরিমাণ যত সামান্যই হোক, তার টান মাইনের চেয়ে বেশি।

হাঁ-বাবু তাঁর পুঁটলি খোলেন না কখনো। প্রতি মাসে গোটা তিনেক আসে। সেগুলো একসঙ্গে কোয়ার্টারের একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে সেই খবর নুরির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন ওস্তাদদের ডেরায়। একদিন না একদিন সেগুলো হাপিশও হয়ে যায়। যাওয়ার সময় কোয়ার্টারের দেওয়ালে তার ছাপ রেখে যায়। সেসব ছাপ হাঁ-বাবু তুলে রাখেন প্লাস্টার অব প্যারিসে। এই ছাপগুলিই ওস্তাদদের পরীক্ষার খাতা। এই খাতার নম্বর দেখেই প্রতি বছর প্রথম তিনজনকে পুরস্কার দেন তিনি। প্রচার হয়, সিঁদ কাটা ছেড়ে ভালো পথে আসার জন্যে থানার বড়বাবু তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছেন।


থানার গায়েই একটা ঝাঁকড়া আমগাছ। যোগেন থানা থেকে বেরিয়ে যেতেই একটা বেঁটে, কালো, মুখভর্তি গোঁফদাড়িওলা লোক গাছটা থেকে নেমে এল। অনেকক্ষণ আগেই থানায় ঢুকতে গিয়ে যোগেনের উপস্থিতি টের পেয়ে সে গাছে উঠে ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। গাছ থেকে নেমেই সে এক ছুটে থানার ভেতর সেঁদিয়ে গেল। তাকে দেখে হাঁ-বাবু মুচকি হাসলেন। বললেন, --লুড়কা যে রে। আয় বোস।

লুড়কা মেঝেতে উবু হয়ে বসে চোখ গোল গোল করে সবাইকে একবার দেখে নিল। তারপর বলল, --পেন্নাম বড়বাবু। মাস তিনেকের জন্যে চালান কর‍্যে দিতে হবেক আঁজ্ঞ্যা।

--কেন রে, কী ফ্যাসাদ বাঁধালি আবার?

--বৌটা বিগড়্যেছে আঁজ্ঞ্যা। ঘরে সেঁধ্যাতেই দিচ্ছেনি।

--সাংঘাতিক কিছু করেছিস নিশ্চয়ই।

নিজের দুই কানে হাত ঠেকিয়ে লুড়কা বলল, --ভগমানের কিরা বড়বাবু, ইবারে খারাপ কিছু করিনি। শালা পচা তো দিনরাত চুলাই খায়্যে পথেঘাটে পড়্যে থাকে; বৌকে লুকায়্যে ঘর থাক্যে এক পাই চাল লিয়ে পচার বিটিটাকে দিয়্যেছিলম। শালি ঠিক জাইনত্যে পার‍্যে গেছে।

বড়বাবু বললেন, --সব্বোনাশ করেছিস লুড়কা! পচার মেয়ে তো বেশ ডাগর হয়েছে রে। তাকে তুই লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়াচ্ছিস! এমন অন্যায্য কাজ কোন বৌ সহ্য করবে বল। তোর বৌ তো আবার আপিসার, বিডিও আপিসে ঝাঁট-জল দেয়।

লুড়কা বলল, --আপনার পায়ে আস্যে পইড়লম। কম করে তিনমাস না হল্যে শালির রাগ পইড়ব্যেক নাই মনে হয়।

হাঁ-বাবু বললেন, --তোর কপাল ভালো রে লুড়কা। সিয়াড়বনির মনু দণ্ডপাটের সিঁদ-কাটা কেসটায় নিমুর নামে রিপোর্ট লিখেছিলাম। নিমু একটু গাইগুঁই করছে। ওর বৌয়ের আজ-কালই বাচ্চা হবে কিনা।

ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করলেন হাঁ-বাবু। দণ্ডপাট হাঁকডাকের মানুষ। কাজেই উপর থেকে চাপ আসছে খুব। কাজটা করেছে বাসু। অসাধারণ কাজ। দণ্ডপাটের বাখুলে হেথাহোথা যত মালকড়ি লুকানো ছিল সব গুছিয়ে বের করে এনেছে। বাড়ির লোক তো দূরের কথা, রাস্তার একটা কুকুরও টের পায়নি। কিন্তু এইসময় কোনোমতেই বাসুকে চালান করে দেওয়া যায় না। বাসু এই এলাকার সেরা শিল্পী। তাই নিমুর নামে রিপোর্ট লিখেছিলেন। জেলের ভাত নিমু যে অপছন্দ করে তেমন নয়, কিন্তু বেচারা এই প্রথম বাপ হতে চলেছে। গৃহস্থের ঘরে তার হাতের কাজ তো ভালোই। এখন নিজের বৌয়ের ঘরে সে কাজটা কেমন করতে পেরেছে সেটা না দেখে জেলে যেতে মন সরছে না। এ একরকম ভালোই হলো। তিনি আগের রিপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে লুড়কার নামে নতুন রিপোর্ট লিখতে শুরু করলেন। লেখা শেষ হলে আজই ভবেনকে দিয়ে রিপোর্টসহ লুড়কাকে আদালতে দাখিল করে দেবেন।


থানার সঙ্গে কোয়ার্টারের একটা মাত্র দরজার ব্যবধান হলে কি হবে, হাঁ-বাবু কোয়ার্টারে বেশিক্ষণ থাকার ভরসা পান না। সেখানে নুরির রাজত্বি। সে হাঁ-বাবুর ঘরদোর, জামাকাপড় পরিষ্কার করে, রান্নাবাড়া করে তাঁকে খাওয়ায়। নুরি খেতে ডাকলে যে-কাজই থাকুক না কেন, সব ফেলে তাঁকে খেতে ছুটতে হয়। নুরির শাসন বড়ো কড়া। তার শাসনের চোটে হাঁ-বাবুর কোয়ার্টারে ধুলোময়লাও ঢুকতে সাহস করে না। নুরির পরিষ্কারের বাতিক, কেবল হাঁ-বাবু যে-কথাটা আজ পাঁচ বচ্ছর ধরে লাগাতার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন, সেটার কোনো পরিষ্কার উত্তর দিচ্ছে না।

কালো ছিপছিপে চেহারা নুরির। বছর ছয়েক আগে বাসুর বাবা যখন তাকে বড়বাবুর কোয়ার্টারে এনে জমা করে দিয়েছিল, তখন তার বয়স ষোল কি সতের। ছোটো থাকতেই মা-বাবা দুটোই মরেছে। কাকার বাড়িতে ছিল। আট-ন’বছর বয়সে ঝাড়গ্রামের এক বাবু তাকে ঘরের কাজ করার জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। বারো-তেরো বয়স হতেই আবার কাকার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন। মেয়ে বড়ো হচ্ছে। তার শরীরে কালো আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। নিজের বাড়িতে রাখার সাহস পেলেন না তিনি। কাকার বাড়িতে ফেরার বছর খানেক পর থেকেই নুরির পিছনে ফেউ লেগে গেল। ততদিনে তার কোঁকড়ানো চুলে, চোখের কালো তারায় আর বুকের দুটি শঙ্খে ক্ষণে ক্ষণে বিজলি চমকায়। তবে তার চোখ টানতেও যেমন, ঝটকা মারতেও তেমন। তার চাউনির ঝটকার সঙ্গে মুখের তীক্ষ্ণ চোপা যখন সঙ্গত করে তখন তার কাছে ঘেঁষাই দায়। ফেউগুলো তাকে কিছুতেই কবজা করতে পারল না। এবার আসরে নামল স্বয়ং বাঘ। নুরির কাকাকে টাকার লোভ দেখাল। ফেউদেরই একজন বর সেজে নুরিকে বিয়ে করতে এল। কাকার কন্যাদায় কিনা! ওদিকে নুরির সঙ্গে বাসুর চোখে চোখে কথা হয়। কাকার মতো মুরুব্বির সঙ্গে বাসু টেক্কা দিতে পারে না ঠিকই, তাই বলে নুরিকে বুদ্ধি দিতে তো অসুবিধে নেই। সেই বুদ্ধিতে নুরি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বাসুর বাবার কাছে কেঁদে পড়ল। বাসুর বাবা বিপদ বুঝে তাদের মুরুব্বি, হাঁ-বাবুর কাছে নুরিকে এনে গচ্ছিত করে দিল। বাসুর বুদ্ধির বারো আনা ফেল করলেও বাকি চার আনা নুরিকে আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিল। হাঁ-বাবু যতই অমায়িক দারোগা হোন, থানায় এসে নাক গলানোর সাধ্যি কোনো বাঘ-মুরুব্বিরও নেই।

নুরির বিপদ কাটল, ওদিকে হাঁ-বাবুর মাথায় বিপদ চাপল। নাওয়া-খাওয়া-ঘুমনোয় বুনো জন্তুর মতো স্বাধীন ছিলেন এতদিন। কোয়ার্টারে কয়েকদিন কাটিয়েই হাঁ-বাবুকে আপাদমস্তক জরিপ করে ফেলল নুরি। তারপরেই তাঁর মাথায় চড়ে বসল। তার চোপাবৃষ্টি আর রোষ-কটাক্ষে ঘন ঘন জেরবার হতে লাগলেন তিনি। প্রথম প্রথম কোয়ার্টারে না ঢুকে থানাতেই চব্বিশ ঘণ্টা কাটাবার তাল করছিলেন। সেটাতেও বাদ সাধল নুরি। খাওয়ার সময় হলে হাঁ-বাবুর নড়া ধরে কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে তাঁকে খেতে বসায়, জামাকাপড়-উর্দি দু’দিন ছাড়া ছাড়া গা থেকে খুলে নিয়ে কাচতে বসে। রাতের বেলায় থানার বেঞ্চিতে শুয়ে যে দুটো চোখ বুজবেন তারও জো নেই। জোর করে কোয়ার্টারের বিছানায় টেনে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেবে। থানায় জরুরি ফোন আসবে বলেও পার পান না। মাঝখানের দরজাটা হাঁ করে খুলে রাখে। বলে, --কিরিং কিরিং বাইজল্যেই তুমাকে তুল্যে দিব।

মাস ছয়েক পরেই হাঁ-বাবু অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর মধ্যে যে-লোকটার বাস সে পাল্টে গেছে বেমালুম। এখন তাঁর সময় সময় খিদে পায়, জামাকাপড় নোংরা হলে নাকে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ ঢোকে। বিছানার চাদর-বালিশ বেশ ফুরফুরে না হলে শুতে পারেন না। আশ্চর্যের কথা, রাত এগারোটা বাজলেই ঘুমে চোখ জুড়ে আসে। কোয়ার্টারের বিছানা তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে।

ভেবে দেখলেন, নুরিই এসব বদভ্যাসের মূলে। সে তাঁকে আদুরে গেরস্থ বানিয়ে ছেড়েছে। আচমকা একটা ভয় ঢুকল মনে। নুরি এখন বিয়ের যুগ্যি মেয়ে। আজ না তো কাল তার বিয়ে হবে। হাঁ-বাবুকেই সেই ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে ওস্তাদের কাছে তাঁর মান যাবে। আর না দিলেই বা কি – নুরি যা জিনিস, সাধ জাগলে কবে না কবে পছন্দের কাউকে বিয়ে করে ভেগে যাবে। তখন তাঁর কী হবে? নুরির দেওয়া বদভ্যাসগুলো সামলাবে কে? তাচ্চেয়ে যদি...

ভাবতে ভাবতেই তাঁর মাথায় একটা মতলব খেলে গেল।


এসব পাঁচ বছর আগের কথা। নুরি সেই সবে সাবালিকা হয়েছে। সেদিন তার বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই হাঁ-বাবুর মনে পড়ে গেল, তাঁর নিজেরও তো বিয়ে হয়নি। তবে তো দু’য়ে দু’য়ে হতেই পারে চার।

নুরির পেতে দেওয়া বিছানায় সেই সবে শুয়েছেন হাঁ-বাবু। বাসনপত্রের আওয়াজে টের পাচ্ছেন নুরি তখনও জেগে। তিনি ডাকলেন, --নুরি একবার ইদিগে আয় তো।

--যাই – বলে একটু পরে চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে নুরি এসে দাঁড়াল তাঁর সামনে। হাঁ-বাবু বিছানায় উঠে বসলেন। নুরির দিকে ফিরে বললেন, --আমাকে বিয়ে করবি?

শুনেই নুরি হাঁ-বাবুর বিছানার চারপাশে একটা পাক মেরেই তাঁর মুখের সামনে এসে দাঁড়াল। হাঁ-বাবু লজ্জা-লজ্জা মুখ করে তাকিয়ে দেখলেন নুরির ভুরুতে ঢেউ খেলছে, তার চোখের তারায় চাপা হাসি ঝিলিক মারছে। মিনিট খানেক তেমনিভাবেই চেয়ে রইল নুরি। তারপর হাঁ-বাবুর কাঁচা-পাকা চুলে হাতের চিরুনি দিয়ে একটা খামচি মেরেই চলে গেল সেখান থেকে। যেতে যেতে বলে গেল, --ঘুমাই পড়ো দিকিনি।

হাঁ-বাবু বোকার মতো শুয়ে পড়লেন। মানেটা কী দাঁড়াল? হ্যাঁ না কিছুই তো বলল না। শেষে ভাবলেন, ভেবে-টেবে দু’দিন পরে হয়তো উত্তর দেবে।

দু’দিন তো ছার, একদিন একদিন করে পাঁচটা বছর কেটে গেল। হাঁ-বাবু রোজ রাতেই ঘুমনোর আগে নুরিকে জিজ্ঞেস করেন, --আমাকে বিয়ে করবি নুরি?

প্রতিদিনই নুরি চোখ-মুখের নতুন নতুন ভঙ্গি করে হাঁ-বাবুকে বুড়ি ছোঁয়ার মতো আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েই পালিয়ে যায়। এতদিনে ব্যাপারটা তাদের দু’জনের কাছেই একটা রোজকার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলার সময় হলে নুরিকে আর ডাকতে হয় না। সে নিজেই চুলে চিরুনি লাগিয়ে চলে আসে হাঁ-বাবুর নিবেদন শুনতে। নিবেদন পেশ হওয়া মাত্র চক্ষু-নাসিকায় শিল্প ফুটিয়ে, নির্দিষ্ট উত্তরকে পাশ কাটিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায়।

পাঁচ বছরের অমীমাংসিত খেলাটা এবার শেষ করবেন হাঁ-বাবু। তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হাজার হোক তিনি দারোগা। মনের অন্তরালেও যে তাঁর নজর পৌঁছে যায় সেটা প্রমাণ করবেন তিনি আসছে সংক্রান্তির দিনে।


সংক্রান্তির ভোরে আঁধার থাকতেই বিছানা ছেড়েছে নুরি। সুয্যি ওঠার আগেই সুবর্ণরেখায় মকর-ডুব দিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে মেলায় যাবে। নদী এখান থেকে মাইল খানেক দূরে। নদীর পাড়ে হাতিমশাল মৌজা। সেখানে সুবর্ণরেখার চড়ায় জমজমাট মেলা। হাজার কয়েক লোক আসবে আশপাশের সব গাঁ থেকে। কাঠি নাচ আর সাঁওতাল নাচের দল সরগরম করে রাখবে মেলা। চড়ার উপরের ডাঙ্গায় কাড়া-গরু খুঁটানো হবে। ওস্তাদ খুঁটিয়েরা লাল শালু হাতে মাদলের তালে তালে নাচতে নাচতে খুঁটোয় বাঁধা বাছা বাছা কাড়া-গরুদের খেপিয়ে তুলবে। খুঁটি উপড়ে ফেলা উন্মত্ত জন্তুদের মোকাবিলা করে শান্ত করাও ওস্তাদদের কাজ। চোখের স্বাদ নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে জিভের স্বাদ নেওয়াও চলতে থাকবে। দর্শকরা সঙ্গের ন্যাকড়ার পুঁটলি খুলে চিত্যে পিঠে খাবে খেজুর গুড় দিয়ে। সেইসঙ্গে দেদার হাঁড়িয়া আর মহুয়া বিক্রি হবে হেথা সেথা।

গত কয়েক বছর ধরে মেলায় একটা নতুন পরব যোগ করেছেন হাঁ-বাবু। লাল-সবুজ কাপড় টাঙিয়ে খানিকটা জায়গা ঘিরে টেবিল চেয়ার পেতে হাঁ-বাবু পঞ্চায়েতের মুরুব্বিদের নিয়ে বসেন। মাইক হাতে তাঁদের কেউ কেউ দু-চারটে ভালো ভালো কথা বলেন, খারাপ কাজ ছেড়ে ভালো পথে রোজগার করার কথা। সবশেষে হাঁ-বাবু সেরা শিল্পীদের ‘পেরাইজ’ দেন।

হাঁ-বাবুর মতো খেপু দারোগা কেউ কখনো দেখেনি, নুরি ভাবছিল। খেপু না হলে কি মাথার ছাতা হয়ে তাকে এমন আগলে রাখত! খেপু না হলে সিঁদেলদের কেউ শিল্পী নাম দেয়? না পেরাইজ দেয়?

কলঘর থেকে বেরিয়ে নুরি সন্তর্পণে এসে হাঁ-বাবুর বিছানার কাছে দাঁড়াল। ফুরফুর করে নাক ডাকছে তাঁর। ডাকতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ডাকল না নুরি। কাল রাত থেকেই হাঁ-বাবুকে বেশি বেশি খেপু লাগছে। এতদিন ধরে শোয়ার আগে যে-খেলাটা তার সঙ্গে খেলে আসছে, সেটাও কাল খেলেনি। নুরি খেলার জন্যে দু-তিন বার খোলা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে তাঁর কাছে এসেছিল। যেন দেখতেই পেল না হাঁ-বাবু। সাদা সাদা চুনা পাথরের গায়ে লাগানো কতকগুলো ছাপ দেখতেই মজে গিয়েছিল যেন। কষ্ট হয়েছিল নুরির। হাঁ-বাবু কি জানে, তাঁর কথা ভেবেই বাসুর সঙ্গে এখনও পালিয়ে যায়নি নুরি? প্রায় রাতেই তো বাসু তার সঙ্গে দেখা করতে কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে, হাঁ-বাবু টেরই পায় না। এসেই চাপা গলায় ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে -–চল নুরি বিয়্যা করি, চল নুরি বিয়্যা করি...

হুঁ, বিয়্যা তো করতেই হবে। কিন্তু খেপু দারোগার কী হব্যেক? তাঁর অভ্যাসটা যে নুরিই খারাপ করে দিয়েছে!

কাল রাতে খেতে বসার আগে হাঁ-বাবু নুরির হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, --মকরচান করে এগুলো পরবি।

প্যাকেট খুলে নুরি দেখল খুব সুন্দর একটা শাড়ি, সেইসঙ্গে সায়া, বেলাউজ। শাড়িটা বের করতেই দেখে প্যাকেটের মধ্যে শালপাতায় মোড়া আর একটা কি জিনিস। হাতে নিতেই ম-ম গন্ধে ভরে উঠল ঘর। রজনীগন্ধার মালা। নুরির বুকটা ঢিপ ঢিপ করে উঠল। এটা কেন এনেছে হাঁ-বাবু! সত্যি সত্যিই তাকে বিয়ে করে ফেলবে নাকি? জিজ্ঞেস করল, --মালায় কী হব্যেক?

হাঁ-বাবু বলল, --কাল চান করে মেলায় যাবি তো, সঙ্গে নিয়ে যাবি মালাটা। আজ রাতে জলের ছিটে দিয়ে রাখ, তাজা থাকবে। পুরস্কার দেওয়ার সময় লাগবে।

নিশ্চিন্ত হয়েছিল নুরি। আবার কাল রাতের খেলাটা হাঁ-বাবু না খেলায় একটা দুর্ভাবনাও বিঁধছিল তাকে। কয়েক দণ্ড হাঁ-বাবুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা ঝোলায় শাড়ি-গামছা আর মালাটা নিয়ে কোয়ার্টার থেকে বেরোল নুরি। নদীর দিকে হাঁটতে লাগল।


মকরের মেলায় হাঁ-বাবুর পুরস্কার ঘোষণা এবং বিতরণ চলছে। তৃতীয় পুরস্কার গামলা-বালতি। পেয়েছে নিমু। দ্বিতীয় পুরস্কার শাবল-গাঁইতি। জিতেছে রাখু। এবার প্রথম পুরস্কার ঘোষণার পালা। হাঁ-বাবু চোঙা মুখে নিয়ে বললেন, --এবারের প্রথম পুরস্কার একেবারেই অন্যরকম। দেখে সবাই আমার মতোই হাঁ হয়ে যাবেন।

নতুন শাড়ি পরে নুরি সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। হাঁ-বাবু তাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। নুরি এগিয়ে আসতেই ফিসফিস করে মালাটা বের করতে বললেন। তারপর চোঙা মুখে ঘোষণা করলেন,--এ বছরের প্রথম শিল্পী বাসু। বাসু কোথায় আছিস, এদিকে আয়।

ছিপছিপে চেহারার বাসু ভিড়ের মধ্যে কোথায় ছিল কে জানে, নিমেষেই যেন মাটি ফুঁড়ে হাজির হলো সামনে। হাঁ-বাবু নুরির কানে কানে বললেন, --মালাটা দু’হাতে ধরে বাসুর সামনে দাঁড়া।

বলেই ঘোষণা করলেন, --এবারের প্রথম পুরস্কার কোনো জিনিস নয়, এক জলজ্যান্ত মানুষ। মানুষ তো নয়, রত্ন – রমণী-রত্ন। এই রত্নটিকে আমি শিল্পী-রত্ন বাসুর গলায় ঝুলিয়ে দিলাম। নুরি, মালাটা বাসুর গলায় পরিয়ে দে।

নুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বাসু তাড়াতাড়ি নুরির দুটো হাতসহ মালাটা নিজের গলায় পরে নিল। তুমুল হাততালি আর চিৎকারের মধ্যে নুরির সঙ্গে বড়বাবুর পরবর্তী কথোপকথন ঢাকা পড়ে গেল। সেই ঢাকা খুলতেই দেখা গেল, বাসুর গলায় মালাটা দিয়েই হাত গুটিয়ে নিয়েছে নুরি। বাসুকে নিজেদের মধ্যে টেনে নিয়ে ততক্ষণে হল্লা জুড়েছে তার স্যাঙাতরা। নুরি হাঁ-বাবুর দিকে তাকাল। তিনি দেখলেন নুরির চোখে জল। হাঁ-বাবু তার কাছে এসে মাথায় হাত রাখলেন। নুরি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, --আমি থাকব না বাসুর সঙ্গে।

হাঁ-বাবু বললেন, --সব্বোনাশ! মেলাভর্তি লোকের মাঝে বাসুকে পুরস্কার দিলাম। এখন সেই পুরস্কার যদি উল্টা গায়, আমার মান থাকে কোথায়?

নুরি বলল, --আচ্ছা, তাইলে আমার দুটা কথা আছে। সেগলা যদি মেনে লাও তালেই আমি রাজি।

--বেশ তো। বল তোর কথা দুটো।

--পরথম কথা, তুমার কুয়াটারে আমাকে থাইকত্যে দিতে হব্যেক। বাসু সঙ্গে থাইকল্যে থাইকব্যেক, না থাকে তো না থাইকব্যেক। পরের কথা, রাইত্যে শুবার আগে যে খেলাটা খেলত্যে, সেটা বন্ধ করা চইলব্যেক নাই।

বড়বাবুর মনে হলো তাঁর মুখের হাঁ বুঝি আর বন্ধ হবে না কোনোদিন।