গল্প - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত
Posted in গল্প১।
উত্তরপাড়া ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে সামনে টুপির দোকানটা দেখতে পেয়েই মনটা আনন্দে ভরে গেল তন্ময়ের। বহুদিন টুপি কেনা হয়না। পরা অবশ্য হয়, কিন্তু সেটা অন্যভাবে। কিন্তু আজকে এই পসার সাজিয়ে বসা দোকানটা দেখে তন্ময়ের সেই ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে গেল।
সেই বাসস্ট্যান্ডের পাশে পোস্টার আর টুপির সমাহার সাজিয়ে বসতো বিহারী দোকানদারগুলো। রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময়ে তন্ময় দেখত – রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, তারপর শাহরুখ খান, অক্ষয় কুমার, ঐশ্বর্য রাই-এর পোস্টারগুলো। টুপি গুলোর দিকেও চোখ যেত – কালো, নীল, লাল-সাদা টুপিগুলোর দিকে, কোনটায় লেখা “ অ্যাডিবাস”, কোনটায় “পুনা”, কোনটায় “রেবক”। তন্ময় তখন জানতো না এগুলো বিশ্ব-বিখ্যাত নামীদামী ব্র্যান্ডের অক্ষম অনুকরণ মাত্র। তবে দেখতে ভালো লাগতো। আর যেহেতু কোনোদিন মা এগুলো কিনে দেন নি, তাই ইচ্ছাটা রয়েই গেছিল।
তা সে যে কারণেই হোক, তন্ময় আজকে একটা টুপি কিনেই ফেলল। টুপি ছাড়া মাথাটা যেন আজকে ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল। দাম দিতে গিয়ে দেখে, “আরে ! টুপি-ওয়ালা ছেলেটা কোথায় গেল !” ভাগ্যিস দামটা লেখা ছিল স্টিকারে, তাই কিউ-আর কোডে পেমেন্ট করে বেরিয়ে এলো তন্ময়।
এবার এখান থেকে অটো ধরবে তন্ময়, বালি-খাল অব্দি, তারপর সেখান থেকে বাস পেলে বাস, শাটল পেলে শাটল। অটো স্ট্যান্ডে এসে দেখে অটো-ওয়ালাগুলো কি নিয়ে জটলা করছে, প্যাসেঞ্জারও নেই, তাই যাওয়ারও ইচ্ছা নেই কারুর-ই। আবছা দু-একটা কথা কানে এলো – “কোথায় হয়েছে?”...”শ্রীরামপুর স্টেশনেই? ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিল?”…“ইস, মাথা থেঁতলে গেচে একদম”…”কি কত্তে যে এরা…”
নির্ঘাত কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আবার শ্রীরামপুরেই ! মনে মনে ভাবে তন্ময়। থাক হেঁটেই সে চলে যাবে আজ বালি-খাল। এদের কাউকে যেতে হবে না। মনটাও ফুরফুরে আছে, নতুন ডিপ ব্লু রঙের টুপিটা পরে।
বালি-খাল পৌঁছে আজ তন্ময় দেখল কপালটা সত্যিই ভালো। তারই জন্য বোধয় দুটো শাটল অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে। তন্ময় একটার পেছনের সিটটায় চেপে বসলো। তার পেছনের সিটে বসতেই ভালো লাগে। লোক থাকলে একটু চাপাচাপি হয়, কিন্তু আজকে তো ফাঁকা। পেছনের সিটে সেই-ই রাজা! দক্ষিনেরশ্বরের পর থেকে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ক্রস করতে করতে তন্ময়ের নিজেকে খুব হাল্কা ফুরফুরে লাগে। টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে সে। ডিপ ব্লু রঙের উপর সাদা সুতো দিয়ে “নাইকি” লেখা।
মনে পড়ল আজকে বাড়িতে ফিরে অবিনাশদার সাথে দেখা করতে হবে। সেলসের কি একটা ভালো জব ওপেনিং আছে। বয়স তো কম হোল না, পঁয়ত্রিশে পা দিল সে এ-বছর - ভাবে তন্ময়। এবারে ভালো মাইনের চাকরির অপরচুনিটিগুলো ধরে নিতে হবে। অবশ্য আজকে তো সে ঝাড়া হাত-পা। সুমনাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে এলো। সেটাও আবার শ্রীরামপুরে। অঞ্জন আসবে কিনা কে জানে ! ওরও তো আজকে ওদিকে যাওয়ার কথা ছিল। কি যেন জায়গাটার নাম – নালিকুল, হ্যাঁ মনে পড়েছে। আগে জানলে একসাথেই ফেরা যেত।
ওরা তিনমূর্তি এক জায়গায় হলেই জ্যোৎস্না বৌদি নানারকম খাবারের ব্যবস্থা করে। ভাবতেই জিভে জল এলো তন্ময়ের।
২।
নারায়নপুর স্টপেজে শাটল থেকে নেমে টাকা বার করে দিতে গিয়েই তন্ময় দেখল গাড়িটা ফট করে ছেড়ে দিল। উফফ, এতো কিসের তাড়া বাপু – ভাবতে ভাবতে ফ্লাই-ওভার থেকে নেমে তন্ময়ের মনে পড়ল সুমনা দোকান থেকে ইস্তিরিগুলো নিয়ে আসতে বলেছিল। চন্দনদার ইস্তিরির দোকানটা আবার ওদের বাড়ির রাস্তার উল্টোদিকে। দু একবার দোনামনা করে তন্ময় ইস্তিরির দোকানের দিকেই পা বাড়াল। আকাশটা মেঘলা করে এসেছে। বৃষ্টি নামার আগেই অবিনাশদার ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়তে হবে। একবার বৃষ্টি নামলে এই ডিপ ব্লু নতুন টুপির দফারফা হয়ে যাবে।
মিনিট দশেক উল্টোদিকে হাঁটার পর তম্নয় হতাশ হোল। দোকান বন্ধ। মানে কালকে আবার আসতে হবে। যাইহোক, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ফিরতে ফিরতে অবিনাশদার ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এসে তন্ময় দূর থেকে পরিচিত একজনকে দেখতে পেল।
অঞ্জন ! কিন্তু হাঁটাটা কেমন অন্যরকম লাগছে না? কেমন টলমল টলমল করে হাঁটছে মনে হচ্ছে। যেন কোন দিকে হুঁশ নেই। একটা সাইকেলের গায়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। তন্ময় চেঁচিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই অবিনাশদার ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল অঞ্জন।
অল্প অল্প কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তন্ময় হাল্কা পা চালিয়ে অবিনাশদার ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে যায়। মাথার টুপিটা খুলতে ইচ্ছা করছিল না তার। অনেকদিন বাদে আজ খুব ফুরফুরে হাল্কা লাগছে।
অবিনাশদার ফ্ল্যাটটা তিনতলায়। অন্যদিন হলে তন্ময় লিফট নেয়। কিন্তু আজকে সিঁড়ি দিয়েই সে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যায়। একতলার সরকাররা অনেকদিন হোল দিল্লিতে শিফট করে গেছে, ওদের বাড়ির ছেলেটা নাকি একদিন গলায় দড়ি দিয়ে… তারপর থেকেই একতলায় কেউ থাকে না। অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে জায়গাটায়। অন্যান্য দিন এই তলাটা লিফটে করে ক্রস করতেও তন্ময়ের কেমন একটা গা ছমছম করে। আজকে করল না।
অবিনাশদার ফ্ল্যাটে পৌঁছে কলিং বেল বাজিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হোল। ভেতরে অবিনাশদার গলা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না? চাপা স্বরে কথা বলছে। কার সঙ্গে? অঞ্জনের জুতো দেখতে পেল তন্ময়, বাইরে ছড়িয়ে রাখা। তাহলে কি…
খুট করে দরজা খুলে যায়, জ্যোৎস্না বৌদি খোলে। দরজা খুলেই তন্ময়কে দেখে ভিরমি খেয়ে, চোখ কপালে তুলে, “মাগো !!” বলে আর্ত চিৎকার করে মাথা ঘুরে পড়ে যায় বৌদি। বসবার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে অবিনাশদা আর অঞ্জন। দুজনের চোখ বিস্ফারিত ! লাল ! দেখে বোঝা যায় দুজনেই কাঁদছিল। অবিনাশদার কথা জড়িয়ে যায়, আঙ্গুল তুলে তন্ময়ের দিকে চেয়ে বলে, “তু তু তুই !! কি করে !!! তন্ময়, কি করে তুই এলি !!” অঞ্জন মেঝেতে বসে পড়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ভাই, তুই আসিস না রে…চলে যা…চলে যা…সুমনাকে আমি বুঝিয়ে বলবো রে…তুই ভাবিস না… চলে যা…”
তন্ময়ের আজকে খুব হাল্কা লাগছে নিজেকে, যেন সে বাতাসে উড়তে পারে। মাথাটাও লাগছে নির্ভার, নতুন টুপিটা ভেজে নি তো - ভেবে আস্তে করে মাথা থেকে সেটা খুলে নেয় সে। খুলতেই তার সব মনে পড়ে যায়। শ্রীরামপুর প্ল্যাটফর্মে ছুটে গিয়ে চলন্ত ট্রেন ধরতে যাওয়া, রড থেকে হাত ফস্কে ছিটকে সোজা ইলেকট্রিক পোলে গিয়ে লাগা, মাথাটা… মাথাটা ভেঙ্গে চৌচির ! ভাবতে ভাবতেই সে তার মাথার ব্রহ্মতালুতে হাত দেয়। অথবা দেওয়ার চেষ্টা করে, কারণ তার মাথা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
প্রচণ্ড হাল্কা লাগে তার নিজেকে। সুমনা, অবিনাশ দা, অঞ্জনদের পৃথিবী থেকে সে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। পড়ে থাকে ডিপ ব্লু রঙের একটা টুপি,যার উপর সাদা সুতো দিয়ে “নাইকি” লেখা।