প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধআরও একটা হাড় হিম করা অমানবিক অত্যাচার ও মৃত্যু ঘটে গেল কলকাতা শহরের বুকে। আর জি কর হাসপাতালের এক মহিলা ডাক্তার জঘন্যতম এক মানুষের লালসার শিকার হোল। সারা দেশের সাথে এ শহরের সব ডাক্তার, পড়ুয়া নার্স স্বাস্থ্যকর্মীসহ সাধারণ নাগরিক বিক্ষুব্ধ, রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। প্রতিবাদের সবরকম ভাষায় তাদের আন্দোলন চলছে। রাজ্য-রাজনীতিতে তার আঁচ পড়ছে। রাজ্যের উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ এবং আদেশে সিবিআই অনুসন্ধান শুরু করেছে।
বেশ কিছু সময় ধরে দেখা যাচ্ছে যৌন অত্যাচারের পর কোনো মেয়েকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় সম্ভবত কোনরকম সাক্ষী না রাখার জন্য যার থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে খুনি ও হত্যাকারী অত্যাচারিতের পরিচিত। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এ ছাড়াও অত্যাচারী তথা হত্যাকারী কারোর আদেশমত অর্থের বিনিময়ে অথবা কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে তাকে দিয়ে একাজ করায়। অনেকসময় কোন গোপন তথ্য জেনে ফেলায় তাকে সরিয়ে ফেলা হয় তবে এক্ষেত্রে পুরুষ বা মহিলা যে কেউ হতে পারে। তবে মহিলা হলে যৌন অত্যাচারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না ঘাতক।
আমাদের সমাজে নারীরা সুরক্ষিত নয়, পুরুষের লালসার শিকার হয় হামেশাই, শহর থেকে গ্রাম একই চিত্র। আবার সময়কেও ছাড়িয়ে যায় হাজার হাজার বছর। অথচ এই সমাজেই কিছু লোক আছেন যারা নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু পুরুষত্ব দাবী করে নারী দুর্বল। কল্প বিজ্ঞান সাহিত্যে সুপ্রসিদ্ধ আর্থার ক্লার্কের একটা গল্পের ছবির নাম 2001 : A Space Odyssey। ১৯৬৮ সালের এই গল্পে পৃথিবীর নানা বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক ভবিতব্য সম্বন্ধে রেখাপাত করলেও নারীরা যে পুরুষের সহকারীমাত্র – এই ধারণার বাইরে বেরোতে পারেননি তিনি। ভাবী ২০০১ সালের নারীদের এভাবেই দেখেছেন সাহিত্যে। অথচ গল্প প্রকাশের দু বছর পর ১৯৭০-এই সমাজে মহিলাদের যোগ্য সম্মানের অধিকারে পশ্চিমী দেশগুলোর সাথে সাথে সারা পৃথিবী জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। নারীরা যে শুধু গৃহবধূ, মাতৃত্ব রক্ষা এবং পুরুষদের যৌন সঙ্গী, এই ধারণা থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলন। আর এর থেকেই জন্ম নেয় নারী মুক্তি আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নারীকে তার অধিকার পাইয়ে দেবার আহ্বান জানিয়েছেন এর বহু বছর আগে কবিতায় গল্পে প্রবন্ধে। কিন্তু এবারের আন্দোলন অধিকার ও মুক্তি ছিনিয়ে নেওয়ার। এই শৃঙ্খলের বাইরে বের করে আনার আন্দোলন। সব মানুষের সমান অধিকার মুখে বলা হলেও নারীরা বঞ্চিতই থেকে যায় দেশে সমাজে পরিবারে।
সন্তান পালন আর গৃহকর্মের মত কাজের জন্য নারী আর পুরুষেরা শক্তি প্রধান কাজের জন্য শারীরিকভাবে গঠিত, এমনটাই প্রচলিত যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে লালিত হয়ে আসছে। কিন্তু চার্লস ডারউইন মানব বিবর্তনের ব্যাখ্যায় সেরকম কিছু বলেননি। জিনগত কোনো পার্থক্য নেই। প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় – নারী ও পুরুষ সংখ্যায় সমান, তাদের শারীরিক ও মস্তিষ্কের গঠনে পার্থক্য নেই এবং দুজনেরই বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন তাও সমান। এমনও নয় যে পুরুষের আগমন মঙ্গল গ্রহ থেকে আর নারী এসেছে শুক্র গ্রহ থেকে। মানুষের আবির্ভাব উদ্ভব বিবর্তন এবং পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আগে বাসস্থান ছিল মূলত আফ্রিকায়। সেখানে অন্য আর সব প্রাণীর মত মানুষও এক জাতীয় প্রাণী, মস্তিষ্ক গঠনের তারতম্যে মানুষ অন্যদের থেকে স্মৃতি চিন্তা সিদ্ধান্তে উন্নত। শুধুমাত্র একটা Y-ক্রোমোজোমের পার্থক্যই মানুষের মধ্যে নারী ও পুরুষের এত ভেদ তৈরি করে দিল! অথচ এই দুই লিঙ্গের মানুষের মধ্যে চিন্তা আবেগ কাজকর্ম ভাষা শিক্ষা সবই সমান, একরকম। তবে কিছু মনোবিদের মতে পুরুষের মন নারীদের থেকে আলাদা, পুরুষের মন যৌনাবেগে পূর্ণ এবং এই কারণেই তারা হিংস্র। সন্তান পালন নারীকে অধিক ভাবাবেগ ও সহানুভূতিশীল করেছে। অথচ এসব ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয়। নারী ও পুরুষের প্রচলিত ভেদাভেদ মনুষ্যসৃষ্ট। আর কোনো প্রাণীর মধ্যে এই ভেদ দেখা যায় না। কিন্তু মানুষের চোখে প্রথমেই ধরা পড়ে একজন নারী না পুরুষ! প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই লিঙ্গ বৈষম্যর জন্যই নারী ও পুরুষের মধ্যে টক্কর, প্রতিযোগিতা।
স্ত্রী জীবকে জয় এবং তাকে বশ্যতা স্বীকার করানো প্রায় সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণিরই প্রধান চরিত্র। পুরুষ প্রাণির বহুগমন এবং বহু সঙ্গ দ্বারা সন্তান উৎপাদন প্রবণতা পূর্বতন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে জিনবাহিত হয়ে মানুষে এসেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ স্ত্রী জীবকে সন্তান ধারণ করতে হয় এবং তার জন্য পরবর্তী যৌন সঙ্গমের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। পুরুষ প্রাণী সে দায় থেকে মুক্ত। ডারউইনের যৌনেচ্ছা সংক্রান্ত বইয়ে স্ত্রী ও পুরুষের যৌন সঙ্গমের ইচ্ছায় কোনো বৈষম্য নেই, মানুষের ক্ষেত্রেও নেই। শুধুমাত্র সন্তান ধারণের জন্য নারীর ইচ্ছা দমনে কিছু সময় সংযমের বাধ্যবাধকতা। সন্তান পালনে পরিবার ও সমাজের শিক্ষাও দায়ী বৈষম্যের বীজ বপনে। মানুষ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখানোর বদলে নারী ও পুরুষ হওয়ার মেকি-বাস্তবতার কথা বলি।
প্রতিটি প্রাণীর নিজের পছন্দমতো যৌন সঙ্গী বেছে নেওয়ার প্রথা আছে। পুরুষেরা একদিকে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে পৌরুষত্ব প্রমাণে ব্যস্ত অন্যদিকে নিজের সৌন্দর্য বিকাশ করে নারীদের প্রলোভিত করার প্রয়াস জারি থাকে। আবার স্ত্রী প্রাণিরাও নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে প্রভাবিত করে। আবার সেই প্রাণী জগতেই জোর করে যৌন সঙ্গমে বাধ্য করার প্রবণতা আছে। পোকামাকড় পাখি থেকে শুরু করে গরিলা ওরাংওটাং শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও এরকম জোর করে যৌন সঙ্গম করার প্রথা চলে আসছে। বিবর্তনের হাত ধরেই এই প্রথা মানুষের মধ্যে চলে এসেছে। কিন্তু যেহেতু মানুষের মস্তিষ্কে ভাল-মন্দ বিচারের বুদ্ধি কাজ করে তাই তার পক্ষে সংযম রক্ষা করাও সহজ। কিন্তু যংযম রক্ষায় যে পুরুষরা ব্যর্থ। তারা নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগে যে সঙ্গম করে তাকেই বলে রেপ বা ধর্ষণ। এই ধরনের যৌন সঙ্গমে শারীরিক আঘাত ও ক্ষতি তো হয়ই কিন্তু সবার চেয়ে বেশি আঘাত পায় মানবতা, যে-গুণের জন্য মানুষ মানুষ হয়ে উঠেছে। দৈহিক ধর্ষণ শুধু দেহকেই আঘাত করে না, আত্মাকে, মানবাত্মাকে খতম করে। প্রতিটি ধর্ষণ, সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, প্রতিবার মানবাত্মাকে ধর্ষণ করছে, মারছে। দুঃখের কথা যে এই এত বছরের সভ্যতা সমাজ দর্শন বিজ্ঞান ধর্ম আমাদের মানবতাকে রক্ষা করার উন্নত করার কোন শিক্ষাই দিল না।
পুরুষ মানুষ কেন ধর্ষণ করে? বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী র্যান্ডি থর্নবিল এবং মনোবিজ্ঞানী ক্রেগ পামার তাঁদের A Natural History of Rape বইতে বলেছেন, “Rape is an abuse of power and control in which the rapist seeks to humiliate, shame, embarrass, degrade, and terrify the victim.” শুধুমাত্র যৌন ইচ্ছাই নয়, যৌনকর্মের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রদর্শন।
মানবতা প্রথম বধ হয় যখন কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হয়। আর মানবতাকে দ্বিতীয়বার মরতে হয় যখন আদালতে দাঁড়িয়ে কোনো নারীকে জনসমক্ষে প্রমাণ করতে বলা হয় যে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আজকাল অবশ্য তৃতীয় দফায় আরও একবার মৃত ধর্ষিতার বাবা ও মা এবং পরিজনদের কাছে মানবতার মরণ হয় যখন সংবাদ, সংবাদপত্র এবং সমাজমাধ্যমে বারবার ‘ধর্ষণ’ কথাটা উল্লেখ করা হয়। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যে তোমাদের মেয়ে ধর্ষিতা ছাড়া আর কেউ নয়, কোনো পরিচয় নেই। এ বড়ই বেদনাদায়ক হতাশাব্যঞ্জক দায়িত্বহীন সমাজের। যদিও শব্দ শব্দইমাত্র তবু তার ব্যবহার যখন সুখকর নয় তখন এই ধরনের শব্দ পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়, প্রতিশব্দ ব্যবহার করা আবশ্যক। এই ধরনের সমাজ, আইনব্যবস্থা ও প্রচারমাধ্যম মানব সমাজের কোন অগ্রগতি বহন করবে তা আমার জানা নেই।
পুরুষেরা এটা অনেকদিন আগেই আবিষ্কার করেছে যে তার পুরুষাঙ্গই হচ্ছে নারীকে বাগে আনার বা শাস্তি দেওয়ার একমাত্র অস্ত্র। “Man’s discovery that his genitalia could serve as a weapon to generate fear must rank as one of the most important discoveries of prehistoric times, along with the use of fire and the first crude stone axe….all men keep women in a state of fear.” ব্রাউন মিলার তাঁর Against Our Will: Man, Women and Rape বইতে নির্দ্বিধায় লিখেছেন। কথাটা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। সত্যিই যদি শুধু যৌন উপভোগের জন্য কেউ ব্যস্ত হন তাঁর জন্য পতিতালয় খোলা আছে। কিন্তু না, তা নয়। মনে ধরেছে এমন নারী সঙ্গই করতে হবে, এরকম বাসনা থেকেই প্রথমে জন্মায় সেই নারীকে কাছে পাওয়া। যখন কোনো ভাবেই তা সম্ভব হয় না তখনই জোর করে তার সঙ্গ আদায় করা হোল একটা প্রথা। অন্য প্রকার ধর্ষণও আছে যেমন বিধর্মী বা নিম্নজাতের মেয়েকে ভয় দেখিয়ে জোর করে ধর্ষণ; কোনো পরিবার বা ব্যক্তি বা কোনো নারীর ওপর প্রতিহিংসা – সেখানে সঙ্গমের ইচ্ছে থেকে বড় হোল সেই পরিবার বা ব্যক্তি বা নারীকে শিক্ষা দেবার জন্য। নিরাপত্তা রক্ষীরা যেমন পুলিশ, মিলিটারি অনেক সময় গ্রামের মহিলাকে ধর্ষণ করেছে বলে খবর আসে। সেখানে আনন্দ পাওয়ার থেকে ক্ষমতা প্রদর্শনে আতঙ্ক সৃষ্টি করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং শাসকের মধ্যে কিছু আছে যারা ক্ষমতার দম্ভে ধর্ষণের মত কামলালসায় উন্মত্ত হয়। অনেক আগে বংশ রক্ষার জন্য শ্বশুরমশাই পুত্রবধূর গর্ভে সন্তানের বীজ পুঁততেন। এটাও এক ধরনের ধর্ষণ কারণ পুত্রবধূর অমতেই বা ভুল-বুঝিয়ে জোর করে এমন কাজ করানো হোত। সামাজিক ভয়ে এইসব নারীরা মুখ বুজেই অত্যাচার সহ্য করেন। এমনকি স্ত্রীর অমতে স্বামী জোর করে যৌন মিলন করলে তা ধর্ষণের সংজ্ঞায় চলে আসে।
যৌন সঙ্গী নির্বাচন প্রতিটি প্রাণির মধ্যেই রয়েছে এবং প্রতিটি প্রাণিই ধর্ষণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে, “প্রাণী জগতের সংসার” পাঠ করে ডারউইনের এই উপলব্ধি হয়েছিল। তবু যখন এই ধরনের কাজ করা হয় তখন স্ত্রী প্রাণির সঙ্গী নির্বাচন অধিকারকেই খর্ব করা হয়। ডারউইন দেখিয়েছেন যে স্ত্রী প্রাণির এই মানসিকতাই প্রাধান্য পায় যে তার সন্তানের যে জন্মদাতা হবে সে তার সন্তানের দায় দায়িত্বও পালন করবে। কিন্তু যে সমস্ত পুরুষ প্রাণী ধর্ষণ কার্যে লিপ্ত হয় তাদের থেকে এ ধরনের দায়িত্ব আশা করা যায় না। মানুষের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই।
সামাজিক হেনস্থা লজ্জা ছাড়াও এবং মানবতা হত্যা ছাড়াও অন্য সামাজিক অসম্মানের সম্মুখীন হতে হয় যখন সেই ধর্ষিতা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। সমীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা পাঁচ শতাংশ সন্তান-গর্ভধারণ-ক্ষমতা সম্পন্ন মহিলার গর্ভে ভ্রূণ সঞ্চার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর জন্য নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয় আর ধর্ষণকারী বেমালুম সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। এইরকম একটা সমস্যায় নারীর গর্ভপাত করা ছাড়া উপায় থাকে না। এরকম একটা ব্যাপক ভ্রূণসঞ্চার ও গর্ভপাতের বিবরণ পাওয়া যায় ১৮৩০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত এশিয়াটিক জার্নালের প্রথম ভল্যুমের ১১ সংখ্যায়। রামু নাথি নামে এক সংস্কৃত পণ্ডিত আইডলেটরি ইন ইন্ডিয়া শীর্ষক এক বিতর্ক সভায় এটি পাঠ করেন। বিতর্ক সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজের কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়ামের হলে। সেখানে অস্বাভাবিক মাত্রায় অবৈধ সন্তান নষ্ট করে ফেলার কথা বলা হয়েছে। যে সমস্ত কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়েরা স্বামীহারা বা স্বামী বৃদ্ধ-অথর্ব সেসব ঘরে প্রতি বছর একটি করে অবৈধ সন্তান গর্ভে ধারণ করে সেই কন্যা এবং তাকে অবৈধভাবে দেশীয় পদ্ধতিতে নষ্ট করা হয়ে থাকে। সারা দেশেই এই কর্মকাণ্ড চলেছে এবং কেবলমাত্র বেঙ্গল প্রভিন্সেই প্রতি মাসে দশ হাজার সন্তান ভ্রূণ নষ্ট করা হয়ে থাকে। আবার এই টোটকা পদ্ধতিতে অনেক নারীর মৃত্যুও ঘটে। ১৯০ বছর আগের এই ছবিটার সাথে আজকের দিনের যে সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যমে বেরোয় তার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। এইসব নারীদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্ষিতা এ নিয়ে সংশয়ের স্থান নেই। এবং তখনকার মতোই আজও নারীকে এইসব অসামাজিক কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত করার রেওয়াজ চলে আসছে। নারীদের যৌন কর্মে জোর করা, বাধ্য করা ও ধর্ষণ করা এক শ্রেণি পুরুষদের মধ্যে বহু যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক ব্যধি। সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতি এই ব্যধিকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে বলে এর শেষ নেই।
ধর্ষণ নিঃসন্দেহে সহিংস জঘন্য সামাজিক ও আইনি অপরাধ। নারী অপহরণ ও ধর্ষণ অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে অন্যতম প্রধান। সমাজের যে কোনো আইন শৃঙ্খলার অবনতিতে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেমন, দাঙ্গা, যুদ্ধ, এমনকি ডাকাতির সময়ও। আবার অন্য সময় বিনা প্ররোচনায় ধর্ষণ হয়ে থাকে। সভ্যতা অগ্রগতির সাথে ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অপরাধের সংখ্যা কমেছে কি? অনেকে বিশ্বাস করেন তাই। অনেকে মনে করেন নারীবাদী আন্দোলনের ফলে জনজাগরণ হয়েছে। আর তাই সামাজিক ও আইন কানুন অনেক শক্ত হয়েছে। কিন্তু অপরাধীর শাস্তি যদি দৃষ্টান্তমূলক না হয় তবে অপরাধের সংখ্যা কমবে না। সেইসাথে আদালতে বিচারের ব্যবস্থা যাতে ধর্ষিতার পক্ষে সম্মানজনক এবং দ্রুত বিচার হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে পুরুষ ধর্ষণ করে বলে পুরুষমাত্রই হ্যাবিচুয়াল ধর্ষক নয়।
নারীর উত্তেজক পোশাক পুরুষকে উত্তেজিত করে বলে মানে অনেকে। তাহলে অর্ধ-উলঙ্গ পুরুষও নারীকে উত্তেজিত করে কি? এশিয়াটিক জার্নালের পূর্বোক্ত সংখ্যায় আর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তৎকালীন ‘অসভ্য’ সমাজের একটা চিত্র। সে সময় কিছু জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো এবং গঙ্গায় বিসর্জনের সময় দুটো নৌকা নেওয়া হোত। একটায় প্রতিমার সাথে পুরুষেরা অন্যটায় শুধু বাড়ির মহিলারা। নৌকা ছাড়ার পর পুরুষেরা সব উলঙ্গ হয়ে ঢাকের বাদ্যির সাথে উদ্দাম নৃত্য করত। মহিলাদের নৌকা অনতিদূরেই থাকত। পুরুষদের এও এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। এর পরিচয় পার্কে বাসে ট্রেনে সিনেমা হলে পাওয়া যায়।
হাসপাতালে মহিলা ডাক্তারের প্রতি এই নৃশংস যৌন-অত্যাচার ও হত্যার প্রতিবাদ সমাজের সমস্ত স্তর থেকে উঠে আসুক, আইনকে বাধ্য করা হোক দ্রুত বিচারের এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। কিন্তু ধর্ম, রাজনীতি, শাসক/রাষ্ট্র পোষিত এই অপরাধের শেষ কীভাবে করা সম্ভব তা সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মানববিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানীদের ভাবতে হবে যে কীভাবে মানুষকে বোঝানো যায় ধর্ষণ শুধু দৈহিক অত্যাচার নয়, মানবতা হত্যা। ধর্মীয় শাসক, রাষ্ট্রের শাসক, আইনের শাসক আপনারা অতি দ্রুত কাজ করুন দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আগে একে শেষ করতে হবে। মানবতার এই চরম মৃত্যু কাম্য নয়।