Next
Previous
0

প্রবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in







কবি মণীন্দ্র গুপ্ত পাঁচ-এর দশকের শেষের ও ছ’য়ের দশকের শুরুর দিকে কবিতা লিখতে শুরু করলেও, আধুনিকতার যে ইয়োরোপীয় ভাবনায় তাঁর সমসময়ের সাহিত্য রচিত হচ্ছিল, তিনি তার থেকে একটু আলাদা ছিলেন। এমনটা নয়, তিনি তাঁর কাব্যভাষায় ও কাব্যদর্শনে প্রাচীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। বরং, তিনি তাঁর সারাজীবনের কাব্যকৃতি এবং কাব্যদর্শনে চিরায়ত সংস্কৃতিকে ধরতে চেয়েছেন দেশজ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে। তিনি পুরনোকে অবিকল হাজির করেননি, কিন্তু পুরনোকে তার ঐতিহাসিক ভিত্তির জায়গা থেকেই নতুন ভাবে দেখেছেন। তাই বিভিন্ন লোকসাহিত্য, লোককথা, পুরাণ, টোটেম, প্রতীক ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায় আধুনিকতার অনুষঙ্গে। আমার এই গবেষণা পত্রের কাজই হল, ষাট দশকের কবিদের পাশাপাশি মণীন্দ্র গুপ্তের কাব্যভুবন কীভাবে আলাদা, তার এক পর্যালোচনা করা।

মণীন্দ্র গুপ্তের প্রয়াণের পরে ‘স্বকাল পত্রিকা’ ও ‘আদম পত্রিকা’ মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যা প্রকাশ করেছে ২০১৮ সালে। সেখানে তাঁকে নিয়ে প্রচুর নিবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন সময়ের কবি ও লেখকরা। এ ছাড়া মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে তেমন ভাবে কোনও আলোচনা বা গবেষণা হয়নি। সেভাবে বলতে গেলে, এই গবেষণাপত্রই বাংলা সাহিত্যের এই প্রখ্যাত কবিকে নিয়ে প্রথম গবেষণাপত্র।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কবিতার মধ্যে যে স্মার্ট নাগরিকতা এবং বিপন্ন অস্তিত্বের ভাষ্য আমরা খুঁজে পেলাম, তার একধরনের পরিবর্ধন দেখা যেতে লাগল ষাটের বা ছ-এর দশকে। আমরা পেলাম ‘বালক জানে না’-এর কবি সুব্রত চক্রবর্তীকে, পেলাম ‘ব্যান্ডমাস্টার’-এর কবি তুষার রায়কে, ‘অন্ধ স্কুলে ঘন্টা বাজছে’-এর কবি দেবারতি মিত্রকে এবং 'অবশ্যই শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'-এর কবি ভাস্কর চক্রবর্তীকে। সঙ্গে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে, পাঁচ-এর দশকের কবিদের কবিতা অনেক বেশি সংহত রূপ ধারণ করল এই ছয়ের দশকেই। পাঁচ-এর দশকের অনেকের-ই প্রথম কবিতার বইও এই ছয়ের দশকেই বেরোন। ফলে, এ কথাও বলা যেতে পারে, যে ছয়ের দশক হল পাঁচ-এর দশকের কবিদের নিজেদের ভাবনা ও কাব্যভাষা খুঁজে পাওয়ার দশক। অনেকটা আশ্চর্যরকম ভাবেই, ভাস্কর চক্রবর্তী এবং তুষার রায় তাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই খুঁজে পেয়েছিলেন এক অনন্য কাব্যভাষা। একদিকে তুষার রায়ের 'ব্যান্ড মাস্টারে' যেমন ছিল এক নাগরিক কবির প্রবল অস্তিত্বসংকটের ভাষ্যের সঙ্গে মৃত্যুবোধের অমোঘ মিথষ্ক্রিয়া, তেমন আরেকদিকে ভাস্করের কবিতায় ছিল জীবনানন্দ কথিত বিপন্ন বিস্ময়ের এক নাগরিক যাপনের ভাষ্য। 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'র পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতে যেমন ভাস্কর অনেক বেশি তীক্ষ্ণ হয়েছেন। ছয়ের দশকের এই কাব্যচর্চায় কীভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা ভিন্ন এক দিগন্ত তুলে ধরেছে , তা-ই এই গবেষণায় অন্যতম সূচনাবিন্দু।


কেমন ছিল তাঁর কবিকৃতি? ষাট দশকের আশেপাশে তিনি যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, তখন তাঁর পাশাপাশি রয়েছে কৃত্তিবাসের কবিরা। সহজেই তিনি প্রভাবিত হতে পারতেন তাঁদের দ্বারা। প্রভাবিত হতে পারতেন কৃত্তিবাসের পাশাপাশি শতভিষা পত্রিকার আবহমান নীচু স্বরে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যব্যক্তিত্ব দ্বারাও।

কিন্তু কবি মণীন্দ্র গুপ্তের মধ্যে ছিল এক নতুন কাব্যভাষার খোঁজ। আর মানসিক ভাবে তিনি বহুস্বরে বিশ্বাসী এক কবি ছিলেন। যখন নাগরিকতার চিত্রকল্প, একাকী মানুষের বিষাদ এবং প্রকৃতির সঙ্গে উচ্ছসিত যাপনের এক ধারাবাহিক লেখার পৃথিবী ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতায়, তিনি একটু অন্য পথে হাঁটা শুরু করলেন। বাংলার দেশজ চিত্রকল্পের কাছে ফিরে গেলেন। ফিরে গেলেন মানুষের কাছে। মানুষের কথ্য ভাষায় ব্যবহৃত নানা ঘটনা, লোককথা, লোকসংস্কৃতি, প্রবাদ, ধর্মীয় বিশ্বাস, টোটেম, আর এ সমস্ত কিছুর অনাবিল শব্দভাণ্ডার তাঁর জীবনকে এবং কাব্যভাষাকে গড়ে তুললো। তিনি অন্বেষণ করতে লাগলেন এমন সব শব্দের, এমন সব চিত্রকল্পের, যা আবহমান কাল ধরে বাংলার সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। সেই সব শিকড়ভেজা শব্দগুলিকে তিনি নতুন করে প্রাণ দিলেন তাঁর কবিতায়।


যেমন, তাঁর এই কবিতাটির মধ্যেই তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভাষা স্পষ্ট-


কিন্তু ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় দেখা যায়, সেই ভূত একলা

ভিখারিনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে শেয়ালনী ছোট্ট মাথাটিকে দুই পায়ের মধ্যে রেখে

কাঁকড়া খাবার মতো করে এক কামড়ে ভেঙে দিলে

বাচ্চাটা ককিয়ে উঠল: মা!

শেয়ালনী করুণ স্বরে ‘বাছা, এই তো আমি— ’ বলে

ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে খেতে লাগল।

(মাহাতদের মরা শিশু, লাল স্কুলবাড়ি,১৯৭৮)



কিন্তু এই প্রাণপ্রতিষ্ঠা পুরনোর কাছে ফিরে যাওয়া হল না। বরং পুরনোকে, শিকড়কে নতুন ভাষার, নতুন ব্যাখ্যার এবং নতুন দৃষ্টিকোণের প্রেক্ষিতে হয়ে উঠলো প্রকৃতই উত্তরাধুনিক এক কাব্যবীক্ষা। আলোচ্য গবেষণায় মণীন্দ্র গুপ্ত কীভাবে তাঁর অধুনান্তিক কাব্যভাষা গড়ে তুলেছিলেন এবং কেনই বা তাঁর কাব্যভাষাকে আধুনিকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে অধুনান্তিকতার পথে উত্তীর্ণ বলে গবেষকের মনে হচ্ছে, তার এক যুক্তিগ্রাহ্য অনুসন্ধান থাকবে। এই আলোচনার পরিসরে আলোচিত হবে তাঁর প্রথম থেকে শেষতম কাব্যগ্রন্থ, তাঁর কাব্যভাবনা, কবিতা সংক্রান্ত গদ্য এবং প্রবন্ধ। আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “আধুনিকতা কাকে বলে? আমি অন্তত তার সংজ্ঞা জানি না। ‘আধুনিকতা’ এই ধারণাটিকে যদি প্রগতির সঙ্গে যুক্ত করি, কিংবা উত্তরোত্তর আধুনিকের লক্ষণ অনুসন্ধান করি তবে শব্দটি ও তার অর্থ অনিত্য ও অস্থির হয়ে যাবে।

আধুনিকতার সঙ্গে আমি সময়ের স্রোত যোগ দিতে চাই না। সমকালীনতা না, ধ্রুবতাও না। আমি ভাবি ফুরফুরে চিরকালের নির্যাস— চির-জীবনবোধের তন্মাত্র, তার আভা।

এ কথা অন্য সব বিষয়ে যেমন, কবিতাতেও তেমনি। ধরা যাক পোশাকের কথা— ইন্দ্রের চক্ষুর মতো পকেটময় একালীন জিনস না কি সন্ন্যাসীর কপনি-বহির্বাস-সাপি, সীবনহীন আর্য ধুতি চাদর, রোমান টোগা, সেমাইট আলখাল্লা বা মায়া পন্‌চো? আমার তো মনে হয়, শত শত জগঝম্প জরদ্গ‌ব পোশাকের (মিউজিয়ম, রাজ্যাভিষেক ও পার্টি দ্রষ্টব্য) বিপরীতে ঐ সব পোশাকই আধুনিক। সন্ন্যাসীর কপনি আধুনিকেরও আধুনিক।

গ্রীকরা তো শেষ লড়াইয়ে যেতেন পুরো বিবস্ত্র হয়ে। তেমনি শেষ কবিতার বেলায় কোনো আভরণ, আড়াল থাকবে না। এতদিনের এত যে যুদ্ধ শেখা তা কেবল ঠিক লক্ষ্যে আঘাত করার জন্যে। হত্যার মতো মৌলিক, মৃত্যু পেরিয়ে আসার মতো সহাস্য— এ শুধু পাওয়া যাবে যদি শরীর দিয়ে শরীরকে আঘাত করি, অস্ত্রাঘাত করি এবং করতে দিই সোজা নিরাবরণ চামড়ায়।

ঐ মরণপণ যুদ্ধের কথা ভাবলে আধুনিকতার ধারণা খুঁজে পাই। নিপুণ, নির্ভয়, অপ্রমত্ত, সংস্কারশূন্য ঐ সংঘর্ষের সঙ্গে ও শেষে আছে তার প্রাপণীয়: জীবন ও জগৎ উপভোগের অনিঃশেষ আনন্দ। অবস্থাটা একটি গল্প দিয়ে স্বচ্ছ করি:

জেন গুরু রিয়োকান নির্জন পাহাড়তলিতে ছোট একটি কুটিরে সরলতম জীবন যাপন করতেন। একদিন তিনি বাড়ি নেই। সন্ধেবেলায এক চোর এসে দেখল, চুরি করার মতো কিছুই নেই সেখানে। ইতিমধ্যে রিয়োকান ফিরে এলেন এবং চোরকে ধরলেন। ‘তুমি হয়তো দীর্ঘ পথ হেঁটে আমাকে দেখতে এসেছ’, সেই নিঃশব্দচরকে বললেন তিনি, ‘তোমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। অনুগ্রহ করে আমার পোশাকটিই উপহার হিসেবে নাও।’

প্রাসঙ্গিক ভাবেই, তাঁর সাক্ষাৎকারও আলোচিত হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর গদ্য থেকেও তুলে আনা হবে এই গবেষণার উপযোগী বিষয়। আমার এই গবেষণার উদ্দেশ্য মণীন্দ্র গুপ্ত-র এই কাব্যভুবন ও কাব্যমানচিত্রকে অনুসরণ করা। বাংলা কবিতার সরণ মণীন্দ্র গুপ্ত-র কাব্যভাষার হাত ধরেই আগামী কাব্যভাষায় প্রবেশ করতে চলেছে। তার বীজ এবং আলোকবর্তিকা রয়েছে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাতেই।
কেন ছয়ের দশকের কবিদের থেকে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার স্বর ভিন্ন, শুধু সে কথাই নয়, আমরা আলোচ্য গবেষণায় দেখব কীভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা আগামী পাঁচ দশকের বাংলা কবিতার জগতে এক ভিন্ন স্বর আনয়ন করল।


কিন্তু ছয়ের দশকের এই কবিতাগুলির বিপ্রতীপে যেন অবস্থান করছে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা। এর একটা কারণ কবি মণীন্দ্র গুপ্ত প্রথম থেকেই এই নাগরিক বিপন্নতার বাইরের লোক ছিলেন। আর আরেকটা কারণ কবি মণীন্দ্র গুপ্তের ভাবনার ভিতরে কাজ করেছিল একধরনের অন্য বিপন্নতা। আর সেই বিপন্নতার নাম মৃত্যুবোধ। কিন্তু এই মৃত্যুবোধ কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে মৃত্যুবিলাসী করে তোলেনি। বরং অনেক বেশি করে টেনে নিয়ে গেছে বাংলার স্বতন্ত্র ধারার যাপনের কাছে। মানুষের ভাবনা, চিন্তা, দর্শন, সংস্কৃতি, রীতি, আচার এবং নিজস্ব এক দর্শনের জগতে তিনি অবগাহন করেছিলেন। যেমন, আমরা উদাহরণ হিসেবে তাঁরই কবিতা থেকে তুলে আনতে পারি তেমনই মণিমুক্তো-

যেমন-
এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কি না।
এখন ওসব কথা থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো ফুল পেকেছে, চলো খেয়ে আসি।
লাল রুখু চুল
সূর্যাস্তের মধ্যে
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
--দেখি দেখি তোমার তামাটে মুখখানা দেখি!


আমরা দেখি মণীন্দ্র কবিতাপাঠ আসলে এক দীর্ঘ যাত্রা। ঠিক ওই মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়ার মতো। যার আদি আছে অন্ত নেই।