ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
(১৯)
গভীর রাতে ঘুম ভাঙতেই গোলকপতি দেখতে পেল যে শৈলবালা তার দুটো চোখে অসংখ্য মুক্তোদানার মত অশ্রু ঝলোমলো হয়ে বাইরের ঘরের চৌকাঠে এসে চুপ করে বোবার মত একদিকে খানিক চুপ করে বসে আছে।
সে রাত্রিটিতে দিগন্তের স্তব্ধবাক আলোহীন সেই ঘনায়মান পটভূমিকায় তাকে যেন অলৌকিক জগতের একজন অতি অপরিচিত নারীর মত দেখাচ্ছে। গোলকপতির তখন যদিও ওর কাছে গিয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা করছিল, তাও সে সেইমুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখতেই বেশী সচেষ্ট হল।
সে ওই ক্রন্দনরতা নারীমুখটি দেখতে দেখতে ভাবছিল যে সেদিনের পরে আরও দুটো রাত এখানে নিরাপদে কেটে গেলেও হৈমবালার বাহ্যিক আচরণটিতে তবুও যেন ঠিকমতভাবে স্বাভাবিকতা এল না।
.....
বসতবাটির পশ্চিমাস্যে রামানন্দের মূল চালাঘরটি বেষ্টন করে আছে আর একটি ছোট চালাঘর। এই ঘরটিতে এর আগে একদা সুদূরবর্তী জনপদ দেগঙ্গা থেকে আগত এক বৃদ্ধ কারিগর তার আশ্রয়ে এসে থাকত। সে পেশায় তন্তুবায় হলেও ছিল শিল্পীমনস্ক ও খামখেয়ালি প্রকৃতির। মাঝেমধ্যে কাজ ফেলে রেখে সে ভারী মিঠে গলায় বৈদ্যকবিরাজ রামপ্রসাদ সেনের কালীকীর্তনের তানকর্তবে মাতিয়ে রাখত সারাৎসারের দীনতা লাঞ্ছিত জনজীবন। তার উদাস দৃষ্টির সামনে রামানন্দ মাঝেমাঝে যেন থই খুঁজে পেতনা। তবে তার হাতে বোনা সুরুচিকর ও শৌখিন পাছাপেড়ে কাপড় এই কয়েকবছর আগেও এদিকে বেশ চলত।
যদিও আজকাল সুতীর কাপড়জামা যেন ক্রমে তার জৌলুস হারিয়ে ইংরেজদের কদর করা পোশাকেই সবার মন টানছে।
বৃদ্ধ কারিগরটি সম্প্রতি লোকান্তরিত হওয়ায় তার শূন্য চালাটির দুটি ঘরে নামমাত্র সিক্কার বিনিময়ে এদের দিনকয়েকের আশ্রয় মিলেছে।
গোলকপতিকে রামানন্দের এত খাতির করার কারণ হল যে তার হস্তক্ষেপে রাজবাড়ির অন্দরে কাপড়ের ফরমায়েশে মনযোগ দেওয়া। কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠিত ফড়ে বা মাঝারি আড়তদারদের দৌলতে ছোট গঞ্জ এলাকায় কারবার চালিয়ে বড়লোক হওয়া বেশ কঠিন। সে উচ্চাভিলাষী হলেও অসৎ নয়।
......
শৈলবালার জীবনটিকে তার নিজের সাথে হুট করে জড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্তটি একটু হঠকারী হয়ে গেল? তখন সেই বিষাদসিন্ধুর ঢেউতোলা তার ক্রন্দন উদ্ভাসি মুখটা দেখে নিজের অন্তরে যেন তপ্ত শেলবিদ্ধের অনুভব হয়।
অবশ্য পরক্ষণেই সে এসবের পরিবর্তে শৈল'র সম্ভাব্য লেলিহান চিতাগ্নি ও সহমরণের কল্পিত দৃশ্যটি তার মনে আসলে সে তখন তার কর্মফলের চিরায়ত ভয়টিকে একটু দূরে রাখতে পারে বলে তার নিজের মনে বেশ স্বস্তি হয়।
সঙ্গে সঙ্গে তার হঠাৎ মনে উদয় হয় একটি প্রশ্নের কথা! শৈলবালার শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা এত সহজে একটি কমবয়েসী, সতী হতে যাওয়া এবং সর্বোপরি সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সপত্নীটির সন্ধান করা কি একেবারেই ছেড়ে দিল? পরক্ষণেই মনে হয় হয়ত ওরা টহলদার ইংরেজ কোতোয়ালের ভয়ে চুপ করে আছে!
কবে যে সব অশান্তি দূর হয়ে গৃহীজীবনে আবার ফিরতে পারবে! কে জানে ! তার ভাগ্যদেবতার যে কি অভিপ্রায়!
....
ধনী জমিদার মতিলাল শীল ইতিমধ্যেই দানবীর নামে কলকাতার দশদিকে বেশ পরিচিত নাম। অনেক ছাত্র সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এমনকি বহুসংখ্যক ভবঘুরে আর বেকার লোকজনও তাঁর বাড়িতে দু বেলা পাত পেড়ে ভরপেটে খেয়ে আসে।
এহেন ব্যক্তিটি যে অবলীলায় গোলদিঘির কাছাকাছি একটা পারিবারিক মালিকানার জমি বিনা বাধায় যে হুট করে মেডিক্যাল কলেজের জন্য দিয়ে দেবেন সেটা যেন অবধারিতই ছিল। তবে এসব কাজে হাত দেওয়ার ব্যাপারে লর্ড বেন্টিঙ্ক বড় নিয়মনিষ্ঠ। সেদিনের লাটভবনে যে ইচ্ছার বীজটি সি.জে গ্রান্ট সাহেবের সাথে সেদিন বপন করেছিলেন, তাকেই এবারে " গ্রান্ট কমিশন" এর রিপোর্টের ভিত্তিতে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কথাটি অবশেষে ঘোষণা করে ফেলতে আর দেরী হলনা।
বেন্টিঙ্ক জানেন যে বিলেতে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে এইরকম একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা এই উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের ভিত্তিটিকেই সার্থক ও সফল করে তুলতে পারে। আর এটাও হয়ে থাকবে সতীদাহ বিরোধী বিল্ ঘোষণার পরে আরেকটি জনমুখী ইংরেজ সিদ্ধান্ত।