গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পমিরজাফরের সিংহাসন আরোহন।
মুর্শিদাবাদ থেকে চিঠি যেতে এবং তার উত্তর আসতে প্রায় ছ-সাত দিন লাগতো। লন্ডন থেকে মাদ্রাজ বা কলকাতায় চিঠি আদানপ্রদান ছিল সময়সাপেক্ষ। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে তাই কোনও আদেশের বা উপদেশের অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ক্লাইভের কাছে যখন সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধের সম্মতি এসে পৌঁছোয় তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ২৯শে জুন যখন ক্লাইভ কাশিমবাজার থেকে মুর্শিদাবাদ অভিযানের আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলেছে তখন লন্ডন থেকে অভিনন্দনবার্তা এসে পৌঁছোল। ক্লাইভের এই জয় সমগ্র ব্রিটিশজাতিকে বিশ্বের কাছে সম্মানের আসনে বসিয়েছে সে কথা জানিয়ে কোম্পানির ওপরমহল থেকে জানানো হলো যে যদিও মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তবুও আনুষ্ঠানিকভাবে এবং ধুমধামের সঙ্গে মিরজাফরকে সিংহাসনে বসানো এখনও বাকি আছে। প্রশাসনের দিক থেকে একজন নবাবের অস্তিত্ব থাকা খুব দরকার। সেক্ষেত্রে বলা যাবে সিরাজের অভাবে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা অনাথ হয়ে যায়নি। মিরজাফরের সিংহাসন আরোহণ সম্পূর্ণ হলে যেন রাজ্য জুড়ে সারা দিনরাত্রিব্যাপী উৎসব পালন করা হয়। ২৯শে জুন ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ পৌঁছে কিছুটা অবাকই হলো। ধনসম্পদ এবং আভিজাত্যে ভরপুর এমন শহর তারা আগে দেখেনি। মানুষের ঢল দেখে ক্লাইভের বুঝতে কোনও অসুবিধে রইলো না যে চাইলে এখানকার মানুষ চাইলে কেবলমাত্র লাঠি আর পাথর দিয়েই ইউরোপিয়ানদের দেশছাড়া করতে পারে। পারেনি তার কারণ নেতৃত্ব দেবার মতো কেউ ছিলনা। এই বিশাল জনশক্তিকে সংঘবদ্ধ করার কোনও প্রয়াস ছিলনা কোনওখানে। প্রচুর রক্ষী সামনে পিছনে নিয়ে ক্লাইভ এসে পৌঁছোল মুরাদবাগ প্রাসাদে। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানাল মির মিরান। কোথাও কোনও ষড়যন্ত্রের লেশমাত্র নেই। সেখান থেকে মির মিরানের সঙ্গে প্রচুর ব্রিটিশসৈন্য সমভিব্যাহারে ক্লাইভ পৌঁছোল হিরাঝিল প্রাসাদে যেখানে এক সপ্তাহ আগেও বীরবিক্রমে বিরাজ করতো সিরাজউদ্দৌল্লা।
মিরজাফর নিজের থেকে সিংহাসনে বসতে চাইলো না। যে সিংহাসনে আলিবর্দি এবং সিরাজ বসেছে সেই সিংহাসনে বসতে স্বাভাবিকভাবেই ইতস্তত করছিল মিরজাফর। যে নবাবের অধীনস্থ হয়ে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেছে মিরজাফর চোরাপথে সেই সিংহাসন অধিকার করার সময় যখন এল তখন মেরুদন্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে এলো তার। ক্লাইভ বুঝতে পারলো মিরজাফর দ্বিধাগ্রস্ত। ক্লাইভ এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে মিরজাফরকে মসনদের সামনে নিয়ে এসে তাকে ধরে ধরে আস্তে আস্তে মসনদে বসিয়ে দিল। প্রথামত নবাবের হাতে তুলে দিল নজরানা, রুপোর থালা ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা। এক এক করে সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সিংহাসনের সম্মানে নজরানা তুলে দিল মিরজাফরের হাতে। যে মিরজাফর যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থেকেছে এবং যুদ্ধ করেনি, যে মিরজাফর যুদ্ধজয় করে নয় বিশ্বাসঘাতকতা করে মসনদ দখল করলো সেই মিরজাফরকে মাহাবাত জং অর্থাৎ যুদ্ধনায়ক উপাধিতে ভূষিত করা হলো। এক এক করে পুত্র মির মিরান এবং জামাতা মির কাশিমকে ভূষিত করা হলো শামাত জং এবং হাইবাত জং ইত্যাদি উপাধিতে। তৈরি হলো নতুন শিলমোহর। মিরজাফরের সিংহাসন আরোহণ এবং নবাব হওয়ার সিদ্ধান্তে শিলমোহর দিয়েছিল ক্লাইভ, দিল্লির মোগলসম্রাট নয়। এবার থেকে দিল্লির ভারতসম্রাট নয় কোম্পানির নিয়োগকারীরাই নবাব নিয়োগ করবে সেই বার্তাই ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এই নবাব নিয়োগের শুরু হলো বাংলায়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি মোগল সম্রাটের কাছ থেকে মিরজাফরের নিয়োগপত্র এসেছিল অনেক পরে, ২৩শে ডিসেম্বর ১৭৫৭। ক্লাইভের চিঠি অনুযায়ী এই বিলম্বের কারণ ছিল যে সকলকে বিতরন করার পর নিয়োগপত্রের বিনিময়ে মোগল সম্রাটকে দেয় অর্থ সেই সময়ে কোষাগারে ছিলনা। কিন্তু তার জন্য মিরজাফরের নবাব হওয়ায় কোনও বাধার সৃষ্টি হয়নি। ব্রিটিশদের উপরে কথা বলার ক্ষমতা ছিলনা মোগল সম্রাটের। কার্যত ব্রিটিশরাই নবাব নিয়োগ করতে শুরু করেছিল। মোগলসম্রাটের নিয়োগপত্র কেবল প্রথাগত। মিরজাফরকে কার্যত নিয়োগ করেছিল ক্লাইভ এবং পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং অবশেষে দিল্লির মসনদ চলে গেল ব্রিটিশদের হাতে। ক্ষমতা যে নবাবের হাতে নয় তার হাতে সে কথা নানাভাবে মিরজাফরকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ক্লাইভ। মিরজাফরের মসনদে বসার পর ক্লাইভের মিথ্যাভাষণের কিছু অংশ শুনলেই বোঝা যায় কথায় আর কাজে কতটা ফারাক ছিল ব্রিটিশদের। ফরাসিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অপরাধেই যে তাকে মসনদ ছাড়তে হয়েছিল সে কথা বোঝাবার চেষ্টা লক্ষ্য করার মত।
‘আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার কোন অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু সিরাজদ্দৌল্লা কেবলমাত্র চুক্তিভঙ্গই করেনি সে ফরাসিদের সাহায্য নিয়ে আমাদের ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে তাকে মসনদ হারাতে হয়েছে। আপনাদের নতুন নবাব বীর, সাহসী এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। তার শাসনে দেশবাসী সুখেশান্তিতে থাকবে। রাজকার্যে মাথা গলানোর কোনও অভিপ্রায় আমাদের নেই। নবাব যতদিন চাইবেন ততদিন আমরা এখানে থাকবো। তারপর আমরা কলকাতা ফিরে গিয়ে আমাদের যা আসল কাজ সেই ব্যবসায় মনোনিবেশ করবো।‘
ছলচাতুরি শেষ করে এবার আসল কাজের পালা। ক্লাইভ মুরাদবাগে ফিরে এসে দেখল জগতশেঠ মাধবরাই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ক্লাইভ জানাল যে জগতশেঠ ভারতবর্ষের এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাকে দিল্লির মোগলসম্রাটও সমীহ করে। সুতরাং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কী আলোচনা হয়েছিল জানা না গেলেও পরেরদিন অর্থাৎ ৩০শে জুন মিরজাফর এলো ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করতে। রায়দুর্লভ যা বলেছিল মীরজাফরও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বললো যে কোষাগারে যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে ক্লাইভের চাহিদা সম্পূর্ণ মেটানো সম্ভব নয়। ক্লাইভ জানাল যে সে চায় জগতশেঠ মধ্যস্থতা করুক। তার দৃঢ় ধারণা যে কোষাগারের টাকা নতুন রাজসভার মন্ত্রীরা গোপনে আত্মস্থ করেছে। তাই সে চায় জগতশঠের সাহায্য নিয়ে যতটা সম্ভব ততটা উদ্ধার করতে। মিরজাফর এবং ক্লাইভ দু’জনে একত্রে জগতশেঠের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে সেই সময় কী অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল এই জগতশেঠেরা। নবাব এবং যে ব্যক্তি আর কিছুদিন পরে দন্ডমুন্ডের কর্তা হবে তারা একত্রে শরণাপন্ন হলো জগতশেঠ মাধবরাই এবং তার খুল্লতাত ভ্রাতা মহারাজ স্বরূপচাঁদের। সঙ্গে চললো ওয়াটস, স্ক্র্যাফটন, মিরান এবং রায়দুর্লভ। উমিচাঁদও চললো সঙ্গে সঙ্গে। উমিচাঁদ ভেবেছিল সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কারস্বরূপ লাল কাগজে যে চুক্তি হয়েছিল তার মান্যতা দেবে ক্লাইভ। সে স্বপ্নেও ভাবেনি ঐ লাল কাগজের চুক্তি ছিল মিথ্যা এবং ওয়াটসনের স্বাক্ষর ছিল জাল। আলোচনা যখন শুরু হলো তখন সবাইকে ডাকা হলো কিন্তু উমিচাঁদকে ডাকা হলো না। তাকে দূরেই বসে থাকতে হলো। জগতশেঠ প্রস্তাব দিল যে কোষাগারে অর্থের অপ্রতুলতার কারণে আপাতত ব্রিটিশদের প্রাপ্য অর্ধেক অর্থ দিয়ে দেওয়া হবে। এই অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ দেওয়া হবে মুদ্রায় এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ দেওয়া হবে অলঙ্কারে। বাকি অর্ধেক আগামী তিনবছরে তিনটি সমান কিস্তিতে মিটিয়ে দেওয়া হবে। এই অর্থের পাঁচ শতাংশ পাবে রায়দুর্লভ। অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা। রায়দুর্লভের প্রাপ্য হবে ৮ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। যেহেতু রায়দুর্লভ দরবারে দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি এবং প্রধানমন্ত্রী সুতরাং ৫ শতাংশ তাকে দেওয়ার ব্যাপারে কোনও দ্বিমত হলোনা।
এছাড়াও আর যা যা ঠিক হলো তা হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামগ্রী একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও শুল্ক লাগবে না। এছাড়া ফরাসিদের সমস্ত সম্পত্তি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং সমস্ত ফরাসিদের এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হবে। কলকাতা থেকে কুলপি এবং কলকাতা বন্দর থেকে হলদিয়ার বিস্তৃত ভূখণ্ড ব্রিটিশদের দিয়ে দেওয়া হবে। যে সমস্ত ইউরোপিয়ান সিরাজের বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের জন্য ১ কোটি ৫০ লক্ষ, স্থল এবং জলবাহিনীর ক্ষতিগ্রস্থ সৈনিকদের এবং তাদের পরিবারের জন্য ৫০ লক্ষ, আর্মেনিয়ান ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ৭ লক্ষ এবং ভারতীয় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ২লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এইসমস্ত টাকা দিয়ে দেওয়ার সময়সীমা জুলাই, ১৭৫৭। মিরজাফর জানালো যে ক্লাইভের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সিরাজের হারেম যা বর্তমানে তার হারেম তার থেকে দশজন সুন্দরী মহিলাকে ক্লাইভের মনোরঞ্জনের জন্য প্রেরণ করা হবে। ক্লাইভ এই উপহার গ্রহণ করেছিল কি না জানা যায় নি। নিজের পারিশ্রমিক বাবদ ক্লাইভ পেল ১৯ লক্ষ টাকা এবং কলকাতার কাছাকাছি একটি জায়গির যার থেকে বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ২লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।কলকাতা কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্যের জন্য ধার্য হলো ৬ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। ধনবন্টনের এই প্রক্রিয়া যখন তুঙ্গে এই সম্পদের মূল আধিকারী সিরাজ তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
এবার উমিচাঁদের পালা। ক্লাইভ এবং স্ক্র্যাফটন উমিচাঁদকে ডেকে পাঠালো। ক্লাইভের নির্দেশে স্ক্র্যাফটন উমিচাঁদকে জানালো যে ঐ লাল কাগজ জাল ছিল এবং এই বিপুল অর্থের কিছুই পাবে না উমিচাঁদ। এই কথা শুনে উমিচাঁদ জ্ঞান হারালো। তাকে প্রাথমিক শুশ্রুষা করে পালকি চাপিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তার কিছুদিনের মধ্যেই উমিচাঁদের আচার আচরণে অপ্রকৃতিস্থতা দেখা যেতে লাগলো। কিছুদিন পর ক্লাইভের উপদেশে উমিচাঁদকে তীর্থভ্রমণে পাঠানো হল এবং সেখান থেকে যখন ফিরে এলো তখন সে বদ্ধ পাগল। ক্লাইভ অবশ্য পরবর্তীকালে উমিচাঁদের জন্য তদ্বির করেছিল। বলেছিল উমিচাঁদ কিন্তু ওয়াটসের সঙ্গে ভালোই সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু অন্তহীন উচ্চাশা এবং অর্থলোভ তাকে এতদূর নিয়ে গিয়েছিল যে সে নবাব হতে চেয়েছিল। তাই ক্লাইভ ভেবেছিল তীর্থভ্রমণ করে এলে সে হয়ত কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হলোনা। ফিরে এসে উন্মাদ উমিচাঁদ রাজপোশাক এবং অলঙ্কারে নিজেকে সজ্জিত করে নিজের সুদিনের অপেক্ষায় বসে থাকত। এইভাবে বছরখানেক কাটিয়ে উমিচাঁদ অসুস্থ হয়ে পরে এবং মারা যায়। সিরাজকে বিপথে চালিত করার ক্ষেত্রে উমিচাঁদের ভূমিকা কম ছিলনা সেকথা সত্য। সিরাজের কাছের লোকেরা যখন মিরজাফরের সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে সিরাজকে খবর এনে দিত উমিচাঁদ হাসিগল্পে সিরাজকে মাতিয়ে রেখে সেকথা ভালো করে শুনতে দিতনা। তাকে তার প্রাপ্য কুড়ি লক্ষ টাকা দিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল বলে পরবর্তীকালে ক্লাইভের মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
জগতশেঠ মাধবরাই যার বাড়ি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক ব্যবসা এবং কূটনৈতিক বিষয়ে আলোচনার এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের অন্যতম কেন্দ্র ছিল সেই মাধবরাই ক্লাইভের কাছে অনুযোগ জানালো যে ফরাসিদের কাছ থেকে তার প্রাপ্য সাত লক্ষ টাকা সে পায়নি এবং আর পাবে বলে মনে হয়না। ক্লাইভ প্রস্তাব দিল যে পরিত্যক্ত ফরাসি দপ্তর এবং কোম্পানির শাখাগুলি থেকে যা উদ্ধার করা যাবে তার উপর প্রথম অধিকার থাকবে মাধবরাই এর। তাতেও যদি কম পড়ে তাহলে জন অ্যাান্ড কোং থেকে বাকি টাকা মাধবরাইকে মিটিয়ে দেওয়া হবে। পরিবর্তে মাধবরাই সমস্ত ব্যবসায়িক বিষয়ে ক্লাইভকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিল। একথাও বললো যে দিল্লির কোষাগার থেকে যতটা সম্ভব ততটা ব্রিটিশদের পাইয়ে দেবার চেষ্টা করবে সে। মাধবরাই মিরজাফরকে অনুরোধ জানালো যে সিরাজের আমলে আলিবর্দির সময়কার যে সমস্ত সভাসদ এবং বিশিষ্টজনেদের দরবার থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল তাদের যেন ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।
এছাড়াও ঠিক হলো যে ক্লাইভ এবং মিরজাফর যৌথভাবে সিরাজের অনুগত পাটনার নায়েব রামনারায়ণকে এই মর্মে চিঠি লিখবে যে তারা বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে প্রস্তুত যদি রামনারায়ণ সিরাজকে তাদের হাতে তুলে দেয় বা তাকে পাটনাকে থেকে বহিষ্কার করে কারণ তাদের কাছে খবর আছে সিরাজ ঐ দিকেই কোথাও আছে।
৩০শে জুন ক্লাইভ অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে লিখলো,’ সিরাজদ্দৌল্লাকে তারই এক জমিদার ত্রিশহাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে। এই মুহূর্তে সিরাজের কাছে এত পরিমাণ অর্থ নেই যে সে কোনও প্রত্যাঘাত হানতে পারে। রামনারায়ণ সিরাজকে পাটনায় আশ্রয় দেবার ঝুঁকি নেবেনা। তদুপরি সিরাজ এখন কপর্দকশূণ্য।‘সেদিনই গভীররাতে সিলেক্ট কমিটিতে চিঠি লিখে ক্লাইভ জানালো যে মিরজাফর খবর পাঠিয়েছে যে সিরাজকে বন্দি করা হয়েছে এবং তার ছেলে মিরানকে সিরাজকে নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয়েছে।
তারপরের ঘটনা আমরা জেনেছি আগের পর্বে। ২রা জুলাই ১৭৫৭ গভীর রাত্রে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো সিরাজকে।
৩রা জুলাই সকালে সিরাজের ছিন্নভিন্ন দেহ একটা হাতির পিঠে চাপিয়ে শহর পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লো মির মিরানের দলবল। মুর্শিদাবাদের অলিগলি রাজপথ পরিভ্রমণ করে হাতি এসে দাঁড়াল হুসেনকুলি খানের দরজায় যেখানে দেড় বছর আগে হুসেনকুলিকে হত্যা করে তার মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দিয়েছিল সিরাজ। সিরাজের মৃতদেহ থেকে দু’ফোঁটা রক্ত টপটপ করে ঝরে পড়ল ঐ জায়গায়। তারপর সেই হস্তিশকট এসে পৌছলো সিরাজের মা আমিনা বেগমের প্রাসাদের সামনে। প্রাসাদের বাইরে এত হৈচৈ শুনে আমিনা বেগম জানতে চাইলো কী হয়েছে। সিরাজের হত্যার খবর শুনে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় নিজের বুক মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে প্রচন্ড আর্তনাদ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল আমিনা বেগম।বাইরে এসে সিরাজের প্রাণহীন দেহকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল তার সমস্ত শরীর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যারা এই দৃশ্য দেখছিল তাদের চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল। সদ্য সন্তানহারা মায়ের এই বুকফাটা হাহাকার দেখে যদি সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তাহলে হত্যাকারীদের বিপদ হতে পারে। সেই ভয়ে মিরজাফরের লোকেরা তড়িঘড়ি জোর করে আমিনা বেগমকে সেখান থেকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আর সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে সিরাজের দেহ সোজা নিয়ে গিয়ে আলিবর্দি খানের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করে দেওয়া হলো। সমাধিস্থ হলো বাংলা, বিহার , উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব।