Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৮)

লন্ডনে বসে একদা সি.জে গ্রান্ট নামের এক মাঝবয়সী সাহেব নানা ধরণের পলিটিক্যাল স্যাটায়র লিখে দলবল নিয়ে অভিনয় করতেন বেশ সুনামের সাথেই।

অবশ্য দেনার দায়ে সেই থিয়েটারের ব্যবসা উঠে যাওয়ার পরে এখন অবশ্য কিছু বছর হল তিনি হিন্দুস্তান মুলুকে এসে সরকারী পর্যবেক্ষকের পদে বহাল হয়েছেন।

আজ তিনি লাটভবনে এসে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে গেলেন। আসলে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমন্ত্রণে প্রাতরাশ শেষ হওয়ার পরেও এখানে বসে একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা চলল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লাটসাহেবের কাছে সত্বর এখানে একটি ভাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয় সে বিষয় নিয়ে একটা বিশেষ পর্যবেক্ষণ সহ রিপোর্ট চেয়েছে। নেটিভ জমিদারদের অনেকেই এ বিষয়ে ইংরেজ কোম্পানির হস্তক্ষেপ চেয়ে তাঁদের চিঠিপত্র দিয়েছে বলে এই উদ্যোগের আকস্মিক প্রণয়ন নিয়ে কথা চলছে।

ইদানীং যদিও মাদ্রাজে এরকমের একটি চিকিৎসালয় ইঙ্গ - ফরাসী উদ্যোগে চলছে বটে, তবুও খোদ রাজধানীর বুকে একটি আধুনিক চিকিৎসালয়ের আশু প্রয়োজন।

গ্রান্ট এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেয়ে খুব উদ্বিগ্ন গলায় লর্ড বেন্টিঙ্ককে উদ্দেশ্য করে বললেন,

" ইওর হাইনেস! আপনিও এ বিষয়টি জানেন যে শহরের আদিগঙ্গার চারপাশের জনপদ বড় দুর্গম ও অস্বাস্থ্যকর। আমাশয়, কলেরা আর অজানা জ্বরের প্রকোপ তো এখানকার নিত্যদিনের সঙ্গী। "

বেন্টিঙ্ক হাসিমুখে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালায় একটি তৃপ্তিকর চুমুক দিতে দিতে গ্রান্ট সাহেবকে বললেন যে তিনি এবিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত।

এমনকি তিনি সুপারিশ করলে এবিষয়ে রামকমল সেন সহ কিছু ধনী বাবু এখনি হাসপাতালের জন্য জমি দিয়ে ব্রিটিশ শাসকের সুনজরে আসতে প্রস্তুত।

তাছাড়া ডেভিড হেয়ার সাহেবেরও আজকাল নেটিভ মহলে সুসম্পর্ক থাকার জন্যে এধরণের একটি হাসপাতাল তৈরীর কাজে অন্য অনেক সুবিধারও বন্দোবস্ত হওয়াটা এখন অসম্ভব নয়।

এমনকি খোদ লন্ডনের রয়্যাল স্কুল অব মেডিসিনও এ এইকাজের বিষয়ে সবরকম সাহায্য করতেও রাজী। এখন খালি সরকারী অনুমোদনের জন্য কিছু সময় অপচয় হবে। যদিও সতীদাহ বিরোধী বিল্ এনে সরকার এখন জনরোষের চাপে পড়ে কিছুটা বিপাকে পড়ে গেছে। নেটিভরা বোধহয় এতটা উপকারী রূপে ইংরেজদের দেখতে বোধহয় এক্ষণি খুব একটা রাজি হবে কি?

.......

রামানন্দ কায়েতের দুটি বৌ বেশ কর্মপটু বলে তার একচিলতে খোড়ো ঘরেই গোলকপতিদের চারদিনের জন্য আপাতত থাকা ঠিক হল। রামানন্দ কিছুদিন হল চাষবাসের জাত ব্যবসা তাঁতের ব্যবসা ধরেছে। মহাজনের কাছ থেকে সে মোটা টাকা দাদন নিয়ে সে চারখানি তাঁতের যন্ত্র কিনে সুতি বস্ত্রের একটি মনোগ্রাহী বিপণন কেন্দ্র খুলে বসেছে। গলসী, ঝাঁপানডাঙা, মামুদপুর এমনকি খোদ বর্ধমানের হাটেও তার হাতে বোনা তসরের শাড়ি ভালো দামে বিকোচ্ছে বলে তার দু'জন বউএর কোমরে একইরকম ঝকঝকে পৈঁছা দুটি দোলে। রামানন্দের সন্তানভাগ্য মন্দ। দু'বার বিবাহ সত্ত্বেও সে এখনও নিঃসন্তান। গোলকপতির কাছে খোদ রাজবাড়ির সীলমোহর আছে দেখে তাদের ঘরে আশ্রয় দিতে রামানন্দ রায় রাজি হল। এই সুযোগে মহারাজ তেজচন্দ্রের দরবারে তার বারোমাসের কাপড় চালানের একটা সুরাহা হলে সেটা অদূর ভবিষ্যতে নেহাত মন্দ হবেনা।

রাজবাড়ির ভিতরমহলে থাকা অজস্র উমেদার ও কৃপাপ্রার্থীদের সিংহভাগও যদি তার থেকে নিয়মিত কাপড় কেনে তাও সেটা বছরে দু -চারশ সিক্কার কম হবেনা।

তাই রামানন্দের খুব ইচ্ছা যে সেহারাবাজারে তাঁতের আড়তে একখানি চালা ভাড়া করে বসার। তবে সেটা নগদ পঞ্চাশ সিক্কার বদলে হওয়া কঠিন।

আড়তদারদের বেশ অনেকেই মোটা অর্থের বিনিময় ছাড়া তাকে ভিন্ মুলুকে চট করে আর একটা নতুন মুখ হিসেবে কারবার ফেঁদে বসতে দেবেনা।

রামার বউদের মধ্যে বড় বৌ ভবানী একটু মাতৃময়ী স্বভাবের। দুই সতীনের মধ্যে একমাত্র সেই দুবার গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও শেষমেশ গর্ভপাত হওয়ায় সে মরমে মরে থাকে। আর ছোটবৌটি প্রায় আড়াই বছর স্বামীসঙ্গ করেও একটিবারের জন্যেও গর্ভবতী হয়নি।

সে একটু কঠিন মনের ও কলহপ্রিয়া নারী। ভবানী তাকে বোনের মত স্নেহ করলেও সে কিছুতেই যেন খুশী হতে পারেনা।

হঠাৎ করে গোলকপতিদের এইভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসাটার বিষয়ে সে সরাসরি আপত্তি না জানালেও এঈজন অপরিচিত ঢলঢলে মুখশ্রীর শৈলবালা নামের মেয়েটিকে তার মোটেও পছন্দ হয়নি। ওর ধারণা যে গোলকপতিরা রামানন্দকে ভাল মানুষ পেয়ে কিছু একটা গোপন ও অন্যায্য কাজে কেবল ব্যবহার করতে চাইছে।

.......

দিল্লীর মুঘল সাম্রাজ্যে আকাশে ক্রমশ ঘনিয়ে এসেছে দিনবদলের পদপাত। ইংরেজ কোম্পানি আসতে আসতে তামাম হিন্দুস্তানকে দখল করে নিতে চাইছে বলে আগ্রাসন ও বিশেষ বিশেষ আইন প্রণয়নের তারা-মুদারায় এদেশে তানকর্তবের রকমারি আলাপ চালাচ্ছে।

এমনকি দিল্লির প্রবীণ মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের প্রতি ইংরেজরা হঠাৎ করে বৈমাত্রেয় ভ্রাতার মত আচরণ করে সেই বৃদ্ধের জীবন প্রায় অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

এমনকি হঠাৎ করে তারা তাঁর প্রাপ্য ভাতাটির পরিমাণ ওরা কম করে দিয়েছে বলে তিনি ইংরেজদের উপর হাড়েহাড়ে চটেছেন।

নিজামতের সুপারিশে তাই তিনি ফারসী ভাষায় লেখা সব আইনী দস্তাবেজের সহজ অনুবাদক ও ফার্সী ভাষায় সুপন্ডিত রামমোহনকে 'রাজা' উপাধি দিয়ে বিলেতে গিয়ে মহারানির রাজদরবারে বাদশাহের ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটা বিরাট চিঠি পাঠিয়েছেন। আজ সকালে উঠে ব্রহ্মোপসনার ঠিক পরেই সেই এত্তালা সাথে নিয়ে শাহী দরবারের খাস্ নবিশ পেয়ারেলাল খান রামমোহনে মির্জাপুর স্ট্রীটের বাড়িতে এসে হাজির।

.....

যদিও দেওয়ানী আইনের মারপ্যাঁচে রামমোহন নিজেও পিতৃপদাঙ্ক অনুসারী ও বেশ জ্ঞানী বলে এই চিঠির অভিঘাতে তিনি আদৌ বিচলিত হননি।

তিনিও সম্মতি জানিয়ে বাদশাহের ফরমানটিকে স্বীকার করে মুচলেকা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

এখন তাঁর ইচ্ছা যে আগামী নভেম্বরে বিলেতের পথে যাত্রা করলে শীতকালের গোড়াতেই সেখানে পৌঁছে যেতে পারবেন। তাহলে হাউসের শীতকালীন অধিবেশনে তাঁর দুটি প্রধান কাজ হবে! একটি হবে মুঘল সম্রাটের হয়ে ভাতা বৃদ্ধির ওকালতনামা জমা দেওয়া, আর অন্যটি হবে প্রিভি কাউন্সেলে সতীদাহ প্রথা রোধ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পরেও কিছু দেশীয় শক্তির বিরোধাভাসের নথির বিপরীতে একটি প্রশ্নোত্তরের আসর সহ স্ত্রীশিক্ষার সূচনার প্রদীপটি জ্বালানো।

তবে একজন উপযুক্ত নবীন সহকারী বিনা স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টি হঠাৎ করে এ দেশে চালু করা কঠিন। দ্বারকনাথ নীলের ব্যবসায় জর্জরিত বলে এযাত্রায় তাঁর সফরসঙ্গী হতে পারেননি। সব ব্যবস্থা ঠিক থাকলে নভেম্বরের মাঝামাঝি তিনি লিভারপুল পৌঁছবেন। তবে এখন এসবের সবটাই বড় অনিশ্চিত।