প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
Posted in প্রবন্ধআমরা এই ভীষণ অস্বস্তিকর গরমে একটা জিনিস খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি যে, গাছ আমাদের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে আসছে। গাছ ছাড়া আমরা তথা গোটা প্রাণিজগৎ বাঁচব না। গাছই পারে চারপাশের তাপমাত্রাকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু আজ সরকারি নানান প্রকল্পের অজুহাতে কিংবা কর্পোরেটদের লোভের তাড়নায় অনেক গাছ কাটা হচ্ছে। সমাজের তথাকথিত নিয়ন্ত্রণকারীরা নিজেদের অসীম লোভ সামলাতে না পেরে গাছ কেটে নিজেদের পরিবেশকে এক বিশাল বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজার ইচ্ছায় গাছ কাটা যায়। কিন্তু, আজকাল অসচেতন স্বার্থপর কিছু গাছকে বাঁচাতে না পারলেও পেরেছিল আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগের এই দেশেরই কিছু পরিবেশ সচেতন মানুষ।
ঘটনাটি ঘটে রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চলে। সেখানে বনাঞ্চল রক্ষার জন্য বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের গ্রামবাসীরা এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাই এই পরিবেশরক্ষার আন্দোলনের নাম ‘বিষ্ণোই আন্দোলন’। রাজস্থানের পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ থর মরুভূমি অঞ্চল, হরিয়ানা এবং পাঞ্জাব রাজ্যের কিছু অঞ্চল জুড়ে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করে থাকে। মরুভূমি অঞ্চলে থাকার জন্য অতীতকাল থেকেই এঁরা বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁরা বনাঞ্চলকে নিজেদের জীবনের অংশ করে তুলেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা সহজ কৃষি কৌশল ব্যবহার করে মরুঅঞ্চলেও ফসল ফলাতে দক্ষতা অর্জন করেছেন। এভাবেই, তাঁদের রোজকার জীবনে আচার আচরণ মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশকে সুস্থায়ী করে তুলেছিল। এইরকমই পরিবেশ রক্ষাকারী ও পরিবেশ নিবেদিত সম্প্রদায় হল বিষ্ণোই। বলা হয় যে, এঁরা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপ-সম্প্রদায় হলেও ধর্মীয় রীতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে পুরোপুরি হিন্দু নয়। কেননা এঁরা হিন্দুদের মতো মৃতদেহ পোড়ান না। কেননা মৃতদেহ পোড়াতে কাঠ ও গাছ লাগবে যে! তখন তো আর আধুনিক চুল্লি ছিল না। আর কাঠ ও গাছ বাঁচাতে তথা পরিবেশ বাঁচাতে তাঁরা মৃতদের দাফন করেন। এই বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষের গুরু হলেন মহারাজ জাম্বাজী যিনি ১৪৮৫ সালে বিষ্ণোই বিশ্বাস বা ধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি গাছ ও প্রাণীর ক্ষতি করা নিষিদ্ধ এই নীতি তৈরি করে গিয়েছিলেন। আসলে, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং মানব সম্প্রদায়কে একাত্ম করে তোলাই ছিল তাঁর মতাদর্শের নীতি। বিষ্ণোই ঐতিহ্যের এই জীবনাচারের ফলে পশ্চিম রাজস্থানের মারওয়ারের রাজপুত প্রধান মহারাজ জাম্বাজীকে গুরু জাম্বেশ্বরের আসনে বসিয়েছিলেন। গুরু জাম্বেশ্বর ২৯টি নীতি প্রণয়ন করেছিলেন যা একজন বিষ্ণোকে আমৃত্যু অনুসরণ করে চলতে হবে। এই নীতিগুলোর মধ্যে ছয়টি তো অসাধারণ যেগুলো দৈনন্দিন জীবনে পরিবেশ রক্ষা আর সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর প্রতি সমবেদনার কথা বলে। শুধু গাছ কাটা নিষিদ্ধ করাই নয়, এই সম্প্রদায়ের মানুষদের পরিত্যক্ত প্রাণীদেরকে আশ্রয় দিতেই হবে। আবার এই সম্প্রদায়ে চারপাশের সকল বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে প্রকৃতির সকল সম্পদকে ভাগাভাগি করতে বলা হয়েছে।
১৭৩৭ সাল। যখন যোধপুরের মহারাজা অভয় সিং রাঠোর তাঁর নতুন প্রাসাদের জন্য খেজরি গাছের খোঁজ করছিলেন। তিনি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, খেজারলি গ্রামে প্রচুর বড়ো বড়ো গাছ আছে। সেই গাছগুলো শুধু বড়োই নই শতবর্ষেরও প্রাচীন। তাঁর লোভদৃষ্টি পড়ে ঐ গাছগুলোর ওপর আর তার ফলে নিজের নতুন রাজপ্রাসাদের স্বার্থে সেই গাছগুলো কাটার নির্দেশ দেন। সেই গাছগুলো কাটার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা হল ‘বিষ্ণোই আন্দোলন’। এই আন্দোলন অনেকটা ‘চিপকো আন্দোলন’-এর মতো কেননা এখানেও মহিলা-শিশুরা গাছগুলোকে জড়িয়ে ধরে সেগুলোকে আপ্রাণ রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। বৃদ্ধা অমৃতা দেবীর নেতৃত্বে খেজারলি এবং তার আশেপাশের গ্রামের বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের গ্রামবাসীরা এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
তা রাজার কর্মকর্তারা সৈন্য বাহিনী নিয়ে যখন গাছ কাটতে সেই গ্রামের ধারে আসে তখন গ্রামবাসীরা তাদের প্রতিরোধ করেন। গ্রামবাসীরা বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের বলে তাঁদের অঞ্চলের পবিত্র গাছগুলোকে অন্যায়ভাবে হত্যা মেনে নিতে পারেনি। অমৃতা দেবী নামের একজন বিষ্ণোই বৃদ্ধা তাঁর সম্প্রদায়ের সকল মহিলা ও শিশুদের সমবেত করে গাছগুলোকে আলিঙ্গন করে বা জড়িয়ে ধরে থাকেন যাতে রাজার লোকেরা গাছ কাটার আগে তাঁদেরকে কাটতে বাধ্য হয়। অমৃতা দেবীর তিন কন্যা আশু, রত্নী এবং ভাগু ও তাঁদের মায়ের সাথে যোগ দিয়েছিলেন এই আন্দোলনে। অন্যদিকে এই প্রতিরোধ দেখে রাজার আদেশের দোহাই দিয়ে মানুষ সহ গাছ কাটতে আরম্ভ করে রাজার সৈন্যরা। এই রাজ সৈন্যরা মানবতা মোটেও বুঝতো না, অশিক্ষার ফলে, অল্প বুদ্ধির ফলে ও রাজার আজ্ঞা পালন করার তাগিদে তারা গাছ কাটার কুড়ালের আঘাতে বিষ্ণোই নারী ও শিশুর দেহ টুকরো করার পরেই গাছগুলোকে টুকরো করে। পরিবেশবিরোধী গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বিষ্ণোই গ্রামবাসীরা মেনে নিতে পারেনি আর তার ফলে ৩৬৩ জন নিহত হয়ে ‘বৃক্ষ শহীদ’ হন। ইসলামি শাসন কিন্তু নেই তবুও হিন্দু রাজার শাসনেই ঘটল এত বড় নৃশংসতা!
রাজা অভয় সিং এই নৃশংস ঘটনার কথা জানতে পেরেই গ্রামে ছুটে আসেন এবং গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমা চান। আর তার সাথে সৈন্যদেরও তিনি গাছ কাটার কাজ বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেন। রাজা হিসেবে নিজের ক্ষুণ্ণ ‘ইমেজ’ রক্ষা করার জন্যে হোক কিংবা মানবতার খাতিরে তখন তিনি বিষ্ণোই অঞ্চলকে একটি সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে মান্যতা দান করেন। আর গুরু মহারাজ জাম্বেশ্বরের অহিংস নীতি মেনে তিনি গাছ ও প্রাণীর ক্ষতি করে এমন কাজগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর সেই ঘোষণা বা আইন আজও সেই বিষ্ণোই অঞ্চলে বিদ্যমান রয়েছে বলে জানা যায়।
এই বিষ্ণোই আন্দোলন মানব সমাজের বা পরিবেশবিদ্যার ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে এক অবিস্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য পরিবেশ আন্দোলন হিসেবে। প্রায় তিনশো বছর আগে রাজস্থানের বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের এইসব গ্রামের মানুষেরাই অমৃতা দেবী নামক এক মহিলার নেতৃত্বে, তাঁদের কাছে পবিত্র খেজরি গাছগুলোকে রাজার একটি নতুন প্রাসাদের জন্য রাজসৈন্যদের দ্বারা কাটা পড়ার হাত থেকে বাঁচানোর একমাত্র বলা যায় প্রধান লক্ষ্যে আঁকড়ে ধরে রাজসৈন্যদের হাতে কাটা পড়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। পরিবেশ আন্দোলনের ধারা লক্ষ্য করলে বোঝ যায় যে এই ‘বিষ্ণোই আন্দোলন’ হল এই ভারত দেশ তথা উপমহাদেশে ঘটা প্রথম পরিবেশ আন্দোলন। যার ছায়া পাওয়া যায় চিপকো সহ বিভিন্ন পরিবেশ আন্দোলনে। এই ‘পরিবেশ দিবস (৫ই জুন)’-এর মাসে মহান বিষ্ণোই আন্দোলনের গাছ তথা পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ের সকল শহীদদের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ প্রণাম। তাঁদের স্মরণ করেই পরিবেশ রক্ষা করবার জন্য বেশি করে গাছ লাগাবার প্রতিজ্ঞা আমাদেরকে নিতেই হবে।