প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধআমাদের দেশের যে রাজ্যটি আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম তার নাম ‘রাজস্থান’। আর, এই রাজস্থানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হল ‘জয়পুর’। জয়পুরকে আমরা ডাকি ‘পিঙ্ক সিটি' বা ‘গোলাপী শহর’ বলে। কেন? ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় যে, ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আগমন উপলক্ষ্যে গোটা জয়পুর শহরকে ও সেখানকার বেশিরভাগ ভবন বা ইমারতগুলোকে আতিথেয়তার রং গোলাপীতে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার মহারাজ রাম সিং। লর্ড অ্যালবার্ট প্রথমবারের মতো জয়পুরকে ‘পিঙ্ক সিটি’ বা ‘গোলাপি শহর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই থেকে জয়পুর আমাদের কাছে ‘গোলাপী শহর’ হিসেবে পরিচিত। বলা হয়, আজও এই গোলাপী ঐতিহ্যকে বজায় রাখা হয়েছে। পুরনো জয়পুরের সমস্ত বাড়ির রং আজও গোলাপী রঙের এবং নগরবাসীও আইনতভাবে এই গোলাপী রং করতে বাধ্য হয়। সে যাই হোক, এক ‘গোলাপী শহর’ যে আমাদের দেশে রয়েছে তা নিয়ে আমরা সবাই বেশ গর্বই অনুভব করে থাকি। কিন্তু, বহুদূরের দেশের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের এই গোলাপী শহরকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় পূর্ব প্রান্তের বিশেষত আমাদের বাঙালিদের গর্বের পরিমাণটা বেশি থাকা উচিত। কেননা, এই জয়পুর শহরের স্থাপত্যনকশা করেছিলেন যে একজন বাংলার মানুষ তথা বাঙালি— বিদ্যাধর ভট্টাচার্য।
বিধাতা ভট্টাচার্য ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে ১৬৯৩ সালে এই বাংলার নৈহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সন্তোষরাম ভট্টাচার্য। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি গণিত, জ্যোতিষ (তখন জ্যোতির্বিদ্যাকেও জ্যোতিষ বলা হত), পূর্তবিদ্যা এবং রাজনীতিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি সদূর রাজস্থানের আম্বার বা আমের শহরে কনিষ্ঠ নিরীক্ষক হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন। আর এই আম্বারে কাজ করার সময়ে তিনি প্রথম জয়পুরের মহারাজের সংস্পর্শে আসেন। মহারাজা সাওয়াই (বা সোয়াই) জয় সিং (দ্বিতীয়) বিদ্যাধরকে তাঁর নানা গুণের পরিচয়লাভ করে মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করেন। জানা যায় যে, বিদ্যাধর রাজসভায় কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতেন। তা একসময় মরুর শহর অম্বরে জলের সঙ্কট দেখা দেয় আর তার সাথে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দেয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা। এরফলে, মহারাজা ঠিক করলেন যে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করা হবে অম্বর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে যে এখনকার জয়পুরে। মহারাজা বিদ্যাধরের বাস্তু ও পূর্তবিদ্যার পারদর্শীতার ব্যাপারে জেনে জয়পুর শহর নির্মাণের জন্য অনুরোধ করেন। এই জয়পুর শহরই দেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি এবং এর পাশাপাশি এই শহর দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর। প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, বাস্তুবিজ্ঞান এমনকি বিদেশি গণিতজ্ঞ টলেমি ও ইউক্লিডের লেখা গাণিতিক বইগুলোর ব্যাপারে বিস্তর জ্ঞান রাখতেন বিদ্যাধর। সেখান থেকে উল্লেখিত জ্ঞান ও শহর গড়ার ব্যাপারে নানান পরিকল্পনা নিয়ে মহারাজা সাওয়াই জয় সিং (দ্বিতীয়)- এর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৭২৭ সালে, প্রযুক্তি ও কৌশলগত পরিকল্পনার সাথে জয়পুর শহরটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শহরটির প্রধান প্রাসাদ ও রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ করতে চার বছর সময় লেগে গিয়েছিল। পুরো শহরটাই নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় শিল্পকলার শিল্পশাস্ত্রের রীতি-নীতি মেনে চলে। শহরের মডেল তৈরি করার জন্য তিনি শিল্পশাস্ত্র ও বাস্তুশাস্ত্রের বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ করেন। পৃথিবীর বৃহত্তম মানমন্দির এবং নগর প্রাসাদ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমস্ত স্থাপত্যবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োগ করেন। ভারতে কর্মরত একজন সুপরিচিত প্রকৌশলী এবং স্থপতি স্যার স্যামুয়েল স্নিন্টন জ্যাকব-এর সাথে তাঁকেও জয়পুরের সিটি প্যালেসের স্থপতি হিসেবে গণ্য করা হয়। জয়পুর শহর তৈরির পাশাপাশি কোনও শহরের ক্ষেত্রে যা অপরিহার্য হয়ে ওঠে অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে মহারাজা জয় সিং বড়োই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিদ্যাধরের পরামর্শ মতো তিনি একটি নব্য বা কল্পিত শহর নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা শহরের নিরাপত্তার দিকটিও ভাবা হয়। কেননা, তখন বৈদেশিক ও দেশীয় অন্যান্য প্রদেশ থেকে হামলার সম্ভাবনা থাকত। তাই, শহরের নিরাপত্তার জন্যে দৃঢ় স্থাপত্য স্থাপন করা হয়েছিল। আর, এর পাশাপাশি দৃঢ় সাতটি দরজাযুক্ত বিশাল দুর্গ প্রাচীরও বানানো হয়েছিল। আজ এই আধুনিক যুগে দেশের আন্তর্জাতিক বর্ডারও বেশ কিছু অংশে তেমন দৃঢ় নয় কিন্তু সে যুগে একটা শহর গড়ে তোলার জন্য কত কিছু ভাবা হয়েছিল। তা মোটামুটি ভাবে ১৭৩১ কি ১৭৩২ সালে শেষ হয় সহ নির্মাণের কাজ। গোটা জয়পুর শহরকে সৌরমণ্ডলের নয়টি গ্রহের প্রতীক হিসেবে নয়টি বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়। যার মধ্যে দুটি ভাগ থাকে রাজা ও রাজকীয় কাজকর্মের জন্যে আর বাকি সাতটি ভাগ থাকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যে। মহারাজ দ্বিতীয় জয় সিংয়ের নামেই শহরের নামকরণ হয় জয়পুর। তাঁর এই নতুন রাজধানী জয়পুর নকশাকার বিদ্যাধরের হাত ধরে হয়ে উঠল যেন স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও সৌন্দর্যের মিশ্রণ।
বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের প্রস্তুত করা নকশা থেকেই জয়পুর শহর নির্মাণ করা হয়। এই মহান স্থাপত্যবিদ জয়পুর শহরের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন। সেই যুগে, জয়পুরে স্থাপত্য ছিল অত্যন্ত উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত ও তার স্থাপত্যশৈলী ছিল গোটা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ১৭৫১ সালে ৫৮ বছর বয়সে মারা গেলেও, এই বাঙালি স্থাপত্যবিদকে জয়পুর তো বটেই এমনকি গোটা উপমহাদেশ মনে রেখেছে ‘শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী স্থপতি’ হিসেবে। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে দেশীয় ও প্রথাগত পদ্ধতি এবং উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যাধর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজস্থানের জয়পুর শহরের স্থাপত্যের পাশাপাশি দেশের আধুনিক স্থাপত্যের প্রবর্তক হিসেবে তিনি সুপরিচিত হয়ে আছেন। বাংলার মানুষ তাদের এই প্রধান স্থপতি, গণিতজ্ঞ, বাস্তুশাস্ত্রী ও নগর পরিকল্পনাবিদকে একপ্রকার ভুলে গেলেও বা তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনও কিছু না বানালেও জয়পুর তথা রাজস্থানের সংরক্ষিত সেরা বাগানগুলোর মধ্যে একটি হল ‘বিদ্যাধর বাগান’ যা শহরের স্থপতিকারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। জয়পুর শহরের গর্ব এই বাগানটি জয়পুরের ৮ কিলোমিটার পূর্বে জয়পুর-আগ্রা সড়কে অবস্থিত। প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য সম্পর্কিত ‘শিল্প শাস্ত্র’ নামক গ্রন্থসমূহ বিদ্যাধর ব্যবহার করেছিলেন জয়পুর শহরের পরিকল্পনাকালে। সেই গ্রন্থসমূহ দ্বারাই বাগানটি নির্মাণ করা হয়। মনে করা হয় যে, সেসোদিয়া উদ্যানের আশেপাশে অবস্থিত ছিল বাগানের একটি দ্রাক্ষাক্ষেত্র বা আঙুরের ক্ষেত।
নৈহাটি অনেক কৃতি মানুষকে উপহার দিয়েছে যাঁদের মধ্যে আমাদের আলোচ্য দেশের অন্যতম কৃতি স্থাপত্যবিদ ও রাজস্থানের 'গোলাপী শহর' জয়পুরের নকশাকার বিদ্যাধর ভট্টাচার্য তো আছেনই আর আছেন দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ের মূলমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্'-এর রচয়িতা, বাংলার নবজাগরনের অন্যতম রূপকার, কিংবদন্তি উপন্যাসিক, গল্পকার তথা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, ভারততত্ত্ববিদ,চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কর্তা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু, জনপ্রিয় গায়ক শ্যামল মিত্র, বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের তো বটেই এমনকি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা কেশবচন্দ্র সেন।