প্রবন্ধ - বেবী সাউ
Posted in প্রবন্ধকবিতার মধ্যে যে কবি ব্যক্তিত্বের বীজ পুঁতে দিতে পারেন, সেই কবির কবিতা পরবর্তীকালের পাঠকদের কাছে সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকে। কিন্তু তার জন্য দরকার পরে কবির অভিপ্রায়ের। কিন্তু সেই অভিপ্রায়টি কী? ব্যক্তিগত এক দর্শন এবং কাব্যভাষার এক ধারাবাহিক সন্দর্ভ ছাড়া হয়তো কোনও কবিই সময়ের কাছে তাঁর আঙুলের ছাপ রাখতে পারেন না। অনেক সময় সমসময় তাঁকে খুঁজে পায়, অনেক সময় পায় না। পরবর্তী সময়ের মানুষজন সেই কবিকে আগ্রহ ভরে পড়তে থাকেন। প্রবালকুমার বসুর কবিতা তাঁর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তুমিই প্রথম’ থেকেই নিজস্ব এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে আছে। দেজ্ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই শ্রেষ্ঠ কবিতার পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯-এ। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “ এটা খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, জীবিকার জন্য অনেক সময় ব্যয় করতে হলেও প্রবাল তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই নতুন নতুন আঙ্গিকের সন্ধান করেছেন।“ এই ক্রমপরিবর্তনশীল কাব্যধারার সঙ্গেই আমরা পরিচিত হই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়তে পড়তে। “ তুমি যদি স্পর্শ করো, আমি তবে গাছ হয়ে যাব”-এর মতো পংক্তি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি লিখেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে প্রবালকুমার বসুকে আমরা বিস্ময়ে লক্ষ করি, তিনি নিজেকে পালটে ফেলার ব্রত যে প্রথম থেকেই নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না, যখন আমরা পড়ি, “ আমাদের কথাগুলি এতকাল বলেছি, যা / না বলা কথারই অবশেষ”। (অবশেষ)।
প্রবালকুমার বসুর কবিতা তার পর থেকে নিয়তই বাঁক নিয়েছে নানান ভাবে। ‘ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে’ কবিতায় তিনি লেখেন, “ যেভাবে বেঁচে আছি এভাবে বেঁচে থাকতে থাকতে আমি একদিন ভারতবর্ষ হয়ে যাব”। এই কবিতাটি রয়েছে তার পরের কাব্যগ্রন্থ “ ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে” নামক কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের চার বছর পর। এই কাব্যগ্রন্থেই আমরা পাই এক নতুন প্রবালকুমার বসুকে, যিনি কাব্যভাষায় অনেক বেশি অভিনব। যেমন, ‘ব্যক্তিগত জীবনী’ নামক কবিতায় তিনি লেখেন, “ আমার প্রথম মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মৃত্যু হতে সময় নিল কুড়িটি বছর।“ প্রবালকুমার বসুর কবিতা পড়তে পড়তে যেমন তাঁর সময়কে স্পষ্টুভাবে চেনা যায়, তেমন বোঝা যায় কীভাবে তিনি আত্মজৈবিনিক উপাদানকে সময়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি নানা ছন্দে, নানা আঙ্গিকে কথা বলেহেন। ১৯৮৯ সালে ‘স্থায়ী আবাস অস্থায়ী ঠিকানা’, ১৯৯৪ সালে ‘যাপনচিত্র’, ১৯৯৮ সালে “ ঈশ্বরের মুখ’ প্রবালকুমার বসুর কাব্যব্যক্তিত্বকে অনেক বেশি স্পষ্ট করে তোলে। একজন কবির অভিযাত্রাকে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তাঁর ধারাবাহিকতা দেখলে। সমগ্র আট-এর দশক ধরে যে কবি লিখেছেন নিভৃতচারী এক ভাষায় কবিতা, তিনিই সমগ্র নয়ের দশক জুড়ে এক স্থিতপ্রজ্ঞ দার্শণিকের মতো কবিতার অন্তর্জগতে ডুব দিয়েছেন। ‘অন্ধের ঈশ্বর’, ‘পা’, ‘জানা রাস্তা’, দেয়ালচিত্র’ প্রভৃতি আশ্চর্য কবিতার সামনে নতজানু হয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। ভেবে দেখতে হবে ভুবনায়নের পর ভুবনায়িত সংস্কৃতির জোয়ারে কবি এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রযুক্তিবিদ এই কবির কাছে প্রযুক্তির বিস্ফোরণ অচেনা কিছু নয়। কিন্তু সময়টা পালটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে কবি পালটে ফেলছেন তাঁর কাব্যভাষা। কিন্তু ভিতরে রয়ে গেছে এক স্থিতপ্রজ্ঞ দ্রষ্টা।
এই ধারাবাহিকতারই অংশ হিসেবে আমরা পাই ‘ আপনাকেই ঠিক করতে হবে গন্তব্য’ যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। আমরা কল্পনা করে নিতে পারে, পূর্বের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংস্করণটি এই গ্রন্থের পূর্বের কাব্যগ্রন্থগুলি নিয়েই হয়েছিল। কারণ ততদিনে চব্বিশ বছরের কাব্যজীবন তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। পরিবর্ধিত এই শ্রেষ্ট কবিতায় তাই আমরা পেয়ে যাচ্ছি ‘ অধর্ম কথা’ (২০০৯), ‘ ভালো বলতে শিখুন’ (২০১১), ‘নির্বাচিত দূরত্ব মেনে’ (২০১৩), ‘এই যে আমি চলেছি’ (২০১৫), এবং ‘আমি তো বলতেই পারতাম (২০১৭) কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্য থেকে কবির নির্বাচিত কবিতাগুলি। আর আশ্চর্য ভাব দেখি, ১৯৮৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কথিত নিয়ত পরিবর্তনশীল কাব্যভাষার বিষয়টি ৩৪ বছরেও পরিবর্তিত হয়নি। ২০১৭ পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতেও প্রবালকুমার বসু অক্ষুণ্ণ রেখেছেন তাঁর চিরজায়মান কাব্যভাষা। এই পরিবর্তনশীলতাই একজন কবিকে জীবিত রাখে। ‘অভ্যাসবশত’ নামক কবিতায় যেমন তিনি লেখেন, “ ফিরে আসতে আসতে দেখি বদলে যায় বাড়ি/ রোজ কার কাছে ফিরি?” এই প্রশ্ন যেন অনুরণিত হতে থাকে শ্রেষ্ঠ কবিতার ৩৪ বছরের নির্বাচিত প্রতিটি কবিতায়। কবির রাজনৈতিক ভাবনা, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, শিল্প এবং নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কিত ভাবনা – সমস্ত কিছুই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি, তাঁর কাব্যভাষা আন্তর্জাতিক আঙিনাকে স্পর্শ করে আছে। একই সঙ্গে আমরা অপেক্ষা করে থাকি শ্রেষ্ঠ কবিতার পুনরায় পরিবর্ধিত সংস্করণের জন্য। কারণ, কবি তো থেমে যাচ্ছেন না। তিনি নিজে পাল্টাচ্ছেন এবং নিজের কবিতাকেও বারবার পাল্টাচ্ছেন। কবির ব্যক্তিত্বের এই মানচিত্র এই শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে ধরা দিচ্ছে।
প্রবালকুমার বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা
দেজ পাবলিশিং
প্রচ্ছদ সৈকত সরকার
২৫০ টাকা