Next
Previous
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in










'শ্রীভোজদেবপ্রভবস্য বামাদেবীসুত শ্রীজয়দেবস্য।
পরাশরাদিপ্রিয়বন্ধুকণ্ঠে শ্রীগীতগোবিন্দকবিত্বমস্ত।।'

'গীতগোবিন্দম্ 'গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। রচনাকাল ১২ শতক। এই কাব্যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা — রাধার বিষাদ বর্ণনা, কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতা, উপালম্ভ বচন, কৃষ্ণের রাধার জন্য উৎকণ্ঠা, রাধার সখীদের দ্বারা রাধার বিরহ-সন্তাপের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে ।

গীতগোবিন্দম্ বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া, মরাঠি ইত্যাদি ভারতীয় ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, জার্মান, ল্যাটিন প্রভৃতি ইউরোপিয় ভাষায় অনূদিত হয়। এ থেকেই কাব্যের জনপ্রিয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতা অনুমান করা যায়।

‘গীতগোবিন্দম্' ভারতবর্ষে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য তার প্রমাণ মেলে উড়িষ্যার মন্দিরে ওড়িষি নৃত্যে ও সুরে গীতগোবিন্দ-গান উপাসনারই একটি অঙ্গ হিসাবে। দর্শকশ্রোতার মনে যে সাড়া জাগে তাতে নানা আবেগের মিশ্রণ ঘটে। অন্তঃসলিলা ভক্তিরস এই কাব্যে প্রবাহিত। অধিকাংশ গানে পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ ইত্যাদি শৃঙ্গাররসের নানা অনুষঙ্গ বর্তমান। শ্রোতা বা দর্শক বুঝতে পারে কৃষ্ণভক্তিই শৃঙ্গাররসের মেলবন্ধনে সম্পৃক্ত।

জয়দেব বার’শ শতকের সংস্কৃত কবি। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অজয়নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে তাঁর জন্ম। কেউ কেউ তাঁকে মিথিলা বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলেও মনে করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ভোজদেব, মাতা বামাদেবী। পদ্মাবতী নামের এক সুন্দরী তরুণীকে তিনি বিবাহ করেন।

জয়দেব সম্বন্ধে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের (১১১৯-১২০৫) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম; অপর চারজন হলেন গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ী ও উমাপতিধর। কারও কারও মতে তিনি কিছুকাল উৎকলরাজেরও সভাপন্ডিত ছিলেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জয়দেবের বিখ্যাত রচনা গীতগোবিন্দম্। এটি একটি সংস্কৃত গীতিকাব্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এর মুখ্য বিষয়। ২৮৬টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমন্বয়ে ১২ সর্গে এটি রচিত।

বর্ণিত বিষয়ের তত্ত্বনির্দেশক বারোটি ভিন্ন ভিন্ন নামে সর্গগুলির নামকরণ করা হয়েছে, যথা: সামোদ-দামোদর, অক্লেশ-কেশব, মুগ্ধ-মধুসূদন, স্নিগ্ধ-মধুসূদন, সাকাঙ্ক্ষ-পুন্ডরীকাক্ষ, ধৃষ্ট-বৈকুণ্ঠ, নাগর-নারায়ণ, বিলক্ষ-লক্ষ্মীপতি, মুগ্ধ-মুকুন্দ, মুগ্ধ-মাধব, সানন্দ-গোবিন্দ এবং সুপ্রীত-পীতাম্বর। কাব্যের নায়ক-নায়িকা রাধা-কৃষ্ণ হলেও তাঁদের প্রতীকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্ক এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেমই এর মূল বক্তব্য। রাগমূলক গীতসমূহ এ কাব্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। পরবর্তীকালের বাংলা পদাবলি সাহিত্যে এর গভীর প্রভাব পড়েছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায় ও সাহিত্য-রসিকদের নিকট গীতগোবিন্দম্ এক সময় পরম শ্রদ্ধার বিষয় ছিল।
গীতগোবিন্দম্ এর সর্গের নামগুলো থেকে বোঝা যায় এ কাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ।

এই গান বা পদ এবং শ্লোকগুলি কৃষ্ণ রাধা অথবা কোন এক সখীর উক্তি-রূপে ব্যবহৃত হওয়াতে সমগ্র কাহিনীটি একটি নাটকের পালার আকার ধারণ করে। বারোটি সর্গের প্রত্যেকটিরই একটি নাম আছে তা উপরে উল্লেখ্য করা হয়েছে।

দ্বাদশ সর্গে বিরচিত ‘গীতগোবিন্দ’ মূলত চব্বিশটি গানের একটি পালা, এ ছাড়া কাহিনী-সূত্র ধরিয়ে দেবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ছন্দে রচিত কতকগুলি শ্লোক। এই সর্গগুলোর উপর সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।

প্রথম সর্গে বর্ণিত হয়েছে----'সামোদ দামোদর’ : কৃষ্ণসন্ধানে তৎপরা শ্রীমতী রাধিকা এক সখীর সহায়তায় দেখতে পেলেন, অপর এক নায়িকার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ আমোদে মত্ত।

দ্বিতীয় সর্গ— 'অক্লেশ কেশব' : নিজের উৎকর্ষ আর রইলো না ভেবে শ্রীমতী নির্জনে এক লতাকুঞ্জে ক্ষুব্ধ হয়ে সখীকে বল্লেন, শ্রীকৃষ্ণ অপর যুবতীর প্রতি আসক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার মন তাঁর প্রতি অনুরক্ত কেন? শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের বিলাসকলা দেখে হয়তো বা রাধার কথাই স্মরণ করেছেন, তাঁর সঙ্গে রাধা মিলন কামনা করেছেন—কেশব সকলের ক্লেশ দূর করুন।

তৃতীয় সর্গ—'মুগ্ধ মধুসূদন' : শ্রীকৃষ্ণ ও অপর ব্রজাঙ্গনাদের ত্যাগ করে রাধার সন্ধানেই তৎপর হলেন। নিজের অপরাধবোধে তিনিও অনুতপ্ত। রাধাভাবে তন্ময় মুগ্ধ মধুসূদন রাধার সঙ্গে মিলনের কথাই ভাবছেন।

চতুর্থ সর্গ – ‘স্নিগ্ধ মধুসূদন': যমুনাতীরে বেতসকুঞ্জে অসহায় উদ্ভ্রান্ত মাধবকে এক সখী জানালেন তাঁর বিরহে রাধা অতিশয় কাতর হয়ে পড়েছেন; কখনো তিনি রোমাঞ্চিত, কখনো বিলাপরত, কখনো বা মূর্ছিত। একমাত্র স্নিগ্ধ মধুসুদনের কথা ভেবেই তিনি এখনো জীবিত রয়েছেন।

পঞ্চম সর্গ – ‘সাকাঙ্খ পুণ্ডরীকাক্ষ': রাধাকে তাঁর কুঞ্জে নিয়ে আসবার জন্য কৃষ্ণ সখীকে রাধার কাছে পাঠিয়ে দিলে সেই সখী রাধার নিকট কৃষ্ণের বিরহ-কাতর অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে জানালেন যে কৃষ্ণ ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে রাধার নাম ধরে কাঁদছেন। অতএব রজনী প্রভাত হবার পূর্বে শ্রীমতী যেন পুশুরীকাক্ষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন।

ষষ্ঠ সর্গ—‘ধৃষ্ট বৈকুণ্ঠ’ : সখী শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে এসে জানালেন যে শ্রীমতীর দেহ কৃষ্ণবিরহে বিকল, তার চলবার শক্তি নেই। এতএব ধৃষ্ট বা নির্লজ্জ-রূপে কৃষ্ণের এখন কর্তব্য বিপরীত অভিসারে রাধাকুঞ্জে গমন।

সপ্তম সর্গ – 'নাগর নারায়ণ’কৃষ্ণের প্রতীক্ষায় সময় কেটে চলে শ্রীমতীর; পাতা পড়ার শব্দে মনে হয় বুঝি কৃষ্ণ আসছেন। এদিকে জ্যোৎস্না দেখা দিলে রাধিকা একান্ত হতাশ হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। তার মনে ভয় হলো, কৃষ্ণ কি তবে সঙ্কেত-নির্দিষ্ট বেতস কুঞ্জে না এসে অপর কোন নায়িকার অভিসারে গিয়েছেন? বিপ্রলব্ধা শ্রীমতী বহুবল্লভ কৃষ্ণের নাগর-রূপের কল্পনায় সাতিশয় মনঃপীড়া বোধ করতে লাগলেন।

অষ্টম সর্গ—“বিলক্ষ লক্ষ্মীপতিঃ যামিনী অবসানে কৃষ্ণ শ্রীমতীর কুঞ্জদ্বারে উপনীত হলে তাঁর দেহে অপর নারীর সম্ভোগচিহ্ন দর্শন করে শ্রীমতী তীব্র ভাষায় তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। খণ্ডিত নায়িকার ভর্ৎসনায় বিলক্ষ অর্থাৎ বিস্মিত কৃষ্ণ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

নবম সর্গ – 'মুগ্ধ মুকুন্দ' : মদনসত্তপা ক্ষুব্ধা কলহান্তরিতা রাধাকে লক্ষ্য করে সখী নির্জনে তাকে বল্লেন যে কৃষ্ণ যখন অভিসারে এসেছেন তখন আর মান করে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। তিনি এসে মধুর কথা বলুন, তোমার হৃদয় যন্ত্রণাও দূরীভূত হবে।

দশম সর্গ—'মুগ্ধ মাধব'। সন্ধ্যার দিকে রাধার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলে কৃষ্ণ কাছে এসে রাধার রূপগুণের প্রশংসা করতে লাগলেন এবং তাঁর মান ত্যাগ করবার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। অতঃপর শ্রীমতীর চরণযুগলে মস্তক স্থাপন করে শ্রীকৃষ্ণ মানিনীর মানভঞ্জন করলেন।

একাদশ সর্গ – 'সানন্দ গোবিন্দ': এইভাবে শ্রীমতীকে প্রসন্ন করে কৃষ্ণ কুঞ্জশয্যায় গেলে সখী রাধিকাকে অনুসরণ করতে বললেন। সখীরা সকলে কুঞ্জ থেকে বাইরে চলে গেলে অভিসারিকা রাধিকার লজ্জাও অপসৃত হলো।

দ্বাদশ সর্গ – ‘সুপ্রীত পীতাম্বর': সখীরা চলে গেলে শ্রীকৃষ্ণ সাদরে রাধিকাকে গ্রহণ করলেন। স্বাধীনভর্তৃকা শ্রীমতী রাধা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন।

বিভিন্ন সর্গের শ্লোকগুলোতে রাধার উপস্থিতি বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয়।রাধা প্রধান চরিত্র।এ কাব্যের বড় একটা অংশ জুড়ে রাধার কথা বর্ণিত হয়েছে।তাঁর প্রেমের পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ এ গ্রন্থের মুখ্য বিষয়। গানে ধ্রুবপদ প্রায়ই ঘুরে ঘুরে আসে। নাচে ওড়িষি ভঙ্গিরই প্রাধান্য। এই সব আঙ্গিকে শৃঙ্গাররস ও ভক্তির আবেশ মিশে রয়েছে তার পশ্চাতে আনুমানিক কয়েক শ’ বছরের যাত্রা, গান ও নাচের পৃথক ও সম্মিলিত শিল্পরূপটি মন্দিরে অনুষ্ঠিত হত তার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যেহেতু নৃত্যগীতেরই প্রাধান্য ছিল তাই শব্দ ও অর্থ কিছুটা গৌণ।

গীতিকবিতার প্রথম স্রষ্টা হলেন কবি জয়দেব। তাঁর সুপ্রসিদ্ধ 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের মূল বিষয় রাধাবিরহ। কৃষ্ণ রাধাকে এড়িয়ে অন্য গোপিনীদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন জেনে রাধার বিরহ, মান, মানভঞ্জনে কৃষ্ণের অনুনয়, সখী-দূতীর মধ্যস্থতায় উভয়ের মিলনই হল কাব্যের বিষয়বস্তু।

বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদিতে কবির পরিচয় যেমন ভণিতাংশে পাওয়া যায় তেমনই 'গীতগোবিন্দ'-র তৃতীয় সর্গ, সপ্তম গীতিতে উল্লেখ আছে-
'বর্ণিতং জয়দেবকেন হরেরিদং প্রবণেন। কেন্দুবিল্বসমুদ্রম্ভবরোহিণীরমণেন।।'

এই ভণিতা অনুসরণে বলা যায় যে জয়দেবের জন্মস্থান কেন্দুবিল্ব। তিনি ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের (শাসন পর্ব ১১৭৮-১২০৬ ) সভাকবি। এর সমর্থনে লক্ষ্মণ সেনের সভামণ্ডপের দ্বারে প্রস্তর ফলকে খোদিত শ্লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। অতীতের কেন্দুবিল্ব ছিল সেনপাহাড়ি পরগণার অন্তর্গত। এই কেন্দুবিল্বই অপভ্রংশ হয়ে কেঁদুলি বা কেন্দুলি হয়। পরবর্তীতে তা জয়দেব-কেঁদুলি নামে পরিচিত হয়। এটি বোলপুর মহকুমার ইলামবাজার ব্লকের একটি গ্রাম। স্থানটি বর্ধমান বীরভূম জেলার সীমা নির্দেশকারী অজয় নদের তীরবর্তী এলাকায়।

জয়দেবের জন্মসন, বাল্যকালের কথা, 'গীতগোবিন্দ'-র রচনাকাল, সভাকবি হিসেবে অবস্থান ইত্যাদি সমস্তই যেহেতু অজ্ঞাত, স্বাভাবিকভাবে সেগুলি আনুমানিক। তাঁর রচনা 'গীতগোবিন্দম্'-ই কেবল সংস্কৃত সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। চক্রদত্তের সংস্কৃত 'ভক্তমাল', নাভজীদাসের 'ভক্তমাল', বীরভূমের কবি বনমালী দাসের 'জয়দেব-চরিত', 'শেকশুভোদয়া' প্রভৃতি গ্রন্থ রচিত হয়েছে জয়দেবকে নিয়ে। রচনাগুলি মূলত কিংবদন্তিকে আশ্রয় করে রচিত। কিংবদন্তির বহিরঙ্গে বহু পরিবর্তন ঘটে দিনে দিনে। কালে কালে তার অবয়বে কল্পনার রঙ লাগে।

পুরীতে পদ্মাবতীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া নিয়ে যেমন কিংবদন্তি আছে তেমনি সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তি হল 'দেহিপদপল্লবমুদারম্‌' লেখা নিয়ে। বিবাহের পর জয়দেব একটি কুটির নির্মাণ করে রাধাবিনোদ মূর্তি স্থাপন করেন এবং পদ্মাবতীকে মূর্তির পরিচর্যার দায়িত্ব দেন। প্রতিনিয়ত সেই যুগলমূর্তি দেখে ভক্তিপরায়ণ জয়দেবের মনে তার লীলা বর্ণনা করার একান্ত আগ্রহ জন্মায়। তিনি রচনা করে ফেলেন 'গীতগোবিন্দম্' নামক দ্বাদশ সর্গের অপূর্ব কাব্য।

এখানেও কিংবদন্তি আছে যে শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে লেখনী ধারণ করে সেখানে অক্ষর সংযোজন করেছিলেন। রাধিকার মধুর-রস বর্ণনা করতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর চরণে পতিত হন-জগতে এটি প্রসিদ্ধ। কিন্তু এ-বিষয়ে জয়দেব দ্বিধান্বিত ছিলেন। তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় প্রভুর লাঞ্ছনা বর্ণনা করতে পারছিলেন না। 'মম সিরসি মণ্ডনম্' পর্যন্ত লিখে দুঃখিত মনে সাগরে স্নান করতে যান। ইতিমধ্যে জয়দেবের রূপ ধারণ করে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এসে 'দেহিপদপল্লবমুদারম্‌' অংশটি লিখে দেন। পদ্মাবতী তাঁর আহার এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন এবং নিজেও আহারে বসেন। ইতিমধ্যে জয়দেব ফিরে আসেন। স্বামীর আগে পদ্মাবতীর আহারপর্ব দেখে অবাকই হন জয়দেব। ততোধিক অবাক হয়ে পদ্মাবতী জিজ্ঞাসা করেন, আপনি আগেই ফিরে এসেছেন এবং অসমাপ্ত অংশ লিখে ফেলেছেন। বুদ্ধিমান জয়দেব এই ঘটনার গূঢ়ার্থ বুঝলেন এবং পংক্তিটি দেখে প্রেমাবেশে উন্মত্ত হলেন। পদ্মাবতীর চরণ ধারণ করে বললেন-তুমিই ধন্যা, তোমারই জীবন সার্থক। তুমি যাঁর দর্শন আজ পেলে তিনিই তোমার প্রকৃত স্বামী।

জয়দেব 'গীতগোবিন্দম্' রচনা করেছিলেন এটা প্রমাণিত সত্য। কিন্তু তাঁর জীবনের নানা ঘটনাবলি নিয়ে নানা মত প্রচলিত। সেই মতের ওপর ভর করেই বলা যায়-জগন্নাথধাম, জয়পুর, বৃন্দাবনধাম পরিক্রমার পর জয়দেব সস্ত্রীক ফিরে আসেন কেঁদুলিতে। এরপর জন্মভূমিতেই ধর্মানুমোদিত বিবিধ কার্যানুষ্ঠানের মধ্যে কাল যাপন করেন। তাঁর প্রয়াণকাল জানা যায় না। প্রায় ৫০০ বছর পর কবি জয়দেবের স্মৃতি জাগরুক রাখতে বর্ধমান রাজপরিবার কেঁদুলিতে নির্মাণ করায় নবরত্ন রাধাবিনোদ মন্দির। পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেব-কেঁদুলিতে মেলা বসে। লক্ষ মানুষের সমাগমে প্রাচীন এই মেলা মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয় আউল-বাউল-সহজিয়াদের আগমনে। রাধাবিনোদ মন্দিরের প্রধান উৎসব রথ, দোল, রাস ইত্যাদি। তবে কেঁদুলি মেলা এই মন্দিরের উৎসব নয়।

এই অসাধারণ শ্লোক দিয়ে এই কাব্য রচনা করেন----মেঘৈমেদুরমম্বরং বনভুব: শ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ। নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়। ইখং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং, রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃকেলয়ঃ।।
বাংলা অর্থ----আকাশ মেঘে মেদুর হয়ে উঠেছে, বনভূমি তমালতরুতে শ্যামবর্ণ ধারণ করেছে। “(এখন) রাত্রি, এ (কৃষ্ণ) ভীরু, তাই রাধিকা তুমিই একে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এস,”নন্দের এই নির্দেশে রাধামাধব যমুনাতীরে পথে চলতে চলতে পথের প্রত্যেকটি কুঞ্জে যে কেলি করলেন তা-ই তোমাদের রক্ষা করুক।

ওই আশ্চর্য প্রথম চরণটি তার ধ্বনিমাধুর্যে নয়শো বছর ধরে শ্রোতা পাঠককে মুগ্ধ রেখেছে।
দ্বিতীয় শ্লোকে জয়দেব নিজের পরিচয় দিয়েছেন, এর তিনটি চরণই সমাসবদ্ধ এক-একটি পদ, খুব একটা বৈশিষ্ট্য নেই, শুধু বিষয়বস্তুটি নির্দেশিত হল : বাসুদেবের রতিকেলির কথাই এর উপজীব্য।

এই অংশটুকু দেখুন -- যদি হরিস্মরণে সরসং মনো/ যদি বিলাসকলাসু কুতূহলম। মধুর কোমলকান্ত-পদাবলীংশৃণু তদা জয়দেবসরস্বতীম।।
বাংলা অর্থ----যদি হরির স্মরণে মন সরস হয়, যদি শৃঙ্গার কলায় কৌতূহল থাকে তা হলে এই মধুর, কোমল, কমনীয় জয়দেবের কাব্য শোন। পড়তে পড়তে বোঝা যায় কবিতার বক্তব্য ও কোমলতা।

গীতগোবিন্দম্ এর নিচের এই বিখ্যাত শ্লোকটি প্রতি দৃষ্টি দিতে পারি।

‘চন্দনচর্চিতনীলকলেবরপীতবসনবনমালী।
কেলিচলন্মণিকুণ্ডলমণ্ডিতগণ্ডযুগস্মিতশালী।।’

বাংলা অর্থ -----কৃষ্ণের নীল শরীরে চন্দনচর্চা, গণ্ড দুটিতে স্মিত হাসি, প্রণয়কালে আন্দোলিত কানের মণিকুণ্ডল আন্দোলিত।

' ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনংত্বমসি মম ভব-জলধিরত্নম।। ' গীতগোবিন্দম্ এই শ্লোকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলা অর্থ-----
তুমিই আমার ভূষণ, তুমি আমার জীবন, এই জীবন-সমুদ্রে তুমিই আমার রত্ন।

এখানে ভূষণ, বা রত্ন প্রেমকে ব্যঞ্জিত করে না, করে কেবল ‘জীবন’ শব্দটি কিন্তু আড়ম্বর সর্বস্ব, অলংকার নির্ভর এ কাব্যে ভূষণ বা রত্ন প্রাধান্য পাবেই, তবু শ্লোকটি বেশই গভীরতায় পৌঁছোয়।

এই কাব্যের মনোরম রচনাশৈলী, ভাবপ্রবণতা, সুমধুর রাগরাগিণী, ধর্মীয় তাৎপর্য তথা সুললিত কোমল-কান্ত-পদাবলী সাহিত্যিক রসপিপাসুদের অপার আনন্দ প্রদান করে।
কবি জয়দেব রচিত ' গীতগোবিন্দম্' কাব্যটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও পৃথিবীর নানা ভাষায় তা অনূদিত হওয়ায় আজ তা বিশ্বসাহিত্যে চিরন্তন কাব্য হিসাবে বিবেচিত।