Next
Previous
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in








৩৯

বের্শেম আগে যে লেফটেন্যান্টকে পেয়েছিল গান কম্যান্ডার হিসেবে, তার নাম গ্রাশ্‌ট। যুদ্ধে যোগ দেবার আগে গ্রাশ্‌ট ছিল ধর্মযাজক। বের্শেম খুব বেশি ধর্মযাজকের সংস্পর্শে আসেনি সেভাবে কোনোদিন। তবে তার মতে গ্রাশ্‌ট বেশ ভালো মানুষ ছিল। গ্রাশ্‌ট সব সময় তার বরাদ্দ সাতটা গোলা হাইডেসহাইমের বাঁয়ে নদীর মোহনার দিকে ছুঁড়ত। সেখানে একটা কর্দমাক্ত বাদাবন ধরনের ব-দ্বীপ জেগে ছিল নদীর মুখে। উঁচু উঁচু ঘাসের বন, বেতের ঝোপ সেখানে। স্থানীয় বাসিন্দারা ওই জায়গাটাকে বলে কের্পেল। সেখানে ছুঁড়লে কারো আঘাত লাগার কথা নয়। বের্শেম তার নোটবইতে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার লিখে রাখত… ‘নদীর মুখে সন্দেহজনক নড়াচড়া।’ লেফটেন্যান্ট এই বিষয়ে আর কিছু বলেননি। ফলে গ্রাশ্‌ট সাতটা গোলা ওই জায়গাটাতেই ছুঁড়ত। কিন্তু দিনদুয়েক হল আরেকজন সেনা মোতায়েন হয়েছে এখানে। সেই সার্জেন্টের নাম শ্নিভিন্ড; সে আবার সাতটা গ্রেনেডের প্রতিটার ব্যাপারে হিসেবী। জ্যাম ফ্যাক্টরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেরিকান সেনার গাড়িটায় অবশ্য সে গোলা ছোঁড়ে না। শ্নিভিন্ড-এর লক্ষ্য হল সব সাদা পতাকাগুলো। আসলে ভাইডেসহাইমের সব বাসিন্দাদের মনে এই আশা ছিল যে আমেরিকান সেনারা তাদের জায়গাটা হয়তো দখল করে নেবে। তাই অনেকেই সুরক্ষিত থাকবার জন্য বাড়িতে সাদা পতাকা টাঙ্গিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমেরিকানরা কাছেই ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকলেও জায়গাটা দখল করেনি। আসলে ভাইডেসহাইমের অবস্থানটা একটু অদ্ভুত। নদীর বাঁকের মধ্যে; ফলে গোটা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি দৃশ্যমান। সেই কারণে আমেরিকান সেনারা হাইডেসহাইম অবধি এসে তারপর থেমে গেছে। হাইডেসহাইমের অবস্থান আবার উল্টো। একটু ভেতরদিকে। ফলে চট করে বাইরে থেকে দেখা যায় না। সেইজন্য আমেরিকান সেনাদের আর এগোবার কোনো পরিকল্পনা নেই। জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় মার্চ করতে করতে প্রায় ২০০ কিমি ভেতরে ঢুকে গেছে আমেরিকান সেনা; প্রায় দেশটার মাঝখানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই অঞ্চলে হাইডেসহাইম অবধি এসে তিন সপ্তাহ ধরে এখানে বসে আছে। একটা গোলা যদি হাইডেসহাইমের দিকে কেউ ছুঁড়েছে, তবে আমেরিকানরা একশখানার বেশি ছুঁড়ে প্রত্যুত্তর দেবে। সেইজন্য এখন কেউ হাইডেসহাইমের দিকে ছুঁড়ছে না গুলিগোলা। ফলে যে সাতখানা গ্রেনেড বরাদ্দ, সেই সবকটা ভাইডেসহাইম এবং তার আশেপাশে ছুঁড়তে হবে। ভাইডেসহাইমের যেসব বাসিন্দারা সাদা পতাকা টাঙ্গিয়ে রেখেছে, সার্জেন্ট শ্নিভিন্ড তাদের শাস্তি দিতে চায়। যারা সাদা পতাকা টাঙ্গিয়েছে, শ্নিভিন্ড-এর মতে তাদের না আছে সাহস, না আছে দেশপ্রেম। সে সাদা পতাকাগুলো সহ্য করতে পারছে না।

যাই হোক, বের্শেম আবার তার নোটবইতে লিখে রাখল, ‘৯ টা বাজে, নদীর মুখে সন্দেহজনক নড়াচড়া।’ ১০.১৫ এবং ১১.৪৫ নাগাদ সে আবার একই জিনিস লিখে রাখল। ‘হাইডেসহাইম থেকে আমেরিকান সেনার গাড়ি এসে জ্যামের কারখানার সামনে দাঁড়াল’। বারোটা নাগাদ সাধারণত সে কিছু সময়ের জন্য নিজের জায়গাটা ছেড়ে খাবার খেতে নামে। আজ যখন সে মই বেয়ে নামতে যাবে, নিচ থেকে শ্নিভিন্ড বলে উঠল …

‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন। ওইখানেই থাকুন একটু।’ বের্শেম আবার হামাগুড়ি দিয়ে খামারবাড়ির জানালায় দূরবিনের কাছে ফিরে গেল। শ্নিভিন্ড তার হাত থেকে দূরবিনটা নিয়ে নিল। তারপর দূরবিনে চোখ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দেখতে লাগল। বের্শেম পাশে বসে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল। আসলে শ্নিভিন্ড এমন একজন মানুষ, যে প্রায় কোনো কিছুই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস প্রচুর এবং চারপাশের লোকজনকে বুঝিয়ে ছাড়ে যে সে অনেক কিছুই পারে। যেরকম উৎসাহ নিয়ে সে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে এবং দূরবিন তাক করে নির্জন, নিষ্প্রাণ ভাইডেসহাইমের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, এই পুরো ব্যাপারটাই দেখানেপনা ছাড়া কিচ্ছু নয়। বের্শেম লক্ষ্য করে দেখল… যে তারামার্কা মেডেলটা বুকে আটকানো আছে শ্নিভিন্ডের, সেটা একদম নতুন। এছাড়া ঘোড়ার ক্ষুর মার্কা মেডেলটাও নতুন মনে হচ্ছে। শ্নিভিন্ড দূরবিনটা ফেরত দেয় তার হাতে, তারপর গজগজ করতে থাকে… ‘শুয়োর সব কটা, অপদার্থ, অভিশপ্ত শুয়োরগুলো সাদা পতাকা আটকে রেখেছে… দিন আমায়, আপনার নোটবুকটা দিন!’ বের্শেম দেয়।

শ্নিভিন্ড নোটবুকটার পাতা উল্টে উল্টে দেখতে থাকে… ‘অর্থহীন কাণ্ডকারখানা!’ বলে ওঠে সে… ‘আমি জানি না ওই নদীর মুখে বাদাবনে আপনি রোজ কী দেখেন! ওইখানে ব্যাঙ ছাড়া কিছু নেই। দেখি, দিন আমায়’… বলে সে দূরবিনটা আবার ছিনিয়ে নেয়। এবার তাক করে নদীর মোহনার দিকে। বের্শেম দেখতে থাকে লোকটার দিকে। সে দেখে যে লোকটার মুখের চারদিকে হালকা থুতুর লালা লেগে আছে… সরু সুতোর মত লালা ঠোঁটে লেগে নিচের দিকে ঝুলে আছে কিছুটা।

‘কিচ্ছু নেই’ বিড়বিড় করে শ্নিভিন্ড… ‘একেবারে কিছুই নেই ওই বাদাবনে… কিচ্ছুটি নড়ছে না… অর্থহীন ভাবনা!’ বের্শেমের নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নেয় লোকটা। নিজের পকেট থেকে এক টুকরো পেন্সিল বের করে। জানালা দিয়ে আবার দেখতে থাকে। তারপর কী যেন লেখে পাতায়… বিড়বিড় করে… ‘শুয়োর… শুয়োরের দল।’ তারপর কোনো রকম অভিবাদন না জানিয়ে উঠে চলে যায় লোকটা। নেমে যায় মই বেয়ে। এক মিনিট পরে বের্শেমও ওই জায়গা ছেড়ে উঠে চলে যায় নিজের খাবার খেতে।

--… ---… ---…



পাহাড়ের উপর থেকে, একটা আঙ্গুরক্ষেতের জমিতে দাঁড়িয়ে ফাইনহালস বুঝতে পারল যে ভাইডেসহাইম কেন আমেরিকান বা জার্মান, কোনও বাহিনী এখনও দখল করেনি। এই জায়গাটা দখল করে আদতে কোনও লাভ হবে না কোনও পক্ষেরই। গোটাপনেরো বাড়ি আর একটা বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা জ্যামের কারখানা… এছাড়া আর কিছু নেই। রেলস্টেশন এখানে নেই; সেটা হাইডেসহাইমে। নদীর উল্টোদিকে আউয়েলব্যার্গ, সেখানে রেলস্টেশন আছে। কিন্তু ওই জায়গাটা জার্মানরা দখল করে রেখেছে। ভাইডেসহাইম একটা নদীর বাঁকের মধ্যে, নদীটা এখানে দড়ির ফাঁসের মত বাঁক নিয়েছে। ভাইডেসহাইম এই দৃশ্যমান বাঁকের মধ্যে একেবারে ফেঁসে রয়েছে।

ভাইডেসহাইম আর পাহাড়ের মাঝে অপেক্ষাকৃত গোপন একটা ঢালের ফাঁকে রয়েছে হাইডেসহাইম অঞ্চলটা। ফাইনহালস দেখতে পেল ওই এলাকার মাঠে মাঠে অনেক ট্যাঙ্ক জড়ো করা আছে। স্কুলের মাঠে, গির্জার মাঠে, বাজারের চৌমাথায়, হোটেল, সরাইখানার আঙিনায় সর্বত্র ট্যাঙ্ক আর সেনাবাহিনীর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো এমনকি গাছপালা বা অন্য কিছু দিয়ে ঢেকে ক্যামোফ্লাজ করাও নেই। পাহাড়ের ঢালে উপত্যকায় এখন গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠছে। সাদা, গোলাপি, নীলচে সাদা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে চারিদিক। বাতাস হালকা হয়ে গেছে। বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। ফিঙ্কের জমি, বাড়ি, সব দেখা যাচ্ছে উপর থেকে। রাস্তার দু’ পাশে দু’টো চৌকো উঠোন, দাঁড়িয়ে থাকা চারজন প্রহরী… সব দেখতে পেল ফাইনহালস। কফিনের দোকানটার উঠোনে বসে একটা লোক কাজ করছে। বিরাট একটা সাদাটে হলদে বাক্স, একটু হেলে থাকা, নতুন একটা কফিন বানাচ্ছে লোকটা। সদ্য পালিশ করা কাঠ রোদ্দুরে চকচক করছে। লালচে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে যেন। লোকটার বউ কাছেই একটা বেঞ্চে বসে আছে। রোদ্দুরে বসে সব্জি কেটেকুটে পরিষ্কার করছে।

রাস্তায় রাস্তায় লোকজন দেখা যাচ্ছে। মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, দোকান বাজারে কেনাকাটা করছে। সেনাদের দেখা যাচ্ছে ইউনিফর্ম পরা। শহরতলির এক প্রান্তে স্কুলবাড়ি থেকে ক্লাসের শেষে এইমাত্র ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে এল; দল বেঁধে পথে হেঁটে যাচ্ছে তারা। কিন্তু উল্টোদিকে ভাইডেসহাইমে সবকিছু নিস্তব্ধ, চুপচাপ। গাছের পাতায় কিছু কিছু বাড়ি ঢেকে আছে। তবে ফাইনহালস ওখানে সবাইকে চেনে। সব কটা বাড়ি তার চেনা। এক ঝলক দেখে সে লক্ষ্য করল ব্যার্গ এবং হপেনরাথ… এদের বাড়িগুলো গোলা লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তার বাবার বাড়িটা একটাও আঁচড় লাগেনি। রাস্তার উপরে বাড়িটার চওড়া, হলুদ রঙের সুন্দর, শান্ত সামনের অংশটা দেখা যাচ্ছে। ফাইনহালস দোতলায় তার বাবা মায়ের ঘরের উপরের ছাদের অংশে সাদা পতাকা লাগানো দেখতে পেল। অন্যান্য বাড়ির তুলনায় তাদের বাড়ির পতাকাটা অনেক বড়। চারদিকে লিনডেন* গাছ সবুজে সবুজ হয়ে উঠছে। কিন্তু এলাকা একেবারে জনমানবশূন্য। একটিও প্রাণী কোনও জায়গায় দেখা যাচ্ছে না। সাদা পতাকাগুলো শক্ত করে লাগানো আছে বাড়িগুলোর গায়ে। অদ্ভুত শ্মশানের মত শান্তি বিরাজ করছে এলাকায়। জ্যামের কারখানার উঠোনটাও একদম খালি। মরচে ধরা খালি বালতিগুলোর স্তুপ দেখা যাচ্ছে। কারখানার শেডটা তালাবন্ধ। হঠাৎ ফাইনহালসের চোখে পড়ল যে হাইডেসহাইম স্টেশন থেকে উপত্যকা, ফলের বাগান পেরিয়ে একটা আমেরিকান গাড়ি দ্রুতবেগে ভাইডেসহাইমের দিকে যাচ্ছে। সাদা ফুলে ফুলে ঢাকা গাছের মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝেই গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অবশেষে দেখা গেল যে ভাইডেসহাইমের প্রধান সড়কের উপর দিয়ে যেতে যেতে গাড়িটা জ্যামের কারখানার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘যাচ্চলে… একী!’ ফাইনহালস নিচুস্বরে বলে। তারপর আঙুল দিয়ে গাড়িটার দিকে দেখিয়ে বুড়ো ফিঙ্ককে জিজ্ঞেস করে… ‘এটা কী ব্যাপার?’

পাহাড়ের উপরে একটা শেডের সামনে বেঞ্চিতে বুড়ো ফিঙ্ক বসেছিলেন ফাইনহালসের পাশেই। মাথা নাড়েন তিনি… ‘কিছু নয়… সেরকম কিছু না… সেরকম অর্থপূর্ণ ব্যাপার নয়… এ হল ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের প্রেমিক, রোজ একবার করে দেখা করতে আসে।’

‘একজন আমেরিকান?’

‘হ্যাঁ’ … বলে ওঠেন ফিঙ্ক… ‘আসলে স্বাভাবিক কারণেই ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখ বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পান। কারণ জার্মানরা মাঝে মাঝে ভাইডেসহাইমের উপরে গোলা ছুঁড়তে থাকে। সেজন্য লোকটিই আসে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে।’



(চলবে)



*লিনডেন গাছ বা লাইমউড ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জন্মানো খুব পরিচিত ওষধিগুণসম্পন্ন গাছ। এই গাছ প্রতীকী অর্থে প্রেমপ্রীতি ও শান্তির বাহক। পাতাগুলি হৃদয়চিহ্নের আকারের।





ReplyForward


Add reaction