ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক১১
ছাতের কামরার সামনে টিনের শেড, টিনের নীচে রংগনাথ, ওর নীচে খাটিয়া। বেলা দশটা, এখন শুনুন আবহাওয়ার খবর।কাল রাত্তিরে আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, এখন কেটে গেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বিগত দিনে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, এখন সেসব পরিষ্কার হয়ে যেতেই পৌষের শীতের কামড় টের পাওয়া যাচ্ছে। বাজারের নব্বই প্রতিশত মিষ্টি যেমন দেখতেই ভাল, খেতে নয়, তেমনই রোদ্দূরও পিঠে লাগানোর ছেয়ে দেখেই বেশি আরাম।রোদ চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু দেখলে মনে হচ্ছে শুধু নীমগাছের মাথাতেই আটকে রয়েছে। রঙ্গনাথ ওই নীমগাছের মাথায় পাতায় পাতায় রোদ্দূরকে মন দিয়ে দেখছে। শহরেও নীম গাছ আছে। সেখানেও রোদ এসে পাতায় পাতায় খেলা করে। কিন্তু তখন রঙ্গনাথ ওর দিকে তাকিয়েও দেখত না।কিন্তু ওই রোদ্দূরের রূপ ও গাঁয়ে এসে খেয়াল করে দেখল। এরকম অনেকের সাথেই হয়।
রঙ্গনাথের হাবভাব ওইসব ট্যুরিস্টের মত দেশে থাকতে যাদের পথঘাট, হাওয়া, ঘরবাড়ি,রোদ, দেশপ্রেম, গাছপালা, বদমাইসি, মদ, ওয়ার্ক কালচার, যুবতী এবং ইউনিভার্সিটি এসব চোখে পড়েনা, কিন্তু বিদেশে গেলেই দেখতে পায়। এর মানে রঙ্গনাথের চোখ রোদ্দুর দেখছে, কিন্তু মন আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির গভীরে হারিয়ে গেছে। ওর অনেক কিছুই তো হারিয়ে গেছে, যা কেবল গবেষকরা খুঁজে বের করতে থাকে।
রঙ্গনাথ ওর রিসার্চের জন্যে এমনই এক সাবজেক্ট খুঁজে বের করেছে। হিন্দুস্তানীরা নিজেদের অতীতের খোঁজে ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে এমনই এক বিষয় দাঁড় করিয়েছে যার গালভরা নাম-ইন্ডোলজি। এই বিষয়ের গবেষণা শুরুই হয় আগে এ’ব্যাপারে কারা কারা গবেষণা করেতাঁদের নামের গবেষণায়।রঙ্গনাথ ঠিক তাই করছিল।দু’দিন আগে শহরে গিয়ে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে গাদাগুচ্ছের বই তুলে এনেছে। এখন নীমগাছের মাথায় বিছিয়ে যাওয়া রোদ্দুরের চাঁদোয়ার নীচে বসে ওই বইগুলো পড়তে শুরু করেছে। ওর ডাইনে মার্শাল, বাঁয়ে কানিংহ্যাম, আর নাকের ঠিক নীচে শোভা পাচ্ছেন উইন্টারনিজ।কীথ পাছার কাছে পায়জামায় গা’ ঘষটাচ্ছেন। ভিনসেন্ট স্মিথ সরে গেছেন পায়ের কাছে এবং কিছু উল্টেপাল্টে গড়াগড়ি খাওয়া বইয়ের ভেতর থেকে উঁকি মারছেন মিসেস রাইস ডেভিস। পার্সিভ্যাল ব্রাউন ঢাকা পড়েছেন বালিশের নীচে। এতসব পন্ডিতের ভিড়ে বিছানার দোমড়ানো মোচড়ানো চাদরের এক কোণে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছেন কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল। ভান্ডারকর চাদরে মুখ ঢেকে লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন।ব্যস্, ইন্ডোলজির রিসার্চের হদ্দমুদ্দ একেবারে।
এইজন্যেই হঠাৎ একটা ‘হাউ-হাউ’ আওয়াজ ওর কানে কোন ঋষির সামবেদ গানের মত বেজে উঠল। ‘হাউ-হাউ’ আরও কাছে এল। ওর মনে হল কোন হরিষেণ বোধহয় সমুদ্রগুপ্তের বিজয়গাথা একেবারে ফুসফুসের সমস্ত জোর দিয়ে শোনাচ্ছে। এবার ওই ‘হাউ-হাউ’ নীচের গলিতে পৌঁছে গেছে আর তার সঙ্গে ‘মেরে ফেলব শালাকে’ গোছের কিছু ওজস্বী বাক্য যুক্ত হয়েছে। রঙ্গনাথ বুঝল –ওসব কিছু নয়, এটা ওই ‘গঞ্জহা’দের কোন লফড়া।
ও ছাদের কার্নিশের কাছে এসে নীচে গলির দিকে উঁকি মারল—এক যুবতী মেয়ে, এলোকেশি, রুক্ষ চুল, পরনের কাপড়টিও এলোমেলো, কিন্তু সমানে মুখ চালাচ্ছে। কিন্তু এইটুকু শুনে ভাববেন না যে শহরের ফ্যাশনদুরস্ত মেয়ে চুইংগাম চিবুচ্ছে। আসলে ও হোল ঠেট দেহাতি মেয়ে, নোংরা পোষাক, আর মুখ নড়ছে কারণ ও সঙ্গের ছাগলগুলোকে ‘হলে-হলে-হলে’ করে তাড়িয়ে আনছে।চার-ছ’টা বকরী পাঁচিলের ফাটলে গজিয়ে ওঠা একটি বটের চারাকে চিবুচ্ছে বা চিবিয়ে শেষ করে আরেকটি পাঁচিলের গায়ে কোন বটের চারা গজিয়েছে কিনা তার খোঁজে ব্যস্ত। রঙ্গনাথ মন দিয়ে দেখল- না, ওই হাউ-হাউয়ের উৎস এখানে নয়। ওর নজর ঘুরে ফিরে ওই মেয়েটির চেহারায় আটকে গেল। যারা কোন মেয়েছেলের কথা উঠতেই তালি বাজিয়ে নাচতে গাইতে লেগে যায়, এবং মেজে থেকে লাফিয়ে ছাদে ধাক্কা খায় তাদের জন্যে সব মেয়ে বা যেকোন মেয়ে, এমনকি এই মেয়েটিও ভাল দেখতে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, এই মেয়েটির তুলনায় ওই বকরীগুলো বেশি সুন্দর। হাউ-হাউ ধ্বনি র উৎস জানা যায়নি, কিন্তু লাগাতার ওই ধ্বনির অনুরণন শোনা যাছে। এই অবস্থায় রঙ্গনাথ পার্সি ব্রাউন, কানিংহামদের ছাদে ফেলে রেখে নিচে নেমে বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল। বৈদ্যজী এখন ওঁর দাওয়াখানায় ওষুধ নিয়ে ব্যস্ত, চার-ছ’জন রোগী এবং শনিচর ছাড়া কারও টিকিটি দেখা যাচ্ছেনা। হাউ-হাউ আওয়াজ এতক্ষণে গলির ভেতরে সেঁধিয়ে গেছে।
রঙ্গনাথ শনিচরকে ইশারা করে শুধোল—শুনতে পাচ্ছ?
শনিচর রোয়াকে বসে একটা কুড়ুলে বাঁট লাগাতে ব্যস্ত ছিল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে কান খাড়া করে খানিকক্ষণ ‘হাউ-হাউ’ শুনতে লাগল। হঠাৎ ওর কপালের চিন্তার ভাঁজগুলো মিলিয়ে গেল।ও শান্তভাবে বলল,’ হ্যাঁ, একতা হাউ-হাউ মত শোনা যাচ্ছে বটে। মনে হচ্ছে ছোটে পালোয়ান আর কুসহরের মধ্যে ফের ঝগড়া হয়েছে’।
এই খবরটা ও এমন নির্লিপ্তভাবে বলল যেন কোন মোষ কারও দেয়ালে একটু শিঙ রগড়ে নিল। ফের ও বাটালি দিয়ে কুড়ুলের বাঁট চাঁছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
হঠাৎ হাউ-হাউ একেবারে জলজ্যান্ত সামনে হাজির! ষাট বছরের এক শক্তসমর্থ বুড়ো।খালি গা’, মালকোঁচা মেরে পরা ধুতিটা হাঁটু অব্দি ঢেকেছে। মাথায় তিনটে ক্ষত, তার থেকে রক্তের ধারা বইছে তিন আলাদা দিশায়, এরথেকে প্রমাণ হচ্ছে যে একজাতের খুনেরও নিজেদের মধ্যে মেলামেশা পচ্ছন্দ নয়। বুড়োটা জোরে জোরে হাউ-হাউ করে চেঁচিয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে যেন সহানুভূতি কুড়োতে চাইছে।
রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেল রঙ্গনাথ।কাঁপা গলায় জানতে চাইল-এই লোকটা? এ কে? কে মেরেছে এমনি করে?
শনিচর কুড়ুলের বাঁট ও বাটালি আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখল।আহত বুড়ো মানুষটার হাত ধরে মাটিতে বসাল। লোকটি ‘কোন সাহায্য চাইনে’ ভাব দেখিয়ে হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিল, কিন্তু বিনা ওজর আপত্তি মাটিতে বসে পড়ল।শনিচর চোখ কুঁচকে মন দিয়ে চোটগুলো দেখে বৈদ্যজীর দিকে ঠোঁটের কোণ বেঁকিয়ে ইশারা করল যে চোট হালকা, বেশি গভীর নয়।ও্রদিকে বুড়োর ‘হাও-হাও’টাও দ্রুতলয় ছেড়ে বিলম্বিত লয় ধরেছে এবং শেষে কোন জটিল তালের সমে গিয়ে আটকা পড়েছে। এসব গায়কের ঘরানার হিসেবে বেয়াড়া চলন, কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট। ও রেগে উঠে চলে যাবেনা, বরং এখানে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসবে। শনিচর এবার নিশ্চিন্ত হয়ে এমন একখান শ্বাস টানল যেটা দূরের মানুষজন শুধু শুনতে নয়, দেখতেও পেল।
রঙ্গনাথের একেবারে পাঁজঞ্জুরিতে তিড়িতংক লেগে গেছে।শনিচর পাশের আলমারিটার থেকে তুলো বের করতে করতে জিজ্ঞেস মুখ খুলল,’ জিজ্ঞেস করছ ওকে কে মেরেছে? এটা আবার কেউ জিজ্ঞেস করে নাকি? এ হোল ছোটে পালোয়ানের বাপ। একে আর কে মারতে পারে, খুদ ছোটে পালোয়ান ছাড়া? কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে পালোয়ানের বাপের গায়ে হাত তুলবে’?
কথা বলতে বলতে শনিচর এক লোটা জল ও কিছু তুলো নিয়ে বুড়োর কাছে পৌঁছে গেল।
নিজের ছেলের এবংবিধ প্রশংসা শুনে ছোটে পালোয়ানের বাপ কুসহর বা কুসহরপ্রসাদের বোধহয় একটু জ্বালা জুড়োলো।সে ওখান থেকেই উঁচু গলায় বৈদ্যজীকে বলল, ‘মহারাজ, এবার তো ছোটুয়া আমায় মেরেই ফেলেছিল। আর তো সয়না।এবার আমাদের ভাগাভাগি করে দাও। নইলে কোন দিন ওই আমার হাতে খুন হয়ে যাবে’।
বৈদ্যজী এবার তক্তপোষ থেকে নেমে রোয়াকের দিকে এগিয়ে এলেন।ক্ষতগুলো মন দিয়ে দেখে অভিজ্ঞ কবিরাজের গলায় বললেন—‘চোট টোটগুলো তেমন গভীর নয়। এখানে চিকিৎসা না করিয়ে হাসপাতালে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।ওখানেই পট্টি-টট্টি বেঁধে দেবে’খন’। তারপর দরবারের লোকজনকে শুনিয়ে বললেন- কাল থেকে ছোটের এখানে আসা বন্ধ। এমন নরকের বাসিন্দের এখানে স্থান নেই।
রঙ্গনাথের রক্ত টগবগ করছিল। বলল,’আশ্চর্য, এমনসব লোকজনকে বদ্রীদাদা পাশে বসিয়ে রাখেন’।
বদ্রী পালোয়ান ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে বলল,’লেখাপড়া জানা লোকেরা একটু ভেবেচিনতে কথা বলে। আসলে কার দোষ, কে জানে?এই কুসহরও কোন কম যায় না। এর বাপ গঙ্গাদয়াল যখন মরল, এ ব্যাটা বাপের শব ঘর থেকে চালিতে করে বের করতেই দিচ্ছিল না। বলছিল নদীর ঘাট অব্দি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে’।
কুসহর ফের হাউ-হাউ হল্লা শুরু করল, কিন্তু বেশ কষ্ট করে। যার মানে, বদ্রী এসব কথা তুলে আসলে ওর প্রতি ভয়ানক অত্যাচার করছে।একটু পরেই ও সোজা দাঁড়িয়ে উঠে হুংকার ছেড়ে বলল, “বৈদ্যজী মহারাজ, ছেলেকে সামলাও। ও এইসব পুরনো কথা তুলে ইচ্ছে করে তোল্লাই দিচ্ছে যাতে দু’চারটে লাশ পড়ে যায়।ওকে চুপ করাও, নইলে খুন না করে থামবো না । আমি হাসপাতালে পরে যাব, আগে থানায় যাচ্ছি। ছোটুয়াকে এবার যদি আদালতে টেনে না নিয়ে যাই, তবে তোমরা আমায় গঙ্গাপ্রসাদের সন্তান নয়, জারজ সন্তান বলে ডেকো। আমি তো তোমাকে খালি আমার আঘাত দেখাতে এসেছিলাম। দেখে নাও মহারাজ, তিন জায়গা থেকে খুন বইছে; দেখে নাও, তোমাকেই আদালতে সাক্ষী দিতে হবে”।
বৈদ্যজী ওর আঘাত না দেখে অন্য রোগীদের দিকে মন দিলেন। তার সঙ্গে বক্তিমে চালু। যেমন, নিজেদের মধ্যে কলহ শোকের কারণ হয়। এসব বলে উনি লাপরমান ফিয়ে ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তারপর পুরাণের ঝাড়বাতির আলোর ছটা থেকে এক লাফে বর্তমানে ফিরে এলেন।এবার পারিবারিক কলহকে শোক ও পশ্চাত্তাপের মূল কারণ প্রমাণ করে উনি কুসহরকে পরামর্শ দিলেন যে কোর্ট-কাচারির চক্করে পড়তে নেই। শেষে উনি আবার প্রমাণ করতে লাগলেন যে থানা-পুলিশও শোকের মূল কারণ।
কুসহর গর্জে উঠল,” মহারাজ, এসব জ্ঞান নিজের কাছে রেখে দাও। এখানে রক্তের নদী বইছে আর তুমি গান্ধীগিরি ঝাড়ছ? যদি বদ্রী পালোয়ান কোনদিন তোমাকে চিত করে বুকের উপর চড়ে বসে তখন দেখব তোমার ইহলোক-পরলোক লেকচার কোথায় থাকে”!
বৈদ্যজীর গোঁফ থরথর করে কাঁপছে, তার মানে উনি অপমানিত বোধ করছেন। কিন্তু মুখের হাসিটি এমন যেন অপমান কাকে বলে উনি জানেনই না। যারা হাজির ছিল তাদের সবার মুখের চেহারা শক্ত হয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছে, কুসহরের এখানে আর সহানুভূতি জুটবে না। বদ্রী পালোয়ান ওকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিল।
“ যাও যাও; মনে হচ্ছে ছোটুয়ার সাথে হাতাহাতি করে মন ভরেনি। গিয়ে ব্যান্ডেজ ফ্যান্ডেজ করিয়ে নাও। এখানে বেশি টিলটিলিও না”।
এখন পর্য্যন্ত যা নমুনা দেখা গেছে তাতে মনে হচ্ছে ছোটে পালোয়ানের বংশটি বেশ খানদানি।ওর প্রপিতামহের নাম পর্য্যন্ত মনে আছে! আর সমস্ত খানদানি বংশের ছেলেদের মত ও নিজের পরিবারের গৌরবগাথা শোনাতে ভালবাসে। কখনও কখনও কুস্তির আখড়ায় সাথিদের কিসসা শোনাতে থাকেঃ
‘আমার পরদাদার নাম ভোলানাথ। কথায় কথায় রাগ; রাগলে পরে নাকের পাটা ফুলে উঠত। রোজ সকালে উঠে আগে নিজের বাপের সঙ্গে একটু করে তারপর মুখ ধুতে যেত। ওই উস্তুম-ধুস্তুমটি না হলে ওনার পেটখারাপ হয়ে যেত’।
ছোটে পালোয়ানের বর্ণনায় পুরনো দিনের জন্যে এক ভালোলাগা ঝরে পড়ে। ওর কিসসা শুনতে শুনতে শ্রোতার চোখের সামনে ফুটে ওঠে একটি উনবিংশ শতকের গাঁইয়ের ছবি, যেখানে দরজার সামনে একগাদা গাইবলদ, গোবর ও চোনার ঝাঁঝালো গন্ধ, নিমের ছায়া আর যার নীচে খাটিয়ায় দুই মহাপুরুষ গড়াতে থাকে ও মাঝে মাঝে উঠে বসে গা’ থেকে নিমের পাতা ফুল ঝাড়তে ঝাড়তে একে অন্যকে এতক্ষণ শুয়ে থাকার অপরাধে গাল পাড়তে থাকে। ওই দুই মহাপুরুষের একজন বাপ, অন্যজন তার ব্যাটা। এরপর দুজন একে অপরকে মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার হুমকি দিতে দিতে খাটিয়া ছেড়ে উঠে দু’চারট্র আলতু ফালতু বকবক করে –‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’ হয়ে যায়। একজন বলদের লেজ মোচড়াতে মোচড়াতে নিজের খেতের দিকে রওনা হয়। অন্যজন মোষ চরাতে অন্যের খেতে চলে যায়।
এরকম একটা গল্প শেষ করার পর ছোটে হরদম বলত, ‘বাপটা মরে গেলে ভোলানাথ দুঃখে ভেঙে পড়েছিল’।
এই লাইনটা ছোটে ন্যাকামি করে বলত না। ভোলানাথ সত্যি সত্যি ছিভেঙে পড়েছিল।ওর বংশে এমনই রেয়াজ ছিল। ওদের খানদানে সব প্রজন্মেই বাপ-ব্যাটার সম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ হত। ওরা প্রেম করত শুধু নিজেদের মধ্যে, লাঠালাঠি? সেও ওই বাপ-ব্যাটার মধ্যে।ওদের ভেতরে ভালো-মন্দ, সুপ্ত প্রতিভা বা গুণ যাই থাকুক তার প্রয়োগ বাপ-ব্যাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত।
বাবা ভোলানাথ নিজের বাপবুড়ো মরে গেলে সত্যি সত্যি বড় শোক পেয়েছিল। জীবনে এক নি;সংগতা এক শূন্যতা ছেয়ে গেল। সকালে উঠে কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে না পেরে ওর পেট গুড়গুড় করতে লাগল। চোখে মুখে জল দেয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেল।রাতদিন খেতে বলদের মত পরিশ্রম করেও খাবার হজম হচ্ছিল না। তখন ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ এগিয়ে এল। লোকে বলে যে ছেলে হোল বুড়ো বয়সে চোখের জ্যোতি। তা’ গঙ্গাপ্রসাদ সতের বছর বয়সেই নিজে বাপ ভোলানাথকে এমন একখান লাঠির ঘা কষাল যে তিনি মাটিতে চিৎপটাং।তাঁর চোখের মণি কড়ির মত বেরিয়ে এল এবং চোখের সামনে ফুলঝুরি জ্বলতে লাগল।
এরপর বাপ-ছেলের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেল।। ভোলানাথ সরে গেল ওর মৃত বাপের ভূমিকায়, ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ চলে এল ওর জায়গায়। কিছুদিন গেলে হাত-পায়ের ব্যথার চোটে ভোলানাথের পেট ঠিক হয়ে গেল বটে, কিন্তু কানের মধ্যে সারাক্ষণ একটা সাঁই সাঁই আওয়াজ চলতে থাকে। এটা বোধহয় গঙ্গাপ্রসাদের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া গালির স্রোতের দান। যাই হোক, এবার সকাল বেলা ঘরের মধ্যে উস্তুম-ধুস্তুম করার আশায় গঙ্গাপ্রসাদের পেটের মধ্যে গুরগুর শুরু হোল।
ছেলে কুশহরপ্রসাদ হল ছোটু পালোয়ানের বাপ। কুশহরপ্রসাদ একটু গম্ভীর স্বভাবের। তাই বাপের সঙ্গে খামোখা গালাগালি করে সময় নষ্ট করত না। এছাড়া রোজ সকালে খেতে কাজ করতে যাওয়ার আগে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করার যে কয়েক পুরুষের অভ্যেস সেটাও ও ছেড়ে দিল। তার বদলে আরম্ভ হোল মাসিক দরে মারপিট। গঙ্গাপ্রসাদের ছোটবেলা থেকেই নোংরা ছ্যাঁচড় গালির জন্যে এত নাম হোল যে নওজোয়ান গঞ্জহা’র দল রোজ বিকেলে ওর আড্ডায় হাজিরা দিতে লাগল। ওর মৌলিক এবং শিল্পসম্মত গালিগুলো শুনে ওরা পরে নিজের নামে চালিয়ে দিত। গালাগাল এবং গেঁয়ো গানের পদরচনার কোন কপিরাইট তো হয়না। এভাবে গঙ্গাপ্রসাদের গালিগুলো হাজার কন্ঠে হাজার পাঠান্তরের সঙ্গে ধ্বনিত হতে থাকল। কিন্তু বাপের এই প্রতিভায় কুসহর আদৌ প্রভাবিত হলনা। ও চুপচাপ গালি শুনতে শুনতে বাপকে মাসে একবার দু-চারটে লাঠির বাড়ি কষিয়ে ফের নিজের কাজে চলে যেত। দেখা গেল, বদহজমের পারিবারিক অসুখটি সারাতে এই পদ্ধতি বেশ কাজের। কারণ, বদহজমের সমস্যাটি গঙ্গাপ্রসাদের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছল।
কুসহরপ্রসাদের আরও দুটো ভাই ছিল-বড়কু আর ছোটকু। ওরা দু’জন শান্তশিষ্ট, নিরস্ত্রীকরণের ভক্ত। সারাজীবনে একটা কুকুরকেও লাঠিপেটা করেনি। বেড়াল আরামসে ওর রাস্তা কাটে, ও তাদের একটা ঢিলও ছোঁড়েনা। কিন্তু ওরা বাপের থেকে গালি দেয়ার শিল্পকলা শিখে ফেলেছিল। আর তার দৌলতেই ওরা রোজ সন্ধ্যায় সমস্ত পারিবারিক ঝগড়ার সমাধান বিনা মারপিট করে সেরে ফেলত। রোজ সন্ধ্যে হলে দুই ভাই আর তাদের দুই গিন্নি মিলে যে ‘কাঁও কাঁও’ শুরু হত সেই অধিবেশন শেষ হতে হতে রাত দশটা। এই অধিবেশনগুলোর তুলনা দেশের সুরক্ষা সমিতির বৈঠকের সঙ্গে কয়রা যেতে পারে। কারণ ওই বৈঠকগুলোতেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অনেকক্ষণ ‘কাঁও কাঁও’ করে যুদ্ধের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কম করে ফেলে।
এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কুশহরপ্রসাদ পরিবারের রোজকার হল্লাগুল্লাকে ঘৃণার চোখে দেখাটা প্রতিক্রিয়াবাদীর চিহ্ন, কিন্তু আশপাশের লোকজনের রাজনৈতিক চেতনা অতটা বিকশিত হয়নি যে, কী আর করা! ফলে যেই সন্ধ্যেবেলা ছোটকু ও বড়কুর গালি এবং হাহাকারের ধ্বনি গলির কুকুরের ভৌ ভৌকে ছাপিয়ে উঠে শিবপালগঞ্জের আকাশকে বর্শার খোঁচায় ফালাফালা করে ফেলে অমনই পড়শিদের টিপ্পনি শুরু হয়ে যায়ও।
‘ এখন এই কুকুরহাও’ (ঘেউ ঘেউ) মনে হচ্ছে আদ্দেক রাত অব্দি চলবে’।
‘ একদিন একটা ফাটা জুতো নিয়ে এদের উপর চড়াও হব, তবেই এরা শিখবে’।
‘এর জিভে ব্রেক ফেল হয়ে গেছে। চলছে তো চলছেই’।
এই ‘কুকুরহাও’ শব্দটা গঞ্জহাদের তৈরি। কুকুরের দল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি করে আর একটা আরেকটাকে উসকে দেয়ার জন্যে খানিকক্ষণ চেঁচায়, সেটাই ‘কুকুরহাও’।শব্দকোষের নিয়ম-টিয়ম দেখলে ছোটকু এবং বড়কুর আলাপকে ‘কুকুরহাও’ বলা বোধহয় উচিত হবেনা। আসলে এরা দুইভাই দুইবৌ যা করে সেটা হোল বান্দরহাও। এরা বাঁদরের মত খোঁ খোঁ করে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কোন রেফারির বাঁশি না বাজলেও নিজে থেকে পিছিয়ে আসে। যদি বাইরের কেউ মধ্যস্থতা করতে আসে বা ওদের শান্তির মহত্ত্ব বোঝাতে চাইবে তাহলে তক্ষুণি ওরা দুজনে এক হয়ে তৃতীয় ব্যক্তির উপর খোঁ খোঁ করে হামলা করবে। বান্দরহাও এর এই নিয়ম সব গঞ্জহা জানে। তাই ছোটকু-বড়কুর পারিবারিক অধিবেশনের সমালোচনা হয় লুকিয়ে চুরিয়ে, পেছনে আর ওদিকে ওদের ওই অধিবেশন মাঝরাত পর্য্যন্ত বাধাহীন চলতে থাকে।
ছোটে পালোয়ানের বাপ কুশহরপ্রসাদ হোল কম কথার কাজের মানুষ।ও ছোট দু’ভায়ের বাগীশ্বরী প্রবন্ধাবলীর ব্যাপারটা কোনদিন বোঝেনি।ওর স্বভাব হোল খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ হঠাৎ হাত চালিয়ে দেয়া। এটা আবার অন্য ভাইদের জীবনদর্শনের সঙ্গে একেবারে খাপ খায় না। এইজন্যে ও বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মারা যাবার কয়েকবছর পরে ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। মানে, কোন কথা না বলে একদিন লাঠির জোরে ভাইদের বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিল। ওরা বাধ্য হোল একটা ক্ষেতের মধ্যে ঝুপড়ি বানিয়ে বাণপ্রস্থ-আশ্রম মেনে নিতে, আর নিজে পৈতৃক বাড়িতে জোয়ান ছেলের সঙ্গে ওদের বাপছেলের খানদানি ঐতিহ্যের সঙ্গে গৃহস্থ-আশ্রম চালাতে লাগল।
মাসের মধ্যে অন্ততঃ একবার বাপকে লাঠিপেটা করে কুশহরের এমন অভ্যেস হয়ে গেছল যে বাপ মরে যাওয়ায় ওর হা্তে মাসে দু’চার দিন পক্ষাঘাতের মত হয়ে যেত।পক্ষাঘাতের ভয়ে ও একদিন আবার লাঠি তুলে নিল এবং ছেলে ছোটে পালোয়ানের কোমরে ত্যাড়া করে এক ঘা কষাল। ছোটে তখনও ছোট, পালোয়ান হয়নি, কিন্তু গাঁয়ের বাইরে রেললাইনের পাশে তার টানা বড় বড় লোহার স্তম্ভের উপর সাদা সাদা ইনসুলেটর ঢিল ছুঁড়ে ভাঙা অভ্যেস করছিল। ওর নিশানা ছিল অব্যর্থ। যেদিন কুশহরপ্রসাদ ছোটের কোমরে লাঠির ঘা কষাল মাত্র সেইদিনই ও রেললাইনের ফাঁকে বিছানো নুড়ির থেকে বেশ ক’টা তুলে নতুন একটা স্তম্ভের গায়ে লাগানো সবক’টা ইন্স্যুলেটর ভেঙে আবার লাইনের ফাঁকে বিছিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। লাঠির ঘা’ খেয়ে ও রেললাইনের দিকে বিশ পা দৌড়ে গিয়ে একটা নুড়ি তুলে বাপের মাথাকে ইন্সুলেটর ভেবে তাক করল।ব্যস্ সেদিন থেকেই ওদের পরিবারে বাপ-ছেলের মধ্যে বংশপরম্পরায় চলে আসা সনাতন ধর্ম প্রাণ পেয়ে জেগে উঠল।ব্যস্ আরকি! এরপর প্রায় প্রতিমাসে কুশহরের চেহারায় দু’একটা ছোট ক্ষত পার্মানেন্ট দেখা যেতে লাগল। এভাবে অল্প দিনেই ও অঞ্চলের রানা সঙ্গার ( বাবরের সঙ্গে লড়াইয়ে আশিটা ঘা’ নিয়ে লড়ে যাওয়া মেবারের রাণা) টাইটেল পেল।
ছোটে পালোয়ান জোয়ান হয়ে উঠলে পরে বাপ-ব্যাটার মধ্যে শব্দের আদানপ্রদান থেমে গেল। ওরা উঁচুদরের শিল্পীর মত নিজের ভাবনার প্রকাশ চিহ্ন, প্রতীক ও ইংগিতের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে শুরু করল।ওদের মধ্যে মারপিটের ঘটনাও কমে গেল। ওসব বড় বড় নেতাদের জন্মদিন পালনের মত ধীরে ধীরে এক বার্ষিক অনুষ্ঠানের রূপ নিল, যা জনতার দাবি হোক না হোক, নির্ধারিত সময়ে পালন করা হয়ে থাকে।
কুশহরপ্রসাদ চলে গেলে রোয়াকের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ফুট কাটল- এই হোল কলিযুগ! বাপের সাথে ব্যাটার ব্যভারটা দেখলে!
মাথার উপরের নীম গাছের ডালপালা সরিয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে লোকটা ফের বলে উঠল, ‘প্রভু তুমি কোথায়? কবে কল্কি অবতাত্রের রূপ ধারণ করে নেমে আসবে?
উত্তরে কোন আকাশবাণী তো দুর, একটা কাকের আওয়াজও শোনা গেল না। কল্কি অবতারকে আহ্বান করা লোকটির মুখ কালো হয়ে গেল। কিন্তু কুড়ুলের বাঁট পরীক্ষায় ব্যস্ত শনিচর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, ‘যাও, তুমিও কুসহরের সঙ্গে সঙ্গে যাও। সাক্ষী দিও, সিকি-আধুলি কিছু না কিছু ঠিক জুটে যাবে’।
বদ্রী পালোয়ান মুচকি হেসে সায় দিল।রঙ্গনাথ দেখল কল্কি অবতারের বাতেলা করা লোকটি একজন পুরুতের মত দেখতে বুড়োমানুষ।চিমড়ে গাল, খিচুড়ি দাড়ি, বোতামহীন জামা, মাথায় একটা যেমন তেমন গান্ধীটুপি, তার পেছন থেকে টিকি এমনভাবে বেরিয়ে যেন আকাশ থেকে বাজ পড়লে আর্থিং এর কাজ দেবে।ওর কপালে লাল চন্দনের ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।
লোকটা সত্যি সত্যি কুশহরের পেছন পেছন চলে গেল। শনিচর বলল,” ওই হোল রাধেলাল। সাক্ষী দেয়ার একনম্বর। কোন উকিল, যত নামজাদাই হোক, আজ অব্দি ওকে জেরা করে পেরে ওঠেনি।
শনিচরের পাশে একটা আমোদগেঁড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভক্তিভরে বলে উঠল, ’রাধে্লাল মহারাজের উপর কোন দেবতার ভর হয়। মিথ্যে সাক্ষী চটপট দিতে থাকে। উকিলের দল চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। বড় বড় লোকের হাওয়া টাইট হয়ে যায়’।
খানিকক্ষণ রাধেলালের তারিফ করে কাটল। শেষে শনিচর আর ওই আমোদগেঁড়ের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল। শনিচরের হিসেবে রাধেলাল বড্ড গোঁয়ার আর শহরের উকিলগুলো হাঁদারাম, নইলে ওকে জেরায় কাত করতে পারে না? উলটো দিকে আমোদগেঁড়ে এটাকে দেবতার আশীর্বাদ এবং বিভূতি প্রমাণ করেই ছাড়বে। যুক্তি আর বিশ্বাসের লড়াইয়ে বিশ্বাস যে ক্রমশঃ যুক্তিকে পেড়ে ফেলছে সেটা বলার দরকার নেই। ঠিক তখনই পাশের কোন একটা গলি থেকে ছোটে পালোয়ান উদয় হোল। বৈদ্যজীর দরজায় এসে এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি মেরে তারপর বলল,’ চলে গেছে’?
শনিচর বলল, ‘হ্যাঁ গেছে। কিন্তু পালোয়ান, এই পলিসিটা মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে’।
পালোয়ান দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’তোর মনুষ্যত্বের ইয়ে করি’।
শনিচর কুড়ুল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাল,’দেখো বদ্রী ভাইয়া! তোমার বাছুর আমাকে চাট মারছে! সামলাও’!
বৈদ্যজী ছোটেকে দেখে উঠে পড়লেন। রঙ্গনাথকে বললেন,’ এমন নীচপ্রবৃত্তির মুখ দেখাও পাপ! একে এখান থেকে ভাগাও’! এই বলে উনি ভেতরে চলে গেলেন।
ছোটে পালোয়ান বৈঠকখানার ভেতরে ঢুকে পড়ল। চারদিকে রোদের খেলা। সামনের নীমগাছে একগাদা টিয়েপাখি টে-টে করে ওড়াউড়ি করছে।রোয়াকের উপর শনিচর কুড়ুল হাতে খাড়া। বদ্রী পালোয়ান এক কোণে চুপচাপ একজড়া মুগুরের ওজন পরীক্ষায় ব্যস্ত।রঙ্গনাথ বৈঠকে পড়ে থাকা একটা বইয়ের পাতা ওল্টানোয় ব্যস্ত। ছোটে টের পেল যে হাওয়ায় বারুদের গন্ধ। এর জবাবে ও ছাতি ফুলিয়ে রঙ্গগনাথের পাশে ধপ করে বসে পড়ল আর চোয়াল নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখের ভেতর পুরে রাখা সুপুরির জাবর কাটতে লাগল।তারপর ছোটে রঙ্গনাথের দিকে এমন করে তাকাল যেন ও একেবারে নস্যি। তারপর তিরিক্ষি ভাবে বলল,’ তাহলে এই ব্যাপার! আমি তো আমার বদ্রীগুরুর ঘর ভেবে এসেছিলাম, কিন্তু যদি তোমাদেরই মাতব্বরি চলে তো এখানে আর পেচ্ছাপ করতেও আসছি না’।
রঙ্গনাথ হেসে পরিবেশ হালকা করতে চাইল। ‘আরে না না, পালোয়ান বসো দিকিনি! মটকা গরম হয়ে থাকে তো এক লোটা ঠান্ডা জল খাও’।
ছোটের গলার স্বর আগের মতই কর্কশ,’জল খাবো? আমি এখানে ছোঁচানোর জন্যেও জল চাইব না। সবাই মিলে আমায় ইল্লি করতে লেগেছে’।
বদ্রী এবার ছোটের দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর একটা মুগুর নিয়ে বাঁহাতে খেলতে খেলতে মুচকি হেসে বলল, ‘রেগে যাওয়া দুর্বলকে শোভা দেয়। তুমি কেন নাক ফোলাচ্ছ? তুমি মানুষ না পায়জামা’?
ছোটে পালোয়ানের সমর্থনের ইশারা বুঝতে দেরি হল না। আরও মেজাজ দেখিয়ে বলল,’ বদ্রী গুরু! আমার একটূও ভাল লাগছেনা। সবাই আমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়েছে্, কাঠি করছে।খালি বলে-বাপের গায়ে কেন হাত তুলেছ? বাপকে কেন মেরেছ?যেন কুশহরপ্রসাদ শিবপালগঞ্জে সবার বাপ!আর আমিই খালি ওর শত্রু’।
বলতে বলতে ওর রাগ আরও চড়ে গেল। বলল,’ দেখ গুরু, শালা একটা বাপের মত বাপ হত, তাও বুঝতাম’।
খানিকক্ষণ সবাই চুপ।
রঙ্গনাথ ছোটে পালোয়ানের বাঁকা ভুরু মন দিয়ে দেখছে। শনিচর এবার রোয়াক থেকে দরবারের ভেতরে এল। ও পালোয়ানকে বোঝাতে চাইল,’এমন সব কথা মুখে আনতে নেই।একটু মাটিতে পা ফেল, খামোখা আকাশের বুকে খোঁচা মেরো না।কুসহর তোমাকে জন্ম দিয়েছে, পালন-পোষণ করে এত বড় করেছে, এটা তো মানবে’?
ছোটে কুড়কুড়িয়ে বলল,’আমি বুঝি স্ট্যাম্প লাগিয়ে দরখাস্ত পেশ করেছিলাম—আমাকে জন্ম দাও? ওরে আমার জন্মদেনেবালে রে’!
বদ্রী এতক্ষণ চুপচাপ কথাবার্তা শুনছিল। এবার মুখ খুলল,’অনেক হয়েছে ছোটে, এবার ঠান্ডা হ’ দিকি’!
ছোটে নিরুৎসাহ ভঙ্গিমায় বসে রইল।বোধহয় নিমগাছের মাথায় টিয়ে পাখির টে-টে কিচিরমিচির শুনছিল। শেষে এক লম্বা শ্বাস টেনে বলল,’তুমিও আমাকেই দোষী ঠাউরেছ গুরু! তুমি জাননা এই বুড়োটা কত বড় ব্জজাত!ওর জ্বালায় বৌ-ঝিরা আমাদের বাড়িতে জল ভরা বন্ধ করে দিয়েছে।আরও বলি? এরপর আর কী বলার থাকে? জিভ নোংরা হবে’।