ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(১৫)
বেলগাছিয়ায় অকল্যান্ড সায়েবের সুদৃশ্য বাগানবাড়িটি সম্প্রতি নব্য শিল্পোদ্যোগী জমিদার বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রায় লাখ দুয়েক টাকায় কিনে একটি ব্যক্তিগত মজলিশের কেন্দ্রবিন্দু করে শহর কলকাতায় এখন বেশ জাঁক দেখাচ্ছেন। চোরবাগানের মল্লিকদের বাড়িটি শ্বেতপাথরের বলে তা এতদিন লোকের চোখে জ্বলজ্বল করত। আজকাল দ্বারকনাথের 'বেলগাছিয়া ভিলা' সেই দর্শনসুখের সামনে জোরালো একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
এই সুরম্য অট্টালিকাটির সমস্ত আসবাব আনানো হয়েছে সুদূর ইংল্যান্ড, ও ইতালি থেকে। বিশেষ বিশেষ দিনে আলোর মালায় সেজে উঠে বাড়িটির রূপান্তর ঘটে যায় রূপকথার দ্বিতীয় অমরাবতীতে।
সেদিন ঈশ্বর গুপ্ত নামে এক রসিক নাগরিক কবিয়াল তার একটি বিদ্রুপাত্মক ছড়ায় সেদিন তো কাগজে কয়েকটি লাইন লিখেই বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছে। বাগবাজারে এখন রূপচাঁদ পক্ষীদের আখড়ায় গঞ্জিকা সেবনে টং হয়ে গায়েন পক্ষীদের দল ধুয়ো ধরে থেকে থেকেই ছড়াটি নানারকম ব্যঙ্গকন্ঠে সোচ্চারে গেয়ে উঠছে,
‘‘বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি কাঁটার ঝনঝনি....
খানা খাওয়ার কি মজা আমরা তাহার কি জানি?...ও জানেন ঠাকুর কোম্পানী...!"
.....
আজকের নৈশভোজটি এক পার্সী জাতীয় শিল্পোদ্যোগী রুস্তমজীর সাফল্যের দরুণ তাঁর মিত্র ও ব্যবসায়ী অংশীদার বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সৌজন্যে।
গোলগাল চেহারার এই পার্সী বণিকটি কার টেগোর এন্ড কোম্পানিতে কিছু মুদ্রা বিনিয়োগ করা ছাড়াও জলযানের ব্যবসাতেও সহযোগিতা চেয়ে কলকাতায় এসেছেন।
এসব বাণিজ্যসাধনে এখন বাঙালীদের মধ্যে দ্বারকানাথ অগ্রগণ্য বলে দুজনের মিত্রাভাষ ক্রমশ শক্ত ভিতের মধ্যে এসে দাঁড়াতে চলেছে। তাই সানন্দে এই মজলিশে দ্বারকানাথ স্বয়ং রামমোহনকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে তার বিশিষ্ট বন্ধুমহলের সাথে রুস্তমজীকে পরিচিত হতে সাহায্য করছেন।
হিমায়িত পুডিং এর পাত্র হাতে রামমোহন হাসিমুখে রুস্তমজীকে সম্ভাষণ জানিয়ে শিষ্টতা বজায় রাখলেন। তিনি অনর্গল পারস্যভাষায় জেন্দা-আবেস্তা' থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন দেখে রুস্তমজী বিস্ময়ে হতবাক।
এসবের ফাঁকেই রামমোহন দ্বারকানাথকে আলাদা ডেকে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের অগ্নিদহন সংক্রান্তটি সবিস্তারে জানালেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি ক্রয়ের বিষয়ে এখুনি কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরও একবার লাটভবনে গিয়ে মন্ত্রণা করার বিষয়েই দ্বারকানাথ জোর দিল।
তবে রামমোহনের বিলাত গমনের বিষয়ে তার কোনও আপত্তি নেই। বরং দ্বারকানাথেরও খুব ইচ্ছা যে রাণীগঞ্জ-মানভূমে কয়লাখনির ব্যবসা সংক্রান্ত জটিলতা স্বল্পদিনের মধ্যে মিটে গেলে সেও রামমোহনের সাথে বিলাত যাত্রায় শরিক হতে পারে।
.....
গোলকপতি দেখল সামনের আকন্দ ঝোপের ফাঁক দিয়ে লাল রং এর শাড়ির পাড়ের কিয়দংশটি দেখা যাচ্ছে।
বোঝা গেল, ওই মেয়েটি ঝোপটিতে এখনও আত্মগোপন করে আছে। হিসেবমতন তার শৌচকর্মটি কিন্তু প্রায় আধঘন্টা আগে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
সে ধীরপায়ে ঝোপড়াটির কাছে এসে দাঁড়াতেই মেয়েটি মুখে গোঁ গোঁ শব্দ করে মূর্ছিত হয়ে পড়ল।
গোলকপতি বুঝতে পারল দূর্বলদেহে ও অর্ধভুক্ত জঠরে ধুতুরার বীজের গুঁড়ো জলের সাথে অতিরিক্ত মাত্রায় পান করার কারণে অতি উত্তেজনার বশেই সে সংজ্ঞা হারিয়েছে।
এরপর কাছে এসে সে মেয়েটির আব্রু বাঁচিয়ে তার মাথাটি তার নিজের কোলে তুলে নিয়ে তাকে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।
মেয়েটির ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ প্রগাঢ়। সে শ্যামবর্ণা ও দীর্ঘাঙ্গী। তবে তার মুখশ্রীটিকে এক অপরূপ দার্ঢ়্যতার সৌকর্যে সাজিয়ে তুলেছে তার চিবুক ও উন্নত নাসিকার আবেশটি।
গোলকপতির মনে হতে লাগল বৃদ্ধটির মৃত্যুর সাথে সাথেই এই রমণীরত্নটি ধর্ম ও লোকাচারের হাতে জীবন্ত পুড়ে মরতে চলেছে।
মেয়েটির জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করার সাথে সাথে সে নিজের মনেই নিজের উদ্দেশ্যে বসে বসে অনেক দুরূহ প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে লাগল। সে ভাবতে বসল আজ তথাকথিত সমাজদ্রোহের পরিণতি সত্ত্বেও সে নিজে কি এই মেয়েটির জীবনের দায়িত্ব নিতে সক্ষম?