প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার
Posted in প্রবন্ধ‘হিন্দু পেট্রিয়টে’র বিখ্যাত সম্পাদক , রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অগ্রদূত হরিশ মুখার্জীর মৃত্যুর ২ বছর পরে ১৮৬৩ সালে মুম্বাইএর এলফিনস্টোন কলেজের এক পার্শি অধ্যাপক ফ্রামজি বোমানজির যে বইটি প্রকাশিত হয় , তার নাম ‘Lights and Shades of the Life of Baboo Hurish Chunder Mookerjee and passing thoughts on India and its people , their present and future.’ এই বইটিকে আমরা প্রথম হরিশ-জীবনী বলতে পারি । তবে স্বাভাবিক কারণে এতে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না । এর পরে ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয় রামগোপাল সান্যালের হরিশ-জীবনী । মাত্র ৫৬ পাতার এই পুস্তিকাকে সঠিকভাবে জীবনী-গ্রন্থ বলা যায় না । এই পুস্তিকায় বিক্ষিপ্তভাবে হরিশের জীবনের কিছু বিবরণ সংকলিত হয়েছে। রামগোপাল ১৮৮৯ সালে রচনা করেন ‘A General Biography of Bengal Celebrities –both living and dead .’ এই বইতে দেশের মোট আটজন খ্যাতনামা ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনকথা বর্ণিত হয়েছে ।
এর পরে ১৯১০ সালে কলকাতার ধর্মতলার চেরি প্রেস থেকে আইনজীবী ও লেখক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় : ‘SELECTION FROM THE WRITINGS OF HURRISH CHUNDER MOOKERJI.’ কোন অনুপ্রেরণায় নরেশচন্দ্র এই সংকলনে ব্রতী হয়েছিলেন , আমরা তার কোন হদিশ পাই না । তবে ভূমিকায় নরেশচন্দ্র উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখার্জীর নামোল্লেখ করেছেন , তাঁর সাহায্যের কথা বলেছেন ( ‘ I have great pleasure in acknowledging the great assistance I have derived from the never failing kindness of Raja Pyri Mohan Mookerji C.S.I , under whose directions mainly the compilation has been made . ’ ) এই প্যারীমোহন ছিলেন হরিশ মুখার্জীর বন্ধু জয়কৃষ্ণ মুখার্জীর পুত্র । ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার দুটি খণ্ড থেকে প্যারীমোহন হরিশের কয়েকটি রচনা সংকলন করেছিলেন , যা নরেশচন্দ্র ব্যবহার করেছেন তাঁর সংকলন গ্রন্থে ।
‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় রচনাকারের নাম থাকত না । এই পত্রিকায় হরিশ মুখার্জী ছাড়াও রামগোপাল ঘোষ , কিশোরীচাঁদ মিত্র , রাজেন্দ্রলাল মিত্র , দ্বারকানাথ মিত্র , জয়কৃষ্ণ মুখার্জী , গিরীশচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতির রচনা প্রকাশিত হত । এত রচনার মধ্য থেকে হরিশ মুখার্জীর রচনা সনাক্ত করা সহজ ছিল না । রচনারীতির আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য বিচার করেই সংকলন করা হয়েছে , নরেশচন্দ্র বলেছেন –‘ In making this selection , internal evidence has been our sole guide and pre-eminently we have relied upon style .’ এই সংকলনের সব রচনাই যে নিশ্চিতভাবে হরিশচন্দ্রের, সে দাবি সম্পাদক করেন নি , তবে –‘ But there is no doubt that most of them are , if one may judge from style.’
রচনাগুলি বিষয়ানুযায়ী ১০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত , শেযে আছে পরিশিষ্ট । প্রথম অধ্যায় ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ ( The Mutiny) । এই অধ্যায়ে How Annexation Worked , The Mutiny , The Causes of the Mutiny , The Panic in Calcutta , The Lucknow Refugees , The Crises and the Native Princes , The Oude Proclamation , The Atrocity Mongers and the Sepoys , English Opinion , Retribution , English Opinion and Indian Facts , The Atrocitirs , Indiscriminate Retribution and the ‘ Antagonism of Race’ ইত্যাদি মোট ৩৫টি রচনা সংকলিত হয়েছে ।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘ক্ষমতার হস্তান্তর’ ( The Transfer to the Crown) । এই অধ্যায়ে The Future of the Indian Government , The East India Company , The New India Bill , The Proclamation , The Transfer , India and House of Commons , The Reconciliation , The Amnesty , The Pacification of the Country ইত্যাদি মোট ১৬টি রচনা সংকলিত হয়েছে ।
তৃতীয় অধ্যায়ের নাম ‘সৈন্য বাহিনী’ ( The Army) । এই অধ্যায়ে আছে তিনটি রচনা – Native Gentlemen Officers, The Europeans Troops , The Old Sepoy Army .
চতুর্থ অধ্যায় ‘ভূমি আইন’ ( Land Law) । এই অধ্যায়ে আছে ৭টি রচনা – The New Sale Law Bill , The Sale Law and the Zaminders , The Rent Bill , The Parmanent Settlement প্রভৃতি ।
পঞ্চম অধ্যায়ের নাম ‘নীল চাষ ‘( Indigo ) । নীল আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই হরিশ মুখার্জীর খ্যাতি , অথচ এই সংকলনে নীল বিষয়ক মাত্র ৭টি রচনা আছে । এটা বিস্ময়ের ব্যাপার । এই অধ্যায়ে আছে : Indigo Planting in Nudia , Indigo Planting in Rajshaye , Indigo Planting , The Zaminder and the Planter , Planter’s Portraits , Indigo Planting and Mofussil Justice , The Planters and Official .
ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাণিজ্যিক বিষয় ( Industrial and Commercial) আলোচিত হয়েছে , যেমন Blowing the Trumpet , Capital and Enterprise , Merchant and Banian , Workmen and Servants .
সপ্তম অধ্যায়ে ইংরেজের ‘ভারত শাসন’ ( Administration of India ) আলোচিত হয়েছে । এতে মোট ১৮টি রচনা স্থান পেয়েছে । যেমন : An Indian Parliament , Federalization , The Indian Debate , The Patriarchal System, Constitutionalism in India , The Civil Service , The Mandarins , Employment of Natives, A Native Judge for the High Court , The Civil Service and the Natives ইত্যাদি ।
অষ্টম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ ভারতীয় ও ইউরোপীয়’ ( Indians and Europeans) । এই অধ্যায়ে The Penal Code , The Black Acts , The Native Meeting in the Town Hall , Our legislator Judges , Popular Fallacies , Who is to Blame , Treatment of Natives , The Position of the Europeans প্রভৃতি মোট ১৭টি রচনা স্থান পেয়েছে ।
দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় ( Social and Religious ) নিয়ে মোট ৭টি রচনা আছে নবম অধ্যায়ে ; যেমন : Divisions in Hindu Society , A plea for Caste , The Social Progress of India , Christianity in India, English and Hindoo Civilization—A contrast প্রভৃতি ।
দশম অধ্যায়ে দেশের শিক্ষা ( Educational) নিয়ে ৮টি রচনা সংকলিত হয়েছে ; যেমন : The Sanskrit and Vernacular Language , Matters Educational , Our Educational Policy , The Indian Universites প্রভৃতি।
পরিশিষ্টাংশে আছে ১৫টি রচনা , যেমন : The Army , The First Indian Debate , The New Danger, The English in India , The Indian Bill , Vernacular Newspaper প্রভৃতি ।
সংকলিত রচনাগুলি প্রমাণ করে যে কোম্পানির শাসনাধীন দেশের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হরিশ নিজের মতামত লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর রচনায় । এ দেশের সাংবাদিকতার , বিশেষ করে রাজনীতিবিষয়ক সাংবাদিকতার অগ্রদূত হরিশ মুখার্জী । ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় দেশে সৃষ্টি করেছিল অ।লোড়ন । নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত সঠিকভাবে বলেছেন , ‘ But never before he took charge of Hindu Patriot was Indo-English journalism conceived as capable of rising to the height that the Patriot achieved under him and never did this class of journalism exercise a wholesome influence upon the small educated community of the day or on the Government . ’
যে সময়কালের মধ্যে হরিশচন্দ্র ‘হিন্দু পেটিয়ট’ সম্পাদনা করেছেন , সেই ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে দেশের ইতিহাসে অনেকগুলি বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল । যেমন : সনদের পুনর্নবীকরণ , রেভিনিউ সেল আইন , সিপাহি বিদ্রোহ , ক্ষমতার হস্তান্তর , ব্ল্যাক অ্যাক্ট আন্দোলন , নীল বিদ্রোহ , বিধবা বিবাহ আইন , বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা , স্বত্ববিলোপ নীতি ইত্যাদি । হরিশচন্দ্র এই সব ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ।
নরেশচন্দ্র বলেছেন যে সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে হরিশ মুখার্জীকে চমৎকার ‘publicist’-এর ভূমিকায় দেখা গেছে। কখনও তিনি বিদ্রোহের কারণ সন্ধান করার চেষ্টা করছেন , কখনও সিপাহিদের অত্যাচারের অতিরঞ্জিত ঘটনা পরিবেশন করার জন্য সাংবাদিক ও প্রচারকদের নিন্দা করছেন , কখনও অবিমৃশ্যকারিতার জন্য সিপাহিদের সমালোচনা করছেন , কখনও ডালহাউসির কার্যকলাপের –বিশেষ করে অযোধ্যা অভিযানের নিন্দা করছেন , কখনও আবার ক্যানিংএর দূরদৃষ্টির প্রশংসা করছেন , কখনও ইংরেজের জাতিগর্ব ও ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করছেন । নরেশচন্দ্র তাই বলেছেন , ‘ The courage and statesmanship that he displayed on this occasion , the comprehensive knowledge and fearless enthusiasm for the right that characterize his writings of this period at once mark him out as a man far above the ordinary run--- a man who in other circumstances might have made his mark in far higher spheres .’
হরিশচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে সমর্থন করেছেন । বেশ জোর গলায় তিনি বলেছেন যত ত্রুটি থাকুক না কেন , এই ব্যবস্থাই ভারতবর্ষের পক্ষে উপযুক্ত ও কর্যকরী ব্যবস্থা ; এই ব্যবস্থা ব্রিটেন ও ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করবে ( ‘Whatever the faults of the Permanent Settlement . it is the only system of landed tenure , it is clear, which is suited to India .’ ) । তিনি আসলে এই ব্যবস্থার রাজনৈতিক তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে পারেন নি বলেই মনে হয় । তাঁর মনে হয়েছিল যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দেশের রায়তদের উপকার হবে । বাস্তবে তার বিপরীত হয়েছিল । নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন যে বহুক্ষেত্রে হরিশ জমিদারদের পক্ষ সমর্থন করেছেন বটে , কিন্তু সমানভাবে রায়তদের উপর জমিদারদের অত্যাচারেরও প্রতিবাদ করেছেন ( ‘ Hurrish Chunder was no less a friend of the ryot than that of the Zaminder , His anxious solicitude to protect the interests of Khudkhast and Kudimee ryots whose title was most insecure in those days , finds expression in many of his articles .’ ) । কৃষকদের প্রতি তাঁর আন্তরিক দরদ ও সহানুভূতির প্রমাণ পাওয়া যায় নীল বিদ্রোহের সময়ে । রিক্ত , বঞ্চিত , অত্যাচারিত রায়তদের তিনি আশ্রয় দিয়েছেন , আহার দিয়েছেন , দরখাস্ত লিখে দিয়েছেন , নীলকরদের বিরুদ্ধে মামলায় সাহায্য করেছেন । সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যে তিনি বঞ্চিত কৃষকদের জমি হারাবার ক্ষোভকে প্রতিফলিত হতে দেখেছেন । তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শিক্ষার দাবিতেও সোচ্চার হয়েছেন ।
হরিশচন্দ্রের মতো রাজনীতিমনস্ক , বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন , আপোসহীন , শ্রেণিস্বার্থহীন , মানবদরদী , দেশপ্রেমিক মানুষ দেশে তাঁর যোগ্য সম্মান লাভ করেন নি বলে সংকলনের সম্পাদক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন । নরেশচন্দ্র বলেছেন যে হরিশ জনস্বার্থের জন্য যে কাজ করেছেন , অন্য দেশের মানুষ হলে সেখানকার জনসাধারণ তাঁকে মাথায় তুলে রাখত ( ‘ In any other country , a career such as his would be a cherished treasure to the historian and a bye-word to every patriotic citizen .’ ) । কিন্তু নিজের দেশে হরিশচন্দ্র অবহেলিত হয়ে থেকেছেন । তাঁরা লেখা ও চিঠিপত্র সংকলিত হয় নি , তাঁর কোন ছবি রাখা হয় নি , তাঁর বসতবাড়ির কোন হদিশ করা হয় নি । নরেশচন্দ্র বলেছেন , ‘Whose intellectual eminence no less than his great public services demanded more adequate recognition than we have been able to give him ; for he was the first exponent and , in a very true sense , the father of the new life whose throbbings are felt today all through the length and breadth of the land.’