Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১০

ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টার কলেজ স্থাপিত হয়েছিল যে উদ্দেশ্য নিয়ে তা’হল ‘দেশের নবীন নাগরিকদের মহান আদর্শের পথনির্দেশ এবং উত্তম শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উত্থান’।

আপনি যদি চকচকে কাগজে কমলা রঙে ছাপা কলেজের ‘সংবিধান এবং নিয়মাবলী’ পড়েন তাহলে বাস্তব জগতের মলিনতায় আচ্ছন্ন আপনার মন সত্যি সত্যি নির্মল এবং পবিত্র হয়ে যাবে। অবশ্যি ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায়টুকু পড়লেও আপনার একই অনুভূতি হয়।

যেহেতু এই কলেজ রাষ্ট্রহিতের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে তাই এখানে আর কিছু হোক না হোক, দলাদলি খুব আছে। তবে দলাদলির আয়তন ও ওজন দেখলে মনে হবে এমন কিছু নয়, কিন্তু যে অল্প সময়ে এটি কলেবরে বেড়েছে তাতে বলা যায় যে হ্যাঁ, কিছু কাজ তো হয়েছে। দু’তিন বছরেই এটি দলাদলির ব্যাপারে আশেপাশের কলেজগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। আর কোন কোন বিষয়ে তো অখিল ভারতীয় গালাগালিস্তরের কম্পিটিশন করার যোগ্যতা দেখিয়েছে।

ম্যানেজিং কমিটিতে বৈদ্যজীর দাপট, কিন্তু এর মধ্যেই রামাধীন ভীখমখেড়ভীজি তাঁর একটি উপদল বানিয়ে নিয়েছেন। এরজন্যে ওনাকে অনেক তপস্যা করতে হয়েছে। বেশকিছু দিন ওঁর দলে একজনই সদস্য ছিল—ভীখমখেড়ভীজি উনি স্বয়ং। পরে একজন দুজন ওঁর দলে চলে গেল। এরপর কড়া মেহনতের ফলে কলেজের কর্মচারিদের মধ্যেও দু’দল তৈরি করা গেছে বটে, কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি। প্রিন্সিপাল সাহেব বৈদ্যজীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, কিন্তু উল্টোদিকে খান্না মাস্টার এখনও রামাধীনের দিকে ততটা হেলে পড়েনি। ছাত্রদের মধ্যেও কোন দলবিশেষের প্রতি নিষ্ঠার ভিত্তিতে স্পষ্ট ভাগাভাগি হয়নি। মাঝেমধ্যে গালাগালি মারপিট হচ্ছে বটে কিন্তু এখনও ওদের ঠিকমত পথ দেখানো যায়নি। এখনও কলেজের কাজকম্ম দলীয় উদ্দেশ্যে নাহয়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগে হচ্ছিল, তাই ছেলেপুলের গুন্ডামির শক্তিও রাষ্ট্রের সার্বজনিক হিতের বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ’বিষয়েও দলাদলির রাজনীতির অনেক কাজ করার আছে।

এটা সত্যি যে কলেজে বৈদ্যজীকে ছেড়ে আর কারও দলাদলির বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই।অন্যেরা কাঁচা খেলুড়ে, কিন্তু প্রতিভায় কম যায় না।বছরে দু’একবার ওদের প্রতিভার ছটা যখন ঝিকিয়ে ওঠে তখন তার যেইতরঙ্গ শহর অব্দি পৌঁছে যায়। এখানে কখনও কখনও এমন সব দাঁও-প্যাঁচ দেখা যায় যে দলাদলির বড় বড় অভিজ্ঞ খেলুড়েও হতভম্ব হয়ে যায়। গত বছর রামাধীন বৈদ্যজীকে এমনই এক প্যাঁচে ফেলেছিলেন। প্যাঁচ ব্যর্থ হল, কিন্তু তার চর্চা দূরে-দূরান্তরে ছড়িয়ে গেল।খবরের কাগজে এ’নিয়ে লেখা হল। তাতে একজন দলবাজির খেলুড়ে এমন অভিভুত হলে যে শহর থেকে দৌড়ে এসে দুটো দলেরই পি্ঠ চাপড়ে দিলেন। উনি ছিলেন একজন সিনিয়র খেলুড়ে, থাকতেন রাজধানীতেই। ওঁর জীবনের বিগত চল্লিশটি বছর উনি চব্বিশ ঘন্টা দলাদলিতেই মজে থাকতেন।উনি অখিল ভারতীয় স্তরের একজন নেতা এবং প্রতিদিন খবরের কাগজে ওঁর কোন না কোন বিষয়ে বিবৃতি বেরোয়। তাতে থাকে দেশপ্রেম এবং দলাদলির অদ্ভুত খিচুড়ি। উনি একবার কলেজে পায়ের ধূলো দিতেই লোকের ভরসা হল যে এখানে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলেও দলাদলি বন্ধ হবে না। কথা হচ্ছে -দলাদলি কেন হল?

এই প্রশ্ন করা আর বৃষ্টি কেন হয়, সত্যি কথা কেন বলা উচিত, বস্তু কী অথবা ঈশ্বর কী জানতে চাওয়া- একই ব্যাপার। আসলে এটি একটি সামাজিক, মনোবৈজ্ঞানিক এবং প্রায় দার্শনিক প্রশ্ন। এর উত্তর পেতে গেলে আপনাকে আগে দর্শন বুঝতে হবে এবং দর্শন-শাস্ত্র জানার জন্যে আপনাকে প্রথমে হিন্দী সাহিত্যের কবি বা গদ্যলেখক হতে হবে।

সবাই জানে যে আমাদের কবি এবং গদ্যলেখকেরা আসলে এক একজন দার্শনিক। ওঁরা কবিতা এবং গদ্য লেখেন ফাউ হিসেবে। যেকোন ঘ্যানঘেনে উপন্যাস খুলে পাতা ওল্টালে দেখা যাবে যে নায়ক নায়িকার তপ্ত অধরে অধর রেখে বলছে—না, নিশা না। আমি এটা মানতে পারিনা। এ তোমার একান্ত ব্যক্তিগত সত্য হতে পারে, কিন্তু আমার সত্য নয়’।

ইতিমধ্যে নিশার ব্লাউজ মাটিতে লুটোচ্ছে।ও অস্ফুট স্বরে বলে, ‘কেন নিক্কু, তোমার সত্য আমার সত্যের থেকে আলাদা কেন’?

এটাকেই বলে ‘টাচ্‌’। এভাবেই নিশা ও নিক্কু’র হাজার মিটার দৌড় শুরু হয়। এবার নিশার ব্রা খসে গিয়ে মাটিতে লুটোয় এবং নিক্কু’র টাই ও শার্ট হাওয়ায় উড়ে যায়। এভাবে হোঁচট খেয়ে, একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে যখন মাঠের অন্য প্রান্তে টাঙানো ফিতেটাকে অবশেষে ‘সত্য’ ভেবে ছুঁয়ে ফেলে, তখন টের পায়—ওটা ‘সত্য’ নয়। ফের যুক্ত হওয়ার শৃংগার, তপ্ত অধর ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পরে ওরা মাঠ ছাড়িয়ে জঙ্গলে পৌঁছে যায় এবং পাথরে ও কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে নগ্ন শরীরে প্রতিটি ঝোপে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়। এভাবে নগ্নতা, ঘ্যানঘ্যান, চুম্বন, লেকচার ইত্যাদির ভেতরে ওরা খুঁজে বেড়ায় এক খরগোসকে যার নাম ‘সত্য’।

এ’জাতীয় ফিলজফি প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাব্য ও কাহিনীতে রয়েছে। এ জন্যেই উপন্যাসটির পাঠক ফিলজফির ঝটকার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ভাবে—হিন্দিসাহিত্যের লেখকটি এতক্ষণ ধরে দুনিয়াভরের কথা বলে গেলেন কিন্তু ফিলজফি কোথায়? ব্যাপারটা কী? ব্যাটা ফ্রড নয়তো?

এটাও সত্যি যে ‘সত্য’ ‘অস্তিত্ব’ গোছের শব্দ শোনামাত্র আমাদের লেখক চেঁচিয়ে ওঠেন-“ শোন ভাইসকল, এখন গল্পের স্রোতকে এখানে থামিয়ে দিয়ে আমি তোমাদের খানিক ফিলজফি পড়াব, তবে তো বিশ্বাস হবে যে আমি আসলে ফিলজফার, ভাগ্যের ফেরে অল্পবয়েসে কুসঙ্গের প্রভাবে কবিতা লিখতাম।অতএব ভাইয়েরা, এই নাও এক ষোল পাতার ফিলজফির শক্‌।যদি আমার লেখা পড়তে পড়তে তোমাদের ভ্রম হয়ে থাকে যে অন্যদের মত ফিলজফি আমার ধাতে নেই, তাহলে সেটাকে এই নতুন ভ্রম দিয়ে খারিজ কর—‘।



বৈদ্যজী বেদান্ত দর্শনকে প্রায় সময় আয়ুর্বেদের চ্যাপ্টার বানিয়ে ফেলেন। ওঁর ভাষ্য অনুযায়ী দলাদলি হল পরমাত্মানুভুতির চরমদশারই আরেক নাম। তখন প্রত্যেক ‘ত্বম’ ‘অহম’কে, এবং প্রত্যেক ‘অহম’ সমস্ত ‘ত্বম’কে নিজের চেয়ে উচ্চতর আসনে অধিষ্ঠিত দেখে এবং নিজে সেখানে পৌঁছতে চায়। অর্থাৎ সমস্ত ‘ত্বম’ যত ‘অহম’ আছে তাদের নিজের জায়গায় টেনে নামিয়ে নিজেরা সবাই ‘অহম’ হতে চায়।

বেদান্ত হল আমাদের ঐতিহ্য, আর যেহেতু দলাদলির তাৎপর্য্য বেদান্তে খুঁজে পাওয়া যায়, তাই দলাদলিও আমাদের শাশ্বত, এবং এই দুয়ে মি্লেই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। স্বাধীনতার পর আমরা এমন অনেক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খুঁজে বের করেছি। হাওয়াই জাহাজে চেপে ইউরোপ যাওয়ার সময়েও আমরা যাত্রার প্রোগ্রাম জ্যোতিষীকে দিয়ে বানিয়ে নিই, ফোরেন এক্সচেঞ্জ এবং ইনকাম ট্যাক্সের ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচতে বাবাজীর আশীর্বাদ নিই, স্কচ হুইস্কি খেয়ে ভগন্দর গজিয়ে গেলে চিকিৎসার জন্যে যোগাশ্রমে গিয়ে শ্বাস ফুলিয়ে পেট ভেতরে টেনে আসন করি। এভাবেই বিলিতি শিক্ষার দান গণতন্ত্র আমদানি করি, কিন্তু তার প্রয়োগ করি দিশি ঐতিহ্যের দলাদলি করে। আমাদের ইতিহাসের পাতা উলটে্ দেখুন, যুদ্ধপর্ব হোক কি শান্তিপর্ব, সব অবস্থাতেই দলাদলির ঐতিহ্য জ্বলজ্বল করছে।ইংরেজ রাজত্বের সময় ওদের খেদিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে কিছুদিন ভুলে ছিলাম বটে, স্বাধীন হতেই আরও অনেক ঐতিহ্যের সাথে একেও আমরা মাথায় তুলে নিয়েছি।এখন দলাদলির প্রগতির জন্যে আমরা অনেকগুলো পদ্ধতির সাহায্য নিচ্ছি-- যেমন ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’, লাথালাথি, জুতোপেটা, সাহিত্য-শিল্প কোনটাই বাদ পড়েনি। যে দেশ একসময় বেদান্তের জন্ম দিয়েছে আজ তারই এই প্রাপ্তি। সংক্ষেপে এই হল দলাদলির দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল।

ছংগামল কলেজে দলাদলির জন্যে এই সব আদিকারণ ছাড়াও অন্য একটি কারণ দায়ি। এখানকার লোকেদের ভাবনা হল সবসময় কিছু-না-কিছু হওয়া চাই। দেখুন, এখানে সিনেমা নেই, হোটেল নেই, কফি হাউস নেই, মারপিট, চাকুবাজি, পথদুর্ঘটনা, নিত্যি নতুন ফ্যাশনের মেয়েরা, এগজিবিশন, গরম গরম এবং গালাগালি ভরা সার্বজনিক সভাসমিতি—এসব কিস্যু নেই। লোকজন কোথায় যাবে? কী দেখবে? কী শুনবে? তাই কিছু-না-কিছু হওয়া চাই।

দিন চারেক আগে কলেজে একটা প্রেমপত্র পাওয়া গেল। একটি ছেলে লিখেছে কোন মেয়েকে। ছেলেটা চালাকি করে এমন ভাবে লিখেছে যে পড়লে মনে হবে আসলে মেয়েটির চিঠিতে লেখা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু এই চাল কাজে এল না। ছেলেটা বকুনি খেল, মার খেল, কলেজ থেকে বের করে দেয়া হল। তারপর ছেলের বাপ কথা দিল যে ওর ছেলে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়বে না, এবং আরও কথা দিল যে কলেজের নতুন ব্লক তৈরির জন্যে পঁচিশ হাজার ইঁট দেবে। ব্যস, ছেলেটা ফের ভর্তি হয়ে গেল। যাই ঘটুক, এর প্রভাব কুল্লে চার দিন, তার বেশি নয়। এর আগে একটা ছেলের কাছে দেশি পিস্তল পাওয়া গেছল। তাতে কোন কার্তুজ ছিলনা এবং পিস্তলটা এত ফালতু যে দেশি কামারদের কারিগরি দক্ষতা্র কথা ভেবে চোখে জল এসে যায়। তবু কলেজে পুলিস এল এবং ছেলেটাকে ও ক্লার্ককে ধরে থানায় নিয়ে গেল- যদিও ক্লার্ক হলেন বৈদ্যজীর লোক। লোকজন উত্তেজনায় ছটফট করছিল -কিছু হবে, এবার চার-পাঁচ দিন ধরে কিছু না কিছু ঘটবে।কিন্তু সন্ধ্যে নাগাদ খবর এল যে ওটা পিস্তল না, একটা ছোটমত লোহার টুকরো । আর ক্লার্ককে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়নি, উনি নিজের ইচ্ছেয় বেড়াতে গেছলেন। এবং ছেলেটা গুন্ডামি করছিল না, বরং সুন্দর বাঁশি বাজাচ্ছিল। সন্ধ্যে নাগাদ যেই ছেলেটা বাঁশি বাজাতে বাজাতে এবং ক্লার্ক মশায় বেড়াতে বেড়াতে থানার বাইরে এলেন মানুষজন হতাশ হয়ে ভাবল—তাহলে কিছুই হয়নি। এর পর হাওয়ায় ভেসে এল সেই শাশ্বত প্রশ্ন- এবার কী হবে?

এই পরিবেশে লোকজনের নজর ছিল প্রিন্সিপাল সাহেব আর বৈদ্যজীর উপর। বৈদ্যজী তো মদনমোহন মালবীয় স্টাইলের পাগড়ি চাপিয়ে নিজের গদিতে গ্যাঁট হয়ে বসেছিলেন। কিন্তু প্রিন্সিপালকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন উনি সরসরিয়ে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় চড়ে দুর থেকে কাউকে দেখে চেঁচাচ্ছেন- ‘দেখো, দেখো, ব্যাটার মাথায় কোন শয়তানি বুদ্ধি ঘুরছে’! ওঁর দৃষ্টিতে সন্দেহভরা, আসলে নিজের চেয়ার আঁকড়ে থাকা সবার মনেই ভয় যে কেউ না কেউ এসে ওকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দেবে। লোকেরা এঁর দুর্বল জায়গাটা ধরে ফেলেছে এবং সেখানে খুঁচিয়ে ওনাকে এবং তার সঙ্গে বৈদ্যজীকে প্যাঁচে ফেলার তাল করছে।এদিকে এরাও মার খাবার ভয়ে আগে থেকেই মারার জন্যে মুখিয়ে রয়েছে।

ক’দিন আগে খান্না মাস্টারকে কেউ ফুসমন্তর দিয়েছে যে সব কলেজেই প্রিন্সিপালের সঙ্গে একটা ভাইস প্রিন্সিপালেরও পোস্ট থাকে। খান্না পড়াতেন ইতিহাস এবং সব থেকে সিনিয়র। সেই গুমরে একদিন বৈদ্যজীকে গিয়ে বলে এলেন যে ওনাকে ভাইস প্রিন্সিপাল বানিয়ে দেয়া হোক। বৈদ্যজী মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললেন- এ তো বেশ নতুন কথা। নবযুবকদের সবসময় নতুন নতুন চিন্তা করা উচিৎ। আমি সবরকম নতুন আইডিয়াকে উৎসাহ দিই। তবে এটা তো পরিচালক সমিতির এক্তিয়ারে। ওদের আগামী বৈঠকে এই প্রশ্নটি উঠলে আমি সমুচিত বিচার করব, কথা দিলাম। খান্না মাস্টার ভাবেননি যে পরিচালন সমিতির আগামী বৈঠক কখনও হয় না। উনি বার খেয়ে সাততাড়াতাড়ি ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিযুক্তির আবেদন বাবদ একটি দরখাস্ত মুসাবিদা করে প্রিন্সিপালকে ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলেন যেন পরিচালক সমিতির আগামী বৈঠকে এটি পেশ করা হয়।

খান্না মাস্টারের এই কারসাজিতে প্রিন্সিপাল হতভম্ব। বৈদ্যজীকে শুধোলেন- খান্না মাস্টারকে এই দরখাস্তটা লিখতে আপনি পরামর্শ দিয়েছেন?

এর জবাবে বৈদ্যজী তিনটে শব্দ উচ্চারণ করলেন- ওর বয়েসটা কম।

প্রিন্সিপাল ইদানীং শিবপালগঞ্জের রাস্তায় যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই ধরে অ্যান্থ্রোপলজি বোঝাতে থাকেন-‘সত্যি, আজকাল লোকজন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে’। খান্না মাস্টারের কারসাজির কথা বোঝাতে গিয়ে উনি হরদম কিছু প্রবাদবাক্যের ব্যবহার করছিলেন; যেমন ‘মুখে রামনাম, বগলে ছুরি’,’ আমার পোষা বেড়াল, আমাকেই খ্যাঁক খ্যাঁক’(যদিও বেড়াল কদাপি খ্যাঁক খ্যাঁক করে না),’পেছন থেকে ছুরি মারা’,’ব্যাঙের সর্দি’ এইসব। একদিন উনি গাঁয়ের চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে রূপকথা বলার ঢঙে শুরু করলেন- একদিন এক ঘোড়ার খুরে নাল লাগানো হচ্ছিল। তাই দেখে কোলাব্যাঙের শখ হল—আমিই বা বাদ যাই কেন!অনেক কাকুতিমিনতির পর নাল লাগানোর লোকটি ব্যাঙের পায়ে একটা নাল ঠুকে দিল। তো ব্যাঙবাবাজি ওখানেই চিতপটাং ! তাই বলছিলাম, নকল করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

এই পঞ্চতন্ত্র রচনার পেছনেও সেই একই গল্প। আজ ভাইস প্রিন্সিপাল হতে চাইছে, কাল প্রিন্সিপাল হতে আবদার করবে। তার জন্যে পরিচালন সমিতির মেম্বারদের হাত করবে। মাস্টারদের মধ্যে নিজের একটা দল বানাবে। ছাত্রদের মারপিট করতে উসকে দেবে। উপর মহলে নালিশ করবে। ব্যাটা বজ্জাত হাড় বজ্জাত হবে।

বড় বড় কথা ভেতর-ফাঁকা,

শাক দিয়ে মাছ যায় কি ঢাকা!

বৈদ্যজীর কাছে রামাধীন ভীখমখেড়ভীজির চিঠি এসেছে। লেটারহেডের মোনোগ্রামের জায়গায় রয়েছে ওই দ্বিপদীটি। চিঠির সারমর্ম হল- গত তিনবছরে একবারও পরিচালক সমিতির বৈঠক হয়নি, আগামী দশদিনের মধ্যে বৈঠকটি ডাকা হোক। আর কলেজের সাধারণ সমিতির বার্ষিক সভা কলেজ শুরু হওয়ার দিন থেকে একবারও হয়নি। সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যাক। চিঠিতে এজেন্ডা আইটেমের মধ্যে ভাইস প্রিন্সিপাল পদ শুরু করার প্রস্তাবও রয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেব বৈদ্যজীর ঘর থেকে ফিরে আসার সময় চিঠিটি নিজের পকেটে ঢোকাতেই হঠাৎ বড্ড গরম গরম লাগল।মনে হোল গায়ের জামাটা পুড়ে যাচ্ছে এবং চারপাশ থেকে আগুনের হলকা আসছে। একটা হলকার চোটে কোটটা জ্বলতে শুরু করেছে, আরেকটা হলকা শার্টের ভেতর থেকে নীচের দিকে বইতে বইতে প্যান্টের ভেতরে নামছে। এরকম বোধ হতেই ওঁর চলার বেগ বেড়ে গেল। হলকার তৃতীয় ধারাটি ওঁর চোখ কান নাকে লাল লাল চিহ্ন ছড়িয়ে মাথার খুলির সেই কোটরে ঢুকে গেল যেখানে বুদ্ধিশুদ্ধি থাকে।

কলেজের গেটের কাছে ওঁর রূপ্পন বাবুর সঙ্গে দেখা হল। উনি রূপ্পনের পথ আটকে বোঝাতে শুরু করলেন—’ দেখছ তো? খান্না এবার রামাধীনের খুঁটি ধরেছে। ভাইস প্রিন্সিপালগিরির শখ চড়েছে। শোন, একবার এক কোলাব্যাঙ দেখল কি ঘোড়ার পায়ে নাল লাগানো হচ্ছে, তখন ও ভাবল-’।

কিন্তু রূপ্পনবাবুর একটু তাড়া ছিল। কলেজ পর্ব সেরে অন্য কোোঁথাও যাচ্ছিলেন।বললেন,’ হ্যাঁ, জানি তো।আর ব্যাঙের গল্পটা সবাই জানে। তবে আপনাকে একটা কথা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিচ্ছি। খান্নার জন্যে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মনে হয়, কলেজে একজন ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়া জরুরি। আপনি না থাকলে এখানকার মাস্টারগুলো কুকুরবেড়ালের মত খেয়োখেয়ি করতে থাকে। টিচার্স রুমে যা গুন্ডামি হয় তা আর কহতব্য নয়। ওই হ্যা-হ্যা, ঠ্যাঁ-ঠ্যাঁ, ফ্যাঁস-ফ্যাঁস’! এবার রূপ্পন একটু গম্ভীর হয়ে প্রায় আদেশের সুরে বললেন-‘প্রিন্সিপাল সা’ব! আমার মনে হয় আমাদের কলেজে একজন ভাইস প্রিন্সিপাল দরকার। খান্না সবচেয়ে সিনিয়র, ওকেই হ’তে দিন। সেরেফ নাম-কা-ওয়াস্তে, মাইনে তো বাড়বে না’।

প্রিন্সিপাল সাহেবের বুকের ভেতর এত জোরে ধক্‌ করে উঠল যেন লাফিয়ে ফুসফুসে ঢুকে পড়বে। “ভুলেও অমন কথা মুখে এনো না রূপ্পন বাবু! এই খান্না-টান্না বলে বেড়াচ্ছে যে তুমি নাকি ওদের সঙ্গে রয়েছ! এটা শিবপালগঞ্জ; ইয়ার্কি করলেও একটু ভেবেচিন্তে মুখ খুলতে হয়’।

“আমি যেটা উচিৎ সেটাই বলি। যাই হোক, পরে দেখা যাবে’খন”। বলতে বলতে রূপ্পনবাবু এগিয়ে গেলেন।

প্রিন্সিপাল সাহেব হড়বড়িয়ে নিজের কামরার ঢুকলেন। বেশ ঠান্ডা পড়েছে, কিন্তু উনি কোট খুলে ফেললেন। লেখাপড়ার সামগ্রী সাপ্লাইয়ের কোন দোকানের একটা ক্যালেন্ডার ঠিক ওঁর নাক বরাবর সামনের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে। তাতে নগ্নবদন স্বচ্ছবসনা এক ফিলিম- অ্যাকট্রেস জনৈক পুরুষকে একটি লাড্ডুমতন কিছু নিবেদন করছে। পুরুষটির লম্বা লম্বা চুল, এক তুলে চোখ ঢাকার ভান করে এমন মুখভঙ্গী করছে যেন ঐ লাড্ডুটি খেলে ওর বদহজম হবে। এরা মেনকা ও বিশ্বামিত্র। খান্নাকে

প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ অপলক এদের দেখতে লাগলেন।হঠাৎ কলিংবেল না বাজিয়ে চেঁচিয়ে চাপরাশিকে ডাকলেন। ও এলে পরে বললেন-যাও, খান্নাকে ডেকে আন।

চাপরাশি রহস্যময় ঢঙে বলল, ‘ফিল্ডের দিকে গেছে। সঙ্গে মালবীয়জি’।

প্রিন্সিপাল চিড়বিড়িয়ে টেবিলের উপর রাখা কলমদানটাকে এক ধাক্কা মেরে আরেক মাথায় পাঠালেন। এই কলমদানটা কোন এডুকেশনাল এম্পোরিয়াম থেকে স্যাম্পল দিয়ে গেছল।কিন্তু প্রিন্সিপাল ওটাকে যেভাবে দুর দুর করলেন তাতে মনে হতে পারে এ’বছর এম্পোরিয়ামটা থেকে কলেজ কোন জিনিসপত্র কিনবে না।কিন্তু সেটা প্রিন্সিপালের উদ্দেশ্য ছিল না। উনি শুধু চাপরাশিকে এই মেসেজ দিতে চাইছিলেন যে এখন উনি চাপরাশির গুপ্তচরগিরির গোপন রিপোর্ট শুনতে উৎসুক নন। তাই উনি কড়া করে বললেন-আমি বলছি, খান্নাকে এক্ষুণি ডেকে আন।

চাপরাশির পরনে ধবধবে পাঞ্জাবি ও সাফসুতরো ধুতি, পায়ে খড়ম এবং কপালে তিলক। ও শান্তভাবে বলল,’ যাচ্ছি; ডেকে আনছি খান্নাকে। এত রেগে যাও কেন’?

প্রিন্সিপাল দাঁত কিটকিটিয়ে টেবিলের উপর রাখা একটি টিনের টুকরোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। টুকরোটাকে পালিশ করে একটা লালরঙা গোলাপ বানিয়ে দেয়া হয়েছে।পন্ডিত নেহেরুর পছন্দের গোলাপ, নীচে জুড়ে দেয়া হয়েছে দিন-তারিখ-মাস দেখার ক্যালেন্ডার। এটা বানিয়েছে একটি বিখ্যাত মদের কোম্পানি। এই ক্যালেন্ডারটি চারদিকে বিনে পয়সায় উপহার দেয়া হচ্ছে এই ভরসায় যে লোকে পন্ডিত নেহেরুর আদর্শের সঙ্গে এই শরাব কোম্পানিকেও মনে রাখবে। কিন্তু এখন এই ক্যালেন্ডারটি দেখে প্রিন্সিপাল সাহেবের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হল না।পন্ডিত নেহেরুর গোলাপ ওঁর মনের ভার কমাতে পারেনি, আর ফেনিল বীয়রের গ্লাস কল্পনা করেও কোন উৎসাহ কোন উদ্দীপনা এলনা। উনি দাঁত পিসতে লাগলেন, পিসেই চললেন। হঠাৎ, চাপরাশির খড়মের আওয়াজ খালি চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে গেছে কি উনি হিসহিসিয়ে উঠলেন,’রামাধীন ওকে ভাইস প্রিন্সিপাল করে দেবে?ছ্যাঁচড় কোথাকার’! চাপরাশি ঘুরে দাঁড়াল। দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া আওয়াজে বলল,‘গালি দিচ্ছেন প্রিন্সিপাল সাহেব’’'?

--‘ঠিক আছে, ঠিক আছে; যাও, নিজের কাজে যাও’।

-- নিজের কাজই তো করছিলাম। আপনি বারণ করলে আর করছি না’।

প্রিন্সিপালের কপালে ভাঁজ পড়ল। উনি উলটো দেয়ালে আরেকটা ক্যালেন্ডারের দিকে মন দিলেন।চাপরাশি একইভাবে বলে চলল, ‘বলেন তোঁ খান্নাকে চোখে চোখে রাখা বন্ধ করে দিই’?

প্রিন্সিপালের মেজাজ চড়ে গেল, ‘চুলোয় যাও’!

চাপরাশি তেমনই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে।ডাঁটের মাথায় বলল,’ আমাকে খান্না-টান্না ভাববেন না যেন!চব্বিশ ঘন্টা খাটিয়ে নিন, পুষিয়ে যাবে। কিন্তু এই আবে-তাবে, তুইতোকারি একদম বরদাস্ত হয় না’।

প্রিন্সিপাল অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাপরাশি ফের বলল,’ শুনুন,আপনি বামুন তোঁ আমিও বামুন।নুন দিয়ে নুন কাটা যায় না, বলে দিলাম’।

প্রিন্সিপাল নরম পড়ে গেলেন।‘তোমার ভুল হয়েছে। তোমাকে না, খান্নাকে ছ্যাঁচড় বলেছি, মহা ছ্যাঁচড়! রামাধীনের সঙ্গে মিলে মিটিং ডাকার নোটিশ পাঠায়’? গালিটা যে খান্নাকে দেয়া সেটা বিশ্বাস করানোর উদ্দেশ ফের বললেন,’ছ্যাঁচড় কোথাকার’!

‘এখখুনি ডেকে আনছি’, চাপরাশিও নরম হল। খড়মের খট খট আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। প্রিন্সিপালের চোখ এবার তৃতীয় এক ক্যালেন্ডারে আটকে গেছে। ওতে পাঁচ বছুরে দুটো বাচ্চা ইয়াবড় সব রাইফেল নিয়ে বরফের ওপর শুয়ে আছে। বোধহয় চীনে সৈন্যের অপেক্ষায়। এভাবে বড় শিল্পসম্মত ভাবে বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে যে ওই কোম্পানিটির চটের ব্যাগ সবচেয়ে ভাল।

প্রিন্সিপাল ওই ক্যালেন্ডারটা দেখতে দেখতে ভাবছিলেন যে খান্নার ভাইস প্রিন্সিপালগিরির শখ না চাগিয়ে উঠলে জীবন কত সুন্দর হত।উনি ভুলে গেলেন যে সবারই কিছু-না-কিছু শখ থাকে। রামাধীন ভীখমখেড়ভীর শখ চিঠির গোড়ায় দু’লাইন উর্দু কবিতা লেখা। প্রিন্সিপালের নিজের শখ হোল অফিসের দেয়ালে নিত্যনতুন রঙীন ক্যলেন্ডার টাঙিয়ে রাখা। তেমনই চাপরাশির শখ হোল বুক চিতিয়ে বড় বড় কথা বলার। ক্লার্কের মতই ও বৈদ্যজীর দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয় যে!

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারের আশার প্রতীক্ষায়। এরপর যা হবে তাকে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দেবার প্রচেষ্টায় বারান্দায় ক্লার্ক সাহেব আড়ি পেতেছেন।দেয়ালের পেছনে জানলার ঠিক নীচে ড্রিল মাস্টার মৌজুদ। উনি পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করার বদলে বিড়ি ধরাতে ব্যস্ত। না, এরপর আর খান্না-প্রিন্সিপাল সংবাদের জনতার দরবারে পৌঁছনর আগে উপে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা রইলনা।

রাত্তিরে রঙ্গনাথ আর বদ্রী ছাতের কামরায় খাটিয়ায় গড়াতে গড়াতে এতোল বেতোল কথা শুরু করেছে। রঙ্গনাথ কথা শেষ করতে করতে বলল,’ খান্না আর প্রিন্সিপালের মধ্যে কী কথা হয়েছিল সেটা জানা যায়নি। ড্রিল মাস্টার জানলার নীচেই ছিল। খান্না চেঁচাচ্ছিল,”এই আপনার মনুষ্যত্ব”? ব্যস, ওইটুকুই শুনতে পেয়েছে’।

বদ্রীর হাঁই উঠছিল। বলল,’ প্রিন্সিপাল গালি দিয়ে থাকবে। জবাবে খান্না মনুষ্যত্ব -টত্ব বলে থাকবে। ও এভাবেই কথা বলে। শালা একনম্বরের বাঙরু’!

রঙ্গনাথ বলল।‘গালির জবাব তো জুতা’।

বদ্রী এর কোন উত্তর না দেওয়ায় ও ফের বলল,’ দেখছি- এখানে মনুষ্যত্বের কথা বলাই বেকার’।

বদ্রী ঘুমুবে বলে পাশ ফিরলো। তারপর গুড নাইট বলার স্টাইলে বলল,’ সে তো বুঝলাম। এখানে যে দুটো ক-খ-গ-ঘ পড়ে ফেলে সেই উর্দূ ঝাড়তে শুরু করে।কথায় কথায় খালি মনুষ্যত্ব-মনুষ্যত্ব!গলায় জোর না থাকলে সবাই মনুষ্যত্বের দোহাই দেয়’।

কথাটা ঠিক। শিবপালগঞ্জে আজকাল ‘মনুষ্যত্ব’এরই বাজার। দুকুরবেলা আমবনের ছায়ায় ছোঁড়াগুলো জুয়ো খেলে। যার জেতার সে জেতে, যে হারে সে চেঁচায়-এই বুঝি তোর মনুষ্যত্ব! জিততেই পেচ্ছাব চাগিয়ে উঠেছে? খালি ফোঁটা ফোঁটা টপকানোর অজুহাত খুঁজছিস?

আবার জেতাপার্টিও কখনও কখনও ‘মনুষ্যত্ব’ নিয়ে হামলে পড়ে। ‘একেই বলে মনুষ্যত্ব? এক বাজি হারতেই পিলপিলিয়ে গেলি? চারদিন ধরে খেলছি, আজ প্রথমবার দাঁও লাগল তো আমার পেশাব বন্ধ করিয়ে দিবি”?

তাড়ির দোকানে মজদুরের দল ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় দোলাতে থাকে। ১৯৬২তে চীনের অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসঘাতকতায় যেমন ঝটকা লেগেছিল, প্রায় তেমনি হাবভাব করে বলতে থাকে,’বুধুয়া পাকা মকান বানিয়েছে রে! আজকাল কারখানাওলাদের দিন। বললাম, বাড়িতে অতিথি এসেছে, তাড়ি কেনার জন্যে দুটো টাকা দে। ব্যাটা সোজাসুজি হ্যাঁ-না করে পেছন ফিরে পাছা দেখিয়ে চলে গেল। এই কি মনুষ্যত্ব? নাগেশ্বর, তুমিই বল’।

অর্থাৎ রাজনীতিতে যেমন ‘নীতিবোধ’কে ধরা হয় তেমনই, ‘মনুষ্যত্ব’ শব্দটা শিবপালগঞ্জে চৌকস ও চালাক লোকদের লক্ষণ। তবে বদ্রী পালোয়ানের চোখে এটা গলার জোরের অভাব ছাড়া কিছু নয়। এইসব বকবক করতে করতে নৈতিকতা ব্যাপারটা রঙ্গনাথের ঘাড়ে চাপিয়ে বদ্রী ঘুমিয়ে পড়ল।

রঙ্গনাথ কম্বল জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবছিল।ছাদের দরজাটা খোলা, বাইরে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। খানিকক্ষণ ও সোফিয়া লোরেন এবং এলিজাবেথ টেলরের ধ্যান করল। তারপর মনে হোল এসব ক্যারেক্টার খারাপ হওয়ার লক্ষণ।তাই ও পাড়ার ধোপার মেয়ের ধ্যান শুরু করল। সেদিন ধোয়া কাপড়ের গাঁঠরি থেকে ওর কাপড় খোঁজার সময় ওর চোখ মেয়েটির হাতকাটা ব্লাউজে আটকে গেছল। খানিক পরে মনে হোল এটা আরও নোংরা, ফিরে এল ফিল্মের দুনিয়ায়। কিন্তু এবার জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম জেগে ওঠায় ও লিজ টেলরদের চিন্তা ছেড়ে ওয়াহিদা রেহমান ও সায়রা বানুর চিন্তায় ডুবে গেল। দু’চার মিনিট পর বুঝতে পারল যে সব ব্যাপারে বিদেশ থেকে প্রেরণা নেওয়া ঠিক নয়। আর ঠিকমত ধ্যান করলে দেশপ্রেমেও বড় মজা। হঠাৎ ওর ঘুম এসে গেল এবং অনেক চেষ্টার পরও সায়রা বানুর সমস্ত শরীরের চেয়ে ওর ধ্যানবিন্দু ক্রমশঃ ছোট আরও ছোট হয়ে গেল। কোত্থেকে এসে গেল কিছু বাঘ ও ভাল্লুক। ও একবার চেষ্টা করল কি সায়রা বানুর পুরো শরীর চেপে ধরে হিঁচড়ে নিয়ে আনবে, কিন্তু সায়রা বানু ওর হাত থেকে বার বার পিছলে গেল। এর মধ্যে বাঘ-ভালুকও কোথায় চলে গেল। তখন ওর মাথায় খান্না মাস্টারের চেহারাটা ভেসে উঠে ভেঙেচুরে গেল। খালি কানের মধ্যে একটা শব্দ টিপ টিপ করতে লাগল – মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব!

একবার মনে হোল— কেউ ফিসফিস করছে। তারপর মনে হোল এটা কেউ কোন মঞ্চের উপর থেকে গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করছে। এবার মনে হোল না, কোথাও দাঙ্গা লেগেছে, লোকজন ছোটাছুটি করছে আর বলছে- মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব!

ঘুমটা ভেঙে গেল। জেগে উঠতেই শুনতে পেল বাইরে খুব চেঁচামেচি হচ্ছে- চোর! চোর! চোর! পালিয়ে না যায়! পাকড়ো! পাকড়ো! চোর! চোর!

একটু পরে পরে আওয়াজ ফিরে ফিরে গানের ধুয়ো ধরছিল-চোর! চোর!

যেন গ্রামোফোনের পিন মুখড়ায় আটকে গেছে। ও দেখল, আওয়াজটা আসছে গাঁয়ের আরেক প্রান্ত থেকে।বদ্রী পালোয়ান খাটিয়া থেকে লাফিয়ে নেমেছে। ‘ছোটে বলছিল বটে, আজকাল একটা চোরের দল এ তল্লাটে ঘোরাফেরা করছে। মনে হচ্ছে আজ আমাদের গাঁয়ে ঢুকেছে’।

দুজনে তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বাইরে বেরোল। কাপড় পরার মানে এ নয় যে বদ্রী চুড়িদার পাজামা ও শেরওয়ানি পরেছে। ঢিলে লুঙিটা কষে বেঁধে খালি গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে, ব্যস্‌।রঙ্গনাথের এখনও ওর মত পরমহংস অবস্থা প্রাপ্ত হয়নি, তাই গায়ে একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে নিল।দরজা অব্দি যেতে যেতে ওদের চাল এবং হৃৎস্পন্দন দুইই বেড়ে গেল। এতক্ষণে চারদিকে শোনা যাচ্ছে -চোর! চোর! চোর!

হল্লাগুল্লা চীৎকার এমন পর্যায়ে উঠলো যে এটা ১৯২১ সালে ইংরেজ শুনলে নির্ঘাৎ ভারতে ছেড়ে পালিয়ে যেত।

দুজনে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে এলো।বৈঠকখানা পার হয়ে বাইরে বেরোনোর সময় বদ্রী পালোয়ান রঙ্গনাথকে বলল, ‘তুমি ভেতর থেকে দোর বন্ধ করে ঘরেই থাক, আমি বাইরেটা দেখে আসি গে’। এরমধ্যে রূপ্পনবাবু কাঁধে ধুতির কোঁচা জড়িয়ে হড়বড়িয়ে ঘর থেকে এসে বললেন, “আপনারা ঘরে থাকুন, আমি বাইরে দেখতে যাচ্ছি”।

ভাবটা যেন চক্রব্যুহ ভেদ করতে যাচ্ছে। রঙ্গনাথ শহীদ হওয়ার ভান করে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনারা যান, আমিই নাহয় ঘরে থাকবো’।

বাইরে ফুটফূটে জ্যোৎস্না, তিনটে লোক চোর! চোর! বলে ছুটতে ছুটতে গেল। ওদের পেছনে আরও দুটো ঠিক ওদের মত চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে গেল। তার পেছনে আরও একজন, সেই চিৎকার। এবার তিনজন, এদের সবার হাতে লাঠি। সবাই চিৎকার করছে, সবাই চোরকে তাড়া করছে। মিছিলের শেষভাগের একজনকে বদ্রী চিনতে পেরে দৌড়ে ওদের ধরে ফেলল।হেঁকে বলল,’ ক্যা রে? ছোটে? চোর কোথায়’? ছোটে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,’ আগে! আগে আগে পালাচ্ছে’! এরপর খানিকক্ষণ এখানে শান্তি। রূপ্পনবাবু ও রঙ্গনাথ বাইরের ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে ছাদে উঠে গেল। ইতিমধ্যে নীচের ঘরে বৈদ্যজীর ঘুম ভেঙেছে। গলা খাঁকরিয়ে আওয়াজ লাগালেন, ‘কে বটে’?

রূপ্পন জবাব দিল,’চোর, পিতাজী’।

বৈদ্যজী ঘাবড়ে গিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ‘কে রুপ্পন? ছাদে গেছ নাকি’?

রূপ্পন বাইরের শোরগোলের সঙ্গে সমানতালে চেঁচিয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমিই। জেনেশুনে জিজ্ঞেস কর কেন? যাও, শান্তিতে ঘুমোও গে’।

বৈদ্যজী নিজের ছোটছেলের এমন মধুমাখা সম্ভাষণ শুনে চুপ মেরে গেলেন। রূপ্পন ও রঙ্গনাথ কান লাগিয়ে গাঁয়ের নানাদিক থেকে ভেসে আসা কোলাহল মন দিয়ে শুনতে লাগল।

এমন সময় ঘরের পেছন থেকে কারও আর্তনাদ ভেসে এল, ‘মেরে ফেলল রে’!

আবার চেঁচামেচি! কারও গলা শোনা গেল, ‘আরে ছেড়ে দে ছোটে, এ তো আমাদের ভগৌতি’!

‘ছাড়, এটাকে ছাড় বলছি! ওদিকে ! ওদিকে! চোর ওদিকে পালিয়েছে’।

কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অন্য কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে।“আরে কেন রাঁড়ির মত কেঁদে ভাসাচ্ছিস? এক ঘা লাঠিই তো!এতে এত ফোঁৎ ফোঁৎ করার কি হোল’?

কাঁদতে কাঁদতে অন্যজনের উত্তর,‘আমিও ছাড়ব না; দেখে নেব’।

আবার খুব চেঁচামেচি, হল্লাগোল্লা; ‘ওদিকে! ওদিকে! পালাতে দিস নে’। ডাইনে থেকে দে এক ঘা লাঠি! আরে লাফিয়ে উঠে মার! চোর শালা কি তোর বাপ লাগে’?

রঙ্গনাথের উত্তেজনার মাঝখানে হাসিও পাচ্ছিল। এ আবার কি নিয়ম! লাঠি মারার সময় বাপকে রেয়াত করতে হবে? ধন্য আমার ভারত, ধন্য রে তোর পিতৃভক্তি!

রূপ্পনবাবু বলল, ভগৌতি আর ছোটের মধ্যে কিছু একটা ক’দিন ধরে চলছিল। মনে হচ্ছে এই হট্টগোলের মাঝখানে ছোটে কিছু একটা করেছে’।

রঙ্গনাথ,’এ তো ভারি অন্যায়’।

রূপ্পন,’এর মধ্যে ন্যায় অন্যায়ের কি আছে? দাঁও লাগা নিয়ে কথা। ছোটে ব্যাটা দেখতে একদম ভোঁদু, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মহা ঘাগ’। দুজনে আবার চারদিকে নজর করে দেখে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল। রঙ্গনাথ বলল,’মনে হচ্ছে চোর পালিয়ে গেছে’।

‘প্রত্যেকবার এই তো হয়’।

রঙ্গনাথ ভাবল রূপ্পনের গ্রাম-প্রেম নিয়ে একটু আমড়াগাছি করা যাক।

‘শিবপালগঞ্জে চোর এসে কেটে পড়বে এ তো অসম্ভব। বদ্রীদাদা যখন গেছেন একটা-দুটো ধরেই ফিরবেন’।

রূপ্পন পুরনো দিনের কোন প্রবীণ নেতার মত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,’না গো রঙ্গনাথ দাদা। এখন ওই পালোয়ানির দিন গেছে। সে ছিল ঠাকুর দূরবীন সিংয়ের দিন। বড় বড় চোর শিবপালগঞ্জের নাম শুনতেই থরথরিয়ে কেঁপে উঠত’।

রূপ্পনবাবুর চোখ বীরপূজার আবেগে জ্বলে উঠল।কিন্তু কথাটা আর এগোল না। হৈ-হট্টগোল মিলিয়ে গিয়ে এখন আকাশ কাঁপিয়ে শোনা যাচ্ছে-জয়, বজরঙবলী কী জয়!

রঙ্গনাথ উৎসুক, ‘মনে হচ্ছে কোন চোর-টোর ধরা পড়েছে’।

রূপ্পনবাবুর ঠান্ডা জবাব,’ ধ্যাৎ, আমি গঞ্জহাদের খুব চিনি। ওরা চোরদের গাঁয়ের সীমানার বাইরে ভাগিয়ে দিয়েছে, ব্যস্‌। আরে চোরের দল যে এদের গাঁয়ের বাইরে তাড়িয়ে নিয়ে যায়নি সেটাই কি কম! সেই আনন্দে এরা জয়-জয়কার করছে’।

চাঁদনি রাত, রাস্তায় মানুষজন দু’এক জনের ছোট ছোট দলে গুজুর গুজুর করতে করতে আসছে যাচ্ছে। রূপ্পনবাবু ছাদের পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে দেখছিলেন। একটা দল নীচের থেকে আওয়াজ দিল, ‘জেগে থাকুন রূপ্পনবাবু! রাতভোর সাবধান থাকবেন’। রূপ্পন ওদের দিকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে বলল,’ যাও যাও, বেশি নকশাবাজি করতে হবেনা’।

এটা তো ভাল কথা, সুপরামর্শ। তবু রূপ্পন কেন খিঁচিয়ে উঠল? রঙ্গনাথ এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি। একটু পরে ওই সুপরামর্শ গাঁয়ের এমাথা ওমাথা থেকে গুঞ্জরিত হল—জাগতে রহো! জাগতে রহো!

থেকে থেকে ওই ধ্বনি আর তার গুঞ্জন। এবার ওর সঙ্গে যুক্ত হোল হুইসিলের শব্দ। “ এই সীটি বাজছে কেন’?

রূপ্পনবাবু,’ কেন, পুলিশ আপনাদের শহরে সীটি বাজিয়ে টহলদারি করে না’?

‘আচ্ছা, পুলিশও এসে গেছে’?

“ আজ্ঞে; পুলিশই তো গ্রামবাসীদের সহযোগে ডাকাতদলের হামলার মোকাবিলা করল’।

রঙ্গনাথ হতভম্ব। “ডাকু’?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ; ডাকু। এই চাঁদনি রাতে কি চোর আসে কখনও? এরা সব ডাকাত’। এবার রূপ্পনবাবু ঠা-ঠা করে হেসে বলল,’দাদা, এসব হোল গঞ্জহাদের চক্কর, বুঝতে সময় লাগে। আমি শুধু কাল সকালে খবরের কাগজে যা বেরোবে সেটা জানিয়ে দিলাম’।

একটা সীটি ঠিক ঘরের পাশের রাস্তায় শোনা গেল। রূপ্পন বলল, ‘মাস্টার মোতিরামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে? পুরনো লোক। দারোগাজী ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করেন। উনি দারোগাজিকে শ্রদ্ধা করেন। প্রিন্সিপাল ওই দুজনকেই শ্রদ্ধা করেন। কোন শালা এক পয়সার কাজ করে না, খালি একজন আরেকজনের শ্রদ্ধা করে সময় কাটায়।

‘ওই মাস্টার মোতিরাম হলেন শহরের কাগজটির বিশেষ প্রতিনিধি।যদি চোরকে ডাকু নাই বানালেন তো মাস্টার মোতিরাম হয়ে কী লাভ’?

রঙ্গনাথ হাসতে লাগল। হুইসিল ও ‘জাগতে রহো’ ক্রমশঃ দূরে মিলিয়ে গেল। এঘর ওঘর দরজা খোলার জন্যে লোকজনের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। ‘দরজাটা খুলে দে মুন্না’ থেকে ‘ শ্বশুর ব্যাটা মরে গেল নাকি’ এবং ‘আরে তোর বাপ বলছি, তখন থেকে চেঁচিয়ে মরছি’ গোছের সব শুরু হয়েছে। বৈদ্যজীর বাড়িতেও কেউ সদর দরজার শেকল ঝনঝনাচ্ছে। বাইরে বারান্দায় শোয়া একজন মুনিষ জোরে কেশে উঠল। রঙ্গনাথ বলল, ‘ বোধহয় বদ্রীদাদা, চলো তালা খুলে দিই’।

ওরা নীচে নেমে এল। তালা খুলতে খুলতে রূপ্পন বলল, ‘কে বটে’?

বদ্রীর হুংকার শোনা গেল, ‘খুলবি কিনা? কি কে-কে শুরু করেছিস’?

রূপ্পন তালা খুলতে খুলতে থেমে গেল। বলল,’ নাম বল’।

ওদিক থেকে বাজের আওয়াজ, ‘রূপ্পন, চুপচাপ ভালোয় ভালোয় খুলে দে বলছি’।

“ কে, বদ্রীদাদা’?

“ হ্যাঁ, হ্যাঁ, বদ্রী দাদা। খোল শিগগির”।

রূপ্পন হালকা হাতে তালা খুলতে খুলতে বলল,’ বদ্রীদাদা, বাপের নামটাও বলে ফেল’।

বদ্রীদাদা গালি দিতে দিতে বৈদ্যজীর নামটা বলল। রূপ্পন ফের বলল,’এবার নিজের ঠাকুর্দার নামটাও বলে দাও’।

বদ্রী ফের গালির সঙ্গে ঠাকুর্দার নাম বলল। আবার প্রশ্ন হল, ’বেশ, প্রপিতামহের নাম’?

বদ্রী দরজায় এক ঘুঁসি মেরে বলল, ‘তোকে আর খুলতে হবে না। আমি চললাম’।

-‘দাদা, দিনকাল খারাপ। বাইরে চোরবাটপাড় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই জিগ্যেস করছি। সাবধানের মার নেই। ঠিক আছে, প্রপিতামহের নাম ভুলে গেছ তো বোল না। কিন্তু রেগে যাবার কী হোল? বেশি রাগলে লোকসান’।

এইভাবে রূপ্পনবাবু বদ্রীদাদার পরীক্ষে নিয়ে এবং ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ গোছের লেকচার দিয়ে তবে দরজাটা খুললেন। বদ্রী পালোয়ান বিছে বা চ্যালার মত হিলহিলিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। রূপ্পন ভালোমানুষের মত জানতে চাইল- কী হোল দাদা? সব ব্যাটা চোর পালিয়ে গেল?

বদ্রী কোন জবাব না দিয়ে দপদপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের ঘরে চলে গেল।রূপ্পনবাবু নীচের ঘরে। রঙ্গনাথ আর বদ্রী খাটিয়ায় শুয়ে খালি দু’চোখের পাতা এক করেছে কি নীচে থেকে কেউ ডাকল -ওস্তাদ, নীচে নেমে এস; মামলা বড্ড গিচপিচ হয়ে গেছে।

বদ্রী উপরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ল,- হোল কী ছোটে?ঘুমুতে দিবি নাকি সারারাত এখানেই হাল জুততে থাকবি?

ছোটে তেমনই চেঁচাল- ওস্তাদ, ঘুম-টুম গোলি মারো। এখন রিপোর্ট লেখানোর হাল হয়েছে। এদিকে সব শালা গলি গলিতে চোর-চোর চেঁচিয়ে বেরিয়েছে, ওদিকে এই সুযোগে কেউ হাত সাফ করেছে। গয়াদীনের ঘরে চুরি হয়ে গেছে। নীচে নেমে এস।