প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস
Posted in প্রবন্ধঅনেক ধৈর্য, অধ্যাবসায় আর নিজের যোগ্যতা ও সুযোগ লাভের ফলে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন গুলজার। অনেক ঘাতপ্রতিঘাতকে মোকাবিলা করে তাকে গুলজার নামে বিখ্যাত হতে হয়েছে।
গুলজার হিন্দি ও উর্দু ভাষার ভারতীয় কবি, গীতিকার, সুরকার, ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে আজ বিশেষভাবে খ্যাতিমান। তিনি মূলত হিন্দী ভাষায় গল্প, কবিতা ও শায়েরী রচনা করেন। তবে উর্দু ভাষায় কবিতা ও শায়েরী রচনাতেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে।
এজন্য তাকে এই যুগের শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি সঙ্গীত পরিচালক এস.ডি. বর্মন ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র বন্দিনীতে গীতিকার হিসেবে এবং আর.ডি. বর্মন, সলিল চৌধুরী, বিশাল ভরদ্বাজ এবং এ.আর. রহমান সহ অনেক সঙ্গীত পরিচালকের সাথে কাজ করেছিলেন। গুলজার কবিতা, সংলাপ এবং স্ক্রিপ্টও লেখেন। তিনি ১৯৭০-এর দশকে আন্ধি এবং মৌসম এবং ১৯৮০-এর দশকে টিভি সিরিজ মির্জা গালিবের মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৩ সালে কির্দার পরিচালনা করেন।
গুলজারের বহুমাত্রিক প্রতিভার কথা বিষদ ভাবে আলোচনার আগে তার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে বলা প্রয়োজন।
সম্পূরণ সিং কালরা গুলজারের আসল নাম। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের (বর্তমান পাকিস্তান)ঝিলম জেলার দিনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাখন সিং। তার মায়ের নাম সুজান কৌর, তার মা ছিলেন তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। তিনি ছিলেন মায়ের একমাত্র পুত্র ।
মায়ের মৃত্যুর পর তিনি বেশিরভাগ সময় বাবার সাথে থাকতেন। মায়ের মৃত্যুতে তার শৈশব জীবন সুখের ছিল না। বৈমাত্রেয় ভাইবোনদের সাথে তাকে বসবাস করতে হয়েছিল নিঃসঙ্গতার মাঝে। বাবার টুপি ও ব্যাগের দোকানে রাতে থাকতে হত। সে পাড়ার লাইব্রেরির বইগুলো তাকে কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। সে-সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সংকলন দ্য গার্ডেনারের উর্দু সংস্করণ পড়ে পালটে যায় তাঁর জীবনবোধ। স্কুলে থাকতেই সাহিত্য এবং কবিতার প্রতি গুলজারের অনুরাগ জেগে ওঠে। গুলজার এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘খামোশ সওয়াল’ এই দুটো শব্দ যে পাশাপাশি যেতে পারে কোনও দিন ভেবে দেখেননি । ‘নিঃশব্দ প্রশ্ন’। আর সেটিই তাঁর গান লেখার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও এক গল্প। কেন বাংলা শিখেছিলেন গুলজার? সেই কাহিনি।
গুলজার সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যখন তার বয়স অনেক কম- এইট নাইনে পড়েন সেই সময়ে রাতে সময় কাটানোর জন্য পাড়ার এক লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে আনতেন রোজ রাতে ৪ আনার বিনিময়ে একটি করে বই নিয়ে আসতেন গুলজার। প্রথমদিকে তিনি গোয়েন্দা কাহিনী ও রোমাঞ্চকর কাহিনীর বই পড়তেন। একদিন লাইব্রেরিতে কোনও বই পছন্দ হচ্ছিল না। তখন লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি বললেন, 'একটি বই দিচ্ছি, পড়ে দেখতে। তারপর তিনি খুব উপর দিকের এক তাক থেকে একটা বই বার করে সেটি দিলেন গুলজারের হাতে। সেই বইটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ।
বাড়ি ফিরে সেই বইয়ে ডুবে গেলেন গুলজার। এতই ভালো লেগে গেল। সেই বইটি থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর আকর্ষণ! গুলজারের জীবন বদলে দেওয়া সেই বইটিই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ। ওই লাইব্রেরী থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মুন্সী প্রেমচাঁদ প্রমুখের অনেক বই পড়েছিলেন।
তারপরেই তিনি ঠিক করে নেন জীবন সমপর্ণ করবেন রবিঠাকুরকে। কয়েক বছর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গুলজার জানিয়েছেন, এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন ইংরেজি অনুবাদ থেকে। কিন্তু তাঁর মন বলত, রবিঠাকুরের মূল বাংলা শব্দগুলির মধ্যে যে গভীর সৌন্দর্য আছে, তা ইংরেজি অনুবাদে টের পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি বাংলা শিখতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মন দখল করে নেন এর পরে। রাত-দিন শুধু বাংলা শিখতে শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য একটাই রবিঠাকুরের লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করা।
সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরাগ বর্তমান সময়ে ভারতের অন্যতম সেরা কবির। রবীন্দ্রনাথ চর্চায় এক সময়ে বহু সময় কাটিয়েছেন তিনি। এখনও রবীন্দ্রনাথ তাঁর পথচলার সঙ্গী, সেটাও জানান গুলজার সাহেব।
সে সময়টায় ভারত বিভাগের ফলে দাঙ্গা হাঙ্গামায় তাদের পরিবারটাও খারাপ অবস্থায় পড়ে।
দেশভাগের পর চলে আসেন দিল্লীর রওশন আরা বাগে। সেখানেই ইউনাইটেড খৃস্টান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন। ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বিদায় জানান তিনি। সঙ্গীহীন মাতৃহারা বিষণ্ণ এক কিশোর বইয়েয় মধ্যেই খুঁজে পান বন্ধুত্বের দুনিয়া। সাহিত্যের প্রতি তীব্র পিপাসা তাকে আরও গভীর পড়াশোনায় ডুবিয়ে দেয়। সাহিত্যের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি।ভারতীয় সুর,শব্দ ও চিত্রের জগতকে তিনি এক সুতোয় বেঁধেছেন। একাধারে সুকবি, গায়ক অন্যদিকে চিত্র পরিচালক। হিন্দি ও উর্দু ভাষায় লেখা ছোটগল্পে তিনি তৈরি করেছেন এক অনির্ণীত জগত।
দিল্লিতে পড়াশোনার পর তিনি মুম্বাইতে চলে যান রোজগারের জন্য। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। পোড়খাওয়া জীবন থেকে তিনি দিনে দিনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল শিখরে আরোহন করেন।
গাড়ির পেইন্টার হিসেবে কাজ করেন গুলজার।কাজ ছিল দুর্ঘটনায় কবলিত গাড়িগুলোকে নতুন করে পেইন্টিং করা।
তার মতে, এই কাজের পাশাপাশি তিনি অনেক সময় পেতেন। আর সেই সময়টা তিনি পড়া ও লেখার কাজে লাগাতেন।
দারিদ্র্যের জোয়ারে ভাসতে থাকা গুলজার তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন লেখক হওয়ার। সেজন্য গুলজার দীনভী এবং পরবর্তীতে গুলজার নাম ধারণ করেন তিনি।
এক সময় তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন , প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং পাঞ্জাবি সাহিত্য সভার সঙ্গে যুক্ত হন। এসব অ্যাসোসিয়েশনে সরদার জাফরী, কৃষণ চন্দর, কাঈফী আজমী, সাহির লুধিয়ানভি, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, গুরওয়েল সিং পান্নু, সুখবীর, রাজিন্দর সিং বেদি এবং বলরাজ সাহানির মতো কবি, লেখক, অভিনেতা ও শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব হয় তাঁর। আর এ থেকেই তার জীবনের মোড় পালটে যায়।
ষাটের দশকের প্রথম দিকের কোনো এক রোববার প্রোগ্রেসিভ রাইটারস অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে গীতিকার শৈলেন্দ্র ও নির্মাতা বিমল রায় তাকে বলেন, চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য। তাদের উৎসাহে গুলজার রাজি হন। বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’ সিনেমায় গান লিখলেন গুলজার। সে গানে সঙ্গীত পরিচালনা করলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মন । বিমল রয় ছাড়াও আরো অনেক গুণী মানুষদের সংস্পর্শে এসে তিনি কাজ করেছেন। সুরকার শচীন দেব বর্মণ, নির্দেশক হৃষিকেশ মুখার্জী তার মাঝে অন্যতম।
বিমল রয়ের সাথে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার ঘটনাটি ছিল দারুণ। দেবু সেন নামে একজন কবি গুলজারকে একটি চলচ্চিত্রে কাজের জন্য বিমল রয়ের অফিসে নিয়ে যায়। অফিসের রুমে যাওয়ার পর গুলজারের সম্পর্কে সব জেনে বাংলায় দেবু সেনকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, বৈষ্ণব কবিতা কী, এর মর্ম কী, এসবের কিছু কি এই লোক বুঝবে? দেবু তখন বিমল রয়কে বলে, দাদা, উনি বাংলা বুঝেন, বাংলার অনেক গল্প-উপন্যাস তিনি পড়ে এসেছেন। এ কথা শুনে বিমল রায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যান। এক সাক্ষাৎকারে গুলজার বলেন, এখনো বিমল রয়ের মুখের সেই অপ্রস্তুত ভাব তিনি ভুলতে পারেন না। এরপর থেকেই গুলজার তার সাথে কাজ করা শুরু করেন। বিমল রয়ের কাছে গুলজার অত্যন্ত ঋণী, কারণ তিনিই প্রথম গুলজারের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাকে কাজ করতে ভরসা দিয়েছিলেন। এগুলো তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
চলচ্চিত্রে এসেও গুলজার ঝুঁকে যাননি কথিত কমার্শিয়াল ভুবনে। তিনি বেছে বেছে সাহিত্য নির্ভর এবং মানসম্মত কাজেই নিজেকে যুক্ত করলেন। গান লেখার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও লেখা শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে ‘আশীর্বাদ’ সিনেমায় তিনি প্রথম সংলাপ লিখেছিলেন। এরপর থেকে গুলজার যেসব চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন, সেগুলোতে অভিনয় করে বহু অভিনেতা পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত গুলজারের গান সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। তার রচিত প্রথম জনপ্রিয় গান ‘হামনে দেখি হ্যায় উন আখো কি মেহেকতি খুশবু’। ১৯৭১ সালের ‘গুড্ডি’ সিনেমায় গুলজার দুটি গান লেখেন। তার মধ্যে ‘হামকো মান কি শক্তি দেনা’ শিরোনামের প্রার্থনা সঙ্গীতটি এতোটাই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে যে, এটি এখনো ভারতের বিভিন্ন স্কুলে বাচ্চাদের গাওয়ানো হয়।
গীতিকার হিসেবে গুলজার কাজ করেছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে। আগেও সেকথা কিছুটা বলা হয়েছে। আর ডি বর্মন, এস ডি বর্মন, শংকর জয়কিশান, হেমন্ত কুমার, লক্ষ্মীলাল-পেয়ারেলাল, মদন মোহন, রাজেশ রোশান ও অনু মালিকের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সাথে তিনি কাজ করেছেন।
লেখক-পরিচিতি এলো পরে। । কবি গুলজারের প্রথম প্রকাশিত বইটি ছোটগল্পের বই, যেটির নাম চৌরাস রাত (১৯৬২)। ১৯৬৩-তে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বই জানম। একই সঙ্গে উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তিনি রচনা করে চলেন কবিতা ও ছোটগল্প। রাত প্যশমীনে কী কবিতার বইটি তেমনি একটি বই, যেটি একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে দুই ভাষাতেই।
এবার গুলজারের লেখা কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ছাইয়া ছাইয়া’। বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের সুরে এই গান ছিল শাহরুখ-মনিশা কৈরালা অভিনীত সিনেমা ‘দিল সে’-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। এ আর রহমানের সুরে ২০০৭ সালে গুলজার গান লিখলেন ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ সিনেমায়। ‘জয় হো’ শিরোনামের সেই গানের জন্য উপমহাদেশের একমাত্র গীতিকার হিসেবে অস্কার জয় করেন গুলজার। একই গানের জন্য তিনি অর্জন করেন বিশ্ব সঙ্গীতের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার গ্র্যামি-ও।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গুলজার অসংখ্য সিনেমায় গান লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’, ‘রাজি’, ‘রাঙ্গুন’, ‘ওকে জানু’, ‘মিরজা’, ‘তালভার’, ‘দৃশ্যাম’, ‘হায়দার’, ‘যাব তাক হ্যায় জান’, ‘ সাত খুন মাফ’, ‘স্ট্রাইকার’, ‘ইশকিয়া’, ‘ভীর’, ‘রাজনীতি’, ‘বিল্লু’, ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’, ‘ঝুম বারাবার ঝুম’, ‘জান-এ-মান’, ‘ওমকারা’, ‘রেইনকোট’, ‘বান্টি অউর বাবলি’, ‘মাকবুল’, ‘দিল সে’, ‘মাসুম’, ‘সদমা’, ‘খাট্টা মিঠা’, ‘মৌসাম’, ‘নামাক হারাম’ ইত্যাদি।
গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজের পাশাপাশি গুলজার আসেন চলচ্চিত্র নির্মাণেও। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমবারের মতো নির্মাণ করলেন ‘মেরে আপনে’ সিনেমাটি। এরপর তিনি ‘পরিচয়’, ‘কোশিশ’, ‘আচনক’, ‘আন্ধি’, ‘খুশবু’, ‘লিবাস’, ‘মাচিস’, ‘হু তু তু’ ইত্যাদি সিনামগুলো নির্মাণ করেন তিনি। গুলজার তার সিনেমাগুলোতে মানুষের সম্পর্ককে সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরতেন।
কবি গুলজারের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো তিনি সাহিত্য বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। ভিন্ন ধারার সিনেমাগুলো তৈরি হতো ভালো কোনো সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস থেকে। গুলজারের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি আগে থেকেই সেসব গল্প-উপন্যাস পড়ে রেখেছেন। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের সাথে পরিচয় থাকার কারণে চরিত্রগুলোর আবেগ, অনুভূতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা থাকতো। সে কারণে চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে মূল গল্পের চরিত্রের সাথে মিলিয়ে অভিনয় করতে কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সমস্যা হতো না।
কোশিশ চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং জয়া ভাদুড়ীর বাকশক্তিহীন দুই দম্পতির অভিনয় কিংবা আঁধি চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে কে মুগ্ধ হয়নি? সত্তর দশকে হিন্দি সিনেমার জগতে যখন শুধুই মারপিট আর এংরি ইয়াং ম্যানের যুগ চলছিল তখন ভিন্ন ধাঁচের গল্প, ভিন্ন ধাঁচের প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন আখ্যানভাগের এ দুটি সিনেমা দর্শকদের মনে আলাদা দাগ কেটেছিল
কোশিশ চলচ্চিত্রের একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এতে বোবা এবং বধিরদের কথা বলার যে সংকেতগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক। এ সম্পর্কে রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে তা অভিনয়ে আনা হয়। তখনকার সময়ে এরকম সিনেমা একদমই হতো না। কিন্তু গুলজার গতানুগতিক চলচ্চিত্র না বানিয়ে ভিন্ন ধাঁচের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতেন, যা দর্শকদের ভালো লাগতো। এগুলো সমালোচকদেরও পছন্দ হতো। বেশ কিছু চলচ্চিত্র অবশ্য অর্থনৈতিকভাবে সফলতার মুখ দেখেনি। তবে অর্থনৈতিকভাবে সফল না হলেও পরবর্তীতে সেগুলো ক্লাসিকের মর্যাদা অর্জন করেছে।
আন্ধি (অনুবাদ. 'ঝড়') হল একটি ১৯৭৫ সালের ভারতীয় রাজনৈতিক ড্রামা চলচ্চিত্র যেখানে সঞ্জীব কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত এবং গুলজার পরিচালিত। সেই সময়ে অভিযোগ করা হয়েছিল যে ছবিটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবন এবং তার বিচ্ছিন্ন স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে, শুধুমাত্র চেহারাটি রাজনীতিবিদ তারকেশ্বরী সিনহা এবং ইন্দিরা গান্ধী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। গল্পটি বেশ কয়েক বছর পর একটি বিচ্ছিন্ন দম্পতির সুযোগে সাক্ষাতের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যখন স্ত্রী আরতি দেবী, এখন একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ একটি নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার স্বামীর দ্বারা পরিচালিত হোটেলে থাকতেন। মুভিটি রাহুল দেব বর্মনের রচিত গানের জন্য বিখ্যাত, গুলজার লিখেছেন এবং কিশোর কুমার এবং লতা মঙ্গেশকর গেয়েছেন।
পড়াশোনা করা লোকজনদের খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন গুলজার। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেরে আপ্নে’তে কোনো পরিচিত মুখ নেননি। ভারতের National School of Drama থেকে অভিনয় শিখে আসা অভিনেতাদের নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। এ চলচ্চিত্রটি পরবর্তীতে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী চলচ্চিত্রের মর্যাদা অর্জন করে।
১৯৯৬ সালে বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র ‘মাচিস’ নির্মাণ করেন গুলজার। চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান চাপ্পা চাপ্পা চারখার
তার কবিতা এবং লেখনী নিয়ে কেউ কখনো নেতিবাচক মন্তব্য করেনি। যারা তার কবিতা ও গান পড়েছে কিংবা শুনেছে তারা একটি বিষয় স্বীকার করেছে- তার প্রতিটি লেখার কোনো না কোনো অংশের সাথে তাদের জীবনের কোনো একটি ঘটনার মিল রয়েছে। সাধারণ মানুষকে যেন পড়তে পারেন গুলজার। তিনি এমন এক কবি যাকে জনসাধারণের কবি বললে ভুল হবে না। চলচ্চিত্র জগতে তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি সাহিত্যকে জনসাধারণের জন্য নির্মাণ করতে পেরেছেন। আর তিনি এ কাজটি করেছেন তার সংলাপ, গান এবং চলচ্চিত্র দিয়ে।
একবার কবিতা লেখা নিয়ে তাকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল- কবি হতে গেলে এবং কবিতা লিখতে হলে কি কাউকে উদাস হতেই হবে? উদাসী না হলে কি কবিতা লেখা যাবে না? তখন কবি গুলজার চমৎকার একটি উত্তর দিয়েছিলেন- মানুষের জীবনে উদাসীনতা একটু বেশী সময় ধরে থাকে, আর সুখ কিংবা আনন্দ হয় অনেকটা ফুলঝুরি বা আতসবাজির মতো যেটা বেশী সময় থাকে না। নিমিষেই আলো দিয়ে ফুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু উদাসী অনেকটা আগরবাতির মতো। চারদিকে নিজের বাসনা বা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়।
একথা অনস্বীকার্য যে তিনি যা-ই লিখেন না কেন, সেটা গান হোক, সংলাপ হোক, গল্প কিংবা উপন্যাস-চিত্রনাট্য হোক, তার লেখা প্রতিটি শব্দই জীবন্ত হয়ে ওঠে।
গুলজার যেমন অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্ম উপহার দিয়েছেন, তেমনি তার অর্জনের পাল্লা হয়েছে ভারি। এক জীবনে যেন সব কিছুই অর্জন করে নিয়েছেন তিনি। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচবার, রেকর্ড সংখ্যক ২১ বার পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার; একবার অস্কার ও একবার গ্র্যামি আছে তার ঝুলিতে। এছাড়া ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মভূষণ, এবং ভারতের চলচ্চিত্রে সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন গুলজার।উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২৩ সালের জন্য ৫৮তম জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত হলেন কবি,গীতিকার, পরিচালক গুলজার।
ব্যক্তি জীবনে গুলজার বিয়ে করেছেন অভিনেত্রী রাখিকে। তাদের একমাত্র সন্তান মেঘনা গুলজার। তিনিও এই সময়ের একজন আলোচিত নির্মাতা। যিনি ‘ফিলহাল’, ‘তালভার’ ও ‘রাজি’-এর মতো সিনেমা নির্মাণ করেছেন। সর্বশেষ মেঘনা গুলজার ‘ছপাক’ সিনেমাটি নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছেন।
হিন্দি থেকে গুলজারের কয়েকটি কবিতা ও শায়েরী অনুবাদ করে দেখা যেতে পারে।
১)এসো তোমাকে কাঁধে তুলে নেই, তোমার ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুমু দাও
চাঁদের কপালে চুমু দিতে
আজ রাতে দেখনি?
কনুই বাঁকালে কিভাবে
চাঁদ এত কাছে এসে গেছে।
২) দেখ, আস্তে আস্তে চল
দেখ, একবার দেখ।
পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না কেন!
নির্জনে কাচের স্বপ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
স্বপ্ন ভেঙে যায় কেউ দেখে না জেগে,
জেগে উঠলে কিছু স্বপ্ন মরে যাবে।
৩)দেখ, ধীরে ধীরে আরও ধীরে ধীরে হাঁট
দেখ, চিন্তা কর আর সাবধানে পা ফেলো
পায়ের শব্দ জোরে হওয়া উচিত নয়
একাকীত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের স্বপ্নে
স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়া উচিত নয়, কেউ জেগে উঠবে না।
জেগে উঠলে যে কোনো স্বপ্ন মরে যাবে।
সুরেলা কথা বলো সুরেলা কথা বলো,
টক-মিষ্টি চোখের রসালো কথা।
রাতে চাঁদে মিছরি মেশান,
দিনের দুঃখগুলো নোনতা মনে হয়।
নোনতা চোখের মাতাল শব্দ,
ডুবন্ত ছায়াগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
সন্ধ্যার ঘ্রাণ যেন তোমার কাছে না পৌঁছায়,
অনুরণিত চোখের মাতাল শব্দ।
দেখো, ধীরে চল!
দেখো, ধীরে ধীরে চল, আরও ধীরে ধীরে,
দেখো, ভেবে চিন্তে সাবধানে পা ফেলো,
পায়ের শব্দ জোরে হওয়া উচিত নয়।
একাকীত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের স্বপ্ন,
কারো স্বপ্ন যেন ভেঙ্গে না যায়, কেউ জেগে না যায়,
জেগে উঠলে যে কোনো স্বপ্ন মরে যাবে।
অনেকবার দেখেছি মানুষের কাছে বিক্রি
বিক্রিতে প্রতিবারই প্রত্যাশা ভেঙ্গে যায়
জীবনের এই বাজারে ভাল, সবাই
গুনতে হলেই দেয় এবং নেয়।
কিন্তু প্রতিবারই কিছু স্মৃতি রেখে যায়
জীবনের এই বাজারে ভাল, সবাই
গুনতে হলেই দেয় ও নেয়।
কিন্তু প্রতিবারই কিছু স্মৃতি রেখে যায়
জীবনের এই বাজারে কয়েক বছর পর জানা যায়
আজও বাজার একইভাবে চলছে
আর আমরাও সবার মতো দৌড়াতে থাকলাম
জীবনের এই বাজারে..!!
( অনুবাদ: প্রাবন্ধিক)
গুলজারের লেখা কয়েকটা হিন্দি শায়েরীর অনুবাদ।
১.কেউ বুঝলে
একটা কথা বলি সাহেব..
একাকীত্ব একশো গুণ ভালো
নিকৃষ্ট মানুষের কাছ থেকে..
২.
গতকাল যা হয়েছে সবই তোমার
আজকের গল্প আমাদের
৩..
সেই ভালোবাসাও তোমার ছিল সেই ঘৃণাও তোমার।
কার কাছে আমরা আমাদের আনুগত্যের বিচার চাইব?
সে শহরও তোমার, সে আদালতও তোমার।
মেধা,মনন, চিন্তা চেতনা, ধৈর্য , অধ্যাবসায়ের বলে
গুলজার আজ আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
( অনুবাদঃ প্রাবন্ধিক)
গুলজারের বহুমাত্রিক প্রতিভার আলোকচ্ছটা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরকালের জন্য মনে করি।